৬ মে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৩৭ : মুশরিকদের সাথে ঐক্যের কিছু ব্যর্থ চেষ্টা



বঙ্গভঙ্গ ইস্যুতে হিন্দু-মুসলিম রাজনৈতিকরা একেবারে দুই মেরুর বাসিন্দা হয়ে পড়লেন। মুসলিম রাজনীতিবিদরা মনে করেছেন হিন্দুদের সাথে আর যুগপৎ রাজনীতি করার আর সুযোগ নেই। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং যুগপৎভাবে আন্দোলন করে ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা আদায় করার লক্ষ্যে কিছু মানুষ উদ্যোগী হন। এর মধ্যে গোপালকৃষ্ণ গোখলে ও তার অনুসারীদের একজন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন অন্যতম। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আগে থেকেই কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। ১৯১২ সালে মুসলিম লীগের কনফারেন্সে তিনি যোগ দেন কিন্তু লীগের সদস্য হননি। যদিও মুসলিম লীগ নেতারা চেয়েছেন তার মতো একজন মেধাবী ও দূরদর্শী লোক মুসলিম লীগের নেতৃত্বে আসুক। কিন্তু জিন্নাহ চাইতেন অন্যকিছু। তিনি ধর্মীয় ভাবধারার মানুষ ছিলেন না। আপাদমস্তক সেক্যুলার ছিলেন। তাই তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সমন্বয় করতে চাইলেন। 

এদিকে ১৯০৫ সালে গোপালকৃষ্ণ গোখলে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি তার এই ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে তার দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী তিলকের ক্ষমতা খর্ব করার কাজে ব্যবহার করেন। ১৯০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির মনোনয়ন থেকে তিলকের নাম বাদ দেওয়া হয়। ফলে কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। গোখলে ও তিলক যথাক্রমে নরমপন্থী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর নেতৃত্বদান করতে থাকেন। এই চরমপন্থীদেরই পরবর্তীকালে বলা হত উগ্র জাতীয়তাবাদী। তিলক গণআন্দোলন ও প্রত্যক্ষ বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের ডাক দেন। অন্যদিকে গোখলে সংস্কারপন্থীই থেকে যান। কংগ্রেস দলও এই বিবাদের জেরে দুটি শাখায় ভেঙে গিয়ে এক দশকের জন্য অকার্যকর হয়ে পড়ে।   

১৯১২ সালে মুসলিম লীগ কাউন্সিল লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নতুন প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগের নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। ১৯১৩ সালেই মুসলিম লীগ স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং হিন্দু মুসলিম আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যৌথ কর্মসূচী গ্রহণের প্রস্তাব রাখে। কংগ্রেস ও লীগের পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ১৯১৫ সালে বোম্বাইয়ে একই স্থানে দুই দলেরই অধিবেশন ডাকা হয়। ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় ব্রিটেনের তুরস্ক বিরোধী নীতি ভারতীয় মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরোধী করে তোলে। এই সময়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করার আগ্রহ দেখা দেয়। এই আগ্রহের ফলেই ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। হিন্দু চরমপন্থি নেতা বালগঙ্গাধর তিলক মুসলিমদের সাথে চুক্তি করতে রাজি হলে কংগ্রেসের দুই অংশের মধ্যেও দূরত্ব ঘুচে যায়। 

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও এ, কে, ফজলুল হকসহ ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দের চেষ্টায় ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে একটি শাসনতান্ত্রিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ নামে পরিচিত এই চুক্তিতে মুসলিম লীগের স্বতন্ত্র নির্বাচনপ্রথা ও আইনসভাগুলোর আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিধান স্বীকৃত হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এই চুক্তির পরিকল্পনার মূল ভিত্তি ছিল। তখন বাংলার লোকসংখ্যার ৫৪ শতাংশ ছিল মুসলমান। সংখ্যালঘিষ্ট প্রদেশের মুসলমানদের অতিরিক্ত আসন দেওয়ার স্বার্থে ফজলুল হকসহ মুসলিম নেতাগণ বাংলাদেশের আইন সভায় মুসলমানদের জন্য মাত্র শতকরা ৪০টি আসন নিতে সম্মত হন। বাকি আসনগুলো বিহার, যুক্ত প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থের জন্য ছেড়ে দেন। পাঞ্জাবে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৫ ভাগ। পাঞ্জাবের মুসলমান নেতাগণ শতকরা ৫০টি আসন রেখে বাকি পাঁচ ভাগ আসন অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ট প্রদেশের মুসলমানদের সুবিধার জন্য ছেড়ে দেন। ভারতের অন্যান্য সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলমানদের স্বার্থে বাংলার মুসলমানদের ত্যাগ ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা।

যে বিষয়গুলোতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস ঐক্যমত পোষণ করে তা হলো, 
১- ভারতের স্বায়ত্তশাসিত (স্বরাজ) সরকার থাকবে, এর জন্য তারা উভয় দল কাজ করবে।
২- গভর্নরের নির্বাহী কাউন্সিলে একই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হবে।
৩- ভারত কাউন্সিল অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে।
৪- ভারতীয় ব্যাপারে নিযুক্ত রাষ্ট্রীয় সচিবের বেতন ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে দিতে হবে এবং ভারতের তহবিল থেকে দেয়া যাবে না।
৫- নির্বাহী বিভাগকে বিচার বিভাগ থেকে পৃথক করতে হবে।
৬- প্রত্যেক প্রদেশে প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিমদের সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।
৭- কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলিমদের এক তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।
৮- যৌথ নির্বাচনে যোগ না দেয়া পর্যন্ত প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা থাকবে।
৯- বয়সের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
১০- আইনসভার মেয়াদ ৫ বছর হবে।
১১- ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের অর্ধেক সদস্য অবশ্যই ভারতীয় হতে হবে।

এরপর প্রথম মহাযুদ্ধের সময় হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার একটি ক্ষেত্র রচিত হয়। রাউলটি বিলের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের এপ্রিলে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে কয়েকশ লোককে গুলী করে হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ফজলুল হক, সিআর দাস, মতিলাল নেহেরু ও তাইয়েবজীকে নিয়ে এ উপলক্ষে এক বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সে বছরই মাওলানা আবদুল বারীর নেতৃত্বে লক্ষ্ণৌতে তুরস্কের অখণ্ডত্ব ও খলীফার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। ১৪ নভেম্বর দিল্লীতে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে খিলাফত কমিটির প্রথম অধিবেশনে খিলাফত সংক্রান্ত দাবির ভিত্তিতে মুসলমানরা ইংরেজ সরকারের সাথে অসহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে।

১৯২০ সালের জুন মাসে হিন্দু ও মুসলমান নেতাদের এক সভায় অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ৩১ আগস্ট মুসলমানরা খিলাফত দিবস পালন করে। সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেস, মসুলিম লীগ, খিলাফত কমিটি ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কলকাতায় এক অধিবেশনে মিলিত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু অসহযোগ উপলক্ষে গান্ধীর নেতৃত্বে স্কুল-কলেজ বয়কটের যে কর্মসূচির গৃহিত হয়, জিন্নাহ, ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দ তার বিরোধিতা করেন। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ মুসলমানরা এর ফলে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফজলুল হক স্পষ্টতই ঘোষণা করেন যে, আসহযোগের নামে স্কুল-কলেজ বয়কট করলে শিক্ষায় শত বছর ধরে এগিয়ে যাওয়া হিন্দুদের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু মুসলমানরা, যারা নতুন করে মাত্র শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, তারা আবার অজ্ঞানতার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। ১৯২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সি আর দাস (চিত্ত রঞ্জন দাস) ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে ছাত্রদেরকে স্কুল কলেজ বর্জনের আহ্বান জানান। পরদিনই ফজলুল হক একই ময়দানে সভা করে ছাত্রদেরকে স্কুল-কলেজ বর্জন না করার পরামর্শ দেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগে আগ্রণী মুসলিম নেতৃবৃন্দও সে সময় উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই ঐক্যবব্ধ আন্দোলনের কর্মসূচির মধ্যেই সূক্ষ্মভাবে মুসলিম জনগণকে দমিয়ে দেওয়ার একটি কারসাজি কাজ করছে।

স্কুল-কলেজ বয়কটের ব্যাপারে কংগ্রেসের সাথে মতদ্বৈততার কারণে ফজলুল হক শেষ পর্যন্ত অসহযোগ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। উগ্রবাদী হিন্দুদের কারণে অসহযোগ আন্দোলন কার্যত মুসলিমবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। নানা স্থানে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ দেখা দেয়। এই সময় হিন্দুদের ব্যাপক সন্ত্রাসবাদী উত্থান ঘটে। হিন্দুরা ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ শুরু করে। তা ১৯৩১ সাল পর্যন্ত অব্যহত থাকে। অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব গান্ধীর হাত থেকে কার্যত সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যায়। যুক্ত প্রদেশের চৌরিচৌরায় একটি থানা আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগের ফলে ২২ জন পুলিশ মারা যাওয়ার পর গান্ধী হঠাৎ করে অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ ঘোষণা করেন।

কংগ্রেসের সাতে মতানৈক্যের কারণে সি আর দাস ১৯২২ সালে সভাপতির পদে ইস্তফা দেন। সি আর দাস ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘স্বরাজ পার্টি’ গঠিত হয়। এই দুই নেতা মনে করেন যে, হিন্দু-মুসলিম মিলিত সংগ্রাম ছাড়া বাংলার স্বাধিকার অর্জন সম্ভব নয়। এ জন্য তাঁরা দীর্ঘ অবহেলিত মুসলমানদের সঙ্গত অধিকারসমূহের প্রতি কিছু সহানুভূতি দেখানো অপরিহার্য বিবেচনা করেন। এ পটভূমিতেই সি আর দাস তৎকালীন বাংলার নেতা সোহরাওয়ার্দীর সাথে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামক রাজনৈতিক চুক্তি সম্পাদন করেন। সি.আর দাস তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের  লক্ষ্যে বঙ্গীয় আইন সভার মুসলিম সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বাংলার বিশিষ্ট মুসলিম নেতাদের সঙ্গে যুগপৎ আলোচনা চালান এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাঁদের সঙ্গে এক চুক্তি করেন। চুক্তিটির (যা সাধারণত বেঙ্গল প্যাক্ট নামে পরিচিত) শর্তাবলি (বিধানসমূহ) ১৯২৩-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বরাজ্য দলীয় সদস্যদের সভায় অনুমোদিত হয়। এ সভায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয় যে, প্রদেশে সত্যিকারের স্ব-নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই এ চুক্তি কার্যকর হবে। চুক্তিটি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির ১৯২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারিখের সভায়ও অনুমোদন লাভ করে। চুক্তিটির বিভিন্ন শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ:

১.    বঙ্গীয়-আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
২.    স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা  ৪০ ভাগ।
৩.    সরকারি চাকরির শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ পদ পাবে মুসলমান সম্প্রদায় থেকে। 
৪.    কোন সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৭৫ শতাংশের সম্মতি ব্যতিরেকে এমন কোন আইন বা সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা যাবে না, যা ঐ সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্বার্থের পরিপন্থী।
৫.    মসজিদের সামনে বাদ্যসহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না।
৬.    আইন সভায় খাদ্যের প্রয়োজনে গো-জবাই সংক্রান্ত কোন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে না।

চুক্তিটি প্রচারিত হওয়ার পরপরই বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। এ চুক্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে প্রবল বিরোধিতা করে। হিন্দু নেতাদের মধ্যে যাঁরা চুক্তিটির বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এস.এন ব্যানার্জী ও বি.সি. পাল। এ চুক্তির বিরুদ্ধে, যা তাঁদের ভাষায় এক-তরফা ছিল, হিন্দু জনমত গড়ে তোলার ব্যাপারে বাংলার হিন্দু গণমাধ্যম এর বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে উঠে। সি.আর দাশের নিজ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা তাঁকে সুবিধাবাদী ও মুসলিম পক্ষপাতদোষে দুষ্ট বলে দোষারোপ করেছিলেন। তিনি কিন্তু সকল বিরোধিতার মুখেও অটল থাকেন। চুক্তিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ব্যতীত স্বরাজ সম্ভবপর নয়।

এরপর ১৯২৮ সালের নেহেরু-কমিটির রিপোর্টের মাধ্যমে কংগ্রেস কোনো কারণ ছাড়াই লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে স্বীকৃত মুসলমানদের সকল দাবি অস্বীকার করে। কংগ্রেসের এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের যাবতীয় আয়োজন ধ্বসে পড়ে। এখানে বলে রাখা জরুরী গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলন নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হলে ১৯২০ সালে জিন্নাহ কংগ্রেস ত্যাগ করেন। এরপর মুসলিম লীগে জয়েন করেন। কিন্তু দৃশ্যত রাজনীতি থেকে দূরে চলে যান। এরপর মুসলিম নেতাদের অনুরোধে তিনি মুসলিম লীগের পক্ষে রাজনীতি করতে সম্মত হন এবং লন্ডন থেকে পুরোপুরি ভারতে চলে আসেন।

১৯২৯ সালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জিন্নাহ চৌদ্দ দফা দাবি উত্থাপন করেন। কংগ্রেস নেতৃত্ব সে সব দাবি অগ্রাহ্য করেন। ১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে লন্ডনে তিন দফা গোলটেবিল বৈঠকেও ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র প্রশ্নে হিন্দু ও মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হয়নি। এরপরও ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত রাখেন। ১৯৩৫ সালে জিন্নাহ লীগের সভাপতি হন। একই বছর কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের সাথে তাঁর আলোচনা ব্যর্থ হয়। ১৯৩৭-৩৮ সালে তিনি গান্ধীর সাথে পত্র বিনিময় করেন। গান্ধী মুসলিম লীগকে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানরূপে মেনে নিতেই অস্বীকার করেন। জিন্নাহর সাথে পত্রালাপে জওহরলাল নেহেরু হিন্দু-মুসলমান সমস্যা আলোচনায় মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের সমান মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেন। ১৯৩৮ সালে জিন্নাহ কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে পত্র বিনিময় করেও সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হন। এভাবেই হিন্দু-মুসলিম একের পর এক চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অবশেষে জিন্নাহর বোধোদয় হয় এবং তিনি নিশ্চিত হন এই মুশরিকদের সাথে মুসলিমরা একদেশে থাকতে পারবে না। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন