৮ মে, ২০২০

আসহাবুল উখদুদ বা গর্তওয়ালাদের গল্প জানুন



একসময় আরবে যাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী এক ইয়াহুদী বাদশাহ ছিলেন। তার দরবারে ছিল এক বিখ্যাত যাদুকর। সে বৃদ্ধ হয়ে গেলে বাদশাহকে বলে, আমি তো এখন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি এবং আমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। সুতরাং আমাকে এমন একটা ছেলে দিন যাকে আমি ভালোভাবে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে পারি এবং আমার উত্তরসূরী করতে পারি। 

তারপর এক মেধাবী বালককে বাদশাহ খুঁজে বের করলেন। যাদুকর তাকে যাদুবিদ্যা শেখাতে শুরু করে। বালকটি তার শিক্ষাগুরুর বাড়ি যাওয়ার পথে এক আলেম ব্যক্তির আস্তানার পাশ দিয়ে যেতো। আলেম ব্যক্তিটি ঐ আস্তানায় বসে কখনো ইবাদত করতেন, আবার কখনো জনগণের উদ্দেশ্যে ওয়াজ নসীহত করতেন। বালকটিও পথের পাশে দাঁড়িয়ে ঐ আল্লাহর ওলীর ইবাদত দেখতো এবং নসীহত শুনতো। এ কারণে যাদুকরের কাছেও সে মার খেতো এবং বাড়িতে বাবার কাছেও মার খেতো। কারন সে যাদুকরের কাছে যেমন দেরিতে পৌঁছতো তেমনি বাড়িতেও দেরি করে ফিরতো। 

যাই হোক এমনিভাবে এ বালক একদিকে যাদু বিদ্যা এবং অন্যদিকে ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করতে লাগলো। একদিন সে দেখলো যে, তার চলার পথে এক বিরাট বিস্ময়কর কিম্ভুত কিমাকার জানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। পথে লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ পাশ থেকে ওপাশে এবং ওপাশ থেকে এপাশে যাওয়া আসা করা যাচ্ছে না। সবাই উদ্বিগ্নও বিব্রতাবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বালকটি মনে মনে চিন্তা করল যে, একটা বেশ সুযোগ পাওয়া গেছে। দেখা যাক, আল্লাহর কাছে আলেমের ধর্ম অধিক পছন্দনীয় না যাদুকরের ধর্ম অধিক পছন্দনীয়। 

এটা চিন্তা করে সে একটা পাথর তুলে জানোয়ারটির প্রতি এই বলে নিক্ষেপ করলো, হে আল্লাহ আপনার কাছে যদি যাদুকরের ধর্মের চেয়ে আলেমের ধর্ম অধিক পছন্দনীয় হয়ে থাকে তবে এ পাথরের আঘাতে জানোয়ারটিকে মেরে ফেলুন। এতে করে জনসাধারণ এর অপকার থেকে রক্ষা পাবে। পাথর নিক্ষেপের পরপরই ওর আঘাতে জানোয়ারটি মরে গেল। সুতরাং লোক চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেল। আল্লাহ প্রেমিক আলেম এ খবর শুনে তার ঐ বালক শিষ্যকে বললেন, হে প্রিয় বৎস! তুমি আমার চেয়ে উত্তম। এবার আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তোমাকে নানাভাবে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। সে সব পরীক্ষা সম্মুখীন হলে আমার সম্বন্ধে কারো কাছে কিছু প্রকাশ করবে না।

অতঃপর বালকটির কাছে নানা প্রয়োজনে লোকজন আসতে শুরু করলো। তার দুআর বরকতে জন্মান্ধ দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে লাগলো। কুষ্ঠ রোগী আরোগ্য লাভ করতে থাকলো এবং এছাড়া আরও নানা দুরারোগ্য ব্যাধি ভাল হতে লাগলো। বাদশাহর এক অন্ধমন্ত্রী এ খবর শুনে বহু মূল্যবান উপহার উপঢৌকনসহ বালকটির নিকট হাজির হয়ে বললেন, যদি তুমি আমার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিতে পার তবে এসবই তোমাকে আমি দিয়ে দিবো। বালকটি একথা শুনে বললো, দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দেয়ার শক্তি আমার নেই। একমাত্র আমার প্রতিপালক আল্লাহই তা পারেন। আপনি যদি তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন তাহলে আমি তাঁর নিকট দুআ করতে পারি। মন্ত্রী অঙ্গীকার করলে বালক তাঁর জন্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলো। এতে মন্ত্রী তাঁর দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে পেলেন। 

অতঃপর মন্ত্রী বাদশাহর দরবারে গিয়ে যথারীতি কাজ করতে শুরু করলেন। তার চক্ষু ভাল হয়ে গেছে দেখে বাদশাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার দৃষ্টিশক্তি কে দিলো? মন্ত্রী উত্তরে বললেন, আমার প্রভু। বাদশাহ বললো, হ্যাঁ, অর্থাৎ আমি। মন্ত্রী বললেন, আপনি কেন হবেন? বরং আমার এবং আপনার প্রভু লা শারীক আল্লাহ রাব্বল আলামীন আমার চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর এ কথা শুনে বাদশাহ বললো, তাহলে আমি ছাড়াও তোমার কোন প্রভু আছে না কি?” মন্ত্রী জবাব দিলেনঃ হ্যা অবশ্যই। তিনি আমার এবং আপনার উভয়েরই প্রভু ও প্রতিপালক। বাদশাহ তখন মন্ত্রীকে নানা প্রকার উৎপীড়ন এবং শাস্তি দিতে শুরু করলো এবং জিজ্ঞেস করলো, এ শিক্ষা তোমাকে কে দিয়েছে? মন্ত্রী তখন ঐ বালকের কথা বলে ফেললেন এবং জানালেন যে, তিনি তার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। 

বাদশাহ তখন বালকটিকে ডেকে পাঠিয়ে বললো, তুমি তো দেখছি যাদুবিদ্যায় খুবই পারদর্শিতা অর্জন করেছে যে, অন্ধদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিচ্ছ এবং দুরারোগ্য রোগীদের আরোগ্য দান করছো? বালক উত্তরে বললো, এটা ভুল কথা। আমি কাউকেও সুস্থ করতে পারি না, যাদুও পারে না। সুস্থতা দান একমাত্র প্রভুই করে থাকেন। বাদশাহ বললো, অর্থাৎ আমি। কারণ সবকিছুই তো আমিই করে থাকি। বালক বললো, না, না, এটা কখনই নয়। বাদশাহ বললো, তাহলে কি তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে প্রভু বলে স্বীকার কর? বালক উত্তরে বললো, হ্যা, আমার এবং আপনার প্রভু আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়। 

বাদশাহ তখন বালককে নানা প্রকার শাস্তি দিতে শুরু করলো। বালকটি অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত আলেমের নাম বলে দিলো। বাদশাহ আলেমকে এরেস্ট করে বললো, তুমি তোমার ধর্ম ত্যাগ করো। আলেম অস্বীকার করলেন। তখন বাদশাহ তাঁকে করাত দ্বারা ফেড়ে দু'টুকরা করে দিলো। এরপর বাদশাহ বালকটিকে বললো তুমি এই লোকের প্রদর্শিত ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগ কর। বালক অস্বীকৃতি জানালো। বাদশাহ তখন তার কয়েকজন সৈন্যকে নির্দেশ দিলো, এ বালককে তোমরা অমুক পাহাড়ের চূড়ার উপর নিয়ে যাও। অতঃপর তাকে আলেমের প্রদর্শিত ধর্ম বিশ্বাস ছেড়ে দিতে বললো। যদি মেনে নেয় তবে তো ভালো কথা। অন্যথায় তাকে সেখান হতে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দাও। সৈন্যরা বাদশাহর নির্দেশমত বালকটিকে পর্বত চূড়ায় নিয়ে গেল এবং তাকে তার ধর্ম ত্যাগ করতে বললো। বালক অস্বীকার করলে তারা তাকে ঐ পর্বত চূড়া হতে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। তখন বালক আল্লাহ তা'আলার নিকট প্রার্থনা। করলো, হে আল্লাহ! যেভাবেই হোক আপনি আমাকে রক্ষা করুণ! এ প্রার্থনার সাথে সাথেই পাহাড় কেঁপে উঠলো এবং ঐ সৈন্য গুলো গড়িয়ে নীচে পড়ে গেল। 

বালকটিকে আল্লাহ রক্ষা করলেন সে তখন আনন্দিত চিত্তে নিজ শহরে ফিরে গেলো এবং আল্লাহর দিকে সবাইকে আহ্বান করতে লাগলো। এই সংবাদ জালিম বাদশাহর নিকট পৌঁছলো বাদশাহ বিস্মিতভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপার কি? আমার সৈন্যরা কোথায়? বালকটি জবাবে বললো, আমার আল্লাহ আমাকে তাদের হাত হতে রক্ষা করেছেন এবং তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। বাদশাহ তখন অন্য কয়েকজন সৈন্যকে ডেকে বললো, নৌকায় বসিয়ে তাকে সমুদ্রে নিয়ে যাও, তারপর তাকে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করে এসো। সৈন্যরা বালককে নিয়ে চললো এবং সমুদ্রের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে নৌকা হতে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। বালক সেখানেও মহান আল্লাহর নিকট ঐ একই প্রার্থনা জানালো। সাথে সাথে সমুদ্রে ভীষণ ঢেউ উঠলো এবং সমস্ত সৈন্য সমুদ্রে নিমজ্জিত হলো। বালক নিরাপদে তীরে উঠলো। 

আবারো সে শহরে ফিরে আসলো এবং মানুষকে শিরক পরিত্যাগ করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে আহ্বান জানালো। এবারো বাদশাহর লোকেরা তাকে ধরে বাদশাহের কাছে নিয়ে গেল। বালক বাদশাহকে বললো, আমার আল্লাহ আমাকে আপনার সেনাবাহিনীর কবল হতে রক্ষা করেছেন। হে বাদশাহ! আপনি যতই বুদ্ধি খাটান না কেন, আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ আমি যে পদ্ধতি বলি সেভাবে চেষ্টা করলে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবে। বাদশাহ বললো, কি করতে হবে? বালক উত্তরে বললো, সকল মানুষকে একটি ময়দানে সমবেত করুন। অতঃপর আমার থেকে একটি তীর বের করে আমার প্রতি সেই তীর নিক্ষেপ করার সময় বিসমিল্লাহি রাব্বিল গোলাম এই বাক্যটি বলবেন। অর্থাৎ “আল্লার নামে (এই তীর নিক্ষেপ করছি), যিনি এই বালকের প্রতিপালক।” তাহলে সেই তীর আমার দেহে বিদ্ধ হবে এবং আমি মারা যাবো।

বাদশাহ তাই করলো। তীর বালকের কানে বিদ্ধ হলো এবং সেখানে হাত দিয়ে চাপা দিলো ও শাহাদাত বরণ করলো। সে শহীদ হওয়ার সাথে সাথে সমবেত জনতা বালকের ধর্মকে সত্য বলে বিশ্বাস করলো। সবাই সমবেত কণ্ঠেধ্বণি তুললো, আমরা এই বালকের প্রতিপালকের উপর ঈমান আনলাম। এ অবস্থা দেখে বাদশাহর ভীত সন্তস্ত্র হয়ে পড়লো। তিনি বালকের কৌশল বুঝতে পারলেন কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই।  

বাদশাহ তখন তার অনুচরবর্গকে নির্দেশ দিলো, সকল মহল্লায় ও রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় গর্ত খনন করো এবং ওগুলোতে জ্বালানী কাঠ ভর্তি করে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দাও। যারা নতুন ধর্মে বিশ্বাসী সকলকে এই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করো। বাদশাহর এ আদেশ যথাযথভাবে পালিত হলো। মুসলমানদের সবাই অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিলেন। সকল মুসলিমকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো। একজন নারী কোলে শিশু নিয়ে একটি গর্তে প্রতি ঝুঁকে তাকিয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ ঐ শিশুর মুখে ভাষা ফুটে উঠলো। সে বললো, মা! কি করছেন? আপনি সত্যের উপর রয়েছেন। সুতরাং ধৈর্যের সাথে নিশ্চিন্তে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। এভাবে হাজার হাজার মুসলিম মৃত্যুবরণ করেন।

এই বাদশাহের নাম জুনাওয়াস বা জুনুয়াস। সেখানের একজন মুসলিম যার নাম দাউস জু সালাবান তিনি রোমে (ইতালি) হাজির হন এবং রোমের বাদশাহের কাছে ইয়াহুদি যাদুকরদের নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন। ইতালির শাসকদের বলা হতো কায়সার। তারা ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ মুসলিম। তিনি আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীকে লিখলেন, তিনি যেন দাউস জু সালাবানের সঙ্গে একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন এবং জুনুয়াসকে শায়েস্তা করেন। আবিসিনিয়া মানে বর্তমানের ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়া থেকে অল্প সমুদ্র পাড়ি দিলেই ইয়েমেন। তৎকালীন ইয়েমেনের শহর নাজরানেই ঘটেছে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে দাবী করেন ঐতিহাসিকগণ। 

ইথিওপিয়াতেও মুসলিমদের শাসন। বাদশাহ নাজ্জাশী আমীর ইবনে ইরবাতকে সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে এক বিরাট সেনাবাহিনী জুনুয়াসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদল ইয়েমেনে পৌঁছলো এবং সহজেই জুনুয়াসকে পরাজিত করলো। জুনুয়াস পালিয়ে গেল এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করলো। এই বিষয়ে সূরা বুরুজে আল্লাহ তায়ালা বলেন, قُتِلَ أَصْحٰبُ الْأُخْدُودِ অর্থাৎ ধ্বংস হয়েছে গর্তওয়ালারা।

এরপর সমগ্র ইয়েমেন আবিসিনিয়ার কর্তৃত্বে চলে গেলো এবং মুসলিমদের কর্তৃত্ব শুরু হলো। সৈন্যাধ্যক্ষ হিসেবে আগমনকারী সর্দার ইয়েমেনে বসবাস করতে লাগলো। আমীর ইবনে ইরবাতের সহকারী ছিলো আবরাহা। সেই আবরাহা আমীর ইবনে ইরবাতকে হত্যা করে এবং  ইয়েমেনের শাসক হয়। এর বহুবছর পর সেও সীমালঙ্ঘন করে এবং আল্লাহর গজবে সেও ধ্বংস হয়। সূরা ফিলে তার কথা বর্ণিত আছে।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন