জায়েদের হাত চেপে তাকে নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছেন তার মা সাওদা। যাচ্ছিলেন তার মায়ের কাছে বেড়াতে। পথে হঠাৎ ডাকাত দলের আক্রমণ। মায়ের সাথে তাল মেলাতে পারছে না জায়েদ। ডাকাতরা তাকে ধরে ফেললো। সাওদা তাকে বুকে চেপে ডাকাতদের থেকে কেড়ে নিতে চাইলো। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ডাকাতরা জায়েদকে নিয়ে গেল।
জায়েদের বয়স তখন মাত্র আট বছর। ডাকাতরা তাকে নজদ থেকে নিয়ে এসে মক্কায় বিক্রি করে দিল দাস হিসেবে। জায়েদসহ আরো কিছু দাস কিনে নিল মক্কার ব্যবসায়ি হাকিম। হাকিম তার কেনা দাসগুলোকে নিয়ে এলো ফুফু খাদিজার কাছে। এসে বললেন, আপনার জন্য হাদিয়া এনেছি ফুফু। এখান থেকে একজন দাসকে আপনি বেছে নিন।
এই খাদিজা আর কেউ নন। আমাদের আম্মাজান হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা.। হযরত খাদিজা রা. দাসগুলির চেহারা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার পর জায়েদকে বাছাই করলেন। তিনি জায়েদের চেহারায় তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ সা.-এর সাথে খাদিজা রা.-এর বিয়ে হয়। তিনি স্বামীকে কিছু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করলেন। বুদ্ধিমান জায়েদ ছিল সেই অসাধারণ উপহার। জায়েদকে তিনি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন আর জায়েদকে বললেন যেন মুহাম্মদ সা.-এর খিদমত করে।
এ সৌভাগ্যবান বালক জায়েদ মুহাম্মাদ সা.-এর তত্ত্বাবধানে বড় হতে লাগলেন। এদিকে তার মা পুত্রশোকে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। নানান স্থানে তিনি জায়েদের খোঁজ করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও জায়েদের পাত্তা পাওয়া গেল না। কয়েকবছর পর হজ্জের সময় জায়েদের গোত্রের কিছু লোক হজ্জ করতে মক্কায় এলো। কাবার চতুর্দিকে তাওয়াফ করার সময় তারা জায়েদের মুখোমুখি হলো। তারা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পেরে কুশল বিনিময় করলো। সেই লোকগুলি হজ্জ শেষে জায়েদের পিতা হারিসাকে তার হারানো ছেলের সন্ধান দিল।
ছেলের সন্ধান পেয়ে হারিসা ও তার ভাই মক্কায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। জায়েদকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অর্থসামগ্রীও নিলেন সাথে। তারা মক্কার পথে বিরামহীন চলার পর মুহাম্মাদ সা.-এর কাছে পৌঁছলেন এবং বললেন, ‘ওহে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। অসহায়ের সাহায্যকারী, ক্ষুধার্তকে অন্নদানকারী ও আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দানকারী। আপনার কাছে আমাদের যে ছেলেটি আছে তার ব্যাপারে আমরা এসেছি। তার মুক্তিপণও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং আপনার ইচ্ছামত তার মুক্তিপণ নির্ধারণ করুন।’
এটা সেসময়ের কথা যখন মহাম্মদ সা. নবুয়্যত লাভ করেন নি। তাঁর আচার ব্যবহার, আমানতদারীতা ও বুদ্ধিমত্তায় পুরো মক্কাবাসী তার সম্মান করে। যাই হোক মুহাম্মাদ সা. তাদের কথা শুনে বললেন,
- আপনারা কোন ছেলের কথা বলছেন?
– আপনার দাস যায়িদ ইবন হারিসা।
– মুক্তিপণের চেয়ে উত্তম কিছু আপনাদের জন্য নির্ধারণ করি, তা-কি আপনারা চান?
– সেটা কী?
– আমি তাকে আপনাদের সামনে ডাকছি। স্বেচ্ছায় সে নির্ধারণ করুক, আমার সাথে থাকবে, না আপনাদের সাথে যাবে, যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, মুক্তিপণ ছাড়া তাকে নিয়ে যাবেন। আর আমার সাথে থাকতে চাইলে আমার কিছু করার নেই। সে অবশ্যই আমার সাথে থাকবে।
তারা অত্যন্ত খুশি হয়ে বললো, আপনি অত্যন্ত ন্যায় বিচারের কথা বলেছেন। মুহাম্মাদ সা. জায়েদকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
- এ দু’ব্যক্তি কারা?
- ইনি আমার পিতা হারিসা ইবনে শুরাহবিল। আর উনি আমার চাচা কা’ব।
- তুমি ইচ্ছা করলে তাদের সাথে যেতে পারো, আর ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থেকে যেতে পার।
- (কোনো রকম ইতস্তত না করেই সঙ্গে সঙ্গে) আমি আপনার সাথেই থাকবো।
হারিসা ইবনে শুরাহবিল বললেন,
- জায়েদ, তোমার সর্বনাশ হোক! পিতা-মাতাকে ছেড়ে তুমি দাসত্ব বেছে নিলে?
- এ ব্যক্তির মাঝে আমি এমন কিছু দেখেছি, যাতে আমি কখনও তাকে ছেড়ে যেতে পারবোনা।
জায়েদের এ সিদ্ধান্তের পর মুহাম্মাদ সা. তার হাত ধরে কাবার কাছে নিয়ে আসেন এবং হাজরে আসওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত কুরাইশদের লক্ষ্য করে ঘোষণা করেন, ‘ওহে কুরাইশরা! তোমরা সাক্ষী থাকো, আজ থেকে জায়েদ আমার ছেলে। সে হবে আমার এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী।
এ ঘোষণায় যায়েদের বাবা-চাচা খুব খুশি হলেন। তারা জায়েদকে মুহাম্মাদ সা.-এর নিকট রেখে প্রশান্ত চিত্তে দেশে ফিরে গেলেন। সেই দিন থেকে জায়েদ ইবনে হারিসা হলেন জায়েদ ইবনে মুহাম্মাদ। সবাই তাকে মুহাম্মাদের ছেলে হিসেবেই সম্বোধন করতো।
এ ঘটনার কয়েক বছর পর মুহাম্মাদ সা. নবুয়্যত লাভ করেন। জায়েদ রা. হলেন পুরুষ দাসদের মধ্যে প্রথম মুসলিম। পরবর্তীকালে তিনি হলেন রাসূলুল্লাহর সা. বিশ্বাসভাজন সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার এবং তার অনুপস্থিতিতে মদিনার অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক। জায়েদ যেমন পিতা-মাতাকে ছেড়ে রাসূলকে সা. বেছে নেন, তেমনি রাসূলও সা. তাঁকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন এবং তাঁকে আপন সন্তান ও পরিবারবর্গের মধ্যে শামিল করে নিয়েছেন। জায়েদ দূরে গেলে তিনি উৎকণ্ঠিত হতেন, ফিরে এলে উৎফুল্ল হতেন এবং এত আনন্দের সাথে তাঁকে গ্রহণ করতেন যে অন্য কারো সাক্ষাতের সময় তেমন দেখা যেত না।
ইসলামপূর্ব যুগের প্রথা ছিল, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কারো পুত্রকে পালকপুত্ররূপে গ্রহণ করতো, তাহলে এ পালকপুত্র তার প্রকৃত পুত্র বলে গণ্য হতো। এ পালকপুত্র সব ক্ষেত্রে প্রকৃত পুত্রের মর্যাদাভুক্ত হতো। তারা প্রকৃত সন্তানের মতো সম্পদের অংশীদার হতো এবং বংশ ও রক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতে যেসব নারীর সঙ্গে বিয়ে-শাদি হারাম, এ পালক পুত্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এরূপ মনে করা হতো। বিয়ে বিচ্ছেদ সংঘটিত হওয়ার পর পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করা যেরূপ হারাম, অনুরূপভাবে পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীও হারাম বলে মনে করা হতো।
জায়েদ বিন হারেসা রা. যৌবনে পদার্পণ করলে রাসুলুল্লাহ সা. নিজের ফুফাতো বোন জনয়ব বিনতে জাহাশকে তার কাছে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠান। জায়েদ রা. যেহেতু মুক্তিপ্রাপ্ত দাস ছিলেন, সেহেতু হজরত জনয়ব ও তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ এ বিয়েতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তারা বলেন, আমরা বংশমর্যাদায় তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তখন আল্লাহ তাআলা সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াত নাজিল করেন—//যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফায়সালা দিয়ে দেন তখন কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর সেই ব্যাপারে নিজে ফায়সালা করার কোনো অধিকার নেই। আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নাফরমানী করে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হয়//
জয়নব ও তাঁর ভাই এ আয়াত শুনে তাঁদের অসম্মতি প্রত্যাহার করে নিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যান। অতঃপর চতুর্থ হিজরিতে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এ বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ১০ দিনার, যা প্রায় চার ভরি স্বর্ণ পরিমাণ ও ৬০ দিরহাম বা ১৮ তোলা রৌপ্য পরিমাণ। তা ছাড়া দেওয়া হয়েছিল একটি ভারবাহী জন্তু, কিছু গৃহস্থালির আসবাবপত্র, আনুমানিক ২৫ সের আটা ও পাঁচ সের খেজুর। মহানবী সা. নিজের পক্ষ থেকে তা প্রদান করেছিলেন।
যদিও মহানবী সা.-এর নির্দেশ মোতাবেক জায়েদ বিন হারেসার সঙ্গে জয়নব রা.-এর বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু তাদের স্বভাব-প্রকৃতিতে মিল হয়নি। অল্প দিনেই তাদের মধ্যে মনমালিন্য তৈরি হয়। জায়েদ রা. মহানবী সা.-এর কাছে জনয়ব রা. সম্পর্কে ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্ব, গোত্রগত মর্যাদা ও আনুগত্যে শৈথিল্য প্রদর্শনের অভিযোগ উত্থাপন করেন।
পরের বছর মহানবী সা.-কে আল্লাহ তায়ালা জানান, জায়েদ রা. জয়নব রা.-কে তালাক দিয়ে দেবেন। অতঃপর আপনি তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। কিন্তু মহানবী সা. এই বিষয়টা লোকলজ্জার কারণে গোপন রাখেন। ইতোমধ্যে হজরত জায়েদ রা. রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে অভিযোগ পেশ করতে গিয়ে হজরত জনয়বকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মহানবী সা. যদিও ওহির মাধ্যমে অবগত হয়েছিলেন, তারপরও তিনি তালাক দিতে নিষেধ করেন। কারণ আল্লাহর রাসূল এই বিয়ে নিজে দিয়েছেন তাই তিনি বিয়েটা ভঙ্গ হোক চান নি। তার ওপর মহানবী সা.-এর অন্তরে এরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় যে জায়েদ তালাক দেওয়ার পর যদি তিনি জয়নব রা.-কে বিয়ে করেন, তবে আরববাসী বর্বর যুগের প্রচলিত প্রথানুযায়ী এ অপবাদ রটাবে যে মুহাম্মদ সা. পুত্রবধূকে বিয়ে করেছেন।
এই প্রসঙ্গে সূরা আহযাবে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেছেন। তিনি ১-৩ নং আয়াতে বলেন, //হে নবী! আল্লাহকে ভয় করো এবং কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সর্বজ্ঞ ও মহাজ্ঞানী। তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যে বিষয়ের ইংগিত করা হচ্ছে তার অনুসরণ করো। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তা সবই জানেন। আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। কর্ম সম্পাদনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।//
এ আয়াতগুলো এমন এক সময় নাযিল হয় যখন হযরত জায়েদ রা. হযরত জয়নবকে রা.-কে তালাক দিয়েছিলেন। তখন আল্লাহর ইশারা এটিই ছিল যে, পালক পুত্রের সম্পর্কের ব্যাপারে জাহেলীয়াতের রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের ওপর আঘাত হানার এটিই মোক্ষম সময়। নবী সা.-কে নিজেই অগ্রসর হয়ে তাঁর পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা উচিত। এভাবে এ রেওয়াজটি চূড়ান্তভাবে খতম হয়ে যাবে। কিন্তু যে কারণে নবী করীম সা. এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে ইতস্তত করেছিলেন তা ছিল এ আশংকা যে, এর ফলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা করার জন্য তারা একটি শক্তিশালী অস্ত্র পেয়ে যাবে। এটা তাঁর নিজের দুর্নামের আশংকা জনিত ভয় ছিল না। বরং এ কারণে ছিল যে, এর ফলে ইসলামের উপর আঘাত আসবে, শত্রুদের অপপ্রচার বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়া বহু লোকের মনে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্মাবে, বহু নিরপেক্ষ লোক শত্রুপক্ষে যোগ দেবে এবং স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যে যারা দুর্বল বুদ্ধি ও মনের অধিকারী তারা সন্দেহ-সংশয়ের শিকার হবে। নবীর এই দুশ্চিন্তার নিরসন করার জন্যই আলোচ্য আয়াতগুলো আল্লাহ নাজিল করেন।
এরপর ৪র্থ ও ৫ম আয়াতে আল্লাহ বলেন, //আল্লাহ কোন ব্যক্তির দেহাভ্যন্তরে দু’টি হৃদয় রাখেননি। তোমাদের যেসব স্ত্রীকে তোমরা “যিহার” করো তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের জননীও করেননি এবং তোমাদের পালক পুত্রদেরকেও তোমাদের প্রকৃত পুত্র করেননি। এসব তো হচ্ছে এমন ধরনের কথা যা তোমরা সম্মুখে উচ্চারণ করো, কিন্তু আল্লাহ এমন কথা বলেন যা প্রকৃত সত্য এবং তিনিই সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করেন। পালক পুত্রদেরকে তাদের পিতার সাথে সম্পর্কিত করে ডাকো। এটি আল্লাহর কাছে বেশী ন্যায়সংগত কথা। আর যদি তোমরা তাদের পিতৃ পরিচয় না জানো, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই এবং বন্ধু। না জেনে যে কথা তোমরা বলো সেজন্য তোমাদের পাকড়াও করা হবে না, কিন্তু তোমরা অন্তরে যে সংকল্প করো সেজন্য অবশ্যই পাকড়াও হবে। আল্লাহ ক্ষমাকারী ও দয়াময়।//
মহান রাব্বুল আলামীন এখানে দুটি উদাহরণ দিয়ে আসল কথা বললেন। প্রথমে বললেন, দু’টি হৃদয় রাখেননি। এর মানে হলো কেউ একইসাথে মুমিন ও মুনাফিক হতে পারে না। হয় সে মুমিন নয় মুনাফিক। অর্থাৎ মুসলিম হওয়ার পর কেউ জাহেলী কুংস্কারে বিশ্বাসী হতে পারবে না। তারপর বলেছেন যিহার করলে কেউ জননী হয়ে যাবে না। ঠিক তেমনি আরেকটি কুসংস্কার কাউকে পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করলে সে আপন পুত্র হয়ে যায় না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কাউকে তার বাবা ছাড়া অন্যকে বাবা পরিচয় দেওয়া ন্যায়সঙ্গত নয়। যেমন জায়েদ রা.-এর পিতার নাম হারেসা। অথচ সমাজে প্রচলিত হয়েছে তার পিতার নাম মুহাম্মদ সা.। যেটা স্পষ্টতই অসত্য। আল্লাহ তায়ালা এটি নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সেদিন থেকে জায়েদ বিন মুহাম্মদ আবার আগের নামে জায়েদ বিন হারেসাতে পরিণত হলেন।
এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াতে বলেন, //হে নবী! স্মরণ করো, যখন আল্লাহ এবং তুমি যার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলে তাকে তুমি বলছিলে, তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় করো। সে সময় তুমি তোমার মনের মধ্যে যে কথা গোপন করছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন, তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহ এর বেশী হকদার যে, তুমি তাকে ভয় করবে। তারপর যখন তার ওপর থেকে যায়েদের সকল প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো তখন আমি সেই মহিলার বিয়ে তোমার সাথে দিয়ে দিলাম। যাতে মুমিনদের জন্য তাদের পালক পুত্রদের স্ত্রীদের ব্যাপারে কোনো প্রকার সংকীর্ণতা না থাকে যখন তাদের ওপর থেকে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। আর আল্লাহর হুকুম তো কার্যকর হয়েই থাকে।//
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর দ্বিধা দেখে আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করেছেন। এখানে মহানবী সা. যে জায়েদ রা.-কে তালাক দিতে নিষেধ করেছেন সেই কথা উল্লেখ করেছেন। মুনাফিক ও কাফিরদের অপপ্রচারের ভয়ের জবাবে আল্লাহ বলেছেন বেশি ভয় আল্লাহকেই করা উচিত। লোকে কী বলবে এই ভেবে কুসংস্কারের রেওয়াজ চালু থাকতে দেওয়া যায় না। মহান রাব্বুল এই আয়াতের মাধ্যমেই নিজেই জয়নব বিনতে জাহাশের সাথে আল্লাহর রাসূলের বিয়ের ঘোষণা দিয়ে দেন।
মহানবী সা. পঞ্চম হিজরিতে মদিনায় জনয়বকে বিয়ে করেন। তখন রাসুল সা.-এর বয়স ছিল ৫৮ বছর, আর জনয়ব রা.-এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। এ বিয়ে হয়েছিল সরাসরি আল্লাহ তাআলার নির্দেশে। জনয়ব রা.-কে মহানবী সা. বিয়ে করলে মুনাফিকরা বিরোধিতার মহা উপকরণ হাতে পায় যা তিনি আগেই আশংকা করছিলেন। তারা প্রচার করতে থাকে যে রাসুলুল্লাহ সা. এতই নারীলোলুপ যে স্বীয় পুত্রবধূকে পর্যন্ত বিয়ে করেছেন।
এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ৩৮-৪০ নং আয়াতে বলেন, //নবীর জন্য এমন কাজে কোনো বাধা নেই যা আল্লাহ তার জন্য নির্ধারণ করেছেন। ইতোপূর্বে যেসব নবী অতীত হয়ে গেছেন তাদের ব্যাপারে এটিই ছিল আল্লাহর নিয়ম, আর আল্লাহর হুকুম হয় একটি চূড়ান্ত স্থির সিদ্ধান্ত অনুসারে। যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে থাকে, তাঁকেই ভয় করে এবং এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না আর হিসেব গ্রহণের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট। (হে লোকেরা!) মুহাম্মদ তোমাদের কোনো ব্যক্তির পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সব বিষয়ে জ্ঞাত।//
মহান রাব্বুল আলামীন পূর্বের নবীদের ইতিহাস টেনে তাদের অপপ্রচারের জবাব দেন এবং একইসাথে মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে কুসংস্কারের দাফন করলেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন