আলী রা. যখন আহত অবস্থায় ছিলেন তখন তাঁকে মুসলিমরা প্রশ্ন করেছিলো, আমরা কার বাইয়াত নিব? আমরা কি হাসান রা.-এর কাছে বাইয়াত নিব? উত্তরে আলী রা. বলেছিলেন, না, তা আমি বলবো না। রাসূলুল্লাহ্ সা. তোমাদেরকে যেমন খলীফা নির্ধারণ না করে রেখে গিয়েছিলেন আমিও তেমনি রেখে যাব।
মহান আল্লাহ্ যদি তোমাদের কল্যাণ চান তাহলে তোমাদের মধ্যে যে শ্রেষ্ঠতম, তাঁর খলীফা নির্ধারণে তিনি তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে দিবেন, যেমন রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর পরে উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির খলীফা নির্বাচনে তিনি তোমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এটাই সঠিক পদ্ধতি। মুসলিমদের নেতা মুসলিমরাই ঠিক করবে। যার ব্যাপারে বেশিরভাগ মুসলিম একমত হবেন তিনিই হবে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ও রাসূল সা.-এর খলিফা।
আলী রা.-এর ইন্তিকালের পর হাসান রা. তাঁর জানাযার নামাযে ইমামতি করলেন। রাজধানীতে তাঁকে দাফন করা হলো। ধারণা করা হয়, এই কথাই সর্বাধিক বিশুদ্ধ। হাসান রা. ও হুসাইন রা. আলী রা.-এর লাশের সাথে শত্রুরা অসম্মান করতে পারে এই ভেবে লাশ দাফন করা হয় গোপনে। তাই আলী রা.-এর কবর নিয়ে একটি ধুম্রজাল রয়েছে।
তিনটি মত আছে এই বিষয়ে। ১. কুফায় দাফন করা হয় ২. রাতের আঁধারে মদিনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ফাতিমা রা.-এর কবরের পাশে দাফন করা হয়। ৩. মদিনায় পাঠানোর সময় লাশবাহী উট হারিয়ে যায়। সেটা আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফে পৌঁছে যায়। সেখানে দাফন করা হয়। তবে সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত মত হলো আলী রা.-এর কবর কুফায়। কুফা ও আফগানিস্তানে আলী রা.-এর মাজার অবস্থিত।
দাফন-কাফন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সমাপ্ত করার পর সর্বপ্রথম কায়স ইবন সা'দ রা. হযরত হাসান রা.-এর সম্মুখে এলেন এবং বললেন, আপনার হাত প্রসারিত করুন। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর সুন্নাত বাস্তবায়নের মর্মে আমি আপনার হাতে বায়'আত করবো। তাঁর এই কথার ওপরে কুফার মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যান। উপস্থিত কেউই এর বিরোধীতা বা ভিন্ন কোনো প্রস্তাব দেননি। তারপর কায়স ইবনে সা'দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর হাতে বায়'আত করেন। এরপর অন্যান্য লোকজন তাঁর হাতে বায়'আত করে।
হযরত হাসান রা. খলীফা হিসেবে কাজ শুরু করেন। কায়স ইব্ন সা'দ ছিলেন আযারবাইজানের গভর্নর। তাঁর অধীনে ছিল চল্লিশ হাজার লড়াকু যোদ্ধা। তারা সকলে আমৃত্যু হযরত আলী রা.-এর প্রতি আনুগত্যের শপথ করেছিল। হাসান রা. দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই মুয়াবিয়া রা.-এর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার জন্য চাপ তৈরি হচ্ছিল। এদিকে মুয়াবিয়া রা. আলী রা.-এর শাহদাতের খবর শোনার পর থেকে কুফা দখলের প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। হাসান রা. সবসময় গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। আলী রা.-এর সাথে সবকয়টি যুদ্ধে অংশ নিলেও তিনি প্রায় সবক'টি যুদ্ধের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন।
এখানেও তাই ঘটেছিল। শুরা সদস্যরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেও তিনি যুদ্ধের জন্য সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন না। অবশেষে মুয়াবিয়া রা.-এর তৎপরতায় তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কায়স ইবনে সা'দের নেতৃত্বে সিরিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো। কায়স রা.-এর অবর্তমানে আজারবাইজানের নতুন গভর্নর করা হয় উবায়দুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস রা.-কে। বিশাল বাহিনী নিয়ে যখন হাসান রা. রওনা হলেন তখন মাদায়েনে সেনাপতি কায়স রা. ইন্তেকালের গুজব তৈরি হয়। এতে সেনাবাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়।
এমনিতেই ব্যক্তিগতভাবে হাসান রা. যুদ্ধ বিরোধী ছিলেন এবং একইসাথে যখন তাঁর নিজের সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খল লক্ষ করলেন, তখন মীমাংসায় রাযী করানোর জন্যে মুআবিয়া রা.-এর নিকট চিঠি লিখলেন। মু'আবিয়া রা. তখন সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা করে এসে পথিমধ্যে অবস্থান করছিলেন। মু'আবিয়া রা. তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে আবদুল্লাহ্ ইব্ন আমীর ও আবদুর রহমান ইব্ন সামুরাকে প্রেরণ করলেন। তারা হাসান রা.-এর সাথে সাক্ষাত করলেন। তারা খিলাফত থেকে সরে দাঁড়ানোর বিনিময়ে হাসান রা. যত ধন- সম্পদ চাইবেন তার সবই প্রদানের প্রস্তাব করলেন।
হাসান রা. এই শর্তে খিলাফতের দাবী পরিত্যাগে রাজি হলেন যে, তাঁকে কুফার বায়তুলমাল থেকে পঞ্চাশ লক্ষ দিরহাম দেওয়া হবে, আবজারাদ অঞ্চলের খাজনা তিনি গ্রহণ করবেন এবং হযরত আলী রা.-এর প্রতি কোনো নিন্দাবাদ যেন তাঁর কানে না আসে। মু'আবিয়া রা. যদি এসব শর্তে রাজি হন তাহলে তিনি মু'আবিয়া রা.-এর পক্ষে খিলাফতের পদ ছেড়ে দিবেন এবং তাতে মুসলমানদের পরস্পরের রক্তপাত বন্ধ হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা এই শর্তে মীমাংসা ও আপোষরফা করলেন এবং মু'আবিয়া রা. একক খলীফা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন।
হাসান রা. ও মুয়াবিয়া রা.-এর মধ্যে চুক্তি লিখিত না হওয়ায় এর সঠিক শব্দগুলো পাওয়া যায় না। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা যায় তা হলো,
১. মুয়াবিয়া রা.-কে হযরত আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, অপবাদ ও প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।
২. জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারগুলোকে অর্থ সাহায্য দিতে হবে।
৩. মুয়াবিয়া রা. কোনো ব্যক্তিকেই (খেলাফতের জন্য) নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করতে পারবেন না। পরবর্তী খলিফা নির্ধারিত হবে শুরা কর্তৃক নির্বাচিত।
৪. মুয়াবিয়া রা.-এর মৃত্যুকালে হাসান রা. জীবিত থাকলে খেলাফতের উত্তরসূরি হবেন হাসান রা.।
হযরত হাসান রা.-এর ভাই হযরত হুসাইন রা. এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন এবং তিনি এই মীমাংসা মেনে নেন নি। সেনাপতি কায়স রা.-ও এই মীমাংসা ও আপোষরফা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি হাসান রা. এবং মু'আবিয়া রা. উভয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন এবং তার অনুগত সৈন্যদেরকে নিয়ে পৃথক সেনা দল গঠন করেন। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পৃথক হয়ে যান।
অবশ্য অল্প কিছুদিন পরে তিনি তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে এবং খলিফা মু'আবিয়া রা.-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাঁর হাতে বায়'আত করে। খলীফা হিসেবে মু'আবিয়া রা.-এর প্রতি হযরত হাসান রা. আনুগত্যের এই ঘটনা ঘটে ৪১ হিজরী সনে। এজন্যে এই বছরটি 'ঐক্যের বছর' নামে প্রসিদ্ধ। যেহেতু এই বছর খলীফারূপে মু'আবিয়া রা.-এর পক্ষে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
মু'আবিয়া রা.-এর পক্ষে হযরত হাসান রা.-এর খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণের ঘটনাটি ঘটেছিল ৪১ হিজরী সনের ৫ই রবিউল আউয়াল তারিখে। এটা মোটামুটি বিশুদ্ধ মত। এই ব্যাপারে কিছু ভিন্নমতও আছে। তারপর মু'আবিয়া রা. কুফা প্রবেশ করেন। তাঁর হাতে সকলে বায়'আত সম্পন্ন হবার পর তিনি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। ইবনে জারির উল্লেখ করেন, আমর ইবনুল আস রা. মু'আবিয়া রা.-কে ইঙ্গিতে বলেছিলেন, যেন হযরত হাসান রা.-কে ভাষণের সুযোগ দেওয়া হয় এবং ভাষণের মাধ্যমে তিনি যেন প্রকাশ্যে সবাইকে জানিয়ে দেন যে, সবাই যেন এখন থেকে মুয়াবিয়া রা.-এর আনুগত্য করে।
মু'আবিয়া রা. হযরত হাসান রা.-কে ভাষণ দানের অনুরোধ করলেন। হযরত হাসান রা. ভাষণ দানের জন্যে দাঁড়ালেন। ভাষণে তিনি আল্লাহ্ প্রশংসা, গুণগান ও রাসূলুল্লাহ্ সা.-এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠের পর বললেন-
//“হে লোক সকল! আমাদের প্রথম ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা আপনাদেরকে সত্য পথের দিশা দান করেছেন। আর আমাদের শেষ ব্যক্তি দ্বারা আপনাদেরকে রক্তপাত থেকে রক্ষা করেছেন। এ বিষয় অর্থাৎ শাসন ক্ষমতার একটি মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। আর দুনিয়া হলো কূপের থেকে পানি তোলার বালতি সদৃশ। কখনো এর হাতে কখনো ওর হাতে।
মহান আল্লাহ্ তাঁর নবীকে সা. বলেছেন, আমি জানি না, হয়ত এটি তোমাদের জন্যে এক পরীক্ষা এবং জীবনের এই ক্ষমতা ভোগ কিছুকালের জন্যে। (সূরা ২১, আম্বিয়া : ১১১)।//
হযরত হাসান রা.-এর এতটুকু কথায় মু'আবিয়া রা. রেগে গেলেন এবং তাঁকে বসে যেতে নির্দেশ দিলেন। তাঁকে আর বক্তব্য দিতে দেননি। বক্তব্য প্রদানের অনুমতি দেয়ার ইঙ্গিত করায় তিনি আমর ইবনুল আস রা.-কেও ভর্ৎসনা করলেন এবং বিষয়টি আজীবন তাঁর মনে অক্ষুণ্ণ ছিল। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
ঐদিন থেকেই বুঝা গিয়েছে মুয়াবিয়া রা. যে চুক্তি করেছেন সেই চুক্তি সংরক্ষণ হবে না। আমরা ইতিহাস থেকে দেখতে পাই মুয়াবিয়া রা. কর্তৃক এই চুক্তিগুলোর মধ্যে ২ নং ছাড়া কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। ইমাম হাসান তিনবার বিষপ্রয়োগের শিকার হলেন। প্রথম দুইবার সুস্থ হলেও তৃতীয়বারে তিনি শহীদ হন।
প্রায়ই জুমুআর খুতবায় আলী রা.-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ও অভিশম্পাত করা হতো। এর বিরুদ্ধে কথা বলায় হুজর বিন আদি রা.-কে হত্যা করা হয় মুয়াবিয়া রা.-এর নির্দেশে। একই ঘটনায় আলী রা.-এর ভাই আকিল রা.-কেও হত্যা করার চেষ্টা করেন। তিনি এক গুহায় মৃত্যবরণ করলে মুয়াবিয়া রা.-এর সৈন্যরা তাঁর মাথা কেটে মুয়াবিয়া রা.-এর কাছে পাঠিয়ে দেয়। মুয়াবিয়া রা. আকিল রা.-এর মাথা সিরিয়ার রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শনী করেন। এরপর বন্দি থাকা আকিল রা.-এর স্ত্রীর কাছে তা প্রেরণ করেন।
মুয়াবিয়া রা. নিজেকে ইসলামের প্রথম বাদশাহ হিসেবে দাবি করতেন। এর আগেও উমার রা.-এর খিলাফতকালে এই আচরণের জন্য তাকে বেত্রাঘাত করতে উদ্যত হয়েছিলেন। মুয়াবিয়া রা. তার জীবদ্দশায় তারই পুত্র ইয়াজিদকে খেলাফতের উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং নেতাদের কাছ থেকে ইয়াজিদের পক্ষে বাইয়াত আদায় করেন। ৪র্থ শর্ত কার্যকর করার সুযোগ ছিল না কারণ তার আগেই হাসান রা. শাহদাতবরণ করেন। হাসান রা.-এর শাহদাতের ব্যাপারে উমাইয়াদের অনেকে দায়ি করলেও সুনির্দিষ্ট প্রমান হাজির করতে পারে নি।
ইয়াজিদ এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি খলিফা হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। শুরা দ্বারা খলিফা নির্বাচনের ব্যাপার হলে তার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হতো না। তিনি ইসলামের বেসিক জ্ঞান, ইনসাফ ও আদল তো দূরের কথা তিনি নামাজ ছেড়ে দিতেন। মদ পান করতেন ও প্রেমাসক্ত কবিতা লিখতেন।
হাসান বসরি রহ. চার কারণে মুয়াবিয়া রা. এর শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করতেন। ১. খলিফা আলী রা.-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তথা হুকুমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ২. হুজর বিন আদি রা.-কে খুন ৩. জিয়াদ বিন আবিহকে নিজের পিতার ঔরশভুক্ত করে নেওয়া (যা হারাম করা হয়েছে সূরা আহজাবের ৫ নং আয়াতে)। ৪. নিজের মদ্যপায়ী সন্তানের অনুকূলে খলিফা হিসেবে বাইয়াত নেওয়া।
মু'আবিয়া রা.-এর সাথে হযরত হাসান রা.-এর সমঝোতা চুক্তি সম্পন্ন হবার পর এক ব্যক্তি হযরত হাসান রা.-কে সম্বোধন করে বললো, 'আপনি মু'মিনদের চেহারায় কালিমা লেপন করেছেন। অথবা লোকটি বলেছে, 'হে মু'মিনদের মুখে কালিমা লেপনকারী ব্যক্তি!' উত্তরে তিনি বললেন, 'মহান আল্লাহ তোমকে দয়া করুন, আমাকে দুঃখ দিও না । কারণ নবী করীম সা.-কে স্বপ্নে দেখানো হয়েছিল যে, তাঁর মিম্বরে বানূ উমাইয়ার লোক বসেছে। এতে তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তখন নাযিল হল- 'আমি অবশ্যই আপনাকে কাওসার দান করেছি। (সূরা-১০৮, কাওসার-১)। অর্থাৎ জান্নাতের কাওসার দান করেছি।
তখন আরো নাযিল হল, আমি এটি অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে আপনি কি জানেন? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। (সূরা-৯৭, কাদর : ১-৩)। এর দ্বারা আল্লাহ্ তাআলা রাসূলুল্লাহ্ সা.-কে বললেন, হে মুহাম্মদ! আপনার পরে বনু উমাইয়া গোত্র খিলাফতের অধিকারী হবে। এর বিনিময়ে আপনাকে কাওসার ও লাইলাতুল কদর দান করা হয়েছে। ইমাম তিরমিজি এই হাদিসটি বর্ণনা করেন।
আবূ আরিফ বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ইমাম হাসান রা.-এর প্রেরণ করা অগ্রবর্তী সেনাদলে আমরা অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। আমরা ছিলাম সংখ্যায় ১২,০০০। সিরিয়াবাসীদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ পরিচালনার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আমরা 'মাসকান-ই-মুসতামীতীন' নামক স্থানে অবস্থান করছিলাম। ইমাম হাসান রা. উমাইয়াদের সাথে সন্ধি স্থাপন করেছেন এই সংবাদ যখন আমাদের নিকট পৌঁছে তখন মনে হচ্ছিল যে, ক্ষোভে-দুঃখে আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। পরে হযরত হাসান রা. যখন কুফায় ফিরে এলেন তখন আবু আমির সাঈদ নামে আমাদের এক লোক তাঁকে সম্বোধন করে বললো,
'হে মু'মিনদেরকে লাঞ্ছিতকারী! আপনাকে সালাম।' হযরত হাসান রা. বললেন, //হে আবু আমির! এমন কথা বলো না। আমি মু'মিনদেরকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করি নি বরং রাজত্বের লোভে মু'মিনদেরকে হত্যা করাকে ঘৃণা করেছি।//
যাই হোক শহর-উপশহরগুলোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর মুআবিয়া রা. কুফায় এলেন এবং সেখানে একটি ভাষণ দিলেন। এ সময়ে সর্বত্র তাঁর প্রতি একক আনুগত্য ঘোষণা করা হল। প্রচণ্ড সাহসী আরব সেনাপতি কায়স ইব্ন সা'দও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। যদিও শুরুতে তিনি মু'আবিয়া রা.-এর বিরুদ্ধাচরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ওই বছরই মু'আবিয়া রা. সর্বত্র একক আনুগত্য অর্জন করেন।
এরপর ইমাম হাসান রা., তাঁর ভাই ইমাম হুসাইন রা., তাঁদের অবশিষ্ট ভাইয়েরা এবং তাঁদের চাচাত ভাই আব্দুল্লাহ্ ইবনে জা'ফর ইরাক থেকে মদীনায় চলে এলেন। মূলত এই কারণেই আলী রা.-এর কবরের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। এসব ঘটনা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে খুলাফায়ে রাশিদার দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি ঘটে।
২১ মে, ২০২৩
১৮ মে, ২০২৩
খিলাফত পর্ব-৪৯ : আলী রা.-এর যেভাবে শহীদ হলেন
![]() |
১৭ মে, ২০২৩
খিলাফত পর্ব-৪৮ : আলী রা.-এর বিরুদ্ধে খারিজিদের বিদ্রোহ
১৪ মে, ২০২৩
সুদানে গৃহযুদ্ধ ও সৌদি সরকারের তেলেসমাতি
![]() |
ছবি : আরএসএফ প্রধান হেমেদতি (বামে), সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল বুরহান (ডানে) |
সুদানের এই সংকট একদিনের নয়। বহু আগ থেকে ব্রিটিশরা এই সংকটের গোড়াপত্তনকারী। আর এখন আমেরিকা এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করে যাচ্ছে।
সুদান আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মিশরের দক্ষিণে এর অবস্থান। ১৮২০ সালে উসমানীয় শাসনের অধীনে আসে পুরো সুদান। উসমানীয়দের মিশরিয় গভর্নর ছিলেন মুহাম্মদ আলী পাশা। তার নেতৃত্বে সুদান উসমানীয় সাম্রাজ্যে যুক্ত হওয়ার পর উসমানীয় সুলতান মাহমুদ সানি আলী পাশার ছেলে তরুণ সেনানায়ক ইসমাঈল পাশাকে সুদানের গভর্নর করেন।
ইসমাঈল পাশার ছেলে তৌফিক ব্রিটিশদের সাথে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে পড়ে। সুদানের পাশাপাশি মিশরেও ব্রিটিশদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৮৭০ সালে মিশরে ব্রিটিশদের পরোক্ষ শাসন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৯ সালে সুদানের শাসক ইসমাঈল পাশাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে তারই ছেলে তৌফিক। তৌফিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেনাবাহিনী ও জনগণের একাংশ। তৌফিক ব্রিটিশদের সাহায্য কামনা করে। এভাবে ব্রিটিশ সৈন্যরা উসমানীয় শাসনে বিনাবাধায় ঢুকে পড়ে।
এ সুযোগে ব্রিটিশরা সুদান তো দখলে নিয়েই আসে তদুপরি ১৮৮২ সালে মিশরও দখল করে নেয়। এরপর সুদানে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। এতে নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ। ১৮৮৫ সালে সুদানে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল গর্ডনের পতন হয়। সুদান থেকে প্রত্যাহার করা হয় মিশরীয় ও ব্রিটিশ সৈন্য।
জিহাদি চেতনায় জনগণকে সংগঠিত করে মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিপ্লব সাধন করেন। ক্ষমতায় আরোহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তিনি মারা যান। এরপর ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ। তিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। আশেপাশে উসমানীয় অঞ্চল না থাকায় তারা কারো সাহায্য পায়নি। তবে সুদানে তারা যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেন। সুদানের দক্ষিণ অঞ্চলের প্রতিবেশি ছিল খ্রিস্টান রাষ্ট্র ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে খ্রিস্টানরা সুদানে এসে দক্ষিণ সুদানের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে এসেছিল ব্রিটিশদের সহায়তায়।
আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ইথিওপিয়া থেকে আক্রমণের হুমকি শুরু হয়েছিল। ফলে আব্দুল্লাহ ১৮৮৭ সালে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে ইথিওপিয়ায় অভিযান চালায় এবং সীমান্তবর্তী বহু অঞ্চল দখলে নিয়ে আসেন। এর দুই বছর পর ১৮৮৯ সালে তিনি মিসরেও অভিযান চালায়। তবে মিসর অভিযানে তিনি ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হন। ১৮৯৩ সালে বেলজিয়াম ও ইতালিয়ানদের সহায়তায় ইথিওপিয়া তার দেশ থেকে থেকে সুদানিদের হটাতে সক্ষম হয়।
১৯৯০ সাল থেকে ব্রিটিশরা নানানভাবে সুদানে বার বার আক্রমণ চালিয়ে আসছিলো। অবশেষে বহু চেষ্টার পর ব্রিটিশরা ১৮৯৯ সালে আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে থাকা সুদানিদের পরাজিত করে। এরপর সুদান ব্রিটিশদের কলোনি হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা সুদানকে দু’টি ভাগে ভাগ করে শাসন করত। দেশটির উত্তরাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্য থেকে গভর্নর করতো এবং দক্ষিণাঞ্চলে খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে গভর্নর করতো। ধীরে ধীরে ইথিওপিয়া থেকে খ্রিস্টানরা এসে দক্ষিণ সুদানের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন করতে শুরু করলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সংখ্যালঘুতে পরিণত হলো। সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সংখ্যাগুরুতে পরিণত হতে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই মিশরীয়রা দাবি করতে থাকে, মিশর ও সুদান এক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু সুদানের নেতারা কোনোভাবেই মিশরের অধীনে যেতে রাজি ছিল না। এদিকে এই সমস্যা সমাধান হতে দেরি হওয়ায় মিশরের স্বাধীনতা বিলম্বিত হতে থাকে। ফলে মিশরের রাজনীতিবিদরা সুদানের দাবি ছেড়ে দিতে রাজি হয় এবং স্বাধীনতাকে তরাণ্বিত করে। ১৯৫৪ সালে মিশরীয়রা ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুসারে ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি সুদান স্বাধীনতা লাভ করে। ইসমাইল আল আজহারি সুদানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক সুদানের প্রথম সরকারের নেতৃত্ব দেন।
তবে স্বাধীনতার এক বছর আগে ১৯৫৫ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের আশঙ্কা, স্বাধীন সুদানে নেতৃত্ব দেবে উত্তরের মুসলমান জনগোষ্ঠী। কারণ উত্তরাঞ্চলের মুসলমানদের সাথে মিশরসহ আরব বিশ্বের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সুদানের দক্ষিণাঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করে ব্রিটিশরা। কিন্তু মুসলিমরা এটা মেনে নেয়নি। এই সমস্যা নিয়ে প্রথম গৃহযুদ্ধ শুরু হয় সুদানে।
এরপর নানান পক্ষ তৈরি হয় সুদানে এবং মারাত্মক গোলযোগ শুরু হয়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলে। ১৯৮৯ সালের ৩০ জুন ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সমর্থন নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটান। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই অভ্যুত্থানে ওমর আল বশির সাধারণ জনগণের একনিষ্ঠ সাপোর্ট পেয়েছেন। এর নেপথ্য নায়ক হাসান আল তুরাবি। তিনি সুদানের ইসলামপন্থী নেতা ছিলেন। হাসান তুরাবি ওমর আল বশিরকে সমর্থন দেন।
ওমর আল বশির সুদানে ইসলামি আইন চালু করেন। হাসান তুরাবিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বানান। তার এই ঘোষণায় বেশিরভাগ মুসলিম যোদ্ধা তার আনুগত্য স্বীকার করে। তিনি সুদানে সুদ নিষিদ্ধ করেন। যে তিনটি রাষ্ট্রে সুদ নিষিদ্ধ এর মধ্যে সুদান একটি। বাকি দুইটি হলো ইরান ও পাকিস্তান।
পাঁচ বছরের মধ্যেই ওমর আল বশির পুরো সুদানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সুদানের প্রেসিডেন্ট হন ওমর আল বশির। একমাত্র প্রার্থী ছিলেন তিনি নিজেই। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। ওমর আল বশির ইসলামী আইন প্রচলন করলেও তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণ কিংবা শুরার তোয়াক্কা করতেন না। বলা যায় তিনি স্বৈরাচার ছিলেন। এদিকে তিনি হাসান তুরাবি তার এইসব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলে হাসান তুরাবিকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে এরেস্ট করেন। হাসান তুরাবির অনুসারীদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়।
মূলত ওমর আল বশির মনে প্রাণে ইসলামিস্ট ছিলেন না। ক্ষমতা দখল করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য যখন হাসিল হলো তখন ইসলামপন্থীদের তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। হাসান তুরাবির অনুসারীরা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বশিরের স্বৈরাচারী আচরণে তিনি জনগণের সমর্থন হারান। দেশের জনগণের সাপোর্ট না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তিনি পশ্চিমাদের কাছে জিম্মি হয়ে যান।
আমেরিকার ইন্ধনে ও অস্ত্র সহায়তায় ২০০৩ সালে দারফুরের মুসলিমরা ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এর বেসিক কারণ ওমর আল বশির আমেরিকার কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়নি। যারাই আমেরিকা ইংল্যান্ডের সহযোগী হয় নাই তাদের দেশে জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে আমেরিকা নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক চক্র। যেমন বাংলাদেশে জেএমবিকে নামিয়ে দিয়েছে।
এছাড়াও দারফুর সংকটের মূলে রয়েছে জাতিগত বিভেদ। ফুর, জাঘাওয়া ও মাসালিত এই তিন উপজাতি মিলে দারফুর লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করেন। সুদান সরকার দারফুরে থাকা আরেক যাযাবর উপজাতি জানজাউইদের সহায়তায় বিদ্রোহ খুব কঠোরভাবে দমন করেন। এই বিষয় নিয়ে ওমর আল বশির আন্তর্জাতিকভাবে বিপদে পড়ে যায়। দারফুর সমস্যা নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র চাদ সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
সুদানের দারফুর এলাকায় বিদ্রোহ দমন করার জন্য বশিরের সরকার যতগুলো সশস্ত্র উপজাতি গোষ্ঠীকে মাঠে নামিয়েছিল, তার একটার নেতৃত্বে ছিলেন মুসা হিলাল নামের এক যুদ্ধবাজ নেতা। মুসা হিলাল দারফুরে তাঁর গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন মোহাম্মাদ হামদান হেমেদতি দাগালোকে। অল্প সময়ের মধ্যেই হেমেদতি নির্দয় ও নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠেন এবং তাঁরই নিয়োগদাতা হিলালের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়েন।
দারফুরের বিপদকে পুঁজি আমেরিকা পুরাতন সমস্যা দক্ষিণ সুদানকে স্বাধীন করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারিতে ওমর আল বশির দক্ষিণ সুদানের নেতাদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। "কমপ্রিহেনসিভ পিস এগ্রিমেন্ট" চুক্তি অনুসারে চুক্তির পর থেকেই দক্ষিণাঞ্চল স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে এবং স্বাধীনতার জন্য ছয় বছর পর গণভোট হবে। কিন্তু চুক্তির পর দক্ষিণের এক নেতা বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে দেশটিতে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
২০০৫ সালের ২৪ মার্চ দেশটিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এ বাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করেন প্রেসিডেন্ট বশির। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। দেশের জনগণের সাপোর্ট না থাকলে বিদেশী সন্ত্রাসীদের খপ্পরে পড়ে যাওয়া খুবই সহজ। জনগণের সাপোর্ট ছিল বিধায় বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ হালে পানি পায়নি। জোট সরকার মাত্র দেড় বছরে জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছে।
২০০৯ সালে দারফুরে গণহত্যার অভিযোগ এনে ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি ২০১০ ও ২০১৫ সালের দুইটি নির্বাচনে বিজয়ী হন। যদিও তার সব নির্বাচন বাংলাদেশের হাসিনা মার্কা নির্বাচন। তার সর্বশেষ নির্বাচন বিরোধীরা বর্জন করে। ২০১১ সালে জানুয়ারিতে স্বাধীনতা ইস্যুতে দক্ষিণ সুদানে গণভোট হয় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। ৯৮% ভোট পড়ে স্বাধীন হওয়ার পক্ষে। ২০১১ সালের ৯ জুলাই দক্ষিণ সুদান একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হয়।
২০১১ সালের পর থেকে সুদানের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খুব খারাপ হতে থাকে। দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যাওয়ায় ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিতে থাকে রাজনীতিবিদ ও জনগণ। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট বশির একটি ডিক্রি জারি করে সব কটি সরকারপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপকে এক করে আরএসএফ গঠন করেন এবং তার প্রধান হিসেবে হেমেদতিকে নিয়োগ দেন। এটা করতে অনুপ্রাণিত হন মূলত সৌদি আরবের চাপে। যখন আরব বসন্ত শুরু হয় তখন সব রাষ্ট্রেই ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় চলে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
হাসান তুরাবির দলও বশিরের বিরুদ্ধে গণভ্যত্থান করে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। এই ভয় দেখিয়ে মিলিশিয়া বাহিনীকে সরকারি বাহিনীতে রূপান্তর করা হয়। তবে শেষ রক্ষা হয় নি বশিরের। এই মিলিশিয়া বাহিনীই তাকে গ্রেপ্তার করে। আরএসএফ ইসলামপন্থীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়।
২০১৫ সালে সুদানের সবচেয়ে বড় বাহিনী হিসেবে আরএসএফ সৌদি আরবের হয়ে ইয়েমেনে যুদ্ধ করতে যায়। বলা বাহুল্য আরএসএফ সরাসরি অর্থায়ন পেতে থাকে সৌদি থেকে। ফলে বশিরকে আনুগত্য করার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না আরএসএফের। ওই যুদ্ধে আরএসএফ ও সৌদির মধ্যে যে কর্মকর্তা মধ্যস্থতা করছিলেন, তিনিই হলেন আজকের সুদানি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান। তিনি এর আগে দারফুরে দীর্ঘ সময় হেমেদতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। হেমেদতি এবং বুরহান দুজনেই সৌদি এবং আমিরাতের নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং ইয়েমেনে লড়াইরত নিজের মিলিশিয়া বাহিনীর কারণে হেমেদতির ভাগ্য খুলে যায়।
২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক উপাদান হিসেবে আরএসএফকে স্বীকৃতি দিয়ে সুদানে একটি আইন পাস করা হয়। সে আইনে বলা হয়, আরএসএফ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত একটি বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। বাহিনীটি সরাসরি প্রেসিডেন্টের আদেশাধীন থাকবে। এর কিছুদিন পরই সেনাবাহিনীর কাছে দুর্নীতি ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট বশির অবিশ্বস্ত হয়ে ওঠায় তিনি খার্তুমে আরএসএফকে একটি সেনাঘাঁটি গড়তে অনুমতি দেন। বশির আরএফএফের ওপর ভর করে বাঁচতে চান। ওই সময় থেকে হেমেদতি আরও ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করতে থাকেন এবং অচিরেই সুদানের সবচেয়ে ধনী লোক হয়ে দাঁড়ান।
২০১৮ সালে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এরকম বিক্ষোভ গত তিরিশ বছরে দেখেনি সুদান। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি এক বছর মেয়াদি জরুরি অবস্থা জারি করেন ওমর আল বশির। তার মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনেন এবং দেশের সব স্টেট সরকারের গভর্নরদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেন।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সুদানে তিন দশক ধরে দায়িত্ব পালন করা ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালের এপ্রিলে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়৷জনগণের বিক্ষোভের পাশাপাশি এতে নেতৃত্ব দেন সেনাপ্রধান বুরহান ও আরএসএফ প্রধান হেমেদতি। এর তিন মাস পর দেশ পরিচালনায় সামরিক ও রাজনৈতিক দলের নিয়োগ দেয়া ব্যক্তিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল৷প্রেসিডেন্ট হয়েছে জেনারেল বুরহান। ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন আয়োজনের কথা ছিল তাদের৷ অন্তবর্তী সরকারে থাকা সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের মধ্যেকার দন্দ্ব গত দুই বছর ধরেই চলে আসছে।
ওমর আল বশিরের ক্ষমতাকালের শেষ কয়েক বছরে সুদানে যে বিভক্তি বাড়ছিল, ২০১৯ সালে তাঁর পতনের পর তা অধিকতর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। আজকের এই অবস্থা সেই বিশৃঙ্খলারই পরিণতি। প্রেসিডেন্ট বশিরের পতন সংকট কাটানোর বদলে আরও ঘনীভূত করেছে। বশিরের পতনের পর ২০১৯ সালে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সার্বভৌম পর্ষদ শাসনক্ষমতা নেয়। হেমেদতিকে এই পর্ষদের উপপ্রধান অর্থাৎ কার্যত ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। এটি হেমেদতির উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
বিক্ষোভকারী জনগণের চাপ ছিল নির্বাচন দেওয়ার। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত হস্তক্ষেপ করে এই নির্বাচন বন্ধ করে। তারা চায় না কোনোভাবেই যাতে হাসান তুরাবির দল 'পপুলার কংগ্রেস পার্টি' ক্ষমতায় না আসতে পারে। এদিকে হেমেদতি আরএসএফকে সেনাবাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি খার্তুম ও ১৭টি প্রদেশে শিবির গড়ে সেখানে প্রায় এক লাখ সেনার অবস্থান ঘটান। তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল মেরোই বিমানবন্দর দখল করে সেখানে বিমানঘাঁটি গড়ে তুলেন।
কয়েক বছর ধরে হেমেদতি সেনাবাহিনীর আদলে অস্ত্রাগার গড়ে চলেছেন। তাঁর অধীন পাইলটদের বিদেশে গিয়ে জঙ্গি বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি তাঁর বাহিনীতে ফাইটার জেট যুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর একটা এয়ারফিল্ড দরকার ছিল। তাঁর সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল সুদানের সশস্ত্র বাহিনী করায়ত্ত করা।
বর্তমান গৃহযুদ্ধ দুইটি কারণে।
১. নির্বাচনকে ঘিরে। অন্তবর্তী সরকারে থাকা কর্মকর্তারা চাপ দেয় নির্বাচন আয়োজন করার। প্রেসিডেন্ট জে. বুরহান সেটা মেনে নেয়। কিন্তু সৌদি-আমিরাত মদদপুষ্ট আরএসএফ প্রধান হেমেদতি এর বিরোধীতা করে।
২. আরএসএফ সৈন্যদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে। হেমেদতির দাবি হলো সে সহ তার বাহিনী সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হবে। বুরহান প্রেসিডেন্ট থাকবে কিন্তু সেনাপ্রধান হবে হেমেদতি। এটা মানতে ঘোর বিরোধী সুদানিজ সেনাবাহিনী।
এর প্রেক্ষিতেই সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। দুই পক্ষই পরষ্পরকেই নিঃশেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। স্পষ্টতই তিনদিনের যুদ্ধে সেনাবাহিনী এগিয়ে আছে। হেমেদতি ব্যাকফুটে গেছে। এই অবস্থায় আবারো দৃশ্যপটে হাজির সৌদি আরব।
সৌদি এবং ইউএই ভয় পাচ্ছে এই লড়াইয়ে যদি হেমেদতি হারে তাহলে জেনারেল বুরহান হয়তো নির্বাচন দিয়ে দেবেন এবং সেই নির্বচনে ইসলামপন্থীরা জিতবে। প্রধানত সে কারণে সৌদিরা মধ্যস্থতা করতে উঠেপড়ে লেগেছে যাতে হেমেদতির আরএসএফ যেন টিকে থাকতে পারে।
তাছাড়া, ২০১৯ সালে বশিরের উৎখাতের পর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষিতে সমৃদ্ধ সুদানে পা রাখার সুযোগ হয় সৌদি আরবের। গত বছর তারা সুদানের কৃষি এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়নে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে তারা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইয়েমেনের সোকোটরা বন্দর থেকে হর্ন অব আফ্রিকার সোমালি-ল্যান্ড পর্যন্ত সাগরপথে বাণিজ্যিক নৌ পরিবহনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে তারা। ডিসেম্বরে আবুধাবি বন্দর কর্তৃপক্ষ পোর্ট অব সুদানের ২০০ মাইল উত্তরে একটি নতুন বন্দর নির্মাণে ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি করেছে।
রিয়াদে এই মীমাংসা বৈঠক আয়োজনের জন্য হেমেদতি সৌদি আরব এবং আমেরিকাকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। এখন মীমাংসা বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়, তার ওপর নির্ভর করবে সুদান স্থিতিশীল হবে কিনা?
১০ মে, ২০২৩
আজ বঙ্গ বিজয়ের দিন
আজ ১০ মে। ১২০৪ সালের এই দিনে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয়। মহাবীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির হাত ধরে আসে এই বিজয়। আল্লাহর রাসূল সা.-এর ওফাতের অল্প কিছুকাল পরেই বঙ্গে সাহাবীরা ও তাবেয়ীরা ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এই অঞ্চলে আসেন। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করতে থাকে।
এভাবে প্রায় ৫০০ বছর পর এই বাংলার একটি বড় অংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলাম গ্রহণের সাথে চলতে থাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের নির্মম নির্যাতন। বাংলার মুসলিমদের ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদী নিষ্ঠুর সেন শাসকদের অত্যাচারের প্রতিবিধানের জন্য বাঙালি মুসলিমরা হিন্দুস্থানের অর্থাৎ দিল্লির মুসলিম শাসকদের কাছে আহবান জানান। বাঙালি মুসলমানদের উদ্ধারের দাবি জানাতে থাকেন।
লক্ষ্মণ সেনের দাদা ও পিতার আমলে হাজার হাজার বাঙালি দাঈ ও মুসলিম সাধারণ জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিক্রমপুরের বাবা আদম শহীদ। একই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে লক্ষ্মণসেনের আমলে। সেসময় হিন্দুস্থানে মুসলিম শাসন থাকলেও তারা বাংলা জয় করতে ব্যর্থ হন। এখানকার রাস্তা ঘাট নদীভিত্তিক হওয়াতে দিল্লি থেকে এসে তাঁরা সুবিধা করতে পারতেন না। সেন রাজবংশ শুধু যে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালাতো তা নয়, তারা একেশ্বরবাদী বৌদ্ধদের ওপরও নির্যাতন চালাতো। আমাদের এই দুরাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে এগিয়ে আসেন তুর্কি বংশদ্ভূত ও আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশে জন্ম নেওয়া মহাবীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি।
এদেশের মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বখতিয়ার খিলজি। ইদানিংকালে কিছু সাহিত্যিক ও বাহ্মণ্যবাদীরা বলতে চান বখতিয়ার কোনটা দুর্গ আর কোনটা বিশ্ববিদ্যালয় তা বুঝতেন না। তিনি দুর্গ মনে করে বৌদ্ধদের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিহারগুলো ধ্বংস করেছিলো। অথচ বৌদ্ধ ঐতিহাসিকরাই জানিয়েছেন বৌদ্ধরা মুসলিমদের স্বাগত জানিয়েছে এদেশে। খিলজিকে বৌদ্ধরা সমগ্র বিহার ও বাংলা অঞ্চল দখল করতে সাহায্য করেছিলো। সুতরাং নালন্দা বিহারসহ অন্যান্য বিহার ধ্বংসের যে অভিযোগ খিলজির উপর আরোপ করা হয়েছে তা পুরোটাই অসত্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। মূলত সেন আমলে আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধদের উপর যে অত্যাচার চালিয়েছিলো তার দায় তারা মুসলিমদের উপর চাপাতে চেয়েছে।
বিহার জয়ের পর বখতিয়ার খলজি কুতুব-উদ্দিন আইবকের সাথে দেখা করতে যান এবং কুতুবউদ্দিন কর্তৃক সম্মানিত হয়ে ফিরে আসেন। এর পরই তিনি বাংলা জয়ের জন্য সাহস এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন। তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেন বাংলার রাজধানী নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন কারণ নদিয়া ছিল সবচেয়ে সুরক্ষিত অঞ্চল। বলা হয়ে থাকে যে নদিয়ায় আসার কিছু আগে রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পণ্ডিত তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এক তুর্কি সৈনিক তাকে পরাজিত করতে পারে। এতে করে লক্ষণ সেনের মনে ভীতির সঞ্চার হয় এবং নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন। লক্ষণ সেনের ধারণা ছিল যে ঝাড়খণ্ডের শ্বাপদশংকুল অরণ্য দিয়ে কোনো সৈন্যবাহিনীর পক্ষে নদিয়া আক্রমণ করা সম্ভব নয় কিন্তু বখতিয়ার সেইপথেই তার সৈন্যবাহিনীকে নিয়ে আসেন। নদিয়া অভিযানকালে বখতিয়ার ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে এত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে তার সাথে মাত্র ১৮ জন সৈনিকই তাল মেলাতে পেরেছিলেন।
বখতিয়ার সোজা রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করেন। এতে প্রাসাদের ভিতরে হইচই পড়ে যায় এবং লক্ষণ সেন দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন। নদিয়া জয় করে পরবর্তীতে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসহ হন এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন। এই লক্ষণাবতীই পরবর্তীকালে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়। গৌড় জয়ের পর আরও পূর্বদিকে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি এলাকাগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে একজন করে সেনাপতিকে শাসণভার অর্পণ করেন। বখতিয়ারের সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে দুজনের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে আলি মর্দান খলজি বরসৌলে, হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি গঙ্গতরীর শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। লাখনৌতিকে কেন্দ্র করে বাংলার নব প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের সীমানা ছিল উত্তরে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পুর্নিয়া শহর, দেবকোট থেকে রংপুর শহর, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে তিস্তা ও কারতোয়া, দক্ষিণে গঙ্গার মূলধারা (পদ্মা) এবং পশ্চিমে কুশী নদীর নিম্নাঞ্চল থেকে গঙ্গার কিনারায় রাজমহল পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। পরবর্তী একশ’ বছরের মধ্যে বাংলার প্রায় সমগ্র এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে আসে।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছরের মুসলিম শাসন শুরু হয়। এই আমলই ছিলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সময়। শিক্ষা, সভ্যতায় ও সম্পদে বাংলা হয়ে উঠেছিলো পৃথিবী বিখ্যাত স্থান। সারা পৃথিবীতে থেকে পর্যটক ও অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিরা বাংলায় আসতেন বাংলার রূপ, রস, সৌন্দর্য ও গন্ধ উপভোগ করতে। ভারতে মুসলিম বিজয় সম্পর্কে গোপাল হালদার মন্তব্য করেন, “ইসলামের বলিষ্ঠ ও সরল একেশ্বরবাদ এবং জাতিভেদহীন সাম্যদৃষ্টির কাছে ভারতীয় জীবনধারা ও সংস্কৃতির………. এ পরাজয় রাষ্ট্র-শক্তির কাছে নয়, ইসলামের উদার নীতি ও আত্ম-সচেতনতার কাছে। ………. কারণ ইসলাম কোন জাতির ধর্ম নয়, প্রচারশীল ধর্ম। ইহা অন্যকে জয় করেই ক্ষান্ত হয় না, কোলে তুলে নেয়”। (সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃষ্ঠা ১৯৬)
ভারতে বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির ব্যর্থতা ও ইসলামী সংস্কৃতির বিজয়ের কারণ চিহ্নিত করে কমরেড এম. এন. রায় ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ নামক গ্রন্হে লিখেছেন, “ভারতে বৌদ্ধ বিপ্লবের পরাজয় ঘটেনি বরং তার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্যই তা ব্যর্থ হয়েছে। সেই বিপ্লবকে জয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজ-শক্তি তেমনভাবে দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। তার ফল হলো এই য, বৌদ্ধ মতবাদের পতনের সঙ্গে-সঙ্গেই সমগ্র দেশ অর্থনৈতিক দুর্গতি, রাজনৈতিক অত্যাচার, বিচার-বুদ্ধির স্বেচ্ছাচারিতা আর আধ্যাত্মিক স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে ডুবে গেল। বাস্তবিকপক্ষে সমগ্র সমাজ তখন ধ্বংস ও বিলুপ্তির ভয়াবহ কবলে পড়ে গেছে। এজন্য নিপীড়ত জনগণ ইসলামের পতাকার নীচে এসে ভীড় করে দাঁড়াল……….। ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা ভারতীয় জনগণের সমর্থন লাভ করল। তার কারণ তার পিছনে জীবনের প্রতি সে দৃষ্টিবঙ্গি ছিল, হিন্দু দর্শনের চাইতে তা ছিল শ্রেয়; কেননা হিন্দু দর্শন সমাজদেহে এনেছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা আর ইসলামই তা থেকে ভারতীয় জনসাধারণেকে মুক্তির পথ দেখায়”।(পৃষ্ঠা ৬১-৬২)
মুসলিম শাসন আমল বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গঠনমূলক যুগ হিসেবে ঐতিহাসিকদের বিবেচনা লাভ করেছে। এ জনপদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ যুগেই একটি উন্নত ও সংহত রূপ লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে এ যুগেই বাংলার জনগণ একটি আদর্শের ভিত্তিতে সামাজিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ হয়। বাংলা ভাষা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তিও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে ড. এম এ রহীমের মন্তব্য, “যদি বাংলায় মুসলিম বিজয় ত্বরান্বিত না হতো এবং এ প্রদেশে আর কয়েক শতকের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন অব্যাহত থাকত, তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত এবং অথীতের গর্ভে নিমজ্জিত হতো”। (বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, ভূমিকা)
৯ মে, ২০২৩
মাওলানা আবু তাহের : আমাদের নেতা
আজ ৯ মে। ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবু তাহেরের আজ ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী।