১৭ জুল, ২০২৩

যেভাবে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার এলো! (পর্ব - ০৩)

১৯৯৪ সালে জামায়াত পড়েছে মহাবিপদে। একদিকে বিএনপির স্বৈরাচারী আচরণ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেয়ারটেকার আন্দোলন। কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন যতটা না আওয়ামী লীগের তার চাইতে বেশি জামায়াতের।

প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের হাতে থেকেছে। জামায়াতের সংকট হলো, কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতির উদ্ভাবক হলেও আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পেছনেই পড়ে থাকতে বাধ্য হবে। রাজনৈতিক ও আদর্শিক দিক থেকে জামায়াতের জন্য এ অবস্থান মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আন্দোলনে জামায়াত যত বলিষ্ঠ ভূমিকাই পালন করুক, জনগণ জামায়াতকে আওয়ামী লীগের লেজুড় বলেই ধারণা করবে।

এই বিষয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //ভারতবিরোধী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর যে ইমেজ রয়েছে তা দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জামায়াতের মতো একটি ইসলামী দলকে আওয়ামী লীগের মতো ইসলামবিরোধী দলের নেতৃত্বে আন্দোলন করতে দেখলে কিছু লোক এ ভুল ধারণাও করতে পারে যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ হয়ত ১৯৭৫-পূর্ব আওয়ামী লীগের মতো ইসলামের দুশমন নয়।//

১৯৯০ সালে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী যুগপৎভাবে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা কায়েমের দাবিতে আন্দোলন করলেও সে আন্দোলন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত ছিল না। বিএনপি ইসলামী দল না হলেও জনগণের নিকট ইসলামবিরোধী হিসেবে গণ্য নয়। তাই বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনো আন্দোলনে জামায়াতের শরিক হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //ঐ সময় মানসিক দিক দিয়ে আমি এত বেশি পেরেশান ছিলাম, সে কথা মনে হলে এখনও বেদনাবোধ করি। রাজনৈতিক আন্দোলনে কোনো সময় আমি এমন কঠিন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। যেহেতু কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু জামায়াতের সৃষ্টি, সেহেতু আওয়ামী লীগ এ দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে জামায়াতের পক্ষে নিশ্চুপ থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর জামায়াত আন্দোলনে শরিক না হলে রাজনৈতিক ময়দান থেকে চিরবিদায় নিতে বাধ্য হবে।//

এ মহাসংকট থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও সংসদে জামায়াতের পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আলাদাভাবে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। তাঁকে সংগঠনের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি যেন কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে খালেদা জিয়াকে বুঝিয়ে বলেন।

শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে জাতীয় সংসদনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তাঁর দফতরে একান্তে সাক্ষাৎ করে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, //১৯৯০ সালে এরশাদের আমলে কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আপনার সাথে মিলে যুগপৎ আন্দোলন করেছি। আন্দোলন সফল হয়েছিল বলেই কেয়ারটেকার সরকার কায়েম হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচন আমাদের দাবি অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নির্বাচনে আপনি সর্বোচ্চসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়েছেন। কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন না হলে আপনি কিছুতেই এত আসনে বিজয়ী হতে সক্ষম হতেন না। কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতির বদৌলতেই আপনার উত্থান। আমরা আশা করেছিলাম, নিরপেক্ষ নির্বাচনের নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে আপনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সংসদে বিল উত্থাপন করে এ চমৎকার পদ্ধতিটি সংবিধানে সংযোজনের ব্যবস্থা করবেন। আমরা '৯১ সালেই বিল জমা দিয়েছি। অন্যান্য বিরোধী দলও এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দিয়েছে।

কিন্তু সংসদে এ বিষয়টি আলোচনার কোনো ব্যবস্থা এ পর্যন্ত হলো না। বাধ্য হয়ে সংসদের বাইরে সকল বিরোধী দল এর পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছে। জনগণ এ বিষয়ে অবহিত যে, বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা দাবি করছে আর সরকারি দল এ দাবিকে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করে চলেছে।

মাগুরা জেলার মুহাম্মদপুর আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা ঘোষণা করেছে যে, এ সরকারের পরিচালনায় আর কোনো নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। তারা এখন কেয়ারটেকার সরকার সংবিধানে সংযোজনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, এমনকি সংসদ বয়কট করারও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।//

নিজামী সাহেব বলেন, //কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু ছাড়া আওয়ামী লীগের নিকট অন্য কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নেই। জনগণকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো কর্মসূচিও তাদের হাতে আছে বলে মনে হয় না। কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের দাবি মেনে নিয়ে এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায়, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল এ দাবিতে একমত হওয়ায় এবং এর ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ দাবি বিশাল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ দাবিতে আবার আন্দোলন হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপুলসংখ্যায় সাড়া দেবে বলে ধারণা করা যায়।

আমরা নিশ্চিত যে, কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন হলে আগামী নির্বাচনে আপনি আরো বেশি আসনে বিজয়ী হবেন। নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কিছুতেই অধিকাংশ আসন পাবে না। তাই আপনি এ জনপ্রিয় ইস্যু আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দেবেন না। আপনি স্বয়ং উদ্যোগ নিয়ে এটাকে সংবিধানে সংযোজনের ব্যবস্থা করুন। এত বড় একটা হাতিয়ার হাতছাড়া করবেন না।

আপনি জানেন, এ ইস্যুটি জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি। এ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করলে জামায়াত তাতে শরিক হতে বাধ্য হবে। জামায়াত কিছুতেই আপনার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলনে যেতে চায় না। আপনি আমাদেরকে আওয়ামী লীগের দিকে ঠেলে দেবেন না। আমাদেরকে আপনার রাজনৈতিক দুশমনে পরিণত করবেন না।

আওয়ামী লীগ সংসদ বয়কটের ঘোষণা দেবে বলে মনে হচ্ছে। এর আগেই যদি কেয়ারটেকার সরকার ইস্যু নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে বলে আপনি ঘোষণা দেন, তাহলে সংসদের আগামী অধিবেশনে আমরা যোগদান করব। তখন আওয়ামী লীগও সংসদে যেতে বাধ্য হবে। আপনি এ সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগ আপনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আর কোনো জনপ্রিয় ইস্যুই পাবে না। আমি বড় আশা নিয়ে আপনার নিকট হাজির হয়েছি।//

নিজামী সাহেবের দীর্ঘ যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনলেও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর পূর্বসিদ্ধান্তে অটল থেকেছিলেন। তিনি বেশি কিছু বলেননি। নিজামী সাহেবের কোনো যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টাও করেননি। অত্যন্ত দাম্ভিকতার সুরে আঙুল উচিয়ে নিজ মুখের দিকে ইশারা করে উচ্চারণ করেছিলেন, “এ মুখ দিয়ে ‘কেয়ারটেকার সরকার' উচ্চারণ হবে না।”

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //হতাশা ও দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজামী সাহেব আমাকে যখন রিপোর্ট দিয়েছিলেন তখন আমার পেরেশানি আরো বেড়ে গিয়েছিল। আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে ভেবেছিলাম, বেগম জিয়া এত বড় ভুল সিদ্ধান্ত কেমন করে নিলেন? কার কুপরামর্শে তিনি কেয়ারটেকার সরকার ফর্মুলাকে শিশুসুলভ বলে ধারণায় পৌঁছালেন? এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন কীভাবে?//

১৯৯৪-এর জুনের প্রথম সপ্তাহে সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছিল। অধিবেশন শুরুর আগের দিন বেগম জিয়া এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বিরোধী দলসমূহকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, 'জনগণ আপনাদেরকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে আপনারা রাজপথে কেন আন্দোলন করবেন? যা বলার সংসদেই বলুন, তবে কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে সংসদে কোনো আলোচনা হবে না।'

খালেদা জিয়ার এই কথা বিরোধী দলকে রাজপথে আন্দোলন করতে বাধ্য করেছিলো। সকল বিরোধী দলও সংসদ বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে আশা করা হয়েছিল যে, স্বাভাবিক নিয়মেই বিএনপি সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করবে এবং বিরোধী দল সংসদে স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্ব পালন করবে।

সরকার যদি নিজেই কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিত, তাহলে গণতন্ত্র স্বাভাবিক গতিতেই অগ্রসর হতো। সরকারের অপ্রত্যাশিত ও স্বৈরাচারী ভূমিকার ফলে বিএনপির বিরুদ্ধে চরম রাজনৈতিক বৈরীভাব সৃষ্টি হলো। যে কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি কায়েমের দাবি বিএনপিসহ সকল দল মেনে নিয়েছিল, সে দাবিতে আবার আন্দোলন করতে সরকার বাধ্য করলো।

এতে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে বিএনপিকে সমর্থন করলো, অথচ বিএনপিই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করলো। এ আন্দোলন না হলে বিএনপি সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই সরকারের পদত্যাগ করার দাবি উঠত না।

এ দাবির কারণে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে গেল। নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ করার সুযোগ দান করাই গণতন্ত্রের দাবি। ১৯৮৮ সালে উল্লেখযোগ্য সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করা সত্ত্বেও স্বৈরশাসক এরশাদ নির্বাচন করেছে। আর নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল বিহীন ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতান্ত্রিক পরিবেশকে কলুষিত করেছে।

এ অস্বাভাবিক নির্বাচনের পর বিএনপি সরকার গঠন করার দুসপ্তাহের মধ্যেই সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকারপদ্ধতি সংযোজন করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের ১৩ নং সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইন প্রণীত হয়। এ আইন অনুযায়ীই যথাক্রমে ১৯৯৬ সালের ১৫ই জুন এবং ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয় কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অনেক কারণেই আওয়ামী লীগ সংসদে বেশি আসন পেয়েছে এবং এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয়েছে। ১৯৯১ সালে কেয়ারটেকার সরকার ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে গঠিত।

১৯৯৬ সালের কেয়ারটেকার সরকার ছিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত সাংবিধানিক কেয়ারটেকার সরকার। আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ায় ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ব্যাকফুটে চলে যায়। নির্বাচনী পরিবেশ আওয়ামী লীগের অনুকূলে চলে গেছে। বিএনপির জনপ্রিয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার পরও ১১৬ আসনে বিজয়ী হয়েছে।

শেখ হাসিনা নির্বাচনের পূর্বে ওমরাহ করে হিজাব অবস্থায় তাসবীহ হাতে নিয়ে দেশে ফিরে এসে গোটা নির্বাচনী অভিযানে দুই হাত জোড় করে জনগণের নিকট দলের অতীত সকল ভুলের জন্য ও ইসলাম বিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়েছে। জনগণ তাদেরকে সুযোগ দিয়েছে। ১৪৬ টি আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। এরশাদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।

এভাবে কেয়ারটেকার বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়, জনপ্রিয়তা পায় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সবশেষ সংবিধানে অন্তুর্ভুক্ত হয়।


১৫ জুল, ২০২৩

যেভাবে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার এলো! (পর্ব - ০২)

 

১৯৮৪ সালে এরশাদের সাথে সংলাপ ব্যর্থ হয়ে গেলে বিনা বাধায় '৮৪ সালের মে মাসে উপজিলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয়ে গেল। এ সাফল্যের ভিত্তিতেই '৮৫ সালের ২১শে মার্চ স্বৈরশাসকদের ঐতিহ্য মোতাবেক তথাকথিত গণ-ভোটের মাধ্যমে প্রধান সামরিক শাসনকর্তা ‘নির্বাচিত' প্রেসিডেন্ট হয়ে গদীতে মজবুত হয়ে বসলেন।

'৮৫ সালের শেষ দিকে যুগপৎ আন্দোলনের আবার সূচনা হলো। আন্দোলন দানা বাঁধার মুখে '৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র মধ্যে চরম মতবিরোধ হয়। যুগপৎ আন্দোলন আবার থেমে যায়।

রাজনৈতিক ঐ পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের তিন দিনব্যাপী এক বৈঠক হয়। ব্যাপক আলোচনার পর জামায়াত সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুগপৎ আন্দোলনের কোনো সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য না থাকায় স্বৈরশাসককে অপসারণের কোনো সম্ভাবনাই নেই, তাই জনগণকে নির্বাচনমুখী করা ছাড়া অন্য কোনো কর্মসূচির প্রতি তেমন সাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। দুই জোটকেও নির্বাচনমুখী করার চেষ্টা করতে হবে। নির্বাচনে যাতে এরশাদের দল কিছুতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হতে না পারে, সে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অন্য কোনো বিকল্প কর্মসূচির সম্ভাবনা নেই।

বিশেষ করে জামায়াতের জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ সবচেয়ে জরুরি। কারণ, নতুন দেশ বাংলাদেশে জামায়াতের নামে তখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে আইনগতভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। কোনো দল পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এবং নির্বাচন কমিশন সে দলের জন্য প্রতীক বরাদ্দ করলে দলটি আইনগতভাবে রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়ে গেল। 

যদি নির্বাচনে অন্তত ১০টি আসনে জয়ী হয় তবে পার্লামেন্টারি পার্টির মর্যাদা পেয়ে যায়। নির্বাচনে কোনো আসন না পেলেও আইনগত সার্টিফিকেট পেয়ে গেল। এ মর্যাদা পেলে রাজনৈতিক ময়দানে সে দলটিকে স্বীকৃতি দিতে সবাই বাধ্য। শেষ পর্যন্ত কর্মপরিষদের সকল সদস্য একমত হলেন যে, জামায়াতের অস্তিত্বের স্বার্থেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন।

এত বড় ইস্যুতে কর্মপরিষদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের গঠনতান্ত্রিক ইখতিয়ার না থাকায় জামায়াতের মজলিসে শূরা আহ্বান করা হলো। মজলিসে শূরা সদস্যগণ বিষয়টির গভীর তাৎপর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রাণ খুলে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। মজলিসে শূরায় দুই দিন বিস্তারিত আলোচনার পর নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।

রাজনৈতিক জোটভুক্ত দলসমূহ ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, অপরদিকে প্রকাশ্যে নির্বাচনবিরোধী বক্তব্যও দিয়ে যাচ্ছিল। বড় দুই জোটের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকাই স্বাভাবিক। কোনো দলই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা না বলায় পারস্পরিক সন্দেহ বিরাজ করছিল। এ পরিবেশে শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম লালদিঘি ময়দানে দলীয় জনসভায় বলেন, এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অর্থহীন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের গদি মযবুত করবে তারা 'জাতীয় বেঈমান' হিসেবে গণ্য হবে।

অথচ ১৫ দলীয় জোটের শরীক দলগুলো নির্বাচনে আসন দাবি করে লীগের সাথে রীতিমতো দর কষাকষি চালাচ্ছে। তখন জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতার আলোচনা চলছে। বেগম জিয়ার পক্ষ থেকে কর্নেল মুস্তাফিজ ও জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠকাদি চলল। প্রথমে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতকে মাত্র ২০টি আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কয়েক দিনের দর কষাকষির পর কর্নেল মুস্তাফিজ ৫০টি আসন জামায়াতকে ছেড়ে দিতে সম্মত হলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তা মেনে নেয়।

জামায়াতকে এত বেশি আসন ছেড়ে দিতে সম্মত হওয়ায় নিজ দলীয় বৈঠকে কর্নেল মুস্তাফিজ রীতিমতো নাজেহাল হন। ফলে বিএনপির সাথে নির্বাচনী সমঝোতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহের কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা না হওয়ায় জেনারেল এরশাদ ধমকের সুরে ঘোষণা করলেন, ১৯ মার্চ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। ২০ মার্চ তিনি জাতির উদ্দেশে নির্বাচন সম্পর্কে ভাষণ দেবেন। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না তাদেরকে নির্বাচন বিরোধী কোনো তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার খবর তিনি হয়তো জানতেন। তাই এই টাইপের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করতে পেরেছেন। 

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১৯ মার্চ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিজ নিজ দলীয় কার্যালয়ে মিটিং ডাকলো। জামায়াতও ঐ একই তারিখে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিল।

জামায়াত আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে দুই জোটের এক জোটও যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাহলে জামায়াত অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। জামায়াত অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলো। জামায়াতের লিয়াজোঁ কমিটির আহ্বায়ক শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন।

রাত ১১টা পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্ত জানা গেল না। দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে আওয়ামী লীগের সংবাদ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। বিএনপির খবর মুজাহিদ সাহেব ফোনে নিচ্ছিলেন। রাত ২টার সময় দৈনিক সংগ্রামের সাংবাদিক মোটর সাইকেলে খবর নিয়ে এলেন। খবর এল যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু বিএনপি তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেনি। 

বিএনপির তদানীন্তন মহাসচিব ওবায়দুর রহমানের সাথে মুজাহিদ সাহেব অব্যাহতভাবে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। রাত তিনটায় ওবায়েদ সাহেব শহীদ মুজাহিদ সাহেবকে জানালেন, //একটা টেকনিক্যাল কারণে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। আগামীকাল সিদ্ধান্ত নেব। আপনাদের সিদ্ধান্ত পত্রিকায় দিয়ে দিন।//

সকল পত্রিকা অফিস তখন পর্যন্ত খবরের প্রতীক্ষা করছিল। ২০ মার্চ (১৯৮৬) বড় বড় হেডিং-এ পত্রিকায় খবর বের হলো, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বিএনপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। 

বিএনপির টেকনিক্যাল কারণটি কী?
শহীদ মুজাহিদ ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করে ঐ কারণটি জেনে নিলেন। বিএনপির প্রথম সারির নয়-দশজন নেতা প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের মন্ত্রী ছিলেন। জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করার পর তাদের বেশ কয়েকজনকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য বলে অন্যায়ভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করেন। তাদের মধ্যে ওবায়দুর রহমানও ছিলেন একজন।

বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করার উদ্দেশ্যে ঐ অর্ডিন্যান্স বাতিল করে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ওয়াদাও নাকি এরশাদ বিএনপি-কে দিয়েছিলেন। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় পর্যন্ত ঐ ওয়াদা পূরণ না করায় বিএনপি সমস্যায় পড়ে গেল। পরের দিন ওয়াদা পূরণের অপেক্ষায় থাকার পর বিএনপি বুঝতে পারল, স্বৈরাচার এরশাদ তাদের ধোঁকা দিয়েছেন। 

তখন বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কারণে হাসিনার দেওয়া 'জাতীয় বেঈমান' উপাধিটি আওয়ামী লীগের প্রতি সার্থকভাবে প্রয়োগ করল। আসল যে কারণে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো না, তা তো জনগণের নিকট প্রকাশ করা যায় না।

উভয় জোট এতদিন পর্যন্ত এরশাদ সরকারের পরিচালনায় নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে প্রচার করেছে। এখন বিএনপি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে নির্বাচন বর্জনকে গৌরবের সাথে প্রচার করতে থাকল। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন দল হিসেবে আবির্ভূত হলো। ‘জাতীয় বেঈমান' গালি খেয়ে আওয়ামী লীগ দাবি করলো, বিএনপি তাদের সাথে প্রতারণা করেছে। তারা আরো দাবি করলো, বিএনপির সাথে তাদের নির্বাচনী প্রার্থীদের তালিকার বিনিময়ও হয়েছে। 

জামায়াত বিএনপি'র সাথে পরামর্শ করেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর জামায়াত আওয়ামীলীগের মতো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণাও দেয়নি। এই প্রসঙ্গে শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //জামায়াত বিএনপির সাথে এবং তাদের মহাসচিবের সম্মতি নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের খবর পত্রিকায় পরিবেশন করেছে। তাই জামায়াতের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। জামায়াত তো নিশ্চিতই ছিল যে, বিএনপিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।//

১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অনেক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে আসন বণ্টন নিয়ে ১৫ দল থেকে পাঁচটি বামদল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে, আওয়ামী লীগ ৭৬ আসনে ও জামায়াত ১০ আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে এরশাদ ঢালাওভাবে ডাকাতি না করে জেনারেল জিয়াকে অনুসরণ করেছিলেন। কোন কোন আসন জাতীয় পার্টিকে জয়ী করা হবে তা আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে। জামায়াতের রংপুরের এক প্রার্থী শাহ রুহুল ইসলামকে জোরপূর্বক হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই আসনের সকল ব্যালট বাক্স সেনাবাহিনী সেনানিবাসে নিয়ে এসে ফলাফল ঘোষণা দেয়। 

জামায়াত নির্বাচনে সন্তুষ্ট না হলেও রাজনৈতিক টার্গেট পূরণ হয়। পার্লামেন্টারিয়ান দলে পরিণত হয়। মার্কা হিসেবে দাড়িপাল্লাও বৈধতা পায়। নির্বাচনের শুরুতে এই নিয়ে ঝামেলা হয়। এটা সুপ্রিম কোর্টের প্রতীক হিসেবে জামায়াতকে পাল্লা মার্কার বরাদ্দ দিতে চায়নি নির্বাচন কমিশন। পরে ১৯৭০ এর নির্বাচনের নথিপত্র দেখিয়ে এই বৈধতা অর্জন করে।  

১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আবার যুগপৎ আন্দোলন গড়ে উঠে। '৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় তারাই এ আন্দোলনে অধিকতর সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে। বিরোধী দলগুলো সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সংসদ থেকে গণ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ৬ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ১০ সদস্য- বিশিষ্ট সংসদীয় দল তাদের নেতা অধ্যাপক মুজীবুর রহমানের নেতৃত্বে স্পীকার জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীর নিকট যেয়ে পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। 

আওয়ামী লীগ বিবিসি'কে পদত্যাগ করবেন বলে জানানো সত্ত্বেও বিদেশে অবস্থানকারী নেত্রীর সম্মতির অভাবে দোদুল্যমান থাকা অবস্থায় তিন দিন পর সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়। আওয়ামী লীগ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যায়। এরশাদ সরকার সংসদ ভেঙ্গে দেয়। 

প্রধান দুই দলের সমন্বয়ের অভাবে যুগপৎ আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় ঐ অনুকূল পরিবেশটিকেও কাজে লাগনো গেল না। ফলে এরশাদ '৮৮ সালের মার্চ মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এ নির্বাচনে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে কয়েকটি বাম দল ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের সকল দলই ঐ নির্বাচন বয়কট করে । প্রহসনমূলক এবং ভোটার বিহীন নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিত্বহীন সংসদের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো সোচ্চার হতে থাকে। এরশাদের পদত্যাগ ও সংসদ ভেঙ্গে দেবার দাবীতে আন্দোলন ঢিমে তালে চলতে থাকে ।

১৯৮৯ সালের অক্টোবরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ জামায়াত প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার সরকারে সম্মত হয়। এবার সব বিরোধী দল কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অভিন্ন দাবীর কারণে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাংগা হয়ে উঠে। কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সুনির্দিষ্ট দাবী সর্বমহলে সহজে বোধগম্য হওয়ায় স্বৈরশাসনের অবসানের পথ সুগম হয়।

কীভাবে সরকার পরিবর্তন করা হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দাবী উত্থাপিত হওয়ায় আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার হয়। কেয়ারটেকার সরকার সম্পর্কে জামায়াতে ইসলামীর দেওয়া ফর্মূলা অনুযায়ীই ১৫, ৭ ও ৫ দলীয় জোটের নামে একটা রূপরেখা পেশ করা হয়। এতে বলা হয় যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির হাতে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। প্রধান বিচারপতি অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত (মন্ত্রীর মর্যাদায়) উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। এ নবগঠিত সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন।

এবার সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন জোরদার হলো এবং জনগণ সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলো। ঠিক ঐ পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় আন্দোলন তুঙ্গে উঠলো। সরকারের ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে জনগণ ময়দানে নেমে এলো। সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে এরশাদ সরকারের পক্ষে ভূমিকা রাখতে অস্বীকার করলো। বাধ্য হয়ে এরশাদ ৬ই ডিসেম্বর (১৯৯০) পদত্যাগ করলো।

কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের আন্দোলন সফল হলো। প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব হাতে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হলেন। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে ১৫ ও ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামীর সাথে জেনারেল এরশাদের সংলাপের সময় যদি কেয়ারটেকার সরকার দাবীটি সবাই একসাথে পেশ করতে সক্ষম হতো তাহলে স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি '৯০ সাল পর্যন্ত বিলম্বিত হতো না ।

প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত সফল নিরপেক্ষ নির্বাচনে কোন দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে সমস্যা দেখা দিল। ঘটনাক্রমে ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ১৮টি আসনের অধিকারী জামায়াতে ইসলামীর হাতে ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার' এসে পড়লো। জামায়াত ক্ষমতায় অংশীদার না হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থভাবে বিএনপি'কে সরকার গঠনে সাহায্য করলো। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন।

জুন মাসে বাজেট সেশনেই জামায়াতে ইসলামী পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভূক্ত করার উদ্দেশ্যে সংসদে পেশ করার জন্য একটি বিল জমা দেন। পরে ঐ বছরই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি পৃথকভাবে এ উদ্দেশ্যে বিল জমা দেয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বিএনপি এ বিষয়ে মোটেই গ্রাহ্য করলো না।

১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচন যদি জেনারেল এরশাদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হতো তাহলে নিশ্চয়ই বিএনপি ক্ষমতাসীন হতে পারতো না। বিএনপি সরকার কেয়ারটেকার সরকারেরই ফসল। ভবিষ্যতে যাতে এ পদ্ধতিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেজন্য দেশের শাসনতন্ত্রে এ বিষয়ে একটি আইনের সংযোজন করাই সবচাইতে যুক্তিসংগত। এ পদ্ধতিতেই জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিশ্চিত হয়।

দুঃখের বিষয় বিএনপি সংসদে ‘কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি' সম্পর্কিত বিল আলোচনার সুযোগই দিতে রাজি হলো না। জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকার দাবী নিয়ে ১০ বছর (১৯৮০ থেকে ১৯৯০) আন্দোলন করেছে। '৯০ সালে বিএনপিও এ আন্দোলনে শরীক ছিল। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির সুবাদেই তাঁরা ক্ষমতায় গেলেন। অথচ এ পদ্ধতিটি সংসদে আলোচনা পর্যন্ত করতে দিলেন না। তাঁরা ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় স্থায়ী হবার অবৈধ উদ্দেশ্য না থাকলে এমন স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারতো না।

১৯৯৪ সালের এপ্রিলে মাগুরা জেলার একটি আসনে উপনির্বাচন হয়। এটি আওয়ামী লীগের আসন ছিল। বিএনপি'র খালেদা সরকার একচেটিয়াভাবে সন্ত্রাসী দিয়ে সকল কেন্দ্র করে নেয়। এভাবে নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে নেবার পর আওয়ামী লীগ ঘোষণা করল যে কেয়ারটেকার সরকার কায়েম না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি সরকারের পরিচালনায় কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো না। নতুন করে আবার শুরু হলো কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন। 

- চলবে 


১৪ জুল, ২০২৩

যেভাবে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার এলো! (১ম পর্ব)



বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বসে পড়েছে মুলত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এক নজিরবিহীন কাণ্ড করে বসে। আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্যান্য দল ভোটারদের কাছে গেলেও আওয়ামী লী ভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছে। তারা জোরপূর্বক ব্যালট বাক্স দখল, বিরোধী প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে কেন্দ্র ছাড়া করে। এর জন্য প্রস্তুত ছিল না মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম ও ন্যাপ (একাংশ)।

এর ফলাফল হিসেবে অভাবনীয় সাফল্য পায় আওয়ামী লীগ। এটা শুধু তৎকালীন পাকিস্তানে তো বেনজির নয় গোটা পৃথিবীতেই ছিল নজিরবিহীন। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও জামায়াত ভেবেছিল নির্বাচন কমিশন অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযুক্ত কেন্দ্রগুলোতে পুনঃনির্বাচন করবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই নির্বাচনেই আস্থা রেখে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে কার্যক্রম এগিয়ে নিলেন। এভাবে ঘটনা পরিক্রমায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিব সমঝোতা শেষ হতে না পারায় যুদ্ধ লাগিয়ে দেয় এদেশের বিপথগামী কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী।

আলাদা দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পর শেখ মুজিব ১৯৭০ এর সাফল্যের কথা ভুলে যায়নি। একইভাবে তারা নির্বাচনে জয়ের পরিকল্পনা করে। মুজিব সরকারের পরিচালনায় ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের প্রায় সব কয়টি আওয়ামী লীগ দখল করে নেয়। ১ টি জাসদ জোর করে দখলে রাখতে পারে। ১ টি জাতীয় লীগ পায়। ৫টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতে যায়। বাকী ২৯৩ আসনে জয়লাভ করে মুজিব। এরমধ্যে খন্দকার মোশতাকের আসন থেকে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টার দিয়ে উড়িয়ে আনে মুজিব। মুজিবের বাসভবন থেকে ঘোষণা হয় মোশতাকের বিজয়।

এভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনের সংস্কৃতি পুরোপুরি ভেস্তে দেয় শেখ মুজিব। এখানে নির্বাচনে জিততে হলে পেশিশক্তি লাগবে। অস্ত্রের শক্তি লাগবে। মানুষ ভোট দিক বা দিক সেটা কোনো মূখ্য ব্যাপার ছিল না। এরপর বাম ভাবাপন্ন সেনাবাহিনীর ক্যুতে মুজিব নিহত হয়। নানান ঘটনা চক্রে ক্ষমতায় আসে জেনারেল জিয়া।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল দুই তৃতীয়াংশ আসনেরও বেশি দখল করে। আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে বিজয়ী হয়ে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে আই.ডি.এল (ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ) নামে নির্বাচনে ১৮ টি আসন পায়।

এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলেও ৭৩ এর নির্বাচনের মতো একচেটিয়া সীট দখলের অপচেষ্টা করা হয়নি। শেখ মুজিবের নগ্ন ডাকাতি এখানে হয়নি। তবে জিয়াউর রহমান কূটকৌশলী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। নির্বাচনে যত দল যোগদান করেছে সে সব দলের প্রধানগণ যাতে সংসদে আসেন সেদিকে খেয়াল রেখেছেন। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে ইচ্ছেমত ফলাফল নিয়ে এসেছেন।

এই প্রসঙ্গে শহীদ গোলাম আযম বলেন, //জিয়ার শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজীজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়ার ছিলেন। সমসাময়িক হিসাবে কিছুটা সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যোগাযোগ ও সাক্ষাত হতো। তাঁর কাছ থেকে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পলিসি সম্পর্কে কিছু জানার সুযোগ পেয়েছি।

তিনি জিয়ার নির্বাচনী পলিসির প্রশংসা করতে গিয়ে জানালেন যে, দলীয় প্রধানগণ যাতে সংসদের বাইরে আন্দোলন করা প্রয়োজন মনে না করেন সে উদ্দেশ্যে তাদেরকে নির্বাচিত হবার সুযোগ দিয়েছেন। সর্বহারা দলের তোয়াহা প্রথম ভোট গণনায় পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত বলে ঘোষণা করা হয় । এ দ্বারা বুঝা গেল যে জিয়াউর রহমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো বিজয়ী হওয়া সম্ভব হয়নি।//

গোলাম আযম আশা করেছিলেন জিয়া যেহেতু বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছেন, সেক্ষেত্রে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি আগ্রহী হবেন। কিন্তু ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তিনি হতাশ হলেন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, //শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, রাজনীতি ও নির্বাচনকে বাকশালী স্বেচ্ছাচারে পরিণত করলো। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল হয়নি। গণতন্ত্রের অগ্রগতি ও বিকাশের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন অপরিহার্য। তা না হলে নির্বাচন নিতান্তই প্রহসন মাত্র।//

শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযম তখন থেকেই বিকল্প পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা ভাবতে থাকলেন। গবেষণা করতে থাকলেন। প্রতিটি সম্ভাবনার সাইড ইফেক্ট চিন্তা করলেন। এরপর তিনি কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার কথা ভাবলেন। এরপর এটি তিনি জামায়াতের নির্বাহী পরিষদে উত্থাপন করেন। দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার পর জামায়াত সর্বসম্মতভাবে এ প্রস্তাব অনুমোদন করে।

অধ্যাপক গোলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন ও কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাই এই বিষয়ে তাঁর একাডেমিক পদচারণা ছিল। একইসাথে তিনি রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় বিষয়টি তাঁর জন্য সুবিধা হয়েছে।

কেয়ারটেকার শব্দটি কীভাবে এসেছে এই নিয়ে তিনি বলেন, //গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের সময় এক ধরনের কেয়ারটেকার সরকারই থাকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলীয় নেতা হওয়ায় সরকার পরিচালনার সুযোগে নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করার সম্ভাবনা থাকে। বৃটেনে দীর্ঘ ঐতিহ্যের কারণে এমন সুযোগ গ্রহণ না করলেও আমাদের দেশে অবশ্যই আছে। এ ভাবনা থেকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি “কেয়ারটেকার সরকার” পরিভাষার আবিষ্কারক নই। এ পরিভাষা রাষ্ট্র বিজ্ঞানেই আমি পেয়েছি। আমার প্রস্তাবে শুধু 'নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক সরকারের' পরিচালনার কথাটুকুই নতুন সংযোজন বলা যায়।//

অধ্যাপক গোলাম আযম প্রস্তাবিত কেয়ারটেকার মডেলের মূলকথা ছিল,
“নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত (অবসরপ্রাপ্ত নয়) প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার গঠন করতে হবে। এ সরকারে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় এমন লোকদেরকে নিয়োগ করতে হবে যারা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত নন এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নন। এ সরকার দলনিরপেক্ষ লোকদের দ্বারা নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ সরকার কায়েম থাকবে এবং প্রধান বিচারপতি নিজ পদে প্রত্যাবর্তন করবেন।”

গোলাম আযম সাহেব বলেন, //মূল প্রস্তাবে কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে সরকার প্রধান করার কথা এ কারণেই বলা হয়েছে যে, তিনি নির্বাচনের পরই পূর্বপদে ফিরে যাবেন বিধায় তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের সুযোগ কম থাকবে। এ অবস্থায় তাঁর কোন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার কোন আশংকা থাকবে না।//

১৯৮০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে রমনায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আব্বাস আলী খান সর্বপ্রথম জামায়াতের পক্ষ থেকে এ দাবীটি উত্থাপন করেন। ১৯৮১ সালের মে মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিহত করার ফলে ঐ বছর নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচিত হন এবং নতুন সরকার গঠন করেন ১৯৮২ সালের মার্চে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন কায়েম করে গণতন্ত্রের ধারা স্তব্ধ করে দেন।

১৯৮৩ সালের এপ্রিলে রাজনৈতিক দলসমূহকে সক্রিয় হবার সুযোগ দিলে ঐ বছরই ২০শে নভেম্বর বাইতুল মুকাররামের দক্ষিণ চত্বরে জামায়াতের জনসভায় একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব হিসাবে কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানানো হয়। এই দাবির সাথে সকল বিরোধী দলকে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় জোট ও বি.এন.পি-এর নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী পৃথক পৃথক ভাবে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে স্থগিত হওয়া শাসনতন্ত্র বহাল করার আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে এ আন্দোলন যুগপতের রূপ নিলে ১৯৮৪ সালের শুরুতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। সামরিক শাসক এরশাদ এপ্রিল মাসে ১৫ দল, ৭ দল ও জামায়াতকে সংলাপের আহবান জানান।

যুগপৎ আন্দোলনের ফলে উভয় জোট নেত্রীর সাথে যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে জামায়াত সে সুবাদে ১৫+৭+জামায়াত মিলে ২৩ দলের একসাথে সংলাপে অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেয়। একসাথে সংলাপে যাবার পক্ষে জামায়াত যুক্তি পেশ করে যে পৃথক পৃথকভাবে গেলে জেনারেল এরশাদ থেকে কোন কমিটমেন্ট আদায় করা যাবে না। একজোটের সাথে কথা বলার পর তিনি বলবেন, আপনাদের কথা শুনলাম, দেখি অন্যান্যরা কী বলেন। একসাথে গেলে এ রকম কোন অজুহাত তুলতে পারবেন না। তাহলে সংলাপ ফলপ্রসূ হবে এবং তাঁকে সিদ্ধান্ত জানাতে বাধ্য করা যাবে।

দুই নেত্রী একসাথে যেতে সম্মত হলেন না। জামায়াত দুই নেত্রীর নিকট প্রস্তাব দিল যে সবাই একসাথে সংলাপে না গেলেও সবাই যদি একই ভাষায় একই রকম দাবী জানায় তাহলেও সংলাপ সফল হতে পারে। উভয় নেত্রী বললেন, ঐ দাবীটি লিখিতভাবে দিলে আমরা জোটের বৈঠকে বিবেচনা করব।

জামায়াত সংলাপে পেশ করার জন্য দাবীটি লিখিত আকারে দুইনেত্রীকে দেবার পর তারা কেউ তা পছন্দ করলেন কিনা জানা গেল না। ১০ এপ্রিল জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীরের নেত্বত্বে ৭ সদস্যের ডেলিগেশন জেনারেল এরশাদের সাথে সাক্ষাৎ করে ঐ লিখিত দাবীটিই পেশ করে যা দুই জোট নেত্রীকে দেওয়া হয়েছিল।

জামায়াতের তৈরি করা দাবিগুলো ছিল নিন্মরূপ,

“সেনাপ্রধান হিসাবে শপথ নেবার সময় আপনি যে শাসনতন্ত্রের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা মুলতবী করে এবং নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করার কোন বৈধ অধিকার আপনার ছিল না। শাসনতন্ত্র বহাল করে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিন। এ ব্যাপারে দুটো বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন :

(১) আপনি যদি নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান তাহলে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত প্রধান বিচারপতির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। তাঁর নেতৃত্বে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। এ নির্বাচনে জনগণ আপনাকে নির্বাচিত করলে আপনি দেশ শাসনের বৈধ অধিকার পাবেন।

(২) যদি আপনি ঘোষণা করেন যে আপনি নিজে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না এবং কোন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকবেন না, তাহলে আপনাকেও কেয়ারটেকার সরকার হিসাবে গ্রহণ করতে আমরা সম্মত। নির্বাচনের পর আপনি পদত্যাগ করবেন এবং নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে।

এ দাবীর জওয়াবে এরশাদ বললেন, //আপনাদের কথা শুনলাম। অন্যদের কথা শুনবার পর সবার প্রস্তাব একসাথে বিবেচনা করবো।//

জনাব আব্বাস আলী খান সংলাপের পর বঙ্গভবন থেকে সরাসরি জাতীয় প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের নিকট ঐ লিখিত দাবীর কপি বিলি করেন।

১৫ দল ও ৭ দলীয় জোটের সাথে আলোচনা শেষে ১৭ এপ্রিল জামায়াতের ডেলিগেশনের সাথে দ্বিতীয় দফা সংলাপে জেনারেল এরশাদ একটু উষ্মার সাথে বললেন, “আপনারা কোথায় পেলেন কেয়ারটেকার সরকারের অদ্ভূত পদ্ধতি? দুই জোটের কেউ আপনাদের দাবী সমর্থন করে না। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সংলাপ শেষ হওয়ার পর ২৯ তারিখে এরশাদ সাহেব দাপটের সাথে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন,

//রাজনৈতিক দলগুলো এত বিভিন্ন রকম দাবী জানিয়েছে যে আমি কার দাবী গ্রহণ করব? তাই অবিলম্বে উপজিলা চেয়ারম্যান নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।//

১৫ দলীয় ও ৭ দলীয় জোট এবং জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনের মূল দাবী ছিল, উপজিলা নির্বাচন নয়, সবার আগে সংসদ নির্বাচন চাই। এ দাবীতে আন্দোলন জোরদার হওয়ায় এরশাদ সংলাপের ডাক দিতে বাধ্য হন।

সব দল যদি একসাথে সংলাপে যেয়ে একই দাবী একবাক্যে পেশ করতে সক্ষম হতো তাহলে ঐ বছরই দেশ স্বৈরশাসন থেকে হয়তো মুক্তি পেতো। সংলাপ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গেল এবং সামরিক শাসক এরশাদ উপজিলা নির্বাচন করিয়ে ক্ষমতায় আরো মজবুত হয়ে বসার সুযোগ পেলো।

- চলবে