১৫ এপ্রি, ২০২০

মহানবীর যাদুগ্রস্থ হওয়ার ইতিহাস



একবার রাসূল সা.-এর কিছু সমস্যা সৃষ্টি হলো। তিনি ভুলোমনা হয়ে পড়লেন। তিনি এমন কাজ করেননি অথচ তাঁর মনে হতে লাগলো তিনি তা করেছেন। আবার কোনো কাজ করার পর তা ভুলে যেতে লাগলেন। এভাবে কিছুদিন চললো। এমন অবস্থা হয় যে, তাঁর মনে হতো তিনি স্ত্রীদের কাছে এসেছেন, অথচ তিনি আদৌ তাঁদের কাছে আসেননি।

এইমন ভুলোমনা অবস্থা দূরীকরণের জন্যে রাসূলুল্লাহ সা. দিন রাত চেষ্টা করতেন। সবকিছু মনে রাখার জন্য আলাদা করে চেষ্টা করতেন। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। কিন্তু তারপরও তিনি ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। এরকম অবস্থায় তিনি কেন পতিত হলেন, এর থেকে উত্তরণের উপায় কী তা তিনি জানতেন না। ছয় মাস পর্যন্ত ঐ একই অবস্থা চলতে থাকে।

এর কারণ ছিলো যাদু। ইয়াহুদীরা আল্লাহর রাসূল সা.-কে যাদুগ্রস্থ করে ফেলে। ইয়াহুদী এক বালক মসজিদে নববীতে আল্লাহর রাসূল সা.-এর পাশে থাকতেন। তাঁর সেবা করতেন। ঐ ছেলেটিকে ফুসলিয়ে ইয়াহুদীরা রাসূল সা. কয়েকটি চুল এবং তাঁর চুল আঁচড়াবার চিরুনির কয়েকটি দাঁত হস্তগত করে। তারপর তারা ওগুলো দিয়ে যাদু করে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিলো লাবীদ ইবনে আ'সাম। কিছু কিছু বর্ণনায় নামটি এসেছে লুবাইদ ইবনে আ'সাম। এ ইয়াহুদীদের মিত্র সুরাইক গোত্রের। সে ছিল মুনাফিক। এরপর যাদুর পোটলা যারওয়ান নামক কূপে তারা স্থাপন করে। এরপর থেকেই রাসূল ঘোরে চলে যেতেন ও ভুলোমনো হয়ে যেতেন।

এদিকে অসুস্থ থাকা অবস্থায় একদিন রাসূল সা. রাতে ঘুমালেন। স্বপ্নে তাঁকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রোগ সম্পর্কে জানালেন। বুখারিতে উল্লেখ রয়েছে, ঘুম থেকে উঠে প্রিয় নবী তাঁর স্ত্রী-কে বললেন, হে আয়েশা! আমি আমার প্রতিপালককে জিজ্ঞেস করেছি এবং তিনি আমাকে জানিয়েছেন এই রোগ সম্পর্কে। স্বপ্নে আমার নিকট দু’জন লোক এলেন। তাদের একজন আমার মাথার নিকট এবং অন্যজন আমার পায়ের নিকট বসলেন।

আমার মাথার কাছের লোকটি অন্যজনকে জিজ্ঞেস করলেন,
- এ লোকটির এই অবস্থা কেন?
- একে যাদু করা হয়েছে।
- কে যাদু করেছে?
- লাবীদ ইবনু আ‘সাম।
- কীসের মধ্যে যাদু করা হয়েছে?
- চিরুনি ও চিরুনি করার সময় উঠে যাওয়া চুলের মধ্যে।
- সেগুলো কোথায়?
- খেজুর গাছের মাথার মধ্যে রেখে ‘যারওয়ান’ নামক কূপের ভিতর পাথরের নিচে রাখা আছে।

আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে আল্লাহ তায়ালা নানানভাবে ম্যাসেজ পাঠাতেন। স্বপ্ন এর মধ্যে অন্যতম। মুহাম্মদ সা. ঘুম থেকে উঠেই হযরত আয়িশাকে অবহিত করলেন ভুলে যাওয়ার আগেই। এরপর রাসূল সা. হযরত আলী রা., হযরত যুবায়ের রা. এবং হযরত আম্মার রা.-কে নিয়ে সে কূপের কাছে গেলেন। এরপর সেই কূপ থেকে যাদুর পোটলাগুলো বের করিয়ে আনেন।

ঐ যাদুকৃত জিনিসগুলোর মধ্যে একটি ধনুকের সুতো ছিল, তাতে ছিলো এগারোটি গেরো। প্রত্যেক গেরোতে একটি করে সূচ বিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপর আল্লাহ তা'আলা এ সময় সূরা ফালাক ও সূরা নাস নাজিল করেন। রাসূলুল্লাহ সা. এ সূরা দু’টির একেকটি আয়াত পাঠ করছিলেন আর ঐ গেরোগুলো একটি একটি করে আপনা আপনি খুলে যাচ্ছিল। সূরা দু'টি পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত গেরোই খুলে যায় এবং রাসূলুল্লাহ সা. সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে যান।

এই সময় জিবরাঈল আ. রাসূল সা.-এর জন্য দোয়া নিচের দোয়াটি পড়ে ফুঁক দেন।
“বিসমিল্লাহি আরক্বিক মিন কুল্লি শাইয়িন উযিক। ওয়া মিন শাররি কুল্লি নাফসিন আও আইনিন হাসিদিন; আল্লাহু ইয়াশফিক। বিসমিল্লাহি আরক্বিক।”

এদিকে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলেন,
- হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমরা কি ঐ নরাধমকে ধরে হত্যা করে ফেলবো?
- না, আল্লাহ তায়ালা আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি মানুষের মধ্যে অনিষ্ট ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাই না।

যাদু থেকে বাঁচতে করণীয়;
কেউ যদি যাদুগ্রস্থ হয়ে পড়েন তবে এর থেকে বাঁচার বা রক্ষা পাওয়ার মোক্ষম উপায় হলো যাদু নষ্ট করা। সেক্ষেত্রে যা করণীয়

১- যদি যাদুর পুটলির সন্ধান পাওয়া যায় তবে তা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যদি যাদুকরকে শনাক্ত করা যায় তাহলে তাকে বাধ্য করতে হবে যেন সে যে যাদু করেছে সেটা নষ্ট করে ফেলে। প্রসঙ্গত, যাদুকরের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। নবী সা. বলেন: “যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তরবারির আঘাতে তার গর্দান ফেলে দেয়া।” একবার হাফসা রা. জানতে পারলেন তাঁর এক দাসী যাদু করেছে। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন শাসক ছিলেন উমার রা.। তিনি ঐ বাঁদির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। তবে অবশ্যই এই শাস্তির বিধান কায়েম করবেন ইসলামী শাসক।

২- যাদুর পুটলি বা যাদুকর কাউকেই যদি না পাওয়া যায় তবে ঝাড়ফুঁক করতে হবে। এর বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। এর পদ্ধতি হচ্ছে- যাদুতে আক্রান্ত রোগীর উপর অথবা কোন একটি পাত্রে পানি নিয়ে আয়াতুল কুরসি, সূরা আরাফ, সূরা ইউনুস, সূরা ত্বহা এর যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো, সূরা কাফিরুন এবং এই দোয়া পড়তে হবে। “আল্লাহুম্মা, রাব্বান নাস! আযহিবিল বা’স। ওয়াশফি, আনতাশ শাফি। লা শিফাআ ইল্লা শিফাউক। শিফাআন লা উগাদিরু সাকামা।”

(অর্থ- হে আল্লাহ! হে মানুষের প্রতিপালক! আপনি কষ্ট দূর করে দিন ও আরোগ্য দান করুন। (যেহেতু) আপনিই রোগ আরোগ্যকারী। আপনার আরোগ্য দান হচ্ছে প্রকৃত আরোগ্য দান। আপনি এমনভাবে রোগ নিরাময় করে দিন যেন তা রোগকে নির্মূল করে দেয়।)

জিবরাঈল আ. নবী সা. যে দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক করেছেন সেটাও পড়া যেতে পারে। এর অর্থ আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। সকল কষ্টদায়ক বিষয় থেকে। প্রত্যেক আত্মা ও ঈর্ষাপরায়ণ চক্ষুর অনিষ্ট থেকে। আল্লাহ আপনাকে আরোগ্য করুন। আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ঝাড়ফুঁক করছি। এই দোয়াটি তিনবার পড়ে ফুঁ দিবেন।

সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার পড়ে ফুঁ দিবেন। এরপর যাদুতে আক্রান্ত ব্যক্তি সে পানি পান করবে। আর অবশিষ্ট পানি দিয়ে প্রয়োজনমত একবার বা একাধিক বার গোসল করবে। তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় রোগী আরোগ্য লাভ করবে। আলেমগণ এ আমলের কথা উল্লেখ করেছেন।

যাদুতে আক্রান্ত হওয়ার আগেই যে প্রতিরোধ্মূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন তা হলো,
১- সূরা ফাতিহা পড়া। সকাল-সন্ধ্যায় ও ঘুমানোর সময়
২- আয়াতুল কুরসি তথা সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত পড়া।
৩- দৈনিক সূরা আরাফের যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো (১০৬-১২২) পড়া।
৪- দৈনিক সূরা ইউনুসের যাদু বিষয়ক আয়াতগুলো (৭৯-৮২) পড়া।
৫- সূরা কাফিরুন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস ৩ বার করে প্রতি ফরজ নামাজের পর পড়া।
৬- জিবরাঈল আ. যা পড়ে ফুঁক দিয়েছেন সে দোয়া পড়া।
৭- প্রতিবার ঘরে ঢুকার সময় সালাম দেওয়া এবং পরিবারের সকল সদস্যকে এই আমলে অভ্যস্ত করা।

এই আমলগুলো হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এসব বিপদ থেকে এই আমলগুলোর উসিলায় প্রটেক্ট করবেন ইনশাআল্লাহ।

বি. দ্র.
১- রাসূল সা.-এর যাদুগ্রস্থ হয়ে যাওয়া মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মক্কার মুশরিকরা তাঁকে এই অপবাদই দিয়েছেন যে, তিনি যাদুগ্রস্থ। যাদুগ্রস্থ অবস্থায় তাঁর কাছে শয়তান আসে এবং শয়তানের শিখিয়ে দেওয়া বাক্যই সে আমাদের শোনায়। এই সমস্যা ও জটিলতার সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মাওলানা মওদূদী। এক্ষেত্রে সূরা ফালাকের তাফসীর তাফহীমুল কুরআন থেকে পড়ার অনুরোধ করছি।

২- আল্লামা সুয়ুতিসহ অনেক প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ জানিয়েছেন প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ সূরা ফালাক ও নাসকে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন না। এবং তিনি তাঁর নিজস্ব পান্ডুলিপিতে তা সংযোজন করেন নি। এই জটিলতারও সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মাওলানা মওদূদী। পড়ে নেয়ার অনুরোধ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন