৬ মার্চ, ২০২১

পররাষ্ট্রনীতি ও চুক্তির ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা



পররাষ্ট্র ও চুক্তি বিষয়ে কুরআনে যে কয়টি আয়াত পাওয়া যায় তার আলোকে এই বিষয়ে নির্দেশনা নেওয়া হয়েছে। 

০১. “যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে নিজের জানমালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ করেছে আর যারা হিজরতকারীদের আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে, আসল তারাই পরস্পরের বন্ধু ও অভিভবক। আর যারা ঈমান এনেছে ঠিকই কিন্তু হিজরত করে (দারুল ইসলামে) আসেনি তারা হিজরত করে না আসা পর্যন্ত তাদের সাথে তোমাদের বন্ধুত্বের ও অভিভাবকত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে হাঁ, দীনের ব্যাপারে যদি তারা তোমাদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের জন্য ফরয। কিন্তু এমন কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ্ তা দেখেন।” (সূরা আনফালঃ৭২)

এ আয়াতটি ইসলামের সাংবিধানিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা। এখানে একটি মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছে। সেটি হচ্ছে, “অভিভাবকত্বের” সম্পর্ক এমন সব মুসলমানদের মধ্যে স্থাপিত হবে যার দারুল ইসলামের বাসিন্দা অথবা বাইরে থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে এসেছে। আর যেসব মুসলমান ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে বাস করে তাদের সাথে অবশ্যি ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকবে, কিন্তু “অভিাভাবকত্বের” সম্পর্ক থাকবেনা। অনুরূপভাবে যেসব মুসলমান হিজরত করে দারুল ইসলামে আসবেনা বরং দারুল কুফরের প্রজা হিসেবে দারুল ইসলামে আসবে তাদের সাথেও এ সম্পর্ক থাকবেনা।

এ আয়াতে দারুল ইসলামের বাইরে অবস্থানকারী মুসলমানদের “রাজনৈতিক অভিভাবকত্বের” সম্পর্ক মুক্ত গণ্য করা হয়েছেল। এখন এ আয়তটি বলছে যে, তারা এ সম্পর্কের বাইরে অবস্থান করা সত্ত্বেও “ইসলামী ভ্রাতৃত্বের” সম্পর্কের বাইরে অবস্থান করছেনা। যদি কোথাও তাদের ওপর যুলুম হতে থাকে এবং ইসলামী ভ্রাতৃ সমাজের সাথে সম্পর্কের কারণে তারা দারুল ইসলামের সরকারের ও তার অধিবাসীদের কাছে সাহায্য চায় তাহলে নিজেদের এ মজলুম ভাইদের সাহায্য করা তাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে। কিন্তু এরপর আরো বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, চোখ বন্ধ করে এসব দ্বীনি ভাইয়ের সাহায্য করা যাবেনা। বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরোপিত দায়িত্ব ও নৈতিক সীমারেখার প্রতি নযর রেখেই এ দায়িত্ব পালন করা যাবে। জুলুমকারী জাতির সাথে যদি ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তিমূলক সম্পর্ক থাকে তাহলে এ অবস্থায় এ চুক্তির নৈতিক দায়িত্ব ক্ষুন্ন করে মজলুম মুসলমানদের কোনো সাহায্য করা যাবেনা।

০২. “আর যদি কখনো কোনো জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের খিয়ানতের আশংকা থাকে তাহলে তার চুক্তি প্রকাশ্যে তার সামনে ছুঁড়ে দাও।” (সূরা আনফালঃ ৫৮)

এ আয়াতের দৃষ্টিতে যদি কোনো ব্যক্তি, দল বা দেশের সাথে আমাদের চুক্তি থাকে এবং তার কর্মনীতি আমাদের মনে তার বিরুদ্ধে চুক্তি মেনে চলার ব্যাপারে গড়িমসি করার অভিযোগ সৃষ্টি করে অথবা সুযোগ পেলেই সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এ ধরনের আশংকা দেখা দেয়, তাহলে আমাদের পক্ষে একতরফাভাবে এমন সিদ্ধান্ত করা কোনোক্রমেই বৈধ নয় যে, আমাদের ও তার মধ্যে কোনো চুক্তি নেই। আর এই সংগে হঠাৎ তার সাথে আমাদের এমন ব্যবহার করা উচিত নয় যা একমাত্র চুক্তি না থাকা অবস্থায় করা যেতে পারে। 

বরং এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে কোনো বিরোধীতামূলক কর্যক্রম গ্রহণ করার আগে দ্বিতীয় পক্ষকে স্পষ্টভাষায় একথা জানিয়ে দেবার জন্য আমাদের তাগিদ দেয়া হয়েছে যে, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এখন আর কোনো চুক্তি নেই। এভাবে চুক্তি ভঙ্গ করার জ্ঞান আমরা যতটুকু অর্জন করেছি তারও ততটুকু অর্জন করতে পারবে এব চুক্তি এখনো অপরিবর্তিত আছে, এ ধরনের ভুল ধারণা তারা পোষণ করবেনা। আল্লাহর এ ফরমান অনুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিন্মোক্ত স্থায়ী মুলনীতি ঘোষণা করেছিলেনঃ “কোনো জাতির সাথে কারোর কোনো চুক্তি থাকলে মেয়াদ শেষ হবার আগে তার চুক্তি লংঘন করা উচিত নয়। এক পক্ষ চুক্তি ভংগ করলে উভয় পক্ষের সমতার ভিত্তিতে অপর পক্ষ চুক্তি বাতিল করার কথা জানাতে পারে।”

০৩. “কাজেই এ লোকদের যদি তোমরা যুদ্ধের মধ্যে পাও তাহলে তাদের এমনভাবে মার দেবে যেনো তাদের পরে অন্য যারা এমনি ধরনের আচরণ করতে চাইবে তারা দিশা হারিয়ে ফেলে। আশা করা যায়, চুক্তি ভংগকারীদের এ পরিণাম থেকে তারা শিক্ষা গ্রহণ করবে।” (সূরা আনফালঃ ৫৭)

এর অর্থ হচ্ছে, যদি কোনো জাতির সাথে আমাদের চুক্তি হয়, তারপর তারা নিজেদের চুক্তির দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে আমরাও চুক্তির নৈতিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। এ ক্ষেত্রে আমরাও তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ন্যায়সংগত অধিকার লাভ করবো। তাছাড়া যদি কোনো জাতির সাথে আমাদের যুদ্ধ চলতে থাকে এবং আমরা দেখি, শত্রুপক্ষের সাথে এমন এক সম্প্রদায়ের লোকেরাও যুদ্ধে শামিল হয়েছে যাদের সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে তাহলে আমরা তাদেরকে হত্যা করতে এবং তাদের সাথে শত্রুর মতো ব্যবহার করতে একটুও দ্বিধা করবোনা। কারণ তারা ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের সম্প্রদায়ের চুক্তি ভংগ করে তাদের ধন প্রাণের নিরাপত্তার প্রশ্নে তাদের সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের যে চুক্তি রয়েছে তা লংঘন করেছে। ফলে নিজেদের নিরাপত্তার অধিকার তারা প্রমাণ করতে পারেনি।


০৪. “আর হে নবী, শত্রু যদি সন্ধি ও শান্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে তুমিও সেদিকে ঝুঁকে পড়ো এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভর করো। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন। যদি তারা তোমাকে প্রতারিত করতে চায় তাহলে তোমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট।” (সূরা আনফালঃ ৬১-৬২)

অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে তোমাদের কাপুরুষোচিত নীতি অবলম্বন করা উচিত নয়। বরং আল্লাহর ওপর ভরসা করে নির্ভীক ও সাহসী নীতি অবলম্বন করা উচিত। শত্রু সন্ধির কথা আলোচনা করতে চাইলে নিসংকোচে তার সাথে আলোচনার টেবিলে বসে যাবার জন্য তৈরী থাকা প্রয়োজন। সে সদুদ্দেশ্যে সন্ধি করতে চায়না বরং বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়, এ অজুহাত দেখিয়ে তার সাথে আলোচনায় বসতে অস্বীকার করোনা। কারোর নিয়ত নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভবপর নয়। সে যদি সত্যিই সন্ধি করার নিয়ত করে থাকে তাহলে অনর্থক তার নিয়তের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে রক্তপাতকে দীর্ঘায়িত করবে কেন?

০৫. তবে যেসব মুশরিকের সঙ্গে তোমরা চুক্তি করেছ, পরে তারা চুক্তি রক্ষার ব্যাপারে কোনো ত্রুটি করেনি, আর তারা তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্যও করেনি, তাদের সেই চুক্তি তোমরা মেয়াদকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ করবে। অবশ্যই আল্লাহ দায়িত্বনিষ্ঠদের ভালোবাসেন। (সুরা তাওবা, আয়াত ৪)

অঙ্গীকার রক্ষা বা চুক্তির বাস্তবায়ন সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার পূর্বশর্ত। পৃথিবীতে মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়। সামাজিক প্রয়োজনেই মানুষকে বিভিন্ন সময় চুক্তি করতে হয়। কেননা চুক্তি না করলে সমাজে বহু ধরনের অঘটন ঘটে, তখন সমাজে বসবাস করা কষ্টকর ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। চুক্তি বা অঙ্গীকার সঠিকভাবে পালন না করলে সমাজের গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়, অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় জীবনে শাসকদের ওয়াদা পালন দেশ ও জাতির উন্নতির চাবিকাঠি।

চুক্তি মোতাবেক কাজ করা ইমানের একটি অপরিহার্য বিষয়। প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি কখনো তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তাঁরা ওয়াদা রক্ষা করেন। নবীজি (সা.) ওয়াদা করলে যেকোনো মূল্যে তা পালন করতেন। ইসলামে ওয়াদা পালনের ব্যাপারে শত্রু-মিত্র, মুসলিম-অমুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই।

উপরোক্ত যেসব আয়াত এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে, তা কুরআনের রাজনৈতিক দর্শন ও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান নীতিমালাকে পরিস্ফুট করে। কুরআন মানব জীবনের এই বিভাগ সম্পর্কে স্পষ্ট পথ নির্দেশনা দান করেছ। মুসলমানদের কর্তব্য হলো, নিজেদের যাবতীয় সামাজিক কার্যক্রম এগুলোর ভিত্তিতে পরিচালনা করা। কেবল এভাবেই তারা নিজেদের দ্বীন ও ঈমানের দাবী পূরণে সক্ষম হবে।

1 টি মন্তব্য: