২৩ ফেব, ২০২১

ফতওয়ার কিতাবের শেষ পাতা



এক গ্রামে এক কৃষক ছিলেন। তিনি সকাল বেলা তার ক্ষেতে চারা লাগাচ্ছিলেন। যোহরের আজান হলো। আজান শুনে তিনি বাড়ি গেলেন। গোসল করে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। পথে দেখলেন তার ক্ষেতে ঢুকে একটি গরু সব চারা খেয়ে ফেলেছে। তিনি অত্যন্ত কষ্ট পেলেন। যাই হোক তিনি গরুটিকে তাড়িয়ে নামাজে গেলেন। নামাজ শেষে তিনি ইমাম সাহেবকে বললেন,
 
- হুজুর একটা বিষয়ে ফতওয়া দরকার। আপনি মেহেরবানী করে ফতওয়া দিন। 
- কী বিষয়ে ফতওয়া? বলো।
- হুজুর, কারো গরু যদি অন্য কারো ক্ষেতে ঢুকে ফসল খেয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে বিচার কী হবে?
- ওহ এইটা? এটা তো সহজ ব্যাপার! যার গরু সে ক্ষতিপূরণ দিবে।
- হুজুর, তাহলে শুনুন। আপনার গরু আমার সব চারা খেয়ে ফেলেছে। আমি সকাল থেকে অনেক পরিশ্রম করে এগুলো লাগিয়েছি।
- ওহ তাই নাকি। একটু অপেক্ষা করুন। আমি একটু ফতওয়ার কিতাব খুলি। আমার এখনো শেষ পাতা পড়ার বাকী আছে।
(হুজুর উঠে দাঁড়ালেন। আলমিরা থেকে ফতওয়ার আরবি কিতাব বের করে পাতা ওল্টাতে লাগলেন। অবশেষে এক পাতায় এসে বললেন)
- পেয়েছি! পেয়েছি! এখানে শর্তসাপেক্ষ ব্যাপার আছে।
- হুজুর, এখানে আবার কী শর্ত?
- শোনো মিয়া! শর্ত হলো ক্ষেতের ফসল খেয়ে যদি গরু অসুস্থ হয় তবে ক্ষেতের মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যদি অসুস্থ না হয় তবে মামলা শেষ। আর গরুর মালিক কখনোই ক্ষেতের মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। কারণ গরু অবুঝ প্রাণী। তার কোনো হিসাব-নিকাশ নাই। ক্ষেতের নিরাপত্তা বিধান করা কৃষকের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কারো কিছু করার নেই।
- (হতভম্ব হয়ে) আমি এখন কী করবো হুজুর?
- তুমি আল্লাহর কাছে দোয়া করো আমার গরু যাতে সুস্থ থাকে। নইলে গরুর দাম দিতে হবে।
 
এটা একটা গল্প। যারা নিজেদের ব্যাপারে আসলে রায় উলটে দেয় তাদের জন্য। এই গল্পটা ছোটবেলায় আমার মাতৃভাষায় খুব শুনতাম। আমি এখানে প্রমিত উচ্চারণে লিখিত রূপ দিলাম। যাই হোক এই গল্প হুজুরদের বিরুদ্ধে। হুজুররা নিজেদের ইচ্ছেমত ইসলামকে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। অথবা শাসকদের দালালি করার জন্য ইসলামকে ব্যবহার করে। আজকে এমন একজন হুজুর সম্পর্কে আলোচনা করবো।
 
তখন কোটা আন্দোলন চলছিল। সারাদেশের ছাত্ররা উত্তাল। সেসময় একদিন এক হুজুরের ভিডিও ভাইরাল হলো। তিনি ঘোষণা করলেন ছাত্র আন্দোলন হারাম। এই ফতওয়া দিলেন বাংলাদেশ আহলে হাদিস জামায়াতের নেতা আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ। তিনি ইমাম বুখারির একটি মন্তব্য নিয়ে এই ফতওয়া দিলেন। ওনার ভাষ্যমতে ইমাম বুখারি বলেছেন কথা ও কর্মের পূর্বে বিদ্যা। এটা খুবই জরুরি কথা। আমি যে বিষয়ে কথা বলবো ও কাজ করবো সে বিষয়ে যদি আমার জ্ঞান না থাকে তবে কেমনে হবে?
 
কিন্তু এর মানে তো এই না, ছাত্র অবস্থায় সে দ্বীনের দাওয়াত দিতে পারবে না। ছাত্র অবস্থায় সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে না। ন্যায় অন্যায় বুঝতে বিশ্ববিদ্যালয় পড়া শেষ করতে হবে এটা কেমন কথা! আর বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেও তো অনেকে ন্যায় অন্যায় বুঝে না। ইমাম বুখারির এই কথা বৃহত্তর অর্থে। এক কথায় বলতে গেলে যে বিষয়ে আমি জানিনা সে বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রজীবন শেষ করলে একজন ব্যক্তি সব বিষয় জেনে ফেলবেন ও মতামত দিতে পারবেন এটা মহা ভুল কথা।
 
যাই হোক তিনি মসজিদে দাঁড়িয়ে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করলেন, "যে কোনো ছাত্র আন্দোলন হারাম"। এই কথা তিনি তিনবার বললেন। পরে এই কথাও বললেন "ছাত্র আন্দোলন মানুষ করে না, পশু করে"। আব্দুর রাজ্জাকের এই ফতওয়া সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ব্যক্তিত্ব ও ভুঁইফোঁড় পেইজ ফেসবুকে ডলার খরচ করে সেই বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাক এভাবে জুলুমের প্রতিবাদকে বন্ধ করে দিতে চেয়েছেন মাফিয়ার মা হাসিনার হয়ে।
 
অথচ তিনি সংগঠন করেন সেই সংগঠনের ছাত্র আন্দোলন আছে। সেই ছাত্র আন্দোলনের নাম বাংলাদেশ আহলে হাদিস ছাত্র সমাজ। এছাড়াও তার ছেলে ছাত্র অবস্থায় থেকেই ওয়াজ মাহফিল করে বেড়াচ্ছে। এই বিষয়টা তার ফতওয়ার বিপরীতে যাচ্ছে। তার ছেলে কেন বিদ্যা শেষের পূর্বে কথা বলছে। তাদের ছাত্র সংগঠন কেন বিদ্যের পূর্বে সংগঠিত হলো।
 
ভোলায় আল্লাহর নবী সা.-এর বিরুদ্ধে কটুক্তি হয়েছে। এর প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে তৌহিদী জনতা। এই সমাবেশকে কটাক্ষ করেছেন আব্দুর রাজ্জাক। ওনার দাবি কটুক্তির শাস্তি দিবে সরকার, এর দায়িত্ব সরকারের। যদি সরকার দায়িত্ব পালন না করে তবে আমাদের কিছু করার নাই। এর জন্য সমাবেশ করা যাবে না। তিনি ভোলার তৌহিদী জনতাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, এই যুবক তুমি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠো কেন? তোমার সমস্যা কী? অর্থাৎ নবী সা.-এর অপর আঘাত এলে ক্ষিপ্ত হওয়ার দরকার নেই। উনি আরো বলেছেন, যে সমাবেশে পুলিশ বাধা দেবে সে সমাবেশে যাওয়াই হারাম।
 
এর আগেও তিনি ইকামাতে দ্বীন, মিছিল, হরতাল ইত্যাদি নিয়ে জামায়াতে ইসলামকে কটাক্ষ করেছেন। অথচ তাকে ইসলামী নেতৃবৃন্দকে খুন, ক্রসফায়ার, গণহত্যা, গুম, লুটপাট ইত্যাদি বিষয়ে জোরালে ভূমিকা রাখতে দেখি নি।
 
কিন্তু সপ্তাহ খানেক আগে ওনার ওপর হামলা হলো সিলেটে। এরপর দেখলাম তার প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবাধীন মাদ্রাসার ছাত্ররা তার ওপর হামলার প্রতিবাদে মিছিল করছে, সমাবেশ করছে। ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, রাজশাহীতে এই ধরণের ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদী সমাবেশের ছবি ও ভিডিও আমি দেখলাম।
 
উপরে যে গল্প উল্লেখ করেছি, আমি ভেবেছি এগুলো শুধু গল্পেই হয়! অথচ দেখুন আহলে হাদীসদের আইকন হয়ে এই হুজুর কীভাবে নিজের প্রয়োজনে ইসলামকে ব্যবহার করছে। এরা সুবিধাবাদী ও অত্যাচারী শাসকদের দালাল। এদের থেকে সাবধান থাকুন। এরা নবীর ওপরে আঘাত এলে ক্ষিপ্ত হতে নিষেধ করে আর নিজের ওপরে আঘাত এলে ছাত্রদের লেলিয়ে দিচ্ছে। এদের থেকে সাবধান থাকুন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন