আলী রা. খিলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর সাহাবাদের মধ্য থেকে প্রথমে তালহা রা. ও যুবাইর রা. খলিফা হত্যার কিসাস দাবী করেন। আলী রা. তাদের বুঝালেন এবং বললেন, যেহেতু বিদ্রোহীরা মদিনার সর্বত্র বিরাজ করছে এবং তাদের সাপোর্টে একটা বড় সংখ্যক জনগণ রয়েছে তাই এটা সাবধানে করতে হবে। আগে রাষ্ট্রের সংহতি নিশ্চিত হোক, রাষ্ট্র কন্ট্রোলে আসুক তারপরে হত্যাকারীদের শনাক্ত ও শাস্তি দেওয়া যাবে। তালহা রা. ও যুবাইর রা. বুঝলেন ও ফিরে গেলেন।
তৎকালে মদিনার সাহাবীরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে যান। একদল ছিল আলী রা.-এর পক্ষে। এরা মূল দল। তারা আলী রা.-এর সিদ্ধান্ত ও শাসনে খুশি ছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় সবাই উসমান রা.-এর হত্যার বিচার চান। তবে পরিস্থিতি পূর্ণরূপে আলী রা.-এর নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন। উসমান রা.-এর সময়ের মিসরীয় ও বসরার বিদ্রোহীরাও আলী রা.-এর পক্ষে ছিলেন।
দ্বিতীয় দল কতিপয় সাহাবী রা.-এর নেতৃত্বে ছিল। এদের মধ্যে আয়িশা রা., যুবাইর রা., তালহা রা., মুয়াবিয়া রা. ছিলেন উল্লেখযোগ্য। উসমান রা.-এর হত্যার কিসাস তারা এখনই কার্যকরের ব্যাপারে আগ্রহী। আলী রা. এই সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছেন বিধায় তারা আলী রা.-এর বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। উমাইয়া পরিবারের প্ররোচনায় এই দলের কেউ কেউ আলী রা.-কে উসমান রা.-এর হত্যাকারী এবং হত্যাকারীদের শেল্টারদাতা হিসেবে মনে করতে লাগলেন। এখানে লক্ষ্যণীয় আবু বকর রা.-এর দুই সন্তান মুহাম্মদ ও আব্দুর রহমান রা. ছিলেন আলী রা.-এর পক্ষে অন্যদিকে অন্য সন্তান আয়েশা রা. ছিলেন বিপক্ষে।
তৃতীয় দল কোনো কিছু বুঝে উঠতে সক্ষম ছিলেন না। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না বিধায় তারা নিরপেক্ষ থাকলেন। এদের সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা., আবু হুরাইরা রা. এবং আবু মুসা আশআরি রা. ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তারা কোনো পক্ষে অবস্থান না করে নিজের ঘরে অবস্থান করাটাকে শ্রেয় মনে করেছেন।
আলী রা. প্রথমে রাষ্ট্রীয় শৃংখলা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় এবং বিদ্রোহীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এতে কেউ কেউ আলী রা.-এর প্রতি রুষ্ট হন। অন্যদিকে হজ্জের মওসুম হওয়ায় রাসূল সা.-এর স্ত্রীগণ সহ বহু সাহাবী হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় ছিলেন। এভাবে চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর তালহা ও যুবায়ের রা. আলী রা.-এর ওপর বিরক্ত হয়ে মক্কায় গমন করেন। উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা. উসমান রা.-এর খুনীদের শাস্তির দাবীতে মক্কার হাতিমে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন।
তাঁকে কেন্দ্র উসমান রা.-এর হত্যার বদলা চাওয়া লোকেরা জমায়েত হতে শুরু করলো। আয়িশা রা. আলী রা. বিরোধী শিবিরের অঘোষিত নেতা হয়ে গেলেন। তাদের দাবী উসমান হত্যার বদলা না নিয়ে এক মুহূর্তও শাসন ক্ষমতায় থাকা থাকা যাবে না। আগে খলিফা হত্যার বিচার করতে হবে। মদিনা থেকে মিশরীয় বিদ্রোহীদের শাস্তি দিয়ে বিতাড়িত করতে হবে ইত্যাদি। এদিকে বসরায় একদল লোক উসমান রা.-এর হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে দল গঠন করলো। তাদের সাথে যুক্ত হতে চাইলেন মক্কায় খুনের বদলা নিতে চাওয়া লোকেরা। উসমান হত্যার ক্বিসাস গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বসরায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আয়েশা রা.-এর নেতৃত্বে মক্কা থেকে তালহা রা., যুবায়ের রা. প্রমুখ সাহাবী বসরার পথে রওয়ানা হন।
পথিমধ্যে আয়িশা রা. বসরার নিকটবর্তী ‘হাওআব’ নামক স্থানে পৌঁছলে কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। তখন তাঁর রাসূল সা.-এর হাদীসের কথা মনে পড়ে যায়। একদা রাসূল সা. তাঁকে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যকার একজনের অবস্থা কেমন হবে, যখন হাওআবের কুকুর তার বিরুদ্ধে ঘেউ ঘেউ করবে? (হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
‘তোমাদের মধ্যে উটে আরোহণকারিনীর অবস্থা কি হবে, যখন সে বের হবে? অতঃপর তার বিরুদ্ধে হাওআবের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করবে? তার ডানে ও বামে বহু মানুষ নিহত হবে। এরপর কোন মতে সে প্রাণে রক্ষা পাবে’ (মুসনাদে বাযযার হা/৪৭৭৭; মাজমাঊয যাওয়ায়েদ হা/১২০২৬, সনদ সহীহ)। তখন আয়িশা রা. বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করলেন। এমন সময় যুবায়ের রা. বললেন, না বরং আপনি সামনে অগ্রসর হন। লোকেরা আপনাকে দেখে হয়ত সন্ধিতে চলে আসবে। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে হয়তো বিবদমান দু’টি দলের মধ্যে মীমাংসা করে দিবেন। তখন তিনি সামনে অগ্রসর হন’ (হাকেম হা/৪৬১৩; আহমাদ হা/২৪২৯৯; ছহীহাহ হা/৪৭৪)।
এই ঘটনাগুলো ৩৬ হিজরির কথা। ৩৫ হিজরিতে আলী রা. খলিফা হন। এরপর সিরিয়ার গভর্নর আলী রা. নির্দেশ না মানলে তিনি সিরিয়ায় সফর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বসরায় সংগঠিত বিদ্রোহ ঠেকাতে তিনি সিরিয়ার দিকে না গিয়ে বসরার দিকে রওনা হন।
আলী রা. কা'কা' রা.-কে বসরায় তালহা ও যুবায়র রা.-এর কাছে দূতরূপে পাঠালেন সম্প্রীতি ও ঐক্যবদ্ধতার প্রতি আহ্বান জানিয়ে এবং বিভেদ-বিভক্তি ও দলাদলিকে ভয়ংকর সাব্যস্ত করে। কা'কা' রা. বসরায় পৌঁছেছে প্রথমে আয়েশা রা.-এর কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, আম্মাজান! আপনি কেন এদেশে এলেন? তিনি বললেন, 'প্রিয় বৎস! মানুষদের মধ্যে আপোস-মীমাংসার উদ্দেশ্যে। কা'কা' রা. তালহা ও যুবায়র রা.-কে ডেকে আনার আবেদন করলেন। তাঁরা উপস্থিত হলে কা'কা' রা. তাঁদের বললেন, “আমি উম্মুল মু'মিনীনকে এখানে আগমনের হেতু জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছেন, মানুষদের মধ্যে আপোসরফা করার উদ্দেশ্যে। তারা দু'জন বললেন, আমরাও একই উদ্দেশ্যে এসেছি।
কা'কা' রা. বললেন, তবে আপনারা আমাকে অবহিত করুন, এ আপোসের পন্থা কী হবে? কিসের ভিত্তিতে হবে? আল্লাহর কসম! তা আমাদের বোধগম্য হলে আমরাও আপোসে সাড়া দিব। তারা দু'জন বললেন, উসমান হত্যাকারীদের বিষয়টি। কেননা, এটি বর্জন করা হলে তা হবে কুরআন বর্জন করা। কা'কা' বললেন, তাঁর হত্যাকারীদের মধ্যে বসরার লোকদের আপনারা হত্যা করেছেন। কিন্তু তাদের হত্যা করার পূর্বে আপনারা আজকের স্থিরতার চেয়ে অধিক স্থির পরিস্থিতির নিকটবর্তী ছিলেন। আপনারা ছয় শত জনকে হত্যা করলে ছয় হাজার তাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে আপনাদের বর্জন করেছে এবং আপনাদের মধ্য হতে বের হয়ে গিয়েছে।
আপনারা হুরকুস ইবন যুহায়রকে (বসরার বিদ্রোহী নেতা) পাকড়াও করার জন্য সন্ধান করলে ছ'হাজার লোক তাকে রক্ষা করার জন্য দাঁড়িয়েছে। এখন যদি আপনারা তাদের ছেড়ে দেন তবে অন্যদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন আপনারা সে অপরাধে দায়ী হলেন। আর যদি আপনারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং তারাও পাল্টা আঘাত হানে তবে তো আপনারা যে উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছেন এবং যা প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আমি দেখতে পাচ্ছি তার চেয়ে যে বিষয়ের ভয়ে আপনারা ভীত-সন্ত্রস্ত তা অনেক সঙ্গীন রূপ ধারণ করবে। অর্থাৎ আপনাদের দৃষ্টিতে আপনাদের কাঙ্ক্ষিত বিষয় তথা উসমান হত্যাকারীদের হত্যা করা একটি কল্যাণকর্ম । কিন্তু তাতে এমন অকল্যাণ ও বিশৃংখলা জন্ম নিবে যা উক্ত কল্যাণের চেয়ে অধিক ভয়ংকর।
আর আপনারা যদি হুরকুস ইবন যুহায়র হতে উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে এ কারণে অক্ষম হয়ে থাকেন যে, তার হত্যাকারীদের হাত হতে তাকে সুরক্ষার জন্য ছয় হাজার লোক প্রস্তুত রয়েছে তবে তো চলমান পরিস্থিতিতে বর্জন করার ক্ষেত্রে আলী রা.-এর অপারগতা অধিক গ্রহণযোগ্য। তিনি তো উসমান হন্তাদের উপর কর্তৃত্ব বিস্তারে নিশ্চিন্ত হওয়া পর্যন্ত তাদের হত্যা করার পরিকল্পনা মুলতবি করেছেন মাত্র। কারণ, জনতার মনোভাব ও বক্তব্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন হয়ে রয়েছে। কা'কা রা. তাদের একথাও অবহিত করলেন যে, সংঘটিত এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে রাবী'আ ও মুযার গোত্রের এক বিশাল বাহিনী সমবেত হয়ে রয়েছে।”
এ পর্যায়ে উন্মুল মু'মিনীন আয়েশা রা. বললেন, তোমার মতামত কি? কা'কা রা. বললেন, আমি বলতে চাই, যা কিছু ঘটেছে তার প্রথম ওষুধ হলো পরিস্থিতি শান্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা। পরিস্থিতি শান্ত হলেই ওরা ধরা পড়বে। কাজেই আপনারা আমাদের বায়'আত মেনে নিলে তা হবে কল্যাণের প্রতীক, রহমানের সুসংবাদের বার্তা ও হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের সময় চলে আসবে। আর যদি আপনারা হটকারীতাই করতে থাকেন এবং নতুন নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে থাকেন তবে তা হবে অকল্যাণের প্রতীক ও ইসলামের বিদায় ঘণ্টা। কাজেই শাস্তি-শৃংখলাকে অগ্রাধিকার দিন, তা প্রাপ্তির সুযোগ গ্রহণ করুন এবং যেমন পূর্বেও ছিলেন, কল্যাণের চাবিকাঠি হোন। আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিবেন না, তাতে আপনারাও তার সম্মুখীন হবেন এবং মহান আল্লাহ্ আমাদের ও আপনাদের ধরাশয়ী করবেন।
তাঁরা বললেন, তুমি সুন্দর বলেছ ও সঠিক বলেছ। এখন ফিরে যাও। আলীও তোমার অনুরূপ মতামত নিয়ে আগমন করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তখন কা'কা' রা. 'আলী রা.-এর কাছে ফিরে গিয়ে তাঁকে সব বিষয় অবহিত করলে বিষয়টি তাঁর মনঃপূত হলো এবং সমবেত জনতা আপোস-সন্ধির দিকে অগ্রণী হলো। যারা (অন্তরে) তা অপছন্দ করল তারা অপছন্দ করল এবং যারা পছন্দ করল তারা পছন্দ করল। আয়েশা রা. ও আলী রা.-এর কাছে এ মর্মে দূত পাঠালেন যে, তিনি আপোস-সন্ধির জন্যই এসেছেন। এতে উভয় পক্ষ আনন্দিত হলো। আলী রা. লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি জাহিলী যুগ ও তার অকল্যাণের কথা ও অপকর্মসমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও দলবদ্ধতার সৌভাগ্যের কথা উল্লেখ করলেন।
তিনি আরও বললেন, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর নবীর ওফাতের পরে এ উম্মতকে খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক রা.-এর নেতৃত্বে একত্রিত করে দিয়েছিলেন। তাঁর পরে উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর নেতৃত্বে, তারপর উসমান রা.-এর নেতৃত্বে। তারপর এ দুর্ঘটনার সূত্রপাত হলো যা সমগ্র উম্মতকে ঘিরে ফেলেছে। একদল লোক দুনিয়ালোভী হয়ে মহান আল্লাহ্ বাদের দুনিয়ার নিয়ামত দান করেছেন তাদের প্রতি মহান আল্লাহ্ যে মাহাত্ম্য ও মর্যাদা দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন তার প্রতি হিংসায় আক্রান্ত হলো। তারা ইসলামকে ও এ বিষয়গুলোকে পিছনে সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা করল; মহান আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁর কর্ম সম্পন্ন করবেন। পরে তিনি বললেন, শোন! আমি আগামী দিন সফর শুরু করব, তোমরাও বেরিয়ে পড়বে। যারা উসমান হত্যায় কোন কিছু দিয়ে কোন প্রকার অংশগ্রহণ করেছে তারা আমার সঙ্গে যাবে না।
আলী রা.-এর এই ঘোষণায় উসমান রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা আড়াই হাজার বিদ্রোহী শঙ্কিত হয়ে পড়ে। আলী রা. বসরা থেকে চলে যেতে উদ্যত হলে তালহা রা. ও যুবাইর রা. বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করে। এরপর আলী রা. তালহা ও যুবায়র রা.-এর কাছে পত্র পাঠালেন যে, তোমরা কা'কা' ইবন 'আমরকে যে কথার উপরে ফেরত পাঠিয়েছিলে তাতে অবিচল থাকলে হাত গুটিয়ে রাখো, যাতে আমরা অবস্থান নিয়ে বিষয়টির প্রতি নজর দিতে পারি। তাঁরা দুইজন পত্রের জবাবে অবহিত করলেন যে, মানুষের মধ্যে আপোসরফার যে কথার উপরে কা'কা' ই আমরকে ফেরত পাঠিয়েছিলাম আমরা তাতে অবিচল রয়েছি। এতে সকল মানুষ শান্ত ও নিশ্চিন্ত হলো এবং উভয় বাহিনীর লোকেরা তাদের সংগী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিলিত হলো।
সন্ধ্যায় আলী রা. আবদুল্লাহ্ ইব্ন 'আব্বাস রা.-কে অপর পক্ষের কাছে পাঠালেন এবং তারা মুহাম্মদ ইব্ন তুলায়বা সাজ্জাদকে আলী রা.-এর কাছে পাঠাল। ফলে জনতা একটি সুখময় রাত অতিবাহিত করলো। তবে উসমান হত্যাকারীরা একটি ভয়ানক রাত অতিবাহিত করল। তারা রাতভর সলা-পরামর্শ করে কাটাল এবং শেষ রাতের আঁধারের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হলো।
সিদ্ধান্তমতে ফজরের সময় শুরু হওয়ার আগেই তাদের প্রায় দুই হাজার লোক উঠে পড়ল এবং প্রত্যেক উপদল তাদের আপনজনদের কাছে পৌঁছে তরবারি দ্বারা আক্রমণ চালাল। এতে প্রত্যেক উপদল আত্মরক্ষার জন্য নিজেদের বড় দলের কাছে ছুটে গেল। ঘুম ভাঙ্গা লোকেরা নিজ নিজ অস্ত্র হাতে তুলে নিল। তারা বলতে লাগল, কুফাবাসীরা (আলী রা.-এর বাহিনী) রাতের আঁধারে আমাদের উপর আক্রমণ করেছে এবং আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা ধারণা করল যে, আলী রা.-এর সঙ্গে আগতদের কোন একটি দল এ কাজ করেছে। আলী রা.-এর কাছে সংবাদ পৌঁছলে তিনি বললেন, লোকদের কি হয়েছে? লোকেরা বলল, বসরাবাসীরা আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। এতে প্রত্যেক পক্ষ তার অস্ত্রের কাছে ছুটে গেল এবং বর্ম পরিধান করে অশ্বারোহী হলো। তাদের কেউই বাস্তবে কি ঘটেছে তা অনুধাবন করতে পারল না।
অশ্বারোহীরা দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হলো। বীর বাহাদুররা চক্কর দিয়ে দিয়ে চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করল। যুদ্ধ তার নখর বসিয়ে দিল। এক সময় উভয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাড়াল।কঠিন যুদ্ধের প্রাক্কালে আলী রা. তালহা রা. ও যুবায়র রা.-এর সঙ্গে কথা বলার জন্য তাদের খোঁজাখুঁজি করলেন। পরে তাঁরা (যুদ্ধক্ষেত্রেই) সমবেত হলেন, এমনকি তাদের ঘোড়াগুলির ঘাড় পরস্পর মিলিত হলো।
আলী রা. যুবায়র রা.-কে বললেন, তোমাকে কে বের করে আনলো (বিদ্রোহী করল)? 'যুবায়র রা. বললেন, তুমিই। এছাড়া এ বিষয়ের জন্য আমি তোমাকে আমার চেয়ে অধিক যোগ্য অধিকারী মনে করি না। আলী রা. তাকে বললেন, সে দিনটির কথা কি তোমার মনে পড়ে যে দিন আমি রাসূলুল্লাহ্ -এর সঙ্গে বনু গুমের এলাকায় পথ চলছিলাম। তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলেন, আমিও তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম। তখন তুমি বলেছিলে, ইব্ন আবু তালিবের গর্বিত আচরণ আর গেল না। তখন রাসূলুল্লাহ্ বলেছিলেন- “সে অহংকারী নয়, তুমি অবশ্যই তার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এবং তখন তুমি তার প্রতি জুলুমকারী হবে।”
যুবায়র রা. বললেন, আল্লাহর কসম, হ্যাঁ (আমার মনে পড়েছে)। আগে তা আমার স্মরণে থাকলে আমি আমার এ সফরে বের হতাম না। এখন, আল্লাহর কসম! তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না। তখন যুবাযর রা. সারি ভেদ করে চলে যেতে লাগলেন। একই কথা আলী রা. তালহা রা.-কেও বললেন। তালহা রা.-ও যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে চাইলেন। তিনি যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়ার সময় যুদ্ধক্ষেত্রেই একটি অজ্ঞাত তীর তাঁকে আঘাত করল- কথিত মতে মারওয়ান ইবনুল হাকাম সেটি মেরেছিল। মহান আল্লাহ্ সমধিক অবহিত। এই তীরের বিষক্রিয়ায় তিনি শাহদাতবরণ করেন। যুবাইর রা.-ও ফিরে যাওয়ার সময় যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে শাহদাতবরণ করেন।
আয়েশা রা. তাঁর হাওদায় বসে এগিয়ে চললেন এবং বসরার কাজী কা'ব ই সিওয়ারের হাতে একখানি কুরআন শরীফ তুলে তাকে বললেন, লোকদের এর দিকে আহ্বান করো। এটি ছিল সে সময় যখন যুবাইর রা. ফিরে গেলেন এবং তালহা রা. শহীদ হলেন এবং যুদ্ধের তীব্রতা প্রচণ্ড রূপ ধারণ করল। এক পর্যায়ে আয়িশা রা.-এর বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লো। আয়িশা রা. অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। আলী রা. তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন।
এ সময় 'আলী রা.-এর ঘোষক ঘোষণা প্রচার করলো- কোন পলাতকের পশ্চাদ্ধাবন করা হবে না। কোন আহতকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া হবে না, বাড়িঘরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাবে না। 'আলী রা. একদল লোককে আয়িশা রা.-এর বাহনটি নিহতদের মধ্য হতে সরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবন আবূ বকর রা. ও আম্মার রা.-কে একটি তাঁবু লাগিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন। ভাই মুহাম্মদ ‘আয়েশা রা.-এর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কোন আঘাত লাগেনি তো? তিনি বললেন, না। আর তাতে তোমার কি এসে যায়? 'আম্মার রা. তাঁকে সালাম করে বললেন, 'মা, কেমন আছেন আপনি? আয়েশা রা. বললেন, 'আমি তোমার মা নই।'
আম্মার রা. বললেন, অবশ্যই, যদিও আপনার অপছন্দ হয়। এ সময় আমীরুল মু'মিনীন আলী রা. তাঁর কাছে এলেন এবং সালাম করে বললেন, মা, কেমন অবস্থায় আছেন? 'আয়েশা রা. বললেন, ভালো। আলী রা. বললেন, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন! এ সময় অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও গোত্রপতি-দলনেতাগণ এসে উম্মুল মুমিনীন রা.-কে সালাম করতে লাগলেন।
রাত ঘনিয়ে এলে উম্মুল মু'মিনীন আয়িশা রা. বসরা শহরে প্রবেশ করলেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিল তার ভাই ও বিপক্ষ দলের মুহাম্মদ ইবন আবূ বকর রা.। তিনি বসরার বৃহত্তম বাড়ি আবদুল্লাহ্ ইব্ন খালাফ খুযা'ঈর বাড়িতে অবতরণ করলেন। খুঁজে খুঁজে উভয় পক্ষের আহতদের বসরার শহরে নিয়ে যাওয়া হলো। আলী রা. ঘুরে ঘুরে উভয়পক্ষের নিহতদের দেখতে লাগলেন। এর মধ্যে তালহা রা.-এর লাশ দেখতে পেয়ে খুবই কষ্ট পেলেন। তাঁর জন্য প্রশংসাসূচক কবিতা বলতে লাগলেন।
মুসলিমদের জন্য ভয়ংকর খারাপ দিন হলো বসরার এই যুদ্ধ। ইতিহাসে এই যুদ্ধের নাম উটের যুদ্ধ নামে পরিচিত। আয়িশা রা. উটের পিঠে চড়ে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে এমন নামকরণ করা হয়েছে। এই যুদ্ধে অগণিত মুসলিম শাহদাতবরণ করেন। বহু মুসলিমের হাত-পা কর্তিত হয়। অনেকেই মুসলিম ভাইকে খুন না করে হাত-পা কেটে পরাজিত করতে চেয়েছেন। তাই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যুদ্ধের পরে আয়িশা রা. অনুতপ্ত হয়েছেন। যুদ্ধ না করে আলী রা.-এর সাথে সরাসরি আলোচনা করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা সঠিক হতো বলে রায় দিয়েছেন।
আলী রা.-এর পক্ষে ছিলেন প্রায় ২০ হাজার সৈন্য। তাঁর পক্ষের কমান্ডাররা হলেন, হাসান রা., হুসাইন রা., আম্মার রা., মুহাম্মদ বিন আবু বকর রা., আব্দুর রহমান বিন আবু বকর রা., আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আবু কাতাদা রা., আবু আইয়ুব আনসারী রা. ইত্যাদি
অন্যদিকে আয়িশা রা.-এর পক্ষে ছিলেন প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য। তাঁর পক্ষের কমান্ডাররা হলেন, মারওয়ান, ওয়ালিদ ইবনে উকবা, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা., মুহাম্মদ ইবনে তালহা রা., উমাইয়া ইবনে খালাফ ইত্যাদি। তালহা রা. ও যুবাইর রা. কমান্ডার ছিলেন কিন্তু তারা যুদ্ধ করেননি।
উভয় পক্ষে মৃত্যুবরণ করেন আড়াই হাজার সৈন্য। আহত হন পাঁচ হাজারেরও বেশি সৈন্য।
২৯ জানু, ২০২৩
২৪ জানু, ২০২৩
ঝিনাইদহ গণহত্যা : বাংলাদেশ পুলিশের ভয়ংকর রূপ ( পর্ব – ০৩)
ঝিনাইদহ গণহত্যা : বাংলাদেশ পুলিশের ভয়ংকর রূপ ( পর্ব – ০২)
সোহান
তার ছোট বোনকে সাথে নিয়ে অপেক্ষা করছিল মায়ের। মা আসবেন ঢাকা থেকে। মাকে এগিয়ে
নিতে জামতলায় অপেক্ষা করছিল সোহান ও মাসুমা। এইসময় একটি ইজিবাইকে চারজন লোক এসে
দাঁড়ায় তাদের সামনে। টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে সোহানকে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয় মাসুমা
এবং উপস্থিত জনতা। সোহানকে সাদা পোষাকে তুলে নিয়ে যায় ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থানার
দুই এসআই নীরব হোসেন ও নাসির উদ্দিন। তাদের সাথে আরো দুইজন কনস্টেবল ছিল যাদের নাম
জানা যায়নি।
ঝিনাইদহের
নূর আলি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল মহিউদ্দিন সোহান। এটা ১০ এপ্রিল ২০১৬
সালের কথা। এরপর আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সোহানকে। কিশোর সোহানের অপরাধ সে
ছাত্রশিবিরের কর্মী। সমির উদ্দিন মণ্ডল হত্যার ঘটনায় জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়
করতে চায় ঝিনাইদহ পুলিশ। এজন্য সোহানকে অপহরণ করে ঝিনাইদহ সহকারী পুলিশ সুপার
আজবাহার আলী শেখ। সবাই খুঁজতে থাকে সোহানকে। না, কোথাও পাওয়া যায় না তাকে। পুলিশ
তার অপহরণের কথা অস্বীকার করে। মামলা, জিডিও কিছুই গ্রহণ করে নি।
১৭
এপ্রিল ২০১৬ তারিখে সংবাদ সম্মেলন করে সোহানের পরিবার। কিছু পত্রিকায় রিপোর্ট হয়।
সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সোহানের বাবা মো. মহসিন আলী। এ সময় সোহানের মা পারভিন খাতুন ও ছোট দুই ভাই বোন উপস্থিত ছিলেন।
লিখিত
বক্তব্যে মহসিন আলী জানান,
গত ১০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে বিকাল ৫টার দিকে আমার বড় ছেলে
কালীগঞ্জ নুর আলী কলেজের ছাত্র সোহান ঈশ্বরবা জামতলা নামক স্থানে তার মায়ের জন্য
অপেক্ষা করছিলো। এ সময় নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয়ে চারজন লোক ইজিবাইকে করে
জোরপুর্বক তাকে তুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে সোহান নিখোঁজ রয়েছে। ছেলের সন্ধানে
রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়ে আমি ক্লান্ত। সবাই আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে
দিয়েছে। সোহানের মা অসুস্থ। ছেলের শোকে আরও অসুস্থ হয়ে পেড়েছে।
উপস্থিত
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সোহানের বাবা এবং মা তাদের আশংকার কথা উল্লেখ করে বলেন, হয়তো
পুলিশের লোকজন তার ছেলেকে নিয়ে গেছে। এ সময় তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তারা অক্ষত অবস্থায়
সোহানকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবী জানান। তারপরও সোহানের খোঁজ পাওয়া
যায়নি কোথাও। পুলিশ সাহায্য করা তো দূরের কথা বরং অস্বীকার করে যাচ্ছে। সংবাদ
সম্মেলনের পর জিডি নিয়েছে তবে হুমকি ধামকি দিয়েছে। সোহানের পরিবারকে জঙ্গী পরিবার
বলেছে।
তার পরের
দিন অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল সোহানের মা স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আজিমের কাছে যান ছেলেকে
বাঁচাতে। আনোয়ারুল আজিম তাকে তাড়িয়ে দেন। প্রায় ৩০০ গ্রামবাসী মিলে এমপির কাছে
গিয়ে অনুরোধ করে পুলিশের কাছ থেকে সোহানকে ছাড়িয়ে আনতে। তারা এও বলে, আগামী
দিন থেকে সোহান ও সোহানদের পরিবার আওয়ামী লীগ করবে। এমপি আনোয়ারুল আজিম দম্ভের
সাথে তাদের বলে, তোদের আওয়ামীলীগ করা লাগবে না। আওয়ামী লীগ করার জন্য লোকের অভাব হবে না।
এর
দুইদিন পর ২০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে কালীগঞ্জ থেকে প্রায় ৫০ কি.মি. দূরে চুয়াডাঙ্গায়
সোহানের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। সকালে চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ভুলাটিয়ার মাঠে ডান
হাত ভাঙ্গা, চোখ উপড়ানো মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় মহিউদ্দীন সোহানের। কান্নায় ভেঙে পড়ে
সোহানের বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজন! তারা তাদের সন্তানকে হারিয়ে ফেললো। সোহানের মা
সেদিন আর্তনাদ করে বলেছিলেন "মারবেই যখন আমার বাবুটারে। চোখ তুইল্যা নিলো
ক্যান বাবুর?"
এভাবে
নৃশংস নির্যাতন করেও মহিউদ্দিন সোহানের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি নিতে পারেনি
পুলিশ। নানানভাবে নির্যাতন করে জামায়াত শিবিরের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে 'ধর্মান্তরিত' হওয়া
সমির উদ্দিন মন্ডলের খুনের দায় চাপাতে চেয়েছে ঝিনাইদহ পুলিশ। সোহান ছিল তাদের ৫ম
শিকার।
ঝিনাইদহ
পুলিশের ৬ষ্ঠ শিকার হলেন ছাত্রশিবির নেতা শহিদ আল মাহমুদ। শহিদ আল মাহমুদ সদর
উপজেলার বদনপুর গ্রামের রজব আলীর ছেলে। ২০১৬ সালের ১৩ জুন ঝিনাইদহ শহরের বদনপুর
থেকে সাদা পোষাকের একদল লোক ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। পুলিশ সাদা
পোষাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে উপস্থিত জনতা তাদের মধ্য থেকে এসআই আমিনুর রহমান ও
এসআই উজ্জলকে চিনতে পারে।
১৮ জুন
২০১৬ তারিখে আল মাহমুদের পরিবারের পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়েছিলো। তিনি
সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেন, “গত ১৩ জুন রাত ১২টার দিকে সাদা
পোশাকধারী ব্যক্তিরা পুলিশ পরিচয় দিয়ে তার ছেলে শহীদ আল মাহমুদকে ঝিনাইদহ সদর
উপজেলার বদনপুর গ্রাম থেকে তুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে আল মাহমুদ নিখোঁজ। ১০/১২ জন
লোক একটি কালো মাইক্রোবাস ও ৩টি মোটর সাইকেল এসে তার ছোট ছেলে শহীদ আল মাহমুদকে
উঠিয়ে নিয়ে যায়। এমতাবস্থায় তিনি এবং তার পরিবার ছেলের জীবন নিয়ে শঙ্কিত। সংবাদ
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শহীদ আল মাহমুদের বড় বোন মদিনা খাতুন এবং মামা ফিরোজ
আহমেদ। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে শিবির কর্মী শহীদ আল মাহমুদকে আটক করা হয়নি বলে
জানানো হয়।
অন্যদিকে
১৬ জুন ২০১৬ তারিখে রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ৯
নাম্বার রোডের ১১ নাম্বার বাসার ৬ তলা থেকে ছাত্রশিবিরে সহকারী সাহিত্য সম্পাদক ও
ঝিনাইদহ শহর শাখার সাবেক সভাপতি ইবনুল ইসলাম পারভেজ, ঝিনাইদহের ছাত্রকল্যাণ ও আইন
সম্পাদক এনামুল হক এবং ঝিনাইদহ পলিটেকনিকের সাবেক সভাপতি আনিসুর রহমানকে সাদা পোষাকের
পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
ঝিনাইদহ
গণহত্যার ৭ম ও ৮ম শিকার হলেন আনিসুর রহমান ও ইবনুল ইসলাম পারভেজ। ঢাকা থেকে ডিবি
পরিচয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ঝিনাইদহে নিয়ে আসে আজবাহার আলী গং। পুলিশের কাছে আটক
থাকা ৪ জনের মধ্যে একজন প্রচণ্ড নির্যাতনে পুরোহিত খুনের স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য
হয়। ২১ জুন ২০১৬ তারিখে শিবির নেতা এনামুল হককে ঝিনাইদহ আদালতে হাজির করা হয়। এসময়
তার এক পা ভাঙ্গা ছিল এবং সারা শরীরে ভয়ংকর নির্যাতনের গভীর ক্ষতস্থান ছিল। এনামুল
হলো ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের মধ্যে একজন।
বাকি
তিনজন অর্থাৎ ১৩ জুন ঝিনাইদহ থেকে আটক হওয়া আল মাহমুদ এবং ১৬ জুন ঢাকা থেকে আটক
হওয়া আনিসুর রহমান ও ইবনুল ইসলাম পারভেজের সন্ধানের দাবীতে পরিবার ও ছাত্রশিবিরের
পক্ষ থেকে একাধিকবার বিবৃতি এবং সংবাদ সম্মেলন করা হয়। একই দাবীতে ২১ জুন
ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এত
কিছুর পরও পুলিশ তাদের বর্বরতার অবস্থান থেকে ফিরে আসতে পারেনি।
১ জুলাই
২০১৬ তারিখে আল মাহমুদ ও আনিসুর রহমানকে হত্যা করে ঝিনাইদহ পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য
অনুসারে ১ জুলাই গভীর রাতে তাদের ওপর আক্রমণ করে শিবির নেতা আল মাহমুদ ও আনিসুর
রহমান। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, গোপন
সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে তেতুলবাড়ীয়া এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত নাশকতা
সৃষ্টির জন্য অবস্থান করছে। খবর পেয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার টহল পুলিশ তেতুলবাড়ীয়া
রাস্তা দিয়ে টহল দিচ্ছিল। পুলিশ টহলের সময় তেতুলবাড়ীয় গ্রামের উত্তর মাঠের দিকে
দুর্বৃত্তরা পুলিশের গাড়ী লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ ও পাল্টা
গুলি চালায়। উভয় পক্ষের প্রায় ২০ মিনিট গুলি বিনিময় হয়। এর এক পর্যায়ে দুর্বৃত্তরা
পালিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুইটি গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
নিহত
আনিসুর রহমানের বাড়ি ঝিনাইদহ না হলেও তিনি ঝিনাইদহ পলিটেকনিকে পড়াশোনা করেছিলেন।
ঝিনাইদহে তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং পলিটেকনিক শাখার সভাপতি
ছিলেন। তার বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার জুগিয়ার ভাটাপাড়ায়। তিনি সাবদার হোসেন ও জাহানারা
খাতুনের ৫ সন্তানের মধ্যে ছোট সন্তান।
ছাত্রশিবির
এই দুইজনের হত্যার প্রতিবাদ বিবৃতিতে বলে, “গ্রেপ্তারের ১৭ দিন পর শিবির নেতা
শহিদ আল মাহমুদ ও ১৪ দিন পর আনিসুর রহমানকে ঝিনাইদহে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে
বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে হত্যা করা হয়। মূলত পুলিশ তাদের দীর্ঘদিন আটক রেখে
পুরোহিত হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আদায়ের জন্য নির্মম নির্যাতন চালায়। শত
নির্যাতনের পরেও মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকার করলে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে
হত্যা করে পুলিশ। আমরা মনে করি, সরকার সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যা
করে এর দায়ভার ছাত্রশিবিরের উপর চাপিয়ে দমন নিপীড়নের ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে।
এইসব হত্যার সাথে সরকার সরাসরি জড়িত”।
এই
দুইজনকে হত্যার পরদিনই অর্থাৎ ২ জুলাই ২০১৬ তারিখে ইবনুল ইসলাম পারভেজকে খুন করে
ঝিনাইদহ পুলিশ। ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার আড়ুয়াকান্দিতে একটি কবরস্থানের পাশে ২
জুলাই ভোররাতে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে ইবনুল ইসলাম পারভেজকে হত্যা করে ঝিনাইদহ পুলিশ। নিহত পারভেজ
ঝিনাইদহ শহরের বনানীপাড়ার জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে। তিনি ঝিনাইদহ শহর ছাত্রশিবিরের সাবেক
সভাপতি ছিলেন।
এই ঘটনা
সম্পর্কে ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, “শুক্রবার দিবাগত রাতে ঝিনাইদহ-মাগুরা মহাসড়কে পুলিশের একটি টহল দল গাড়িতে করে
টহল দিচ্ছিল। রাত আড়াইটার দিকে মহাসড়কের আড়ুয়াকান্দি কবরস্থান এলাকায় পুলিশের
গাড়িটি পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে
পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেলে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একজনের
লাশ উদ্ধার করে। পরে জানা যায়, নিহত ব্যক্তি শিবিরের নেতা পারভেজ”।
পারভেজের
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্রশিবির তাদের বিবৃতিতে বলে, “গ্রেপ্তারের পর প্রায় ১৬ দিন গুম রেখে পুরোহিত হত্যার
মিথ্যা স্বীকারোক্তির আদায় করতে তাদের উপর বর্বর নির্যাতন চালায় পুলিশ। কিন্তু শত
নির্যাতনের পরেও মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকার করলে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে
হত্যা করে পুলিশ”।
পুরোহিত
হত্যার স্বীকারোক্তি দেওয়া শিবির নেতা আমিনুল হককে ভয়ংকরভাবে অসুস্থ অবস্থায়
আদালতে উপস্থাপনের মাধ্যমে এই কথা নিশ্চিত হয়ে যায়, আল মাহমুদ, আনিসুর
রহমান ও পারভেজকে হত্যার জন্য নিঃসন্দেহে পুলিশ দায়ী। আমিনুলকে তাদের সাথেই
গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের ১৫-১৬ দিন আটক রেখে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়
করতে না পেরে খুন করা হয়েছে।
স্বীকারোক্তি
আদায় করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ ভয়ংকর নির্যাতন করে। এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে
সন্দেহভাজনরা প্রায়ই দায় স্বীকার করে। এরকম একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো
নারায়ণগঞ্জের দিশামণির ঘটনা। ৪ জুলাই ২০২০ সালে দিশা মণি এক কিশোরি নিখোঁজ হয়। তার
পরিবার নিখোঁজ ডায়েরি করলে পুলিশ ঐ এলাকার তিন সন্দেহভাজন যুবককে প্রচণ্ড নির্যাতন
করে হত্যার স্বীকারোক্তি আদায় করে নেয়। ঐ তিন যুবক ধর্ষণের পর হত্যার বিবরণ দিয়ে
জবানবন্দি দেয়। মূলত দিশা তার প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। পালিয়ে যাওয়ার ৪৯
দিন পর সে ফিরে এসেছে। এই নিয়ে দেশে তোলপাড় হয়েছে ব্যাপক। যদি সত্যিই খুন হতো দিশা
অথবা আর ফিরে না আসতো তবে মিথ্যা অভিযোগে ঐ তিন যুবকের জীবন স্তব্ধ হয়ে যেত।
পুলিশ
স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য শিবির নেতা এনামুল হককে নির্যাতন করে পা ভেঙ্গে দেয়, তার হাত
পায়ের সব নখ উপড়ানো ছিল। তার পুরো শরীর থেতলে দিয়ে তার থেকে স্বীকারোক্তি নিয়েছিল।
একইভাবে দেখা যায়, খুন হওয়া
সোহান, আল মাহমুদ, আনিস ও পারভেজের শরীর ভীষণভাবে নির্যাতিত। কিশোর সোহানের এক
চোখ উপড়ানো ছিল। ভয়ঙ্কর নির্যাতনেও এরা স্বীকারোক্তি দেয়নি বলে তাদের তাদের হত্যা
ঝিনাইদহ পুলিশ।
সোহান, মাহমুদ, আনিস ও
পারভেজ এই চারজন নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনায় তাদের পরিবার ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন
ছাত্রশিবির সন্দেহাতীতভাবে পুলিশকে দায়ী করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে ৪টি খুনের জন্যই
এএসপি আজবাহার আলী শেখ ও ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম
খান দায়ী। এর বাইরে কিশোর মহিউদ্দিন সোহান হত্যার জন্য আনোয়ার হোসেন (ওসি, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহ), নীরব
হোসেন (এসআই, সদর, ঝিনাইদহ) ও নাসির উদ্দিন (এসআই, সদর, ঝিনাইদহ)
দায়ী। বাকী তিনজন হত্যার জন্য হাসান
হাফিজুর রহমান (ওসি,
সদর,
ঝিনাইদহ), আমিনুর রহমান (এসআই, সদর, ঝিনাইদহ), উজ্জল
(এসআই, সদর, ঝিনাইদহ), প্রবির কুমার (এসআই,
সদর,
ঝিনাইদহ), রাব্বি হোসেন (কনস্টেবল, সদর, ঝিনাইদহ), তারিকুল
ইসলাম (কনস্টেবল,
সদর,
ঝিনাইদহ), আরিফুল ইসলাম (কনস্টেবল, সদর, ঝিনাইদহ)
এবং সামন্ত কুমার (কনস্টেবল, সদর,
ঝিনাইদহ)।
ঝিনাইদহ গণহত্যা : বাংলাদেশ পুলিশের ভয়ংকর রূপ ( পর্ব – ০১)
ঘটনার সূত্রপাত একজন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান নাগরিক হত্যা নিয়ে। ঝিনাইদহে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক সমির উদ্দিন মণ্ডল ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে কাজ করছিলেন। কে বা কারা ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি তার চেম্বারে রোগী সেজে তাকে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটে ঝিনাইদহ সদরের কালুহাটি গ্রামের বেলেখাল বাজারে।
ওইদিন রাতেই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) 'ধর্মান্তরিত হওয়ায়' সমিরকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে খবর দেয় জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট 'সাইট ইনটিলেজেন্স গ্রুপ'। সমির উদ্দিন ২০০১ সালে স্থানীয় 'ওয়ানওয়ে চার্চ বাংলাদেশ' এর মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন বলে দাবি করেন চার্চের ঝিনাইদহ এলাকার কো-অর্ডিনেটর হারুন অর রশিদ। হারুন আরো বলেন, "সমির খ্রিস্টধর্ম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। জঙ্গিরা এ কারণেই তাকে হত্যা করেছে।"
বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে জোর গলায় আইএসের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। তারা তাদের এই কথাকে সত্য প্রমাণ করতে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র শুরু করে। মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া সমিরের খুনের দায় তারা জামায়াত-শিবিরের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। খুনীদের ধরার ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টা দেখা যায় না বরং তারা কীভাবে এর দায় জামায়াত-শিবিরের ওপরে চাপিয়ে দেবে সেই প্রচেষ্টা বেশ লক্ষ্যণীয়।
বাংলাদেশ পুলিশ তাদের এই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য একে একে খুন করে ১৪ জন মানুষকে। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কয়েকজনকে সমির হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করে। যে কয়েকজন স্বীকারোক্তি দিয়েছে তারা বেঁচে আছেন। যারা শত নির্যাতনেও স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়নি তাদের খুন করে ফেলা হয়েছে। এই গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড হলো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক। মাঠ পর্যায়ে এই গণহত্যা কার্যক্রম পরিচালনা করে ঝিনাইদহের তৎকালীন এএসপি আজবাহার আলী শেখ, সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান, হরিণাকুণ্ড থানার ওসি মাহাতাব উদ্দীন, মহেশপুর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম, কালিগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেন ও ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম খান।
গণহত্যার প্রথম শিকার জামায়াত কর্মী ও মাদ্রাসা শিক্ষক আবু হুরাইরা মালিথা। তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বছর। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শৈলমারী বাজার সংলগ্ন কুঠিদুর্গাপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে আবু হুরাইরা মালিথাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে যায়। কুঠিদুর্গাপুর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক আবু হুরাইরা সদর উপজেলার অশ্বস্থলী গ্রামের মৃত আশির উদ্দীন মালিথার ছেলে। মাদ্রাসা সুপার শরিফুল ইসলাম জানান, ঘটনার দিন (২৩ জানুয়ারি ‘১৬) সকাল ১০টার দিকে আবু হুরাইরা মাদ্রাসার ক্লাস নিচ্ছিলেন। এ সময় মটরসাইকেল যোগে কয়েকজন সাদা পোশাকের মানুষ এসে জানান, তারা বৃহত্তর যশোর থেকে এসেছেন এবং ডিবি পুলিশের লোক। ডিবি পুলিশের কথা শুনে শিক্ষক আবু হুরাইরা তাদের সঙ্গে চলে যান।
ডিবি পরিচয়ে শিক্ষক আবু হুরাইরাকে নিয়ে যাওয়ার পর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও তার পরিবারের লোকজন এক মাসেরও বেশি সময় কোথাও তাকে খুজে পাচ্ছিলেন না। ঝিনাইদহ পুলিশ ও ডিবির পক্ষ থেকেও বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঝিনাইদহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম খান জানিয়েছে, আবু হুরাইরা নামে তারা কাউকে আটক করেননি। আবু হুরাইরার পরিবার সদর থানায় জিডি করতে গেলে তা গ্রহণ না করে পরিবারকেই খোঁজ করতে বলেছে সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান।
২৩ জানুয়ারী আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মাদরাসা থেকে তুলে নেয়ার ১ মাস ৬ দিন পর আবু হুরাইরা মালিথার ক্ষত-বিক্ষত লাশ ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী সোমবার যশোর চৌগাছা সড়কের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাওয়া যায়। যশোর কতোয়ালি থানা পুলিশ অজ্ঞাত হিসেবে লাশটি উদ্ধার করে। সন্ধ্যায় যশোর হাসপাতাল মর্গে লাশটি আবু হুরাইরার বলে তার ভাই আব্দুল খালেক মাস্টার শনাক্ত করেন।
ঝিনাইদহ পুলিশের ২য় শিকার হলেন ঝিনাইদহ আলীয়া মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র ও শিবির নেতা হাফেজ জসিম উদ্দীন। তাঁর বয়স ২৫ বছর। জসিমের বাবা কালুহাটি গ্রামের খলিল মন্ডল জানান, গত ১১ জানুয়ারী জসিম উদ্দীন সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি গোয়ালন্দ ঘাট পার হয়ে জসিম তার বাবাকে জানান, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন তাদের বাসটি চেক করবে বলে থামিয়েছে। এরপর থেকেই জসিমের মোবাইল বন্ধ রয়েছে। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, আবু হুরাইরা ও জসিম নামে কাউকে পুলিশ আটক করেনি। তাদের কোন তথ্যও পুলিশের কাছে নেই। অথচ দুই পরিবারের লোকেরা জিডি করতে গেলে তা নেওয়া হয়নি।
নিখোঁজ হওয়ার ২২ দিন পর ২০১৬ সালের ৪ মার্চ ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুর হিঙ্গার গ্রামের একটি মাঠ থেকে থেকে জসিম উদ্দিনের হাত-পা বাঁধা গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সকালে কৃষকরা মাঠে কাজ করতে গিয়ে অজ্ঞাত এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। তাকে চোখ ও পেছনে হাত বেধে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। খবর পেয়ে পুলিশ সকাল ১০টার দিকে লাশ উদ্ধার করে হরিণাকুণ্ডু থানায় নেয়। ঝিনাইদহ জেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আনোয়ার হোসেন জানান, নিহত জসিম উদ্দিন ঝিনাইদহের গান্না ইউনিয়নের শিবিরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। পুলিশ শিবির নেতা জসিমকে আটকের পর অস্বীকার করছে। গতকাল শুক্রবার সকালে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হিঙ্গেরপাড়া গ্রামের মাঠ থেকে তার গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
নিহতর ভাই সাইফুর রহমান জানান, গত ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেট থেকে বাসযোগে বাড়ি ফেরার পথে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে জসিমকে নামিয়ে নেয়। সেই থেকে জসিম নিখোঁজ ছিলো। শুক্রবার সকালে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হিঙ্গেরপাড়া মোস্তবাপুর গ্রামের মাঠে মুখ ও পিঠমোড়া করে হাত-বাধা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় জসিমের। সাইফুর রহমান অভিযোগ করেন, তার ভাইকে প্রশাসনের সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ঝিনাইদহে আজবাহার আলী গং-দের ৩য় ও ৪র্থ শিকার হলেন আবু যর গিফারী ও শামীম হোসেন। ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ দুপুরে জুমআর নামাজের পর ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় চাপালী গ্রামের ইসলাম আলীর ছেলে আবু জর গিফারীকে। তাঁর বয়স ২২ বছর। তিনি যশোর এম এম কলেজের অনার্সের ছাত্র। এর পরদিন ২৪ মার্চ বিকেলে বাকুলিয়া গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে শামীম হোসেনকে পুলিশ পরিচয়ে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর বয়স ২০ বছর। তিনি ঝিনাইদহ সরকারি কে সি কলেজের ছাত্র।
আবু জর গিফারী ছাত্রশিবিরের কালীগঞ্জ পৌর শাখার সভাপতি ও শামীম হোসেন ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিলেন। আবু জর গিফারীর পিতা ইসলাম আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ২৭ দিনেও তিনি তাঁর ছেলে আবু জর গিফারীকে ফেরত পাননি। ১৮ মার্চ জুমার নামাজ পড়ে ফেরার সময় বাড়ির সামনে অপেক্ষমাণ দুটি মোটরসাইকেলে চারজন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে গিফারীকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তাদের কাছে পিস্তল ও হ্যান্ডকাপ ছিল। তিনি আরো বলেন, ‘ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর কালীগঞ্জ থানায় একটি জিডি করার জন্য আবেদন করি। পুলিশ আবেদনটি রেখেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জিডি হিসেবে আর লিপিবদ্ধ করেনি।’
আরেক অপহৃত ছাত্র শামীম হোসেনের বাবা বাকুলিয়া গ্রামের মাদ্রাসাশিক্ষক রুহুল আমিন গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁর ছেলে ২৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে সন্ধ্যায় কালীগঞ্জ শহরের মাহতাব উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। সেখানে অপেক্ষায় থাকা কয়েক ব্যক্তি ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাঁকে অস্ত্র দেখিয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁর খোঁজ মিলছে না।
২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল আবু যর গিফারী ও শামীম হোসেনের লাশ একসাথে পাওয়া যায়। সেদিন সকালে ঝিনাইদহের বারোবাজার সীমান্তে যশোর সদরের লাউখালি শ্মশান এলাকা থেকে তাদের ক্ষতবিক্ষত ও গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা যথাক্রমে ১৮ ও ২৪ মার্চ পুলিশ কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, লাউখালী গ্রামের মাঠে একটি শ্মশান রয়েছে। ১২ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মাঠে কাজ করতে আসা লোকজন ওই শ্মশানে দুটি লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। তাঁরা যশোর থানার পুলিশকে জানালে যশোর কোতোয়ালি থানার পুলিশ এসে লাশ দুটি উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পরে গিফারীর চাচাতো ভাই পান্নু মিয়া গিফারীকে শনাক্ত করেন। শামীম হোসেনের ভাই তাজনিম হোসেন তাঁর মরদেহ শনাক্ত করেন।
যশোর হাসপাতাল মর্গের সামনে আবু জর গিফারীর ফুপা আক্কাস আলী গণমাধ্যমকে বলেন, গিফারীকে গত ১৮ মার্চ বাড়ি থেকে পুলিশ পরিচয়ে সাদাপোশাকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে নিয়ে যায়। এরপর থানায় খোঁজ করা হলেও তাঁর খোঁজ মেলেনি। গিফারী ছাত্রশিবিরের কালীগঞ্জ পৌর শাখার সভাপতি ছিলেন। শামীমের মামা ইমরান হোসেন বলেন, ২৪ মার্চ বিকেলে শামীম কালীগঞ্জের মাহতাব উদ্দীন ডিগ্রি কলেজের সামনের একটি দোকানে পত্রিকা পড়ছিলেন। এ সময় দুটো মোটরসাইকেলে হেলমেট পরা চারজন এসে শামীমকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আশপাশের লোক ধাওয়া দিলে পিস্তল বের করে তাঁরা নিজেদের পুলিশের লোক বলে পরিচয় দেন। এরপর থানায় খোঁজ করলে শামীমের খোঁজ মেলেনি।
কালীগঞ্জ থানা পুলিশ আটকের বিষয় অস্বীকার করে। একইসাথে জিডিও নেয়নি। এই চারজন নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনায় তাদের পরিবার ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াত সন্দেহাতীতভাবে পুলিশকে দায়ী করেছেন। সুনির্দিষ্টভাবে ৪টি খুনের জন্যই এএসপি আজবাহার আলী শেখ ও ঝিনাইদহ ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ হাসেম খান দায়ী। এর বাইরে আবু হুরাইরা খুনের জন্য হাসান হাফিজুর রহমান (ওসি, সদর, ঝিনাইদহ) দায়ী। হাফেজ জসিম উদ্দিন জসিম উদ্দিন খুনের জন্য মাহাতাব উদ্দীন (ওসি, হরিণাকুন্ডু, ঝিনাইদহ) ও হাসান হাফিজুর রহমান (ওসি, সদর, ঝিনাইদহ) দায়ী। আবু জর গিফারী ও শামীম হোসেন খুনের জন্য আনোয়ার হোসেন (ওসি, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহ), নীরব হোসেন (এসআই, সদর, ঝিনাইদহ) ও নাসির উদ্দিন (এসআই, সদর, ঝিনাইদহ) দায়ী।
২২ জানু, ২০২৩
হিন্দুত্ববাদের কবলে পাঠ্যপুস্তক পর্ব ০২ (৭ম শ্রেণি)
ষষ্ঠ শ্রেণির মতো ৭ম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকেও রয়েছে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমস্যা। এই সমস্যাগুলো অনিচ্ছাকৃত নয় বরং টার্গেটভিত্তিক। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক সেগুলো আলোচনা করবো। ৬ষ্ঠ শ্রেণির মতো ৭ম শ্রেণীতেও সবচেয়ে বেশি সমস্যা সামাজিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইতে। সামাজিক অনুশীলন বই ১ম ১০৯ পৃষ্ঠা পড়লে মনে হবে আপনি সামাজিক বিজ্ঞান বই নয়, হিন্দু ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের কোনো ধর্মীয় বই পড়ছেন।