২০০৩ সালে জামায়াত যখন ক্ষমতার একটি অংশ তখন জামায়াত পিআর পদ্ধতির বিষয়টি আবারো রাজনীতিতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। জামায়াত মনে করেছে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি যেহেতু বাংলাদেশে কায়েম হয়েছে, এবার পিআর পদ্ধতি যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হবে। আলোচনা তৈরি করার নিমিত্তে জামায়াতের তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি শহীদ কামারুজ্জামান বিভিন্ন পত্রিকায় পিআর নিয়ে ধারাবাহিক লেখা লিখতে থাকেন।
তবে খালেদা জিয়ার প্রবল বাধায় এটি টেবিল ওয়ার্কেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজনীতির মাঠে নামতে পারে নি। এরই ধারাবাহিকতায় জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ২০০৫ সালে ছোট একটি বই লিখে পিআর সিস্টেমের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে লয়াল থাকতে গিয়ে জামায়াত পিআর নিয়ে আলোচনা করতেই সক্ষম হয়নি। খালেদা জিয়াকে রাজি করানো তো বহুদূর।
আমি এই সিরিজ লেখাটা লিখার একটি কারণ আছে, আর তা হলো খালেদা জিয়ার অসত্য বচন। ২০০৮ সালে ইলেকশনে নাকি জামায়াত বিএনপিকে টেনে নিয়ে গেছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী বিএনপি ও খালেদা জিয়া কখনোই জামায়াতের মতামতকে গুরুত্ব দেয় নাই। আওয়ামী লীগ থেকে বাঁচতে বিএনপি অনুসরণ করে যাওয়াই ছিল জামায়াতের নিয়তি।
২০০৮ সালের ইলেকশন প্রসঙ্গে আসি..
২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারী করা হয় জরুরী অবস্থা। ২২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বন্ধ করে দিলো তারা। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও কার্যত সেটি পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই সরকার আভাস দিয়েছিল যে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ছবি সহ ভোটার তালিকা তৈরি। একই সাথে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় তথাকথিত দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা। এ সময় দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতি এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় দেশের মানুষের বড় একটি অংশ চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এমন প্রেক্ষোপটে ২০০৭ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সেনাসদস্যদের প্রহার করার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গন্ডি পেরিয়ে সহিংস এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সেই আন্দোলনের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুধাবন করে যে অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন আটকে রাখা যাবে না। ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা ঘোষণা করেন, সেপ্টেম্বর মাস থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু হবে। সেপ্টেম্বর মাস থেকে শুরু করে দফায়-দফায় এই সংলাপ চলেছে ২০০৮ সালেও। নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য এই সংলাপ আহবান করেছিল নির্বাচন কমিশন।
ছাত্র বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখাতে চেয়েছিল যে নির্বাচন আয়োজনের দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচন কমিশন সংলাপ শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলের সাথে যখন সংলাপ শুরু হয়, তখন বিএনপিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে তীব্র বিতর্কের মুখে পড়ে নির্বাচন কমিশন। এখানে বিএনপি'র আভ্যন্তরীণ কোন্দল স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হবার আগে বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া এবং যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। মান্নান ভুঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি দল ভাঙার চেষ্টা করছেন এবং সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছেন।
মান্নান ভুঁইয়াকে বহিষ্কার করে খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নিয়োগ করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানায় সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে। মান্নান ভুঁইয়ার বহিষ্কারাদেশ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হয়নি বলে অভিযোগ তোলেন মেজর হাফিজসহ বিএনপির আরো কিছু নেতা, যারা সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
দলের স্থায়ী কমিটির একটি অংশ খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে মহাসচিব নিযুক্ত করে। এমন অবস্থায় বিএনপির মূলধারা হিসেবে পরিচিত মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে সংলাপের জন্য আমন্ত্রন না জানিয়ে সংস্কারপন্থী হিসেবে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে আমন্ত্রন জানানোর বিষয়টি বিএনপির ভেতরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। অবশ্য পরবর্তীতে খন্দকার দোলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপির মূলধারার সাথেই চূড়ান্ত সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সেটি নিয়ে ২০০৮ সালের গোড়া থেকেই সন্দেহ শুরু হয়। নির্বাচনে অংশ নেবার বিষয়ে খালেদা জিয়ার কিছু আপত্তি ছিল। তিনি চেয়েছিলেন তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানের মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেনা গোয়েন্দারা শর্ত দেন যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে খালেদা জিয়ার শর্ত মেনে নেয়া হবে। এই নিয়ে খালেদা জিয়ার সাথে সেনা কর্মকর্তাদের তীব্র দরকষাকষি চলে দীর্ঘ সময়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়।
তবে খালেদা জিয়ার সাথে সরকারের কী ধরণের সমঝোতা হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিএনপির নেতারাও জানেন না। 'বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)' শিরোনামের বইতে মওদুদ আহমদ বলেছেন, ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
২০০৮ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বিএনপি নিশ্চিত করে যে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। নির্বাচনে অংশ নেবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। এর আগে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে বিএনপির সাথে নির্বাচন কমিশনের মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল। খালেদা জিয়ার দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচন ১১ দিন পিছিয়ে ২৯শে ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়।
বিএনপির তরফ থেকে একটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল যে খালেদা জিয়া কারগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন সেপ্টেম্বর মাসে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা প্যারোলে কারাগার থেকে বের হয়েছিলেন জুন মাসে। সেজন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে খালেদা জিয়ার সময় প্রয়োজন বলে বিএনপির তরফ থেকে বলা হয়েছিল। নির্বাচন পিছিয়ে ২৯শে ডিসেম্বর নির্ধারন করার বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত তারা সেটি মেনে নিয়েছিল।
এখানে আমরা আরেকটি তথ্য পরে জানতে পারি তা হলো ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের দায়মুক্তি। এই বিষয়ে খালেদা ও হাসিনা উভয়েই নীরব ছিল। যদিও সেনাশাসনের সময় উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সকল বিএনপি নেতার দুর্নীতি প্রকাশিত হয়েছে। এই নিয়ে বিএনপি জোট বিব্রতকর অবস্থায় ছিল। খালেদার আরো বিব্রতকর বিষয় হলো খালেদার দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে অনেক বড় নেতা গাদ্দারি করেছে তার সাথে। সেসময় মধ্য সারির এক নেতা হান্নান শাহ মুখপাত্র হয়ে উঠেছে। বড় নেতারা প্রায় সব বিট্রে করেছে অথবা দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে।
ফখরুদ্দিন-মঈনরা দায়মুক্তি নিতে খালেদা ও হাসিনার কাছে যায়। খালেদা ডিজিএফআই কর্তৃক প্রাপ্ত দায়মুক্তির বিনিময়ে ক্ষমতায় যাওয়ার অফার প্রত্যাখ্যান করেছে। এই বিষয়ে তিনি পরে বলেছেন। অন্যদিকে ডিজিএফআই-এর এই প্রস্তাব হাসিনাকে দিলে হাসিনা সানন্দে তা গ্রহণ করে। এই তথ্যটা যদি খালেদা নির্বাচনের আগে জাতিকে জানান দিতো তবে জাতি বুঝতে পারতো একটা পাতানো নির্বাচন হবে। কিন্তু খালেদা তা না জানিয়ে নিজেদের ছেলেদের জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে নির্বাচনে গিয়েছে। খালেদা নির্বাচনে যেতে গড়িমসি যা করেছে তা অবৈধ নির্বাচন থেকে জাতিকে বাঁচাতে নয় বরং তার ছেলেদের জীবন রক্ষা করতে। তারেক আর রাজনীতি করবে না, এই মুছলেকা নিয়ে ডিজিএফআই ও খালেদার মধ্যে সমঝোতা হয়। তারেককে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর যখন পাতানো নির্বাচনে হেরে গেলো চার দলীয় জোট, তখন খালেদা জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, জামায়াত নাকি বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছে। অথচ জামায়াত ঐ সময় নির্বাচন চেয়েছে সেনাসরকারের হাত থেকে বাঁচার জন্য। এটা বিএনপিও চেয়েছে। নির্বাচনের জন্যই তো খন্দকার দেলাওয়ার নিয়মিত সংলাপে বসেছে। দরকষাকষি করেছে। সংস্কার আলোচনায় অংশ নিয়েছে।
২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনে (খালেদা-হাসিনা জানতো এটা পাতানো, বাকীরা জানতো না) খালেদা যেতে বাধ্য হয়েছে মূলত দুইটি কারণে।
১। খালেদা দুই ছেলেকে জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছে।
২। খালেদা ইলেকশনে না গেলে বিএনপি ভেঙে যেত। বিএনপি সিনিয়র নেতারা ইলেকশনে চলে যেত।
খালেদা জামায়াতের মতামত জানতে চাইলে জামায়াত ইলেকশনে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেয়। এর মানে এই ছিল না যে, খালেদা ইলেকশনে না গেলে জামায়াত ইলেকশনে চলে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে।
-আর চলবে না ...
পিআর পদ্ধতিটা যদি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতেন তাহলে ভালো হতো
উত্তরমুছুন