২৫ ডিসে, ২০২১

কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ




আজ ২৫ ডিসেম্বর। ১৪৫ বছর পূর্বে আজকের এই দিনে জন্ম হয় উপমাহদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর। তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশ ও হিন্দুদের নিষ্ঠুর আগ্রাসন থেকে উপমহাদেশের মুসলিমদের রক্ষার সংগ্রামে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। উপমহাদেশের মুসলিমদের অন্তরে তিনি কায়েদে আযম (মহান নেতা) হিসেবে সম্মানের স্থান দখল করে আছেন।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আইনজীবী, রাজনীতিক ও পাকিস্তানের স্থপতি। তিনি ১৮৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামাতা ভারতের গুজরাট থেকে করাচিতে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। জিন্নাহ করাচির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বোম্বের গোকুলদাস তেজ প্রাইমারি স্কুল এবং করাচির সিন্ধু মাদ্রাসা হাইস্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং পরে খ্রিস্টান মিশনারি সোসাইটি হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৮৯২ সালে মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি লন্ডন যান এবং আইন পড়ার জন্য লিংকন’স ইনে ভর্তি হন।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৮৯৬ সালে করাচিতে ফিরে আসেন। ১৮৯৭ সালে তিনি আইন ব্যবসায়ের জন্য বোম্বাই যান, কিন্তু প্রথম তিন বছর তাঁকে কঠিন অর্থকষ্টে ভুগতে হয়। শতাব্দীর মোড় ঘুরতেই তাঁর ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আয়ের দিক থেকে তিনি বোম্বাইর সব আইনজীবীকে ছাড়িয়ে যান। জিন্নাহ রাজনীতিতে আসেন ১৯০৬ সালে। সেসময় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুসমাজের তীব্র প্রতিবাদমুখর পরিস্থিতিতে কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন চলছিল। দাদাভাই নওরোজীর কংগ্রেসের নতুন ব্যানারে তখন ‘স্বরাজ’-এর স্লোগান যুক্ত হয়, জিন্নাহও তাতে সামিল হন।

২০ বছর বয়সে জিন্নাহ বোম্বেতে তার আইনপেশা শুরু করেন। বোম্বেতে তখন তিনি ছিলেন শহরের একমাত্র মুসলিম ব্যারিস্টার। ১৯০৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট পাশ হলে রাজনীতিতে জিন্নাহর উত্থান শুরু হয়। এ আইনের মাধ্যমে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলকে ইম্পেরিয়েল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে রূপান্তরিত করা হয় এবং এতে নতুন ৩৫ জন মনোনীত সদস্য এবং ২৫ জন নির্বাচিত সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে এর কলেবর বৃদ্ধি করা হয়। এতে মুসলমানদের এবং জমিদারশ্রেণীর জন্য বিশেষ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকে। 

জিন্নাহ বোম্বাইয়ের একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। জিন্নাহ হিন্দু-মুসলিম সংহতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি মুসলিম লীগে যোগ না দিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর মুসলিম লীগের সঙ্গে জিন্নাহর যোগাযোগ শুরু হয়। জিন্নাহ পরের বছর ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগের অধিবেশনে যোগ দেন। এ অধিবেশনে কংগ্রেসের সঙ্গে একই সুরে ‘স্বরাজ’ দাবি করার লক্ষ্যে মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। মওলানা মোহাম্মদ আলী ও সৈয়দ ওয়াজির হাসানের অনুরোধে জিন্নাহ ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন।

১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেস বোম্বাইতে তাদের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানের প্রস্ত্ততি নেয়। বোম্বাইর মুসলিম নেতাদের সম্মতি নিয়ে জিন্নাহ একটি পত্রের মাধ্যমে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে কংগ্রেসের সঙ্গে একই স্থানে এবং একই সময়ে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগকে তার বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানের আহবান জানান। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা এর তীব্র বিরোধিতা করে। 

১৯১৬ সালের শরৎকালে জিন্নাহ পুনর্বার ইম্পেরিয়েল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে লক্ষ্ণৌতে একই স্থানে একই সময়ে বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠানে রাজী করান। জিন্নাহ লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। দুটি দলের অধিবেশনেই তাদের যৌথ কমিটির তৈরি করা ন্যূনতম সংস্কারের দাবি অনুমোদন লাভ করে এবং ভারত সরকারের কাছে তা পেশ করা হয়। যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সেখানে আইন পরিষদে তাদের প্রতিনিধিত্বে অতিরিক্ত সুযোগ দেওয়া হবে এই মর্মে কংগ্রেস জিন্নাহর সঙ্গে একমত হলে পৃথক নির্বাচনী এলাকা সংক্রান্ত ভারতীয় রাজনীতির প্রধান অভ্যন্তরীণ সমস্যার সুরাহা হয়। এই ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তির পর জিন্নাহ মুসলমানদের সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভাব হন।

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে রাউল্যাট আইন পাস করে ভারত সরকার রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য প্রচুর ক্ষমতা হাতে নেয়। এর প্রতিবাদে জিন্নাহ ইম্পেরিয়েল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন এবং গান্ধী অহিংস  অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। এপ্রিলের প্রথমদিকে গান্ধীর অনুসারীরা অমৃতসরে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করে তিনজন ইউরোপীয় ব্যাংক ম্যানেজারকে হত্যা করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালা বাগে সংঘটিত হয় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত করেন। 

১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে এই দল সম্পর্কে জিন্নাহর ধারণা সম্পূর্ণ বদলে যায়। এখান থেকেই তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছেদ করেন। ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তিতে কংগ্রেস যেসব অঙ্গীকার করেছিল, দলটি তা কখনও পালন করে নি। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। কংগ্রেস মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। কয়েকবার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতা করতে যেয়ে ব্যর্থ হন জিন্নাহ। তিনি নিজেকে ব্যর্থ মনে করে ইংল্যান্ড চলে যান।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন পাস হয়। এর মাধ্যমে আইন পরিষদে মুসলমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের প্রতিনিধিত্ব রাখার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ আইন মধ্যবিত্ত রাজনীতিকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে। মুসলিম নেতৃবৃন্দের আহবানে জিন্নাহ ভারতে ফিরে এসে মুসলমানদের নেতৃত্ব গ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নতুন ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন হলো। মুসলিমরা বিভিন্ন জাতিগত দলে বিভক্ত ছিল। 

উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান হলেও সেখানে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ একটি আসনও পেল না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাবে মুসলমানরা নানা পুরনো দলের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ ছিল এবং জিন্নাহর পুনরুজ্জীবিত মুসলিম লীগের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। সিন্ধু প্রদেশেও মুসলমানরা লীগকে পাত্তা না দিয়ে ভারত বিভক্তি নীতির বিরোধিতা করে কংগ্রেসের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগ শুধু বাংলায় জয়লাভ করে এবং কৃষক প্রজা পার্টির নেতা এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।

১৯৩৮ সালে জিন্নাহ হিন্দুদের মুসলিম বিরোধী প্রচারণার মোকাবেলা করার জন্য দিল্লিতে Dawn নামে একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯৪০ সালে জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্বের প্রচারণা শুরু করেন এবং ওই  বছর ২৩ মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এ অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ গ্রহণ করা হয়।

জিন্নাহ একইসাথে কংগ্রেসের হিন্দু ও দেওবন্দী আলেমদের বিরোধীতার মুখোমুখী হন। তিনি নিশ্চিত বুঝতে পেরেছেন মুসলিমরা ব্রিটিশ শাসিত ভারতের চাইতে বহুগুণে বিপদে পড়বে কংগ্রেস শাসিত ভারতে। তাই পাকিস্তানের কোনো বিকল্প ছিল না। দেওবন্দী নেতা হুসাইন আহমদ মাদানীর বিরুদ্ধে জিন্নাহর এই সংগ্রামকে সহযোগিতা করেছেন আরেক দেওবন্দী নেতা শাব্বির আহমদ ওসমানী এবং সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। 

কংগ্রেসের সন্ত্রাসীরা বহুবার জিন্নাহকে খুন করার চেষ্টা করে। ১৯৪৩ সালের ২৬ জুলাই বোম্বাইয়ে জিন্নাহকে একজন খাকসার স্বেচ্ছাসেবক হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু জিন্নাহ অল্পের জন্য বেঁচে যান। তবে আহত হন। 

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে ব্যর্থ হলেও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিমলীগ মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। মুসলিমরা কংগ্রেসপক্ষীয় মুসলিম নেতা আবুল কালাম আযাদ ও হুসাইন আহমদ মাদানীকে পরিত্যাগ করে। মুসলিমরা আলাদা রাষ্ট্র তথা পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। জিন্নাহর ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের মুসলিমরা নিজেদের জন্য এক স্বাধীন ভূমি লাভ করে।   

জিন্নাহর আশঙ্কা ছিল যে ব্রিটিশরা ভারত থেকে চলে যাওয়ার পর কংগ্রেস প্রধান আইনসভায় মুসলিমরা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবে। তিনি দাবি করেন যে স্বাধীনতার পূর্বেই সেনাবাহিনীকে ভাগ করতে হবে। এজন্য এক বছরের মত সময় দরকার ছিল। মাউন্টব্যাটেন আশা করেছিলেন যে স্বাধীনতার পর একটি যৌথ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা থাকবে কিন্তু জিন্নাহ চাইছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্রের আলাদা সেনাবাহিনী থাকুক। সেনাবাহিনী ভাগ হয়ে আগে পাকিস্তান স্বাধীন হলো। হায়দরাবাদ স্বাধীন হলো, কাশ্মীর স্বাধীন হলো। তারপর ভারত স্বাধীন হলো। 

জিন্নাহর আশংকাই সত্য হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর দখল করলো, হায়দরাবাদ দখল করলো। পাকিস্তানের পাঞ্জাবের কিছু অংশ ও পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার খুলনা, সাতক্ষীরা ও  যশোর দখল করে ফেললো। পাকিস্তান তাদের ভূমি পুনরুদ্ধার করতে পারলেও হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর এখনো বন্দী হয়ে রইলো। 

কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিমদের জন্য চিন্তা করতেন। তাদের অধিকার তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে মাগফিরাত দান করুন। দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করুন। সালাম, ইয়া কায়েদ, ইয়া কায়েদে আযম।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন