১৯৩২ সালের কথা। মুসলিম লীগের সাথে কংগ্রেসের একের পর চুক্তি ভঙ্গ ও সকল ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম ছাত্রদের নিয়ে মুসলিম লীগের অধীনে ছাত্রদের একটি সংগঠন অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ গঠন করেন। সভাপতি হন ঢাকার আব্দুল ওয়াসেক, সাধারন সম্পাদক হন যশোরের শামসুর রহমান। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই দলটি তিন মুসলিম নেতার অনুসারীদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। কলকাতা, হুগলি তথা পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীক প্রাধান্য থাকে সোহরাওয়ার্দি ও শেরে বাংলার স্টুডেন্টস লীগ। আবার ঢাকায় থাকে খাজা নাজিমুদ্দিনের স্টুডেন্টস লীগ।
সেসময় স্টুডেন্টস লীগের সভাপতি পদ ছাত্রদের কাছে থাকতো না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। সেক্রেটারি হতো মূল ছাত্রদের নেতা। এখন যেরকম ডাকসুতে হয়। ডাকসুর সভাপতি হন ইউনিভার্সিটির ভিসি। আর ভিপি বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হলো ছাত্রদের মূল নেতা। ১৯৪৫ সালে অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ তথা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। তিনি পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের ৫ম প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৪৭ সালেও অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগের নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। এদিকে শেখ মুজিব ছাত্রলীগে কখনোই যুক্ত ছিলেন না। তিনি মূল সংগঠন মুসলিম লীগে সক্রিয় ছিলেন সোহরাওয়ার্দির অনুসারী হিসেবে। শাহ আজিজ সত্যিকার অর্থেই ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধা হয় নি।
১৯৪৭ সালে কলকাতা যাতে পাকিস্তানের অংশ হয় এজন্য সোহরাওয়ার্দি চেষ্টা করেছিলেন। শাহ আজিজ ও শেখ মুজিবও একই পক্ষে ছিলেন। কারণ তারা কলকাতার নেতা। ঢাকায় তাদের অবস্থান দুর্বল। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতাকে পূর্ব-পাকিস্তানের অংশ হতে বিরোধীতা করেছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেস ও হিন্দুরা তো আছেই। অবশেষে মুসলিমদের একটি শহর হিন্দুদের কাছে চলে গেলো। কলকাতাকে মুসলিমদের শহর বলেছি ১৯৩৫ সাল থেকে কলকাতার সব নির্বাচনে মুসলিমরা বিজয়ী হয়েছে।
১৯৪৭ সালের আগস্টে পাকিস্তান স্বাধীন হলো। কলকাতা হয়ে হিন্দুস্থানের অংশ। কলকাতার মুসলিম নেতারা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসলো। সোহরাওয়ার্দি প্রথমে ঢাকায় আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতদিন সোহরাওয়ার্দির বাধায় কলকাতায় মুসলিমদের নেতা হতে না পারার দুঃখে খাজা নাজিমুদ্দিন সোহরাওয়ার্দিকে ঢাকায় উঠতে দেয়নি। বিশাল জাহাজসমেত সোহরাওয়ার্দি সদরঘাট থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তিনি চলে যান করাচি।
তার অধীনস্ত দুই নেতা শাহ আজিজ ও শেখ মুজিবকে তিনি ঢাকায় পাঠান। শাহ আজিজ যেহেতু পুরো ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি দ্রুতই ঢাকার ছাত্রদের নেতা হয়ে গেলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ঢাকার ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ শুরু করলেন। শাহ আজিজ ও শেখ মুজিব একই নেতার অনুসারী হলেও তারা পরষ্পরের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ ছিলেন না। শাহ আজিজ ছাত্রনেতা হিসেবে খ্যাতিমান হলেও শেখ মুজিব মারদাঙ্গা অর্থাৎ সোহওয়ার্দির পেয়াদা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। বিশেষত কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় তিনি মুসলিমদের পক্ষে ভূমিকা রেখে নাম করেন।
শেখ মুজিব শাহ আজিজের এই উত্থান মেনে নিতে পারেনি। শাহ আজিজের মতো তিনিও ঢাবিতে ভর্তি হন। এরপর ফজলুল হক হলে তার মতো মারদাঙ্গাদের একত্র করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে ঘোষণা করেন, যেহেতু পাকিস্তান গঠন হয়েছে। বাংলা ভাগ হয়ে গেছে। তাই আমরা এখন আর অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ দলের নাম থাকতে পারে না। আমাদের দলের নাম হবে ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বলা হলেও মূলত তা ছিল ছাত্রলীগের ভাঙন। এই দিন ছাত্রলীগ থেকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী ভাবাপন্নরা আলাদা হয়েছিল। শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালে শাহ আজিজের ছাত্রলীগের সাথে টেক্কা দিতে পারেনি। তারা কয়েকটি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় যুক্ত হয়ে পড়ে এবং মুজিবসহ সবাই এরেস্ট হয়। এটা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে।
কিন্তু পরের বছর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর সেক্রেটারি শামসুল হক। সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। আর এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দি-ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়। মুজিব এর সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায়। শাহ আজিজ আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগে গণজোয়ার তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন হয় শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ। ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দির জনপ্রিয়তার কারণে শাহ আজিজের ছাত্রলীগ অল্প সময়ের মধ্যে বিলুপ্ত হয়। কারণ ছাত্রলীগের বেসিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সোহরাওয়ার্দি। তাই শেখ মুজিবের ছাত্রলীগে অন্যান্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সমবেত হয়।
শেখ মুজিবের ছাত্রলীগের ১ম সভাপতি হন দবিরুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি হন খালেক নেওয়াজ খান। এরা দুজন ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন ৫২ সাল পর্যন্ত। শেখ মুজিবের সাথে মতবিরোধ করে তারা ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ ও অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ত্যাগ করে শেরে বাংলার কৃষক-শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন।
১৯৫৬ সালে মাওলানা ভাসানী ও বামপন্থীদের চাপে 'ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ' ও 'অল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' উভয় সংগঠনের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের পর 'ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস লীগ' নাম পরিবর্তন করে হয় 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ'।
১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালের আগ পর্যন্ত দাঙ্গাবাজী আচরণ করার রেকর্ড নেই। তাদের কাজ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রদের অধিকার আদায়। ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবের ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা হলে শুরু হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা। প্রথমে তারা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি দাওয়া নিয়ে ঢাবি শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের ক্যম্পাসে ও কোয়াটারে হেনস্তা করে। এর প্রেক্ষিতে একাংশ গ্রেপ্তার হয়। ভাষা আন্দোলন নিয়েও তারা বাড়িবাড়ি করে। উর্দুপক্ষীয়দের ওপর আক্রমণ করে। সচিবালয়ে আক্রমণ করে।
এর ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকে আজ পর্যন্ত। পাকিস্তান আমল থেকেই ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত। বিপক্ষীদের মারধর, ফাও খাওয়া ও চাঁদাবাজি করা ছিল তাদের আইকনিক কাজ। শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের সভাপতি বানাতে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশকে মারধর করে অফিস থেকে বের করে দেয়। তর্কবাগীশকে বের করে দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে শেখ মুজিব জোরপূর্বক নিজেকে আওয়ামীলীগের সভাপতি ঘোষণা করে।
১৯৬৮ সালে আইয়ুবপন্থী ছাত্রনেতা সাইদুর রহমানকে (পাচপাত্তু) খুন করে ছাত্রলীগ ঢাবিতে খুনের রাজনীতি শুরু করে। স্বাধীনতার পর ৭২ সাল থেকে সকল অপকর্ম শুরু করে ছাত্রলীগ। এর মধ্যে ছাত্র ধর্ষণ, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, মাদক সেবন ও ব্যবসা এবং খুনের মতো সব জঘন্য অপরাধ শুরু করে। এটা এখনো চলমান। ৭৪ সালে ছাত্রলীগ আভ্যন্তরীণ কোন্দলে মহসিন হলে একসাথে ৭ জনকে খুন করে বৃহৎ খুনের নজির স্থাপন করে। ৯৯ সালে জাবিতে শত নারী ধর্ষণ করে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনের মতো ভয়ংকর কাজ করে ছাত্রলীগ নেতা মানিক।
ইডেন মহিলা কলেজের মেয়েদের মধ্যে যাদের ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা নেই এবং যারা বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ রাখে না তারাই বাধ্য হয়ে কলেজের হোস্টেলে থাকতে হয়। হোস্টেলে থাকতে বাধ্য হওয়া মেয়েদের ছাত্রলীগের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হয়। ছাত্রলীগের কথামত না চললে তারা হোস্টেলে থাকতে পারে না।
ছাত্রলীগের নেত্রীরা প্রথমত নতুন ছাত্রীদের থেকে চাঁদা কালেকশন করে। বিভিন্ন মিছিল সমাবেশে তাদের যেতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়ত তাদের মধ্যে যাদের চেহারা ভালো তাদেরকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামীলীদের নেতাদের বাসায় এবং আবাসিক হোটেলে যেতে বাধ্য করে। তৃতীয়ত নতুন ছাত্রীদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক সচেতন তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও দেহব্যবসার লভ্যাংশ দিয়ে লাঠিয়াল বানায়। এই লাঠিয়ালরাই কয়েকবছর পর নেত্রী হয়ে যায় ও উপরোক্ত কাজগুলো করে। এভাবে জঘন্য দেহব্যবসা ও এর নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে মুজিবের ছাত্রলীগ।
বাংলাদেশে এমন কোনো পাবলিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পৌঁছে নি। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের খুনের নজির রয়েছে। এছাড়াও মাদক নেটওয়ার্ক তৈরি, পরীক্ষায় অবৈধ সুবিধা নেওয়া, শিক্ষকদের লাঞ্ছনাসহ হেন কোনো অপরাধ বাকী নেই যা ছাত্রলীগ করে নি। দেশের মেধাবী ছাত্রদের অপরাধ কার্যক্রমে বাধ্য করে তাদের শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত করছে মুজিবের ছাত্রলীগ।
এভাবে শেখ মুজিব একটি ক্যান্সারের জন্ম দিয়ে এদেশের তরুণদের সন্ত্রাসী বানিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনয়ত তরুণরা প্রথমে বাধ্য হয়ে ছাত্রলীগ করে পরে একজন দাগী সন্ত্রাসী হিসেবে আবির্ভূত হয়।
আপনার যে একটা ব্লগ আছে এটা আজকেই প্রথম জানলাম।
উত্তরমুছুনআপনার লেখা ভালো লাগে।