৯ আগ, ২০২১

পর্ব : ৩২ - সন্ধির সুযোগে ইসলামকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিলেন মুহাম্মদ সা.

 

মুশরিকদের সাথে যুদ্ধবিরতির সন্ধি হওয়ার সাথে সাথেই মুহাম্মদ সা. কালবিলম্ব করেননি। পুরো আরবে তিনি তাবলীগ ও তারবিয়াতের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। যেহেতু নতুন করে যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা কমে গিয়েছে তাই তিনি পুরো পৃথিবীতে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করলেন। 

ষষ্ঠ হিজরির শেষদিকে মুহাম্মদ সা. শাসক হিসেবে তাঁর নিজের জন্য সিলমোহর তৈরি করলেন। এটি ছিল রুপোর আংটি। এতে লেখা ছিল আল্লাহ, রাসূল ও মুহাম্মদ। আল্লাহ ১ম, রসূল ২য় এবং মোহাম্মদ ৩য় লাইনে লেখা হয়। সিলমোহর বানানোর পর মুহাম্মদ সা. কয়েকজন লেখক দিয়ে সমগ্র বিশ্বের নেতাদের কাছে চিঠি লিখে এবং তাতে নিজের সিলমোহরের ছাপ দিয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন ইসলামের আগমনের খবর।    

চিঠি লেখানোর পর বিতর্ক ও কূটনীতিতে অভিজ্ঞ এমন সাহাবীদের বিভিন্ন গ্রুপ করে বিশ্বের শাসকদের কাছে পাঠিয়ে দেন। প্রথমেই পাঠান বিপদের দিনে বন্ধু হিসেবে পাওয়া আবিসিনিয়ার (বর্তমানে ইথিওপিয়া) শাসক আসহামের নামে। যাকে আমরা নাজ্জাশি নামে জানি। নাজ্জাশি নাম নয়, সেখানের শাসককে নাজ্জাশি বলা হতো।  

আসহামের কাছে পাঠানো চিঠিটি নিম্নরূপ
//পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
‘আল্লাহর রসূল মোহাম্মদের পক্ষ থেকে হাবশার নাজ্জাশী আজমের প্রতি। 
সালাম সেই ব্যক্তির ওপর যিনি হেদায়াতে অনুসরণ করেন। আমি আপনার কাছে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। যিনি কুদ্দুস, যিনি সালাম, যিনি নিরাপত্তা ও শান্তি দেন, যিনি হেফাজতকারী ও তত্তাবধানকারী। 
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ঈসা ইবনে মরিয়ম আল্লাহর রূহ এবং তাঁর কালিমা। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পবিত্র ও সতি মরিয়মের ওপর স্থাপন করেছেন। আল্লাহর রূহ এবং ফুঁ-এর কারণে হযরত মরিয়ম গর্ভবতী হলেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা হযরত আদমকে নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর আনুগত্যের প্রতি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। এছাড়া একতার প্রতিও দাওয়াত দিচ্ছি যে, আপনি আমার আনুগত্য করুন এবং আমি যা কিছু নিয়ে এসেছি, তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন। কেননা আমি আল্লাহর রসূল, আামি আপনাকে এবং আপনার প্রজাবৃন্দদের সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আনুগত্যের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমি তাবলিগ ও নসিহত করছি। কাজেই আমার তাবলিগ ও নসিহত কবুল করুন। সালাম সেই ব্যক্তির ওপর, যিনি সত্যপথের পথিক।//

এই চিঠিটি আবিসিনিয়ার শাসক আসহামার কাছে নিয়ে যান আমর ইবনে উমাইয়া জামারি রা.। তিনি দরবারে উপস্থিত হয়ে একটি ছোট বক্তব্য উপস্থাপন করেন এবং চিঠিটি আসহামার হাতে দেন। আসহামা চিঠি পড়েন ও মুহাম্মদ সা.-এর কথাকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেন। 

এরপর তিনি প্রতিনিধি দলের কাছে মুহাম্মদ সা.-উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে দেন। 

//পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আল্লাহর রসূল মোহাম্মদের কাছে নাজ্জাশী আসহামার পক্ষ থেকে।

হে আল্লাহর নবী, আপনার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম, তাঁর রহমত ও বরকত নাজিল হোক। সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। অতঃপর, হে আল্লাহর রসূল, আপনার চিঠি আমার হাতে পৌঁছেছে। এ চিঠিতে আপনি হযরত ঈসা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। আসমান ও জমিনের মালিক আল্লাহর শপথ, আপনি যা কিছু উল্লেখ করেছেন হযরত ঈসা এর চেয়ে বেশি কিছু ছিলেন না। তিনি সেইরূপ ছিলেন আপনি যেরূপ উল্লেখ করেছেন।

আপনি আমার কাছে যা কিছু লিখে পাঠিয়েছেন, আমি তা জেনেছি এবং আপনার চাচাতো ভাই এবং আপনার সাহাবাদের মেহমানদারী করেছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর সত্য ও খাঁটি রসূল। আমি আপনার কাছে বাইয়াত করছি, আপনার চাচাতো ভাইয়ের বাইয়াত করছি এবং তাঁর হাতে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্যে ইসলাম কবুল করেছি।//

এই ঘটনার প্রায় দুই বছর পর নবম হিজরিতে আসহামা ইন্তেকাল করেন। মুহাম্মদ সা. এই খবর পেয়ে তাঁর জন্য দোয়া করেন ও গায়েবানা জানাজা আদায় করেন। এটাই প্রথম গায়েবানা জানাজা।  

এরপর আল্লাহর রাসূল সা. তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি চিঠি লিখেন। দিহইয়া কালবি রা.-কে প্রধান করে একটি প্রতিনিধি দল হিরাক্লিয়াসের কাছে পাঠানো হয়। তার দরবারে সরাসরি পৌঁছানো কঠিন ছিল তাই রোমান সম্রাটের অনুগত বসরার শাসকের মাধ্যমে দিহইয়া ক্বালবি হিরাক্লিয়াসের দরবারে পৌঁছান। সেখানে তিনি মুহাম্মদ সা.-এর পরিচিতি সম্বলিত ছোট বক্তব্য উপস্থাপন করে চিঠিটি হিরাক্লিয়াসের কাছে দেন।    
 
//পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি।
সালাম সেই ব্যক্তির প্রতি, যিনি হেদায়াতের আনুগত্য করেন। আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন তবে শান্তিতে থাকবেন ও দ্বিগুণ পুরস্কার পাবেন। যদি অস্বীকৃতি জানান, তবে আপনার প্রজাদের পাপও আপনার ওপর বর্তাবে। 
হে আহলে কিতাব, এমন একটি বিষয়ের প্রতি আসুন, যা আমাদের ও আপনাদের জন্যে একই সমান। সেটি হচ্ছে আমরা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা ও আনুগত্য করবো না। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবো না। আল্লাহ ব্যতীত আমাদের কেউ পরস্পরকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করবো না। যদি লোকেরা অমান্য করে, তবে তাদের বলে দিন যে, তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।//

এই চিঠি পেয়ে হিরাক্লিয়াস মক্কার মুশরিকদের সন্ধান করলো যারা তার বিরোধী। এরপর হিরাক্লিয়াসের গোয়েন্দারা খবর দিল মক্কার একটি বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়াতে আছে। হিরাক্লিয়াস তাদের খবর দিয়ে ডেকে আনলো। আবু সুফিয়ান ছিল সেই কাফেলার প্রধান। সেসময় হিরাক্লিয়াস জেরুজালেমে ছিল। জেরুজালেমেই তাদের ডাকা হলো। হিরাক্লিয়াস তাদের জিজ্ঞাসা করলো কে আত্মীয়তার দিক থেকে মুহাম্মদের বেশি কাছাকাছি? আবু সুফিয়ান বললো, আমি বেশি কাছাকাছি। 

অতঃপর হিরাক্লিয়াস মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে অনেক জিজ্ঞাসা করলো আবু সুফিয়ানকে। আবু সুফিয়ানের উত্তর শুনে তিনি নিশ্চিত হলেন মুহাম্মদ সা.-ই প্রতিশ্রুত শেষ নবী। তিনি মুহাম্মদ সা.-এর দাবিকে সত্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, তুমি যা কিছু বলেছো, যদি এসব সত্য হয়ে থাকে তবে তিনি খুব শীঘ্রই আমার দুই পায়ের নিচের জায়গারও মালিক হয়ে যাবেন। আমি জানতাম যে, এই নবী আসবেন কিন্তু আমার ধারণা ছিলো না যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই আসবেন। আমি যদি তার কাছে পৌঁছার কষ্ট স্বীকার করতে সক্ষম হতাম, তবে তার কাছে থেকে তার দুই পা ধুয়ে দিতাম।

এতে তার দরবারে বেশ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। পাদ্রিরা বেশ ক্ষেপে যায় ও হট্টগোল শুরু করে। চতুর হিরাক্লিয়াস দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন তার বাগ্মীতা দিয়ে। তিনি বলেন, আমি আসলে পরীক্ষা করছিলাম যিশুর প্রতি তোমাদের আস্থা কেমন আছে! আমি খুশি হয়েছি তোমরা যিশুর প্রতি আস্থাশীল। 

হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানদের চলে যেতে বলেন। এরপর দিহইয়া ক্বালবি রা.-কে কিছু মালামাল ও কাপড় উপহার দিয়ে বিদায় দেন। উপহার নিয়ে মদিনায় ফেরার পথে হুসামের জুজাম নামক গোত্র ডাকাতি করে উপহারগুলো নিয়ে যায়। দিহইয়া ক্বালবি রা. মদিনায় এসে রাসূল সা.-কে জানানোর পর নবিজী জায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠিয়ে জুজাম গোত্রকে শাস্তি দেন। তাদের গবাদি পশু ও অনেককে বন্দি করে নিয়ে আসেন।  

এরপর মুহাম্মদ সা. মিশর ও আলেকজান্দ্রিয়ার শাসক জুরাইজের নিকট চিঠি পাঠান। তার উপাধি ছিল মুকাওকিস। তার কাছে পাঠানো চিঠির বক্তব্য হিরাক্লিয়াসের চিঠির অনুরূপ ছিল। 
এই চিঠি পৌঁছানোর জন্যে হাতিব ইবনে আবি বালতাআকে মনোনীত করা হয়। তিনিও খ্রিস্টান ছিলেন। তাই নবীর আগমনকে স্বাগত জানিয়েছেন।

মুকাওকিস আল্লাহর রসূলের চিঠি নিয়ে হাতীর দাঁতের একটি কৌটোয় রাখেন এরপর মুখ বন্ধ করে সীল লাগিয়ে তার এক দাসীর হাতে দেন। এরপর আরবী ভাষার কাতেবকে ডেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লারেম কাছে নিম্নোক্ত চিঠি লেখেন।

‘পরম করুণাময় ও অতি দয়ালুয আল্লাহর নাম শুরু করছি। 
মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর কাছে মুকাওকিস আযিম কিবত-এর পক্ষ থেকে। 
আপনার প্রতি সালাম। আপনরার চিঠি পাঠ করেছি। আপনার চিঠির বক্তব্য এবং দাওয়াত আমি বুঝেছি। আমি জানি যে, এখনো একজন নবী আসার বাকি রয়েছে। আমি ধারণা করেছিলাম যে, তিনি সিরিয়া থেকে আবির্ভূত হবেন। আমি আপনার দূতের সম্মান করেছি। আপনার খেদমতে দুইজন দাসী পাঠাচ্ছি। আপনার সওয়ারীর জন্যে একটি খচ্চরও হাদিয়া স্বরূপ পাঠাচ্ছি। আপনার প্রতি সালাম।

মুকাওকিস আর কোনো কথা লেখেননি। তিনি ইসলামও গ্রহণ করেননি। তার প্রেরিত দাসীদের নাম ছিলো মারিয়া কিবতিয়া এবং শিরিন। খচ্চরটির নাম ছিলো দুলদুল। রাসূল সা. মারিয়া কিবতিয়াকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মারিয়া রা.-এর গর্ভ থেকেই মুহাম্মদ সা.-এর তৃতীয় পুত্র ইবরাহীম জন্ম গ্রহণ করেন। শিরিনকে কবি হাসসান ইবনে সাবিত আনসারী রা.-কে দান করেন।

এরপর মুহাম্মদ সা. আরেক ক্ষমতাধর শাসক পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠি নিয়ে যাওয়ার জন্যে আবদুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রা.-কে মনোনীত করা হয়। তিনি চিঠিখানি বাহরাইনের শাসনকর্তার হাতে দেন। বাহরাইনের শাসনকর্তা তার দূতসহ আবদুল্লাহ ইবনে হুজাইফাকে খসরুর দরবারে পাঠান। খসরুর কাছে লেখা চিঠি ছিল নিম্নরূপ। 

//পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লারহ নামে শুরু করছি—
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে পারস্যের পারভেজের কাছে।’
সালাম সেই ব্যক্তির প্রতি, যিনি হিদায়াতের আনুগত্য করেন এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস-স্থাপন করেন। তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরিক নেই, মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রসূল। আমি আপনাকে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ আমি সকল মানুষের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। যারা বেঁচে আছে, তাদেরকে পরিণাম সম্পর্কে ভয় দেখানো এবং কাফেরদের ওপর সত্য কথা প্রমাণিত করাই আমার কাজ। কাজেই, আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। যদি এতে অস্বীকৃতি জানান, তবে সকল অগ্নি উপাসকের পাপও আপনার ওপরই বর্তাবে।//

খসরুকে চিঠি পড়ে শোনানোর পর সে চিঠিখানি ছিঁড়ে ফেলে অহংকারের সাথে বললো, আমার প্রজাদের মধ্যে একজন সাধারণ প্রজা নিজের নাম আমার নামের আগে লিখেছে। দূত হত্যা করার নিয়ম না থাকায় তোমরা বেঁচে গেছো। নইলে তোমাদের হত্যা করতাম। 

এরপর সম্রাট খসরু পারভেজ তার ইয়েমেনের গভর্নর বাজানকে লিখে পাঠালো যে, তোমার ওখান থেকে তাগড়া দু’জন লোককে পাঠাও, তারা যেন হেজাজ গিয়ে সে লোককে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসে। বাজান সম্রাটের নির্দেশ পালনের জন্যে দু’জন লোককে তার চিঠিসহ আল্লাহর রসূলের কাছে মদিনায় প্রেরণ করে। প্রেরিত দু’জন লোক মদিনায় আল্লাহর রাসূলের কাছে গেলো। তাদের একজন বললো, শাহনশাহ একখানি চিঠি লিখে বাজানকে নির্দেশ দিয়েছে আপনাকে যেন তার দরবারে হাজির করা হয়। বাদশাহ বাজান আমাদেরকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন কাজেই, আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। সাথে সাথে উভয় আগন্তুক হুমকিপূর্ণ কিছু কথাও বললো। মুহাম্মদ সা. শান্তভবে বললেন, তোমরা আগামীকাল দেখা করো।

এদিকে পারস্যের খসরু পারভেজের পারিবারিক বিদ্রোহ ও কলহ তীব্ররূপ ধারণ করলো। আবার হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদের হাতে পারস্যের সৈন্যরা একের পর এক পরাজয় স্বীকার করে যাচ্ছিলো। পরিণামে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাটের পুত্র শিরওয়াই নিজের পিতাকে হত্যা করে নিজেই ক্ষমতা দখল করলো। সময় ছিলো মঙ্গলবার রাত্রি। সপ্তম হিজরীর ১০ই জমাদিউল আউয়াল। মুহাম্মদ সা. ওহির মাধ্যমে এ খবর পেলেন। পরদিন সকলে দুই প্রতিনিধি আল্লাহর রসূলের দরবারে এলে তিনি তাদের এ খবর জানালেন। 

তারা বললো, আপনি এসব আবোল-তাবোল কি বলছেন? এর চেয়ে ছোট কথাও আমরা আপনার অপরাধ হিসাবে গণ্য করেছি। আমরা কি আপনার এ কথা বাদশাহর কাছে লিখে পাঠাবো? মুয়াম্মদ সা. বললেন, হ্যাঁ লিখে দাও। সাথে সাথে এ কথাও লিখে দাও যে, আমার দ্বীন এবং আমার হুকুমত সেখানেও পৌঁছুবে, যেখানে তোমাদের বাদশা পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, বরং এমন জায়গায়ও পৌঁছুবে, যার পরে উট বা ঘোড়া যেতে পারবে না। তোমরা তাকে একথাও জানিয়ে দিয়ো যে, যদি সে মুসলমান হয়ে যায়, তবে যা কিচু তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেসব তাকে দিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকেই আমরা তার কওমের বাদশাহ করে দেবো।

উভয় দূত এরপর মদিনা থেকে ইয়েমেনের বাজানের কাছে যায় এবং তাকে সবকথা জানায়। কিছুক্ষণ পর ইয়েমেনে এক চিঠি এসে পৌঁছায় যে, শিরওয়াই তার পিতাকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেছে। নতুন সম্রাট তার চিঠিতে ইয়েমেনের গভর্নর বাজানকে এ নির্দেশও দিয়েছেন যে, আমার পিতা যার সম্পর্কে লিখেছেন পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে বিরক্ত করবেন না। এই ঘটনার কারণে বাজান এবং তার পারস্যের বন্ধু-বান্ধব, যারা সেই সময় ইয়েমেনে উপস্থিত ছিলেন, সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যান।

এরপর মুহাম্মদ সা. বাহরাইনের শাসনকর্তা মুনজির ইবনে সাওয়ারের কাছে চিঠি পাঠান। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। আল্লাহর রাসূল তাকে বাহরাইনের শাসনকার্যে নিযুক্ত রাখেন। তার সাথে রাসূল সা.-এর আরো কিছু পত্র বিনিময় হয়। এসব পত্রে শাসন সংশ্লিষ্ট কথাবার্তা হয়। 

এরপর আল্লাহর রাসূল সা. সালিত ইবনে আমর রা.-কে ইয়ামামার শাসনকর্তা হাওজা ইবনে আলীর নিকট প্রেরণ করেন। সে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কিছু বলে নি তবে সে দূতের সাথে ভালো আচরণ করেছে ও মুহাম্মদ সা.-এর আনুগত্য করবে বলে জানায়। সে রাসূল সা.-এর কাছে চিঠি লিখে তাকে কিছু এলাকা দিতে বলে যাতে সে মুহাম্মদ সা.-এর হয়ে শাসন করতে পারে।  

মুহাম্মদ সা. তার এ চিঠি পাঠ শেষে মন্তব্য করেন যে, সে যদি এক টুকরো জমিও আমার কাছে চায়, তবু আমি তাকে দেব না। সে নিজেও ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তার হাতে রয়েছে, সেসবও ধ্বংস হবে। সে ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী না হওয়ায় মুহাম্মদ সা. তার প্রতি বিরক্ত ছিলেন। 

মক্কা বিজয় থেকে ফিরে আসার পর জিবরাঈল আ. মুহাম্মদ সা.-কে খবর দিলেন যে, হাওজা মৃত্যুবরণ করেছে। মুহাম্মদ সা. অতঃপর সাহাবাদের বললেন, শোনো, ইয়ামামায় একজন মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে এবং আমার পরে সে নিহত হবে। একজন সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল, তাকে কে হত্যা করবে? মুহাম্মদ সা. বললেন, তোমরা এবং তোমাদের সাথীরা। পরবর্তীকালে আল্লাহর রসূলের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো এবং সেখানে মুসাইলিমা নিজেকে নবী দাবি করেছে। ইয়ামামার যুদ্ধে সে নিহত হয়। 

আল্লাহর রাসূল সা. সুজা ইবনে ওয়াহাব রা.-কে চিঠি দিয়ে পাঠান দামেশকের শাসনকর্তা হারিস ইবনে আবু শিমার গাসসানির কাছে। সে চিঠি ভীষণ ক্রোধ দেখায়। সে বলে, আমার বাদশাহী আমার কাছ থেকে কে ছিনিয়ে নিতে পারে?

সবশেষে আল্লাহর রাসূল সা. আমর ইবনুল আস রা.-কে দিয়ে আম্মানের বাদশাহ জেফার ও তার ভাই আবদের নিকট চিঠি পাঠান। আমর ইবনুল আসের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। 

এভাবে আল্লাহর রাসূল সা. হুদায়বিয়ার সন্ধির সুযোগ নিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেন। শুধু শাসকদের কাছে চিঠি নয়, বিভিন্ন স্থানে জনসাধারনের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য দাওয়াতি গ্রুপ প্রেরণ করেন। এভাবে হুদায়বিয়া থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত চার বছরে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় দশগুণে পরিণত হয়। মক্কা বিজয়ের পর পুরো আরবই ইসলামের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়।   


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন