২২ মে, ২০২০

জামায়াতে ইসলামী কেন বাইয়াতবদ্ধ জীবনের কথা বলে?



আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা. মক্কার লোকদের কাছে প্রথম যে আহ্বান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তা হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মদ তাঁর বার্তাবাহক। এই আল্লাহর সাথে মক্কার লোকেরা অপরিচিত ছিল। তারা তাঁর কাছে প্রার্থনা করতো। একইসাথে তারা আরো অনেককে প্রভু মানতো ও তাদের উপাসনা করতো। কিন্তু মুহাম্মদ সা. নির্দিষ্ট করে দেন আল্লাহ ছাড়া কাউকে প্রভু মানা যাবে না। এর বিস্তারিত অর্থ হলো আল্লাহর কথা ও নিয়ম বা বিধান ছাড়া অন্য কোনো বিধান চলবে না। আল্লাহ যা মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে জানাবেন সেভাবেই মানবজাতিকে চলতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে ও সমাজে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা চেষ্টা করবে তারাই সফল অন্যরা ব্যর্থ।   

যাই হোক ইসলামের আহবান জানানোর সাথে সাথে এতদিনের সবার প্রিয়ভাজন আল-আমীন মুহাম্মদ (সা.) পরিণত হলেন মক্কার এক বিপজ্জনক ব্যক্তিত্বে। মক্কার স্বার্থবাদী নেতারা তাদের ক্ষমতার জন্য রাসূল (সা.) এর নবুওয়াতী মিশনকে হুমকি হিসেবে গণ্য করেছিলো। তাদের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল (সা.) উপর অবতীর্ণ বাণীর প্রচারকে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সকল প্রকার চেষ্টা চালায়। মক্কায় রাসূল (সা.) এর সাহচর্যে যাওয়াও বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এই সময় শুধু সে সকল সাহসী সত্যপ্রিয় মানুষই রাসূল (সা.) এর পাশে দাঁড়িয়ে সকল প্রকার প্রতিকূলতা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, যারা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন।

মক্কার নেতৃত্বের প্রচন্ড বাধায় রাসূল (সা.) মক্কায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। মক্কায় দীর্ঘ তেরো বছর পর্যন্ত তিনি দ্বীনের প্রচারই করে গেছেন। তার এই প্রচারের মধ্য দিয়ে একজন দুইজন করে ধীরে ধীরে ইসলামের অমীয় বাণীর আলোয় নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলছিলো। এভাবে কিছু লোককে মহানবী নিজের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত করেছেন ইসলামের ব্যাপারে। তাদের সবসময় উপদেশ দিতেন। তাই তাদের জন্য আনুষ্ঠানিক বাইয়াতের দরকার হয়নি। অবশ্য প্রত্যেকেই মুসলিম হওয়ার সময় বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন।

মক্কার ক্ষমতালিপ্সু নেতৃত্ব যতই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, সকল বাধাকে পরিহার করে ইসলাম মক্কার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এই নতুন আন্দোলন সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠে এ সম্পর্কে খোঁজখবর করা শুরু করে। এদের মধ্যে অনেক সত্যপ্রিয় বিবেকবান মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।

নবুওয়াতের একাদশ বছর অর্থাৎ ৬২০ সালে হজ্জ্বের মওসুমে রাসূল (সা.) এর কাছে এরকম ছয়জন লোক তৎকালীন ইয়াসরিব (মদিনা) থেকে সাক্ষাত করতে আসে। ইয়াসরিবে তখন বনু খাজরাজ ও বনু আউস এই দুই আরব গোত্রের বসবাস ছিল। এই দুইটি গোত্রের মধ্যে প্রায়ই লড়াই লেগে থাকতো। বছরের পর বছর অব্যাহত লড়াইয়ে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। নিজেদের মধ্যকার এই লড়াই সমাপ্ত করার জন্য তারা একজন মধ্যস্থতাকারীর সন্ধানে ছিল। পাশাপাশি বনু কুরাইজা, বনু কায়নুকা ও বনু নাযীর, এই তিনটি ইহুদি গোত্রও ইয়াসরিবে বসবাস করতো।

আসমানী কিতাবধারী এই ইহুদি গোত্রসমূহের কাছ থেকে বনু আউস ও বনু খাজরাজের লোকেরা সবসময়ই শেষ একজন নবীর আগমনের কথা শুনতো। মক্কায় রাসূল (সা.) এর নবুওয়াতের কথা শুনে খাজরাজ গোত্রের ছয়জন ব্যক্তি কৌতূহলবশত রাসূল (সা.) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। রাসূল (সা.) তাদেরকে ইসলামের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করলে তারা  চিন্তা করলেন, ইনিই হয়তো সেই নবী যার আগমনের কথা ইহুদিরা বলে থাকে। আল্লাহর রাসূল তাদের ইসলাম সম্পর্কে জানালেন এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করলেন। ঐ ছয়জন মদিনার ঘরে ঘরে দাওয়াত পৌঁছে দিলেন।

পরবর্তী বছর নবুওয়াতের দ্বাদশ বছরে হজ্জ্বের সময় ইয়াসরিব থেকে মোট বারো জন লোক রাসূল (সা.) এর সাথে সাক্ষাত করেন। তারা মক্কা থেকে কিছু দূরে মীনার কাছাকাছি আকাবার নিকটে সাক্ষাত করেন এবং রাসূল সা.-কে নিজেদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করেন। এবার আল্লাহর রাসূল সা.তাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বাইয়াত গ্রহণ করলেন। এটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক বাইয়াত। ইসলাম গ্রহনের পাশাপাশি তারা রাসূল (সা.) এর কাছে ছয়টি বিষয়ের উপর শপথ গ্রহণ করেন। তা নিম্নরূপ,
(১) আমরা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করবো।
(২) আমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হবো না।
(৩) আমরা চুরি-ডাকাতি বা কোনোরূপ পরসম্পত্তি আত্মসাৎ করবো না।
(৪) আমরা সন্তান হত্যা বা বলিদান করবো না।
(৫) কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ বা দোষারোপ করবো না।
(৬) প্রত্যেক সৎকাজে আল্লাহর রাসূল সা.-কে মেনে চলবো এবং কোনো ন্যায় কাজে তার অবাধ্য হবো না।

এই শপথটিই আকাবার প্রথম শপথ নামে পরিচিত। হজ্জ্ব শেষ হওয়ার পর এই দলটি ইয়াসরিবে ফিরে যায়। রাসূল (সা.) তাদের সাথে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য  একজন শিক্ষক প্রেরণ করেন। হযরত মুসয়াব ইবনে উমায়ের (রা.) মদীনায় মুসলমানদের সহায়তায় তার দাওয়াতী অভিযানে সফলতা অর্জন করেন। এমনকি উভয় গোত্রের গোত্রপতিরাও ইসলাম গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে আরবের বুকে ইসলামের জন্য একটি ভূখন্ড প্রস্তুত হতে থাকে।

এর পরবর্তী বছর নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে অর্থাৎ ৬২২ সালে হজ্জ্বের সময়ে ইয়াসরিবের উভয় গোত্রের ৭৩ জন মুসলমান রাসূল (সা.) এর কাছে আকাবায় সাক্ষাত করেন। তাদের মধ্যকার চলমান যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তারা রাসূল (সা.) কে গ্রহণ করেন এবং রাসূল (সা.) কে তাদের সাথে ইয়াসরিবে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এসময় রাসূল (সা.) তাদের প্রস্তাব কবুল করেন। এরপর তাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মদিনায় আল্লাহর রাসূল সা. কে নিরাপত্তা দেওয়ার বাইয়াত নেন। এটি আকাবার ২য় শপথ নামে পরিচিত। 

এর মাধ্যমেই মক্কা থেকে দীর্ঘ তেরো বছরের ইসলামের প্রচারকেন্দ্র ইয়াসরিবে স্থানান্তরিত হয়। আকাবার দ্বিতীয় শপথের অল্প কিছুদিন পরেই রাসূল (সা.) ইয়াসরিবে হিজরত করেন। তখন থেকেই ইয়াসরিব পরিচিত হয় মদিনাতুন নবী (নবীর শহর) বা সংক্ষেপে মদিনা নামে। মদিনাতেই রাসূল (সা.) আল্লাহর দ্বীনকে পূর্নাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ পান। মদিনাতেই প্রথম ইসলামের আলোকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে গঠনের প্রয়াস পাওয়া যায়।

অতএব বলা যায়, আকাবার শপথসমূহ মূলত মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রগঠনের প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। আকাবার শপথের মধ্যে দিয়ে মদীনায় প্রথমবারের মত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর উপর প্রেরিত আল্লাহর বাণীর বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়। সুতরাং, আকাবার শপথ ইসলামের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। আকাবার শপথের মধ্য দিয়ে ইসলাম তার চলমান যাত্রায় এক বৃহত্তর মাইলফলক অতিক্রম করে।

এখান থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই?
যখন সমাজে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত থাকবে না তখন আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়তে হবে, জিহাদ করতে হবে, লড়াই করতে হবে। আর এজন্য বাইয়াতবদ্ধ জীবন গ্রহণ করতে হবে। যদি প্রকাশ্যে বাইয়াত গ্রহণ করা সম্ভব না হয় তবে প্রয়োজনে গোপনে বাইয়াত নিতে হবে।

এরপর যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে তখন বৈধ শাসকের কাছে আনুগত্যের বাইয়াত নেওয়া ফরজ। শাসক ব্যাতীত অন্য কারো বাইয়াত নেওয়া অথবা বাইয়াত ছাড়া থাকা অথবা ফিতনা তৈরি করা নাজায়েজ। আল্লাহর রাসূল সা.-এর ইন্তেকালের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে হযরত আবু বকর রা. আমীর নির্বাচিত হন। পুরো প্রক্রিয়াতে কিছুটা অসন্তুষ্ট থাকেন কিছু সাহাবী। এর মধ্যে ছিলেন হযরত আলীও রা.। কিন্তু অল্প সময় পরই সবাই আবু বকর রা.-এর কাছে আনুগত্যের বাইয়াত গ্রহণ করেন।

আমীর যদি ভুল করেন বা ইসলামবিরুদ্ধ কিছু করেন তবে তার প্রতিবাদ করতে হবে। তাকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু বিদ্রোহ করা যাবে না।

কিন্তু আমীরই যদি অবৈধ হন মানে পরামর্শ ছাড়া জোর করে নিজেই নেতৃত্বের আসন দখল করেন তবে তার তাকে মানা জরুরি নয়। বরং জরুরি হলো তাকে অপসারণ ও ইসলামকে প্রতিষ্ঠা। এর জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করতে হবে। উদাহরণ হলো অবৈধ শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হযরত হুসাইন রা.-এর প্রতিবাদ, যুদ্ধ ও শাহদাত। একইভাবে প্রখ্যাত সাহাবী ও হযরত আবু বকর রা. এর নাতি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরের জিহাদ ও শাহদাত।

এবার আসি বাংলাদেশের প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে মুসলিম শাসক শাসন করেন কিন্তু তারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান না। এটা যে শুধু শাসকদের চাওয়া এমন নয়, এদেশের জনগণও বেশিরভাগ ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠিত হোক চান না। এক্ষেত্রে আমরা যারা আল্লাহর রাসূলের উম্মত এবং ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই তাদের কী করণীয়?

আমরা দাওয়াত দিয়ে এদেশের মানুষকে কনভিন্স করবো ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে। এবং কাজ সম্পন্ন করার জন্য একটি দলে জামায়াতবদ্ধ হবো এবং বাইয়াত গ্রহণ করবো যেভাবে মদিনার লোকেরা বাইয়াত নিয়েছে। এরপর আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আল্লাহ চাইলে তিনি আমাদের সফলতা দান করবেন। এখানে প্রতিষ্ঠিত শাসকের (যারা ইসলামকে ধারণ করেন না) কাছে বাইয়াত নিয়ে বাইয়াতের হক আদায় হবে না যা আল্লাহর রাসূল চেয়েছেন।

মুসলিমদের জন্য বাইয়াত ছাড়া জীবন কি বৈধ?
এই ব্যাপারে আমি কিছু বলবো না। তবে আল্লাহর রাসূলের কিছু হাদিস উল্লেখ করবো যা থেকে পাঠকমাত্রই বাইয়াতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারবেন।

১- যে ব্যক্তি আনুগত্য থেকে তার হাতকে খুলে ফেললো, কিয়ামতের দিন সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে এমনভাবে যে, তার বলার কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি বাইয়াতের বন্ধন ছাড়াই মারা গেল সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো। (মুসলিম : ৩৪৪১)

২- আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আমরা রাসূল সা.-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতাম শ্রবণ ও আনুগত্যের ওপর। আর তিনি আমাদেরকে সামর্থ্য অনুযায়ী উক্ত আমল করতে বলতেন। (বুখারি : ৬৬৬২)

৩- উবাদা বিন সামেত রা. বলেন, আমরা বাইয়াত গ্রহণ করেছি এ মর্মে যে, কোনো ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবো না এবং সর্বাবস্থায় সত্যের ওপর অটল থাকবো। এ ব্যাপারে কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে পরোয়া করবো না। (মুসলিম : ৩৪২৬)

৪- জারির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বলেন, আমি রাসূল সা.-এর নিকট শ্রবণ ও আনুগত্যের বাইয়াত গ্রহণ করেছি। অতঃপর তিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন আমি যেন সাধ্যমত এ কাজ করি এবং প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করি। (বুখারি : ৬৬৬৪, মুসলিম : ৮৫)

৫- কিয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ধরনের ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন না এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধও করবেন না। আর তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।
ক. এমন ব্যক্তি যার নিকট সফরে অতিরিক্ত পানি আছে অথচ তা থেকে কোনো মুসাফিরকে দেয় না।
খ. যে ব্যক্তি কেবল দুনিয়াবি স্বার্থে নেতার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে।
গ. যে ব্যক্তি পণ্য বিক্রি করার সময় আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করে। (বুখারি : ৬৬৭২)

বাইয়াতে রিদওয়ানের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, (হে রাসূল!) যারা আপনার হাতে বাইয়াত নিয়েছে তারা তো আল্লাহর কাছেই বাইয়াত নিয়েছে, তাদের হাতের ওপর আল্লাহর হাত ছিলো। এখন যে এই ওয়াদা ভঙ্গ করবে এর কুফল তার ওপরই পড়বে। যে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, তবে তিনি অবশ্যই তাকে বড় পুরস্কার দেবেন। (সূরা ফাতাহ : ১০)

তিনি আরো বলেন, অবশ্যই আল্লাহ মুমিনগণের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছিল, অতঃপর তাদের অন্তরে যা ছিল তা তিনি জেনে নিয়েছেন; ফলে তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয়ে পুরস্কৃত করলেন। (সূরা ফাতাহ : ১৮)

শুধু পুরুষ নয় বাইয়াত নিতে হবে নারীদেরকেও। আল্লাহ বলেন, হে নবী! যখন ঈমানদার নারীরা তোমার কাছে এসে এই মর্মে বাইয়াত করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তারা জেনে শুনে কোনো অপবাদ রচনা করে রটাবে না এবং সৎকাজে তারা তোমার অবাধ্য হবে না। তখন তুমি তাদের বাইয়াত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা মুমতাহিনা : ১২)

জামায়াতে ইসলামী দেশে দেশে তাই কাজ করে যাচ্ছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার। এজন্য তারা কিছু বাইয়াতবদ্ধ কর্মী চায়। বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে একেই ইসলামের বাইয়াত হিসেবে গ্রহণ করা শুধু হাস্যকরই নয় বরং আল্লাহর রাসূলের সাথে বেয়াদবি। অতএব জামায়াত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ইসলামকে সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর এজন্য আমরা বাইয়াত গ্রহণ করি সেভাবে যেভাবে মদিনার সাহাবীরা আকাবায় বাইয়াত নিয়েছেন।

আরেকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাইয়াতের হাকীকত। কেন বাইয়াত?
বাইয়াতের বেসিক উদ্দেশ্য হলো জামায়াতবদ্ধ থাকা। আর জামায়াতবদ্ধ থাকতে গেলে যে বিষয়টা প্রথমে আসে তা হলো নেতৃত্ব। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই। পুরো পৃথিবীব্যাপীও নেই দেশভিত্তিকও নেই। এখানে ঐক্যের একটি বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছে। জামায়তবদ্ধ থাকা ও নেতার আনুগত্যের থাকার ব্যাপারে অনেক কড়া নির্দেশ থাকার পরও সেটা আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। তাই জামায়াতে সকল মাজহাব ও সকল মতের মুসলিমদের একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছে যেখানে সবাই বাইয়াতবদ্ধ, জামায়াতবদ্ধ ও নেতার আনুগত্যে থাকতে পারবে। আল্লাহর রাসূল সা. যেখানে তিনজনের কাফেলাকেও নেতা নির্ধারণ করে চলতে বলেছেন সেখানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত চলছে নেতা ছাড়া। জামায়াতবদ্ধ থাকার জন্য নেতা প্রয়োজন। নেতার আনুগত্যে থাকার জন্য বাইয়াত প্রয়োজন।

ইসলামে জামায়াতবদ্ধ থাকা ফরজ। জামায়াতবদ্ধ থাকার জন্য উলিল আমর নির্ধারণ করা ফরজ। উলিল আমরের আনুগত্যও ফরজ। উলিল আমরের আনুগত্যের জন্য বাইয়াতও ফরজ। বাইয়াত তাই তিন কারণে ফরজ।

অনেকে মনে করেন, বাইয়াত শুধু খলিফার হাতেই নিতে হবে। এ ছাড়া কোনো বাইয়াত নেই। তাহলে যেহেতু এখন মুসলিমদের খলিফা নেই তাই বাইয়াতও নেই।

এগুলো ভ্রান্ত ও মাদখালীদের প্রচারণা। বাইয়াত সংক্রান্ত যত প্রসিদ্ধ হাদিস পাওয়া যায় তা বেশিরভাগই মাক্কী জীবনের। যখন কোন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ছিল না, খলিফাও ছিল না। আর খলিফা ছাড়া বাইয়াত নেই, এটা যদি শুদ্ধ হয় তাহলে আর কখনোই খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ কেউ খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ/বাইয়াত নিবে না, জীবন বাজি রাখবে না। আর সেটা বাস্তবায়নও হবে না। রাজতন্ত্রীরা এই ধরনের চিন্তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

খলিফা বা খিলাফত ছাড়া বাইয়াত হয় না এটা মস্ত ভুল ধারণা। ইসলামী শরীয়াতের উদ্দেশ্য এই নয় যে, কেউ খলিফা দাবী করলে তার বাইয়াত নিতে হবে। বরং তার কাছে আনুগত্যের বাইয়াত নিলে পরে সে খলিফা হিসেবে বৈধতা পাবে। উস্তাদ মাওলানা মওদূদী রহ. একটি দারুণ কথা বলেছেন, "বাইআতের মাধ্যমে খলীফা, খলীফার ক্ষমতায় বাইআত নয়"। অতএব বাইয়াত আগে খলিফা পরে। মুসলিমরা কারো কাছে আনুগত্যের বাইয়াত নিলে তিনি ঐ মুসলিমদের শাসক হবেন। কেউ যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় এসে শাসক হলে তার কাছে বাইয়াতের শরয়ি মর্যাদা হওয়া তো দূরের কথা, তার কাছে বাইয়াত বৈধই নয়। যেমন ইয়াজিদের ক্ষমতা পাওয়া বৈধ পন্থায় না হওয়াতে জান্নাতের সর্দার হুসাইন রা. জীবন দিয়েছেন বাইয়াত নেন নি। একইভাবে মক্কা ও মদীনায় অসংখ্য মর্যাদাবান সাহাবী ইয়াজিদের বাইয়াত নেন নি। এই কারনে সে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সাহাবীরা জীবন দিয়েছেন, বাইয়াত দেন নি।

এখন প্রশ্ন হলো কার বাইয়াত নেব? কার সাথে জামায়াতবদ্ধ হবো?
জামায়াতে ইসলামী ওহী দ্বারা সার্টিফাইড নয়, তাই এটা একমাত্র সত্য পথ এটা ভাবার যৌক্তিকতা নেই। তবে আমাদের কাছে বিদ্যমান জামায়াতগুলোর মধ্যে এটাকে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয় বিধায় আমারা জামায়াতে ইসলামের সাথে জামায়াতবদ্ধ হয়েছি। আপনারা বিদ্যমান জামায়াতগুলোর মধ্যে যাকে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মনে করেন সেই দলের বাইয়াত নিতে পারেন। তবে মূলকথা হলো জামায়াত থাকা, উলিল আমরের বাইয়াত নেয়া এবং উলিল আমরের আনুগত্য করা ফরজ। এর থেকে দূরে থাকার কোনো সুযোগ নেই। কোন দলটি বিশুদ্ধ সেটা জানার জন্য ব্যাপক পড়াশোনা ও অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। এই জ্ঞানর্জনও ফরজ। কোনো ব্যাক্তির কথায় বিশুদ্ধতা নিরুপণ না করে কুরআন, হাদিস, সীরাতে রাসূলুল্লাহ এবং সাহাবাদের আমল থেকে দলের বিশুদ্ধতা নিরুপণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক পথে থাকার তাওফিক দান করুন।

আমরা (জামায়াতে ইসলামী) যেসব বিষয়ের উপর শপথ গ্রহণ করি সেগুলো হলো 
//আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে সাক্ষী রাখিয়া পূর্ণ দায়িত্ববোধের সহিত ওয়াদা করিতেছি যে, দুনিয়ায় সামগ্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবজাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত দ্বীন কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাই আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য হাসিলের প্রচেষ্টা চালাইবার জন্য আমি খালিসভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে শামিল হইতেছি। 



আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র বুঝিয়া লওয়ার পর আরো ওয়াদা করিতেছি যে, 
১- আমি এই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতের নিয়ম-শৃঙ্খলা পূর্ণরূপে মানিয়া চলিব;
২- সর্বদাই শরীয়াত নির্ধারিত ফরয-ওয়াজিবসমূহ রীতিমত আদায় করিবো এবং কবীরা গুনাহসমূহ হইতে বিরত থাকিব; 
৩- আল্লাহ তায়ালার নাফরমানির পর্যায়ে পড়ে উপার্জনের এমন কোন উপায় গ্রহণ করিব না 
৪- এমন কোন পার্টি বা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্ক রাখিব না, যাহার মূলনীতি এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ইসলামের ঈমান ও আক্বীদা এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কর্মনীতির পরিপন্থী।

নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার সর্বপ্রকার ইবাদাত অনুষ্ঠানসমূহ, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সব কিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহরই জন্য।
[সূরা আল-আনআম-১৬২] 
আল্লাহ তায়ালা আমাকে এই ওয়াদা পালনের তাওফীক দান করুন। আমীন।//

এই হলো আমাদের শপথ। আমরা মনে করি মুসলিম মাত্রই বাইয়াতবদ্ধ জীবন যাপন করতে হবে যা আল্লাহর রাসূল সা. নির্দেশ করেছেন।

আরো ডিটেইলস জানার জন্য পড়ুন
বাইয়াতের হাকীকত

1 টি মন্তব্য: