১৪ ডিসে, ২০২১

খিলাফত পর্ব-০৮ : আবু বকর রা.-এর ইরাক অভিযান


সেসময় পৃথিবীতে দুটি বড় সাম্রাজ্য ছিল। একটির নাম বাইজেন্টাইন বা রোমান সাম্রাজ্য। এদের অবস্থান আরবের উত্তরে সিরিয়া ও উত্তর পশ্চিমে ফিলিস্তিনে। এরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বি ছিল। অন্যদিকে আরেকটি সাম্রাজ্য ছিল পারসিক সাম্রাজ্য। এদের অবস্থান ছিল আরবের পূর্বে ইরাকে। পারসিকরা মুশরিক ছিল। তারা বিভিন্ন দেবতার পূজা করতো। তবে অগ্নিপূজকরা শক্তিশালী ছিল। সেসময় পারসিক ও রোমানরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। আবু বকর রা.-এর সময়ে রোমানরা যুদ্ধে এগিয়ে ছিল। 

মুসলিমদের সাথে দুইবার রোমানরা যুদ্ধ করেছে। কিন্তু পারসিকদের সাথে মুসলিমদের কোনো মোকাবেলা হয়নি। আবু বকর রা. ইসলামী রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ সমস্যা মিটিয়ে ফেলার পর একটুও দেরি করেন নি ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা বাড়ানোর জন্যে। এই ব্যাপারে আবু বকর রা.-এর পরিকল্পনা ছিল অফেন্সিভ। তিনি মনে করতেন শত্রু সাম্রাজ্যগুলোর ওপর চড়াও না হলে নিজের রাষ্ট্র নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। তাই তিনি প্রথমে ইরাক তথা পারসিকদের শহরগুলো নিজের অধিকারে আনার চেষ্টা করেছেন। ইরাকে বিজয় লাভ করার পরই তিনি সিরিয়া দখলের দিকে মনোনিবেশ করেন। মাত্র আড়াই বছরের শাসনে আবু বকর রা. এতো বেশি কাজ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাঁর সব কাজ সহজ করে দিয়েছেন। তিনি শুধু নিজে কাজ করেন নি বরং পুরো মুসলিম জাতিকে রাষ্ট্রের কাজে নিয়োজিত করেছেন। 

মুসান্না রা. বাহরাইনে মুসলিমদের নেতা ছিলেন। বাহরাইনে বিদ্রোহীদের দমনের পর মুসান্না রা. ইরাক সীমান্তে যেসব মুশরিক গোত্র মুসলিমদের ওপর নির্যাতন করেছিল তাদের শায়েস্তা করছিলেন। এসময় তিনি পারসিক বাহিনীর তৎপরতা টের পান। পারসিকরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই খবর তিনি আবু বকর রা.-নিকট পাঠান। মুসান্না রা.-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে আবু বকর রা. খবর পেয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-কে ইরাকে পাঠান। তিনি তখন মাত্র ইয়ামামার ভয়াবহ যুদ্ধ শেষ করেছেন। [১] 

আবু বকর রা.-এর নির্দেশে খালিদ রা. ২০০০ সেনা নিয়ে ইরাকের দিকে রওনা হলেন। খলিফা তাঁকে আরো কিছু নির্দেশনা দিলেন 
১. ইরাকের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত উবুল্লাহ থেকে যুদ্ধ শুরু করবে। 
২. উঁচু ভূমি দিয়ে ইরাকে প্রবেশ করবে। 
৩. ইরাকে জনগণের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। তাদের মন জয়ের চেষ্টা করবে। তাদের আল্লাহর দিকে আহবান জানাবে। তারা দাওয়াত গ্রহণ করলে ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে। নতুবা জিজিয়া দেওয়ার জন্য বলবে। সেটাতেও অস্বীকার করলে তবেই যুদ্ধের দিকে যাবে। 
৪. তোমার সাথে কোনো মুসলিম সৈন্য যুদ্ধে যেতে না চাইলে বাধ্য করবে না।
৫. যেসকল মুসলিম ধর্মত্যাগ করে আবার মুসলিম হয়েছে তাদেরকে তোমার সাথে নিবে না। 
৬. কোনো মুসলিম তোমাদের পাশে থাকলে তোমাদের সাথে নিয়ে নিবে। [২] 

খালিদ রা. রওনা হওয়ার পর আবু বকর রা. ইরাক যুদ্ধের সম্ভাব্য ভয়াবহতা অনুধাবন করে ইয়াদ ইবনু গানাম রা.-কে তার বাহিনীসহ ইরাকে পাঠান খালিদ রা.-কে সহায়তা করার জন্য। একইসাথে মুসান্না রা.-কে পত্র পাঠান যাতে খালিদ রা.-এর নেতৃত্বে যুদ্ধ করে তাদের উপযুক্ত সমাদর করে। খালিদ রা. মাত্র দুই হাজার সৈন্য নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন। পথিমধ্যে রাবিয়াহ গোত্র থেকে জিহাদে উজ্জীবিত ৮০০০ সেনা সাথে নেন। ইরাকের তিনজন প্রখ্যাত আমীর মাজউর ইবনে আদি, সুলমা ইবনে কায়ন এবং হারমালাহ ইবনে মুরায়তাহকে সৈন্য প্রস্তুত রাখার জন্য চিঠি লেখেন। তারা প্রায় ৮০০০ সেনার সমাবেশ করেন। ফলে খালিদ রা.-এর সৈন্যসংখ্যা আঠারো হাজারে দাঁড়ালো [৩]

হুদাইরের যুদ্ধ : 
ইরাকে খালিদ রা. প্রথমে যে যুদ্ধের মুখোমুখি হলেন তা হলো হুদাইরের যুদ্ধ। হুদাইর বসরার পূর্বে পারস্য উপসাগরের নিকটে অবস্থিত। এর শাসক ছিল হুরমুজ। হুরমুজ ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের একজন গভর্নর। হুরমুজ একজন অত্যাচারী ও দাম্ভিক শাসক ছিল। খালিদ রা. তার কাছে পত্র লিখেন। পত্রে উল্লেখ করেন, 
ইসলাম গ্রহণ করো, তবেই তুমি নিরাপদ থাকবে। নতুবা তোমাকে ও তোমার জাতিকে জিজিয়া দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় যা কিছু ঘটবে তার জন্য তুমি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দায়ি করতে পারবে না। আমি তোমার নিকট এমন সকল লোককে নিয়ে এসেছি তারা মৃত্যুকে ঠিক সেরূপ ভালোবাসে তোমরা যেরূপ জীবনকে ভালোবাসো। [৪]   

হুরমুজ এই পত্র পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে হুরমুজ মৃত্যুবরণ করে ও পারসিক বাহিনীর পরাজয় হয়। খালিদ রা. বিশাল গণিমত লাভ করেন। এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ তিনি মদিনায় পাঠিয়ে দেন।

উবুল্লাহ বিজয় : 
হুদাইরের যুদ্ধ শেষে খালিদ রা. নিজে হুদাইরে অবস্থান করেন। আর মাকিল ইবনে মুকাররিন রা.-কে উবুল্লায় পাঠান। উবুল্লাবাসী মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সৈন্য সমাবেশ করে। তাদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের পরাজয় হয়। 

মুজারের যুদ্ধ : 
হুদাইরের যুদ্ধের পর পারসিক সৈন্যরা তাদের রাজধানীর দিকে পালাতে থাকে। খালিদ রা.-এর নির্দেশে মুসান্না রা.-এর বাহিনী তাদের ধাওয়া করে। কিছুদূর যাওয়ার পর মুসান্না রা. খবর পেলেন পারস্যের সম্রাট মুশরিকদের প্রখ্যাত বীর কারিনকে হুদাইরের দিকে পাঠাচ্ছেন বিশাল সেনাবাহিনীসহ। খবর পেয়ে তিনি আর এগুলেন না। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস (দজলা ও ফোরাত) নদীর মোহনায় তিনি মুজার নামক স্থানে ক্যাম্প তৈরি করে করেন। খালিদ রা. দ্রুত মুজারে চলে আসেন। প্রাথমিক দ্বন্দ্বযুদ্ধেই বীর কারিন মারা যায়। ফলে বিশাল পারসিক বাহিনী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। মুসলিমরা সহজে এই যুদ্ধে জয়ী হয়। 

ওয়ালাজাহর যুদ্ধ :
পারসিকরা পর পর দু'বার পর্যদস্তু হবার পর নতুন কৌশল গ্রহণ করলো। তাদের অধীনস্ত খ্রিস্টানদের ক্ষেপাতে লাগলো। খ্রিস্টানরা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের স্বাধীনতার লোভ দেখানো হয়। বলা হয় যদি তারা পারসিকদের সহায়তা করে মুসলিমদের তাড়িয়ে দিতে পারে তবে তাদের স্বাধীন  করে দেওয়া হবে। এই ফাঁদে পা দেয় ইরাকের খ্রিস্টানরা। তারা ওয়ালাজাহতে একত্রিত হয়। মুসলিমরা তাদের প্রতিরোধ করে ও পরাজিত করে। 

উল্লায়সের যুদ্ধ : 
খালিদ রা. খ্রিস্টান নেতাদের বুঝানোর চেষ্টা করলেন পারসিকদের ফাঁদে পা না দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারা বুঝলো না। খ্রিস্টান সৈন্যরাও জান্নাতের জন্য লড়ে। তাই তাদের মনোবল সবসময় অটুট থাকে। তাদের সাথে যুদ্ধ কঠিন হয়ে থাকে মুশরিকদের তুলনায়। খ্রিস্টান নেতা অল্প সময়ের মধ্যে আবারো বিশাল বাহিনী গড়ে তুললো। যাদের ওয়ালাজহর যুদ্ধে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে তারা আবারো মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। খালিদ রা. এবার তাদের প্রতি কঠোর আচরণ করলেন। তিনি মুজাহিদদের নির্দেশ দিলেন যারা আত্মসমর্পন করবে তাদের শুধু হত্যা না করে গ্রেপ্তার করা হবে। আর যারা পালাচ্ছে তাদের ধাওয়া দিয়ে হত্যা করতে। এই যুদ্ধে একটা বিশাল পারসিক শক্তি ও খ্রিস্টান সৈন্য খুন হয়। এই খবরে অসুস্থ থাকা পারস্য সম্রাট আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন।

হীরা বিজয় : 
হীরা তৎকালীন ইরাকের একটি সমৃদ্ধ শহর ছিল। এটি পারসিকদের শহর ছিল যদিও হীরাবাসী ছিল খ্রিস্টান। হীরা ছিল বর্তমানে কুফার অন্তর্গত। খ্রিস্টানদের বড় পরাজয় হওয়া সত্ত্বেও হীরার খ্রিস্টানরা মনোবল হারায়নি। তারা মনে করেছিল তাদের শক্তিশালী দুর্গ রয়েছে যার দ্বারা তারা মুসলিমদের মুকাবিলা করতে পারবে। আর তারা ছিল ফোরাত নদীর ওপারে। হীরার শাসক আজাজিবাহ উজানে বাঁধ দিয়ে ফোরাতের পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে নৌযান চলা বন্ধ হয়ে গেছে। আর কাদার মধ্যে দিয়ে ঘোড়া নিয়ে পার হওয়া সম্ভব না। মুসলিমরা খবর নিয়ে বাঁধের খবর পেল। 

খালিদ রা. বাঁধের কাছে গিয়ে সেখানের নিরাপত্তায় থাকা সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। তারা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলে মুসলিমরা বাঁধ নষ্ট করে দেন। নৌযানে করে তারা নদী পার হন। মুসলিমরা তাদের চারটি দূর্গ অবরোধ করলো। দুর্গ থেকে তারা পাথর ও তীর নিক্ষেপ করলে মুসলিমরা তীরের মাধ্যমে সেই আক্রমণের জবাব দেয়। পরিস্থিতি কঠিন হবে বুঝতে পেরে আজাজিবাহ সন্ধির প্রস্তাব করলেন ও জিজিয়া দিতে সম্মত হলেন। এই বিজয়ের ফলে ইরাকে আর কেউ প্রভাবশালী হয়ে মুসলিমদের রুখতে আসেনি। আরো কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে খালিদ রা. পুরো ইরাক মুসলিমদের আয়ত্বে নিয়ে আসলেন। 

হীরার সন্ধিপত্র : 
যুদ্ধের সেনাপতি খালিদ রা. হলেও বহুদূর থেকে যুদ্ধের ময়দানের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন খলিফাতুর রাসূল আবু বকর রা.। হীরাবাসী সন্ধি করতে চাইলে খালিদ রা.-কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।[৬]  

১. তাদের গীর্জা ও ইবাদতের স্থান নষ্ট ও দখল করা যাবে না। 
২. নাকূস বাজনা (ধর্মীয় বাজনা) থেকে তাদের বিরত রাখা যাবে না। 
৩. ক্রুশের মিছিলে বাধা দেওয়া যাবে না। 
৪. জিজিয়া আদায় করলে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে হবে এবং তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। 
৫. গীর্জার পাদ্রীদের জিজিয়ার আওতামুক্ত রাখতে হবে। 
৬. তাদের মধ্যেকার বৃদ্ধ, অসুস্থ ও পঙ্গু লোকদের ব্যয়ভার বাইতুলমাল থেকে বহন করা হবে। 
৭. তারা যে কোনো পোষাক পরিধান করার স্বাধীনতা পাবে। 
৮. তাদের মধ্যেকার কোনো গোলাম ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে সর্বোচ্চ মূল্যে কিনে আযাদ করে দেওয়া হবে। মূল্য মালিককে পরিশোধ করা হবে। 
৯. যদি তারা কেউ আর্থিক সাহায্য চায় তবে বাইতুলমাল থেকে সাহায্য করা হবে। 

তথ্যসূত্র :
১. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৫৫৭-৫৫৮
২. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৬ষ্ঠ খন্ড / পৃ. ৫১৬
৩. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৫৬০-৫৬১  
৪. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৫৬৩
৫. আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া / ইবনে কাসীর / ইসলামিক ফাউন্ডেশন / ৬ষ্ঠ খন্ড / পৃ. ৫১৭- ৫২৫
৬. আবূ বাকর আছছিদ্দীক / ড. আহমদ আলী / বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার / পৃ. ৬৫২ 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন