১৮ আগ, ২০২২

ইসলামী ব্যাংকিং



জনাব আব্দুর রকিব। পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন। এরপরের বছর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে তিনি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের বাংলাদেশ শাখার প্রধান হন। ১৯৭১ এর পর বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির প্রধান হন।

সত্তরের দশকের শেষ দিকে সারা পৃথিবীতে ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে যখন ব্যাপক আলোচনা ও এর আলোকে ব্যাংক চালু হওয়া শুরু হলো তখন তিনি ইসলামী ব্যাংকিং-এর সাথে জড়িত হন। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ প্রেসিডেন্ট হন। যারা ইসলামী ব্যাংক নিয়ে কাজ করেছে, পলিসি তৈরি করেছে এমন বহু মানুষের মধ্যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একজন।

জনাব শেখ মুহাম্মদ। পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞানে। ১৯৮৪ সালে কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৮৬ সালে সরকারি চাকুরি ছেড়ে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকে যোগ দেন। ইসলামী ব্যাংকে এসেছেন শুধুমাত্র ইসলামকে ভালোবেসে। এদেশে একটি সুদমুক্ত ব্যাংক চালু করে জাতিকে বিকল্প দেওয়ার জন্য। ইসলামী ব্যাংকের যেমন ভবিষ্যত সম্পর্কে কারো কোনো আইডিয়া ছিল না তেমনি এখানে তার সম্মানীও কমে গেছে। তিনি ইসলামী ব্যাংকের একজন গবেষক ছিলেন। সারা পৃথিবীর অন্যান্য ইসলামী ব্যাংক থেকে আইডিয়া ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ও বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যাংকিং পদ্ধতি নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন।

এই দুইজন ব্যক্তি ২০০৪ সালে একটি বই লিখেন 'ইসলামী ব্যাংকিং' নামে। এখানে তারা ইসলামী ব্যাংকের থিওরি, প্রয়োগ ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। বইটিতে মোট ১৪ টি অধ্যায় রয়েছে। তারা ইসলামী ব্যাংকিং-এর সকল আলোচনা এই বইতে সন্নিবেশ করেছেন।

১ম অধ্যায়ে তারা ব্যাংক ও অর্থ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্যাংকের সংজ্ঞা, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, কমিউনিজম, ইসলামী অর্থব্যবস্থা এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।

২য় অধ্যায়ে সুদ ও সুদের প্রকার নিয়ে আলোচনা করেছেন।

৩য় অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের উতপত্তি, বাংলাদেশে এর পটভূমি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর ইসলামী ব্যাংক ও সুদি ব্যাংকের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তারা ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেন।

৪র্থ অধ্যায়ে লেখকদ্বয় মূলত ইসলামী ব্যাংকের টাকা সংগ্রহ/ আমানত/ জমা গ্রহণ নিয়ে আলোচনা করেন। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের দুইটা পদ্ধতি আছে। আল ওয়াদিয়াহ ও মুদারাবা। এই দুইটি পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এই অধ্যায়ে। কীভাবে এর মুনাফা বন্টন হয় তা নিয়েও আলোচনা হয়।

৫ম অধ্যায়ে চেক সংক্রান্ত আলোচনা করেন তারা। চেকের প্রকারভেদ, হস্তান্তর, অনুমোদন, অনুমোদনের শর্তাবলী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়।

৬ষ্ঠ অধ্যায়টি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিনিয়োগের পদ্ধতিগুলোকে তারা তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন।

ক. ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি
১. বাই মুরাবাহা
২. বাই মুয়াজ্জাল
৩. বাই সালাম
৪. ইসতিসনা

খ. অংশিদারিত্ব পদ্ধতি
১. মুদারাবা
২. মুশারাকা

গ. মালিকানায় অংশীদারিত্ব

এই অধ্যায়ে লেখকদ্বয় প্রতিটি পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং এক পদ্ধতির সাথে অপর পদ্ধতির পার্থক্য সূচিত করেন। যাতে সাধারণ পাঠক বুঝতে সক্ষম হয়। এখানে তারা আরেকটি দারুণ কাজ করেছেন তা হলো প্রতিটি পদ্ধতির ক্ষেত্রে তারা সম্ভাব্য অনিয়ম ও ত্রুটির কথাও উল্লেখ করেছেন। এজন্য একটা কথা বলা হয়ে থাকে 'ইসলামী ব্যাংকের জন্য পূর্বশর্ত ইসলামী ব্যক্তিত্ব'। কাজী ওমর ফারুক ২০০৬ সালে এই নামেই একটি বই লিখেছেন।

ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের সমাধান এখানে তারা দিয়েছেন। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের মুনাফার হার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সুদের হারের সাথে মিলে যায়। তাহলে ইসলামী ব্যাংকের এই আয় কি সুদ? এই প্রশ্নের সমাধান দেওয়া আছে এই অধ্যায়ে। এরপর সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করেছেন লেখকদ্বয়।

এরপর তারা কীভাবে একজন ব্যবসায়ীর সাথে বিনিয়োগে যাবে সেই পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। কীভাবে রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট করেন তা নিয়ে আলোচনা করেন। শুধু তাই নয়, ইসলামী ব্যাংক যেখানে বিনিয়োগ করে সেই ব্যাবসার তদারকি ও মুনাফা আদায়ের পদ্ধতিও তারা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। এরপরও যদি ক্ষতি হয় তবে সেই ক্ষতিপূরণের পদ্ধতি নিয়েও আলোচনা হয়।

৭ম অধ্যায়ে চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়। ব্যবসায়ে লিখিত চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিনিয়োগ গ্রাহকদের সাথে চুক্তি কীভাবে করতে হবে ও মানতে হবে সে পদ্ধতি উল্লেখ করেন।

৮ম অধ্যায়ে বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করেন তারা। এই অধ্যায়ে ঋণপত্র, শরিয়ার আলোকে ঋণপত্র, মুদ্রা বিনিময়, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে এবং এসবের শরিয়াহ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়।

৯ম অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কিছু বিশেষ বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই অধ্যায় থেকে ১৪শ অধ্যায় পর্যন্ত মূলত ইসলামী ব্যাংকের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।

১০ম অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

১১শ অধ্যায়ে বিনিয়োগের শ্রেণীবিন্যাস ও প্রভিশনিং নিয়ে আলোচনা হয়।

১২শ অধ্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের মূলধন নিয়ে আলোচনা হয়।

১৩শ অধ্যায়ে ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে আলোচনা হয়।

১৪শ ও সর্বশেষ অধ্যায়ে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বলা হয়, জনগণের আস্থা অর্জন করে বিশাল আমানত সংগ্রহ করেছে ইসলামী ব্যাংকগুলো। সেই সাথে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ভালো ভূমিকা রেখেছে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ ও সবচেয়ে বেশি লাভও অর্জন করেছে তারা। এখনো সেই অবস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে লেখকদ্বয় যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন তা হলো,
১. ইসলামী ব্যাংক পরিচালনার আইন নেই।
২. সুদমুক্ত সিকিউরিটিজ/বন্ড-এর অভাব
৩. খেলাপি বিনিয়োগ। অন্যান্য ব্যাংকগুলো দন্ডসুদ আরোপ করে। এখানে যা সম্ভব নয়।
৪. ব্যাংক কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত ট্রেইনিং-এর অভাব
৫. শরীয়তের বিষয়ে দক্ষতার অভাব।

বইটি ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে আপনার ধারণাকে পরিপূর্ণ করবে এবং বাজারি কথাবার্তা থেকে আপনাকে মুক্ত করবে। একইসাথে আপনি এখান থেকে সুদ ও ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে বিস্তর ধারণা লাভ করতে পারবেন। যদি ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে ধারণা নিতে চান তবে এই বইটি আপনার জন্য পাঠ্য।

বইটির পিডিএফ লিংক দেওয়া হয়েছে।

#বুক_রিভিউ
বই : ইসলামী ব্যাংকিং
লেখক : আব্দুর রকীব ও শেখ মোহাম্মদ
প্রকাশনী : আল আমিন প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ২৭২
মুদ্রিত মূল্য : ২০০
জনরা : অর্থনীতি
 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন