২২ মে, ২০২৫

বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ইসলামপন্থীদের ঐক্যে আমাদের করণীয়

জুলাই বিপ্লবের পর নতুন বাংলাদেশে দাবি উঠেছে ইসলামপন্থীদের এক হওয়ার। দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদের কবলে পড়ে আমরা এক হতে পারিনি। এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন ইসলামপন্থীদের মধ্যে বিভাজন জিইয়ে রেখেছে। এখন সময় এসেছে তা নিরসন করার। 

সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষায় ঐক্য জরুরি বিষয়। পবিত্র কোরআনে বারবার মুমিনদের ঐক্যের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। বিভাজন বিশৃঙ্খলা উসকে দেয়; অশান্তি সৃষ্টি করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখো এবং বিভেদ কোরো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো।

তোমরা একে অপরের শত্রু ছিলে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরগুলো জুড়ে দিলেন, ফলে তাঁর দয়ায় তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে। …’ (সুরা আল ইমরান: ১০৩)

দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে বিবাদে জড়ানো মুমিনদের কাজ নয়। মুসলমানেরা যখন বিভেদ জিইয়ে রাখে, তখন ধীরে ধীরে তাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় এবং শত্রুদের সামনে টিকে থাকা তাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করো এবং পরস্পর কলহ কোরো না। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে। …’ (সুরা আনফাল: ৪৬)

বিভেদ তৈরি হয়ে গেলে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ ত্যাগ করে কোরআন-সুন্নাহর সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াই মুমিনের কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে আল্লাহ ও রাসুলের ওপরই বিষয়টি ন্যস্ত করো, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হয়ে থাকো। এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ।’ (সুরা নিসা: ৫৯)

বিবদমান দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করে দেওয়া অন্য মুসলমানদের দায়িত্ব। ইনসাফ ও তাকওয়ার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ কথারই নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘সব মুমিন ভাই ভাই। কাজেই তোমাদের ভাইদের মধ্যে শান্তি-সমঝোতা করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজরাত: ১০)

কখনো যদি মুসলমানদের বিভেদ চরমে পৌঁছায় এবং তা যুদ্ধ ও হানাহানিতে রূপ নেয়, তখন সবার জন্য সমঝোতার পথ অবলম্বন করা আবশ্যক। তবে সমঝোতার পরও কেউ সীমা লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুমিনদের দুটি দল যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। এরপর তাদের এক দল যদি অন্য দলের ওপর বাড়াবাড়ি করে, তবে বাড়াবাড়ি করা দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো—যতক্ষণ না তারা আল্লাহর ফায়সালার পথে ফিরে না আসে। …’ (সুরা হুজরাত: ৯)

ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়ায় আলেম-ওলামাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রদানকারী। তাঁদেরই এগিয়ে আসতে হবে এই সংকট মোকাবিলায়। আলেম সমাজ ও আমাদের করণীয়। 

১. ঐক্যের গুরুত্ব অনুধাবন ও প্রচার: 
সর্বপ্রথম আলেম-ওলামাদের নিজেদের মধ্যে ইসলামপন্থীদের ঐক্যের অপরিহার্যতা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঐক্যের গুরুত্ব ও ফযিলত সাধারণ মানুষ ও ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের কাছে তুলে ধরতে হবে। মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর ইসলামি স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে হবে।

২. জনমত গঠন: 
ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি কল্যাণমূলক সমাজ বিনির্মাণের পক্ষে এবং অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করতে আলেম-ওলামারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। একটি শক্তিশালী জনমত ঐক্যবদ্ধ ইসলামপন্থী শক্তির ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

৩. সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন:
বিভক্ত দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিরপেক্ষ আলেমগণকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে হবে।

৪. সংলাপ ও সমঝোতার উদ্যোগ:
বিভিন্ন ইসলামপন্থী দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং নীতি নির্ধারকদের মধ্যে আন্তরিক সংলাপ ও আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টিতে আলেম-ওলামারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁরা নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য কমিয়ে এনে একটি সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারেন।

৫. সচেতনতা সৃষ্টি:
সাধারণ জনগণের মধ্যে ইসলামী রাজনীতির গুরুত্ব এবং ইসলামপন্থীদের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে খুতবা, মাহফিল ও মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

৬. নৈতিক চাপ প্রয়োগ:
যেসব রাজনৈতিক নেতারা ব্যক্তিগত স্বার্থে বিভাজন তৈরি করছেন, তাঁদের ওপর নৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তাঁরা উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে একত্র হতে বাধ্য হন।

৭. দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে অবস্থান: 
আলেম-ওলামাদের কোনো বিশেষ দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য না দেখিয়ে বৃহত্তর ইসলামি উম্মাহর কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করলে তা সকলের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে।

৮. যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচি প্রণয়নে সহায়তা:
ইসলামপন্থী দলগুলো যেন নিছক আবেগসর্বস্ব বা অবাস্তব কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করে, সেদিকে আলেম-ওলামাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, সাংবিধানিক কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে যুগোপযোগী ও বাস্তবায়নযোগ্য কর্মসূচি প্রণয়নে তাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা প্রদান করতে পারেন।

৯. তরুণ আলেমদের সম্পৃক্ত করা: 
তরুণ, আধুনিক-মনস্ক আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের ঐক্য প্রচেষ্টায় যুক্ত করা দরকার, যাতে নতুন প্রজন্মের আস্থা অর্জন করা যায়।

১০. ইসলামী মূল্যবোধে অটল থাকা:
ক্ষমতা বা প্রভাবের লোভে কোনো আপস না করে ইসলামি আদর্শ ও নীতির প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

১১. নেতৃত্ব নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতা:
যদি ইসলামপন্থীদের কোনো সমন্বিত জোট গঠিত হয়, তবে তার নেতৃত্ব নির্বাচনে স্বচ্ছতা, যোগ্যতা, দূরদর্শিতা এবং ইসলামি জ্ঞানের গভীরতাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়ে আলেম-ওলামাদের সোচ্চার হতে হবে। ব্যক্তিগত পছন্দ বা গোষ্ঠীতন্ত্রের চেয়ে বৃহত্তর স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে।

১২. শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থার অনুসরণ: 
রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সর্বদা শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বনের জন্য ইসলামপন্থী দলগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। যেকোনো ধরনের সহিংসতা বা উগ্রপন্থা পরিহার করে আলাপ-আলোচনা ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে থাকার পরামর্শ দিতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন