১৬ ফেব, ২০২২

খিলাফত পর্ব-১৯ : উমার রা.-এর সময়ে সুবিচারের কিছু নমুনা

উমার রা. সত্যের ব্যাপারে অনেক কঠোর ছিলেন। তিনি শাসন ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। তাঁর এই কঠোরতাকে তিনি নিজেই ভয় পেতেন মাঝে মধ্যে। তাঁর কাছে মনে হতো তিনি অন্যান্য বাদশাহদের মতো বাদশাহ হয়ে গেছেন। এই অনুভূতি তাঁকে পীড়া দিত। তখন তিনি হন্য হয়ে অভিজ্ঞ সাহাবাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতেন তোমাদের কী মনে হয়, আমি কি খলিফা থেকে বাদশাহ হয়ে গেছি? 

উত্তরে এক সাহাবা তাঁকে জানালেন, এই দু'য়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। খলিফা যা নেয় তা ন্যয়সঙ্গতভাবে নেয়। যা দেয় তাও ন্যয়সঙ্গতভাবে দেয়। আলহামদুলিল্লাহ আপনি এরকম। বাদশাহরা জুলুম করে। একজনেরটা নিয়ে আরেকজনকে দেয়। আরেকবার সালমান ফারসি রা.-কে উমার রা. একই কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, রাষ্ট্র থেকে ১ দিরহামও যদি বেশি নেন অথবা ১ দিরহামও যদি অন্যায়ভাবে খরচ করেন তবে আপনি খলিফা নন, বাদশাহ। উমার রা. এই অনুভূতিই তাঁকে খলিফা হিসেবে মহিমান্বিত করে তুলেছে। 

উমার রা.-এর ১০ বছরের শাসনামল ছিল তাই আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মহানবী সা. -এর সময়ে একই সমাজের মানুষ নিয়ে ছোট রাষ্ট্র গঠিত হওয়ায় রাষ্ট্রের অনেক বিষয় বিকশিত হওয়ার দরকার হয়নি। যা উমার রা.-এর সময়ে পূর্ণাঙ্গতা পায়। আবার আবু বকর রা. ছিলেন মাত্র আড়াই বছরের খলিফা। এই আড়াই বছরে তিনি বিদ্রোহ দমন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ব্যয় করতে হয়েছে। ফলে তাঁর সময়েও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বিকশিত হয় নি। 

শুরাভিত্তিক সিদ্ধান্ত :
ইসলামে স্বৈরাচারিতার স্থান নেই। মুহাম্মদ সা. আল্লাহর মনোনীত রাসূল হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনায় শুরার সাহায্য নিতেন। এমনও হতো যে, মুহাম্মদ সা.-এর নিজের প্রস্তাবনা বাদ পড়ে যেত। উমার রা.-ও সেভাবে শুরাভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। শুরা মেম্বার নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি কখনোই তোষামোদকারীদের স্থান দিতেন না। এক্ষেত্রে তিনি ইসলামের প্রাথমিক সময়ের মুসলিদের গুরুত্ব দিতেন। তবে মেইন ফোকাস ছিল কুরআনের জ্ঞান। যাদের কুরআনের জ্ঞান বেশি ছিল তারাই শুরা মেম্বার হতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যুবক হোক কি বয়স্ক, কেউ যদি কুরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী হতেন, তিনি উমারের পরামর্শ সভার সদস্য হওয়ার সুযোগ পেতেন। উমার রা. নিজে পরামর্শ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন এবং প্রাদেশিক গভর্নরদেরও একইভাবে প্রদেশ পরিচালনার নির্দেশ দিতেন। 

সমতা : 
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষ সমান। লিঙ্গ, বর্ণ, বংশ, ভাষা, ক্ষমতা ইত্যাদি দিয়ে ভেদাভেদ হারাম। উমার রা. এর শাসনামলে একবার মদিনায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। সেসময় উমার রা. অভাবীদের দুঃখ ভাগ করে নিতে নিজের লাইফস্টাইল একেবারে গরীবদের কাতারে নামিয়ে এনেছেন। তিনি নিজে ও তাঁর পরিবারের জন্য ঘি, দুধ ও দই নিষিদ্ধ করে দেন। নতুন পোষাকও নিষিদ্ধ করে দেন। তিনি বলেন, তারা যে কষ্টে ভুগছে, আমি যদি সে কষ্টে না ভুগি তবে কীভাবে তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হবো? 

উমার রা. সাধারণত ঘি আর রুটি খেতেন। কিন্তু যখন বাজারে ঘি অপ্রতুল হয়ে যেত, বেশি দাম হয়ে যেত তখন তিনি জলপাইয়ের তেল দিয়ে রুটি খেতেন। এতে তাঁর পেটের সমস্যা। গুড়গুড় ডাক দিত। তিনি পেটকে শাসিয়ে বলতেন, যত পারো গুড় গুড় করো, কিন্তু লোকেরা যতক্ষণ না ঘি খেতে পারবে ততক্ষণ তুমিও ঘি পাবে না। 

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একবার উমার হজে গেলে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া তাকে কিছু খাবার পরিবেশন করলেন। বড় এক থালা ভর্তি খাবার নিয়ে হাজির হলো চারজন দাস।  উমার রা. খাবার শুরু করতে গিয়ে দেখলেন ঐ কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছেন। উমার রা. জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি আপনার সাথে খেতে বসবে না?  তিনি উত্তর করলেন, না। তারা তো আমাদের অধস্তন। এতে উমার রা. ক্ষিপ্ত হন। তিনি বলেন, এসব লোক কারা যারা দাসদের ওপরে নিজেদেরকে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহ যেন তাদের শাস্তি দেন। এই বলে তিনি দাসদের নির্দেশ দেন, তোমরা আমাদের সাথে খেতে বসো। 

উমার রা. একবার বাইতুলমালের সম্পদ বিতরণ করছিলেন। প্রচুর ভিড়। সবাই লাইন ধরে নিজেদের হক বুঝে নিচ্ছিল। এমন সময় প্রখ্যাত সাহাবী সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. লাইন ভেঙ্গে সামনে চলে এলেন। উমার রা. তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে তাঁকে গুঁতো দিয়ে ভয়ঙ্করভাবে তিরস্কার করলেন। জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবীর ব্যাপারেও উমার রা. কোনো ছাড় দেননি।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা : 
যদিও উমার রা. কঠোর শাসক ছিলেন তবুও সাধারণ মানুষ তাঁর আমলে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও শাসকের সমালোচনা করতে পারতেন। কারণ তাঁর কঠোরতা ছিল হকের খাতিরে। তাঁর শাসনে বহু মানুষ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। উমার রা. তাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদের মুখে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছিলেন। একবার তিনি বিয়ের মোহরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করতে চাইলেন এবং সেটা হলো ৪০ উকিয়া। তিনি বলেছেন এর বেশি যদি কোনো নারী মোহর নেয় তবে বাড়তি মোহর বাইতুল মালে জমা হবে। কিন্তু মহিলাদের যৌক্তিক প্রতিবাদের মুখে পিছু হটেছেন উমার রা.। 

একবার বাইতুলমাল থেকে সকল জনগণের জন্য কাপড় বরাদ্দ হয়। সকলে সমান কাপড় পায়। ঐ কাপড় দিয়ে পরিপূর্ণ জোব্বা তৈরি করা যায়নি। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল ঐ কাপড় দিয়ে উমার রা. পরিপূর্ণ জোব্বা তৈরি করে খুতবা দিতে দাঁড়িয়েছেন। তখন এক লোক দাঁড়িয়ে বললো, হে আমীরুল মু'মিনিন! আল্লাহকে ভয় করুন। আমি আপনার খুতবা শুনবো না। উমার রা. বললেন, কেন হে আল্লাহর বান্দা? বাইতুলমালের কাপড় দিয়ে আমাদের কারো জামা হয় নি। আপনার কীভাবে হলো? উমার রা. বললেন, এর জবাব আমার ছেলে আব্দুল্লাহ দিবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আমার কাপড় আমার বাবাকে দিয়েছি। তাতে তার পরিপূর্ণ জামা তৈরি হয়েছে। 

এবার উমার রা. বললেন, এবার কি আপনারা আমার খুতবা শুনবেন? সবাই সমস্বরে বললো। ইয়া আমিরুল মুমিনিন! অবশ্যই। আমরা আপনার কথা শুনবো ও মানবো। উমার রা.-এর শাসনামলে তাঁর বিরুদ্ধে ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে কেউ ভয় পেত না। কতটা সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে অর্ধেক পৃথিবীর শাসকের সামনে চোখ চোখ রেখে প্রতিবাদ করতো সাধারণ জনগণ।  

হিজরি সন গণনা : 
১৬ হিজরির শাবান মাসের ঘটনা। তখন অবশ্য ১৬ হিজরি বলে কিছু ছিল না। একটি অফিসিয়াল সার্কুলার হাজির হলো উমার বিন খাত্তাব রা.-এর সামনে। সেখানে মাসের নাম লেখা ছিল কিন্তু সনের নাম ছিল না। উপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হলো এটি কোন সনের সার্কুলার! উমার রা. বললেন এটি এখনই সমস্যা তৈরি করছে। ভবিষ্যতে তো এটি বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়াবে। এর সমাধান কী? এর কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি সেসময়। 

তৎকালীন আরবে সুনির্দিষ্ট কোন সন প্রথা প্রচলিত ছিল না। বিশেষ ঘটনার নামে বছরগুলোর নামকরণ করা হতো। যেমন- বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, ভূমিকম্পের বছর, হস্তীর বছর ইত্যাদি। মহানবী সা. যখন পৃথিবীতে এসেছেন আরববাসী তখন ‘হস্তীর বছর’ থেকে কাল গণনা করছিল। এরপর ফিজার যুদ্ধ দিয়েও সাল গণনা হতো। যেমন তারা বলতো হস্তীর বছরের তিন বছর পরে আমার মেয়ের জন্ম। ফিজার যুদ্ধের আগের বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে ইত্যাদি। 

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমার ফারুক রা. যখন খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তখন বহু দূর-দূরান্ত পর্যন্ত নতুন নতুন রাষ্ট্র ও ভূখন্ড ইসলামী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রের জরুরি দলিল, কাগজপত্র ইত্যাদিতে কোন সন উল্লেখ না থাকায় অসুবিধার সৃষ্টি হতো। আবার বসরার (ইরাক) গভর্নর মুসা আল আশয়ারি রা. রাষ্ট্রনায়ক উমার ফারুক রা.-কে লিখে পাঠালেন, আপনি পাঠানো চিঠিতে সন না থাকায় সমস্যা হচ্ছে। তিনি এক্ষেত্রে গ্রিসকে অনুসরণ করার পরামর্শ দেন।  

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমীরুল মুমেনিন একটি বিশেষজ্ঞ মিটিং আহ্বান করলেন এই সমস্যা সমাধানে। এখানে বিজ্ঞ সাহাবা ও পন্ডিত ব্যক্তিদের আহ্বান জানান হয়েছে।  সোলার ক্যালেন্ডার নাকি লুনার ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হবে? কোন ঘটনাকে সাক্ষী রেখে বছর গণনা শুরু হবে? কোন মাসকে প্রথম মাস হিসেবে ধরা হবে? ইত্যাদি সব জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে সেই মিটিং-এ।        

হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জমাদিউল আউয়ালে আসলো সেই ঐতিহাসিক দিন। যেহেতু আরবের মানুষ ও সাহাবীরা চন্দ্রবর্ষ অনুসরণ করতো এবং আমাদের ইবাদতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ চাঁদের সাথে সম্পর্কিত তাই সৌর ক্যালেন্ডার বাদ পড়ে যায় শুরুতেই। মহানবী সা.-এর জন্ম, নব্যুয়ত, হিজরত ও মৃত্য—এ চারটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যেকোন একটি হতে হিজরি সন গণনা করার প্রস্তাব উত্থাপিত হলো। 

কিন্তু সমস্যা হলো জন্ম ও নবুয়তের তারিখ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। আর মৃত্যু শোকের সিম্বল। অতএব হিজরতের মাধ্যমেই সন গণনা শুরু করার পক্ষে সাহাবার একমত হলেন। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন বিজ্ঞ সাহাবী সাইয়্যেদেনা আলী রা.। কারণ ঐদিন থেকে আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সা. শাসনক্ষমতা গ্রহণ করতে শুরু করেন এবং মুসলিমরা রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জন করে। সেজন্যই দিনটি মুসলিমদের কাছে চিরস্মরণীয়। আর পবিত্র মাস মহররমকে ১ম মাস হিসেবে নির্ধারণ করতে একমত হন সাহাবারা।

সিদ্ধান্ত হলো যে বছর মুহাম্মদ সা. হিজরত করে মদিনায় এসেছেন সে বছরের মহররমের ১ তারিখ থেকে হিজরি বর্ষ গণনা করা হবে। হিসেব করে দেখা গেল ১ হিজরির ১ মহররম অর্থাৎ প্রথম দিনটি ছিল জুমাবার, জুলিয়ান দিনপঞ্জি অনুসারে ১৬ জুলাই ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। আর এই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয় ঘটনার ১৬ বছর পর ৯ জুন ৬৩৭ সালে। সেদিনই বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখলো সেদিন ছিল ১০ জমাদিউল আউয়াল, ১৬ হিজরি। 

গোপন বৈঠকের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা : 
একবার মদিনায় থাকা কুরাইশরা নিজেদের নিয়ে একটি ঘরে গোপন সভা করেছিল। খবর পেয়ে উমার রা. তাদের সতর্ক করে দিলেন। ঘোষণা করে দিলেন এমন বৈঠক যেন আর কেউ না করে। এগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দিবে। মুসলিমদের মধ্যে গ্রুপিং তৈরি হবে ও ঐক্য বিনষ্ট হবে। তিনি আরো বলেছেন, তোমাদের বৈঠকগুলো উন্মুক্ত করে দাও। সবাই মিলে একসাথে বসো। এতে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা বাড়বে, মানুষের কাছে তোমাদের সম্মান বাড়বে। 

বাজার ব্যবস্থাপনা : 
উমার রা. এর সময়ে মুসলিমদের বাজারে প্রচুর বিদেশী নওমুসলিম ও অমুসলিম ব্যবসায়ী আসতো। উমার রা. তাদেরকে ইসলামী নিয়মকানুন ও নিষিদ্ধ সুদ সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন ও তাদেরকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা মেনে চলতে বাধ্য করতেন। মজুদদারী, প্রতারণা ও জুলুম ঠেকাতে বাজারে টহলের ব্যবস্থা করতেন। কেউ যাতে অতিরিক্ত দাম না হাঁকে সেই ব্যবস্থা রাখতেন। ব্যবসায়ীদের মালপত্রের নিরাপত্তা ও এক শহর থেকে আরেক যাতায়াতের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম করে দিয়েছেন। 

মুসাফিরদের জন্য ব্যবস্থাপনা : 
উমার রা. সময়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে যাতায়াতের মধ্যবর্তী বসতিগুলোতে মুসাফিরখানা তৈরি করেছেন, যাতে মুসাফিররা বিপদে পড়লে এখান থেকে সাহায্য পায়। তারা এখানে ঘোড়া বদলের সুযোগ পেত। বিশ্রামের সুযোগ পেত। এছাড়া উমার রা. গরীব মুসাফিরদের জন্য বাইতুলমাল থেকে উটের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। যাতে তারা প্রয়োজনীয় সফর করতে পারে। 

ব্যবসা :
উমার রা.-এর সময়ে মুসলিমদের আয় বেড়ে যায়। রাষ্ট্র থেকে যে ভাতা পেত তাতে অনেকের জিবিকা নির্বাহ হয়ে যেত। তাই তারা আর ব্যবসার দিকে নজর দিত না। এই সুযোগে মুসলিমদের বাজারে বিদেশী ব্যবসায়ীদের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। এই বিষয় নিয়ে উমার রা. বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি কুরাইশদের কড়া নির্দেশ দেন তারা যাতে নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করে ও ব্যবসা ছেড়ে না দেয়।  ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেখিয়ে বললেন, বিজয় দানের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ব্যবসায়ের ঝামেলা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। উমার রা. বলেন, হে কুরাইশরা! এভাবে তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কাউকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দিয়ো না। বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্ষমতার তিনভাগের এক ভাগ। আল্লাহর কসম করে বলছি, যদি এভাবে চলতে থাকে তোমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। 

রাতের টহল : 
উমার রা.-এর সুশাসনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তিনি জনগণের পরিস্থিতি দেখতে রাতে টহল দিতেন। এই টহলে তিনি যেমন অপরাধীদের পাকড়াও করতে পারতেন তেমনি অভাবী মানুষদের সন্ধান পেতেন। তিনি টহলের সময় কাউকে বিপদ্গ্রস্থ অবস্থায় পেলে সাহায্য করতেন। এরকম টহলের কারণে অনেক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন, অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

টহল দেওয়ার সময় তিনি এক ঘর থেকে প্রায়ই বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন। এরপর সেই ঘরে গিয়ে বাচ্চার মাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন বাচ্চা এভাবে কাঁদছে। বাচ্চার মা উত্তর করলো, সে দুধ ছাড়ানোর চেষ্টা করছে এই কারনে বাচ্চা কাঁদছে। তিনি বাচ্চার বয়স জানতে চাইলেন। বয়স শুনে তিনি বললেন, দুধ ছাড়ানোর জন্য তাড়াহুড়ো করো না। মা উত্তর করলো, দুধ না ছাড়ালে তো আপনি তার ভাতা দিবেন না। তখন নিয়ম ছিল কোনো শিশু জন্ম নেওয়ার পর যখন তার দুধ ছাড়ানো হবে তখন থেকে সে নাগরিক ভাতা পাবে। 

গরীব মায়েরা তাই আগে দুধ ছাড়ানোর চেষ্টা করতো যাতে বাচ্চার নাগরিক ভাতা উত্তোলন করা যায়। পরদিন ফজর নামাজ পড়তে গেলে আরেক বাচ্চা এতো কেঁদেছিল যে, নামাজে ডিস্টার্ব হয়েছে। নামাজ শেষ উমার রা. মনে মনে বললেন, হতভাগা উমার! কত মুসলিম বাচ্চাকে না জানি তুমি মেরে ফেলছো! এরপর ঘোষক দিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানালেন, কোনো মা যাতে দুধ ছাড়ানোর ব্যাপারে তাড়া না করে। আর এখন থেকে বাচ্চা জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই তার ভাতা চালু হয়ে যাবে। 

এক বাড়িতে এক গৃহবধূর কান্নার আওয়াজ পেলেন। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ঐ মহিলা যুদ্ধে থাকা স্বামীর জন্য কান্না করছিল। রাতেই তিনি তার মেয়ে উম্মুল মুমিনিন হাফসা রা.-এর ঘরে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন একজন মেয়ে তার স্বামীর অনুপস্থিতি কতদিন সহ্য করতে পারে? উত্তরে তাঁর মেয়ে বললেন, বড়জোর তিন মাস। চতুর্থ মাসে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবে। এরপর উমার রা. নিয়ম করলেন, কোনো সৈন্য যাতে চার মাসের বেশি সময় পরিবার থেকে দূরে না থাকে। 

শিক্ষাকেন্দ্র ও মসজিদ স্থাপন : 
উমার রা. মক্কা মদিনাসহ নতুন বিজিত সব শহরে প্রচুর মসজিদ ও শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। যাতে মুসলিমরা ইসলামে মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত না হয়। জ্ঞান বিজ্ঞানে যাতে এগিয়ে থাকে। তবে ফিকহ ও ফতওয়ার জন্য তিনি মদিনাকেই নির্দিষ্ট করেছেন। যাতে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। 

অবকাঠামো উন্নয়ন : 
উমার রা. অবকাঠামো উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি মসজিদে নববীকে বড় করেন। এর জন্য তিনি আব্বাস রা.-এর ঘরকে অধিগ্রহণ করেন। মসজিদকে শক্ত ও মজবুত করেন। মেঝে আগে ছিল মাটির ও ধুলোময়। উমার রা. সেখানে পাথর বসিয়ে পাকা মেঝে তৈরি করে দেন। এতে মুসল্লিদের ইবাদাত করা সহজ ও আরামদায়ক হয়। কাবা শরিফেও তিনি সংস্কার করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ডাক ও কুরিয়ার ব্যবস্থা চালু করেন। কৃষির স্বার্থে পুরো মুসলিম সাম্রাজ্যে পানি সরবরাহের জন্য প্রচুর খাল খনন করেন। এর মাধ্যমে পানি মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থাও সুগম হয়।   

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন