৩ আগ, ২০২১

মুসলিম জাতির পিতা কি ইব্রাহিম আ.?


১৯৭১ সালের পরে আমাদের সমাজের এক বৃহত্তর অংশ শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে মান্য করে, অনুসরণ করে। তার আগে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জাতির পিতা হিসেবে মান্য করতো। জিন্নাহকে পাকিস্তানের অনেকে এখনো জাতির পিতা হিসেবে মান্য করে। 

আমার যতটুকু জানাশোনা, তা অনুসারে ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমাদের এই উপমহাদেশে নতুন আরেক জাতির পিতা পাওয়া গেছে। তিনি হলেন, ইরাকে জন্ম নেওয়া নবী ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ আ.। 

একটু গোড়া থেকে শুরু করি। 
১৯৩৫ সাল থেকে মোটামুটি পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয়। তবে হিন্দুস্থানের প্রথম নির্বাচনে মুসলিমরা মুসলিম লীগের এই দাবির পক্ষে খুব বেশি সমর্থন দিতে দেখা যায়নি। মুসলিম আসনগুলোতে আঞ্চলিক মুসলিম দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। যেমন বাংলায় শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি সবচেয়ে বেশি আসন পায়। 

পরবর্তীতে কংগ্রেস নেতাদের শত্রুতামূলক আচরণ ও জিন্নাহর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলিমরা পাকিস্তানের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিমরা পাকিস্তানের পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র ঘোষিত হয়। মুসলিমদের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে পাকিস্তান গঠিত হয় ও এই দেশের নাগরিকরা নতুন পাকিস্তানী নামে নতুন জাতীয়তা লাভ করে। 

জিন্নাহকে তার এই সাফল্য পেতে দুইটি বড় ও শক্ত বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রথমত কংগ্রেসের রাজনৈতিক বাধা। দ্বিতীয়ত দেওবন্দীদের আদর্শগত বাধা। কংগ্রেসের বাধা তো খুবই স্বাভাবিক। তারা ভারতকে রামরাজ্য বানাতে চায়। কিন্তু দেওবন্দীদের কী সমস্যা তা আল্লাহই ভালো জানেন। 

দেওবন্দী আলেমদের একটি সংগঠন ছিল জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। এর প্রধান হুসাইন আহমেদ মাদানী ১৯৩৮ সালে ‘মুত্তাহিদা কওমিয়াত আওর ইসলাম’ বা ‘যুক্ত জাতীয়তা ও ইসলাম’ শিরোনামে একটি বই লিখেন। তিনি যুক্ত জাতীয়তার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে পুস্তিকায় লেখেন, "আমাদের যুগে দেশ থেকেই জাতির উৎপত্তি ঘটে থাকে। এতএব হিন্দু মুসলিম এক জাতি, আমরা সবাই ভারতীয়"। তিনি মুসলিমদেরকে আহ্বান জানান যাতে মুসলিমরা কংগ্রেসের দাবির সাথে যুক্ত থাকে ও পাকিস্তান দাবির বিরোধীতা করে। 

ওনার এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলিমদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। একদিকে তাদের মন সায় দিচ্ছে পাকিস্তানের প্রতি, অন্যদিকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় আলেম বলছেন, মুশরিকদের সাথে থাকার কথা। তার এই বইয়ের বিপরীতে কিছু দেওবন্দী নেতা বক্তব্য দিলেও তার যুক্তি খণ্ডন করে কেউ কিছু করতে পারে নি। অন্যদিকে আলিয়া মাদ্রাসার আলেমদেরকে তো দেওবন্দীরা পাত্তাই দিত না। 

অবশেষে তাত্ত্বিক দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিষয়ে আদ্যোপান্ত গবেষণানির্ভর বই লিখেন ইমাম মওদূদী রহ.। সেই বইটি বাংলায় “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” নামে প্রকাশিত হয়েছে পরে। তিনি সেই বইতে হিন্দু-মুসলিম এক জাতি এই ধারণার  সব যুক্তি খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর গোটা মানব বসতিতে মাত্র দু’টি দলের অস্তিত্ব রয়েছে; একটি আল্লাহর দল অপরটি শয়তানের দল। তাই এই দুই দল মিলে কখন এক জাতি হতে পারে না, যেমন পারে না তেল ও পানি মিশে এক হয়ে যেতে। মাওলানার এই বই তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

উস্তাদ মওদূদী রহ. বলেন, ইসলামী জাতীয়তায় মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে, কিন্তু জড়, বৈষয়িক ও বাহ্যিক কোন কারণে নয়। করা হয় আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্য বিধান পেশ করা হয় যার নাম ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয়মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা, সততা ও ধর্মানুসরণের দিকে গোটা মানব জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। 

যারা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে,তারা এক জাতি হিসাবে গণ্য হবে আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে, তারা সম্পুর্ণ ভ্ন্নি জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমস্ত ব্যক্তিসমষ্টি মিলে একটি উম্মাহ। অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি। মুসলিম ও মুশরিক কখনো এক জাতি হতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, দ্বি-জাতি তত্ত্ব হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোন তত্ত্ব নয়। এ তত্ত্ব মানুষের সৃষ্টি থেকে, বিশেষ করে ইসলামের আবির্ভাব  থেকে সমাজে সুস্পষ্ট ছিল। রসুল সা. বলেছেন “আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহেদা”- সমস্ত  কুফর জাতি এক জাতি এবং “আল মুসলিমু আখুল মুসলিম” এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। এ এক চরম সত্য। 

যেহেতু  মুসলিম  ধর্মের মূল শিরক বিবর্জিত ওহদানিয়াতের প্রতি বিশ্বাস  ও তদানুযায়ী জীবনাচার। এই বিশ্বাসের রূপরেখা প্রতিফলিত হয় মুসলিম সংস্কৃতিতে ও এরই সৃষ্ট  শ্রেষ্ঠ চরিত্র দিয়ে। কুরআন ধর্মের একত্বের উপরে জোর দিয়ে একে ঈমানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। যে কারণে দেশের, ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও গোটা বিশ্বের মুসলিম সংস্কৃতিতে ঐক্যের সুর বিরাজমান। সব মুসলমান এক জাতি।

মাওলানা মওদূদীর এই বই মুসলিম সমাজে ব্যাপক সাড়া তৈরি করে। দেওবন্দী ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতি মুসলিমদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এই বইয়ের প্রভাবে জমিয়তে উলামায় হিন্দ থেকে বের হয়ে আসেন মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে একটি দল। তারা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে নতুন দল করেন। মাওলানা আশরাফ আলী থানবিও এই নতুন দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।     

যাই হোক অবশেষে পাকিস্তান আন্দোলন সফল হলো। এরপর জিন্নাহর অনুসারীরা জিন্নাহকে পাকিস্তানের 'বাবায়ে কওম' বা জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর জিন্নাহ বিরোধী আলেমেরা আরো ক্ষেপে যায়। তারা অর্থাৎ দেওবন্দীদের মূলধারা তখন সূরা হজ্জ্বের শেষ আয়াত তথা ৭৮ নং আয়াতকে সাক্ষী করে দাবি করে মুসলিম জাতির পিতা হলেন ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ আ.। আর কেউ মুসলিমদের জাতির পিতা হতে পারেন না। 

পাকিস্তান তখন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর (বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, কাশ্মীরি, পশতুন ইত্যাদি) মুসলিমদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় এটি মুসলিমদের সমার্থক জাতীয়তায় পরিণত হয়েছিল। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতা হুসাইন আহমদ মাদানীর অনুসারীরা জিন্নাহকে ঠেকাতে গিয়ে নতুন জাতির পিতা হাজির করেছেন। জিন্নাহপন্থীরা এর বিরোধীতা করে নিজেদেরকে ইব্রাহিম আ.-এর বিরোধী বানাতে চায়নি। তাই জিন্নাহ 'বাবায়ে কওম' হিসেবে পরিচিত না হয়ে 'কায়েদে আজম' হিসেবে বেশি পরিচিত হয়েছেন। 

এবার আমরা দেখি সূরা হজ্বের ৭৮ নং আয়াতে আল্লাহ কী বলেছেন? 
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 
১। আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ। 
২। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন। 
৩। দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। 
৪। তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। 
৫। তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’ পূর্বে এবং এ কিতাবেও। 
৬। যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় আর তোমরা মানুষের জন্য সাক্ষী হও। 
৭। অতএব তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে মজবুতভাবে ধরো। 
৮। তিনিই তোমাদের অভিভাবক। আর তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক এবং কতই না উত্তম সাহায্যকারী!   

এখানে একটি আয়াতে আটটি কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যারা ইব্রাহিম আ.-কে জাতির পিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন তারা বলতে চান, তারা ৪ নং ও ৫ নং কথাকে মিলিয়ে বলতে চান, আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম আ.-কে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন কারণ তিনিই (ইব্রাহিম আ.) আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন। 

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা 'মিন ক্ববলিকুম ওয়া ফি হাজা' এই শব্দটুকু যোগ করে নিশ্চিত করেছেন ৫ নং কথায় 'তিনি' বলতে আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম আ. নয়, নিজেকেই বুঝিয়েছেন। কুরআন ও আগের কিতাবে আমাদের নাম মুসলিম রাখার অধিকার নিশ্চয়ই নবী ইব্রাহিমের আ. নয়। এইসব আসমানী কিতাবের সত্ত্বাধিকারী কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালা। 

আর ইব্রাহিম আ.-কে পিতা বলতে আরবের লোকদের বুঝানো হয়েছে কারণ তারা নিজেদেরকে আগে থেকেই ইব্রাহিম আ.-কে তাদের পিতা হিসেবে দাবি করতো। মদিনার ইহুদিরাও একই দাবি করতো। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের দাবি অনুসারেই তাদেরকে নসিহত করছেন যেন তারা পিতাকে সঠিকভাবে অনুসরণ করে। 

আমি যতগুলো তাফসীর পড়েছি কোনো স্থানেই পাইনি আল্লাহ তায়ালা 'তোমাদের পিতা' বলতে সকল মুসলিমের পিতা বুঝিয়েছেন। বরং সবাই বলেছে কুরাইশদের পিতা বুঝিয়েছেন। আর ৫ নং কথার ক্ষেত্রে 'ইব্রাহিম আ. আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন' এটা যদি বলা হয়, তবে তা হবে কুরআনের অপব্যাখ্যা ও মিথ্যার শামিল। এটা ভয়ংকর গর্হিত কাজ। 

১৯৭১ সালের পর যারা মুজিব বিরোধী তারাও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের এই বিতর্কিত ব্যাখ্যাকে মনে প্রাণে ধারণ করেছে। ফলশ্রুতিতে এটা এখন প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে, ইব্রাহিম আ. আমাদের জাতির পিতা আর তিনিই আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন। 

আমার এই লেখা দেখে আবার কেউ ভেবে নিয়েন না আমি জিন্নাহ ও মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে মনে করি। আপনি যদি জিন্নাহকে জাতির পিতা হিসেবে মনে না করেন তবে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, জিন্নাহর মতো একজন বেনামাজী, মদখোর মুসলিম জাতির পিতা হতে পারে না। আবার মুজিবকে যদি জাতির পিতা হিসেবে মানতে না চান, এতটুকুই যথেষ্ট যে, তার মতো লুটেরা, স্বৈরাচার ও জালিম কখনোই আমাদের জাতির পিতা হতে পারে না। 

জিন্নাহ ও মুজিবকে ঠেকাতে কুরআনের ব্যাখ্যাকে বিকৃত করা জঘন্য অপরাধ বলে মনে করি। এই কথাগুলো বলার কারণ ঈদের কয়েকদিন পর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতের এক ঈদ পুনর্মিলনী প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রায় সব বক্তাই ইব্রাহিম আ.-কে জাতির পিতা ও তিনি আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। আমি মনে করি এই ভুলের সংশোধন হওয়া উচিত। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের হক মেনে নেওয়ার তাওফিক দান করুন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন