৩১ আগ, ২০২২

ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা


সাইয়েদ কুতুব রহ.। জীবনের একটা বড় অংশজুড়ে তিনি ছিলেন কারাগারে। ১৯৬৪ সালে তার একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটির নাম ছিল معالم فى الطريق  (মা'আলিম ফিত তারিক্ব)। এই কথাটার অর্থ হতে পারে পথনির্দেশক। সাইয়েদ কুতুব এখানে মূলত আমাদের করণীয় কী হবে তা উল্লেখ করেছেন। তাঁর এই বইটি ছিল মুসলিমদের করণীয় বিষয়ক গাইড বুক। 

সেই সময় মিশরের জালিম, তাগুত ও স্বৈরাচারী সরকারের প্রধান ছিল জামাল আব্দুন নাসের। সে তার সরকারের জন্য এই বইটিকে হুমকি হিসেবে দেখেছে। উনিশ শ’পয়ষট্টি সালে কর্নেল নাসের মস্কো সফরে থাকাকালে এক বিবৃতিতে ঘোষণা করে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন সাইয়েদ কুতুবের নেতৃত্বে তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। আর এই ঘোষণার সাথে সাথেই সারা মিসরে ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। আবারো গ্রেপ্তার হন সাইয়েদ কুতুব। 

মা'আলিম ফিত তারিক্ব বইটি লিখে নাসেরকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অপরাধে(!) ১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট আমাদের নেতা সাইয়েদ কুতুব শহীদ রহ.-কে ফাঁসী দিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর বইটি সারা পৃথিবীতে হটকেক হয়ে যায়। হয়তো আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছেই ছিল এমন। আল্লাহ তায়ালা এই শহীদকে দিয়ে শুধু মিসর নয়, সারা পৃথিবীতে দাওয়াতী কাজ করাবেন। 

এই বইটি দিয়ে এখনো দাওয়াতী কাজ করছেন, পথ নির্দেশ করছেন আমাদের নেতা, আমাদের সাইয়েদ। আল্লাহ তায়ালা যথার্থই বলেছেন, শহীদেরা মরে না, তাদের মৃত বলো না। আমি তাদের রিজিক দেই। 

মা'আলিম ফিত তারিক্ব বইটি পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে 'মাইলস্টোন' নামে। বাংলায় অনুবাদ হয়েছে 'ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা' নামে। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদ আব্দুল খালেক। 

বইটি মোট ১২ টি অধ্যায়ে লেখা। বইয়ের ভূমিকাতে লেখক সারা পৃথিবীর মতবাদগুলো নিয়ে আলোচনা করে দেখিয়েছেন মানবরচিত মতবাদের ফলে মানবতা দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে। এর বিপরীতে ইসলামী আদর্শ তথা আল্লাহ প্রদত্ত বিধানই মানবতাকে রক্ষা করতে পারে। এছাড়াও তিনি ভূমিকাতে বিশ্ব নেতৃত্বের জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাবলী, আধুনিক যুগের জাহেলিয়াত, ইসলাম ও জাহেলিয়াতের পার্থক্য ও ইসলামী সমাজের পুনরুজ্জীবন এসব পয়েন্টে কথা বলেছেন। 

১ম অধ্যায়ে হাফেজ সাইয়েদ কুতুব কুরআনের কর্মীদের দল নিয়ে আলোচনা করেন। সাহাবীদের মতো কেন আমাদের ডেডিকেশন নেই অথবা আমরা কেন মান হারিয়েছি তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। 

২য় অধ্যায় লেখক শুরু করেছেন মাক্কী যুগে মুহাম্মদ সা. ও সাহাবারা কীভাবে দাওয়াতী কাজ করেছেন, কুরবানীর নজরানা দিয়েছে সেই প্রসঙ্গ দিয়ে। সাহাবাদের জীবন বিধান সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ/ তারবিয়াত ও সংগঠনিক কর্মকান্ড আলোচনা করেছেন। একই অধ্যায়ে তিনি বিপ্লব বলতে কী বুঝায় ও বিপ্লব কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ২য় অধ্যায়ে তিনি আরো আলোচনা করেছেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার সঠিক উপায় ও এই বিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত কর্মসূচি নিয়ে।   

৩য় অধ্যায় মুফাসসির সাইয়েদ কুতুব শুরু করেছেন ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য ও সমাজ গঠনের উপায় নিয়ে আলোচনা দিয়ে। তিনি এই অধ্যায়ে ইসলামী সমজের আদর্শিক ভিত্তি ও জাহেলী পরিবেশে ইসলামী পুনর্জাগরণের পন্থা কী হতে পারে নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার এই আলোচনার বেসিক হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলল্লাহ' তথা কালিমাতুত তাওহীদের অর্থ বুঝে আল্লাহর কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া এবং মুহাম্মদ সা.-কে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করা। 

৪র্থ অধ্যায়ে মাওলানা সাইয়েদ কুতুব শহীদ আলোচনা করেছেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নিয়ে। তিনি প্রথমে জিহাদের স্তর, জিহাদের বিপ্লবী ঘোষণা ও আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে কথা বলেছেন। এরপর শুধু আত্মরক্ষার নাম জিহাদ নয়, এটাও ক্লিয়ার করেছেন। মাক্কী জীবনে জিহাদ নিষিদ্ধ থাকার কারণ ও প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন। সর্বশেষ মাওলানা কুতুব ইসলাম, দেশরক্ষা ও হিহাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করেছেন। একইসাথে জিহাদ সম্পর্কিত কিছু ভুল ধারণার অপনোদন করেছেন। 

৫ম অধ্যায় ছিল ইসলামী জীবন বিধান নিয়ে। এখানেও কালেমাতুত তাওহীদ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য, ইসলামী সমাজ গঠনের উপায়, জাহেলিয়াত ও তার প্রতিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার অসারতা ও মুসলিম হিসেবে এই ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়াকে কুফরি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। 

৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ইসলামী আদর্শই যে বিশ্বজনীন জীবনাদর্শ তা নিয়ে আলোচনা করেন। মানুষের জৈবিক অংশ যে অন্যান্য সৃষ্টির মতো আল্লাহর বিধান পূর্ণরূপে মান্য করে তা নিয়েও বিশদ আলোচনা করেন। ইসলামের বিধান ত্যাগ অথবা ইসলাম থেকে বিচ্যুতির ফলে মানবতার যে অস্থিরতা তা এই অধ্যায়ের শেষে আলোচনা করেন। 

৭ম অধ্যায়ের আলোচনার বিষয় ছিল সভ্যতা। কাকে আমরা সভ্যতা বলতে পারি আর কোনটা অসভ্যতা এই নিয়েই এই অধ্যায়ের শুরু।  ইসলাম ও জাহিলী সমাজের মৌলিক পার্থক্য ও সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড কী হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করেন।  এই অধ্যায়ের শেষে শহীদ কুতুব ইসলামী সমাজের ক্রমবিকাশ ও ইসলামী সভ্যতা যে সকল ধর্মের মানুষের জন্যই কল্যাণকর তা নিয়ে ব্যখ্যা করেন। 

৮ম অধ্যায়ে আমাদের সাইয়েদের আলোচনার বিষয় ছিল সংস্কৃতি/ কৃষ্টি। এই অধ্যায়ে লেখক ইসলাম, কৃষ্টি ও এই ব্যাপারে ইসলামের সীমারেখা নিয়ে দারুণ আলোচনা করেছেন। এখানে তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা করেছেন।

৯ম অধ্যায় ছিল লেখকের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি। এখানে তিনি আলোচনা করেছে মুসলিমদের জাতীয়তা কী হবে? কীসের ওপর ভিত্তি করে করে আমাদের জাতীয়তা নির্ধারণ হবে? ঈমানই হবে আমাদের জাতীয়তার পরিচয় ও ঐক্যের ভিত্তি। এরপর তিনি মধ্যপন্থী উম্মাহ'র ব্যবচ্ছেদ করেছেন। দারুল ইসলাম ও দারুল হারব নিয়ে আলোচনা করেছেন। 

লেখক বলেন, দ্বীনের প্রতি আহবানকারীদের অন্তরে ইসলাম ও জাহেলিয়াত এবং দারুল ইসলাম ও দারুল হরবের প্রকৃতি ও পরিচয় সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকা উচিত নয়। কারণ সন্দেহের পথ ধরেই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। যে দেশে ইসলামের প্রধাণ্য নেই, যেখানে ইসলামী শরীয়াত বাস্তবায়িত হয়নি এবং যে ভূখণ্ডের আইন-কানুন ইসলাম নয়। ঈমানের বহির্ভূত যা কিছু আছে তাই কুফর এবং ইসলামের বাইরে যা আছে তা শুধুই জাহেলিয়াত এবং সত্যের বিপরীত সবকিছুই মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়।

১০ম অধ্যায় শহীদ কুতুব যারা ইসলামী রাষ্ট্রের দাওয়াত দিবে তাদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন। কীভাবে দাওয়াত দিতে হবে, কীভাবে আপোষহীন থাকতে হবে, আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য, কীসে আমাদের সাফল্য তা উল্লেখ করেছেন।  

তিনি নসিহত করে বলেন, দ্বীনের প্রতি আহবানকারীদের কোন প্রকারেই জাহেলিয়াতের সাথে খাপ খাইয়ে চলার নীতি গ্রহণ সম্ভব নয়। জাহেলিয়াতের কোন একটি মতবাদ, কোন রীতিনীতি অথবা তার সামাজিক কাঠামোর কোন একটি মতবাদ, কোন রীতিনীতি অথবা তার সামাজিক কাঠামোর কোন একটির সাথেও আপোষ করা আমাদের জন্যে অসম্ভব। এ জন্যে জাহেলিয়াতের ধারক-বাহকগণ যদি আমাদের উপর অত্যাচারের স্টিমরোলারও চালিয়ে দেয় তবু আমরা বিন্দুমাত্র নতি স্বীকার করতে রাজি নই।

১১শ অধ্যায়ে আলোচনার বিষয় ছিল ঈমান ও আকিদা। ঈমান আনার পর একজন মানুষের আচরণ ও চরিত কী রকম হওয়া উচিত তা নিয়েও আলোচনা করেন। মূলত এই অধ্যায়ে একজন মুমিনের চালচলন ও আচার আচরণ কীরূপ হবে তা বর্ণনা করা হয়েছে। 

১২শ অধ্যায়ের নাম রক্তে রঞ্জিত পথ। লেখক বলেন ইসলামী সমাজ কায়েম তথা ঈমানের পথে চলা সহজ কাজ নয়। এর জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তিনি শুরুতে সূরা বুরুজে বর্ণিত ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন। 

আমাদের নেতা সাইয়েদ কুতুব বলেন, কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের চলার পথে যেসব বাধা বিপত্তি আসতে পারে তা উল্লেখ করেছেন এবং সম্ভাব্য সকল প্রকার বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টকে বরণ করে নেয়ার জন্যে উৎসাহ দিয়েছেন।

একজন মুসলিমের জন্য এই বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য এটা পাঠ্য। এই বইটি আপনাকে পথ দেখাবে। কুরআন ও রাসূল সা.-এর সীরাত বুঝতে আপনাকে সহায়তা করতে। আপনাকে আপনার করণীয় সম্পর্কে সঠিক নির্দেশনা দিবে। 

বইটি আমাদের সকলের পড়া উচিত। যারা পড়েন নাই তারা তো অবশ্যই পড়বেন, যারা পড়েছেন তারাও পুনরায় পড়বেন। আপনার ঈমান তাজা হবে ইনশাআল্লাহ। 

#বুক_রিভিউ
বই : ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা
লেখক : সাইয়েদ কুতুব শহীদ
অনুবাদক : মুহাম্মদ আব্দুল খালেক 
প্রকাশনী : আধুনিক প্রকাশনী 
পৃষ্ঠা : ২১৬
মুদ্রিত মূল্য : ১৬৪
জনরা : রাজনীতি 

২৬ আগ, ২০২২

বাংলায় জামায়াতের প্রচার যেভাবে হয়!



১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ৭৫ জন নিয়ে জামায়াত যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন একজনমাত্র বাঙালি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর নাম মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। তিনি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার পটুয়াখালী শহরের বাসিন্দা ছিলেন। মাওলানা ৭৫ জনের মধ্যে ১৬ জনকে নিয়ে মজলিসে শুরা গঠন করেছিলেন সেই মজলিশে শুরাতেও ছিলেন মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। সেই হিসেবে ১ম বাঙালি রুকন ও ১ম বাঙালি শুরা সদস্য ছিলেন তিনি। তবে তিনি দুই বছরের মধ্যে জামায়াত ত্যাগ করেন।

১৯৪৬ সালে জামায়াতের সম্মেলনে যোগ দেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি কলকাতা থেকে সেখানে গিয়েছেন। তখন তার বয়স ২৮ বছর। তিনি মাওলানার সাথে দেখা করেন ও রুকন শপথ নেন। সেই হিসেবে ২য় বাঙালি রুকন হলেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে নিজ গ্রামে অর্থাৎ পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানার শিয়ালকাঠি গ্রামে দাওয়াতী কাজ করেন। সেখানে তিনি ১০-১২ জন যুবককে ইকামাতে দ্বীনের কাজের জন্য রাজি করান। এদেরকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলার ১ম ইউনিট। ইউনিট সভাপতি ছিলেন মাওলানা লেহাজ উদ্দিন।

মাওলানা আব্দুর রহীম নাজিরপুরে একটি মাদ্রাসার হেড মাওলানা পদে চাকুরি শুরু করেন। এই মাদ্রাসাতেও আরেকটি ইউনিট তিনি গঠন করেন। এখানে স্থানীয় অতুল চন্দ্র ও ভবানীসেন নামে দুই বাম কমরেডের সাথে প্রায়ই মাওলানা আব্দুর রহীমের বিতর্ক হতো। সেই সূত্রে তিনি ইসলাম, কমিউনিজম ও অর্থনীতি নিয়ে 'ইসলামে অর্থনীতি' নামে একটি বই লিখে ফেলেন।

১৯৪৮ সালেও ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়নি। ততক্ষণে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে। ইংরেজমুক্ত হয়েছে উপমহাদেশ। ঢাকায় কাজ নিয়ে কেন্দ্র বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেভাবে সফল হওয়া যায়নি। ১৯৪৮ সালে খুরশিদ আহমদ বাট নামে একজন সরকারি কর্মকর্তা করাচি থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছিলেন। তিনি রুকন ছিলেন। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন যাতে ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়। এজন্য তিনি কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। কেন্দ্র তাকে মাওলানা আব্দুর রহীমের ঠিকানা দেন।

খুরশিদ আহমদ বাট ঢাকায় এসে চাকুরিতে জয়েন করেন। তিনি মাওলানা আব্দুর রহীমকে চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি তাঁকে ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেন। জবাবে মাওলানা আব্দুর রহীম জানান, ঢাকায় শুধু থাকার একটি জায়গা দিতে পারলে তিনি নির্দ্বিধায় চলে আসবেন। খুরশিদ আহমদ বাট একটি প্রশস্ত রুম ভাড়া করেন আব্দুর রহীম সাহেবের জন্য। এপ্রিলেই আব্দুর রহীম সাহেব ঢাকায় চলে আসেন। তাঁরা দুইজন ঢাকার কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন।

১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতে মাওলানা মওদূদী রহ. ঢাকায় কাজ করার জন্য বাগ্মী ও বিখ্যাত দায়ি রফি আহমদ ইন্দোরিকে ঢাকায় প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে আলিয়া মাদ্রাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানের একজন শিক্ষক ছিলেন মাওলানা কারি জলিল আশরাফ নদভী। রফি আহমদ ইন্দোরীর নেতৃত্বে ঢাকায় এখন রুকন চারজন।
১. রফি আহমদ ইন্দোরি
২. কারি জলিল আশরাফ নদভী
৩. খুরশিদ আহমদ বাট
৪. মাওলানা আব্দুর রহীম

এর মধ্যে শুধু আব্দুর রহীম ছাড়া বাকিরা ছিল অবাঙালী। তবে আব্দুর রহীম ছাড়া বাকিরা ছিল সাংগঠনিক কাছে বেশ পারদর্শী। তাই তারা ঢাকায় কাজ শুরু করেন ঢাকায় থাকা মুহাজিরদের মধ্যে। লালবাগ, নবাবপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে মুহাজিরদের মধ্যে জামায়াতের কাজ দ্রুত সম্প্রসারণ হতে থাকে।

এরমধ্যে মাওলানা আব্দুর রহীম দাওয়াতী কাজে ভীষণ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। তাকে সামনে রেখেই রফি আহমদ ইন্দোরি ঢাকাকে জামায়াতের শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে পিতার অসুস্থতার কারণে আব্দুর রহীম সাহেবকে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে হয়। তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় এবং জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হন। মাওলানা মওদূদী তাঁকে অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং উর্দু ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলো বাংলায় অনুবাদ করার কাজ দেন। এভাবে তার জীবিকার ব্যবস্থা হয়। তিনি পূর্ণ মনোযোগের সাথে ঢাকার সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য কাজ করতে থাকেন।

অবশেষে কাজের বিস্তৃতি মোটামুটি হলে মাওলানা মনজুর আহমেদ জামেয়ীর নেতৃত্বে ঢাকা শহরের ইমারত গঠিত হয়। তিনি হন ঢাকার প্রথম আমীর। ঢাকায় জামায়াতের কাজ প্রতিষ্ঠায় যাদের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে পূর্বে বর্ণিত চার জন, মনজুর আহমেদ জামেয়ী ছাড়াও আরো রয়েছেন,

১. সাইয়্যেদ হাফিজুর রহমান, হেড মাস্টার, রহমতুল্লাহ মডেল হাই স্কুল
২. খাজা মাহবুব এলাহী, প্রথম সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৩. মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী, সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৪. মাওলানা আব্দুস সুবহান, সাবেক এমপি, পাবনা।
৫. ব্যারিস্টার কোরবান আলী।

এছাড়া আরো একজনের কথা আলাদাভাবে বলতে তিনি হলেন শেখ আমিনুদ্দিন ভাই। ঢাকায় জামায়াতের কাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না এই খবর পৌঁছে গেছে বিহারের ছোট নাগপুরের রুকন শেখ আমিনুদ্দিনের কাছে। ১৯৪৭ সালে বিহার থেকে হিজরত করে পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন। কিন্তু তার মন পড়ে আছে বাংলায়। কারণ ঢাকায় জামায়াতের কাজ করার লোক তৈরি হচ্ছে না। 

শেখ আমিনুদ্দিন দাওয়াতী কাজ করার জন্য ঢাকায় চলে এলেন। তিনি দাওয়াতী কাজ করতে পছন্দ করেন। ঢাকার অলি গলিতে হাঁটেন আর পুরান ঢাকার মানুষের সাথে উর্দুতে কথা বলেন, পরিচিত হন। এভাবে নবাবপুরে তিনি বেশ পরিচিতি লাভ করেন। 

তিনি খেয়াল করেছেন, ঢাকার মানুষ পান খেয়ে গল্প করতে পছন্দ করেন। তিনি পান দোকান দিয়ে বসলেন মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য। একটি দুটি নয় ঢাকায় নবাবপুর, মোহাম্মদ পুর, বংশাল ও মিরপুরে পানের দোকান দিয়ে মানুষকে পান খাওয়াতেন। ঢাকার মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করে তিনি ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। 

ঢাকায় যখন মোটামুটি সংগঠন কায়েম হয়ে গেল, অনেকজন দায়ি তৈরি হয়ে গেল তখন একদিন তিনি আমীরের অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন বগুড়ায়। শুরু করলেন সেখানে দাওয়াত দেওয়া। বগুড়ায়ও তিনি পান দোকান দিয়ে সংগঠনের দাওয়াত দিতে থাকলেন! 

বাংলায় জামায়াতে ইসলামীর পথচলার একেবারে শুরুতে যারা দাওয়াতী কাজে জীবন উতসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে একজন বিহারের শেখ আমিনুদ্দিন ভাই। দ্বীন কায়েমকে তিনি সত্যিকারভাবেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন।

কত মহামানুষের অপরিসীম ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইসলামী আন্দোলন! এই তালিকা শেষ হবার নয়। শেখ আমিনুদ্দিন ভাইয়ের গল্প যেদিন প্রথম শুনছিলাম, তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছিল। 

এই অঞ্চলের বাঙালিদের ইসলামী আন্দোলন বুঝাতে আমিনুদ্দিন ভাইয়ের যত পেরেশানী, এই অঞ্চলের মানুষের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা তার এক ছটাক যদি আমাদের থাকতো! হায়! 

আমরা যদি সত্যিই এই অঞ্চলের মানুষকে ভালোবেসে তাদেরকে জান্নাতের দাওয়াত দেওয়ার পেরেশানী নিয়ে কাজ করতাম তাহলে তো আমাদের চোখে ঘুম ধরার কথা ছিল না। কাজের নেশায় পাগল হয়ে যেতাম। হায়!

আজ ২৬ আগস্ট জামায়াতের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সকল কাজপাগল মুজাহিদদের প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। যাদের রক্তঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সংগঠন, যাদের কাজের বদৌলতে আমরা ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত পেয়েছি, তাঁদের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে সম্মান ভিক্ষা চাইছি।


১৮ আগ, ২০২২

ইসলামী ব্যাংকিং



জনাব আব্দুর রকিব। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন। এরপরের বছর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে তিনি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের বাংলাদেশ শাখার প্রধান হন। ১৯৭১ এর পর বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির প্রধান হন।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে সারা পৃথিবীতে ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে যখন ব্যাপক আলোচনা ও এর আলোকে ব্যাংক চালু হওয়া শুরু হলো তখন তিনি ইসলামী ব্যাংকিং-এর সাথে জড়িত হন। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট হন। যারা ইসলামী ব্যাংক নিয়ে কাজ করেছে, পলিসি তৈরি করেছে এমন বহু মানুষের মধ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একজন।

জনাব শেখ মুহাম্মদ। পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞানে। ১৯৮৪ সালে কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৮৬ সালে সরকারি চাকুরি ছেড়ে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকে যোগ দেন। ইসলামী ব্যাংকে এসেছেন শুধুমাত্র ইসলামকে ভালোবেসে। এদেশে একটি সুদমুক্ত ব্যাংক চালু করে জাতিকে বিকল্প দেওয়ার জন্য। ইসলামী ব্যাংকের যেমন ভবিষ্যত সম্পর্কে কারো কোনো আইডিয়া ছিল না তেমনি এখানে তার সম্মানীও কমে গেছে। তিনি ইসলামী ব্যাংকের একজন গবেষক ছিলেন। সারা পৃথিবীর অন্যান্য ইসলামী ব্যাংক থেকে আইডিয়া ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ও বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যাংকিং পদ্ধতি নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন।

এই দুইজন ব্যক্তি ২০০৪ সালে একটি বই লিখেন 'ইসলামী ব্যাংকিং' নামে। এখানে তারা ইসলামী ব্যাংকের থিওরি, প্রয়োগ ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। বইটিতে মোট ১৪ টি অধ্যায় রয়েছে। তারা ইসলামী ব্যাংকিং-এর সকল আলোচনা এই বইতে সন্নিবেশ করেছেন।

১ম অধ্যায়ে তারা ব্যাংক ও অর্থ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্যাংকের সংজ্ঞা, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, কমিউনিজম, ইসলামী অর্থব্যবস্থা এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।

২য় অধ্যায়ে সুদ ও সুদের প্রকার নিয়ে আলোচনা করেছেন।

৩য় অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের উতপত্তি, বাংলাদেশে এর পটভূমি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর ইসলামী ব্যাংক ও সুদি ব্যাংকের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তারা ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেন।

৪র্থ অধ্যায়ে লেখকদ্বয় মূলত ইসলামী ব্যাংকের টাকা সংগ্রহ/ আমানত/ জমা গ্রহণ নিয়ে আলোচনা করেন। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের দুইটা পদ্ধতি আছে। আল ওয়াদিয়াহ ও মুদারাবা। এই দুইটি পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এই অধ্যায়ে। কীভাবে এর মুনাফা বন্টন হয় তা নিয়েও আলোচনা হয়।

৫ম অধ্যায়ে চেক সংক্রান্ত আলোচনা করেন তারা। চেকের প্রকারভেদ, হস্তান্তর, অনুমোদন, অনুমোদনের শর্তাবলী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়।

৬ষ্ঠ অধ্যায়টি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিনিয়োগের পদ্ধতিগুলোকে তারা তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন।

ক. ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি
১. বাই মুরাবাহা
২. বাই মুয়াজ্জাল
৩. বাই সালাম
৪. ইসতিসনা

খ. অংশিদারিত্ব পদ্ধতি
১. মুদারাবা
২. মুশারাকা

গ. মালিকানায় অংশীদারিত্ব

এই অধ্যায়ে লেখকদ্বয় প্রতিটি পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং এক পদ্ধতির সাথে অপর পদ্ধতির পার্থক্য সূচিত করেন। যাতে সাধারণ পাঠক বুঝতে সক্ষম হয়। এখানে তারা আরেকটি দারুণ কাজ করেছেন তা হলো প্রতিটি পদ্ধতির ক্ষেত্রে তারা সম্ভাব্য অনিয়ম ও ত্রুটির কথাও উল্লেখ করেছেন। এজন্য একটা কথা বলা হয়ে থাকে 'ইসলামী ব্যাংকের জন্য পূর্বশর্ত ইসলামী ব্যক্তিত্ব'। কাজী ওমর ফারুক ২০০৬ সালে এই নামেই একটি বই লিখেছেন।

ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের সমাধান এখানে তারা দিয়েছেন। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার হার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সুদের হারের সাথে মিলে যায়। তাহলে ইসলামী ব্যাংকের এই আয় কি সুদ? এই প্রশ্নের সমাধান দেওয়া আছে এই অধ্যায়ে। এরপর সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করেছেন লেখকদ্বয়।

এরপর তারা কীভাবে একজন ব্যবসায়ীর সাথে বিনিয়োগে যাবে সেই পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। কীভাবে রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট করেন তা নিয়ে আলোচনা করেন। শুধু তাই নয়, ইসলামী ব্যাংক যেখানে বিনিয়োগ করে সেই ব্যাবসার তদারকি ও মুনাফা আদায়ের পদ্ধতিও তারা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। এরপরও যদি ক্ষতি হয় তবে সেই ক্ষতিপূরণের পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হয়।

৭ম অধ্যায়ে চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়। ব্যবসায়ে লিখিত চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ গ্রাহকদের সাথে চুক্তি কীভাবে করতে হবে ও মানতে হবে সে পদ্ধতি উল্লেখ করেন।

৮ম অধ্যায়ে বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করেন তারা। এই অধ্যায়ে ঋণপত্র, শরিয়ার আলোকে ঋণপত্র, মুদ্রা বিনিময়, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে এবং এসবের শরিয়াহ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়।

৯ম অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কিছু বিশেষ বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই অধ্যায় থেকে ১৪শ অধ্যায় পর্যন্ত মূলত ইসলামী ব্যাংকের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

১০ম অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

১১শ অধ্যায়ে বিনিয়োগের শ্রেণীবিন্যাস ও প্রভিশনিং নিয়ে আলোচনা হয়।

১২শ অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের মূলধন নিয়ে আলোচনা হয়।

১৩শ অধ্যায়ে ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে আলোচনা হয়।

১৪শ ও সর্বশেষ অধ্যায়ে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বলা হয়, জনগণের আস্থা অর্জন করে বিশাল আমানত সংগ্রহ করেছে ইসলামী ব্যাংকগুলো। সেই সাথে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ভালো ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ও সবচেয়ে বেশি লাভও অর্জন করেছে তারা। এখনো সেই অবস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে লেখকদ্বয় যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন তা হলো,
১. ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার আইন নেই।
২. সুদমুক্ত সিকিউরিটিজ/বন্ড-এর অভাব
৩. খেলাপি বিনিয়োগ। অন্যান্য ব্যাংকগুলো দন্ডসুদ আরোপ করে। এখানে যা সম্ভব নয়।
৪. ব্যাংক কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত ট্রেইনিং-এর অভাব
৫. শরীয়তের বিষয়ে দক্ষতার অভাব।

বইটি ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে আপনার ধারণাকে পরিপূর্ণ করবে এবং বাজারি কথাবার্তা থেকে আপনাকে মুক্ত করবে। একইসাথে আপনি এখান থেকে সুদ ও ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে বিস্তর ধারণা লাভ করতে পারবেন। যদি ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে ধারণা নিতে চান তবে এই বইটি আপনার জন্য পাঠ্য।

বইটির পিডিএফ লিংক দেওয়া হয়েছে।

#বুক_রিভিউ
বই : ইসলামী ব্যাংকিং
লেখক : আব্দুর রকীব ও শেখ মোহাম্মদ
প্রকাশনী : আল আমিন প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ২৭২
মুদ্রিত মূল্য : ২০০
জনরা : অর্থনীতি
 

১১ আগ, ২০২২

মুহাররমের শিক্ষা

মাওলানা মওদূদী। উপমহাদেশের এক দারুণ মুজাদ্দিদ। তুর্কি খিলাফত ভেঙ্গে যাওয়া, মুসলিমদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উত্থান, উম্মাহর ভাঙ্গন, সারা পৃথিবীতে পরাজিত ও লাঞ্চিত হওয়ার মাধ্যমে মুসলিমরা যখন তাদের গতি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে তখন উত্থান হয়ে মাওলানা মওদূদীর।

মুসলিমদের প্রয়োজনীয় সব দিককে সামনে রেখেই তিনি কলম চালিয়েছেন। মুসলিমদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। মুসলিমদেরকে তাদের ঈমান ও দায়িত্বের ওপর অবিচল থাকার ব্যাপারে নসিহত করেছেন।

মুহাররম নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে শোক প্রকাশ তিনি দেখেছেন। কিন্তু কেন হুসাইন রা. জীবন কুরবানী করলেন, তার কী উদ্দেশ্য ছিল এই নিয়ে মুসলিমদের কোনো কর্মকান্ড বা কর্মতৎপরতা তিনি লক্ষ্য করেন নি। তাই এই উদ্দেশ্যে তিনি একটি বই লিখেছেন 'মুহাররমের শিক্ষা' নামে। এই বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আব্দুল মান্নান তালিব।

মাওলানা বইয়ের শুরুতে বলেন, হুসাইন রা.-এর উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যদি আমরা কিছু না করি, বরং তার বিপরীত কাজই করে যেতে থাকি, তখন নিছক তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্যে শোক প্রকাশ এবং তাঁর হত্যাকারীদেরকে গালিগালাজ করে কিয়ামতের দিন আমরা ইমামের নিকট থেকে কোনো বাহবা লাভেরও আশা রাখতে পারিনা। উপরন্তু আমরা এও আশা করতে পারি না যে, আল্লাহ্‌ও আমাদের এ কাজের কোনো মূল্য দিবেন।

এরপর মাওলানা শাহদাতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, হুসাইন রা.-এর দৃষ্টি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি, প্রাণশক্তি এবং ব্যবস্থার মধ্যে কোনো বিরাট পরিবর্তনের পূর্বাভাস লক্ষ্য করছিল এবং এর গতিরোধের জন্যে সব ধরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তাঁর নিকট অত্যাধিক প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। এমনকি এজন্যে প্রয়োজনবোধে সশস্ত্র জিহাদে অবতীর্ণ হওয়াকেও তিনি শুধু বৈধই নয়, অবশ্য করণীয় বা ফরজ বলে মনে করেছেন।

ইয়াজিদের ক্ষমতা দখলের ফলে কী পরিবর্তন এসেছে এই নিয়ে মাওলানা বলেন, শাসনব্যবস্থায় তিনটি পরিবর্তন এসেছে।
১। বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন
২। উদ্দেশ্যে পরিবর্তন
৩। প্রাণশক্তির পরিবর্তন

ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হলো, দেশের মালিক আল্লাহ, জনসাধারণ আল্লাহর প্রজা এবং এই প্রজাপালনের ব্যাপারে রাষ্ট্রকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। রাষ্ট্র জনসাধারণের মালিক নয় এবং জনসাধারণও রাষ্ট্রের গোলাম নয়। ইয়াজিদের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে রাজতান্ত্রিক শাসন চালুর সাথে সাথে এই বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হতে থাকলো।

ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর পৃথিবীতে তাঁরই পছন্দের কাজগুলোর প্রতিষ্ঠা এবং প্রসার আর অসৎ কাজের পথরোধ এবং বিলুপ্তি সাধন। কিন্তু মানবীয় কর্তৃত্ব ভিত্তিক রাজতন্ত্র চালু করার পর রাজ্য জয়, মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব, কর উসূল এবং বিলাসী জীবন যাপন করা ছাড়া রাষ্ট্রের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলো না।

ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি ছিল তাকওয়া বা আল্লাহ্‌ভীতি। রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যেই হতো এর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। রাষ্ট্রের সকল কর্মচারী, বিচারপতি এবং সেনাপতিগণ এই রুহানী শক্তিতে ভরপুর হতেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের পথে পা রাখার সাথে সাথেই মুসলমানদের রাষ্ট্র এবং শাসক সমাজ রোমের কাইসার ও ইরানের কিসরার রীতিনীতি এবং চাল চলন অনুকরণ করলো। ইনসাফের পরিবর্তে জুলুম ও নিপীড়ন, আল্লাহ্‌ ভীতির পরিবর্তে উচ্ছৃংখলতা, চরিত্রহীনতা, গান-বাজনা এবং বিলাসিতার স্রোত প্রবাহিত হলো।

এরপর মাওলানা ইসলামী রাষ্ট্রের ৭ টি ধারা/ মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করলেন।
১। জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে
২। রাষ্ট্রপরিচালিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে এবং পরামর্শও করতে হবে তাদের সাথে যাদের ইলম, তাকওয়া এবং নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছার মতো বুদ্ধিবৃত্তির উপর জনসাধারণ আস্থা রাখে।
৩। স্বাধীন মতামত প্রকাশের ব্যাপারে জনসাধারণকে পুর্ণ সুযোগ দান।
৪। খলীফা এবং তাঁর রাষ্ট্রকে আল্লাহর এবং জনগণ উভয়ের নিকট জবাবদিহী করতে হবে।
৫। রাষ্ট্রের কোষাগার আল্লাহর সম্পত্তি এবং মুসলমানদের আমানত।
৬। রাষ্ট্রে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
৭। অধিকার এবং মর্যাদার দিক দিয়ে পূর্ণ সাম্যের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ইসলামী খিলাফতকে রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত করার ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য ও প্রাণশক্তির পরিবর্তন হয়। ইয়াযিদের উত্তারাধিকার সূত্রে সিংহাসন দখলের ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের অত্যাবশ্যকীয় মূলনীতিরও পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়েছে।

হুসাইন রা. ভেবেছেন, ইসলামী রাষ্ট্রের বিচ্যুতির ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম যে পরিবর্তন সাধন করেছিল তা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এজন্যেই হুসাইন রা. পেরেশান হয়ে গেলেন। তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। বিপদসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ কথা প্রমাণ করে গেছেন, ইসলামী রাষ্ট্রের বুনিয়াদী নীতিগুলোর সংরক্ষণের জন্য মুমিন যদি তাঁর জান কুরবান করে দেয়, তাঁর আত্মীয় পরিজনকে কুরবানী করে, তাহলেও তাঁর উদ্দেশ্যের তুলনায় এবস্তু নেহায়েত কম মূল্যই রাখে।

আর এই নীতিগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে উপরোল্লিখিত সাতটি পরিবর্তন ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে কেউ হয়তো তাচ্ছিল্ল ভরে একে নিছক একটা রাজনৈতিক কার্য বলতে পারে, কিন্তু হুসাইন ইবনে আলী রা.-এর দৃষ্টিতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এটি ছিল একটি দ্বীনি কর্তব্য। এজন্যে শাহাদাতের জযবা নিয়েই তিনি এ কার্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন।

সুতরাং মুহাররম/ কারবালার শিক্ষা হলো ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রকে তার মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখা দ্বীনি কর্তব্য। এর জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে। এই শিক্ষা ধারণ করা ছাড়া হুসাইনের জন্য শোক প্রকাশ ও ইয়াজিদের জন্য ঘৃণা কোনো কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে না। আসুন দ্বীনি দায়িত্ব পালনে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় লিপ্ত হই। এই ছিল মাওলানা মওদূদী কর্তৃক লিখিত 'মুহাররমের শিক্ষা' বইয়ের মূল ভাব।

#বুক_রিভিউ
বই : মুহাররমের শিক্ষা
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : আব্দুল মান্নান তালিব
প্রকাশনী : আইসিএস
পৃষ্ঠা : ২৪
মুদ্রিত মূল্য : ১২
জনরা : আত্মউন্নয়ন ও মোটিভেশন

৭ আগ, ২০২২

হাসিনাকে কেন তেলের দাম বাড়াতে হলো?

 


বাংলাদেশের জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির বেসিক কারণ হলো রিজার্ভ সংকট। আর রিজার্ভ সংকটের কারণ হলো মেগাপ্রজেক্টের নামে মেগাদুর্নীতি। সরকারের আমলা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা ছোটখাটো কাজ থেকে শুরু করে বড় কাজ সব স্থানে হরিলুট চালিয়েছে।

যে সড়কের মেরামতে লাগার কথা এক কোটি টাকা সেখানে ব্যয় করেছে ১০ কোটি টাকা। একেকটা বালিশ কিনেছে ৫৫ হাজার টাকায়। ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু ৪০ হাজার কোটি টাকায়। এভাবে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে সরকারি অর্থের হরিলুট হয় নাই। সরকারের কোনো কেনাকাটা বাজারদরের দশগুণের চাইতে কম হয়নি। এসব কারণে জনগণের ওপর বার বার ট্যাক্স আরোপ করেও রিজার্ভ সংকট কাটানো যায়নি।

এছাড়া যেসব কারণে রিজার্ভ বাড়ার কথা সেসব খাতে সরকারের কোনো সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। প্রবাসী কল্যাণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। নতুন নতুন দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। তৈরি পোষাক ও চামড়া শিল্পের বিকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভারতকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। ইত্যাদি বহু কারণে রিজার্ভ সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ। সেগুলো পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো পরিকল্পনা।

এমতাবস্তায় অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারী সরকার IMF-এর কাছে ঋণ চেয়েছে। IMF সাধারণত যে শর্তগুলো দেয় তার একটি হলো জ্বালানী খাতে ভর্তুকি না দেওয়া। IMF তাদের ঋণ ফেরত পাওয়ার সক্ষমতা যাচাই করে। সে অনুযায়ী শর্তারোপ করে এবং ঋণ দেয়। বাংলাদেশ এখনো ঋণ দাতা গোষ্ঠীগুলোর সাথে বৈঠক করেনি। বৈঠকের আগেই হাসিনা সরকার তেলের মূল্য বড় আকারে বাড়িয়ে IMF ও দাতা গোষ্ঠীকে বুঝাতে চায়, শুধু জ্বালানীতে ভর্তুকি বন্ধ নয়, জ্বালানী তেল থেকে লাভ করেও আমরা ঋণ পরিশোধে সক্ষম।

মহাদুর্নীতি ও হরিলুটের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু এ সংস্থা থেকে ঋণের প্রধানতম শর্তই হলো জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া। এখন বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, সরকার যে ঋণ চেয়েছে সংস্থাটির কাছ থেকে তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগেই তেলের দাম বাড়িয়ে তাদের শর্ত পূরণ করে নিলো।

বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা যে ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার বড় অংশই জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য। গত মাসে আইএমএফ'র একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছিলো এবং সে সময় সরকারকে এ ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছিলো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যত সরকার এসেছে তারা সবাই জ্বালানীতে ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এই মাত্র ছয় মাস তারা কিছুটা সাবসিডি বা ভর্তুকি দিয়েছে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে। ৭ বছরের লাভ তারা লুট করে ফেলেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি জানিয়েছে ছয়মাসে জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।

বিশ্ব বাজারে তেলের দাম নজিরবিহীন কমে আসায় ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করেই সংস্থাটি মুনাফা করেছিলো প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এটা তাদের হিসাব। কিন্তু এখানে ব্যাপক গড়বড় রয়েছে। এত কম হওয়ার কথা নয়। জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন ডিজেলের দাম ১১৪ টাকা নির্ধারণের পরও নাকি তাদের সাবসিডি দিতে হচ্ছে। এটা ডাহা মিথ্যা কথা।

সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানী নিয়ে বার বার মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসে হাসিনাও মিথ্যা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। এমনকি IMF-এর ঋণ নিয়েও মিথ্যা তথ্য দিয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন তাদের নাকি ঋণের দরকার নেই। আবার এখন ঋণের জন্য জ্বালানী তেলের মূল্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হলো।

গত সপ্তাহের বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৮৮ ডলার। বাংলাদেশের ডলার রেট ৯৫ টাকা। এই হিসেবে অপরিশোধিত তেলের ক্রয়মূল্য ৫২ টাকা লিটার প্রতি। এটাকে পরিশোধন করতে ২ টাকা যুক্ত হয় লিটার প্রতি। বাকী, এলসি, পরিবহন, ভ্যাট-ট্যাক্স ইত্যাদি মিলে সর্বোচ্চ ৮ টাকা যুক্ত হতে পারে লিটার প্রতি। ডিজেলের মূল্য সর্বোচ্চ হতে পারে ৬২-৬৫ টাকা। ভর্তুকি বন্ধ করলেও ৭০ টাকায় ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেল পাওয়ার কথা। এটা বর্তমান রেট। কিন্তু গত ৭ বছরে ব্যারেল প্রতি দাম ছিল মাত্র ২২-২৭ ডলার এবং ডলার রেট ছিল ৮৫ টাকা প্রায়। তাহলে অনুমান করুন জ্বালানী তেলে কী পরিমাণ হরিলুট করেছে সরকার।

সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে দুইটা বিষয়কে টার্গেট করে। প্রথমত IMF থেকে ঋণ বাগিয়ে নেওয়া, দ্বিতীয়ত জ্বালানী তেল থেকে মুনাফা করে তাদের লুট জনিত ঘাটতি কিছুটা ব্যাকআপ দেওয়া। সরকারের লুটের দায় জনগণকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।

৬ আগ, ২০২২

মদিনায় লুট, খুন ও ধর্ষণের মর্মান্তিক ঘটনা!

 

মক্কা ও মদিনাবাসী শুরু থেকেই ইয়াজিদের প্রতি অনুগত ছিল না। বিভিন্ন চাপে পড়ে তারা আনুগত্যের বাইয়াত গ্রহণ করে। কিন্তু যখন হুসাইন রা.-কে ইয়াজিদের বাহিনী খুন করে তখন মদিনাবাসী ক্ষিপ্ত হয় এবং ইয়াজিদের প্রতি বাইয়াত প্রত্যাহার করে। তারা আব্দুল্লাহ ইবন হানযালাকে নেতা নির্বাচন করল। তারা সকলে মসজিদে নববীর মিম্বরের কাছে জমায়েত হল।

তখন তাদের মধ্যে হতে একজন বলতে লাগলেন, আমি এ পাগড়ীকে প্রত্যাহার করলাম এ বলে সে মাথা থেকে পাগড়ীটি ফেলে দিল। অন্য একজন বলল, আমি ইয়াযীদকে প্রত্যাহার করলাম যেমন আমি আমার এ জুতা প্রত্যাহার করলাম,। এ বলে সে তার জুতা ছুঁড়ে মারলো। এভাবে একজনের পর একজন বলতে লাগল ও এরূপ করতে লাগল। ফলে সেখানে অনেক পাগড়ী ও জুতার স্তুপ হয়ে গেল। তারপর তারা তাদের মধ্যে থেকে ইয়াজিদের গভর্নরকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে একমত হল। তিনি হলেন উসমান ইবন মুহাম্মদ ইবন আবু সুফিয়ান, ইয়াযীদের চাচাতো ভাই। বনূ উমাইয়ার সদস্যদেরকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করার ব্যাপারেও তারা একমত হলো।

অবস্থা বেগতিক দেখে বনু উমাইয়ার লোকেরা মারওয়ান ইবন হাকাম-এর ঘরে একত্রিত হলো। আর মদীনাবাসীরা তাদেরকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে রাখল। কিন্তু কিশোর আলী ইবনুল হুসাইন ওরফে জয়নুল আবেদীন এবং নবী পরিবারের নারী সদস্যরা এই আয়োজনের সাথে ছিলেন না। তারা নিজ ঘরে নিশ্চুপ ছিলেন।

মদিনার লোকদের আনুগত্য অস্বীকারের খবর ও বনু উমাইয়ার সদস্যদের অবরুদ্ধ হওয়ার খবর ইয়াজিদের কাছে পৌঁছলো। তিনি মুসলিম ইবনে উকবাকে সেনাপতি বানিয়ে বললেন, “মদিনার সম্প্রদায়কে তুমি তিনবার আহবান করবে, যদি তারা বশ্যতা স্বীকার করে তাহলে তুমি তাদের থেকে আনুগত্য গ্রহণ করবে এবং তাদের থেকে বিরত থাকবে, অন্যথায় তুমি আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করবে। যদি তুমি তাদের উপর বিজয় লাভ করো তবে মদিনায় তিনদিন হালাল ঘোষণা করবে (যা ইচ্ছা তা করবে, হারাম কাজও হালাল বলে গণ্য হবে)। তারপর বিরত হবে। আলী ইবন হুসাইনের প্রতি নযর রাখবে, তার থেকে বিরত থাকবে এবং তার কল্যাণ কামনা করবে, তাকে মজলিসে ডেকে নিবে। মদীনার কাজ সমাপ্ত করে মক্কা অবরোধ করবে।

ইতপূর্বে ইয়াজিদ উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে আদেশ দিয়েছিলেন, সে যেন আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা.-কে মক্কায় অবরোধ করার জন্য সেখানে গমন করে। কিন্তু উবাইদুল্লাহ ইবন যিয়াদ তার আদেশ অমান্য করে এবং বলে আল্লাহর শপথ! আমি ইয়াজিদের ন্যয় এরূপ ফাসিক লোকের জন্য দুইটি মারাত্মক কাজ একত্রে করতে পারবো না। একটি হল রাসূল সা. এর নাতিকে হত্যা করা এবং দ্বিতীয়টি হল মহাসম্মনিত বাইতুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। তার মা মারজানা তাকে ইমাম হুসাইন রা.-এর শাহাদাতের সময় বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য তোর! অভিশপ্ত তুই! তুই কী করেছিস! তুই কীসের দায়িত্ব নিয়েছিস? হুসাইন রা.-এর শাহদাতের পর তার আত্মীয়রা তাকে তিরস্কার করলে সে কিছুটা হীনমন্যতায় পড়ে যায়।

মুসলিম ইবনে উকবা তার সেনাবাহিনী নিয়ে মদীনার দিকে রওয়ানা হলো, সেনাবাহিনী যখন মদীনার নিকটবর্তী হলো, মদীনাবাসীরা বনু উমাইয়ার সদস্যদের অবরোধে কঠোরতা অবলম্বন করতে লাগল এবং বলতে লাগল, আল্লাহর শপথ! আমরা তোমাদের সকলকে এখনই হত্যা করবো। যদি তোমরা আমাদেরকে এমন একটি চুক্তিনামা লিখে দাও যে, তোমরা সিরিয়ার সৈন্যদেরকে আমাদেরকে চিনিয়ে দেবে না, আমাদের সাথে যুদ্ধে তাদের সহায়তা করবে না এবং আমাদের প্রতি তাদেরকে উসকানিও দিবে না। তখন বনূ উমাইয়ার লোকেরা তাদেরকে এ ব্যাপারে একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করলো।

যখন ইয়াজিদ বাহিনী মদিনায় পৌঁছল তখন বন্ উমাইয়ার লোকেরা তাদের সাথে সাক্ষাত করলো। সেনাপতি তাদের খবরাখবর সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করলো, তখন তাদের কেউ তাকে কোন সংবাদ দিল না। আবদুল মালিক ইবন মারওয়ান সেনাপতির কাছে আসলো এবং বললো, যদি আপনি তাদের উপর জয়ী হতে চান তাহলে আপনি মদিনার পূর্বদিকে হাররায় সেনাবাহিনী নিয়ে অবস্থান নিন। যখন শত্রুরা আপনার দিকে আসবে তখন সূর্যের তাপ থাকবে তাদের চোখে মুখে। এমন সময় আপনি তাদেরকে আপনার বাধ্যতা স্বীকার করতে আহবান জানাবেন। যদি তারা আপনার আহবানে সাড়া দেয় তাহলে ভাল কথা, অন্যথায় তাদেরকে হত্যা শুরু করবেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করবেন। কেননা তারা দেশের ইমাম তথা খলীফার বিরুদ্ধাচরণ করছে এবং তার অবাধ্য হয়েছে।

এ পরামর্শ দেওয়ার জন্য মুসলিম ইবন উকবা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং তিনি যেদিকে ইঙ্গিত করলেন তা তিনি পরোপুরি পালন করলেন। তিনি পূর্ব মদীনার হাররায় অবতরণ করেন এবং মদীনাবাসীদেরকে তিনদিনের অবকাশ দিলেন। মদিনাবাসী তাদেরকে অন্যায়ের পথ ছেড়ে ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানালেন। তারা অবৈধ শাসকের আনুগত্যের বিপরীতে শাহদাতকে আপন করে নেয়ার শপথ নিলেন। প্রতিদিন তারা বশ্যতা স্বীকার না করে যুদ্ধ ও মুকাবিলার কথা পুনরাবৃত্তি করলেন।

যখন তিনদিন শেষ হয়ে গেল তখন সেনাপতি তাদরকে চতুর্থ দিন অর্থাৎ ৬৩ হিজরীর জুলহাজ্জ মাসের ২৮ তারিখ বুধবার দিন বললো, হে মদীনাবাসীগণ! তিনদিন অতিবাহিত হলো, আমীরুল মু'মিনীন আমাকে বলেছিলেন যে, তোমরা তার আত্মীয়স্বজন। তাই তিনি তোমাদের রক্তপাতকে খারাপ মনে করেন। তিনি আমাকে হুকুম দিয়েছেন আমি যেন তোমাদেরকে তিন দিনের সময় দেই। তিনদিন শেষ হয়ে গেল। এখন তোমরা কি করবে? তোমরা কি আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে, না সন্ধি করবে? তারা বললেন, যুদ্ধ করবো।

মুসলিম আবার বললো, যুদ্ধ করো না বরং সন্ধি করো তাহলে আমরা ঐ বিদ্রোহী ব্যক্তিকে (আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর রা.) দমন করার জন্য সর্বশক্তি ও প্রচেষ্টা প্রয়োগ করতে পারব। তারা বললেন, “হে আল্লাহর দুশমন! তোমার যদি এটাই ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলে আমরা কখনোই তোমার সহযোগী হবো না। আমরা কি তোমাদেরকে ছেড়ে দিব যে, তোমরা বাইতুল্লাহ গিয়ে যথেচ্ছা আচরণ করবে? তারপর তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিল।

মদিনাবাসী বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিখা খনন করে নিলেন। তারা নিজেদের সৈন্যদেরকে চার ভাগে ভাগ করে নেয় এবং প্রতিটি ভাগের জন্য একজন আমীর নিয়োগ করে। সবচাইতে সুবিন্যস্থ ভাগের আমীর হলেন আবদুল্লাহ ইবন হানযালা। তারপর তারা প্রচণ্ড যুদ্ধ করলেন। যুদ্ধে মদীনাবাসীরা পরাজয়বরণ করলেন। দু'পক্ষ থেকেই বহু সর্দার ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ নিহত হলেন। এই ঘটনাকে ইতিহাসে 'আল হাররা'র যুদ্ধ' হিসেবে অভিহিত করা হয়।

তারপর এক জঘন্য ঘটনার অবতারণা হলো মদিনায়। মুসলিম ইবন উকবা তার নেতা ইয়াজিদের নির্দেশমতে মদিনায় তিন দিন যাবত লুটতরাজ করার নির্দেশ দিলো। সে এ তিন দিনে মদীনার বহু সাহাবি, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও ন্যায়নিষ্ঠ লোকদের পাইকারিভাবে হত্যা করতে শুরু করলো। মদিনায় জঘন্যতম লুট, ধর্ষণ, নির্যাতন ও উৎপীড়নের অজস্র ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে হতে সাতশত জন গণ্যমান্য ব্যক্তি, তাদের দাস-দাসী এবং অপরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে দশ হাজার নিহত হয়েছিল। বহু সম্মানিত মুসলিম নারী ধর্ষিত হয়েছেন ইয়াজিদের বাহিনীর দ্বারা।

জালিম ইয়াজিদ তিনদিনের জন্য মদিনাকে লুটপাটের লক্ষ্যে মুসলিম ইবন উকবাকে নির্দেশনা দিয়ে জঘন্য অপরাধ করেছে। যার দরুন সাহাবায়ে কিরামের একটি বিরাট দল ও তাদের সন্তানগণ নিহত হন। বহু সম্মানিত নারী ধর্ষিত হয়েছেন। সা'দ ইবন আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বলতে শুনেছি, “যদি কেউ মদীনাবাসীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে তাহলে লবন যেভাবে পানিতে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় সেও এভাবে গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।” ইমাম মুসলিমও আবু আবদুল্লাহ সা'দ ইব্ন আবু ওয়াক্কাস রা. হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যদি কোন ব্যক্তি মদীনাবাসীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে আল্লাহ্ তা'আলা তাকে জাহান্নামে এমনভাবে গলাবেন যেমন সীসা আগুনে গলে যায় কিংবা লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়।”

কিছু অর্বাচীন ও জ্ঞানপাপীকে দেখা যায় নানানভাবে ইয়াজিদকে শাসক এমনকি আমিরুল মুমেনিন হিসেবে আখ্যায়িত করতে। যে পাইকারীভাবে খুন ও ধর্ষণ করার নির্দেশ দেয় সে মুসলিমদের নেতা হওয়া তো দূরের কথা তাকে মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করাও তো কঠিন। তার আক্রমনের পর মদিনার সমস্ত সাহাবী হয় খুন হয় নাহয় জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সাহাবাদের সাথে যার এই আচরণ সে জালিম ও ফাসিক, এটাই তার পরিচয়। আল্লাহ তায়ালা তার যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুন। আমিন।

বি. দ্র. ঘটনার বর্ণনা আল্লামা ইবনে কাসীরের বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ 'আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া'-এর ৮ম খন্ড (৪০০-৪১৫) থেকে নেওয়া হয়েছে।

হিন্দু জনসংখ্যা কমার আসল কারণ কী?

 

বাংলাদেশে আদমশুমারি হয়ে গেল। যদিও অনেক বিষয় নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। টোটাল সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিকলনা মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন আদমশুমারি কিছুটা সমস্যা থাকতে পারে। এই বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। আজকে আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে। আর সেটা হলো বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

এই নিয়ে প্রায় সব মিডিয়া অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছে। কেউ কেউ ইতিহাস টেনে নিয়ে অনেক বিশ্লেষণী রিপোর্ট করেছে। এসব বিষয় এতটা গুরুত্ব না পেলেও বুয়েটের শিক্ষক এনায়েত চৌধুরীর গত বুধবারের ভিডিও বরাবরের মতোই ভাইরাল হয়। তিনি হিন্দু কমে যাচ্ছে এই নিয়ে ভিডিও তৈরি করেছেন।

তিনি তার বিশ্লেষনে কয়েকটি বিষয়কে ফাইন্ড আউট করেছেন যার দ্বারা হিন্দু সংখ্যা কমে যাচ্ছে বাংলাদেশে।
১। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে মাইগ্রেশন (মুসলিমরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করছে)
২। এনিমি সম্পত্তি দখলের ফলে মাইগ্রেশন (আবুল বারাকাতের মতে হিন্দুদের জমি দখল করার কারণে এটা হয়)
৩। ফার্টিলিটি রেইট (এই সমস্যার কথা উল্লেখ করে ছেড়ে দিয়েছেন। এনায়েত এই কারণকে গুরুত্ব দেননি)

এনায়েত চৌধুরীর ভাষ্যমতে বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার বেসিক কারণ হলো ভারতে মাইগ্রেশন। কিন্তু আসলে কি তা হয়?

এদেশে হিন্দুদের অবস্থা, জীবন যাপন প্র্যাকটিসিং মুসলিমদের চাইতে অনেক ভালো। হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৮% শতাংশ হলেও সরকারি চাকুরিতে হিন্দুদের পরিমাণ প্রায় ২২%। এখান থেকে সাধারণত হিন্দুরা যায় না। যারা মাইগ্রেশন করে তারা মূলত এখানে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছে এবং যাদের কালো টাকা আছে তারা ভারতে সেগুলো পাচার করে ও এক পর্যায়ে নিজেদের মাইগ্রেশন করে। এই সংখ্যাটা নিতান্তই কম। এটা ধর্তব্য নয়।

ধরে নিলাম এনায়েতের বিশ্লেষণ ঠিক। পাকিস্তানেও হিন্দু সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বৌদ্ধপ্রধান শ্রীলংকায়ও হিন্দুদের পার্সেন্টেজ কমে যাচ্ছে। এনায়েতের হিসাবকে সত্য হিসেবে ধরে নিলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে দলে দলে মানুষ ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে। এদিকে ভারতের হিন্দুদের তো মাইগ্রেশনের ঝামেলা নেই।

এনায়েত ও বারাকাতের হিসেবে ভারতে হিন্দুদের পার্সেন্টেজ লাফিয়ে বাড়ার কথা। কিন্তু আসলে কী হচ্ছে সেখানে? ভারত থেকে দাঙ্গা কিংবা এনিমি সম্পত্তি দখলের কারণে মাইগ্রেশন নেই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার হিন্দুরা সেখানে যাচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে নেপাল থেকেও কেউ কেউ ভারতে মাইগ্রেশন হচ্ছে।

এত হিন্দু চারদিক থেকে ভারতে এলেও ভারতে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমি যে ছবিটি শেয়ার করেছি সেটা ভারতের ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার তুলনামূলক চিত্র। এটি দ্য হিন্দু পত্রিকা থেকে নিয়েছি। এখানে দেখা যাচ্ছে ভারতে ১৯৫১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮৪%। ২০১১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯%এ। ভারতের বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে ৫% কমে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার!

এনায়েত ও বারাকাতেরা মাইগ্রেশনে যে চিত্র দেখিয়েছে তা যদি সঠিক হতো তবে কি ভারতে হিন্দুদের জনসংখ্যা কমে যেত? অন্যদিকে খেয়াল করুন ভারতে মুসলিমদের পার্সেন্টেজ বেড়ে গেছে। ১৯৫১ সালে তা মুসলিমরা ছিল ৯.৮%। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৪.২%। প্রায় সাড়ে ৪% বেড়ে গেছে।

ভারতে মুসলিমদের সুযোগ সুবিধা কয়েকটি স্থানে কিছুটা ভালো। বাকী পুরো ভারতে মুসলিমদের যুদ্ধ করে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। ভারত থেকে কিছু মুসলিম মাইগ্রেশন হয় মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপে। কিন্তু তারপরও সেখানে মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়ছে ও হিন্দুদের জনসংখ্যা কমছে।

একপাক্ষিক ও পূর্ব ধারণা মাথায় রেখে বিশ্লেষণ করার কারণে এনায়েত চৌধুরির বিশ্লেষণের মৌলিক ত্রুটি দেখা গেছে। যদি মাইগ্রেশনই মূল সমস্যা হতো তবে ভারতে হিন্দু সংখ্যা বেড়ে যেত।

হিন্দুরা জনসংখ্যার দিক দিয়ে ১ম দেশ ভারতে, এরপর নেপালে এবং ৩য় দেশ বাংলাদেশ। অবাক করা ব্যাপার হলো এই তিন দেশেই জনসংখ্যা কমছে। ভারত ও নেপালে মাইগ্রেশন সমস্যা নেই। তবুও কেন কমছে?

এর বেসিক কারণ হলো ফার্টিলিটি রেট। যে বিষয়টা এনায়েত উল্লেখ করেও গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে গেছে। অথচ এটাই হচ্ছে বেসিক কারণ।

হিন্দুদের ফার্টিলিটি রেট বা জন্মহার কমে যাওয়ার কারণ দুইটি
১। জন্মনিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় প্রভাব নেই
২। তাদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

ফার্টিলিটি রেট জলবায়ু ও অঞ্চলের ওপর বেশি নির্ভর করে। আমাদের অঞ্চলের চাইতে আফ্রিকায় ফার্টিলিটি রেট বেশি। একই এলাকার দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে এর পার্থক্য হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু দুই কারণে পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে।

আমাদের উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা প্ররোচনায় প্রচার করা হচ্ছে জনসংখ্যাই আমাদের সমস্যা। এজন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই প্রচারণার সাথে একমত হয় নি মুসলিমরা। কিন্তু হিন্দুদের তাতে সমস্যা ছিল না। মুসলিম সমাজের মসজিদে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে হামেশাই বক্তব্য দেওয়া হয়। উপমহাদেশের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মওদূদী এই নিয়ে বই লিখেছেন 'ইসলামের দৃষ্টিতে জন্মনিয়ন্ত্রণ'।

এই বইটি উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে ও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রজেক্টটা বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে অল্প কয়েকদিন হচ্ছে জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু হিন্দু সমাজে এটা গোড়া থেকেই জনপ্রিয় ছিল। তারা পশ্চিমা প্রচারণায় কান দিয়েছে। তাই তাদের জন্মহার কমে গিয়েছে।

আরেকটি বিষয় হলো তাদের খাদ্যাভ্যাস। এই উপমহাদেশের হিন্দুরা লাল গোশত খুবই কম খায়। গরু ছাগলের গোশত কম খাওয়ায় তাদের ফার্টিলিটি রেট কমে যাচ্ছে। গরু ছাগলের গোশতে (রেড মিট) প্রচুর জিংক থাকে। যা সন্তান জন্মদান ও গর্ভধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু ছেলে-মেয়েরা দীর্ঘসময় ধরে গোশত না খাওয়ায় ফার্টিলিটি রেট কমে যাচ্ছে।

তাই শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব স্থানে, সব দেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকায় হিন্দু সংখ্যা কমছে। এই বিষয় নিয়ে ভারতের লোকেরাও গবেষণা করেছে। তারা এই ফার্টিলিটি রেটকেই ফাইন্ড আউট করেছে কারণ হিসেবে।