৩০ সেপ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৫৩ : ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের নাটকীয়তা

 


১৯৫৪ সালের আগে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলা দরকার। তাহলে সে সময়ের পরিস্থিতি কিছুটা উপলব্ধি করা যাবে এবং যুক্তফ্রন্টের প্রেক্ষাপট বুঝা যাবে। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার কালে মোটাদাগে বাংলায় রাজনৈতিক দল ছিল দুইটি। এক মুসলিম লীগ, দুই কৃষক প্রজা পার্টি। ১৯৪৫-৪৬ সালের পরিস্থিতিতে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি অস্তিত্ব হারিয়েছে হিন্দুদের সাথে মিলিত হওয়ার দায়ে। একইসাথে বাংলার মানুষের কাছে ফজলুল হক প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর তিনি রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে আইন পেশায় সময় দিতে থাকেন। 

এছাড়া জামায়াতে ইসলামী তখন একেবারে ক্ষুদ্র একটি দল। রাজনীতিতে যাদের খুব একটা প্রভাব নেই। এছাড়াও আরেকটি দলের অস্তিত্ব তখন ছিল তারা হলো জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। এটা হলো আলিয়া ও দেওবন্দি আলেমদের একটি বিচ্ছিন্ন দল যারা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ থেকে আলাদা হয়েছেন। আলেমদের মধ্যে যারা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানকে সাপোর্ট করেছেন তারা হুসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্বকে অস্বীকার করে আলাদা দল গঠন করেন। এদের নেতা ছিলেন শাব্বির আহমদ উসমানী। এই দলের উতপত্তিই হয়েছিল মুসলিম লীগকে সাপোর্ট করার জন্য। 

সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে নবগঠিত পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ছাড়া আর কারো প্রভাব ধর্তব্য ছিল না। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। তাদের প্রভাবে দলের মধ্যে প্রায় কোণঠাসা ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারীরা। তারা মূলত ইসলামী চেতনা ধারণ করতেন না। তারা মুসলিম জাতীয়তাবাদটাকেই বেশি ধারণ করতেন। তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। সোহরাওয়ার্দির নির্দেশে তার অনুগত শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে এসে তাদের সাথে যুক্ত হন।

এদিকে ভাসানী এবং তার অনুসারীরা মুসলিম লীগকে সমাজতান্ত্রিক বামধারায় রূপান্তর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইসলামী চেতনাধারীদের তোপের মুখে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। ভাসানী টাঙ্গাইলের আরেক নেতা শামসুল হককে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বুঝান এবং তার সাথে রাখেন। ভাসানী আদর্শিক বিষয় গোপন রেখে বাঙালিদের নিয়ে আলাদা দল গঠনের উদ্যোগ নিতে থাকেন। তারই প্রস্তুতি হিসেবে সোহরাওয়ার্দির সাথে যোগাযোগ করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর সেক্রেটারি শামসুল হক। ঘটনাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু'জনেই টাঙ্গাইলের। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আর এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

নিখিল পাকিস্তানে এই দলটি আসলে কার্যকর ছিল না। এটা মূলত বাঙালিদের একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠেছে। 

ভাসানী এই দলটিকে মুসলিম লীগ বিরোধী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা বাঙালিদের মধ্যে মুসলিম লীগ বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি করে। ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশে আওয়ামী যুবলীগ সকল বিরোধীদলের ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুরুতেই ‘গণতান্ত্রিক দল’ ও ‘আওয়ামী লীগ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দও মুসলিম লীগ বিরোধী জোটের জন্য কাজ করতে থাকে।  

এর সূত্র ধরে ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিশেন মুসলিম লীগ বিরোধী জোট গঠনের উদ্দেশে সমমনা দলসমূহ নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভাসানী শেরে বাংলাকে আবারো রাজনীতিতে আসার জন্য অনুরোধ করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা জারির সঙ্গে সঙ্গে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের নির্বাচনে তার দলের ভরাডুবি ঘটলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তখন নূরুল আমিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ফজলুল হককে পূর্ববাংলার এটর্নি জেনারেল পদে নিযুক্ত করেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পুনরায় রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে তার ১৯৩০ এর দশকের নিজস্ব দল কৃষক-প্রজা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। নাম পরিবর্তন করে এর নতুন নামকরণ করেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি (KSP)। 

আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তিনি যুক্তফ্রন্টে যোগ দেন। যুক্তফ্রন্টের আরেকটি শরিকদল- নেজামে ইসলাম যাদের পূর্ব নাম ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর মুসলীম লীগ নেতৃবৃন্দের ওয়াদা ভঙ্গের ফলে নবগঠিত পাকিস্তানে 'নেজামে ইসলাম' তথা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সুদূর পরাহত দেখে তারা নিরাশ হয়ে পড়েন। এক প্রকার প্রতারিত হয়েই ১৯৫২ সালে নিখিল ভারত জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের সঙ্গ ত্যাগ করে 'নেজামে ইসলাম পাটি' নামে পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলায় দলটির কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অধিবেশনেই মাওলানা আতহার আলীকে সভাপতি, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক এবং মাওলানা আশরাফ আলীকে সহকারী সম্পাদক নির্বাচিত করে 'নেজামে ইসলাম পার্টি'র কার্যক্রম শুরু হয়। যেকোন মূল্যে পাকিস্তানে নেজামে ইসলাম তথা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে এই পার্টির প্রধান লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়। মুসলিম লীগের তুলনায় এই দলের নেতৃতে বড় বড় উলামা থাকায় অল্পদিনেই নেজামে ইসলাম পার্টি একটি শক্তিশালী বৃহৎ দলে পরিণত হয়। 

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বুঝতে পেরে নেজামে ইসলাম যুক্তফ্রন্টে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশেষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি এবং নেজামে ইসলামীর সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যদিও যুক্তফ্রন্ট গঠনের মূল উদ্যোক্তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, গণতন্ত্রী দল ও যুবলীগ; কিন্তু শেরে বাংলা ও নেজামে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের বিরোধীতায় এই দলগুলিকে ফ্রন্টভুক্ত করা হয়নি। তবে ভাসানীর চেষ্টায় গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য আওয়ামী মুসলিম লীগের নামে নমিনেশন লাভ করেন। ১৫ জন যুবলীগ সদস্য, ১০ জন গণতন্ত্রী দলের সদস্য এবং ১০ জন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য আওয়ামী লীগের পরিচয়ে যুক্তফ্রন্টের নমিনেশন লাভে সমর্থ হয়। 

নির্বাচনে যাওয়ার আগে আরো একটি দল যুক্তফ্রন্টে যোগ দিতে চেয়েছে। তারা হলো খেলাফতে রব্বানী পার্টি। এই উদ্দেশে ১৯৫৩ সালের ১৬ নভেম্বর ঢাকার গোপীবাগে পার্টির সভাপতি জনাব আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তারা যুক্তফ্রন্টে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেই। খেলাফতে রব্বানী হলো তমুদ্দুন মজলিশের ফাদার অর্গানাইজেশন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তমুদ্দুনকে অনেকে বাম কমিউনিস্টদের আরেকটি রূপ বলে ধরে নিয়েছে। তাই খেলাফতে রব্বানীও শেরে বাংলা ও মাওলানা আতাহার আলীর বিরোধীতায় যুক্তফ্রন্টে যুক্ত হতে পারেনি। তাই তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, তারা মাত্র ১০টি মুসলিম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, এবং বাকি ২২৬টি আসনের জন্য রব্বানী পার্টি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের সমর্থন করবেন। 

এদিকে বাংলায় মুসলিম লীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। তার প্রধানমন্ত্রীত্ব চলাকালে ১৯৫৩ সালে জামায়াতে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও কাদিয়ানী দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বিধায় গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মোহাম্মদ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তার আমলে দারিদ্রেরর হার বাড়ে বিধায় পশ্চিম পাকিস্তানে সমাজতন্ত্রের উত্থান হয়, এটিও তার পদচ্যুতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে পদচ্যুত হয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন বলে ঘোষণা করেন। এই কারণেই মূলত মুসলিম লীগ দূর্বল হয়ে পড়ে। ওনার পরে মোহাম্মদ আলী বগুড়া হাল ধরলেও তিনি নাজিমুদ্দিনের মতো প্রভাবশালী নেতা ছিলেন না। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের গ্রহণ যোগ্যতাও ভালো ছিল না। সর্বোপরি আলেমদের একটি বড় অংশ মুসলিম লীগকে ত্যাগ করলে মুসলিম লীগের অবস্থান নষ্ট হয়ে পড়ে।   

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তাদের নীতি ও ২১ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। 

নীতি : কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে। 

নির্বাচনী ওয়াদা :

১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে। 

২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চহারের খাজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হইবে 

৩. পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ, পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাটচাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমলের পাট কেলেঙ্কারি তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে। 

৪. কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে ও সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে। 

৫. পূর্ববঙ্গকে লবণশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমস্ত উপকূলে কুটিরশিল্প ও বৃহৎশিল্পে লবণ তৈয়ারির কারখানা স্থাপন করা হইবে এবং মুসলিমীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হইবে।  

৬. শিল্প ও কারিগরি শ্রেণীর গরিব মুহাজিরদের কাজের আশু ব্যবস্থা করিয়া তাহাদের পুনর্বসতির ব্যবস্থা করা হইবে। 

৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে। 

৮. পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকলপ্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হইবে। 

৯. দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে। 

১০. শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয়সমূহকে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে। 

১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয় সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে। 

১২. শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হইবে এবং তদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভোগীদের বেতন কমাইয়া কম বেতনভোগীদের বেতন বাড়াইয়া তাহাদের আয়ের একটি সুষ্ঠু সামঞ্জস্য বিধান করা হইবে। যুক্তফ্রন্টের কোনো মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ করিবেন না।

১৩. দুনীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা করা হইবে এবং এতদুদ্দেশে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পদাধিকারী ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাবনিকাশ লওয়া হইবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ দিতে না পারিলে তাহাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে। 

১৪. জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করত বিনাবিচারে আটক বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য-আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা সমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে। 

১৫. বিচার বিভাগকে শাসন-বিভাগ হইতে পৃথক করা হইবে। 

১৬. যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলাভাষা গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে। 

১৭. বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যাহারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হইয়াছেন তাহাদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হইবে এবং তাহাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে। 

১৮. ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করিয়া উহাকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হইবে। 

১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত সমস্ত বিষয় (অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তান অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করত পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে। 

২০. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোনো অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াইবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবে। 

২১. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হইবে, তিন মাসের মধ্যে তাহা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইবে এবং পর পর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হইলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিবেন। 

১৯৫৪ সালে মার্চের ৮-১২ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে একটি বড় অংশ মানুষ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। এর কারণ সম্ভবত মুসলিম লীগের নিষ্ক্রিয়তা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ৩৭% ভোট কাস্ট হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে মোট আসন ছিল ৩০৯ টি। এর মধ্যে মুসলিম আসন ছিল ২৩৭ টি। এর মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন, যুক্তফ্রন্ট ২১৫টি আসন, খেলাফতে রব্বানী ১টি আসন ও বাকীগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতে নেয়। পরবর্তীতে স্বতন্ত্রদের একজন মুসলিম লীগে ও আটজন যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয়। ফলে মুসলিম লীগের জয়ী আসন হয় ১০টি আর যুক্তফ্রন্টের জয়ী আসন হয় ২২৩টি।  

প্রচণ্ড জনপ্রিয় মুসলিম লীগের এই পতনের কারণ যা পাওয়া যায় তা হলো, 

১- দল ভেঙে যাওয়া ও বহু প্রভাবশালী নেতার আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান 

২- লবণ, কোরোসিন ও সরিষার তেল প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। 

৩- দীর্ঘ ৭ বছরেও সংবিধান প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হওয়া। 

৪- ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নূরুল আমিন সরকারের দমন-নীতি 

৫- খাজা নাজিমুদ্দিনের নীরব থাকা 

৬-  লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববাংলাকে স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া

৭- পূর্ববাংলার জনগণের আর্থিক দুর্দশা। 

৮- মুসলিম লীগের গণসংযোগের অভাব। 

৯- দুর্নীতি দমনে সরকারি ব্যর্থতা 

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জিতে যাওয়া মূলত মুসলিম লীগের অদক্ষতার কারণেই হয়েছে। এর বাইরে আরেকটি কারণ ছিল যুক্তফ্রন্ট নেতাদের প্রচারণা ছিল চোখে পড়ার মতো। সারাদেশে সাংগঠনিক মজবুতি ও নির্বাচন মনিটর করার জন্য ভাসানী কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। একইসাথে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবেন বলে প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রার্থী হন নি। সেই সুবাদে এই দুই নেতা সারা বাংলায় জনসমাবেশ করে বেড়িয়েছেন। 

নির্বাচনে সরকারি দলের এমন শোচনীয় পরাজয় ছিল বিরল ঘটনা। পূর্ববাংলার তৎকালীন সরকার নির্বাচনে পরাজয়ের সম্ভাবনা এড়ানোর জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেন, কিন্তু নির্বাচনে কারচুপির প্রচেষ্টা করেননি। এই নির্বাচনে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যালটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ লাভ করেছিল এবং তারা উক্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের ফলে পাকিস্তান গণপরিষদে তাদের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পায়, ফলে পাকিস্তানের কোয়ালিশন সরকার গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কেন্দ্রের সরকার যুক্তফ্রন্টের সাথে কোয়ালিশন করে। যুক্তফ্রন্ট থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তখন মোহাম্মদ আলী বগুড়া ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। 

এদিকে যুক্তফ্রন্টের পার্লামেন্টারি বোর্ডের প্রধান নির্বাচিত হন শেরে বাংলা ফজলুল হক। কারণ সোহরাওয়ার্দি ও ভাসানী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। সেই জন্য শেরে বাংলা পূর্ববাংলায় সরকার গঠনের আমন্ত্রণ পান এবং তার নেতৃত্ব ৩ এপ্রিল (১৯৫৪) চার সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির সৈয়দ আজিজুল হক ও আবু হোসেন সরকার এবং নেজামে ইসলামীর মৌলভী আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী। প্রাদেশিক আইন পরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন যথাক্রমে কৃষক শ্রমিক-পার্টির আবদুল হাকিম এবং আওয়ামী লীগের শাহেদ আলী। ১৫ মে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীসভা গঠন করেন এবং বাংলার মূখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক। মন্ত্রী পরিষদ গঠন নিয়ে শেরে বাংলা ও আওয়ামীলীগের সাথে ব্যাপক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শেরে বাংলা কিছু কিছু নেতা যেমন শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খানকে কোনোভাবেই মন্ত্রীসভায় নিতে প্রস্তুত ছিলেন না।    

যাই হোক, শেরে বাংলা আওয়ামীলীগের চাপে মন্ত্রিসভা গঠন করেন নিজের অপছন্দের ব্যাক্তিরাসহ। মন্ত্রীসভার সদস্যরা হলেন, এ কে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন; আবু হোসেন সরকার অর্থ; আতাউর রহমান খান বেসামরিক সরবরাহ; আবুল মনসুর আহমদ জনস্বাস্থ্য; কফিল উদ্দিন চৌধুরী বিচার ও আইন; সৈয়দ আজিজুল হক শিক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন; আবদুস সালাম খান শিল্প ও পূর্ত; শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন; আবদুল লতিফ বিশ্বাস রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার; আশরাফ আলী চৌধুরী সড়ক ও গৃহ নির্মাণ; হাশিম উদ্দিন আহমদ বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন; রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী স্বাস্থ্য ও কারা; ইউসুফ আলী চৌধুরী কৃষি, বন ও পাট এবং মোয়াজ্জেম উদ্দিন হোসেন জমিদারি অধিগ্রহণ।

মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরুর আগে আদমজী জুট মিলে দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গায় ১ হাজার ৫০০ নিরপরাধ শ্রমিক নিহত হন। শুরুতেই এমন একটি বিপর্যয় প্রাদেশিক সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে। শপথ নেয়ার পর শেরে বাংলা কলকাতায় সফরে যান এবং সেখানে হিন্দু মহাসভার কয়েক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। সেসব বক্তব্যে তিনি হিন্দু মহাসভার পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে এক করার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। এরপর ঢাকায় তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাতকারে তিনি সাংবাদিক কালাহানকে বলেছেন, বাংলাকে স্বাধীন করা তাঁর প্রথম কাজ।’ কলকাতার বক্তব্য ও সাক্ষাৎকারের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয় ঢাকায়। মাত্র কয়েকদিন আগে বিপুল ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধান ফজলুল হকের বিরুদ্ধে সারা বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। ফজলুল হকের পদত্যাগের দাবি জোরালো হতে থাকে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩১ মে দেশদ্রোহের অভিযোগে এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন।

শেরে বাংলা ফজলুল হককে গৃহবন্ধী করা হয়। আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করার অপরাধে শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগের বহু নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। এদিকে সোহরাওয়ার্দি ছিলেন পাকিস্তানে। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আর ভাসানী ইউরোপ সফরে ব্যস্ত ছিলেন। সদ্য নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকার অল্পদিনের মধ্যেই লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে।  যুক্তফ্রন্টের এই বেহাল দশা দেখে শেখ মুজিব আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এই দিন থেকে বাঙালীদের দুঃখের দিন শুরু হলো। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কাজ করতে নামতে নেই, তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশ বেশি হয়।’

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন। প্রায় সাত মাস বন্দী জীবন যাপন করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। এরপর দলের নির্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান করাচি গমন করেন। সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন:

আমি তাঁর (সোহরাওয়ার্দী) সঙ্গে বেয়াদবি করে বসতে পারি। পরের দিন সকাল নয়টায় আমি হোটেল মেট্রোপোলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।…তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, “বুঝেছি, আর বলতে হবে না, বেলা তিনটায় এসো, অনেক কথা আছে।” আমি বেলা তিনটায় গিয়ে দেখি, তিনি একলা শুয়ে বিশ্রাম করছেন।…আমি তাঁর কাছে বসলাম। তিনি আলাপ করতে আরম্ভ করলেন। অনেকক্ষণ আলাপ করলেন, তার সারাংশ হলো গোলাম মোহাম্মদ জানিয়ে দিয়েছেন যে মন্ত্রিসভায় যোগ না দিলে তিনি মিলিটারিকে শাসনভার দিয়ে দেবেন। আমি বললাম, পূর্ব বাংলায় গিয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য কাউকেও তো মন্ত্রিত্ব দিতে পারতেন। আমার মনে হয়, আপনাকে ট্র্যাপ করেছে। ফল খুব ভালো হবে না, কিছুই করতে পারবেন না। যে জনপ্রিয়তা আপনি অর্জন করেছিলেন, তা শেষ করতে চলেছেন।

মাওলানা ভাসানী ইউরোপ থেকে ফিরে কলকাতায় একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেই। যুক্তফ্রন্ট নিষ্ক্রিয়প্রায়। এদিকে গোলাম মুহাম্মদ কেএসপি নেতা আবু হোসেন সরকারকে কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা মাওলানা ভাসানীর দেশে ফিরে আসার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় ভাসানী ১৯৫৫ সালের ২৬ এপ্রিল কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।’

এদিকে মুসলিম লীগের মোহাম্মদ আলী বগুড়ার সাথে শেরে বাংলার সমঝোতা হয়ে যায়। বগুড়ার পরামর্শে ফজলুল হক আওয়ামীলীগকে ছাড়াই পুনরায় মন্ত্রীসভা গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এটা সঠিক কাজ ছিল না, কারণ আওয়ামীলীগ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এতে ক্ষিপ্ত হয় সোহরাওয়ার্দি এবং ভাসানী। কিন্তু তাদের কিছু করার ছিল না কারণ তারা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নন। তাই তারা শেখ মুজিবকে দিয়ে শেরে বাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। তারা ভেবেছিল এতে শেরে বাংলা মূখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন না। ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টারি নেতা হিসেবে ফজলুল হকের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে শেখ মুজিব। কিন্তু এতে আওয়ামী লীগের জন্য হিতে বিপরীত হয়। ৩২ জন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য পার্টি পরিবর্তন করে কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন। এই ধারা অব্যাহত থাকে, ফলে ২ এপ্রিল (১৯৫৫)এর মধ্যেই আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যসংখ্যা ১৪০ থেকে ৯৮-এ নেমে আসে। তখন কৃষক শ্রমিক পার্টির সদস্য সংখ্যা ৩৪ থেকে বেড়ে ৬৯ হয় এবং নেজামে ইসলামীর সদস্য সংখ্যাও বেড়ে ১২ থেকে ১৯ হয়। 

তাছাড়া ১৯৫৫ সালের শুরুর দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ভাসানী মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলের নাম শুধু আওয়ামী লীগ করে। এই ‘মুসলিম' শব্দ বাদ দেবার কারণে ২০ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলবদ্ধ হয় এবং তারা কৃষক-শ্রমিক পার্টি ও নেজামে ইসলামীকে সরকার গঠনের ব্যাপারে সমর্থন দেয়। এইভাবে যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে আওয়ামী লীগ এবং অন্যদিকে কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলামী এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ। গণতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্ট দলের সদস্যবৃন্দ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, অন্য দিকে খিলাফতে রব্বানী পার্টি ও কিছু হিন্দু-সদস্য ফজলুল হকের জোটকে সমর্থন দেন। এইভাবে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টভুক্ত মুসলমান সদস্যবৃন্দ দুই ধারায় বিভক্ত হয়। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় গঠিত মন্ত্রিসভা ‘যুক্তফ্রন্ট’ নাম নিয়েই শপথ নিয়েছিল। অর্থাৎ যুক্তফ্রন্ট সরকারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল, তবে এখানে আওয়ামীলীগের কেউ ছিল না। 

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ধারাটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে গ্রহণ করে, অপরপক্ষে ফজলুল হকের জোট মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতি গ্রহণ করে মুসলিম লীগের নিকট নিজেদেরকে গ্রহণযোগ্য করে তুলে। আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার অস্তিত্ব রক্ষার্থে ১৯৫৬ সালে ৫ মার্চ ফজলুল হক পূর্ববাংলার গভর্নর পদ লাভে সক্ষম হন। গভর্নর পদে যোগদান করে ফজলুল হক ২২ মে ১৯৫৬ তারিখে প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশন আহবান করেন। কিন্তু বাজেট পাস করাতে ব্যর্থ হলে মন্ত্রিসভার পতন হবে এই আশঙ্কায় গভর্নর ২৪ মে (১৯৫৬) আইনসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখেন। পূর্ববাংলায় মন্ত্রিসভা সংবিধান অনুসারে চালানো যাচ্ছে না এই কারণ দেখিয়ে জরুরি ক্ষমতা বলে এখানে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। সাত দিন পর কেন্দ্রের শাসন প্রত্যাহার করে আবু হোসেন সরকারের পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা পুনর্বহাল করা হয়। 

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে উত্থাপিত খসড়া-সংবিধান সমর্থন করে আবু হোসেনের মন্ত্রীসভা। অপরদিকে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র রূপে ঘোষণা করাকে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে বিরোধিতা করে ভাসানীর নির্দেশে। কিন্তু আওয়ামীলীগের মূল নেতা সোহরাওয়ার্দি ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেন। আওয়ামী লীগ সংবিধানে যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা ও পূর্ববাংলার জন্য অধিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি করে। কিন্তু গণপরিষদে কৃষক-শ্রমিক পার্টি মুসলিম লীগকে সমর্থন করায় কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার সংবিধান পাস করিয়ে নিতে সমর্থ হন। আওয়ামী লীগ গণপরিষদ থেকে ওয়াকআউট করে এবং সংবিধানে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে। তবে সোহরাওয়াদী ব্যক্তিগতভাবে সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।

২৮ সেপ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৫২ : ভাষা আন্দোলন ও এর ঘটনা প্রবাহ


১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশ তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তখন একটি প্রদেশ হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে, সে সিদ্ধান্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে আগেই ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আলোচনা চলাকালে এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। এর মধ্যেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে যায়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরুতে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। এর প্রতিবাদ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, তদানীন্তন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগই ছিল পূর্ববঙ্গের অধিবাসী এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা। এটাই ছিল ড. শহীদুল্লাহর একমাত্র যুক্তি। 

অন্যপক্ষে অবিভক্ত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হিন্দুদের হিন্দি-প্রীতির বিপরীতে মুসলমানদের উর্দুর প্রতি একটা সহজাত দুর্বলতা ছিল। তা ছাড়া উপমহাদেশীয় মুসলমানদের প্রাচীনপন্থি ও আধুনিকপন্থি উভয় ধরনের শীর্ষ শিক্ষাকেন্দ্র যথাক্রমে দেওবন্দ ও আলীগড় উর্দু অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় উর্দুর প্রতি  প্রাচীন ও আধুনিক উভয়পন্থী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে একটা সমীহ বোধ ছিল। উর্দু ছিল সকল মুসলিমের কাছে বোধগম্য একমাত্র ভাষা। যদিও পাকিস্তানে বাঙালি বেশি তবে বাঙালি ছাড়া আর কেউ বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত ছিল না। সুতরাং উর্দু রাষ্ট্রভাষা না হলে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী সমস্যায় পড়ে যাবে। 

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বহু অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমান পরিবারে উর্দুতে কথাবার্তা বলা একটা আভিজাত্যের পরিচায়ক বলে মনে করা হতো। অন্যদিকে ঢাকা মহানগরীর আদি অধিবাসীদের মধ্যে উর্দু-বাংলা মিশ্রিত এক ভাষা বহুল প্রচলিত থাকায় তারাও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে সুনজরে দেখেননি বরং মুশরিকদের ষড়যন্ত্র হিসেবেই গণ্য করেছে। এসব কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন মোটেই গণদাবি বা জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল না। ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা পরে হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই এ নিয়ে আলোচনা, বাদ-প্রতিবাদ, লেখালেখি শুরু হয়। এসব বাদ-প্রতিবাদ ও লেখালেখিতে বাংলার পক্ষে অংশগ্রহণ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রাবন্ধিক আবদুল হক, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ। 

উর্দু কারো মাতৃভাষা ছিল না। এটি একটি লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা। লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা মানে হল আন্তঃযোগাযোগীয় ভাষা। যেটি কয়েকটি ভাষার সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের (যেমন সিলেট, নোয়াখালী, বরিশাল, রংপুর ও চট্টগ্রাম) মানুষ যখন একটা অফিসে বাংলা একাডেমীর ঠিক করে দেয়া কলকাতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা 'প্রমিত' বাংলায় কথা বলে, তখন কিন্তু সেখানে এক প্রকার লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কাই ব্যবহার করে। এখানেও মাতৃভাষার উপরে একটা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা চাপানো হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য এটাই জরুরি। 

হিন্দি নামটি ফার্সি থেকে এসেছে। পারস্যের অধিবাসীরা ভারতীয় লোক ও তাদের ভাষাকে হিন্দি নামে ডাকতো। ইতিহাসবিদেরা তাই মনে করেন। ৮ম-১০ম শতকের দিকে ভারতে মুসলিম আক্রমণের সময় উত্তর ভারতের খাড়ি বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লি এলাকার ভাষা, এবং বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা সাধারণ জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য এই ভাষাই ব্যবহার করতেন। এই খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফার্সি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করলে উর্দু নামের এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে। 

উর্দু শব্দটি তুর্কি "ওর্দু" শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ "শিবির" বা "ক্যাম্প"। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় আরবি-ফার্সির তেমন প্রভাব পড়েনি, বরং তারা সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ ও সাহিত্যিক রীতি ধার করতে শুরু করে এবং এভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। সেই হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের মুসলিমরা উর্দু আর অন্যরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। পাকিস্তানের সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মাতৃভাষাগুলো ছিল বাংলা, পাঞ্জাবী, বেলুচ, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি। এর মধ্যে উর্দুই ছিল বোধগম্যতার দিক দিয়ে কমন যা হিন্দীর অনুরূপ। তাই এই ভাষাই মুসলিমদের ভাষা হয়ে ওঠে।

মুসলিম লীগের তথা পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাদের প্রদেশগুলোর মধ্যে কমন ভাষা চালু করার জন্যই উর্দুকে সিলেক্ট করেছে। আর বিষয়টা এমন ছিল না যে উর্দু অপ্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। প্রত্যেক জাতি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বঞ্চিত করেছে সংহতি রক্ষার জন্য। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ভিন্ন দাবি করেছে আমাদের কিছু বাঙালি ছাত্র। বাংলার সব মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল এটাও সঠিক নয়। ঢাকায় সেসময় প্রচুর ছাত্র উর্দুর পক্ষেও ভূমিকা রেখেছিলো। বাংলার কোন রাজনৈতিক নেতা বায়ান্নোর আগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। ঢাকা ভার্সিটি ও জগন্নাথ কলেজের (তখন কলেজ ছিল) কিছু ছাত্র ছাড়া এই আন্দোলন অন্য কেউ করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সর্বপ্রথম অফিসিয়ালি উত্থাপন করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তৎকালীন সকল বাঙ্গালী সংসদ সদস্যরা ওনার বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃএব এটা বাংলার গণমানুষের দাবী এটা বলা অযৌক্তিক। 

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করে তমুদ্দুনে মজলিশ ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বরে। তমুদ্দুনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ভাষা আন্দোলনের মেনিফেস্টোরূপী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ নামের একটি ছোট বই। এই বইয়ে স্থান পায় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবদুল মনসুর আহমদ এবং তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ লেকচারার অধ্যাপক আবুল কাসেমের তিনটি নিবন্ধ।

তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ওই পুস্তিকার প্রথম নিবন্ধই ছিল অধ্যাপক আবুল কাসেমের। তমুদ্দুনের পক্ষ থেকে তার লিখিত “আমাদের প্রস্তাব” শীর্ষক নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি উত্থাপিত হয় দুইটি। 

১. বাংলা ভাষাই হবে -

(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন

(খ) পূর্ব পাকিস্তানে আদালতের ভাষা

(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।

২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি :

উর্দু ও বাংলা।

সমগ্র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই মূল দাবিতেই পরিচালিত হয়। অধ্যাপক আবুল কাসেম তার নিবন্ধে এক পর্যায়ে বলেন, "গণপরিষদের প্রত্যেক সদস্যের কাছে ডেপুটেশন নিয়ে তারা যেন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে মত দিয়ে বাঙালির আত্মহত্যার পথ সুগম না করেন, তা স্পষ্ট বুঝাতে হবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করায় বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এ পরিস্থিতির সুযোগ নেন নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসনের উচ্চ স্তরের কর্মকর্তারা।"

পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত না হওয়ায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না নেয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা শুরু করে দেন। তার প্রমাণ পাওয়া যায়, নতুন রাষ্ট্রের পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুর ব্যবহার থেকে। এই প্রেক্ষাপটে নবগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে দেয়। এ দাবিকে শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যক্তিগত যোগাযোগের পাশাপাশি আলোচনা সভা অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করে দেন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল কাসেম। 

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার অধ্যাপক নূরুল হক ভুইয়াকে আহ্বায়ক করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, কবি জসীমউদ্দিন, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। ১৯৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মওলানা আকরম খাঁসহ কয়েকশ চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও ছাত্রনেতাদের স্বাক্ষরসহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়। 

এর বিপরীতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধী আন্দোলনও তখন জমে উঠে। এই প্রসঙ্গে আবুল কাসেম বলেন, "এদিকে উর্দু সমর্থক আন্দোলন গড়ে উঠে। স্বনামখ্যাত মৌলানা দ্বীন মোহাম্মদ সাহেব প্রমুখকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল্লায় ও মফস্বলের বহুস্থানে উর্দুকে সমর্থন করে বহু সভা করা হয়। এরা কয়েক লাখ দস্তখত যোগাড় করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক মেমোরেণ্ডাম পেশ করেন। পথেঘাটে ইস্টিমারে এ স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ চলে। স্বাক্ষর সংগ্রহের পর কয়েকজন নামকরা ব্যক্তি করাচীতে গিয়ে সরকারের কাছে পেশ করে আসেন।"  

যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে ছিলেন তারা কেউ কিন্তু অবাঙালি ছিলেন না। তাদের যুক্তি হলো পূর্ব পাকিস্তানে যদি বাংলাকে অফিসিয়াল ভাষা করা হয় তবে অন্যান্য অঞ্চল যেমন পাঞ্জাব, সিন্ধ, বেলুচ, কাশ্মীরে তাদের নিজস্ব ভাষা চালু হবে। এক্ষেত্রে বাঙালিদের সেসব অঞ্চলে কাজ করা ও শিক্ষাগ্রহণ করা কঠিন হবে। অন্যদিকে বাংলায় অন্যান্য জাতি গোষ্ঠির পাকিস্তানীরা আসবে না। ফলে দীর্ঘদিনের ইংরেজ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শোষণের ফলে পিছিয়ে থাকা বাংলা আরো পিছিয়ে যাবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সংহতি বিনষ্ট হবে।    

১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর করাচিতে একটি শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর প্রতিবাদে ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। এ সময় পাকিস্তান সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক ১৫ ডিসেম্বর এক সার্কুলারে বাংলাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ও উর্দুকে পরীক্ষার বিষয়ভুক্ত করায় তার বিরুদ্ধে অধ্যাপক আবুল কাসেম এক বিবৃতি দেন। আবুল কাসেম এমনভাবে বিবৃতি দেন যেন পাকিস্তানে বাঙালি বাদে আর কোনো জাতি গোষ্ঠী নেই। তার এই অনুচিত বিবৃতি ছাপে নি কোনো পত্রিকা। 

আবুল কাসেম এই বিবৃতি ৩১ ডিসেম্বর ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে ছাপার ব্যবস্থা করেন। কলকাতার ঐ পত্রিকা এ বিষয়ে পাকিস্তানের কড়া সমালোচনা করে ও বাঙালি নির্যাতনের অভিযোগ এনে “অবিশ্বাস্য” শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ওই পত্রিকায় কপি ঢাকায় নিয়ে এসে প্রচারণা চালায় তমুদ্দুনে মজলিসের কর্মীরা। এই ঘটনা ঢাকাবাসীর মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাদের আগের ধারণা সত্য হয়েছে বলে তারা মনে করেন। নতুন একটি ইসলামী ভাবধারার রাষ্ট্রে ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্যই মুশরিকরা কিছু ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়েছে। এরকমটাই ভাবতে থাকেন ঢাকাবাসী। তারা তমুদ্দুনের বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন।  

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। একমাত্র চারজন হিন্দু ছাড়া আর কোনো পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেননি। ফরিদপুরের নেতা তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে গণপরিষদের সকল বাঙালি নেতা একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ঢাকার নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক, আমরা সবাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি চাই।” পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে”। গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথের সংশোধনী প্রস্তাব ভোটে বাতিল হয়ে যায়।   

গণপরিষদে বাংলার রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব বাতিল হওয়ার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সাবেক বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থক অংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এ সংগঠন ভাষা আন্দোলনের সমর্থক হওয়ায় পুনর্গঠিত সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর নির্বাচিত হন যুগপৎ মজলিস ও ছাত্রলীগের সদস্য তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শামসুল আলম। তবে বাংলার একজন রাজনৈতিক নেতারও প্রত্যক্ষ সমর্থন না পাওয়াও ভাষা আন্দোলন গণভিত্তি তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। যাই হোক রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও মিটিং-মিছিলের মাধ্যমে ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনকারীরা খুবই সহিংস হয়ে ওঠে। তারা সচিবালয়ে ঢুকে সরকারি কর্মকর্তাদের হেনস্তা করতে থাকে। এর প্রতিরোধে মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা রাস্তায় নামে। ফলে পালিয়ে যায় ভাষা আন্দোলনকারীরা। মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা ঢাকা মেডিকেল ও ঢাবির হলে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে। পুলিশ দুই পক্ষের লোকদেরই ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। 

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিতে  স্বাক্ষর করেন। চুক্তিগুলো ছিল-

১- ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে।

২- পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।

৩- বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।

৪- সংবাদপত্রের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।

৫- আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।

৬- ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে।

৭- পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করা হবে।

৮- রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন " রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই" এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন।

পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"। এতে ভাষা আন্দোলনকারীরা ক্ষেপে যায় এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্যোগ নেয়। এরপর ২৪ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির প্রতিবাদ জানায়। জিন্নাহ তাদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী হন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্‌'র সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। বৈঠকে জিন্নাহ একক রাষ্ট্রভাষার গুরুত্ব তুলে ধরেন, পাকিস্তান নিয়ে তার চিন্তা ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। 

জিন্নাহ তাদের বুঝাতে সক্ষম হন কেন উর্দু জরুরি এবং এতেই কল্যাণ রয়েছে বাঙালিদের। প্রতিটা প্রদেশে আলাদা ভাষা থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বাঙ্গালিরাই। জিন্নাহ ছাত্রদের বুঝিয়ে ভাষা আন্দোলন থেকে সরে আসার অনুরোধ করেন। ভাষা আন্দোলনের নেতারা জিন্নাহর যুক্তির কাছে হার মানে এবং আন্দোলন থেকে সরে আসার মৌখিক স্বীকৃতি দেয়। অবশ্য জিন্নাহ তাদের কাছ থেকে লিখিত কোনো ডকুমেন্টস চাননি। তিনি আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে ছাত্রদের ভুল আন্দোলন থেকে ফিরতে বলেছেন। ঢাকা ত্যাগের সময় তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে করা চুক্তির আর প্রয়োজনীয়তা নেই বলে উল্লেখ করেন একইসাথে উর্দুর ব্যাপারে আবারো তার মতামত ব্যক্ত করেন। আন্দোলন নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে তমুদ্দুন মজলিস। দ্বিধান্বিত নেতৃত্ব থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব কেড়ে নেয় বামাদর্শের ছাত্রনেতা কমরেড তোয়াহা এবং এই আন্দোলনকে বামদের আন্দোলনে পরিণত করেন। নেতৃত্ব হারানোর পর পরবর্তীতে তমুদ্দন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে।

১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেই মিটিং-এ ডাকসুর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে মানপত্র পাঠ করা হয়। সেই মানপত্র পাঠ করেন ডাকসুর জিএস গোলাম আযম। মানপত্রে তিনি বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন। তবে লিয়াকত আলী খান এই ব্যাপারে কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নভেম্বর আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করা হয় এবং সেটি ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোনো সাড়া দেননি। 

যদিও ভাষা আন্দোলন করেছে অল্প কিছু ছাত্র এবং এটি মোটেই গণভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়নি তথাপি পাঞ্জাবের নেতা লিয়াকত আলী খান এটিকে একেবারে উড়িয়ে দেননি। তিনি মনে করেছেন যেহেতু এই ভাষায়ই পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে এটা একসময় বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই তিনি এর কিছুদিন পর, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। এই জন্য বাংলা সমর্থক মাওলানা আকরম খাঁনের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করেন লিয়াকত আলী খান। ভাষা কমিটিকেও এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলেন। ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে ও সমাধানে কিছু প্রস্তাবনা তৈরি করে। ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। 

১৯৫২ সালে ঢাকার নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। সেই ভাষণে পাকিস্তানের মূল সমস্যা সংবিধান নিয়ে কথা বলেন। সেখানে পাকিস্তানের অফিসিয়াল ভাষা ইংরজি পরিবর্তন করে উর্দু করার কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, 'কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। প্রদেশের সরকারি কাজকর্মে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু'। এতে আবারো বামপন্থী ছাত্ররা নতুন করে সংগঠিত হয়। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। নতুন কর্মপরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এবার আন্দোলন চাঙ্গা হয় কারণ এবার মুসলিম ভেঙে গঠিত হওয়া আওয়ামীলীগের একাংশের সাপোর্ট পায় ভাষা আন্দোলন। ভাসানীর সাপোর্টের মূল কারণ হলো নাজিমুদ্দিনের বিরোধীতা। সেসময় মুসলিম লীগের বিরোধীতা করাই ছিল আওয়ামীলীগের অন্যতম কাজ। যাই হোক ৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিল করে ভাষা আন্দোলনকারীরা এবং প্রচুর ভায়োলেন্স করে। জ্বালাও পোড়াও শুরু করে। এর অন্যতম কারণ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।  

৪ ফেব্রুয়ারির সহিংসতার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব-পাকিস্তান সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বাম ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে আলাদা সিদ্ধান্ত নেয় এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্তা পাঠিয়ে দেয়। 

সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সমাবেশ চালাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। পুলিশের নমনীয় অবস্থান দেখে ছাত্রলীগ তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সমাবেশে যোগ দেয়। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঐসময় উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রলীগ যোগ দিলে সমাবেশের আকার অনেক বড় হয়ে যায়। তাই এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রশাসনের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। অনেক ছাত্র ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। পুলিশ পিছিয়ে আসে।

পুলিশ পিছিয়ে গেলে ছাত্ররা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। এ সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এবার পুলিশ  অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে এবং তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ভাষা আন্দোলনকারীরা তাদের বাধা দেয়। অনেককে হেনস্তা করে। পুলিশ লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়ানক পরিবর্তন ঘটে যখন ছাত্ররা দলবল নিয়ে আইনসভার দখল নিতে যায়। আইনসভার ওপর তারা ক্ষ্যাপা কারণ আইনসভার সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে পছন্দ করেনি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। এ সময় ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণে লুটিয়ে পড়ে গণপরিষদের পিয়ন আব্দুস সালাম। যাকে এখন ভাষা শহীদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে আইনসভার সদস্য নিরাপত্তায় গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া আবুল বরকত ও ওহিউল্লাহ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পরেরদিন আবারো হত্যার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনকারীরা মিছিল বের করে। এখানেও পুলিশ গুলি করে। এতে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন নিহত হন। 

ঐসময় গণপরিষদে অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে আওয়ামী লীগের মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। যদিও মাওলানা তর্কবাগিশ বাংলা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তারপরও তিনি পুলিশের গুলির প্রতিবাদ করেন। পরবর্তীতে মুসলিম লীগ সরকার আর ভাষা আন্দোলনকারীদের কোনো সভা সমাবেশ বা কোনো কার্যক্রমের সুযোগ দেয়নি। 

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া এক সভায় সিদ্ধান্ত নেন বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করে হবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে সেখানকার প্রতিনিধিত্বকারীরা। পশ্চিম পাকিস্তানের আরেক মুসলিম লীগ নেতা আবদুল হক এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান এবং তার এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অনড় থাকেন। তার নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল করাচিতে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মিছিলে অংশ নেয় ও মুসলিম লীগের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। সেখানে সহিংস ঘটনায় সিন্ধি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক আল ওয়াহিদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে ২৭ এপ্রিল বাংলা ও অন্যান্য ভাষাকে সমমর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এমন জটিল ও সহিংস পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী বগুড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ বন্ধ করেন। ১৯৫৪ সালে গণপরিষদ নির্বাচনে শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট অধিকাংশ আসনে জয়লাভ করে। 

যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমী গঠন করে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, গবেষণা এবং মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে তারিখে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার বাতিল ঘোষণা করে। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন তারিখে যুক্তফ্রন্ট পুণর্গঠন করা হয়; যদিও আওয়ামী লীগ সে মন্ত্রীপরিষদে যোগ দেয়নি।

১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। শহীদ মিনার নতুনভাবে তৈরি করার লক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পাকিস্তানের গণপরিষদে কার্যক্রম পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। সারাদেশব্যাপী পালিত হয় শহীদ দিবস এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। আরমানীটোলায় এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী। ১৯৫৬ সালে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর পদত্যাগের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তার প্রত্যক্ষ প্রভাবে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। পাস হওয়া শাসনতন্ত্র নানান ইস্যুতে বিতর্কের জন্ম দেয়। তার প্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে ভাঙন হয়। সোহরাওয়ার্দি পদত্যাগ করেন। তার বছরখানেক পর সেনাবাহিনী শাসন ক্ষমতা দখল করে। সেনাপ্রধান আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হন এবং সংবিধান স্থগিত করেন।  

ভাষা আন্দোলন নিয়ে বড় ঘটনা ঘটায় এই নিয়ে আর কেউ নতুন করে বিতর্ক করে নি। ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি আইয়ুব খান এক সরকারি বিবৃতি জারি করেন এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উল্লেখিত দুই রাষ্ট্র ভাষার উপর সরকারি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। এভাবেই বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থায়ী হয়।

১৬ সেপ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৫১ : ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও জামায়াত

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। এর মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের মুসলিমদের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের সাফল্য আসে। যদিও পাকিস্তান গঠিত হওয়ার আনন্দ অনেকখানি ম্লান হয়ে যায় পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ হওয়ার মাধ্যমে। ভারতের হিন্দু প্রধান প্রদেশ একটিও ভাগ হয়নি অথচ মুসলিম প্রধান দুইটি প্রদেশ ভাগ করতে বাধ্য করে কংগ্রেস। ব্রিটিশ আইনজীবী র‍্যাডক্লিপকে মাউন্টব্যাটেন দায়িত্ব দেন সীমারেখা টেনে দেওয়ার জন্য। পাঞ্জাব ও বাংলায় সেই ভাগ করতে গিয়ে ইংরেজ সরকার কংগ্রেসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে। সেই সূত্রে সীমান্ত অঞ্চলে নতুন করে আবার দাঙ্গা শুরু হয়। ফলে মুসলিমরা স্বাভাবিকভাবেই মনঃক্ষুণ্ণ হয়। যাই হোক তারপরও প্রায় দুইশ বছরের পরাধীনতার অবসান হওয়ায় মুসলিমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। 

পাকিস্তানেও তুর্কির মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। মোস্তফা কামাল পাশা ব্রিটিশদের থেকে তুর্কি জাতিকে উদ্ধার করে। স্বভাবতই মুসলিমরা ভেবেছিল তিনি আবার প্রচলিত খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু খিলাফতের কফিনে শেষ পেরেকটি মারেন তিনি। খিলাফত ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে সেক্যুলার তুরস্ক গঠন করেন। একই ব্যাপার ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ আমলে জিন্নাহ যখন বিভিন্ন জনসভায় যেতেন তখন তিনি বুক পকেটে থাকা ছোট্ট একটি কুরআনের কপি বের দেখিয়ে বলতেন, এটিই হবে পাকিস্তানের সংবিধান। কুরআনের ভিত্তিতেই চলবে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র। 

যখন থেকে পাকিস্তান প্রস্তাব হয়েছে তখন থেকেই মুসলিম লীগের নেতারা বলতেন পাকিস্তান একটি ইসলামী রাষ্ট্র হবে। পাকিস্তানের পক্ষে থেকে মুসলিম লীগের এই দাবিকে সঠিক মনে করতেন না গত শতাব্দির পৃথিবী বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। তিনি ১৯৪০ সালে এই বিষয়ে একটি লেকচার দেন যা পরে বই আকারে ছাপা হয়েছে। বইটির নাম ইসলামী হুকুমাত কিস্তারা কায়েম হতি হ্যায়। সেখানে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরের বছর তিনি প্রস্তাবিত পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একটি সংগঠন কায়েম করেন, যার নাম জামায়াতে ইসলামী। 

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের সংবিধান একটি সেক্যুলার সংবিধান হবে বলে ধারণা দেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা। 

১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করে ১৯৪৮ সাল থেকে। আর সেটি ছিল ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবি নিয়ে। ১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান। 

দফাগুলো হচ্ছে

১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।

২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।

৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।

৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।

এই দাবীগুলো নিয়েই জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে।

১৯৪৮ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। গভর্ণর জেনারেল হন ঢাকার নওয়াব পরিবারের সন্তান খাজা নাজিমুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকেন লিয়াকত আলী খান। এই সময় থেকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ শাসকের ভূমিকায় থাকেন। লিয়াকত আলী খান সরকার ১৯৪৮ সনের ৪ অক্টোবর ইসলামী শাসনতন্ত্রের অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। প্রায় ২০ মাস জেলে রাখার পর ১৯৫০ সনের ২৮ মে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১৯৫০ সনের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন যে দেশের আলিম সমাজ যদি সর্বসম্মতভাবে কোন শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব উপস্থাপন করে, গণপরিষদ তা বিবেচনা করে দেখবে। প্রধানমন্ত্রী আস্থাশীল ছিলেন যে বহুধাবিভক্ত আলিম সমাজ এই জটিল বিষয়ে কখনো একমত হতে পারবে না এবং কোন সর্বসম্মত প্রস্তাবও পেশ করতে পারবে না।

১৯৫১ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে করাচিতে সারা দেশের সকল মত ও পথের ৩১ জন শীর্ষ আলিম একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে একত্রিত হন। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ সুলাইমান নদভী। সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী একটি খসড়া পেশ করেন। আলাপ-আলোচনার পর চূড়ান্ত হয় একটি মূল্যবান দলিল “ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতি।”

দফাগুলো ছিলো নিন্মরুপ:

১. দেশের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহ।

২. দেশের আইন আল-কুরআন ও আসসুন্নাহ ভিত্তিতে রচিত হবে।

৩. রাষ্ট্র ইসলামী আদর্শ ও নীতিমালার উপর সংস্থাপিত হবে।

৪. রাষ্ট্র মা‘রুফ প্রতিষ্ঠা করবে এবং মুনকার উচ্ছেদ করবে।

৫. রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য সম্পর্ক মজবুত করবে।

৬. রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের গ্যারান্টি দেবে।

৭. রাষ্ট্র শারীয়াহর নিরিখে নাগরিকদের সকল অধিকার নিশ্চিত করবে।

৮. আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না।

৯. স্বীকৃত মাযহাবগুলো আইনের আওতায় পরিপূর্ণ দ্বীনি স্বাধীনতা ভোগ করবে।

১০. অমুসলিম নাগরিকগণ আইনের আওতায় পার্সোনাল ল’ সংরক্ষণ ও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।

১১. রাষ্ট্র শারীয়াহ কর্তৃক নির্ধারিত অমুসলিমদের অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।

১২. রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম পুরুষ।

১৩. রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হবে।

১৪. রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি মাজলিসে শূরা থাকবে।

১৫. রাষ্ট্রপ্রধান দেশের শাসনতন্ত্র সাসপেন্ড করতে পারবেন না।

১৬. সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে রাষ্ট্রপ্রধানকে পদচ্যুত করা যাবে।

১৭. রাষ্ট্রপ্রধান তার কাজের জন্য মজলিসে শূরার নিকট দায়ী থাকবেন এবং তিনি আইনের ঊর্ধ্বে হবেন না।

১৮. বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন হবে।

১৯. সরকারী ও প্রাইভেট সকল নাগরিক একই আইনের অধীন হবে।

২০. ইসলামবিরোধী মতবাদের প্রচারণা নিষিদ্ধ হবে।

২১. দেশের বিভিন্ন অঞ্চল একই দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট বলে গণ্য হবে।

২২. আলকুরআন ও আসসুন্নাহর পরিপন্থী শাসনতন্ত্রের যেই কোন ব্যাখ্যা বাতিল বলে গণ্য হবে।

এই নীতিমালা বিপুল সংখ্যায় লিফলেট আকারে ছাপিয়ে সারা দেশে ছড়ানো হয়। এর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সারা দেশে বহুসংখ্যক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামী শাসনতন্ত্রের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। আবার জামায়াতের দাবির বিরুদ্ধেও কেউ কেউ অবস্থান নেন। মুসলিম লীগ নেতারা কৌশলী অবস্থান নেন। তারা ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে দেখতে চান না। তবে তারা তা স্পষ্ট করেননি।

 প্রকাশ্যে ইসলামী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বিভিন্ন আঞ্চলিক নেতারা। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মাওলানা(!) আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও ছিল অন্যতম। তিনি তো পাকিস্তানকে সেক্যুলার হিসেবেও দেখতে চাইতেন না। তিনি মাওবাদী কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র বাস্তবায়ন হলে কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করতেন। 

কাদিয়ানী সমস্যা :

পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন বাঙ্গালী খাজা নাজিম উদ্দিন। তিনি ১৯৫৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। সে সময় পাকিস্তানে আহমদিয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ব্যাপক বিস্তার হয় এবং একইসাথে তারা পাকিস্তানের সংবিধানে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। পাকিস্তানের কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা এই মতবাদের অনুসারী ছিলেন। কাদিয়ানীদের বিভ্রান্ত মতবাদ পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে প্রভাব রাখার আশংকা শুরু হয় মুসলিমদের মধ্যে। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মূল নেতা মওদূদী সাহেব বিষয়টাকে গুরুত্বের সাথে দেখেন। তিনি সংবিধান কমিটি থেকে চিহ্নিত কাদিয়ানীদের বাদ দেওয়া, কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কাদিয়ানী ও অমুসলিমদের অংশগ্রহণ না করানোর দাবি তুলেন। 

রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাইয়্যেদ মওদুদী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনও চালিয়ে যান। তিনি 'কাদিয়ানী মাসয়ালা' নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম প্রমাণ করেন এবং তাদের ভ্রান্ত আকিদার স্বরূপ উন্মোচন করেন। এই বইটি কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনে গতি এনে দেয়। এই আন্দোলন বড় ধরনের নাড়া দেয় পাকিস্তানকে। অধিকাংশ মুসলিম এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। এ সময় অনেকগুলো সংগঠন একযোগে কাদিয়ানীদেরকে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তারা সর্বদলীয় কনভেনশনে ১৯৫৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন কমিটি' গঠন করে। জামায়াত এই কমিটির বিরোধিতা করে অহিংস আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। 

এদিকে পাঞ্জাবে কাদিয়ানী সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকার ও জনগণের মধ্যকার দাঙ্গা ভয়াবহরূপ ধারণ করে। এরূপ পরিস্থিতিতে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ১৯৫৩ সালের আটাশে মার্চ মাওলানা মওদূদীসহ জামায়াতের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। এটা ছিল মূলত সামরিক কর্তৃপক্ষের ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতার নগ্ন বহিপ্রকাশ। তারা দাঙ্গা সৃষ্টির অভিযোগে গ্রেপ্তার করলেও মূলত মওদূদী ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। 

পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাওলানাকে গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে “কাদিয়ানী মাসয়ালা” বইয়ের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। এ অভিযোগেই ৮ই মে তারিখে সামরিক আদালত মাওলানাকে ফাঁসীর আদেশ প্রদান করে। অথচ মাওলানা সামরিক মানুষ ছিলেন না। মূলত এটা ছিল একটা অজুহাত। মওদূদীকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে দূরে রাখাই ছিলো এর বেসিক উদ্দেশ্য। এর পেছনে মুসলিম লীগের ইন্ধন ছিল। মাওলানার ফাঁসীর ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আরেক বাঙালি নেতা মোহাম্মদ আলী বগুড়া। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর তীব্র বিরোধিতা ও ক্ষোভের মুখে মুসলিম লীগ ও সেনাবাহিনী তাঁর মৃত্যু দণ্ডাদেশ মওকুফ করে তারা মাওলানাকে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করে। আবার এর বিশ মাস কারাবাসের পর মাওলানা বিনা শর্তে মুক্তি দেয় সরকার।

যাই হোক, সামরিক কর্তৃপক্ষ যে “কাদিয়ানী মাসয়ালা” পুস্তিকা প্রণয়নের অজুহাতে মাওলানাকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করে সে পুস্তিকাটির কিন্তু তারা বাজেয়াপ্ত করেনি। লাহোরের সামরিক আদালতে তার বিচার চলাকালেই লাহোর শহরেই বইটির বেস্ট সেল চলছিল। শুধু লাহোর নয় সারা পাকিস্তানেই বইটির বিক্রি চলছিল দেদারছে। মূলত বইটির কোথাও কোন উস্কানিমূলক কথা ছিল না। বরং তাতে তিনি 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন কমিটি'র বিরোধিতা করেছেন। তাই সরকারও চেয়েছিলো বইটি মানুষ পড়ুক।  

কাদিয়ানীরা যে মুসলমান নয়, অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে এ বইটিতে তা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কাদিয়ানীদেরকে আইনগতভাবে অমুসলিম ঘোষণা করাই ছিল মওদূদীর দাবি। এ দাবির স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্য এ বইটিতে সরবরাহ করা হয়েছে। এ দাবী আদায়ের লক্ষ্যে মাওলানা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলবার আহ্বান জানান। অবশেষে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। কাদিয়ানীরা যে অমুসলিম এ ব্যাপারে উম্মতের গোটা আলেম সমাজ একমত।

গণদাবির মুখে গণপরিষদ ১৯৫৬ সনের ২৯ ফেব্রুয়ারি একটি শাসনতন্ত্র পাস করে। কিন্তু সেখানে ইসলামপন্থীদের বেশিরভাগ দাবিই উপেক্ষা করা হয়। এসময় পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামীলীগ। আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। সংবিধানে পাকিস্তানকে 'ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান' হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। মুসলিম লীগ মনে করেছে এই দাবি দিয়ে মওদূদী ও জামায়াতকে বোকা বানিয়ে আন্দোলন থেকে দূরে রাখবে। মওদূদী তাদের এই চালাকি বুঝতে পেরেও 'ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান' এই ঘোষণাকে পজেটিভ হিসেবে গ্রহণ করে সংবিধানকে স্বাগত জানান এবং বাকী দাবিগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। মাওলানার যুক্তি ছিল এর মাধ্যমে রাষ্ট্র তার পরিচয় পেয়েছে। ধীরে ধীরে সকল নিয়ম কানুন, আইন আদালত ইসলামী শরিয়াহর ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। 

মাওলানার এই চিন্তা বাস্তব হচ্ছে। পাকিস্তানের ইসলামী রিপাবলিক পরিচয়ে একে একে পাকিস্তান থেকে সুদ, মদসহ অনেক অনৈসলামিক নিয়ম ও আচার বন্ধ হয়েছে। কাদিয়ানীরাও অমুসলিম ঘোষিত হয়ে একটি সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।   

তবে শাসনতন্ত্র নিয়ে পাকিস্তানে ব্যাপক গোলযোগ তৈরি হয়। প্রথমত ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের মধ্যে ভাঙন তৈরি হয়। আগেই বলেছিলাম মাওলানা(!) ভাসানী ইসলামী রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছেন। এর পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দি সরকার আমেরিকা ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। এতে চীনপন্থী ভাসানী সোহরাওয়ার্দির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং কাগমারিতে সম্মেলন করেন। কাগমারিতে তিনি ইসলামী রিপাবলিক ও আমেরিকাপন্থী অবস্থান থেকে সরে না এলে সালামুন আলাইকুম জানাতে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দি ও আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতারা তার এই অবস্থানকে গুরুত্ব দেন নি। কোণঠাসা হয়ে পড়েন ভাসানী। অবশেষে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে মাওবাদী দল গঠন করেন। 

এদিকে নতুন সংবিধানে গভর্নর জেনারেল সিস্টেম বাদ পড়ে। গভর্নর জেনারেল ছিলেন ইংল্যান্ড কর্তৃক নিয়োগকৃত। স্বাধীনতার সময় এই নিয়ম যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান নিজেদের জন্য শাসনতন্ত্র তৈরি না করবে ততদিন ইংল্যান্ডের রাজা/রাণী কতৃক গভর্নর জেনারেল থাকবেন। তিনি মুর্শিদাবাদের নওয়াব পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন মীর জাফরের বংশধর। আগে মূলত রাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হতো। নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বেড়ে যায়। ইস্কান্দর মির্যার সাথে সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ বাড়তে থাকে। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে সংসদ অধিবেশনে সংঘর্ষ চলাকালে স্পিকার শাহেদ আলী ইন্তেকাল করেন। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে অস্থিরতা শুরু হয়। ইস্কান্দর মির্যাকে চাপে ফেলতে ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করেন। 

সোহরাওয়ার্দির পদত্যাগে পুরো পাকিস্তানে গোলযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। প্রদেশগুলোতেও নানান ইস্যুতে অস্থিরতা তৈরি হয়। যেমন পূর্ব পাকিস্তানে অস্থিরতার মূল বিষয় ছিলো আওয়ামীলীগ ও ন্যাপের মধ্যেকার বিরোধ। সোহরাওয়ার্দির পদত্যাগের পর গুজরাট থেকে আসা মুসলিম লীগ নেতা ইবরাহীম ইসমাঈলকে প্রধানমন্ত্রী করে ইস্কান্দর মির্যা। আওয়ামীলীগ ও রিপাবলিকান পার্টির ভেটোতে মাত্র ৫৫ দিন পরই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ইসকান্দর মির্যা নিজ দলের ফিরোজ খান নুনকে প্রধানমন্ত্রী করেন। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেকার সমস্যার সমাধান হয় না। সারাদেশেই গোলযোগ তৈরি হয়। বিভিন্নস্থানে বিশেষত লাহোরে ও পাঞ্জাবে সেনাবাহিনীকে মানুষ আহ্বান করতে থাকে। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ইস্কান্দর মির্যা সংবিধান স্থগিত করে সামরিক আইন জারি করেন। সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। সামরিক আইন জারির পর সারাদেশে সেনা নিশ্চিত করা হয়। গোলযোগ ও হট্টগোল বন্ধ হয়। সামরিক আইন জারির বিশ দিন পর আইয়ুব খান ইস্কান্দর মির্যাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেন। ইস্কান্দার মির্জা লন্ডনে নির্বাসিত হন।

পাকিস্তানে শুরু হয় সেনাশাসন। আইয়ুব খানের অধ্যায়। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হয় আইয়ুব খানকে স্বাগত জানিয়ে। 

যে লেনদেনকে আল্লাহ তায়ালা স্বাগত জানিয়েছেন


সেসময় বসরা ছিল ইরান বা পারস্যের অন্তর্গত। এখন অবশ্য ইরাকে। যে সময়ের গল্প বলছি সে সময় এখনকার মতো অনেক রাষ্ট্র ছিল না। ইরানকে কেন্দ্র করে ছিল পারসিয়ান সাম্রাজ্য। এখানে মুশরিকদের বসবাস ছিলো। তারাই শাসন করতেন। আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বি সাম্রাজ্য ছিল ইতালির রোমকে কেন্দ্র করে রোমান সাম্রাজ্য। রোমানরা ছিল ঈসা আ.-এর অনুসারী। 

বসরার আল আবেলাহ শহরের শাসক ছিল সিনান ইবনে মালিক। তিনি পারস্যের সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে শাসন করতেন। তার ছেলের নাম সুহাইব। সুহাইবকে নিয়ে তিনি ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতে থাকেন, তাকে দিগ্বিজয়ী বীর বানাবেন। পুরো বসরার শাসক হবে সে। স্বপ্ন অনুযায়ী খুব ছোটবেলা থেকেই তাকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও সুহাইব ছিলেন কর্মঠ ও পরিশ্রমী। শিশু অবস্থায়ই সে বেশ ভালো তীরন্দাজ হয়ে ওঠে। 

একদিন রোমানরা বসরা আক্রমণ করে। আল আবেলাহও তাদের আক্রমণের শিকার হয়। সিনান ইবনে মালিক তার শহরকে রক্ষা করতে সক্ষম হন নাই। রোমানরা বসরা থেকে বহু মানুষকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এর মধ্যে ছিলেন সিনানের ছেলে সুহাইবও। ভাগ্য বিড়ম্বনায় শাসকের ছেলে হয়ে পড়লেন দাসে। সৈন্যরা সুহাইবকে নিয়ে রোমে দাসের হাটে বিক্রি করে দেয়। 

শুরু হয় সুহাইবের নতুন জীবন। পরিবার ছাড়া, সাম্রাজ্য ছাড়া এই জীবন বড় পরিশ্রমের, বড় গ্লানির, বড় কষ্টের। এখন তার স্থান রোমে। কয়েকজন মালিকও বদল হয়েছে তার। এর মধ্যে তিনি প্রায় ভুলে বসেছেন তার মাতৃভাষা আরবিকে। রোমানদের ভাষা আয়ত্ব করতে হয়েছে। দাসের জীবনে আর কোনো আশা ছিল না সুহাইবের। এর মধ্যে সুহাইব যুবক হয়ে উঠলেন। রোমে তিনি খ্রিস্টান পণ্ডিতদের দেখা পান। তারা তাকে বাইবেলের জ্ঞান দান করেন এবং আল্লাহ, নবী, ফেরেশতা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা দেন। 

এর মধ্যে পণ্ডিত কাহেনের সাথে তার সখ্যতা তৈরি হলো। সুহাইব প্রায়ই তার কাজের ফাঁকে কাহেনের কাছে যেতেন উপদেশ নিতে। কাহেন তাকে শেষ নবী সম্পর্কে থাকা আল্লাহর ভবিষ্যতবাণী জানায়। এবং এও জানায় তার আসার সময় হয়েছে। তিনি আরবে আসবেন। তিনি সকল অন্যায় দূর করবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবেন। কাহেনের এই কথায় বেশ আগ্রহী হয় সুহাইব। সে প্রায়ই শেষ নবীর কথা জানতে চায় কাহেনের কাছে। কাহেন তাকে শেষ নবীর সমস্ত চিহ্নের কথা জানায়। কাহেন যখন এসব কথা বলছিলেন তখন মক্কায় মুহাম্মদ সা. ছিলেন। তবে তখনো তিনি নবুয়্যত পাননি।

এবার আশাহীন সুহাইবের মনে নতুন আশা জন্মালো। তার খুব ইচ্ছে সে আরবে ফিরে যাবে। শেষ নবীর সাথী হবে। এই জন্য সে নিয়মিত দোয়া করতে থাকে আল্লাহর কাছে। একদিন সুযোগ এলো। মক্কার এক ব্যবসায়ি তাকে কিনে নিতে চাইলো। সুহাইবের দামও নির্ধারণ করলো বেশ ভালো। সুহাইবের রোমান মালিক তাই তাকে মক্কার ব্যবসায়ির কাছে বিক্রয় করে দিলেন। আল্লাহ যেন সুহাইবের দোয়াই কবুল করলেন এর মাধ্যমে।      

এবার সুহাইবের নতুন মালিক মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ি আব্দুল্লাহ বিন জুদআন। তিনি দেখলেন সিহাইব বেশ বুদ্ধিমান ও তার ব্যবসায়িক যোগ্যতা দারুণ। তিনি তাকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দান করলেন। সুহাইব দক্ষতার সাথে তার মালিকের ব্যবসা পরিচালনা করে তার মূল্য পরিশোধ করেন। অবশেষে তিনি দাসত্ব থেকে মুক্ত হন। এবার আব্দুল্লাহ ইবনে জুদআন তার সাথে অংশীদারী ভিত্তিতে ব্যবসার সুযোগ করে দেন। 

ব্যবসায়ে খুব ভালো করলেন সুহাইব ইবনে সিনান। দাস সুহাইব থেকে হয়ে ওঠলেন ব্যবসায়ি সুহাইব। ইতোমধ্যে তার বিপুল সম্পত্তি গড়ে ওঠে। মক্কায় তার নাম হয় সুহাইব রুমি। সে যেহেতু রোম থেকে এসেছে তাই তার এমন নাম হয়েছে। একবার সিরিয়া থেকে ব্যবসায়িক সফর শেষ করে মক্কায় ফিরলেন সুহাইব। এমন সময় লোকমুখে খবর পেলেন হজরত মুহাম্মদ সা.-এর কথা। মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ নতুন সব কথা প্রচার করছে। সে নাকি শেষ নবী। 

যুবক সুহাইব আগে থেকেই মুহাম্মদ সা.-কে চিনতেন। কাহেনের ভবিষ্যতবাণী তিনি মুহাম্মদ সা.-এর সাথে মিলিয়ে নিলেন। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে কাহেনের কথানুসারে মুহাম্মদ সা.-ই শেষ নবী। গোপনে তিনি ছুটে গেলেন মহানবীর আস্তানা দারুল আরকামে। দেখলেন সেখানে ইতস্তত ঘুরাফেরা করছে আম্মার ইবনে ইয়াসার। জিজ্ঞাসা করলেন, 

-কী হে আম্মার এখানে কী করো? কেন এসেছো? 

-আগে তুমি তুমিই বলো এখানে কেন এসেছো?

- আমি আসলে এই লোকের সাথে দেখা করতে চাই। সে কী বলে তা বুঝতে চাই। 

- আমারো সেরকম ইচ্ছে, চলো... 

সুহাইব ও আম্মার দুইজনে একসাথে হাজির হলেন আল্লাহর রাসূলের কাছে। মনযোগ দিয়ে কথা শুনলেন। ইসলাম কবুলের জন্য সময়ক্ষেপন করলেন না দুজনের কেউই। মহান রাব্বুল আলামীন হিদায়েতের আলো দিয়ে বরণ করে নিলেন। সুহাইব রুমি রা.-এর দোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন। 

সুহাইব রা. যে সত্যের ভবিষ্যতবাণী রোমে শুনেছিলেন তার সংস্পর্শে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন বন্ধুদের মাঝে। এক কান দুই কান হয়ে সুহাইবের ইসলাম গ্রহনের কথা জানাজানি হয়ে যায়। মক্কার মুশরিক নেতারা তার ওপর নির্যাতন শুরু করে। তবে তিনি স্বাধীন ছিলেন বিধান নির্যাতনের মাত্রা বেলাল রা., আম্মার রা.-দের মতো ভয়াবহ ছিল না। 

মদিনায় যখন হিজরতের সিদ্ধান্ত হয়, তখন সুহাইব পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি মুহাম্মদ সা.-এর সাথে মদিনায় যাবেন। কিন্তু অতি গোপনে রাসূল সা. চলে যাওয়ায় তিনি তাঁর সাথে যেতে পারেন নি। এদিকে মুশরিকরা তার ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে যাতে তিনি মদিনায় যেতে না পারেন। তার ওপর নজর রাখা লোকেরা এসময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে কৌশলে তিনি তার ঘর থেকে বের হয়ে পড়লেন। সুহাইব রা. অস্ত্র সজ্জিত হয়ে তার বাহনে করে মদিনার দিকে রওয়ানা হলেন। 

কিছুক্ষণ পরই পাহারাদার কুরাইশরা টের পেয়ে যায়। সুহাইব রা. পালিয়ে যাচ্ছেন বুঝতে পেরে মুশরিকরা তার পিছু ধাওয়া করে। সুহাইব রা. ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন মদিনার উদ্দেশে। এক পর্যায়ে বুঝতে পারলেন তিনি তাদের হাতে ধরা পড়ে যাবেন তাই তিনি একটি পাহাড়ের উপর উঠে ধনুক উঁচিয়ে ধরে বললেন,

" হে কুরাইশের লোকেরা! আল্লাহ শপথ, তোমরা জানো যে আমি অন্যতম সেরা তীরন্দাজ এবং আমার নিশানা নির্ভুল। আল্লাহর শপথ, যদি তোমরা আমার কাছে আসো, আমার কাছে থাকা প্রত্যেকটি তীর দিয়ে আমি তোমাদের একেকজনকে হত্যা করব। এরপর আমি তলোয়ার হাতে নেব।"

মুশরিকরাও আল্লাহর শপথ করে উত্তর দেয়, "আল্লাহর শপথ, আমরা তোমাকে জানমাল নিয়ে আমাদের কাছ থেকে পালাতে দেব না। তুমি মক্কায় দাস হিসেবে এসেছিলে। দুর্বল ও দরিদ্র ছিলে। তোমার যা আছে তা তুমি এখানে অর্জন করেছ।"

সুহাইব রা. সাথে সাথে উত্তর দিলেন, "যদি আমি আমার সম্পদ তোমাদের জন্য ছেড়ে যাই তবে তোমাদের ফয়সালা কী? তোমরা কি আমাকে আমার পথে যেতে দেবে?" 

মুশরিকরা হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়।

সুহাইব রা. তার বাড়িতে কোথায় কী সম্পদ আছে তা বর্ণনা করে তাদের জানিয়ে দিলেন। তারাও সুহাইব রা.-এর পথ ছেড়ে দিল। 

জাগতিক দৃষ্টিতে এই বিনিময় অত্যন্ত ক্ষতিকারক মনে হয়েছে সুহাইব রা.-এর পক্ষে। তিনি যদি একটু কম্প্রোমাইজ করতেন তাহলে তার বিপুল সম্পত্তি হারাতে হতো না। সুহাইব রা. ইসলামী আন্দোলনের কাজকে ছাড় দেননি। ছেড়ে দিয়েছেন তার কষ্টার্জিত সম্পত্তি। অন্যদিকে আমরা এখন আমাদের সম্পদ বাঁচাতে ইসলামী আন্দোলনকে ছাড় দিই। আমাদের সম্পদ বাঁচাতে আমরা বাতিলের সাথে কম্প্রোমাইজ করি। আমরা হিকমতের নাম করে ইসলামী আন্দোলনের সাথে ততটুকু সম্পর্ক রাখি যতটুকু রাখলে বাতিল আমাদের ক্ষতি করবে না, আমাদের সম্পত্তির ক্ষতি করবে না। 

মহান রাব্বুল আলামীন সুহাইব রুমি রা.-এর এই ব্যবসাকে (ইসলামী আন্দোলনের বিনিময়ে সম্পত্তি ছেড়ে দেওয়া) দারুণভাবে পছন্দ করেছেন। তাই তিনি কুরআনে এই ঘটনাকে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করে রেখেছেন। সূরা বাকারার ২০৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, //আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজকে বিকিয়ে দেয়। আর আল্লাহ (তাঁর সেই) বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল।// 

মুশরিকরা তাঁর রাস্তা ছেড়ে দিলে সুহাইব রা. পুরো নিঃস্ব অবস্থায় তবে নিশ্চিন্তে ও খুশি মনে আল্লাহর রাসূল সা.-এর বিশ্বস্ত সঙ্গী হওয়ার জন্য মদিনার দিকে ছুটে চললেন। ইতোমধ্যে আল্লাহর রাসূলের কাছে ওহি পৌঁছে গেছে। তিনি সুহাইব রা.-কে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সুহাইব রুমি রা. পৌঁছালে মুহাম্মদ সা. তাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "তোমার লেনদেন ফলপ্রসূ হয়েছে, হে আবু ইয়াহিয়া। তোমার লেনদেন ফলপ্রসূ হয়েছে।" একথা তিনি তিনবার বলেন।

একথা শুনে সুহাইব রা. অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং বলেন, "আল্লাহর শপথ, ইয়া রাসুলুল্লাহ সা.! আমার পূর্বে কেউ আপনার কাছে আসেনি যে আমার খবর আপনাকে দিবে। শুধু জিব্রাইলই পারে আপনাকে এই খবর দিতে।"

সুহাইব রুমি রা.-এর উপনাম ছিল আবু ইয়াহিয়া। মহানবী সা. এই নামেই তাকে সম্বোধন করেছেন। তিনি আনসার সাহাবি হারিস ইবনে সাম্মা রা.-এর সাথে সুহাইব রুমি রা.-এর ভাইয়ের সম্পর্ক করে দেন। ফলে হারিস রা. তার সম্পত্তি ভাগ করে নেন সুহাইব রা.-এর সাথে। মদিনায়ও সুহাইব রা. ভালো ব্যবসায়ি হিসেবে নাম করেন। তবে তিনি সম্পত্তি বাড়তে দিতেন না। দান করতেন দুই হাতে। 

সাহাবাদের মধ্যে সুহাইব রা. মর্যাদা ছিল উঁচু স্তরে। তিনি বদর, ওহুদ, খন্দকসহ বহু যুদ্ধে এটেইন করেন। রাসূল সা. ও  খুলাফায়ে রাশেদার সময়ে তিনি পরামর্শ সভায় থাকতেন। উমার রা. সবসময় তাঁর বিচক্ষণতার ওপর আস্থা রেখেছেন। তাই ছুরিকাহত উমার রা. মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত খলিফা হিসেবে সুহাইব ইবনে সিনান রা.-কে দায়িত্ব দেন। আর ছয়জন সাহাবির একটি কমিটি করে দেন। তারা হলেন উসমান ইবনে আফফান, আলী ইবন আবী তালিব, জুবায়ের ইবনুল আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ ও সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস। তাদেরকে দায়িত্ব দেন তারা যেন তিনদিনের মধ্যে পরবর্তী খালিফা নির্ধারণ করেন। 

তিনদিন ইসলামী রাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত খলিফা ছিলেন সুহাইব ইবনে সিনান রা.। উমার রা. তার নামাজে জানাজার ইমামতি করার ওসিয়ত করে যান সুহাইব রা.-এর কাছে। সুহাইব রা. দক্ষতার সাথে সেসময়ের জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। উমার রা. দাফন সম্পন্ন করার পর শুরা মেম্বারদের পরামর্শে যখন উসমান রা. খলিফা নির্বাচিত হলেন তখন সুহাইব রা. আমানতদারিতার সাথে উসমান রা.-এর কাছে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেন।

১১ সেপ, ২০২০

যে বিয়ে আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন


জায়েদের হাত চেপে তাকে নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছেন তার মা সাওদা। যাচ্ছিলেন তার মায়ের কাছে বেড়াতে। পথে হঠাৎ ডাকাত দলের আক্রমণ। মায়ের সাথে তাল মেলাতে পারছে না জায়েদ। ডাকাতরা তাকে ধরে ফেললো। সাওদা তাকে বুকে চেপে ডাকাতদের থেকে কেড়ে নিতে চাইলো। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ডাকাতরা জায়েদকে নিয়ে গেল।
জায়েদের বয়স তখন মাত্র আট বছর। ডাকাতরা তাকে নজদ থেকে নিয়ে এসে মক্কায় বিক্রি করে দিল দাস হিসেবে। জায়েদসহ আরো কিছু দাস কিনে নিল মক্কার ব্যবসায়ি হাকিম। হাকিম তার কেনা দাসগুলোকে নিয়ে এলো ফুফু খাদিজার কাছে। এসে বললেন, আপনার জন্য হাদিয়া এনেছি ফুফু। এখান থেকে একজন দাসকে আপনি বেছে নিন।

এই খাদিজা আর কেউ নন। আমাদের আম্মাজান হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা.। হযরত খাদিজা রা. দাসগুলির চেহারা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার পর জায়েদকে বাছাই করলেন। তিনি জায়েদের চেহারায় তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ সা.-এর সাথে খাদিজা রা.-এর বিয়ে হয়। তিনি স্বামীকে কিছু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করলেন। বুদ্ধিমান জায়েদ ছিল সেই অসাধারণ উপহার। জায়েদকে তিনি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন আর জায়েদকে বললেন যেন মুহাম্মদ সা.-এর খিদমত করে।

এ সৌভাগ্যবান বালক জায়েদ মুহাম্মাদ সা.-এর তত্ত্বাবধানে বড় হতে লাগলেন। এদিকে তার মা পুত্রশোকে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। নানান স্থানে তিনি জায়েদের খোঁজ করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও জায়েদের পাত্তা পাওয়া গেল না। কয়েকবছর পর হজ্জের সময় জায়েদের গোত্রের কিছু লোক হজ্জ করতে মক্কায় এলো। কাবার চতুর্দিকে তাওয়াফ করার সময় তারা জায়েদের মুখোমুখি হলো। তারা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পেরে কুশল বিনিময় করলো। সেই লোকগুলি হজ্জ শেষে জায়েদের পিতা হারিসাকে তার হারানো ছেলের সন্ধান দিল।

ছেলের সন্ধান পেয়ে হারিসা ও তার ভাই মক্কায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। জায়েদকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অর্থসামগ্রীও নিলেন সাথে। তারা মক্কার পথে বিরামহীন চলার পর মুহাম্মাদ সা.-এর কাছে পৌঁছলেন এবং বললেন, ‘ওহে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। অসহায়ের সাহায্যকারী, ক্ষুধার্তকে অন্নদানকারী ও আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দানকারী। আপনার কাছে আমাদের যে ছেলেটি আছে তার ব্যাপারে আমরা এসেছি। তার মুক্তিপণও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং আপনার ইচ্ছামত তার মুক্তিপণ নির্ধারণ করুন।’

এটা সেসময়ের কথা যখন মহাম্মদ সা. নবুয়্যত লাভ করেন নি। তাঁর আচার ব্যবহার, আমানতদারীতা ও বুদ্ধিমত্তায় পুরো মক্কাবাসী তার সম্মান করে। যাই হোক মুহাম্মাদ সা. তাদের কথা শুনে বললেন,
- আপনারা কোন ছেলের কথা বলছেন?
– আপনার দাস যায়িদ ইবন হারিসা।
– মুক্তিপণের চেয়ে উত্তম কিছু আপনাদের জন্য নির্ধারণ করি, তা-কি আপনারা চান?
– সেটা কী?
– আমি তাকে আপনাদের সামনে ডাকছি। স্বেচ্ছায় সে নির্ধারণ করুক, আমার সাথে থাকবে, না আপনাদের সাথে যাবে, যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, মুক্তিপণ ছাড়া তাকে নিয়ে যাবেন। আর আমার সাথে থাকতে চাইলে আমার কিছু করার নেই। সে অবশ্যই আমার সাথে থাকবে।

তারা অত্যন্ত খুশি হয়ে বললো, আপনি অত্যন্ত ন্যায় বিচারের কথা বলেছেন। মুহাম্মাদ সা. জায়েদকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
- এ দু’ব্যক্তি কারা?
- ইনি আমার পিতা হারিসা ইবনে শুরাহবিল। আর উনি আমার চাচা কা’ব।
- তুমি ইচ্ছা করলে তাদের সাথে যেতে পারো, আর ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থেকে যেতে পার।
- (কোনো রকম ইতস্তত না করেই সঙ্গে সঙ্গে) আমি আপনার সাথেই থাকবো।

হারিসা ইবনে শুরাহবিল বললেন,
- জায়েদ, তোমার সর্বনাশ হোক! পিতা-মাতাকে ছেড়ে তুমি দাসত্ব বেছে নিলে?
- এ ব্যক্তির মাঝে আমি এমন কিছু দেখেছি, যাতে আমি কখনও তাকে ছেড়ে যেতে পারবোনা।

জায়েদের এ সিদ্ধান্তের পর মুহাম্মাদ সা. তার হাত ধরে কাবার কাছে নিয়ে আসেন এবং হাজরে আসওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত কুরাইশদের লক্ষ্য করে ঘোষণা করেন, ‘ওহে কুরাইশরা! তোমরা সাক্ষী থাকো, আজ থেকে জায়েদ আমার ছেলে। সে হবে আমার এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী।

এ ঘোষণায় যায়েদের বাবা-চাচা খুব খুশি হলেন। তারা জায়েদকে মুহাম্মাদ সা.-এর নিকট রেখে প্রশান্ত চিত্তে দেশে ফিরে গেলেন। সেই দিন থেকে জায়েদ ইবনে হারিসা হলেন জায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ। সবাই তাকে মুহাম্মাদের ছেলে হিসেবেই সম্বোধন করতো।

এ ঘটনার কয়েক বছর পর মুহাম্মাদ সা. নবুয়্যত লাভ করেন। জায়েদ রা. হলেন পুরুষ দাসদের মধ্যে প্রথম মুসলিম। পরবর্তীকালে তিনি হলেন রাসূলুল্লাহর সা. বিশ্বাসভাজন সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার এবং তার অনুপস্থিতিতে মদিনার অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক। জায়েদ যেমন পিতা-মাতাকে ছেড়ে রাসূলকে সা. বেছে নেন, তেমনি রাসূলও সা. তাঁকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন এবং তাঁকে আপন সন্তান ও পরিবারবর্গের মধ্যে শামিল করে নিয়েছেন। জায়েদ দূরে গেলে তিনি উৎকণ্ঠিত হতেন, ফিরে এলে উৎফুল্ল হতেন এবং এত আনন্দের সাথে তাঁকে গ্রহণ করতেন যে অন্য কারো সাক্ষাতের সময় তেমন দেখা যেত না।

ইসলামপূর্ব যুগের প্রথা ছিল, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো পুত্রকে পালকপুত্ররূপে গ্রহণ করতো, তাহলে এ পালকপুত্র তার প্রকৃত পুত্র বলে গণ্য হতো। এ পালকপুত্র সব ক্ষেত্রে প্রকৃত পুত্রের মর্যাদাভুক্ত হতো। তারা প্রকৃত সন্তানের মতো সম্পদের অংশীদার হতো এবং বংশ ও রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে যেসব নারীর সঙ্গে বিয়ে-শাদি হারাম, এ পালক পুত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এরূপ মনে করা হতো। বিয়ে বিচ্ছেদ সংঘটিত হওয়ার পর পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা যেরূপ হারাম, অনুরূপভাবে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীও হারাম বলে মনে করা হতো।

জায়েদ বিন হারেসা রা. যৌবনে পদার্পণ করলে রাসুলুল্লাহ সা. নিজের ফুফাতো বোন জনয়ব বিনতে জাহাশকে তার কাছে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠান। জায়েদ রা. যেহেতু মুক্তিপ্রাপ্ত দাস ছিলেন, সেহেতু হজরত জনয়ব ও তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ এ বিয়েতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তারা বলেন, আমরা বংশমর্যাদায় তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তখন আল্লাহ তাআলা সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াত নাজিল করেন—//যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোনো অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়//

জয়নব ও তাঁর ভাই এ আয়াত শুনে তাঁদের অসম্মতি প্রত্যাহার করে নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যান। অতঃপর চতুর্থ হিজরিতে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এ বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ১০ দিনার, যা প্রায় চার ভরি স্বর্ণ পরিমাণ ও ৬০ দিরহাম বা ১৮ তোলা রৌপ্য পরিমাণ। তা ছাড়া দেওয়া হয়েছিল একটি ভারবাহী জন্তু, কিছু গৃহস্থালির আসবাবপত্র, আনুমানিক ২৫ সের আটা ও পাঁচ সের খেজুর। মহানবী সা. নিজের পক্ষ থেকে তা প্রদান করেছিলেন।

যদিও মহানবী সা.-এর নির্দেশ মোতাবেক জায়েদ বিন হারেসার সঙ্গে জয়নব রা.-এর বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তাদের স্বভাব-প্রকৃতিতে মিল হয়নি। অল্প দিনেই তাদের মধ্যে মনমালিন্য তৈরি হয়। জায়েদ রা. মহানবী সা.-এর কাছে জনয়ব রা. সম্পর্কে ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্ব, গোত্রগত মর্যাদা ও আনুগত্যে শৈথিল্য প্রদর্শনের অভিযোগ উত্থাপন করেন।

পরের বছর মহানবী সা.-কে আল্লাহ তায়ালা জানান, জায়েদ রা. জয়নব রা.-কে তালাক দিয়ে দেবেন। অতঃপর আপনি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। কিন্তু মহানবী সা. এই বিষয়টা লোকলজ্জার কারণে গোপন রাখেন। ইতোমধ্যে হজরত জায়েদ রা. রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে অভিযোগ পেশ করতে গিয়ে হজরত জনয়বকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মহানবী সা. যদিও ওহির মাধ্যমে অবগত হয়েছিলেন, তারপরও তিনি তালাক দিতে নিষেধ করেন। কারণ আল্লাহর রাসূল এই বিয়ে নিজে দিয়েছেন তাই তিনি বিয়েটা ভঙ্গ হোক চান নি। তার ওপর মহানবী সা.-এর অন্তরে এরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় যে জায়েদ তালাক দেওয়ার পর যদি তিনি জয়নব রা.-কে বিয়ে করেন, তবে আরববাসী বর্বর যুগের প্রচলিত প্রথানুযায়ী এ অপবাদ রটাবে যে মুহাম্মদ সা. পুত্রবধূকে বিয়ে করেছেন।

এই প্রসঙ্গে সূরা আহযাবে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেছেন। তিনি ১-৩ নং আয়াতে বলেন, //হে নবী! আল্লাহকে ভয় করো এবং কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যে বিষয়ের ইংগিত করা হচ্ছে তার অনুসরণ করো। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা সবই জানেন। আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। কর্ম সম্পাদনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।//

এ আয়াতগুলো এমন এক সময় নাযিল হয় যখন হযরত জায়েদ রা. হযরত জয়নবকে রা.-কে তালাক দিয়েছিলেন। তখন আল্লাহর ইশারা এটিই ছিল যে, পালক পুত্রের সম্পর্কের ব্যাপারে জাহেলীয়াতের রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের ওপর আঘাত হানার এটিই মোক্ষম সময়। নবী সা.-কে নিজেই অগ্রসর হয়ে তাঁর পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা উচিত। এভাবে এ রেওয়াজটি চূড়ান্তভাবে খতম হয়ে যাবে। কিন্তু যে কারণে নবী করীম সা. এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ইতস্তত করেছিলেন তা ছিল এ আশংকা যে, এর ফলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা করার জন্য তারা একটি শক্তিশালী অস্ত্র পেয়ে যাবে। এটা তাঁর নিজের দুর্নামের আশংকা জনিত ভয় ছিল না। বরং এ কারণে ছিল যে, এর ফলে ইসলামের উপর আঘাত আসবে, শত্রুদের অপপ্রচার বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়া বহু লোকের মনে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাবে, বহু নিরপেক্ষ লোক শত্রুপক্ষে যোগ দেবে এবং স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যে যারা দুর্বল বুদ্ধি ও মনের অধিকারী তারা সন্দেহ-সংশয়ের শিকার হবে। নবীর এই দুশ্চিন্তার নিরসন করার জন্যই আলোচ্য আয়াতগুলো আল্লাহ নাজিল করেন।

এরপর ৪র্থ ও ৫ম আয়াতে আল্লাহ বলেন, //আল্লাহ কোন ব্যক্তির দেহাভ্যন্তরে দু’টি হৃদয় রাখেননি। তোমাদের যেসব স্ত্রীকে তোমরা “যিহার” করো তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের জননীও করেননি এবং তোমাদের পালক পুত্রদেরকেও তোমাদের প্রকৃত পুত্র করেননি। এসব তো হচ্ছে এমন ধরনের কথা যা তোমরা সম্মুখে উচ্চারণ করো, কিন্তু আল্লাহ এমন কথা বলেন যা প্রকৃত সত্য এবং তিনিই সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন। পালক পুত্রদেরকে তাদের পিতার সাথে সম্পর্কিত করে ডাকো। এটি আল্লাহর কাছে বেশী ন্যায়সংগত কথা। আর যদি তোমরা তাদের পিতৃ পরিচয় না জানো, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই এবং বন্ধু। না জেনে যে কথা তোমরা বলো সেজন্য তোমাদের পাকড়াও করা হবে না, কিন্তু তোমরা অন্তরে যে সংকল্প করো সেজন্য অবশ্যই পাকড়াও হবে। আল্লাহ ক্ষমাকারী ও দয়াময়।//

মহান রাব্বুল আলামীন এখানে দুটি উদাহরণ দিয়ে আসল কথা বললেন। প্রথমে বললেন, দু’টি হৃদয় রাখেননি। এর মানে হলো কেউ একইসাথে মুমিন ও মুনাফিক হতে পারে না। হয় সে মুমিন নয় মুনাফিক। অর্থাৎ মুসলিম হওয়ার পর কেউ জাহেলী কুংস্কারে বিশ্বাসী হতে পারবে না। তারপর বলেছেন যিহার করলে কেউ জননী হয়ে যাবে না। ঠিক তেমনি আরেকটি কুসংস্কার কাউকে পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করলে সে আপন পুত্র হয়ে যায় না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কাউকে তার বাবা ছাড়া অন্যকে বাবা পরিচয় দেওয়া ন্যায়সঙ্গত নয়। যেমন জায়েদ রা.-এর পিতার নাম হারেসা। অথচ সমাজে প্রচলিত হয়েছে তার পিতার নাম মুহাম্মদ সা.। যেটা স্পষ্টতই অসত্য। আল্লাহ তায়ালা এটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সেদিন থেকে জায়েদ বিন মুহাম্মদ আবার আগের নামে জায়েদ বিন হারেসাতে পরিণত হলেন।

এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে বলেন, //হে নবী! স্মরণ করো, যখন আল্লাহ এবং তুমি যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলে তাকে তুমি বলছিলে, তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করো। সে সময় তুমি তোমার মনের মধ্যে যে কথা গোপন করছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন, তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহ এর বেশী হকদার যে, তুমি তাকে ভয় করবে। তারপর যখন তার ওপর থেকে যায়েদের সকল প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো তখন আমি সেই মহিলার বিয়ে তোমার সাথে দিয়ে দিলাম। যাতে মুমিনদের জন্য তাদের পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে কোনো প্রকার সংকীর্ণতা না থাকে যখন তাদের ওপর থেকে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। আর আল্লাহর হুকুম তো কার্যকর হয়েই থাকে।//

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর দ্বিধা দেখে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করেছেন। এখানে মহানবী সা. যে জায়েদ রা.-কে তালাক দিতে নিষেধ করেছেন সেই কথা উল্লেখ করেছেন। মুনাফিক ও কাফিরদের অপপ্রচারের ভয়ের জবাবে আল্লাহ বলেছেন বেশি ভয় আল্লাহকেই করা উচিত। লোকে কী বলবে এই ভেবে কুসংস্কারের রেওয়াজ চালু থাকতে দেওয়া যায় না। মহান রাব্বুল এই আয়াতের মাধ্যমেই নিজেই জয়নব বিনতে জাহাশের সাথে আল্লাহর রাসূলের বিয়ের ঘোষণা দিয়ে দেন।

মহানবী সা. পঞ্চম হিজরিতে মদিনায় জনয়বকে বিয়ে করেন। তখন রাসুল সা.-এর বয়স ছিল ৫৮ বছর, আর জনয়ব রা.-এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। এ বিয়ে হয়েছিল সরাসরি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। জনয়ব রা.-কে মহানবী সা. বিয়ে করলে মুনাফিকরা বিরোধিতার মহা উপকরণ হাতে পায় যা তিনি আগেই আশংকা করছিলেন। তারা প্রচার করতে থাকে যে রাসুলুল্লাহ সা. এতই নারীলোলুপ যে স্বীয় পুত্রবধূকে পর্যন্ত বিয়ে করেছেন।

এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ৩৮-৪০ নং আয়াতে বলেন, //নবীর জন্য এমন কাজে কোনো বাধা নেই যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করেছেন। ইতোপূর্বে যেসব নবী অতীত হয়ে গেছেন তাদের ব্যাপারে এটিই ছিল আল্লাহর নিয়ম, আর আল্লাহর হুকুম হয় একটি চূড়ান্ত স্থির সিদ্ধান্ত অনুসারে। যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে থাকে, তাঁকেই ভয় করে এবং এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না আর হিসেব গ্রহণের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট। (হে লোকেরা!) মুহাম্মদ তোমাদের কোনো ব্যক্তির পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত।//

মহান রাব্বুল আলামীন পূর্বের নবীদের ইতিহাস টেনে তাদের অপপ্রচারের জবাব দেন এবং একইসাথে মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে কুসংস্কারের দাফন করলেন।

৮ সেপ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৫০ : ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগের ইতিহাস


হিন্দুস্থানের মুসলিম ও মুশরিকদের সাথে প্রকাশ্য ও মারাত্মক দ্বন্দ্ব শুরু হয় ১৯০৫ সাল থেকে বঙ্গভঙ্গ ইস্যুতে। ১৯০৫ সালে ইংরেজরা বাংলাকে দুইভাগে ভাগ করে। ঐসময় বাংলা সমৃদ্ধ ছিল এবং এখানে বার বার বিদ্রোহ হচ্ছিল। তাই বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা পূর্ববঙ্গকে আলাদা করে ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী করে। এতে বিদ্রোহী মুসলিমরা অসন্তুষ্ট হলেও রাজনীতিবিদ মুসলিমরা খুশি হয় কারণ তাতে পূর্ববঙ্গের উন্নতি হবে। ঢাকা তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। মুসলিমদের এই সন্তুষ্টিতে খুবই অসন্তুষ্ট হয় মুশরিক হিন্দুরা।

তারা শুরু করে দাঙ্গা হাঙ্গামা। ফলশ্রুতিতে মুসলিমরা কংগ্রেস থেকে বের হয়ে আলাদা রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ গঠন করে। বাংলা নাকি হিন্দুদের মা। এই মাকে নাকি ভাগ করা যায় না। তাদের বাংলা মায়ের জন্য তাদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বাংলা আবার একত্র হয়ে যায়। যাই হোক ১৯৩৫ সালে প্রথম নির্বাচনে মুসলিমরা জয়ী হয় এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনেও মুসলিম লীগ বাংলায় সরকার গঠন করে। যখন পাকিস্তান প্রস্তাবের ব্যাপারে ইংরেজ সরকার রাজি হয়ে যায় তখন থেকেই এদেশের রাজনৈতিক নেতারা বাংলার ভবিষ্যত নিয়ে নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। 

নিয়ম অনুযায়ী বাংলা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে। এবার দেখা গেল উল্টো ঘটনা। এবার ১৯৪৭ সালে এসে কিন্তু আর হিন্দুরা বাংলা মাকে এক রাখতে চায় না। তারা ঘোঁ ধরেছে তারা এবার বাংলা মা কে কেটেই ফেলবে। ভাগ করে ফেলবে। কোনোভাবেই বাংলাকে এক থাকতে দিবে না। এখন তারা আর বাংলা মা বলতেই রাজি না। যাই হোক বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের মতবিরোধের ফলে বাংলার ভবিষ্যত নিয়ে তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি তৈরি হয়। 

১- বাংলা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে।

২- বাংলা আলাদা স্বাধীন রাজ্য বা দেশ হিসেবে থাকবে। 

৩- বাংলা ভাগ হবে। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সাথে এবং পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে। 

বাংলার প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি পরিকল্পনা পেশ করেন যে, পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা ভারত কিংবা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে না যুক্ত হয়ে বরং একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সোহরাওয়ার্দী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, যদি বাংলা এভাবে বিভক্ত হয় তবে পূর্ব বাঙলা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে কেননা, সব কয়লা খনি কিংবা পাট কল পশ্চিম বাংলার অংশ হয়ে যাবে এবং একটি সিংহভাগ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যারা কিনা শিল্পায়নের সাথে যুক্ত পশ্চিম বাংলায় অভিবাসন সম্পন্ন করবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, 'কোলকাতা' যা ভারতের অন্যতম প্রধান শহর এবং শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু তা পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সোহরাওয়ার্দী ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে দিল্লির একটি সংবাদ সম্মেলনে তার প্রস্তাব তুলে ধরেন। বাংলার সব মুসলিম লীগ নেতারা এর সাথে একমত ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু মুসলিম লীগ প্রধান জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দিকে সমর্থন দিয়েছেন তাতে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ আর তেমন ভূমিকা রাখে নি। অন্যদিকে এই প্রস্তাবের অন্যতম বিরোধী হলো বাংলার হিন্দু নেতৃবৃন্দ ও কংগ্রেস। 

ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন নিজেও কিছুদিন ধরে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান থেকে পৃথক ঐক্যবদ্ধ বাংলার কথা চিন্তা করেছিলেন। ২৬ শে এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী যখন মাউন্টব্যাটেনের কাছে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব করেন এবং বলেন যে “যথেষ্ট সময় পেলে তিনি বাংলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হবেন বলে বিশ্বাস করেন”, তখন এই প্রস্তাবের পক্ষে মাউন্টব্যাটেনের সমর্থন ছিল। ঐ দিনেই মাউন্টব্যাটেন জিন্নাহকে সোহরাওয়ার্দীর কথা জানান এবং জিন্নাহ তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। ২৮শে এপ্রিল মাউন্টব্যাটেন বারোজকে জানালেন যে, তাঁর এবং তাঁর ব্রিটিশ সহকর্মীদের “পরিকল্পনা পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান থেকে পৃথক অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত রেখেছে। জিন্নাহ কোনো আপত্তি করবে না।

পৃথক স্বাধীন দেশ হবার সম্ভাবনা যাতে তৈরি হয় সেজন্য ১ মে মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব দিলেন যে, বাংলা থেকে নির্বাচিত সংবিধান সভার সদস্যরা প্রথমে ভোট দিয়ে ঠিক করবেন যে তাঁরা স্বাধীন বাংলার পক্ষে, না হিন্দুস্থান বা পাকিস্তানে যোগদান করতে চান। পরে তাঁরা বাংলা ভাগ হবে কিনা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবেন। ২ মে বারোজকে মাউন্টব্যাটেন জানালেন, বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য আর একটা বিকল্প হিসাবে বাংলায় সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সমস্ত ভোটদাতাদের মতামত গ্রহণ করার উপর জোর দেওয়া যেতে পারে। ৩রা মে কিরণশঙ্কর রায় যখন মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করলেন তখন সংবিধান সভার সদস্যদের ভোটভুটির মাধ্যমে অথবা গণভোটের মাধ্যমে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন থাকার অধিকার দেবার যে পরিকল্পনা মাউন্টব্যাটেন করেছিলেন তার কথা কিরণশঙ্করকে বললেন। মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে কিরণশঙ্কর যখন শুনলেন যে সোহরাওয়ার্দী যুক্ত নির্বাচকমণ্ডলী ও সংযুক্ত মন্ত্রিসভাতে সম্মত তখন তিনি উল্লসিত হলেন।

৪ মে বারোজ মাউন্টব্যাটেনকে চিঠির মাধ্যমে ও টেলিগ্রাম করে জানালেন যে, বাংলার জনগণের মতামত নেবার জন্য গণভোট হতে পারে, তার জন্য কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগবে। তখন স্থির ছিল যে ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে ১৯৪৮-এর জুনের মধ্যে। অতএব বাংলায় গণভোট সম্পূর্ণ সম্ভব ছিল। বাংলা ঐক্যবদ্ধ থাকবে, না বিভক্ত হবে- এই প্রশ্নটি শুধু সেদিনের ৬ কোটির কিছু বেশি বাঙালীর কাছে নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৭ মে তে মাউন্টব্যাটেন বলেছেন যে, সোহরাওয়ার্দী তাঁকে জানিয়েছেন যে জিন্নাহ স্বাধীন বাংলাতে রাজি আছেন। মাউন্টব্যাটেন তখন ঐ প্রশ্নে গণভোট বা সাধারণ নির্বাচনের কথা ভাবছিলেন। কিন্তু তার পরেই ভি পি মেনন ও নেহেরুর সাথে কথা বলে মাউন্টব্যাটেনের মত সম্পূর্ণ বদলে গেলো। 

মাউন্টব্যাটেন এবার ঠিক করলেন যে, বাংলার জনমত জানার জন্য গণভোট বা সাধারণ নির্বাচন হবে না, এমনকি বাংলার আইনসভার সদস্যরা বাংলা অবিভক্ত পৃথক রাষ্ট্র থাকবে তার পক্ষে ভোট দেবার অধিকার পাবে না। বাংলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে সংবিধান সভা। যেখানে ছিল কংগ্রেসের প্রাধান্য। বাংলা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং পৃথক রাষ্ট্র হবে তাতে মুসলিম লীগ নেতাদের সম্মতি ছিল। ২৬ এপ্রিল মাউন্টব্যাটেন যখন জিন্নাহকে সোহরওয়ার্দীর স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ বাংলার প্রস্তাবের কথা বললেন তখন জিন্নাহ একটুও ইতস্তত না করে বলেছিলেন, “আমি আনন্দিত হবো… তারা ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন থাকুক সেটাই ভালো হবে”।

অন্যদিকে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বরাবর বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। পাকিস্তান হোক আর না হোক, তবু বাংলাকে ভাগ করতে হবে- এই ছিল তাঁদের অন্যতম দাবি। তাঁরা চেয়েছিলেন বাংলাকে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্ত দিক থেকে পঙ্গু করতে। বিড়লা প্রমুখ মাড়োয়ারী বড় মুৎসুদ্দিদের ঘাঁটি কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গকে তাঁরা কখনো হাতছাড়া করতে প্রস্তুত ছিলেন না।

কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গুটিকয়েক নেতা সোহরাওয়ার্দির পরিকল্পনার সাথে একমত ছিলেন। তাদের মাঝে ছিলেন বাংলা প্রদেশের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা এবং নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসের বড় ভাই শরৎচন্দ্র বোস এবং কিরণশঙ্কর রায়। তবে, জওহরলাল নেহেরু এবং ভাল্লাবভাই পাতিল সহ বেশিরভাগ কংগ্রেস নেতা এই পরিকল্পনা বাতিল করেন। এছাড়াও শ্যাম প্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল এর তীব্রভাবে বিরোধিতা শুরু করে। তাদের মতামত ছিলো যে, এই পরিকল্পনা আসলে বিভক্তিকরনের বিপক্ষে সোহরাওয়ার্দীর দ্বারা একটি চাল মাত্র যাতে কলকাতা শহর সহ শিল্পোন্নত পশ্চিম অংশের উপর লীগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। তারা আরো মতামত পোষণ করেছিলেন যে, যদিও পরিকল্পনায় একটি সার্বভৌম বাংলার কথা উল্লেখ করা আছে, এটা বাস্তবিক পক্ষে একটি ভার্চুয়াল পাকিস্তান ছাড়া কিছুই হবে না এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের চিরতরে মুসলিম সংখ্যাগুরুদের দয়ার উপর চলতে হবে।

যদিও কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া প্রস্তাবটি আলোর মুখ দেখা সম্ভব ছিলো না, শরৎচন্দ্র এবং সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গঠনতন্ত্র নিয়ে একটি মতৈক্যে পৌঁছুতে তাদের আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর মত শরৎচন্দ্রও বিশ্বাস করতেন যে, বিভক্তিকরণের ফলে বাংলার অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং অর্ধেকের মত হিন্দু জনগোষ্ঠী অসহায় অবস্থায় পুর্ব পাকিস্তানে আটকা পরবে। চুক্তিটি ২৪ মে, ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয়।

৮ই জুন গান্ধী শরৎচন্দ্র বোসকে লিখেছিলেন, “নেহরু ও প্যাটেল অবিভক্ত বাংলার সম্পূর্ণ বিরোধী এবং তাঁদের মতে তফশিলী নেতাদের হিন্দুদের থেকে পৃথক করার এটা একটা কৌশল। এটা তাঁদের সন্দেহ নয় দৃঢ় বিশ্বাস।… তাঁরা আরও মনে করেন যে, তফশিলীদের ভোট কেনার জন্য জলের মত টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। যে ব্যবস্থাই হোক তার জন্য কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে আগে চুক্তি হতে হবে। আমি যা দেখছি সেটা তোমার পক্ষে ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়।” তিনি শরৎ বোসকে বাংলার ঐক্যের জন্য লড়াই বন্ধ করার ও বাংলা বিভাগের জন্য যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করার জন্য উপদেশ দিলেন।

যেহেতু কংগ্রেস নানান ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান মেনে নিয়েছে তাই ইংরেজরা মুসলিম অধ্যুষিত দুই প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ মেনে নিতে বাধ্য করে মুসলিম লীগকে। সোহরাওয়ার্দি চেয়েছিলো অন্তত কলকাতা যাতে পাকিস্তানে থাকে। জিন্নাহ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হিন্দুদের চাপে সেটা সম্ভব হয়নি। সিদ্ধান্ত হয় জেলা ভিত্তিক ভাগ হবে। হিন্দুপ্রধান জেলাগুলো ভারতে যোগ দিবে। মুসলিম প্রধানগুলো পাকিস্তানে থাকবে। 

সে সময় বাংলা প্রদেশে জেলা ছিল ২৭ টি।  এর মধ্যে ১৫ টি মুসলিম প্রধান জেলা হলো দিনাজপুর, রংপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, নাদিয়া, ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম। আর ১১ টি ছিল হিন্দু প্রধান জেলা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, যশোর, খুলনা। আর একটি ছিল বৌদ্ধ প্রধান জেলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম।

হিন্দুদের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিচক্ষণ জিন্নাহ সুন্দরবন ও সমুদ্রকে বেশি পাবার জন্য খুলনা ও যশোর পাকিস্তানে রাখতে চেয়েছেন। বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন মুর্শিদাবাদ ও মালদা। 

অবশেষে যেভাবে চুড়ান্ত ভাগে পাকিস্তানে যেসব জেলাগুলো থাকে সেগুলো হলো, পূর্ব দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, পূর্ব নাদিয়া, ঢাকা, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম। অন্যদিকে বাংলার যে জেলাগুলো হিন্দুস্থানে যোগ দেয় সেগুলো হলো, কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম দিনাজপুর, পশ্চিম নাদিয়া, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি।  

বাংলায় গণভোট হতে দেয়নি হিন্দুরা কারণ ভোট হলে বাংলার মানুষ দু'টি সিদ্ধান্তের একটি বেছে নিতো। এক পুরো বাংলা পাকিস্তানে যোগ দিতো নতুবা বাংলা স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতো। সিলেটের ব্যাপারে হিন্দুদের ও কংগ্রেসের বাধা না থাকায় সেখানে স্বাভাবিকভাবে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সিলেটের মানুষ ভোট দিয়ে পাকিস্তানে যুক্ত থাকার ব্যাপারে রায় দেয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ই জুলাই সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে মোট ভোটার ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮১৫ জন। ভোট দিয়েছিল ৭৭ শতাংশ মানুষ। ২৩৯ টি ভোটকেন্দ্রে বড় কোনো ঝামেলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছিল বলেই জানা যায়। 

নির্বাচনে কংগ্রেসের মার্কা ছিল ঘর আর মুসলীম লীগের ছিল কুড়াল। হিন্দুদের মধ্যে শূদ্ররা ছিল মুসলীম লীগের পক্ষে। তারা নিয়মিতই হিন্দু প্রভাবশালীদের অত্যাচারের শিকার হতেন। আর সেই অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য তারা ভারতের বদলে পাকিস্তানে থাকতে চেয়েছেন। তারা হিন্দুদের চাইতে মুসলিমদের কাছে নিজেদের নিরাপদ ভাবতেন। আলেমদের একদল ছিল কংগ্রেসি। এরা মূলত কওমী আলেম। তারা মুসলিমদের বিভ্রান্ত করে কংগ্রেসী হিন্দুদের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন। হুসাইন আহমেদ মাদানী ছিলেন হিন্দুপন্থী আলেমদের নেতা। 

দেশভাগের ইতিহাসে সিলেটের গণভোট এক বিরল ঘটনা। এই ভোটে জয়ী হতে মুসলিম লীগের ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালায়। সিলেটের জনগণকে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদিতে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল মুসলিম লীগ। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া ফরজ ঘোষণা করে ফতোয়াও জারি করা হয় মুসলিম লীগ পন্থী আলেমদের কাছ থেকে। শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে উল্লেখ রয়েছে গণভোটের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচশো কর্মী নিয়ে কলকাতা থেকে সিলেট এসেছিলেন প্রচারণা চালাতে। সিলেটে ৬০ শতাংশ মুসলিম। তারপরও ভোটে জেতার জন্য মুসলিম লীগকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে কারণ কওমী আলেমরা হিন্দুদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় অনেক মুসলিম বিভ্রান্ত হয়ে কংগ্রেসের ভোট দিতে চেয়েছিলো। 

অবশেষে মুসলিম লীগ জয়ী হলো। পাকিস্তানের পক্ষে পড়লো ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯ ভোট। আর ভারতে যোগদানের পক্ষে পড়লো ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ ভোট। মুসলিম লীগ ৫৫ হাজার ৫শ ৭৮ ভোট বেশি পায়। ভোটে জিতার পরেও সিলেটের পাঁচটি মহকুমার একটি মহকুমা করিমগঞ্জ পাকিস্তানে যুক্ত হয়নি। বেআইনিভাবে র‌্যাডক্লিফ লাইন অনুসারে করিমগঞ্জকে ভারতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সিলেটের মুসলিমদের কাছে তাই র‌্যাডক্লিফ লাইন বরাবরই বিতর্কিত।