২৬ আগ, ২০২২

বাংলায় জামায়াতের প্রচার যেভাবে হয়!



১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ৭৫ জন নিয়ে জামায়াত যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন একজনমাত্র বাঙালি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর নাম মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। তিনি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার পটুয়াখালী শহরের বাসিন্দা ছিলেন। মাওলানা ৭৫ জনের মধ্যে ১৬ জনকে নিয়ে মজলিসে শুরা গঠন করেছিলেন সেই মজলিশে শুরাতেও ছিলেন মাওলানা আতাউল্লাহ বুখারী। সেই হিসেবে ১ম বাঙালি রুকন ও ১ম বাঙালি শুরা সদস্য ছিলেন তিনি। তবে তিনি দুই বছরের মধ্যে জামায়াত ত্যাগ করেন।

১৯৪৬ সালে জামায়াতের সম্মেলনে যোগ দেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি কলকাতা থেকে সেখানে গিয়েছেন। তখন তার বয়স ২৮ বছর। তিনি মাওলানার সাথে দেখা করেন ও রুকন শপথ নেন। সেই হিসেবে ২য় বাঙালি রুকন হলেন মাওলানা আব্দুর রহীম। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে নিজ গ্রামে অর্থাৎ পিরোজপুর জেলার কাউখালী থানার শিয়ালকাঠি গ্রামে দাওয়াতী কাজ করেন। সেখানে তিনি ১০-১২ জন যুবককে ইকামাতে দ্বীনের কাজের জন্য রাজি করান। এদেরকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলার ১ম ইউনিট। ইউনিট সভাপতি ছিলেন মাওলানা লেহাজ উদ্দিন।

মাওলানা আব্দুর রহীম নাজিরপুরে একটি মাদ্রাসার হেড মাওলানা পদে চাকুরি শুরু করেন। এই মাদ্রাসাতেও আরেকটি ইউনিট তিনি গঠন করেন। এখানে স্থানীয় অতুল চন্দ্র ও ভবানীসেন নামে দুই বাম কমরেডের সাথে প্রায়ই মাওলানা আব্দুর রহীমের বিতর্ক হতো। সেই সূত্রে তিনি ইসলাম, কমিউনিজম ও অর্থনীতি নিয়ে 'ইসলামে অর্থনীতি' নামে একটি বই লিখে ফেলেন।

১৯৪৮ সালেও ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়নি। ততক্ষণে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে। ইংরেজমুক্ত হয়েছে উপমহাদেশ। ঢাকায় কাজ নিয়ে কেন্দ্র বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, কিন্তু সেভাবে সফল হওয়া যায়নি। ১৯৪৮ সালে খুরশিদ আহমদ বাট নামে একজন সরকারি কর্মকর্তা করাচি থেকে ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছিলেন। তিনি রুকন ছিলেন। তিনি খুব করে চেয়েছিলেন যাতে ঢাকায় কাজ শুরু করা যায়। এজন্য তিনি কেন্দ্রকে জানিয়েছেন। কেন্দ্র তাকে মাওলানা আব্দুর রহীমের ঠিকানা দেন।

খুরশিদ আহমদ বাট ঢাকায় এসে চাকুরিতে জয়েন করেন। তিনি মাওলানা আব্দুর রহীমকে চিঠি লিখেন। চিঠিতে তিনি তাঁকে ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেন। জবাবে মাওলানা আব্দুর রহীম জানান, ঢাকায় শুধু থাকার একটি জায়গা দিতে পারলে তিনি নির্দ্বিধায় চলে আসবেন। খুরশিদ আহমদ বাট একটি প্রশস্ত রুম ভাড়া করেন আব্দুর রহীম সাহেবের জন্য। এপ্রিলেই আব্দুর রহীম সাহেব ঢাকায় চলে আসেন। তাঁরা দুইজন ঢাকার কাজ নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন।

১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতে মাওলানা মওদূদী রহ. ঢাকায় কাজ করার জন্য বাগ্মী ও বিখ্যাত দায়ি রফি আহমদ ইন্দোরিকে ঢাকায় প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে আলিয়া মাদ্রাসা কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। সেখানের একজন শিক্ষক ছিলেন মাওলানা কারি জলিল আশরাফ নদভী। রফি আহমদ ইন্দোরীর নেতৃত্বে ঢাকায় এখন রুকন চারজন।
১. রফি আহমদ ইন্দোরি
২. কারি জলিল আশরাফ নদভী
৩. খুরশিদ আহমদ বাট
৪. মাওলানা আব্দুর রহীম

এর মধ্যে শুধু আব্দুর রহীম ছাড়া বাকিরা ছিল অবাঙালী। তবে আব্দুর রহীম ছাড়া বাকিরা ছিল সাংগঠনিক কাছে বেশ পারদর্শী। তাই তারা ঢাকায় কাজ শুরু করেন ঢাকায় থাকা মুহাজিরদের মধ্যে। লালবাগ, নবাবপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে মুহাজিরদের মধ্যে জামায়াতের কাজ দ্রুত সম্প্রসারণ হতে থাকে।

এরমধ্যে মাওলানা আব্দুর রহীম দাওয়াতী কাজে ভীষণ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। তাকে সামনে রেখেই রফি আহমদ ইন্দোরি ঢাকাকে জামায়াতের শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে পিতার অসুস্থতার কারণে আব্দুর রহীম সাহেবকে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে হয়। তাকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয় এবং জীবিকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হন। মাওলানা মওদূদী তাঁকে অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং উর্দু ভাষায় রচিত সাহিত্যগুলো বাংলায় অনুবাদ করার কাজ দেন। এভাবে তার জীবিকার ব্যবস্থা হয়। তিনি পূর্ণ মনোযোগের সাথে ঢাকার সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য কাজ করতে থাকেন।

অবশেষে কাজের বিস্তৃতি মোটামুটি হলে মাওলানা মনজুর আহমেদ জামেয়ীর নেতৃত্বে ঢাকা শহরের ইমারত গঠিত হয়। তিনি হন ঢাকার প্রথম আমীর। ঢাকায় জামায়াতের কাজ প্রতিষ্ঠায় যাদের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে পূর্বে বর্ণিত চার জন, মনজুর আহমেদ জামেয়ী ছাড়াও আরো রয়েছেন,

১. সাইয়্যেদ হাফিজুর রহমান, হেড মাস্টার, রহমতুল্লাহ মডেল হাই স্কুল
২. খাজা মাহবুব এলাহী, প্রথম সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৩. মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আলী, সভাপতি, জমিয়তে তলাবা, পূর্ব পাকিস্তান
৪. মাওলানা আব্দুস সুবহান, সাবেক এমপি, পাবনা।
৫. ব্যারিস্টার কোরবান আলী।

এছাড়া আরো একজনের কথা আলাদাভাবে বলতে তিনি হলেন শেখ আমিনুদ্দিন ভাই। ঢাকায় জামায়াতের কাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না এই খবর পৌঁছে গেছে বিহারের ছোট নাগপুরের রুকন শেখ আমিনুদ্দিনের কাছে। ১৯৪৭ সালে বিহার থেকে হিজরত করে পশ্চিম পাকিস্তানে গেছেন। কিন্তু তার মন পড়ে আছে বাংলায়। কারণ ঢাকায় জামায়াতের কাজ করার লোক তৈরি হচ্ছে না। 

শেখ আমিনুদ্দিন দাওয়াতী কাজ করার জন্য ঢাকায় চলে এলেন। তিনি দাওয়াতী কাজ করতে পছন্দ করেন। ঢাকার অলি গলিতে হাঁটেন আর পুরান ঢাকার মানুষের সাথে উর্দুতে কথা বলেন, পরিচিত হন। এভাবে নবাবপুরে তিনি বেশ পরিচিতি লাভ করেন। 

তিনি খেয়াল করেছেন, ঢাকার মানুষ পান খেয়ে গল্প করতে পছন্দ করেন। তিনি পান দোকান দিয়ে বসলেন মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য। একটি দুটি নয় ঢাকায় নবাবপুর, মোহাম্মদ পুর, বংশাল ও মিরপুরে পানের দোকান দিয়ে মানুষকে পান খাওয়াতেন। ঢাকার মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করে তিনি ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন। 

ঢাকায় যখন মোটামুটি সংগঠন কায়েম হয়ে গেল, অনেকজন দায়ি তৈরি হয়ে গেল তখন একদিন তিনি আমীরের অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন বগুড়ায়। শুরু করলেন সেখানে দাওয়াত দেওয়া। বগুড়ায়ও তিনি পান দোকান দিয়ে সংগঠনের দাওয়াত দিতে থাকলেন! 

বাংলায় জামায়াতে ইসলামীর পথচলার একেবারে শুরুতে যারা দাওয়াতী কাজে জীবন উতসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে একজন বিহারের শেখ আমিনুদ্দিন ভাই। দ্বীন কায়েমকে তিনি সত্যিকারভাবেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন।

কত মহামানুষের অপরিসীম ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ইসলামী আন্দোলন! এই তালিকা শেষ হবার নয়। শেখ আমিনুদ্দিন ভাইয়ের গল্প যেদিন প্রথম শুনছিলাম, তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছিল। 

এই অঞ্চলের বাঙালিদের ইসলামী আন্দোলন বুঝাতে আমিনুদ্দিন ভাইয়ের যত পেরেশানী, এই অঞ্চলের মানুষের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা তার এক ছটাক যদি আমাদের থাকতো! হায়! 

আমরা যদি সত্যিই এই অঞ্চলের মানুষকে ভালোবেসে তাদেরকে জান্নাতের দাওয়াত দেওয়ার পেরেশানী নিয়ে কাজ করতাম তাহলে তো আমাদের চোখে ঘুম ধরার কথা ছিল না। কাজের নেশায় পাগল হয়ে যেতাম। হায়!

আজ ২৬ আগস্ট জামায়াতের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সকল কাজপাগল মুজাহিদদের প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। যাদের রক্তঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সংগঠন, যাদের কাজের বদৌলতে আমরা ইকামাতে দ্বীনের দাওয়াত পেয়েছি, তাঁদের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে সম্মান ভিক্ষা চাইছি।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন