৯ নভে, ২০২৩

আল্লামা ইকবাল ভার্সেস হুসাইন মাদানী


মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি। এ তত্ত্ব আধুনিক যুগের কোন আবিষ্কার নয়। দুনিয়ার প্রথম মানুষ একজন মুসলমান, আল্লাহর নবী ও খলিফা ছিলেন। আল্লাহ তাঁকে অগাধ জ্ঞান ভান্ডার দান করেন। তাঁর থেকে ইসলাম ও ইসলামী জাতীয়তার সূচনা। উপমহাদেশে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে এ তত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক ও স্বাধীন আবাসভূমি দাবী করা হয়েছিল। এ জাতীয়তা ইসলামের শাশ্বত 'থিওরি' বা মতবাদ। 


হিন্দু প্রধান দল কংগ্রেস উপমহাদেশের সংখ্যালঘু মুসলমানের উপর সংখ্যাগুরু হিন্দুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে এক জাতীয়তার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন এক প্রখ্যাত আলেম, দেওবন্দের শায়খুল হাদীস মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী। তিনি কংগ্রেসের সুরে সুর মিলিয়ে ঘোষণা করেন একই ভৌগোলিক সীমারেখার ভিতরে বসবাসকারী মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে মিলে এক জাতি। এই বিষয়ে তিনি বইও লিখেন। তিনি দেওবন্দভিত্তিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর সভাপতি ছিলেন। 

মুসলিম লীগ উপমহাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের (মুসলিম ও মুশরিক দুই জাতি) ভিত্তিতেই পাকিস্তানের দাবী করে। মাওলানা মাদানীর উপরোক্ত ঘোষণায় শুধু মুসলিম লীগ নয়, আলেম সমাজ ও সাধারণ মুসলমান বিস্মিত ও হতবাক হয়ে পড়ে। তখনো পাকিস্তান দাবী উত্থাপিত না হলেও মুসলমান একটি স্বতন্ত্র জাতি এ সত্যটি সকলের জানা ছিল এবং বারবার এ কথা বিভিন্ন সময়ে ঘোষণা করা হয়।

মাওলানা মাদানীর উক্ত ঘোষণা পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালকে অবহিত করা হয়। তিনি ছিলেন রোগশয্যায় শায়িত। তিনি ধীরে ধীরে কম্পিত কলেবরে শয্যার উপর উঠে বসেন এবং স্বভাব কবি রোগযন্ত্রণার মধ্যেও কয়েকছত্র কবিতার সুরে মাদানী সাহেবের উক্তির তীব্র সমালোচনা করেন— 

আজম হনুয্ নাদানিস্ত রমূ যে দ্বীন ওয়ার না,
যে দেওবন্দ্ হুসাইন আহমদ ইচেবুল্‌ আজবীস্ত্। 
সরুদে বর সরে মেম্বর কে মিল্লাত আহ্ ওতনস্ত্, 
চে বেখবর আয্ মকামে মুহাম্মদে আরবীস্ত্। 
বমুস্তাফা বরে সাঁ খেশরা কে দ্বীন হুমাউস্ত, 
আগার বাউ নারসীদী তামামে বু লাহাবীস্ত্।
- (আল্লামা ইকবাল : আরমগানে হেজায, পৃঃ ২৭৮)

অর্থ :
আজমবাসী দ্বীনের মর্ম বুঝেনি মোটে,
তাই দেওবন্দের হুসাইন আহমদ কন আজব কথা ।
মিম্বর থেকে ঘোষণা করেন, 'ওয়াতন থেকে মিল্লাত হয়' 
মুহাম্মদ আল আরাবীর মর্যাদা থেকে বেখবর তিনি।
পৌঁছিয়ে দাও নিজেকে মুস্তাফার কাছে,
এসেছে গোটা দ্বীন তাঁর থেকে,
পৌঁছাতে না পার যদি, সবই হবে বৃথা!

আল্লামা ইকবাল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন রাসূল সা.-এর কথা। মিল্লাত বা জাতীয়তা হবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে, ভূমির ভিত্তিতে নয়। মুসলিমরা ভাই ভাই, তারা এক জাতি। এখানে বাঙালি, আর্, তুর্কি আর হিন্দুস্তানীর কোনো স্থান নেই। আবার দু'জন বাঙালির একজন মুসলিম ও একজন মুশরিক হলে তারা কখনো জাতিভাই হতে পারে না।    

ড. ইকবালের কয়েক ছত্র কবিতা যদিও মাওলানা মাদানী সাহেবের মতবাদ খন্ডন করলো, তথাপি তা এক জাতীয়তা মিথ্যা প্রমাণ করার জন্যে যথেষ্ট ছিলনা। আল্লামা ইকবাল এই বিষয়ে মাওলানা মওদূদীকে লিখতে অনুরোধ করেন। 

মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী উপমহাদেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির চুলচেরা পর্যালোচনা করে তাঁর সম্পাদিত মাসিক তর্জুমানুল কুরআনে ধারাবাহিকভাবে 'মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসি কাশমাকাশ' নামে ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন।

এই লেখাগুলো একত্র করে বইও প্রকাশিত হয়। মাওলানা মওদূদীর এই বই মুসলিম সমাজে ব্যাপক সাড়া তৈরি করে। দেওবন্দী ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতি মুসলিমদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। 

শুধু তাই নয়, এই বইয়ের প্রভাবে জমিয়তে উলামায় হিন্দ থেকে বের হয়ে আসেন মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানীর নেতৃত্বে একটি দল। তারা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে নতুন দল করেন। মাওলানা আশরাফ আলী থানবিও এই নতুন দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।  


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন