তুর্কিতে পায়িতাথ নামে একটি সিরিজ শুরু হয়েছিলো অনেক আগে। এর কিছু অসাধারণ ভিডিও ক্লিপ বাংলা সাবটাইটেল আকারে প্রচার হয়। তা থেকে উৎসাহিত হই। লকডাউনে কিছু পর্ব দেখি। এই সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্র উসমানীয় সুলতান আব্দুল হামিদ খান দ্বিতীয়। পরে ওনার সম্পর্কে পড়াশোনা করতে আবিষ্কার করি আমাদের উপমহাদেশে ওনার এক ব্যর্থ পরিকল্পনার কাহিনী। এই কাহিনী রেশমি রুমাল আন্দোলন নামে পরিচিত।
আব্দুল হামিদের মূল শত্রু ছিলো ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চল তাদের উপনিবেশে পরিণত করছে। এমনকি তুর্কি সালতানাতের অঞ্চলগুলো দখলের চেষ্টা চালায়, বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ উস্কে দেয়। শুধু তাই নয়, তারা গোটা তুর্কি সালতানাতই দখলের প্রচেষ্টা চালায় আব্দুল হামিদের সময়। আব্দুল হামিদও তাদের ষড়যন্ত্র দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করতে থাকে।
এই মোকাবেলার অংশ হিসেবে আব্দুল হামিদ ব্রিটিশ শাসিত হিন্দুস্থানে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করে। তাঁর এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হয় দেওবন্দি আলেম শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি বিপ্লবী দল গঠন করে মাহমুদুল হাসান তার ছাত্রদের দ্বারা।
এদিকে তুরস্কে ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে তরুণ তুর্কি নামে একদল সেক্যুলার যুবকদের উত্থান হয়। ১৯০৯ সালে তারা বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনতার নামে সুলতান আব্দুল হামিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আব্দুল হামিদ তার ছোট ভাইয়ের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ফলে এদেশের স্বাধীনতা কামীদের সাথে তুরস্কের যোগাযোগে ফাটল সৃষ্টি হয়। ১৯১৪ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অবস্থান হেতু তুরস্ক মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তুরস্ক ভারতে বিদ্রোহ তৈরি করে ব্রিটিশদের চাপে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বাধীনতার মূল দাবীদার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ আগেই ব্রিটিশদের সাথে সমঝোতা করে যদি তারা ব্রিটিশদের অনুগত থাকবে যুদ্ধের সময়। বিনিময়ে ভারতে স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হবে। এজন্য তারা চুপ থাকে।
তুরস্ক বাধ্য হয়ে দেওবন্দি আলেম মাহমুদুল হাসানের সাথে যোগাযোগ করে আবার তাদের সংগঠিত করে। ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতাকামীর সংখ্যা কম ছিল না। তুর্কিরা জার্মানিতে অধ্যায়নরত কিছু ভারতীয় ছাত্র ও স্বাধীনতাকামী কিছু বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য আফগানিস্তানের আমীরের সাথেও তারা যোগাযোগ করে। আফাগানিস্তান যদিও স্বাধীন ছিলো তথাপি তারা ব্রিটিশদের সাথে নানা চুক্তি ও ঘেরাও-এর মধ্যে ছিল। কার্যত অনেকটাই ব্রিটিশ অনুগত থাকতে হতো।
তুরস্ক এ সময় মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে তুর্কি ও আফগান সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ আলোচনার জন্য দায়িত্ব দেয়। তাদের এই কার্যক্রম ব্রিটিশ সরকার টের পেয়ে যায়। মাহমুদুল হাসান ও সঙ্গীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। মাহমুদুল হাসান তার ছাত্র ওবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে পাঠিয়ে দেন কাবুলের পথে এবং নিজে রওনা হন মক্কার পথে। কাবুলে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল আফগান সরকারের সহযোগিতা নিশ্চিত করা ও আফগান সীমান্তে থাকা স্বাধীনতাকামীদেরকে সংগঠিত করে ভারতের আজাদী আন্দোলনের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা।
ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি কাবুল পৌঁছেন। কাবুল আমীরকে সহযোগিতায় রাজি করান। তিনি তুর্কি ও জার্মানি মিশনের সাথে কাজ করতে রাজি হন। ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি সেখানে গিয়ে অনেক স্বাধীনতাকামীদের দেখতে পান এবং সেখানে একটি অস্থায়ী ভারত সরকার গঠন করেন। তুর্কি- জার্মান মিশনের সমন্বয়কারী প্রতিনিধি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট, বরকতুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী এবং উবায়দুল্লাহ সিন্ধি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
এদিকে মাহমুদুল হাসান মক্কা পৌঁছেন। মক্কা মদিনা তখন ছিল তুর্কি খেলাফতের অংশ। তিনি গিয়ে তুর্কি গভর্নর গালিব পাশার সাথে সাক্ষাত করেন। গালিব পাশার তখন ধর্মীয় প্রভাব ছিল অনেক। তিনি দুটি পত্র লিখেন। একটি পাঠানো হয় মদিনার গভর্নর বসরী পাশার কাছে আরেকটি আফগান গোত্রপতি মুসলমানদের কাছে। এতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান ছিল।
সেসময় তুর্কি যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশা মদিনায় এসেছিলেন। মাহমুদুল হাসান তার সাথে সাক্ষাতে করেলেন। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সহায়তার চুক্তি সাক্ষর করলেন। তিনি শায়খুল হিন্দকে তিনটি চিঠি লিখে দিলেন। একটি ছিল অস্থায়ী ভারত সরকার ও তুর্কি সরকারের মধ্যকার চুক্তিনামা। দ্বিতীয়টি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে শায়খুল হিন্দকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান। তৃতীয়টি ছিল আফগান সরকারের প্রতি।
আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাতের সময় সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আফগান সরকার সম্মত থাকলে তুর্কি বাহিনী সীমান্তে অবস্থান নিবে। সুযোগমতো সেই বাহিনী ভারতে প্রবেশ করবে এবং অভ্যুত্থান ঘটাবে। সেই সময় শায়খুল হিন্দ আফগানিস্তান থেকে সামগ্রিক দিক নির্দেশনা দিবেন এবং তুর্কি বাহিনীর রসদের যোগান দিবেন এক্ষেত্রে সাহায্য করবেন আফগান আমীর।
ওবাইদুল্লাহ সিন্ধির নেতৃত্বে এই পত্র আফগান সরকারের নিকট পৌঁছানো হল। কিন্তু তিনি ব্রিটিশদের চাপের কথা তুলে প্রথমে সম্মতি দিতে চাইলেন না। পরে এই মর্মে চুক্তি হলো আফগান সরকার নিরপেক্ষ থাকবে সাহায্য যা করার গোপনে করবে এবং তুর্কি বাহিনী আফিগান সীমান্ত দিয়েই ভারতে প্রবেশ করবে। আর যদি কোন আফগানী এই যুদ্ধে যেতে চায় তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে কোন নিষেধ থাকবেনা। ইংরেজদেরকে দেওয়ার জন্য কৈফিয়তও প্রস্তুত রাখা হল, “সীমান্তের স্বাধীনতাকামীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে আফগান সরকার”।
উবাইদুল্লাহ সিন্ধি মাহমুদুল হাসানের বার্তা পাঠান হিন্দুস্থানে অবস্থানরত দেওবন্দীদের কাছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই চিঠি ধরা পড়ে যায় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে। পুরো প্ল্যান ফাঁস হয়ে যায়। কওমী নেতাদের এরেস্ট করা শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। তুর্কিদের একটি প্ল্যান এভাবে ভেস্তে যায়। উবায়দুল্লাহ সিন্ধি আফগানিস্তান থেকে তুর্কিতে পালিয়ে যায়। ফলে তাকে এরেস্ট করা সম্ভব হয়নি। তবে মূল নেতা মাহমুদুল হাসান মক্কায় এরেস্ট হন। মক্কায় তখন শরিফ হুসেইন নামে এক হাশেমীয় নেতা ব্রিটিশদের সহায়তায় বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে থাকে। শরীফ খুব জনপ্রিয় ছিলো আরবদের কাছে। ব্রিটিশরা শরীফের সাহায্যে মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে এরেস্ট করে।
এরপর মাহমুদুল হাসান, হোসাইন আহমেদ মাদানীসহ অপরাপর দেওবন্দী নেতাদের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায় নির্বাসন দেন। তিন বছর পর ১৯২০ সালের শুরুতে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়ে তারা খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। তবে মাহমুদুল হাসান আর বেশিদিন বাঁচেন নি। ওই বছরই নভেম্বরে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের আগে আযাদি আন্দোলনে কংগ্রেসকে সহায়তা ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির সাথে দেওবন্দীদের আন্দোলন করার পরামর্শ দেন।
তার সিদ্ধান্ত অনুসারে দেওবন্দীদের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সবসময় মুশরিকদের সংগঠন কংগ্রেসকে সাপোর্ট করে এবং মুসলিম লীগের বিরোধীতা করে। তবে এই মতের বিরোধী ছিলেন আরেক দেওবন্দী আলেম হাকিমুল উম্মত আশ্রাফ আলী থানবী রহ.। পাকিস্তান আন্দোলন যখন চরমে তখন মাওলানা থানবী'র অনুসারী সাব্বির আহমেদ ওসমানী জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ থেকে আলাদা হয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে আলাদা আরেকটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠন পাকিস্তান আন্দোলনকে সাপোর্ট করেন এবং মুসলিম লীগের পক্ষে কাজ করেন।
মাওলানা মাহমুদুল হাসানের এই বিদ্রোহ রেশমি রুমাল আন্দোলন নাম দিয়েছে মূলত ইংরেজরা। কারণ উবাইদুল্লা সিন্ধি বার্তাটি লিখে পাঠান একটি রুমালে করে যা রেশমি কাপড়ের ছিলো। অর্থাৎ ইংরেজ গোয়েন্দারা যে চিঠিটি পায় তা লেখা রেশমি কাপড়ের রুমালে। সেখান থেকেই এই আন্দোলনের এরূপ নাম হয়।
রেশমী রুমাল আন্দোলন হিন্দুস্তানে ইংরেজের সাথে যুদ্ধ করার সেনাদল তৈরি করে তার নাম দেয় ‘জুনুদে রব্বানিয়া'। নিম্নোক্ত নেতৃবর্গ ছিলেন এ সেনাদলের প্রথম সারিতে :
প্রধান পৃষ্ঠপোষক : তুরস্কের সুলতান মেহমেদ খান পঞ্চম, ইরানের সুলতান আহমদ শাহ কাচার, আফগানিস্তানের আমীর হাবিবুল্লাহ খান।
সহকারী পৃষ্ঠপোষক : আনোয়ার পাশা, তুরস্কের যুবরাজ, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী, আফগানিস্তানের সহকারী রাষ্ট্রপ্রধান সরদার নসরুল্লাহ খান, হায়দরাবাদের নিজাম, ভূপালের নওয়াব, রামপুরের নওয়াব, বাহাওয়ালপুরের নিজাম, ইয়াগিস্তানের মুজাহিদ দলের প্রধান।
প্রধান সেনাপতি : শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান এবং সহকারী সেনাপতি : মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী।
বিভাগীয় সেনাপতিবৃন্দ : মওলানা আবদুর রহীম, মওলানা গোলাম মুহাম্মাদ দীনপুরী, মওলানা তাজ মাহমুদ আনরুজ, মওলবী হুসাইন আহমদ মাদানী, মওলবী হামদুল্লাহ, হাজী তরঙ্গ যই, ডা. মুখতার আহমদ আনসারী, মুল্লা সাহেব বাবড়া, জান সাহেব বাজোড়, মওলবী মুহাম্মাদ মিয়া, হাকিম আবদুর রাজ্জাক, মওলবী উবাইদুল্লাহ গাজীপুর, মওলবী আবদুল বারী ফিরিঙ্গী মহলী, মওলানা আবুল কালাম আযাদ, মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, মওলানা শওকত আলী, মওলানা জাফর আলী খান, মওলানা হাসরাত মোহানী, মওলবী আবদুল কাদের কাসুরী ও পীর আসাদুল্লাহ শাহ সিন্ধী।
রেশমী রুমাল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবর্গের সংখ্যা দুশ' বাইশের মতো। সাধারণ লোকেরাও এর মধ্যে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে চলছিল। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে শুরু করে সিন্ধু, পাঞ্জাব, দিল্লী, অযোধ্যা পর্যন্ত এর প্রভাব বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছিল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন