মুহাম্মদ সা.-এর যুগে মদিনাতে তিনটি ইহুদী গোত্রের বসবাস ছিল। তারা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে আল্লাহর রাসূল সা.-এর আগমনের ভবিষ্যতবাণী জানতেন। এজন্য তাদের সাথে কারো ঝামেলা হলেই তারা বলতেন সময় হয়েছে আখেরি নবী আসার। তিনি আসলে তোদের শায়েস্তা করবো। এখন যেমন কেউ কেউ ইমাম মাহদীর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে, অথচ নিজের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট নয়, সেরকম। ইহুদীরা ভেবেছে যেহেতু নবীরা বেশি এসেছেন বনী ইসরাঈলে। তাই তাদের মধ্য থেকেই কেউ হবে শেষ নবী। কিন্তু যখন শেষ নবী আসলেন মক্কার কুরাইশ থেকে তখন তারা নবীকে মেনে নেয়নি। অথচ নবী সা. এর সাথে তাদের জানা সকল বৈশিষ্ট্য মিলে গিয়েছে।
এই তিন ইহুদী গোত্র থেকে খুব কম অংশই ইসলাম গ্রহণ করেছে। অথচ তারা এই নবীর জন্যই বহু বছর ধরে অপেক্ষা করেছে। তারা শুধু মুহাম্মদ সা.-কে গ্রহণ না করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং বন্ধুত্বের মোড়কে থেকে পিঠে ছুরি মারার অপেক্ষায় ছিল। মদিনার তিন ইহুদী গোত্রই আল্লাহর রাসূল সা.-এর মদিনা সনদে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর মধ্যে বনু নাজিরের প্রধান কা'ব বিন আশরাফকে মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কুরাইশদের তথ্য সরবরাহ, চিঠি পাঠানো, আবু সুফিয়ানের সাথে মুহাম্মদ সা.-কে হত্যার চুক্তি স্বাক্ষর ও মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানোর পরিকল্পনার অপরাধে হত্যা করা হয়। খন্দকের যুদ্ধের সময় কুরাইশরা আক্রমণ করলে মদিনায় থাকা বনু কুরাইজা পেছন দিক থেকে মুহাম্মদ সা.কে আক্রমণ করার পরিকল্পনা ও কুরাইশদের সাথে এই মর্মে চুক্তি করে। আল্লাহর রাসূল তাদের সাথে যুদ্ধ করেন ও তাদের সুপারিশকৃত বিচারকের রায়ে তাদের হত্যা করেন। বনু কায়নুকাও এমন এক মুসলিম মহিলাকে নির্যাতন বিবস্ত্র করার সূত্র ধরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং পরে তারা মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হয়।
যাই হোক ইহুদীদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের ইহুদী ধর্মে তারা উট খেত না এবং শনিবারকে পবিত্র জ্ঞান করতো। যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ উট খাওয়া থেকে বিরত থাকতো এবং শনিবারে রোজা রাখতো ও নফল ইবাদত বেশি করতো। এটা তাদের পূর্বের ধর্মের অনুরাগ থেকেই করতো। তাদের এই আচরণ আল্লাহ পছন্দ করেন নি। তাদের উদ্দেশ্যে সূরা বাকার ২০৮ ও ২০৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
//হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো এবং শয়তানের অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের স্পষ্ট শত্রু। অতএব তোমরা যদি সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও পদস্থলিত হও তবে জেনে রাখো, আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান।//
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আলিম অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের উট খেয়ে মুসলিম হতে বলেছেন। যারা ইহুদী তারা যদি মুসলিম হয় তবে তারা উট খেয়ে নিশ্চিত হতে হবে সত্য উপলব্ধি করার পর আগের ধর্মের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর নেই। তেমনি এদেশে যারা মুশরিক থেকে মুসলিম হবে তারাও গরু খেয়ে নিশ্চিত হতে হবে তারা এখন আর গরুকে তাদের মা মনে করেন না।
আর একারণে বাংলায় দাওয়াতী কাজে আসে আলিমরা এদেশের মানুষকে গরু জবাইতে অভ্যস্ত করে তুলেছেন। যাতে তারা পরিপূর্ণভাবে মুসলিম হয়।
ঈদুল আযহায় গরু কুরবানী সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয় বাংলাদেশে। অথচ বাঙালিদের আশে পাশের মুসলিম জাতিরা এই ঈদকে বকরির ঈদ বলে। তারা সাধারণত বকরি/ভেড়া কুরবানী করে। মধ্যপ্রাচ্যেও উট, দুম্বা, ভেড়া ইত্যাদি দেয়া হয়। অবশ্য সেসব স্থানে গরু বেশি উৎপাদন হয় না, এটাও একটা ব্যাপার হতে পারে। ইন্দোনেশিয়াতেও গরু কুরবানী হয় তবে সেটা বাঙালিদের মতো এতো বেশি সংখ্যায় অবশ্যই নয়।
এর ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব যুগে যখন আর্যরা এদেশে আগ্রাসন চালাতে শুরু করেছে তখন থেকে তারা তাদের আয়ত্বাধীন এলাকাগুলোতে গরু কুরবানী বা জবাই করা বন্ধ করে দেয়। তখন থেকে বাঙালিরা বা দ্রাবিড়রা গরু জবাইকে মুশরিকদের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ হিসেবে দেখে আসছে। এদেশে ইসলাম রাজনৈতিকভাবে আগমনের আগে ও পরে বহু মুসলিম প্রাণ দিয়েছেন গরু কুরবানীর কারণে। এই নিয়ে পাল আমল ও সেন আমলে ব্রাহ্মন্যবাদী তথা আর্যদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়েছে। এরকম একটি যুদ্ধ হয়েছে বাবা আদম শহীদের সাথে বল্লাল সেনের।
বাবা আদম শহীদ (রহ.) ১১৪২ খিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান। তিনি জন্মগ্রহণ করেন পবিত্র আরব দেশের তায়েফ নগরীতে। ১০৯৯ সালে জেরুজালেম ক্রুসেডে তার বাবা শহীদ হন। খোরসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম (রহ.) উচ্চশিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর বাবা আদম (রহ.) আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর সাহচর্যে আসেন এবং তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
বাবা আদম (রহ.) প্রথমে মহাস্থানগড়ে মাদ্রাসা স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তার সফরসঙ্গী ১২ জন আউলিয়ার অধীনে ১২টি মিশন গঠন করে এলাকায় পানির অভাব দূর করতে পুকুর খনন, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ জন ওলি বাবা আদমের নেতৃত্বে ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। ইসলাম প্রচারের সময় রাজা বল্লাল সেনের রাজকর্মচারীদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। বিরোধ যুদ্ধের দিকে গড়িয়ে যায় গরু কুরবানীকে কেন্দ্র করে। একজন নওমুসলিম গরু জবাই করলে বল্লালসেনের কর্মাচারীরা সেই পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। বাবা আদম এর প্রতিবাদে সেই কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করে।
বল্লাল সেন বাংলায় দ্বীন প্রচারকারী সব দায়ির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরের কানাইচং ময়দানে বল্লালসেনের বাহিনীর মোকাবেলা করেন বাবা আদম শহীদ। সে যুদ্ধে বল্লাল সেন পরাস্ত হয়ে ফিরে যান। এর চার বছর পর বল্লাল সেন আবারো আক্রমণ করেন বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জে। ১০ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে মুন্সীগঞ্জে কানাইচং ময়দানে ১০ দিনব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে বহু সংখ্যক সৈন্য ও মুজাহিদ নিহত হন। এ যুদ্ধে বল্লাল সেনের সৈন্য ছিল ২০ হাজার, অপরদিকে মুজাহিদ ও সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। যুদ্ধে পরাজয়ের আশংকায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করলে বাবা আদম সরল বিশ্বাসে মেনে নেন। সেদিন রাতে ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা। বিক্রমপুরের দরগাহ বাড়িতে রাতে অতর্কিত আক্রমণ করে এবং বাবা আদম শহীদ রহ.-কে হত্যা করে। তাঁর কবর মুন্সিগঞ্জে এখনো আছে। তাঁর নামে বহু বছর পর সুলতানি আমলে একটি মসজিদও স্থাপিত হয়।
গরু কুরবানী নিয়ে এভাবে অসংখ্য বাঙালি জীবন দিয়েছেন। এরপর আরেকটি মশহুর ঘটনা হলো শ্রীহট্ট তথা সিলেটের ঘটনা। সেটাও গরু জবাইকে কেন্দ্র করে। বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে বাংলা মুসলিমদের অধিকারে আসার পর সিলেটে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠেছে। সেখানের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করে হিন্দু রাজা গৌর গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে, গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশুপুত্রকে হত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তত্কালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরোজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তাঁর ভাগ্নে সিকান্দর গাজীকে তার বাহিনীসহ সিলেটে প্রেরণ করেন। সৈন্যরা যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ যাদুশক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। সিকান্দার শাহকে ঠেকিয়ে দেয়। গোবিন্দের যাদুশক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর ব্যর্থ হওয়ার সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন।
দিল্লির সম্রাট তার সেনাবাহিনীর মধ্যে একজন বুজুর্গ ও আল্লাহ ওয়ালা সেনানায়ককে দায়িত্ব দিলেন সিলেট অভিযানে। তিনি ছিলেন সৈয়দ নাসির উদ্দীন। এদিকে বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এসময় শাহ জালালও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহ জালাল উদ্দিনের সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন তার কাছেও নিজের পুত্র হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেন।
শাহ জালাল উদ্দিন দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীনসহ ২৪০ জন সঙ্গীসহচর সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। শাহ জালাল সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহ জালাল সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহ জালালের শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন জিহাদী সাথী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ শাহ জালাল নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সিকান্দর গাজী সোনারগাঁয়ে অপেক্ষা করছিলেন।
সিকান্দর গাজী শাহ জালাল উদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে শাহ জালালের শিষ্য সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জনে পৌঁছায়। এদিকে গৌর গৌবিন্দ শাহ জালালের সমাগম সংবাদ পেয়েছেন। নতুন এ দল যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে জন্য নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়। জনশ্রুতি আছে, তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বিনা বাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন। শাহ জালাল উদ্দিনের এই অভিনব আগমনে ভীত হয়ে যুদ্ধ ছাড়াই পলায়ন করে গৌর গোবিন্দ। সিলেট শহরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম হযরত শাহ জালাল উদ্দিন (রঃ) এর আদেশে সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দিন আজান দেন। বুজুর্গ নাসির উদ্দিনের আজানের ধ্বনিতে গৌর গোবিন্দের যাদুগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। যাদুবিদ্যার স্থান ও মন্দির ধ্বসে পড়ে।
পরবর্তিতে সুলতানি আমলজুড়ে দ্রাবিড় তথা বাঙালিরা গরু কুরবানী করে মুশরিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। এটি ধীরে ধীরে বাঙালিদের কালচারে পরিণত হয়েছে। ইংরেজ আমলে যখন হিন্দু জমিদাররা আবারো মুসলিমদের উপর চেপে বসে তখনো গরু কুরবানী নিয়ে বাঙালিদের বহু নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। পাকিস্তান আমল থেকে বাঙালিরা আবারো মহা সমারোহে গরু কুরবানী করতে শুরু করে মুশরিকদের বহুদিনের নির্যাতনের প্রতিবাদে।
আমাদের গরু কুরবানী শুধু কুরবানী নয়, এটি মুশরিকদের রসমের প্রতিবাদ ও কুরআনের নিদর্শনের বাস্তবায়ন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন