৩ জানু, ২০২৩

সুদী লেনদেনে জড়িয়েছে ইসলামী ব্যাংক

 


পৃথিবীজুড়ে লেনদেনকে সহজ করার জন্য ব্যাংকব্যবস্থা চালু হওয়ার মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে মুসলিমরাও ব্যবসায়ের কাজে সুদী লেনদেনে জড়িত হতে বাধ্য হয়েছে। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পৃথিবীর বিখ্যাত ইসলামী স্কলাররা ইসলামী ব্যংকিং সিস্টেম চালু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে মিশরে 'মিটগামার ব্যাংক' নামে ইসলামী ব্যংক চালু হয়।

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় এদেশের ইসলামপন্থী মানুষদের সহায়তায় ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ধারার ১ম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড চালু হয়। ইসলামী ব্যাংকের বেসিক উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের জনগণকে সুদের জাল থেকে রক্ষা করা। সুদকে বাদ দিয়ে ব্যাংকিং-এর যাবতীয় সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা করা।

১৯৭১ সালে পটপরিবর্তনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশকে সেক্যুলার/ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে চালু করায় বাংলাদেশ ইসলামকে বাদ দিয়েছে। সুদী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাই ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা নীতি প্রবর্তন করেনি। বাংলাদেশের মানুষ ইসলামপ্রিয় হওয়ায় ও এর পরিচালনায় জামায়াত সংশ্লিষ্ট মানুষরা যুক্ত থাকায় ইসলামী ব্যাংক জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। ফলশ্রুতিতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সেরা ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। এর আমানত, রেমিটেন্স, বিনিয়োগ এবং লাভ সবচেয়ে বেশি।

২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচার হাসিনা ক্ষমতায় এসে জামায়াতের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে। শীর্ষ নেতাদের খুন করেছে। জামায়াত সংশ্লিষ্ট সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং এমডিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ডিজিএফআই সদর দপ্তর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে।

সেখানে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাদের পদত্যাগ পত্র এগিয়ে দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করতে বলেন। বাধ্য হয়ে তারা পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করে চলে আসেন। এরপর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি হোটেলে (হোটেল রেডিসন ব্লু ) সভা ডেকে ইসলামী ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়।

এভাবেই শুরু হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ও বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের দুর্ভাগ্যের সূচনা। ৭ বছর আগে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম গ্রুপ যখন ইসলামী ব্যাংক দখল করে তখন ইসলামী ব্যাংকে মানুষের আমানত সবচেয়ে বেশি ছিল। মালিকানা দখল করে এস আলম গ্রুপ নামে বেনামে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে জামানত ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় ইসলামী ব্যাংক থেকে।

বিধি বহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণ করে ইসলামী ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়ে। এর মধ্যে জনগণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এস আলম গ্রুপের আগ্রাসী ভূমিকার কথা জেনে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছে। এতে সংকট আরো ঘণীভূত হয়েছে। এখন ইসলামী ব্যাংক তারল্য ঘাটতি কাটাতে বাধ্য হয়ে সুদের ভিত্তিতে আমানত নিচ্ছে। এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক তার লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। তার লক্ষ্যই ছিল সুদ এড়ানো। এখন তারা তাদের লেনদেনে সুদকে জড়িত করেছে। অর্থাৎ ইসলামী ব্যাংক এখন সুদী ব্যাংকে পরিণত হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক এতদিন আমানত গ্রহণ করতো মুদারাবা সিস্টেমে। মুদারাবা হল ইসলামি শরীয়াহ সম্মত এক ধরনের অংশীদারি ব্যবসায় পদ্ধতি, যেখানে একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করে এবং অপর পক্ষ মেধা ও শ্রম দিয়ে উক্ত মূলধন দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করে। যে পক্ষ মূলধন সরবরাহ করে তাকে সাহিব-আল-মাল বলে এবং ব্যবসায় পরিচালনাকারীকে বলা হয় মুদারিব বলে। এক্ষেত্রে, ব্যবসায়ে মুনাফা হলে পূর্ব চুক্তি অনুসারে বা আনুপাতিক হারে উভয়পক্ষের মাঝে মুনাফা বণ্টিত হয় এবং ব্যবসায় লোকসান হলে মূলধন সরবরাহকারী বা সাহিব-আল-মাল উক্ত লোকসান বহন করে। অন্যদিকে, ব্যবসায় পরিচালনাকারী বা মুদারিব তার মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক পায় না, যা তার লোকসান হিসেবে গণ্য হয়। তবে যদি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে লোকসান হয় তাহলে মুদারিবকেই লোকসানের দায় বহন করতে হয়।

তারল্য সংকট এড়াতে ইসলামী ব্যাংক গত মাসে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে 'নগদ'-এর কাছ থেকে ৮% সুদে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে। অন্যদিকে নগদও তা দিতে রাজি হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানিয়েছেন, গত ২৮ ডিসেম্বর ৫ হাজার ১০১ কোটি টাকা ঘাটতিতে পড়ে ইসলামী ব্যাংক। সেজন্য তারা ৮.৭৫% সুদে জরুরি ভিত্তিতে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

এই ঘটনা ইসলামী ব্যাংকের জন্য প্রথম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের কখনোই অন্যান্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হয় নাই। কারণ এই ব্যাংকের আমানতদাতা ছিল বেশি। আর সুদের ভিত্তিতে ঋণ নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সুদ রিলেটেড ইসলামী ব্যাংকের প্রবলেম ছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে যে টাকা পরিশোধিত মূলধন হিসেবে জমা রাখতো সেখান থেকে সুদ পেত। এই সুদের টাকা তারা মূল ব্যবসার সাথে না জড়িয়ে বিভিন্ন দান-খয়রাত ও দাতব্য কাজে ব্যয় করতো। এখন ইসলামী ব্যাংক নতুনভাবে সুদের জালে জড়িয়ে পড়েছে। তারা সুদের ভিত্তিতে আমনত নিয়েছে।

ইসলামী ব্যাংকের নানা অনিয়ম আলোচনায় আসার পর ব্যাংকটিতে আমানত কমতে থাকে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়। ইসলামী ব্যাংক এত দিন বাংলাদেশ গভর্নমেন্ট ইসলামিক বিনিয়োগ বন্ড ও সুকুক বন্ড জমা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করলেও এখন সেই সুযোগও শেষ হয়ে এসেছে। কারণ, টাকা ধার করতে ব্যাংকটির হাতে আর বন্ড ও সুকুক নেই। ফলে ব্যাংকটির তারল্য জোগানে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহের বিকল্প নেই।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক ইসলামি ধারার অন্য ব্যাংকগুলোকে ৮ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়ে রাখলেও সেই টাকা এখন ফেরত পাচ্ছে না। কারণ, যেসব ব্যাংককে টাকা ধার দিয়েছে সেগুলোও একই মালিকানার প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এসব ব্যাংকও তারল্যসংকটে পড়েছে। এসব ব্যাংকও বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়মিত সিআরআরের অর্থ রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

২০১৭ সালের পর থেকে ইসলামী ব্যাংকে আমানত রাখার ব্যাপারে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে এবং এটা অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সাথে আস্থার সংকট প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধতার সংকটে পড়েছে। সুদের ভিত্তিতে ঋণ নেয়ার পর এই ব্যাংককে আর 'ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ব্যাংক' বলার সুযোগ নেই। এটি সাধারণ সুদী ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার একটি প্রতিষ্ঠিত লাভজনক ইসলামী ব্যাংককে সুদী ব্যাংক বানিয়ে ছাড়লো।

1 টি মন্তব্য: