আজ পহেলা মার্চ। ইসলামী সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী জাগরণের কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ৭১ তম জন্মবার্ষিকী।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংগীতাঙ্গনে ইসলামী চেতনার যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করতে যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি মল্লিক। বাংলাদেশের ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার যে ক্ষেত্রে তৈরী হয় মল্লিক হলেন তার পথ প্রদর্শক।
বিশ্বাসী চেতনার শৈল্পিক ধারায় সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার এক নতুন ভুবনের স্রষ্টা বলা যায় তাকে। বিশেষ করে বাংলা কবিতা ও গানের ক্ষেত্রে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কবি ফররুখ আহমদের ধারাকে নতুন করে বেগবান এবং উজ্জ্বল করেছেন তিনি। এক কথায় বলা যায় মতিউর রহমান মল্লিক বাংলাসাহিত্যে ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের ধারা চর্চার নতুন ক্ষেত্র তৈরীর প্রধান সিপাহসালার।
ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিকের জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯৫০ সালের ১ মার্চ বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুন্সি কায়েম উদ্দিন মল্লিক স্থানীয় জারিগানের দলের জন্য গান লিখতেন। মাতা আয়েশা বেগম। ২০১০ সালের ১২ আগস্ট রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে হার্ট এ্যাটাক মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এরআগে হার্টের ব্লক ও কিডনী রোগে ভুগছিলেন তিনি। একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, সংগঠক কবি মতিউর রহমান মল্লিক
কবি মতিউর রহমান মল্লিক বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমেদের পর মল্লিক দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি ইসলামি ধারায় অসংখ্য গান ও কবিতা রচনা করেন। তাকে অনেকেই সবুজ জমিনের কবি ও মানবতার কবি বলে থাকেন।
কবি মল্লিক ছিলেন একজন বড় মাপের সংগঠক। তিনি ছিলেন ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা। শৈশব থেকেই তিনি বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। তারপর একে একে তার অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়ল ও মাদরাসায় গড়ে ওঠে একই ধারার অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ বিশ্বের যেখানেই বাংলাভাষাভাষী মুসলমান রয়েছে সেখানেও গড়ে উঠেছে একই ধারার বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন।
তৎকালীন রেডিওতে কবি ফররুখ আহমদ যে সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন সেই আসরে মল্লিকের বড় ভাই কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। পিতা-মাতার সান্নিধ্যে থেকে তিনি গানের প্রাথমিক জীবন শুরু করেন। প্রাথমিক জীবনে রেডিওতে গান শুনে শুনে গান লেখা শুরু করেন।
সেসময়ে তার লেখা প্রায় সকল গানই ছিল প্রেমের। পরে ইসলামি আদর্শে প্রভাবিত হয়ে ইসলামি ধারায় গান লেখা শুরু করেন। মল্লিক বারুইপাড়া সিদ্দীকিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবনে কবি মতিউর রহমান মল্লিক সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, ‘বিপরীত উচ্চারণ’ সাহিত্য সংকলনও সম্পাদনা করেন। মাসিক কলম পত্রিকার সম্পাদক এবং মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন।
প্রচার বিমুখ এ ব্যক্তিটি কাজ করেছেন মানুষের জন্য, মানবতার জন্য, বিশ্বাসের জন্য। ছোট বড় সবার জন্য লিখেছেন তিনি। তার লেখা অনেক কিন্তু কমই প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত সফলতার চেয়ে আদর্শিক সফলতার কথাই বেশি ভেবেছেন। তার ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের আকুল আকতিতে কথা ও সুর নিয়ে সংস্কৃতিপ্রেমীদের মাঝে উৎসাহের কারণে কিছু কাজকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন।
তার রচিত বইগুলো হচ্ছে, নীষন্ন পাখির নীড়ে (কাব্যগ্রন্থ), সুর-শিহরণ (ইসলামি গানের বই), যত গান গেয়েছি (ইসলামি গানের সঙ্কলন), ঝংকার (গানের বই), আবর্তিত তৃণলতা (কাব্যগ্রন্থ), তোমার ভাষার তীক্ষ্ণ ছোরা (কাব্যগ্রন্থ), অনবরত বৃক্ষের গান (কাব্যগ্রন্থ), চিত্রল প্রজাপতি (কাব্যগ্রন্থ), নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রবন্ধের বই) প্রভৃতি।
অনুবাদক হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। পাহাড়ি এক লড়াকু নামে আফগান মুজাহিদদের অমর কীর্তিকলাপ তার বিখ্যাত অনুবাদ উপন্যাস যা কিশোকণ্ঠের পাঠকরা মন উজার করে পড়তেন নিয়মিত। মহানায়ক (উপন্যাস) ছাড়াও হযরত আলী ও আল্লামা ইকবালের মতো বিশ্বখ্যাত মুসলিম কবিদের কবিতাও অনুবাদ করেন তিনি।
সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। কবি মতিউর রহমানের প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা হলো, সবুজ-মিতালী সংঘ, বারুইপাড়া, বাগেরহাট; স্বর্ণপদক: জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা; সাহিত্য পদক: কলমসেনা সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা; সাহিত্য পদক: লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদ; সাহিত্য পদক: রাঙামাটি সাহিত্য পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম; সাহিত্য পদক: খানজাহান আলী শিল্পীগোষ্ঠী, বাগেরহাট; সাহিত্য পদক: সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ; সাহিত্য পুরস্কার: সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ, বাগেরহাট প্রভৃতি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন