১৪ মে, ২০২৩

সুদানে গৃহযুদ্ধ ও সৌদি সরকারের তেলেসমাতি

ছবি : আরএসএফ প্রধান হেমেদতি (বামে), সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল বুরহান (ডানে)

সুদানের এই সংকট একদিনের নয়। বহু আগ থেকে ব্রিটিশরা এই সংকটের গোড়াপত্তনকারী। আর এখন আমেরিকা এই সংকটকে দীর্ঘায়িত করে যাচ্ছে।


সুদান আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মিশরের দক্ষিণে এর অবস্থান। ১৮২০ সালে উসমানীয় শাসনের অধীনে আসে পুরো সুদান। উসমানীয়দের মিশরিয় গভর্নর ছিলেন মুহাম্মদ আলী পাশা। তার নেতৃত্বে সুদান উসমানীয় সাম্রাজ্যে যুক্ত হওয়ার পর উসমানীয় সুলতান মাহমুদ সানি আলী পাশার ছেলে তরুণ সেনানায়ক ইসমাঈল পাশাকে সুদানের গভর্নর করেন।

ইসমাঈল পাশার ছেলে তৌফিক ব্রিটিশদের সাথে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে পড়ে। সুদানের পাশাপাশি মিশরেও ব্রিটিশদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৮৭০ সালে মিশরে ব্রিটিশদের পরোক্ষ শাসন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৯ সালে সুদানের শাসক ইসমাঈল পাশাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে তারই ছেলে তৌফিক। তৌফিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সেনাবাহিনী ও জনগণের একাংশ। তৌফিক ব্রিটিশদের সাহায্য কামনা করে। এভাবে ব্রিটিশ সৈন্যরা উসমানীয় শাসনে বিনাবাধায় ঢুকে পড়ে।

এ সুযোগে ব্রিটিশরা সুদান তো দখলে নিয়েই আসে তদুপরি ১৮৮২ সালে মিশরও দখল করে নেয়। এরপর সুদানে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। এতে নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ। ১৮৮৫ সালে সুদানে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল গর্ডনের পতন হয়। সুদান থেকে প্রত্যাহার করা হয় মিশরীয় ও ব্রিটিশ সৈন্য।

জিহাদি চেতনায় জনগণকে সংগঠিত করে মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিপ্লব সাধন করেন। ক্ষমতায় আরোহণের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তিনি মারা যান। এরপর ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ। তিনি নিজেকে খলিফা ঘোষণা করেন। আশেপাশে উসমানীয় অঞ্চল না থাকায় তারা কারো সাহায্য পায়নি। তবে সুদানে তারা যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেন। সুদানের দক্ষিণ অঞ্চলের প্রতিবেশি ছিল খ্রিস্টান রাষ্ট্র ইথিওপিয়া। ইথিওপিয়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে খ্রিস্টানরা সুদানে এসে দক্ষিণ সুদানের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে এসেছিল ব্রিটিশদের সহায়তায়।

আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ইথিওপিয়া থেকে আক্রমণের হুমকি শুরু হয়েছিল। ফলে আব্দুল্লাহ ১৮৮৭ সালে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে ইথিওপিয়ায় অভিযান চালায় এবং সীমান্তবর্তী বহু অঞ্চল দখলে নিয়ে আসেন। এর দুই বছর পর ১৮৮৯ সালে তিনি মিসরেও অভিযান চালায়। তবে মিসর অভিযানে তিনি ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হন। ১৮৯৩ সালে বেলজিয়াম ও ইতালিয়ানদের সহায়তায় ইথিওপিয়া তার দেশ থেকে থেকে সুদানিদের হটাতে সক্ষম হয়।

১৯৯০ সাল থেকে ব্রিটিশরা নানানভাবে সুদানে বার বার আক্রমণ চালিয়ে আসছিলো। অবশেষে বহু চেষ্টার পর ব্রিটিশরা ১৮৯৯ সালে আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে থাকা সুদানিদের পরাজিত করে। এরপর সুদান ব্রিটিশদের কলোনি হিসেবে পরিচিত হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা সুদানকে দু’টি ভাগে ভাগ করে শাসন করত। দেশটির উত্তরাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্য থেকে গভর্নর করতো এবং দক্ষিণাঞ্চলে খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে গভর্নর করতো। ধীরে ধীরে ইথিওপিয়া থেকে খ্রিস্টানরা এসে দক্ষিণ সুদানের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন করতে শুরু করলো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সংখ্যালঘুতে পরিণত হলো। সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সংখ্যাগুরুতে পরিণত হতে থাকে।

ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই মিশরীয়রা দাবি করতে থাকে, মিশর ও সুদান এক রাষ্ট্র হবে। কিন্তু সুদানের নেতারা কোনোভাবেই মিশরের অধীনে যেতে রাজি ছিল না। এদিকে এই সমস্যা সমাধান হতে দেরি হওয়ায় মিশরের স্বাধীনতা বিলম্বিত হতে থাকে। ফলে মিশরের রাজনীতিবিদরা সুদানের দাবি ছেড়ে দিতে রাজি হয় এবং স্বাধীনতাকে তরাণ্বিত করে। ১৯৫৪ সালে মিশরীয়রা ব্রিটিশদের সাথে একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুসারে ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি সুদান স্বাধীনতা লাভ করে। ইসমাইল আল আজহারি সুদানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক সুদানের প্রথম সরকারের নেতৃত্ব দেন।

তবে স্বাধীনতার এক বছর আগে ১৯৫৫ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের আশঙ্কা, স্বাধীন সুদানে নেতৃত্ব দেবে উত্তরের মুসলমান জনগোষ্ঠী। কারণ উত্তরাঞ্চলের মুসলমানদের সাথে মিশরসহ আরব বিশ্বের সুসম্পর্ক রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সুদানের দক্ষিণাঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করে ব্রিটিশরা। কিন্তু মুসলিমরা এটা মেনে নেয়নি। এই সমস্যা নিয়ে প্রথম গৃহযুদ্ধ শুরু হয় সুদানে।

এরপর নানান পক্ষ তৈরি হয় সুদানে এবং মারাত্মক গোলযোগ শুরু হয়। ১৯৫৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলে। ১৯৮৯ সালের ৩০ জুন ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সমর্থন নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটান। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই অভ্যুত্থানে ওমর আল বশির সাধারণ জনগণের একনিষ্ঠ সাপোর্ট পেয়েছেন। এর নেপথ্য নায়ক হাসান আল তুরাবি। তিনি সুদানের ইসলামপন্থী নেতা ছিলেন। হাসান তুরাবি ওমর আল বশিরকে সমর্থন দেন।

ওমর আল বশির সুদানে ইসলামি আইন চালু করেন। হাসান তুরাবিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বানান। তার এই ঘোষণায় বেশিরভাগ মুসলিম যোদ্ধা তার আনুগত্য স্বীকার করে। তিনি সুদানে সুদ নিষিদ্ধ করেন। যে তিনটি রাষ্ট্রে সুদ নিষিদ্ধ এর মধ্যে সুদান একটি। বাকি দুইটি হলো ইরান ও পাকিস্তান।

পাঁচ বছরের মধ্যেই ওমর আল বশির পুরো সুদানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সুদানের প্রেসিডেন্ট হন ওমর আল বশির। একমাত্র প্রার্থী ছিলেন তিনি নিজেই। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। ওমর আল বশির ইসলামী আইন প্রচলন করলেও তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণ কিংবা শুরার তোয়াক্কা করতেন না। বলা যায় তিনি স্বৈরাচার ছিলেন। এদিকে তিনি হাসান তুরাবি তার এইসব কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলে হাসান তুরাবিকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে এরেস্ট করেন। হাসান তুরাবির অনুসারীদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়।

মূলত ওমর আল বশির মনে প্রাণে ইসলামিস্ট ছিলেন না। ক্ষমতা দখল করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য যখন হাসিল হলো তখন ইসলামপন্থীদের তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। হাসান তুরাবির অনুসারীরা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বশিরের স্বৈরাচারী আচরণে তিনি জনগণের সমর্থন হারান। দেশের জনগণের সাপোর্ট না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তিনি পশ্চিমাদের কাছে জিম্মি হয়ে যান।

আমেরিকার ইন্ধনে ও অস্ত্র সহায়তায় ২০০৩ সালে দারফুরের মুসলিমরা ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এর বেসিক কারণ ওমর আল বশির আমেরিকার কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অংশ নেয়নি। যারাই আমেরিকা ইংল্যান্ডের সহযোগী হয় নাই তাদের দেশে জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে আমেরিকা নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক চক্র। যেমন বাংলাদেশে জেএমবিকে নামিয়ে দিয়েছে।

এছাড়াও দারফুর সংকটের মূলে রয়েছে জাতিগত বিভেদ। ফুর, জাঘাওয়া ও মাসালিত এই তিন উপজাতি মিলে দারফুর লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করেন। সুদান সরকার দারফুরে থাকা আরেক যাযাবর উপজাতি জানজাউইদের সহায়তায় বিদ্রোহ খুব কঠোরভাবে দমন করেন। এই বিষয় নিয়ে ওমর আল বশির আন্তর্জাতিকভাবে বিপদে পড়ে যায়। দারফুর সমস্যা নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র চাদ সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
সুদানের দারফুর এলাকায় বিদ্রোহ দমন করার জন্য বশিরের সরকার যতগুলো সশস্ত্র উপজাতি গোষ্ঠীকে মাঠে নামিয়েছিল, তার একটার নেতৃত্বে ছিলেন মুসা হিলাল নামের এক যুদ্ধবাজ নেতা। মুসা হিলাল দারফুরে তাঁর গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন মোহাম্মাদ হামদান হেমেদতি দাগালোকে। অল্প সময়ের মধ্যেই হেমেদতি নির্দয় ও নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠেন এবং তাঁরই নিয়োগদাতা হিলালের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়েন।

দারফুরের বিপদকে পুঁজি আমেরিকা পুরাতন সমস্যা দক্ষিণ সুদানকে স্বাধীন করার প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৫ সালের ৯ জানুয়ারিতে ওমর আল বশির দক্ষিণ সুদানের নেতাদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। "কমপ্রিহেনসিভ পিস এগ্রিমেন্ট" চুক্তি অনুসারে চুক্তির পর থেকেই দক্ষিণাঞ্চল স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে এবং স্বাধীনতার জন্য ছয় বছর পর গণভোট হবে। কিন্তু চুক্তির পর দক্ষিণের এক নেতা বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে দেশটিতে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

২০০৫ সালের ২৪ মার্চ দেশটিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এ বাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করেন প্রেসিডেন্ট বশির। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। দেশের জনগণের সাপোর্ট না থাকলে বিদেশী সন্ত্রাসীদের খপ্পরে পড়ে যাওয়া খুবই সহজ। জনগণের সাপোর্ট ছিল বিধায় বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ হালে পানি পায়নি। জোট সরকার মাত্র দেড় বছরে জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছে।

২০০৯ সালে দারফুরে গণহত্যার অভিযোগ এনে ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি ২০১০ ও ২০১৫ সালের দুইটি নির্বাচনে বিজয়ী হন। যদিও তার সব নির্বাচন বাংলাদেশের হাসিনা মার্কা নির্বাচন। তার সর্বশেষ নির্বাচন বিরোধীরা বর্জন করে। ২০১১ সালে জানুয়ারিতে স্বাধীনতা ইস্যুতে দক্ষিণ সুদানে গণভোট হয় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। ৯৮% ভোট পড়ে স্বাধীন হওয়ার পক্ষে। ২০১১ সালের ৯ জুলাই দক্ষিণ সুদান একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হয়।

২০১১ সালের পর থেকে সুদানের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খুব খারাপ হতে থাকে। দক্ষিণ সুদান আলাদা হয়ে যাওয়ায় ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিতে থাকে রাজনীতিবিদ ও জনগণ। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট বশির একটি ডিক্রি জারি করে সব কটি সরকারপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপকে এক করে আরএসএফ গঠন করেন এবং তার প্রধান হিসেবে হেমেদতিকে নিয়োগ দেন। এটা করতে অনুপ্রাণিত হন মূলত সৌদি আরবের চাপে। যখন আরব বসন্ত শুরু হয় তখন সব রাষ্ট্রেই ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় চলে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

হাসান তুরাবির দলও বশিরের বিরুদ্ধে গণভ্যত্থান করে ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। এই ভয় দেখিয়ে মিলিশিয়া বাহিনীকে সরকারি বাহিনীতে রূপান্তর করা হয়। তবে শেষ রক্ষা হয় নি বশিরের। এই মিলিশিয়া বাহিনীই তাকে গ্রেপ্তার করে। আরএসএফ ইসলামপন্থীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়।

২০১৫ সালে সুদানের সবচেয়ে বড় বাহিনী হিসেবে আরএসএফ সৌদি আরবের হয়ে ইয়েমেনে যুদ্ধ করতে যায়। বলা বাহুল্য আরএসএফ সরাসরি অর্থায়ন পেতে থাকে সৌদি থেকে। ফলে বশিরকে আনুগত্য করার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না আরএসএফের। ওই যুদ্ধে আরএসএফ ও সৌদির মধ্যে যে কর্মকর্তা মধ্যস্থতা করছিলেন, তিনিই হলেন আজকের সুদানি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান। তিনি এর আগে দারফুরে দীর্ঘ সময় হেমেদতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। হেমেদতি এবং বুরহান দুজনেই সৌদি এবং আমিরাতের নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং ইয়েমেনে লড়াইরত নিজের মিলিশিয়া বাহিনীর কারণে হেমেদতির ভাগ্য খুলে যায়।

২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক উপাদান হিসেবে আরএসএফকে স্বীকৃতি দিয়ে সুদানে একটি আইন পাস করা হয়। সে আইনে বলা হয়, আরএসএফ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত একটি বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। বাহিনীটি সরাসরি প্রেসিডেন্টের আদেশাধীন থাকবে। এর কিছুদিন পরই সেনাবাহিনীর কাছে দুর্নীতি ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট বশির অবিশ্বস্ত হয়ে ওঠায় তিনি খার্তুমে আরএসএফকে একটি সেনাঘাঁটি গড়তে অনুমতি দেন। বশির আরএফএফের ওপর ভর করে বাঁচতে চান। ওই সময় থেকে হেমেদতি আরও ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করতে থাকেন এবং অচিরেই সুদানের সবচেয়ে ধনী লোক হয়ে দাঁড়ান।

২০১৮ সালে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এরকম বিক্ষোভ গত তিরিশ বছরে দেখেনি সুদান। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি এক বছর মেয়াদি জরুরি অবস্থা জারি করেন ওমর আল বশির। তার মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনেন এবং দেশের সব স্টেট সরকারের গভর্নরদের সরিয়ে দিয়ে সেখানে সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বসিয়ে দেন।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সুদানে তিন দশক ধরে দায়িত্ব পালন করা ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালের এপ্রিলে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়৷জনগণের বিক্ষোভের পাশাপাশি এতে নেতৃত্ব দেন সেনাপ্রধান বুরহান ও আরএসএফ প্রধান হেমেদতি। এর তিন মাস পর দেশ পরিচালনায় সামরিক ও রাজনৈতিক দলের নিয়োগ দেয়া ব্যক্তিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছিল৷প্রেসিডেন্ট হয়েছে জেনারেল বুরহান। ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন আয়োজনের কথা ছিল তাদের৷ অন্তবর্তী সরকারে থাকা সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের মধ্যেকার দন্দ্ব গত দুই বছর ধরেই চলে আসছে।

ওমর আল বশিরের ক্ষমতাকালের শেষ কয়েক বছরে সুদানে যে বিভক্তি বাড়ছিল, ২০১৯ সালে তাঁর পতনের পর তা অধিকতর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। আজকের এই অবস্থা সেই বিশৃঙ্খলারই পরিণতি। প্রেসিডেন্ট বশিরের পতন সংকট কাটানোর বদলে আরও ঘনীভূত করেছে। বশিরের পতনের পর ২০১৯ সালে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সার্বভৌম পর্ষদ শাসনক্ষমতা নেয়। হেমেদতিকে এই পর্ষদের উপপ্রধান অর্থাৎ কার্যত ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। এটি হেমেদতির উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

বিক্ষোভকারী জনগণের চাপ ছিল নির্বাচন দেওয়ার। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত হস্তক্ষেপ করে এই নির্বাচন বন্ধ করে। তারা চায় না কোনোভাবেই যাতে হাসান তুরাবির দল 'পপুলার কংগ্রেস পার্টি' ক্ষমতায় না আসতে পারে। এদিকে হেমেদতি আরএসএফকে সেনাবাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি খার্তুম ও ১৭টি প্রদেশে শিবির গড়ে সেখানে প্রায় এক লাখ সেনার অবস্থান ঘটান। তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল মেরোই বিমানবন্দর দখল করে সেখানে বিমানঘাঁটি গড়ে তুলেন।

কয়েক বছর ধরে হেমেদতি সেনাবাহিনীর আদলে অস্ত্রাগার গড়ে চলেছেন। তাঁর অধীন পাইলটদের বিদেশে গিয়ে জঙ্গি বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি তাঁর বাহিনীতে ফাইটার জেট যুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর একটা এয়ারফিল্ড দরকার ছিল। তাঁর সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল সুদানের সশস্ত্র বাহিনী করায়ত্ত করা।

বর্তমান গৃহযুদ্ধ দুইটি কারণে।
১. নির্বাচনকে ঘিরে। অন্তবর্তী সরকারে থাকা কর্মকর্তারা চাপ দেয় নির্বাচন আয়োজন করার। প্রেসিডেন্ট জে. বুরহান সেটা মেনে নেয়। কিন্তু সৌদি-আমিরাত মদদপুষ্ট আরএসএফ প্রধান হেমেদতি এর বিরোধীতা করে।
২. আরএসএফ সৈন্যদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে। হেমেদতির দাবি হলো সে সহ তার বাহিনী সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হবে। বুরহান প্রেসিডেন্ট থাকবে কিন্তু সেনাপ্রধান হবে হেমেদতি। এটা মানতে ঘোর বিরোধী সুদানিজ সেনাবাহিনী।

এর প্রেক্ষিতেই সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। দুই পক্ষই পরষ্পরকেই নিঃশেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। স্পষ্টতই তিনদিনের যুদ্ধে সেনাবাহিনী এগিয়ে আছে। হেমেদতি ব্যাকফুটে গেছে। এই অবস্থায় আবারো দৃশ্যপটে হাজির সৌদি আরব।

সৌদি এবং ইউএই ভয় পাচ্ছে এই লড়াইয়ে যদি হেমেদতি হারে তাহলে জেনারেল বুরহান হয়তো নির্বাচন দিয়ে দেবেন এবং সেই নির্বচনে ইসলামপন্থীরা জিতবে। প্রধানত সে কারণে সৌদিরা মধ্যস্থতা করতে উঠেপড়ে লেগেছে যাতে হেমেদতির আরএসএফ যেন টিকে থাকতে পারে।

তাছাড়া, ২০১৯ সালে বশিরের উৎখাতের পর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষিতে সমৃদ্ধ সুদানে পা রাখার সুযোগ হয় সৌদি আরবের। গত বছর তারা সুদানের কৃষি এবং খনিজ সম্পদ উন্নয়নে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে তারা।

সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইয়েমেনের সোকোটরা বন্দর থেকে হর্ন অব আফ্রিকার সোমালি-ল্যান্ড পর্যন্ত সাগরপথে বাণিজ্যিক নৌ পরিবহনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে তারা। ডিসেম্বরে আবুধাবি বন্দর কর্তৃপক্ষ পোর্ট অব সুদানের ২০০ মাইল উত্তরে একটি নতুন বন্দর নির্মাণে ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি করেছে।

রিয়াদে এই মীমাংসা বৈঠক আয়োজনের জন্য হেমেদতি সৌদি আরব এবং আমেরিকাকে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। এখন মীমাংসা বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয়, তার ওপর নির্ভর করবে সুদান স্থিতিশীল হবে কিনা?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন