২৫ সেপ, ২০২২

খিলাফত পর্ব-২৬ : উমার রা.-এর শাসনামলে সিরিয়া অভিযান

 

আবু বকর রা.-এর আমলে দুইটি ফ্রন্টে যুদ্ধ চলছিল মুসলিম বাহিনীর। এক সিরিয়া ফ্রন্টে দুই ইরাক ফ্রন্টে। আমরা আগের পর্বগুলোতে ইরাক ফ্রন্টের যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এখন আমরা সিরিয়া ফ্রন্টে যুদ্ধের ধারাবাহিক অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ। 

আবু বকর রা. যখন মৃত্যুশয্যায় তখন সিরিয়ায় ইয়ারমুকের ভয়াবহ যুদ্ধ চলছিল। এই অবস্থায় রাজধানী মদিনা থেকে চিঠি আসে খবর ও নির্দেশনাসহ। খবর ছিল, আবু বকর রা. ইন্তেকাল করেছেন। আর নতুন খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন উমার রা.। নির্দেশনা ছিল আবু উবাইদা রা.-এর প্রতি। তিনি এখন থেকে সিরিয়ায় অবস্থিত মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করবেন। 

ইয়ারমুকের যুদ্ধ চলাকালে এই খবর ও নির্দেশনা আবু উবাইদাহ রা.-এর কাছে পৌঁছলেও তিনি বিভিন্ন দিক বিবেচনায় তিনি এসব খবর ও নির্দেশনা গোপন রাখেন। আল্লাহর ইচ্ছায় ও সহায়তায় ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিজয় আসলে তিনি সবাইকে এসব বিষয়ে অবহিত করেন। 

খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. যখন জানতে পারলেন তাকে সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন তিনি আবু উবাইদাহর নিকট এসে বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। খলিফা আপনাকে পত্র মারফত নিয়োগ দিয়েছেন, কিন্তু আমাকে তা আপনি জানাননি। জবাবে আবু উবাইদাহ রা. বললেন, আমি আপনাকে জানাইনি কারণ আমি চেয়েছিলাম অন্য কেউ এটা জানাক। মুসলিম বাহিনীর ব্যাপারে যুদ্ধ চলাকালে কোনো পরিবর্তন হোক তা চাইনি। বরং আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করছি। 

খালিদ রা. বিনাবাক্যে কমান্ড থেকে সরে আসলেন এবং আবু উবাইদাহ রা.-এর আনুগত্য মেনে নিলেন। আবু উবাইদাহ রা. প্রতিটা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে খালিদ রা.-এর পরামর্শ নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে থাকেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর আবু উবাইদাহ রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী দামেশকের দিকে যাত্রা শুরু করে। আবু উবাইদাহর টার্গেট ছিল দামেশক অবরোধ করা। কিন্তু পথিমধ্যে খবর আসলো, রোমান সৈন্যরা হোমস থেকে বিশাল সৈন্য সাহায্য পেতে যাচ্ছে। একইসাথে ফিলিস্তিনেও রোমানরা বড় সৈন্য সমাবেশ করেছে। 

কোন বাহিনীকে আগে সামলাবেন তা তিনি নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন  সেনাপতি। উমার রা.-এর কাছে পত্র লিখে সিদ্ধান্ত চাইলেন আবু উবাইদাহ রা.। উমার রা. জানালেন, আপনি দামেশকের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখেন। হিমস থেকে রোমানরা সাহায্য পাওয়ার আগেই দামেশক বিজয়ের চেষ্টা করুন। একদল অশ্বারোহীকে পাঠিয়ে দিন ফিহলের উদ্দেশ্যে। যাতে তারা হিমসের বাহিনীকে আটকাতে পারে। আমাদের আশা অশ্বারোহীরা ফিহলে হিমসের বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। আর যদি আগেই দামেশক বিজয় হয় তবে দামেশকে কাউকে দায়িত্ব দিয়ে আপনি ও খালিদ উভয়ে হিমসের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। আমর ও শুরাহবিলকে জর্ডান ও ফিলিস্তিনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করুন।  

সাহাবী আম্মারা ইবনে মুখশী রা. নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনীকে আবু উবাইদাহ রা.ফিহলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তারা ফিহলে ৮০০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীকে দেখতে পান। মুসলিমরা ছিল উজানে আর রোমানরা ছিল ভাটির দিকে। মুসলিমরা খাল কেটে রোমানদের দিকে পানি প্রবাহিত করে দিল। রোমানদের মাঠ, তাঁবু, চুলা সব ভেসে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেল। মুসলিমরা আল্লাহর ইচ্ছায় ও সাহায্যে অল্প ক্লেশে যুদ্ধে বিজয় লাভ করলো। রোমানরা পিছিয়ে গেল হিমসের দিকে।   

মুসলিম বাহিনী দামেশক অবরোধ করলেন। রোমানরা শহরে প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করে রাখলো। কিছু স্থানে উঁচু দেওয়াল, কিছু স্থানে পরিখার মাধ্যমে তারা আত্মরক্ষা করলো। খালিদ রা. তাদের এই বাধা ভাঙ্গার জন্য নানান কৌশল করলেন। ছোট ছোট দলে বিভক্ত করলেন। ঝটিকা আক্রমণ করে পুরো দামেশকের প্রতিরক্ষা নিয়ে অবগত হলেন। দুর্বল প্রতিরক্ষার স্থানে আক্রমণ করতে করতে তিনি দামেশকের প্রতিরক্ষা ভেদ করে খন্ড যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থেকে যখন প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে গেল তখন তারা আর যুদ্ধ না করে সন্ধির প্রস্তাব দিল। মুসলিমরা জিজিয়ার বিনিময়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দামেশক অধিকার করলো। 

দামেশক বিজয় হয় ১৩ হিজরিতে। বিজয়ের পর আবু উবাইদাহ রা. খালিদ রা.-কে বিকা জয় করার জন্য পাঠান। তিনি সফলভাবে তা জয় করেন। আরেকটি বাহিনীকে পাঠান আইন মিসনুনে। লেবাননের রোমান বাহিনী তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করলেও একটা বড় অংশ শাহদাতবরণ করেন। এই কারণে আইন মিসনুনকে আইন আশ শুহাদা বলা হয়। 

আবু উবাইদা ইয়াজিদ ইবনু আবু সুফিয়ানকে দামেশকের দায়িত্ব প্রদান করেন। দিহাইয়া ইবনে খলিফাকে তামদূর জয় করার জন্য প্রেরণ করেন। শুরাহবিল রা.-কে জর্দান জয় করার জন্য প্রেরণ করেন। এরপর আবু উবাইদা রা. ও খালিদ রা. ফিহল অবরোধ করেন। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার পর তারা বাধ্য হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং পরাজয়বরণ করে। মুসলিমরা দখলকৃত অঞ্চলে ইসলামী শাসন, তাবলীগ, মসজিদ স্থাপন ও প্রশিক্ষণের কাজ করতে থাকেন। 

১৫ হিজরিতে রোমানরা হিমসে একত্রিত হতে থাকে। আবু উবাইদাহ রা. মুসলিম বাহিনী নিয়ে হিমস অবরোধ করেন। তখন তীব্র শীল চলছিল। হিমসের অধিবাসীরা ভেবেছে তীব্র শীতে খোলামাঠে থাকতে না পেরে মুসলিমরা ফিরে যাবে। কিন্তু মুসলিমরা আল্লাহর রহমতে তীব্র শীতের মধ্যেও অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে তারা সন্ধি করতে সম্মত হয়। মুসলিমরা বিনাযুদ্ধে হিমস দখল করে নেয়। 

এরপর আবু উবাইদাহ রা. খালিদ রা.-কে কিন্নাসরিনে পাঠান। সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে আল্লাহর রহমতে মুসলিমরা বিজয় লাভ করে। এই ভয়াবহ যুদ্ধে খালিদ রা.-এর সাহস, নৈপুণ্য ও আত্মত্যাগের কথা উমার রা.-এর কাছে পৌঁছে। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ আবু বকরের প্রতি দয়া করুন। তিনি মানুষ চিনতেন আমার চাইতে বেশি। আমি খালিদকে এই কারণে বরখাস্ত করিনি এজন্য যে, সে কোনো অপরাধ করেছে। বরং এজন্য যে, লোকেরা তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছিল। 

১৫ হিজরিতে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে সিরিয়া ছেড়ে রোমে চলে গেল। এরপর উমার রা. মুয়াবিয়া রা.-কে কায়সারিয়ায় সেনাপতি হিসেবে প্রেরণ করেন। মুয়াবিয়া রা. সেখানে গিয়ে শহর অবরোধ করেন। তাদের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হয়। একইসাথে উমার রা.-এর নির্দেশে আমর ইবনুল আস রা. জেরুলাজালেমের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথমধ্যে রামাল্লার আজনাদায়নে রোমান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। আমর ইবনুল আস বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকলেন এবং সাহায্য চেয়ে উমার রা. এবং আবু উবাইদাহ রা.-এর নিকট পত্র লিখলেন। হিমস থেকে আবু উবাইদাহ রা. আমর ইবনুল আস রা.-কে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যে আমর ইবনুল আস যুদ্ধে জয় লাভ করলেন এবং আরো দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়ে জেরুজালেম অবরোধ করলেন।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন