৭ নভে, ২০২৩

গুপ্তহত্যা কি তবে গুম-খুনের নতুন ভার্সন?

ছবি - নিহত জামায়াত নেতা মাহবুবার রহমান (বামে) ও তার খুনী (ডানে)


বাংলাদেশে রাজনীতির কারণে খুন করে ফেলা এখন ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। এই খুনোখুনীর বিষয়টা এসেছে বামপন্থী রাজনীতির হাত ধরে। বিশেষভাবে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের মধ্যে যারা বামপন্থী ছিল তাদের হাত ধরেই খুনের রাজনীতি শুরু হয়। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খানের হাত ধরে সৃষ্টি হয় গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াস। 


বাংলাদেশে প্রতিপক্ষদের টার্গেট করে খুন করার প্রচলন এই নিউক্লিয়াস তথা ছাত্রলীগ শুরু করে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে তারা বহু রাজনীতিবিদদের হত্যা করে। এরপর বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় হাজার হাজার বিহারী ও পাকিস্তানপন্থী সাধারণ জনগণকে তারা হত্যা করে। আলেম ওলামা, মসজিদ্গুলোর ইমাম, ডানপন্থী রাজনীতিবিদ, ডানপন্থী পেশাজীবী তাদের টার্গেট। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যার রাজনীতিও তাদের হাত ধরে শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে এনএসএফ নেতা সাইদুর রহমান ঢাবি ক্যম্পাসে হত্যা করে ছাত্রখুনের রাজনীতি ওপেন করে ছাত্রলীগ। 


বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে আওয়ামীলীগ থেকে বামপন্থীরা বেরিয়ে যায় ও জাসদ গঠন করে। এরপর আওয়ামী লীগ ও জাসদ পরস্পরকে খুনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। জাসদ গুপ্তহত্যা করে আওয়ামী নেতাদের হত্যা করতে থাকে। অন্যদিকে আওয়ামীলীগ জাসদ নেতাদের ধরে ক্রসফায়ার দিতে থাকে। কাউকে কাউকে গুম করতে থাকে। 


২০০৯ সালে শেখ মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা আবারো তাদের ঐতিহ্য অনুসারে গুম খুন শুরু করে। হাসিনার আমলে গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা ৬১৪। ক্রসফায়ারে খুন হওয়া মানুষের সংখ্যা ৩৮৭৩। 


২০২০ সালের ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাওকে ক্রসফায়ারে হত্যা করে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস। এই ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ মুখোমুখি হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ওসি প্রদীপের সাজা হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্রসফায়ারের হার অনেক কমে যায়। কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয় নি। 


২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও র‌্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ হয়। এর প্রেক্ষিতে ক্রসফায়ার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে হাসিনার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা বাড়তে থাকে। এর কারনে শেখ হাসিনা আগের মতো ক্রসফায়ার ও গুম খুন চালাতে পারছে না। 


মার্কিন ভিসানীতির সুযোগ নিয়ে ২০২৩ সালের ১০ জুন প্রকাশ্যে সমাবেশ করে জামায়াতের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ শাখা। এর মাধ্যমে মেইনস্ট্রিমের রাজনীতিতে আবারো প্রভাব তৈরি করে জামায়াত। এর ধারাবাহিকতায় জামায়াত আলোচনায় আসে। কিন্ত তারপরও কয়েকমাস সভা-সমাবেশ করার বৈধ অধিকার হাসিল করতে পারেনি জামায়াত। সব শেষে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি না পেয়ে লাখো জনতাকে হাজির করে জামায়াত অনেকটা জোর করে আরামবাগে বিশাল সমাবেশ করে। 


আর এতেই ক্ষিপ্ত হয় শেখ হাসিনা। কিন্তু ভিসানীতির কারণে তার হাত বাঁধা। আগের মতো খুন করতে পারছে না। গত ১৫ বছরে জামায়াতের ২৪৬ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা করে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামীলীগ। এর মধ্যে ক্রসফায়ারের নামে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে ৮৬ জনকে। গুম করেছে জামায়াতের ২৫ জনকে। এর মধ্যে ৫ জন এখনো নিখোঁজ। বাকীদের মধ্যে কয়েকজনকে ফেরত পাওয়া গেছে, অন্যদের লাশ সনাক্ত করা গেছে। 


জামায়াত নেতা-কর্মীদের রিমান্ডের নামে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছে। জামায়াত নেতাকর্মীদের রিমান্ডের দিন যোগ করলে তা হয় ৯৬৩৬৭ দিন। বছরের হিসেবে তা ২৬৮ বছর! পুলিশের নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছেন জামায়াতের ৫২০৪ জন নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের আক্রমণে মারাত্মক আহত হয়েছেন (যাদের হাসপাতালে থাকতে হয়েছে) ৭৫১৮৯ জন। 


জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১০৪৭২ জন নেতা কর্মী। এর মধ্যে নারী রয়েছেন ১৭৬৩ জন। জামায়াতের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে ও জামায়াতের প্রথম সারির প্রায় ১১ নেতাকে হত্যা করে আওয়ামীলীগ চেয়েছিলো দলটিকে গায়েব করে দিতে। কিন্তু জামায়াত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে জানান দিয়েছে তারা হারিয়ে যায় নি বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে। 


পশ্চিমা চাপে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে পুলিশ দিয়ে গুম খুন করতে না পেরে এখন শেখ হাসিনা গুপ্তহত্যার আশ্রয় নিয়েছে। যাতে এই হত্যার দায় সরকারের ওপর না পড়ে। জামায়াত বাংলাদেশের তৃণমূলে শক্তিশালী হওয়ায় তারা রাজধানীর বাইরে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা শুরু করেছে।  


২৮ অক্টোবরের পর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই ৭ দিনে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১১ জন জামায়াত ১ জন বিএনপির নেতা কর্মী। এর মধ্যে ৭ জন মারাত্মক আহত হলেও কোনোরকম প্রাণে বেঁচে যান। ৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। ২৯ অক্টোবর রাজশাহীতে এরশাদ আলী দুলাল ও গোলাম কাজেম আলী খুন হন অজ্ঞাত আততায়ী দ্বারা। এরশাদ আলী দুলাল পল্লী চিকিতসক। গোলাম কাজেম আলী রাজশাহী মেডিকেলের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। দুই জনেই জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।


৩০ অক্টোবর জামায়াত কর্মী ও শ্রমিক মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় ভোলার অটোচালক শফিকুল ইসলামকেও একই কায়দায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। ৩ নভেম্বর নাটোরের যুবদল কর্মী মাসুদ রানাকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। 


৫ নভেম্বর রাত নয়টার দিকে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি জামায়াতের মনোনীত ও নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। জনপ্রিয় এই জামায়াত নেতাকে বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। 


এছাড়া নাটোরের নলডাঙ্গায় আরো চারটি অজ্ঞাত আক্রমণের ঘটনা ঘটে। প্রত্যেকটি ঘটনায় ভিকটিম ছিল জামায়াত নেতা। দুইটি ঘটনা ঘটে রাজশাহীতে সেখানেও ভিকটিম জামায়াত কর্মী। জামায়াতের নেতার ওপর একটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে নোয়াখালীতে। এই সাতজন ভিকটিম মারাত্মক আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। 


শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকার বিরোধী মত দমনের জন্য ঘৃণ্য পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর কোনোটাই কাজে আসবে না। প্রতিটি অমানবিক ও নোংরা পদক্ষেপ বুমেরাং হবে জালিমদের প্রতি। জামায়াত এদেশের জাতিসত্তার শিকড়। শিকড় উপড়ে ফেলা যাবে না।   

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন