ভারত ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত সংলগ্ন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রসহ বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন হয়। এ সরকারই মুজিবনগর সরকার হিসাবে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এ দিনই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত বলে গণ্য হয়। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার পর এটি যুদ্ধের দ্বিতীয় মাইলফলক যা বাংলাদেশের অনেক তারুণ্যকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার উৎসাহ যোগায়। ভারত সরকার দেশভাগের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ।
ভারতের শরনার্থী গ্রহণ
২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট ও পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সারাদেশে আগ্রাসী সামরিক অভিযান অনেককে ভীত সন্ত্রস্ত করে। প্রথমে হিন্দু জনগোষ্ঠী ভারতে শরনার্থী হিসেবে গমন করে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ দলবেঁধে ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। পরে অন্যান্য অংশের মানুষও শরনার্থী হয়। এভাবে ভারতের শরণার্থী শিবিরে ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করে ।
মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী গঠন এবং প্রশিক্ষণ
সেনাবাহিনীর সাঁড়াশী অভিযানে কিংকর্তব্যবিমুঢ় বিদ্রোহীরা মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় দিকনির্দেশনা পায়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিদ্রোহী বাঙালি সামরিক বাহিনী, ই.পি.আর, ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ সংঘবদ্ধ হতে থাকেন। ৪ এপ্রিল ৭১ তারিখে সামরিক কর্মকর্তাগণ মিলিত হন হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে। পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগকারী সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদসদের নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিফৌজ। এর প্রধান করা হয় কর্ণেল (পরবর্তীতে জেনারেল) আতাউল গনি ওসমানীকে।
অন্যদিকে তাজউদ্দিন ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং প্রবাসী সরকার গঠন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সীগুলোর মাধ্যমে পূর্ব রণাঙ্গনের প্রতিরোধ সংগ্রামের এ সব ঘটনা ও সিদ্ধান্তের সংবাদ তাজউদ্দিনের কাছে পৌঁছতে শুরু করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার আওয়ামী কর্মী ভারতে আশ্রয় নিলে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। দেশত্যাগীরা নিজের অস্তিত্বের তাগিদে ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুপ্রেরণায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণের দাবী জানাতে থাকে। এ সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নিউক্লিয়াসের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। RAW এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় মুজিববাহিনী আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা। জুলাই মাসে মুক্তিফৌজ আর মুক্তিযোদ্ধা একীভূত করে গঠন করা হয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে জেনারেল ওসমানী থাকলেও মুজিববাহিনীর নেতৃত্ব দেন ভারতীয় জেনারেল ওবান।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দেশ রক্ষার মন্ত্র নিয়ে দেশদ্রোহীদের শায়েস্তা করার শুরুর দিন থেকে মাত্র পাঁচ দিন পরেই পূর্ব বাংলার বিদ্রোহীদের সাহায্য করার জন্য ভারতীয় পার্লামেন্ট যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তা অল্পদিনের মধ্যেই কার্যকর রূপ লাভ করেছিল। ফলে এপ্রিল মাসে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী (বিএসএফ) বিক্ষিপ্তভাবে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যে অল্প স্বল্প সাহায্য করে চলেছিল তার উন্নতি ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় চার সপ্তাহ মেয়াদী ট্রেনিং কার্যক্রম। এখানে শেখানো হতো সাধারণ হাল্কা-অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় দু'হাজার ছাত্র ও যুবকের প্রথম দলের ট্রেনিং।
তরুণদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারে অবশ্য ভারতীয় প্রশাসন সতর্ক ছিল। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, নক্সালবাদী, নাগা, মিজো প্রভৃতি সশস্ত্র বিদ্রোহীদের তৎপরতা-হেতু পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সম্পর্কে ভারতীয় উদ্বিগ্ন ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্র এই সব সন্ত্রাসবাদী বা বিদ্রোহীদের হাতে যে পৌঁছবে না, এ নিশ্চয়তাবোধ গড়ে তুলতে বেশ কিছু সময় লাগে। তাই শুধু আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সাধারণ যুবকদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেওয়া হয়নি।
আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, সামগ্রিক সমস্যার চাপে ভারত সরকারের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যখন দক্ষিণপন্থীদের প্রভাব হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার মধ্যে তাজউদ্দিনের অবস্থান অপেক্ষাকৃত সবল হয়, তখন বাংলাদেশের বামপন্থী তরুণদের বিরুদ্ধে এই বিধি-নিষেধ বহুলাংশে অপসারণ করা হয়। মনি সিং এর তৎপরতার ফলে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে আলাদাভাবে একটি প্রশিক্ষণ শিবির চালু করা হয় অক্টোবর মাসে। তারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের পূর্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে (মার্চ-এপ্রিল) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সকল দল, মত, ধর্মের মানুষ ভারতে পাড়ি জমায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিং গ্রহণ করতে তারা আগ্রহ প্রকাশ করেন। এটি ছিল স্বাধীনতার স্বপক্ষে একপ্রকার ঐক্য। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মনোনয়ন ও ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রে প্রদর্শিত বৈষম্য তরুণদের সেই একতাবোধকে বহুলাংশে বিনষ্ট করে। বিশেষ করে দাড়ি টুপিধারী শরণার্থীকে মারধর অথবা বন্দী করে রাখার ঘটনা ইসলামপন্থী মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনার মানুষদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটায়।
ইসলামী ছাত্রসংঘের (পরবর্তীতে ইসলামী ছাত্রশিবির) কর্মী সন্দেহে ট্রেনিং থেকে বের করা সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “এর মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে। প্রথমে আমরা বুঝতেই পারিনি কী হয়েছে! আমাদের ব্যাচের একজনকে ডেকে পাঠানো হয়। বলা হয়, ঐ ছেলেটিকে উইথড্র করা হয়েছে। একটা চাপা গুঞ্জন শুনি, সে নাকি ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে জড়িত ছিল।” মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। জেনারেল ওসমানী এক সাক্ষাতে বলেন, এ সংখ্যা ছিল প্রায় ষাট হাজার।
স্বাধীনতার পক্ষে রাজনৈতিক শক্তি
এ যুদ্ধের নেতৃত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নাম প্রথমে আসে, এরপর মস্কোপন্থী কমুনিস্ট পার্টি, ন্যাপসহ কিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল এবং মস্কোপন্থী অনেক বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রশক্তি। ব্রিটিশ পলিসি ছিল বরাবরই চতুর। ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের একাংশ পাকিস্তানের পক্ষে আর অন্য অংশ বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন।
চীনপন্থী রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কোন ভূমিকা রাখেননি। মাওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য ভারতে গিয়ে বন্দী জীবন কাটান। রাশেদ খান মেনন বলেন “তারপর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস মাওলানাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানতাম তিনি আমাদের কাছেই আছেন। পত্রিকায় তাঁর বিবৃতি পড়েছি। আকাশবাণীতে সাক্ষাৎকার শুনেছি। প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সভার ছবিও দেখেছি পত্রিকায়। কিন্তু মওলানা যা আশংকা করেছিলেন, তিনি সুভাস বসুর মতো বন্দী ছিলেন ভারত সরকারের হাতে"।
মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবের উর্দ্ধে কোন নেতার আবির্ভাব ভারতের কাছে বিব্রতকর ছিল। ভারত সরকার আশংকা করত ভারতের বাইরে গেলে ভাসানী হয়তো বামপন্থীদের নিয়ে স্বাধীনতা শক্তির পক্ষে অপর একটি সরকার গড়ে তুলতে পারেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ লাভ করুক এটাও ভারত সরকারের কাম্য ছিল না। তাই ভাসানীকে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে গৃহ-অন্তরীণ থাকতে হয়।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ১৬৭ জন ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮ জন সদস্যের অধিকাংশই ভারতে গমন করেন তবে এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায় না। কতিপয় সদস্য মিয়ানমারে (বার্মায়) আশ্রয় গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সরকার ৭৭ জন জাতীয় পরিষদের ও ১৪৫ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদেরকে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার জন্য ইশতেহার জারী করে। এই থেকে অনুমান করা যায় ১৬৭ জনের মধ্যে ৭৭ জন স্বাধীনতার পক্ষে ও ২৮৮ জনের মধ্যে ১৪৫ জন স্বাধীনতার পক্ষে থেকে ভারতে গমন করেছে বা পলাতক হয়েছে। বাকীরা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত তথা দেশভাগের বিরুদ্ধে ছিল।
মস্কোপন্থী ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট পার্টি
দুটি ভিন্ন ভিন্ন নামের দল হলেও আদর্শিকভাবে তারা ছিল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ধারক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ন্যাপের অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ আর কম্যুনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং যুগপৎ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্রদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দু’জন নেতা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে ছদ্মবেশে আগরতলা প্রেরণ ও বিভিন্ন সময় গোপন বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন ন্যাপ ও কমিউনিস্ট নেতারা।
তৎকালীন ন্যাপ নেতা ক্যাপ্টেন হালিমের নেতৃত্বে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ ও বিক্রমপুর অঞ্চলে ৬ হাজার গেরিলা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পূর্ব-পাক ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম-সম্পাদক দেওয়ান মাহবুব আলী জাতিসংঘসহ পূর্ব ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি সর্বোচ্চ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এক হয়ে মুজাফফর ও কমরেড মণি সিংহ, সোভিয়েত পার্টিকে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে কনভিন্স করেন। মুজাফফর আহমদ কংগ্রেসের সোশ্যালিস্ট ফোরাম ও ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সর্বোচ্চ উপদেষ্টা পরিষদ, সচিব পরে মন্ত্রী ডিপি ধর, পিএন হাকসার প্রমুখ ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ভাসানী ন্যাপ (পিকিংপন্থী)
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তী সময়ে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন এবং লেনিন ও মাও এর চিন্তাধারার ভিন্নতায় ন্যাপ দ্বিখন্ডিত হয়ে ভাসানী ন্যাপ ও মস্কোপন্থী ন্যাপ নামে দুটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ভাসানী পিকিংপন্থী হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রতি ছিলেন দুর্বল এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র করার স্বপ্ন তিনি ১৯৬৯ সন থেকেই দেখতেন বিধায় মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভারতে পাড়ি জমান। ভারত প্রথম দিকে তাকে বন্দী ও পরে গৃহবন্দী করে রাখলেও মুক্তিযুদ্ধের উপদেষ্টা পরিষদে তাকে সভাপতি করে রাখা হয়। এ দলের মশিউর রহমান যাদু মিয়া, কাজী জাফরসহ শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাই ভারতে গিয়ে ফিরে আসেন।
বিদ্রোহী পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা দেশভাগের পক্ষে কাজ করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালি সেনারা। বাংলাকে ১১ সেক্টরে ভাগ করে তারা যুদ্ধ পরিচালনা করে। সামরিক বাহিনীর সকল শাখা, ইপিআর ও পুলিশের বিদ্রোহীরা মুক্তিফৌজ নামে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
ছাত্র এবং ছাত্র সংগঠন
মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্রদের দ্বারা গঠিত নিউক্লিয়াস। পরে তারা ভারতের সহায়তায় গঠন করে মুজিব বাহিনী। সিরাজুল আলম খান, শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আসম আব্দুর রব প্রমুখ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে এদেশের অনেক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে এটেইন করে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ ও বামপন্থীদের প্রভাব। সেই প্রভাবেই রাজনীতি সচেতন ছাত্রদের একটি অংশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
কাদেরিয়া বাহিনী
আবদুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ১-২৫ মার্চ তিনি টাংগাইলে আওয়ামী কর্মীদের সাথে নিয়ে গণহত্যা চালান। সেনাবাহিনীর অভিযানে তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরে তিনি ভারত না গিয়ে এলাকার যুবক, কৃষক ও ডাকাতদের সংগঠিত করতে থাকে টাংগাইলের সখীপুরে। এই বাহিনীই কাদেরিয়া বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পায়। অতর্কিত ও চোরাগোপ্তা হামলা করে তারা সেনাবাহিনীকে নাজেহাল করতে থাকে। সাফল্য আসায় তাদের বাহিনী বড় হতে থাকে। এই বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭০০০। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা এবং ঢাকা, ময়মনসিংহ ও পাবনার কিছু অংশ ছিল এর কর্মক্ষেত্র। এ বাহিনীর কোন যোদ্ধাই বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেনি। তবে এদের মধ্যে অনেকেই পূর্বে ডাকাতির সাথে যুক্ত ছিল বিধায় যৎসামান্য আগ্নায়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার তারা জানতো। ফলে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পাক সেনাবাহিনীকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। টাঙ্গাইলে তারা মুক্ত অঞ্চল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
হেমায়েত বাহিনী
হেমায়েত উদ্দিন ছিলেন ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার। তিনি জয়দেবপুর ক্যাম্পে ছিলেন। তিনি এবং তার অনুসারী সৈনিকরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৫ জনকে হত্যা করে শতাধিক অস্ত্র, প্রচুর গোলাবারুদ, ৩টি গাড়ী এবং কয়েকজন জোয়ান নিয়ে পূর্ব দিকে চলে যান। হেমায়েত প্রথমে বাঘিয়ার বিলে তার ঘাঁটি স্থাপন করেন। ২৯ মে গৌরনদী থানার বাটরা বাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে হেমায়েত বাহিনীর উদ্বোধন করেন। ১ জুন বরিশাল অঞ্চলে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। হেমায়েত বাহিনীর কর্মক্ষেত্র ছিল বরিশালের উজিরপুর ও গৌরনদী থানা, ফরিদপুরের কালকিনি, মাদারীপুর, রাজৈর, গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া। সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণভাবে গড়ে উঠেছিল এই হেমায়েত বাহিনী। তার দলে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৫,০৫৪ জন। তাদের মধ্যে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীর লোক ছিল ৪০ জন। এদের সাহায্যে তিনি কোটালীপাড়া থানার জহরের কান্দি হাই স্কুলে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিন মাসে প্রায় চার হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ দান করা হয়। এদের মধ্যে দেড় হাজার গরীব শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাকে মাসিক ৯৫ টাকা হিসেবে বেতনও দেওয়া হতো। বিভিন্ন বাজার থেকে তারা চাঁদা কালেকশন করতেন।
সরকারী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা
১৯৭১ সনে প্রায় ২০০ জন সিএসপি ছিলেন যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মাত্র ১৩ জন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া ইপিসিএস ৬২ জন অন্যান্য বিভাগের ৫১ জন উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন