১০ ফেব, ২০২১

দেওবন্দীদের সাথে মাওলানা মওদূদীর বিরোধ যেভাবে শুরু হয়

ছবি : মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী 

বছর কয়েক আগে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (ইআবা) সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি ফয়জুল করীম তার এক বক্তব্যে বলেন, রাজনীতিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য একটি ভুলই যথেষ্ট। সেখানে জামায়াত করেছে অনেক ভুল। সেখানে তিনি জামায়াতের ভুল হিসেবে যেগুলো আবিষ্কার করেন তা হলো, 

১. ১৯৪৭ সালে জামায়াত দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে ছিল 
২. ১৯৭১ পাকিস্তান ভাগের বিপক্ষে ছিল 
৩. ১৯৮৬ সালে হাফেজ্জি হুজুরের পক্ষে ইলেকশন না করা। 
৪. ১৯৯১ সালে বিএনপিকে সাপোর্ট দেওয়া 
৫. ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা 
৬. ২০০৮ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা 
৭.  ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করা। 

এসব ভুলগুলো বলার পরে তিনি বলেছেন, তার কথা রেকর্ড হচ্ছে। কেউ যাতে তার ভুল হলে ধরিয়ে দেয়। এবং চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন কেয়ামত পর্যন্ত তার কথা শুনে যেতে হবে কারণ এগুলোর জবাব কেউ দিতে পারবে না। 

যাই হোক এখানে আমি চরমোনাই নেতা ফয়জুল করিমের ১ম অভিযোগ নিয়ে কথা বলবো শুধু। এই দেশে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হয়। আর সেটা যদি জামায়াত হয় তবে তার ওপর দোষ চাপানো পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ও আরামদায়ক কাজ। যেমন এদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যা গণধর্ষণ করেছে বাঙালি সৈনিক ও আওয়ামী নেতা-কর্মীরা। কিন্তু এর দায় চাপিয়ে খুন করা হয়েছে জামায়াত নেতাদের। এভাবেই চলে আসছে। এই সম্পর্কে জানতে পড়ুন

মেজর জিয়াউর রহমান ও গণহত্যা প্রসঙ্গ
১৯৭১ সালের হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও সত্যাসত্য প্রসঙ্গ

মাওলানা মওদূদী বা জামায়াত কি দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপক্ষে ছিলেন?
এর উত্তর হচ্ছে 'না'। মুফতি(!) ফয়জুল অনরেকর্ড মিথ্যে কথা বলেছেন। বরং ওয়ান নেশন থিওরির পক্ষে ছিলেন ইআবা'র আকাবির হুসাইন আহমেদ মাদানী।   

মূলঘটনা হলো ১৯৩৫ সাল থেকে বারংবার মুশরিকদের হিংসা ও আক্রমনের শিকার হয়ে মুসলিমরা নিজেদের জন্য আলাদা আবাসভূমির কথা ভাবছিল। তার প্রেক্ষিতে লাহোর প্রস্তাব ও পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়। তখন হিন্দু নেতাদের সাথে সুর মিলিয়ে কিছু মুসলমান ব্যক্তিত্বও পাকিস্তান আন্দোলনের সমালোচনায় নেমে পড়লেন। মুসলমান ব্যক্তিত্বের অন্যতম ছিলেন দেওবন্দিদের প্রধান নেতা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আমীর মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী।

১৯৩৭ সালে ভারতে ১ম নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগ ভালো ফলাফল করতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ ছিল হুসাইন আহমেদ মাদানী মুসলিম লীগ ও দ্বিজাতিত্ত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং প্রচারণা চালান। তিনি মুসলিমদেরকে মুসলিম লীগে ভোট না দিয়ে মুশরিকদের সংগঠন কংগ্রেসকে ভোট দিতে বলেন। এভাবে মুসলিমদের মধ্যে বড়সড় দ্বিধা ও বিভাজন তৈরি করতে সক্ষম হয় দেওবন্দি আলেমরা। তাদের এই প্রচারণার কারণে সিলেটের করিমগঞ্জ ভারতের সীমানায় চলে গেছে। আজকে সেখানে করিমগঞ্জের মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।    
 
১৯৩৮ সালে হুসাইন মাদানী ‘মুত্তাহিদা কওমিয়াত আওর ইসলাম’ বা ‘যুক্ত জাতীয়তা ও ইসলাম’ শিরোনামে একটি বই লিখেন। তিনি যুক্ত জাতীয়তার পক্ষে  সাফাই গাইতে গিয়ে পুস্তিকায় লেখেন, “যুক্ত জাতীয়তার বিরোধীতা ও তাকে ধর্ম বিরোধী আখ্যায়িত করা সংক্রান্ত  যে সব ভ্রান্ত ধারণা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে, তার নিরসন করা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হলো। 

১৮৮৫ সাল থেকে কংগ্রেস ভারতের জনগণের কাছে স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে জাতিগত ঐক্য গড়ার আবেদন জানিয়ে অব্যাহতভাবে জোরদার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। আর তার বিরোধী শক্তিগুলি সেই আবেদন অগ্রহণযোগ্য, এমনকি অবৈধ ও হারাম সাব্যস্ত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের জন্য  এ জাতিগত  ঐক্যের চাইতে ভয়ংকর আর কিছুই নেই, এ কথা সুনিশ্চিত। এ জিনিসটা ময়দানে আজ নতুন আবির্ভূত হয়নি,  বরং ১৮৮৭ সাল বা তার পূর্ব থেকে আবির্ভূত। বিভিন্ন শিরোনামে এর ঐশী তাগিদ ভারতীয় জনগণের মন মগজে কার্যকর করা হয়েছে। তিনি আর এক ধাপ  এগিয়ে বলেন,“ আমাদের যুগে দেশ থেকেই জাতির উৎপত্তি ঘটে থাকে। এতএব হিন্দু মুসলিম এক জাতি, আমরা সবাই ভারতীয়”

ওনার এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিমদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। একদিকে তাদের মন সায় দিচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি অন্যদিকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় আলেম বলছেন হিন্দুদের সাথে থাকার কথা। তার এই বইয়ের বিপরীতে কিছু দেওবন্দী নেতা বক্তব্য দিলেও তার যুক্তি খণ্ডন করে কেউ কিছু করতে পারে নি। অন্যদিকে আলিয়া মাদ্রাসার আলেমদেরকে তো দেওবন্দীরা পাত্তাই দিত না। 

অবশেষে তাত্ত্বিক দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিষয়ে আদ্যোপান্ত গবেষণানির্ভর বই লিখেন মওলানা মওদূদী রহ.। সেই বইটি বাংলায় “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” নামে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সেই বইতে হিন্দু-মুসলিম এক জাতি এই ধারণার  সব যুক্ত খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর গোটা মানব বসতিতে মাত্র দু’টি দলের অস্তিত্ব রয়েছে; একটি আল্লাহর দল অপরটি শয়তানের দল। তাই এই দুই দল মিলে কখন এক জাতি হতে পারে না, যেমন পারে না তেল ও পানি মিশে এক হয়ে যেতে। মওলানার এই বই তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

মাওলানা মওদূদী রহ. বলেন, অমুসলিম জাতি সমূহের সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্কের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমটি এই যে মানুষ হওয়ার দিক দিয়ে মসলিম-অমুসলিম সকলেই সমান। আর দ্বিতীয়টি এই যে, ইসলাম ও কুফরের পার্থক্য হেতু আমাদেরকে তাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে দেয়া হয়েছে। প্রথম সম্পর্কের দিক দিয়ে মুসলিমরা তাদের সাথে সহানুভূতি, দয়া ঔদার্য ও সৌজন্যের ব্যবহার করবে।  

কারণ মানবতার দিক দিয়ে এরূপ ব্যবহারই তারা পেতে পারে। এমনকি তারা যদি ইসলামের দুশমন না হয়, তাহলে তাদের সাথে বন্ধুত্ব, সন্ধি এবং মিলিত উদ্দেশ্যের (Common Cause) সহযেগিতাও করা যেতে পারে। কিন্তু কোন প্রকার বস্তুগত ও বৈষয়িক সম্পর্ক তাদেরকে ও আমাদেরকে মিলিত করে ‘একজাতি’ বানিয়ে দিতে পারেনা।

তিনি আরো বলেন, যেসব গন্ডীবদ্ধ, জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও কুসংস্কারপূর্ণ ভিত্তির উপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ গড়ে উঠেছে আল্লাহ ও তাঁর রসুল তা চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেন। বর্ণ, গোত্র, জন্মভূমি, অর্থনীতি ও রাজনীতিক অবৈজ্ঞানিক বিরোধ ও বৈষম্যের ভিত্তিতে মানুষ নিজেদের মূর্খতা ও চরম অজ্ঞতার দরুণ মানবতাকে বিভিন্ন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত করেছিল, ইসলাম তার সবগুলোকে আঘাতে চূর্ণ করে দেয় এবং মানবতার দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষকে সমশ্রেণীর সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমানাধিকার প্রধান করেছে। 

ইসলামী জাতীয়তায় মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে, কিন্তু জড়, বৈষয়িক ও বাহ্যিক কোন কারণে নয়। করা হয় আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্য বিধান পেশ করা হয় যার নাম ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয়মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা, সততা ও ধর্মানুসরণের দিকে গোটা মানব জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। 

যারা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে,তারা এক জাতি হিসাবে গণ্য হবে আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে, তারা সম্পুর্ণ ভ্ন্নি জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমস্ত ব্যক্তিসমষ্টি মিলে একটি উম্মাহ। অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি। মুসলিম ও মুশরিক কখনো এক জাতি হতে পারে না।

দ্বি-জাতি তত্ত্ব হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোন তত্ত্ব নয়। এ তত্ত্ব মানুষের সৃষ্টি থেকে, বিশেষ করে ইসলামের আবির্ভাব  থেকে সমাজে সুস্পষ্ট ছিল। রসুল সা. বলেছেন “আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহেদা”- সমস্ত  কুফর জাতি এক জাতি এবং “আল মুসলেমু আখুল মুসলিম” এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। এ এক চরম সত্য। 

যেহেতু  মুসলিম  ধর্মের মূল শিরক বিবর্জিত ওহদানিয়াতের প্রতি বিশ্বাস  ও তদানুযায়ী জীবনাচার। এই বিশ্বাসের রূপরেখা প্রতিফলিত হয় মুসলিম সংস্কৃতিতে ও এরই সৃষ্ট  শ্রেষ্ঠ চরিত্র দিয়ে। কুরআন ধর্মের একত্বের উপরে জোর দিয়ে একে ঈমানের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছে। যে কারণে দেশের, ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও গোটা বিশ্বের মুসলিম সংস্কৃতিতে ঐক্যের সুর বিরাজমান। সব মুসলমান এক জাতি।

মাওলানা মওদূদীর এই বই মুসলিম সমাজে ব্যাপক সাড়া তৈরি করে। দেওবন্দী ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতি মুসলিমদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এই বইয়ের প্রভাবে জমিয়তে উলামায় হিন্দ থেকে বের হয়ে আসেন মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে একটি দল। তারা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে নতুন দল করেন। মাওলানা আশরাফ আলী থানবিও এই নতুন দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।  

১৯৪৬ সালের পরবর্তী নির্বাচনে মুসলিম লীগ আশানুরূপ ভালো ফলাফল করে। যার ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি মুসলিমদের অকুণ্ঠ সমর্থন লক্ষ্য করা যায়। দেওবন্দী তথা হুসাইন আহমদ মাদানীর অনুসারীদের সাথে মাওলানা মওদূদীর বিরোধ এখান থেকে শুরু। এরপর যত আলাপ তৈরি হয়েছে তা তাদের হিংসা ও মিথ্যাচার থেকে উদ্ভূত। আর এখন এসে মুফতি ফয়জুল হুসাইন আহমেদ মাদানীর দায় জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। 

ফয়জুল করীমের বক্তব্য 


1 টি মন্তব্য:

  1. ভাই বিএনপি কে যদি বলা হয় বাজাদ কেমন শোনাবে।
    ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কে বলা হয় আইএবি

    উত্তরমুছুন