২৬ এপ্রি, ২০২২

আল্লাহ তায়ালা যেভাবে ইহুদীদের দর্প চূর্ণ করলেন!


মদিনার ইহুদীরা বেশ অহংকারী ছিল। এই অহংকার ছিল জ্ঞান, ঐতিহ্য, ব্যবসা ও আল্লাহর প্রিয় গোষ্ঠী হিসেবে। যেহেতু তাদের ওহির জ্ঞান ছিল তাই তারা নিজেরা ছাড়া বাকীদের মূর্খ বলে মনে করতো, শুধু তাই তাদের উম্মী বা অশিক্ষিত হিসেবে সম্বোধন করতো। তাদের কিতাবে শেষ নবীর ভবিষ্যৎবাণী ছিল। এই নিয়েও তারা গর্ব করতো। যেহেতু বনী ইসরাঈল থেকেই নবী বেশি এসেছে তাই তারা ভাবতো তাদের বংশ থেকেই নবী আসবে।

নবী আসা নিয়ে মদিনার ইহুদীরা অন্যান্য মুশরিক গোত্রকে এই বলে হুমকি দিত যে, শেষ নবী আসার সময় হয়েছে। শেষ নবী আসলে আমরা তোমাদের ওপর বিজয়ী হবো এবং সারা আরব শাসন করবো। কিন্তু নবী সা.-এর আবির্ভাব হয়েছে মক্কাতে। ইহুদীদের কথিত 'উম্মী'-দের বংশ থেকে। এটা তারা মেনে নিতে পারে নাই। তাই তারা মুহাম্মদ সা.-এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক শত্রুতা করতে শুরু করলো।

নবী সা. মদিনায় আসলে তাদের শত্রুতা আরো বেড়ে যায়। তারা মুসলিমদের ফকির, উম্মী ইত্যাদি বলে অপমান করতো। অযথা ঝগড়া তৈরি করতো। মদিনায় তখন তিনটি ইহুদি গোত্র ছিল। বনু কাইনুকা, বনু নাদির ও বনু কুরাইজা। বনু কাইনুকার বাজারে এক মুসলিম মহিলাকে বিবস্ত্র করার ইস্যুতে মুসলিমদের সাথে বনু কাইনুকার যুদ্ধ বেধে যায়। মুহাম্মদ সা. তাদের অবরোধ করেন। একপর্যায়ে তারা নতি স্বীকার করে এবং মুহাম্মদ সা. তাদেরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন।

এরপর বনু নাদির গোত্র মুহাম্মদ সা.-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। জিব্রাঈল আ.-এর মাধ্যমে আল্লাহ তা জানিয়ে দিলে মুসলিমরা তাদের অবরোধ করে। তারা দীর্ঘদিন অবরোধে থেকে অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে। মুহাম্মদ সা. তাদেরকেও মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। এই নাদির গোত্রের নেতা আরবের সকল গোত্রকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে এবং সবাইকে একতাবদ্ধ করে। যার ফলে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যখন প্রায় ১০,০০০ মুশরিক সৈন্য মদিনা অবরোধ করে তখন মদিনার অবশিষ্ট ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজা মদিনার ভেতর থেকেই মুসলিমদের ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুহাম্মদ সা. কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা চালিয়ে তাদের ঐক্য বিনষ্ট করে দেয়। অবশেষে আল্লাহর সাহায্যে বিজয় আসে। তারপর বনু কুরাইজার সৈন্যদের হত্যা করা হয়।

মদিনা থেকে বিতাড়িত ইহুদীদের একটা বড় অংশ খায়বারে ইহুদী পল্লীতে অবস্থান নেয়। সেখানে ইহুদীদের শক্তিশালী আটটি দুর্গ ছিল। মদিনা থেকে খায়বার ছিল প্রায় ১৭০ কি.মি. দূরে। রাসূল সা. সেখানে অভিযান চালিয়ে তাদের পরাস্ত করেন। তারা মুসলিম অধীনে প্রজা হিসেবে থাকতে চাইলে মুহাম্মদ সা. তাদের অনুমতি করেন।

এরপর আল্লাহ তায়ালা সূরা জুম'আর ১ম ৮ আয়াত নাজিল করেন। ইহুদীদের অহংকার চূর্ণ করে ২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
তিনিই মহান সত্তা যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছেন যে তাদেরকে তাঁর আয়াত শুনায়, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। অথচ ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।

আল্লাহ তায়ালা এখানে বুঝাতে চেয়েছেন, তোমরা এ রাসূলকে মানতে অস্বীকার করছো এই কারণে যে, তিনি এমন এক কওমের মধ্যে প্রেরিত হয়েছেন যাদেরকে অবজ্ঞা ভরে তোমরা ‘উম্মী’ বলে ডাকো। তোমাদের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, রসূলকে অবশ্যই তোমাদের নিজেদের কওমের মধ্যে থেকে হতে হবে। তোমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে ছিলে যে, তোমাদের কওমের বাইরে যে ব্যক্তিই রিসালাতের দাবি করবে সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী।

কিন্তু আল্লাহ তা’আলা সেই উম্মীদের মধ্যেই একজন রাসূল সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের চোখের সামনেই যিনি তাঁর কিতাব শুনাচ্ছেন, মানুষকে পরিশুদ্ধ করেছেন এবং সেই মানুষকে হিদায়াত দান করেছেন তোমরা নিজেরাও যাদের গোমরাহীর অবস্থা জান। এটা আল্লাহর করুণা ও মেহেরবানী, তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। তাঁর করুণা ও মেহেরবানীর ওপর তোমাদের কোন ইজারাদারী নেই যে, তোমরা যাকে তা দেয়াতে চাও তাকেই তিনি দিবেন আর তোমরা যাকে বঞ্চিত করতে চাও, তাকে তিনি বঞ্চিত করবেন।

এরপর আল্লাহ তায়ালা ৫ নং আয়াতে বলেন,
যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি। তাদের উপমা সেইসব গাধা যারা বই-পুস্তক বহন করে। এর চেয়েও নিকৃষ্ট উপমা সেই সব লোকের যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছে। আল্লাহ এ রকম জালেমদের হিদায়াত দান করেন না।

এখানে আল্লাহ তায়ালা বুঝাতে চেয়েছেন, তোমাদের তাওরাতের বাহক বানানো হয়েছিল। কিন্তু তোমরা এর গুরুদায়িত্ব উপলদ্ধিও করোনি, পালনও করোনি। তোমাদের অবস্থা সেই গাধার মত যার পিঠে বই পুস্তকের বোঝা চাপানো আছে কিন্তু সে কি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তা জানে না। তোমাদের অবস্থা গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা, তোমরা আল্লাহর কিতাবের বাহক হওয়ার গুরুদায়িত্ব শুধু এড়িয়েই চলছো না, জেনে বুঝে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলছো। এসব সত্ত্বেও তোমাদের ধারণা এই যে, তোমরা আল্লাহর অতি প্রিয় এবং রিসালাতের নিয়ামত চিরদিনের জন্য তোমাদের নামে লিখে দেয়া হয়েছে।

তারপর ৬-৮ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
হে ইহুদী হয়ে যাওয়া লোকগণ! তোমরা যদি ভেবে থাকো যে, অন্য সব মানুষ বাদ দিয়ে কেবল তোমরাই আল্লাহর প্রিয়পাত্র, আর তোমাদের এ ধারণার ক্ষেত্রে তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে মৃত্যু চেয়ে নাও। কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে, তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আল্লাহ‌ এসব জালেমকে খুব ভালভাবেই জানেন। তাদের বলো, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাচ্ছো তা তোমাদের কাছে আসবেই তারপর তোমাদেরকে সেই সত্তার সামনে পেশ করা হবে যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুই জানেন। তখন তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করছিলে।

আল্লাহ তায়ালা তাদের দাবি এখানে পরিষ্কারভাবে নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের বলেছেন, সত্যিই যদি তোমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে এবং এ বিশ্বাসও তোমাদের থাকতো যে, তাঁর কাছে তোমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার স্থান সংরক্ষিত আছে তাহলে মৃত্যুর এমন ভীতি তোমাদের মধ্যে থাকতো না যে, অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন গ্রহণীয় কিন্তু কোন অবস্থায়ই মৃত্যু গ্রহণীয় নয়। আর মৃত্যুর এই ভয়ের কারণেই তো বিগত কয়েক বছরে তোমরা পরাজয়ের পর পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছো। তোমাদের এই অবস্থা-ই প্রমাণ করে যে, তোমাদের অপকর্মসমূহ সম্পর্কে তোমরা নিজেরাই অবহিত।

এই আয়াতগুলো(১-৮) ৭ম হিজরিতে খাইবারের যুদ্ধের সময় নাজিল হয়েছিল। সূরা জুম'আর আয়াত সংখ্যা ১১। এর অনেক আগে বাকি ১ম হিজরিতে বাকী ৩ আয়াত নাজিল হয়েছিল। মুহাম্মদ সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর একদিন মসজিদে নববীতে জুম'আর খুতবা দিচ্ছিলেন। সে সময় মাদীনার একটি ব্যবসায়ী কাফেলা এসে হাজির হয়। ব্যবসায়ীরা কী পণ্য নিয়ে এসেছে তা দেখার কৌতুহল সামলাতে পারেন নি মুসলিমরা। মাত্র বারোজন সাহাবা ছাড়া বাকীরা খুতবা চলাকালীন মসজিদ থেকে থেকে বের হয়ে গেলেন।

এই প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তায়ালা সূরা জুম'আর ৯-১১ নং আয়াত বলেন,
হে মুমিনগণ, যখন জুমু‘আর দিনে সালাতের জন্য আহবান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও। আর বেচা-কেনা বর্জন কর। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে। অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পারো। আর তারা যখন ব্যবসায় অথবা ক্রীড়া কৌতুক দেখে তখন তারা তার দিকে ছুটে যায়, আর তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে যায়। বল, আল্লাহর কাছে যা আছে তা ক্রীড়া- কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উত্তম। আর আল্লাহ সর্বোত্তম রিজিকদাতা।

এই আয়াতগুলো থেকে সহজেই আমরা অনুভব করতে পারি আল্লাহ তায়ালা কী বুঝিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো আগের অংশের সাথে এই অংশ কেন একই সূরায় সন্নিবেশ করা হলো? এই প্রসঙ্গে মাওলানা মওদূদী রহ. তাফহীমুল কুরআনে বলেন,

আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের ‘সাবত’ বা শনিবারের পরিবর্তে মুসলমানদের ‘জুমআ’ দান করেছেন। তাই আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের সাবধান করে দিতে চান যে, ইহুদীরা, সাবতের সাথে যে আচরণ করেছে তারা যেন জুমআর সাথে সেই আচরণ না করে। রাসূলুল্লাহ সা. বক্তব্য দেওয়া অবস্থায় মসজিদ ছেড়ে চলে যাওয়া ঈমানের সাথে যায় না। তাই নির্দেশ দেওয়া হয় যে, জুমআর আযান হওয়ার পর সব রকম কেনাবেচা এবং অন্য সব রকম ব্যস্ততা নিষেধ। ঈমানদারদের কাজ হলো, এ সময় সব কাজ বন্ধ রেখে আল্লাহর জিকিরের দিকে ধাবিত হবে।

এই সূরা থেকে আমাদের শিক্ষা হলো, আমরা যেন ইহুদীদের মতো আচরণ না করি। ইহুদীদের মতো নিজেদের বিশেষ গোষ্ঠী মনে না করি। আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর ভরসা রাখি। আমরা যেন আল্লাহর আয়াতের নির্দেশনা মান্য করি। আল্লাহর আয়াতকে পাল্টে না দেই। ইহুদীদের মতো আমার যেন আল্লাহর আয়াতকে বিক্রি করে পেট ভর্তি না করি যার কথা আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ৪১ নং আয়াতে বলেছেন।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন