৫ এপ্রি, ২০২৫

সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ০৭ : সংবিধানের মূলনীতি কী হওয়া উচিত!!

বাংলাদেশ মুসলিমদের দেশ। এদেশ পরিচালনার জন্য গঠিত সংবিধান অবশ্যই মুসলিমদের চেতনার আলোকেই হতে হবে। সংবিধানের মূলনীতি যা হওয়া উচিত।
১. আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব
২. আদল ও ইনসাফ
৩. শুরাভিত্তিক শাসন (গণতন্ত্র)
৪. ইনসানিয়াত / মানবতা
৫. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা

আমরা গত দুই পর্বে ১ থেকে ৩ নং মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ৪ নং মূলনীতি 'মানবতা' নিয়ে আলোচনা করবো।

মানবতা মানে হলো একজন মানুষ পৃথিবীতে মর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে জীবন অতিবাহিত করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা। মানুষের জন্য সংবিধান কখনোই মানবতা বা ইনসানিয়াতের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না।

১। জীবনের মর্যাদা ও বেঁচে থাকার অধিকার

কুরআন মজীদে পৃথিবীর প্রথম হত্যাকান্ডের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি ছিলো মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম দুঃখজনক ঘটনা। সেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করেছিল। প্রথম বারের মতো তখনই প্রয়োজন দেখা দেয় মানুষকে মানুষের প্রাণের মর্যাদা শেখানোর এবং একথা বলে দেয়ার যে, প্রত্যেক মানুষেরই বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এ ঘটনার উল্লেখ করার পর কুরআন বলছেঃ

“কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো লোককে হত্যা করে, যে লোক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনো গোটা মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনো গোটা মানব জাতিকে বাঁচালো।” (আল মায়েদাঃ আয়াত-৩২)

কুরআন মজীদ এ আয়াতে একজন মানুষের অন্যায় হত্যাকে গোটা মানব জাতির হত্যা বলে উল্লেখ করেছে। আবার একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে গোটা মানবজাতির জীবন রক্ষার সমকক্ষ বলে ঘোষণা করেছে।

অন্য কথায় কোনো মানুষ যদি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য চেষ্টা করে তাহলে সে গোটা মানব জাতিকে জীবিত রাখার কাজ করে। এ ধরনের প্রচেষ্টা এতো বড় কল্যাণের কাজ যে, এটাকে গোটা মানবতাকে জীবিত করার সমান গণ্য করা হয়েছে। কেবল দু’টি অবস্থায় এ নীতির ব্যতিক্রম করা যাবেঃ

একঃ কোনো ব্যক্তি হত্যার অপরাধে অপরাধী হলে কিসাস নেয়ার জন্য (বিচারের মাধ্যমে) তাকে হত্যা করা যাবে।

দুইঃ কোনো ব্যক্তি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করলে তাকেও হত্যা করা যাবে (বিচারের মাধ্যমে)।

এ দু’টি ব্যতিক্রমী অবস্থা ছাড়া আর কোনো অবস্থায়ই মানুষ হত্যা করা যাবে না।

মানব ইতিহাসের প্রাথমিক যুগেই মহান আল্লাহ মানব জীবনের নিরাপত্তা বিধানের এ নীতি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন। অসভ্যতার অন্ধকারের মধ্যে মানুষের জন্ম, এমন ধারণা পোষণ করা ভুল। মানুষ তার আপন প্রজাতি অর্থাৎ অন্য মানুষকে হত্যা করতে করতে কোনো এক পর্যায়ে পৌছে চিন্তা করে যে, মানুষকে হত্যা করা ঠিক নয়, এ ধারণাও একেবারেই ভ্রান্ত। এটা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা প্রসূত। কুরআন আমাদের বলে, মহান আল্লাহ প্রথম থেকেই মানুষকে পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে মানুষের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করেছেন।

২। নিরাপত্তা লাভের অধিকার

কুরআন এবং রসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে স্পষ্ট জানা যায়ঃ নারী, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু ও অসুস্থ মানুষ নিজ জাতির লোক হোক কিংবা শত্রু কওমের লোক, কোনো অবস্থায়ই তাদের উপর আঘাত করা বৈধ নয়। তবে তারা যুদ্ধরত থাকলে ভিন্ন কথা। তা না হলে অন্য যে কোনো অবস্থায়ই তাদেরকে আঘাত করা নিষিদ্ধ। এ নীতি শুধু নিজ জাতির জন্য নয়। বরং গোটা মানবতার জন্যেই এ নীতি প্রযোজ্য।

মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে অত্যন্ত স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। খোলাফায়ে রাশেদীন শত্রুর বিরুদ্ধে কোনো সেনাবাহিনী পাঠানোর সময় গোটা সেনাদলকে সম্বোধন করে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিতেনঃ ‘শত্রুর উপর আক্রমণের সময় কোনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ, আহত, পঙ্গু ও রুগ্ন ব্যক্তিকে আঘাত করবে না।’

শুধু তাই নয়, আল্লাহ তায়ালা মু'মিনদের নির্দেশ দিয়েছেন অসহায় মানুষদের উদ্ধার করার জন্য। তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও। (সূরা নিসাঃ৭৫)

৩। মহিলাদের মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভের অধিকার

কুরআন মজিদ থেকে আরো একটি মৌলিক অধিকারের কথা জানা যায়। এটি সম্পর্কে হাদিসেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে। সেটি হলো, নারীদের মান-সম্ভ্রমের প্রতি সর্বাবস্থায় অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে। অর্থাৎ যুদ্ধ ক্ষেত্রেও যদি শত্রু কওমের নারীরা মুসলমান সৈনিকদের হস্তগত হয় তাহলে তাদের উপর হস্তক্ষেপ করা কোনো মুসলমান সৈনিকের জন্যে বৈধ নয়। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে যে কোনো নারীর সাথে ব্যভিচার হারাম। সে নারী মুসলিম হোক বা অমুসলিম। স্বজাতির হোক বা বিজাতির। বন্ধু দেশের হোক বা শত্রু দেশের-তাতে কিছু আসে যায় না।

৪। ন্যায় আচরণ লাভের অধিকার
কুরআন মজীদ একটি অলংঘণীয় নীতি প্রদান করেছে যে, মানুষের প্রতি ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতে হবে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেনঃ
“কোনো সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা দলের প্রতি শত্রুতা তোমাদেরকে যোনো তাদের প্রতি বে-ইনসাফী করতে উৎসাহিত না করে। ইনসাফ করো এটি তাকওয়ার সর্বাধিক নিকটবর্তী।” (সুরা ৫ মায়েদাঃ আয়াত ৮)

এ আয়াতটিতে ইসলাম একটি নীতি ঠিক করে দিয়েছে। তাহলো, মানুষের সাথে-সে ব্যক্তি হোক বা গোষ্ঠী, সর্বাবস্থায় ইনসাফ করতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এ নীতি মোটেই ঠিক নয় যে, আমরা বন্ধুদের সাথে ন্যায় ও ইনসাফের আচরণ করবো আর শত্রুর সাথে আচরণের ক্ষেত্রে এ নীতি পরিহার করবো।

৫। ভালো কাজে সহযোগিতা এবং মন্দ কাজে অসহযোগিতা
কুরআন আরো একটি মূলনীতি দিয়েছে। তা হলো, ভালো ও ন্যায়ের কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করা এবং অন্যায় ও যুলুমের কাজে কারো সাথে সহযোগিতা না করা। ভাইও যদি মন্দ কাজ করে তাহলে আমরা তার সাথেও সহযোগিতা করবো না। আর কল্যাণের কাজ যদি শত্রুও করে তাহলে তাকেও সহযোগিতা করবো। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
“কল্যাণমূলক কাজে সবার সাথে সহযোগিতা করো এবং পাপ কাজে কারো সাথে সহযোগিতা করোনা” ( আল কুরআন, সূরা ৫: আয়াত ২)

৬। সমতার অধিকার
আরেকটি নীতি কুরআন মজীদ অত্যন্ত জোরালোভাবে বলে দিয়েছে। নীতিটি হলো, সমস্ত মানুষ সমান। কেউ মর্যাদা লাভ করলে তা করবে উত্তম নৈতিক চরিত্রের কারণে। এ ব্যাপারে কুরআন ঘোষণা করেছেঃ
“হে মানবজাতি, আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে বিভক্ত করেছি - যাতে করে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তবে তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বেশি আল্লাহভীরু সে-ই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান।” (সুরা ৪৯ হুজুরাতঃ আয়াত ১৩)

এ আয়াতে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো সমস্ত মানুষের জন্ম-উৎস এক। ভিন্ন ভিন্ন বংশধারা, ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রকৃতপক্ষে মানব বিশ্বকে বিভক্ত করার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ হতে পারেনা।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বলা হয়েছে তা হলো, ‘আমি মানব সমাজকে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি শুধু তাদের পারস্পরিক পরিচয়ের জন্য।’ অন্য কথায় একটি গোষ্ঠী, একটি জাতি এবং একটি গোত্রের অন্যদের উপর মর্যাদা ও গৌরবের এমন কিছু নেই যে, তা নিজেদের অধিকার বাড়িয়ে দেবে এবং অন্যদের কমিয়ে দেবে।

আল্লাহ তা’য়ালা যে সব পার্থক্য করেছেন অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি দান করেছেন এবং পরস্পরের ভাষা আলাদা করেছেন, এসব পার্থক্য গর্ব প্রকাশ করার জন্যে নয়। বরং এ জন্যে করেছেন যাতে করে পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ের পার্থক্য করা যায়। যদি সব মানুষ একই রকম হতো তাহলে তাদের মধ্যে পার্থক্য করা যেতো না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এ বিভক্তি স্বাভাবিক। তবে এটা অন্যের অধিকার নস্যাত করা এবং বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যে নয়। মর্যাদা ও গৌরবের ভিত্তি হলো উন্নত নৈতিক চরিত্র। এ বিষয়টি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকভাবে বর্ণনা করেছেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে তিনি বলে দেনঃ

“কোনো আরবের কোনো অনারবের উপর এবং কোনো অনারব কোনো আরবের উপর এবং কোনো সাদা বর্ণের কোনো কালো বর্ণের মানুষের উপর এবং কোনো কালো বর্ণের কোনো সাদা বর্ণের মানুষের উপর কোনো প্রকার মর্যাদা নেই একমাত্র তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতি ছাড়া। বংশের ভিত্তিতে কারো কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই।”

অর্থাৎ- মর্যাদার ভিত্তি শুধু উন্নত নৈতিক চরিত্র এবং আল্লাহভীতি। ব্যাপারটা এমন নয় যে, কোনো মানুষকে রৌপ্য, কোনো মানুষকে পাথর আবার কোনো মানুষকে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। বরং সমস্ত মানুষ পরস্পর সমান।

৭। রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের অধিকার

মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সমূহের মধ্যে ইসলাম একটি বড় অধিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাহলো সমাজের সমস্ত মানুষের রাজনৈতিক ও সরকারী কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণের অধিকার। ইসলাম কোনো সমাজের মানুষকে উচু ও নীচু বা শাসক ও শাসিত হিসেবে বিভক্ত করার পক্ষপাতি নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষের পরামর্শক্রমে সরকার গঠিত হবে। কুরআন বলেছেঃ
لِـيَـسـتَـخـلِـفَـنَّـهُـم فِـى اَلارضِ
‘আল্লাহ তা’য়ালা তাদেরকে-অর্থাৎ ঈমানদারদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন।’ (আল কুরআন, সূরা নূর, আয়াত-৫৫) এখানে আল্ল্লাহ বহু বচনের শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বলেছেন আমি কিছু সংখ্যক লোককে নয় বরং গোটা জাতিকে খিলাফত দান করবো। সরকার শুধু এক ব্যক্তির, এক পরিবারের কিংবা একটি শ্রেণীর হবে না। বরং তা হবে গোটা জাতির এবং সব লোকের পরামর্শের ভিত্তিতে তা অস্তিত্ব লাভ করবে। কুরআনের ঘোষণা হচ্ছেঃ
شُـورى بَـيـنَـهُـم وَاَمـرُهُـم
অর্থাৎ ‘এ সরকার সবার পরামর্শ নিয়ে কাজ করবে।’ (আল-কুরআন, সূরা শুরাঃ আয়াত-৩৮। এ ছাড়া দেখুন- সূরা নিসাঃ আয়াত-১৫৯)

এ ব্যাপারে হযরত উমর রা· -এর সুস্পষ্ট মতামত বিদ্যমান। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া তাদের সরকার পরিচালনা বা তাদের উপর শাসনকার্য পরিচালনার অধিকার কারো নেই। মুসলমানরা সম্মত হলে তাদের সরকার পরিচালনা করা যাবে। তারা সম্মত না হলে তা করা যাবে না। এ বিধানের ভিত্তিতে ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ও পরামর্শ ভিত্তিক সরকার গঠনের নীতি অনুমোদন করে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের ঘাড়ে রাজতন্ত্র চেপে বসেছিল।

৮। ব্যক্তি মালিকানার নিরাপত্তা
আর একটি মৌলিক অধিকার হলো মানুষের ব্যক্তি মালিকানার অধিকার। এ ব্যাপারে কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ধারণা পেশ করেছে। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেনঃ وَلا تَـا كُـلُـوا اَمـوَالَـكُـم بَـيـنَـكُـم بِـالـبَـاطِـلِ ‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের অর্থ-সম্পদ ভোগ দখল করো না।’ (সূরা ১ আল বাকারাঃ আয়াত ১৮৮)

কুরআন, হাদিস ও ফিক্‌হ অধ্যয়ন করলে অপরের অর্থ সম্পদ ভোগের অন্যায় পন্থা কি কি তা জানা যায়। এসব অবৈধ পন্থা ইসলাম অস্পষ্ট রেখে দেয়নি। এ নীতি অনুসারে কোনো ব্যক্তির সম্পদ অবৈধভাবে হস্তগত করা যায় না।

স্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে ইসলাম সম্পদ লাভের যেসব নিয়ম-নীতি ও পন্থা-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তা ভংগ করে কারো ব্যক্তি মালিকানার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো ব্যক্তি বা সরকারের নেই।

৯। মান-সম্মানের নিরাপত্তার অধিকার

মান-সম্ভ্রমের নিরাপত্তা লাভ করাও মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। এ অধিকার সম্পর্কে কুরআনে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা বলছেনঃ

একঃ لا يَـسـخَـر قَـومٌ مّـن قَـومِ 'তোমাদের মধ্যকার একদল যেন আরেক দলকে নিয়ে হাসি-তামাশা বিদ্রুপ না করে।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১১)
দুইঃ وَلا تَـنَـابَـزُوا بِـالالـقَابِ ‘তোমরা একজন অন্যজনকে মন্দ উপাধি দিয়ে ডেকো না।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১১)
তিনঃ وَلا يَـغـتَـب بَـعـضُـكُـم بَـعـضًا ‘তোমরা একে অপরের নিন্দা (অসাক্ষাতে) করো না।’ (সূরা ৪৯ হুজরাতঃ আয়াত-১২)

অর্থাৎ মানুষের সম্মান ও সম্ভ্রমের উপর আক্রমণ করার যতো উপায় ও পন্থা হতে পারে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে, কোনো মানুষ সে সামনে উপস্থিত থাক বা না থাক তাকে নিয়ে বিদ্রুপ ও হাসি-তামাশা করা যাবে না, তাকে মন্দ নামে আখ্যায়িত করা যাবে না এবং তার নিন্দাবাদও করা যাবে না। কেও কারো মর্যাদার উপর আঘাত করবেনা। হাত ও মুখের দ্বারা কারো উপর কোনো প্রকার যুলুম করবে না। এটা প্রতিটি মানুষের আইনগত অধিকার।

১০। ব্যক্তিগত জীবনে গোপনীয়তার নিরাপত্তা

ইসলামের দেয়া মৌলিক অধিকার অনুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ব্যক্তিগত জীবনকে নিরাপদ রাখার অধিকার রাখে। এ ব্যাপারে কুরআনে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে।
‘তোমাদের নিজেদের ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করোনা যতোক্ষণ না তাদের সাগ্রহ সম্মতি পাও।’( আল কুরআন, সূরা ২৪ নূরঃ আয়াত-২৭)

কুরআনে বলা হয়েছে لا تَـجَـسَّـسُـو অর্থাৎ- অপরের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করো না।’ (সূরা ৪৯ হুজুরাতঃ আয়াত ১২) নবী সা· বলেছেনঃ ‘নিজের ঘর থেকেও অন্যের ঘরে উঁকি দেয়ার অধিকার কারো নেই।’

নিজের ঘরে বসে অন্য কোনো লোকের শোর-গোল, উঁকি-ঝুঁকি ও হস্তক্ষেপ থেকে নিরাপদ থাকার পূর্ণ আইনগত অধিকার যে কোনো মানুষের আছে। যে কোনো ব্যক্তির খোলামেলা পারিবারিক পরিবেশ ও গোপনীয়তা বজায় থাকার অধিকার রয়েছে। এ ছাড়া কারো চিঠি-পত্র পড়াতো দূরের কথা উপর থেকে দৃষ্টি দিয়ে দেখার অধিকারও কারোর নেই। ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার পুরোপুরি নিরাপত্তা দেয় এবং অন্যের ঘরে উঁকি-ঝুঁকি মারতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করে। একইভাবে ডাকে আসা কারো জিনিস পত্রও দেখা যাবে না। তবে কারো ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্রে যদি জানা যায় যে, সে বিপজ্জনক কাজ-কর্মে লিপ্ত আছে তা হলে ভিন্ন কথা। কারো দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা ইসলামী শরীয়তে বৈধ নয়।

১১. স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার

মানুষের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার (Freedom of expressian) অধিকার। কুরআন এটাকে বলেছে, ‘আমর বিল মারুফ ও নাহী আনিল মুনকার (امـر بـالـمـعـروف ونـهـى عـن الـمـنـكر)’। এটা মানুষের শুধু অধিকারই নয় বরং এটা তার জন্য কুরআন ও হাদিস উভয়ের নির্দেশ অনুসারেই ফরয।(কুরআন বলেঃ كُـنـتُـم خَـيـرَ اُمَّـةٍ اُخـرِجَـت لِلـنَّـاسِ تَـامُـرُونَ بِـالـمَـعـرُوفِ وَتَـنـهَـونَ عَـنِ الـمُـنـكَـرِ- النساء:110 ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মাহ। মানবতার কল্যাণের জন্যে তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে। তোমরা মারূফ (ভালো) কাজের আদেশ করবে এবং মুনকার (মন্দ কাজ করতে নিষেধ করবে।’) মানুষের জন্য ফরয (কর্তব্য) হলো সে অন্য মানুষকে ভালো বা কল্যাণের কাজের জন্য আহবান জানাবে এবং মন্দ বা অকল্যাণের কাজ থেকে বিরত থাকতে বলবে।

কোনো মন্দ বা অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে থাকলে তার বিরুদ্ধে সে শুধু সোচ্চারই হবে না, বরং তা বন্ধ করার চেষ্টা করাও তার জন্য ফরয। এ ধরনের কাজের বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রতিবাদ না করা হয় এবং বন্ধ করার জন্য চিন্তা-ভাবনা না করা হয় তা হলে অপরাধ হবে। ইসলামী সমাজকে পূত-পবিত্র রাখা মুসলমানের কর্তব্য। এ ব্যাপারে মুসলমানদের কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার চেয়ে বড় অপরাধ আর নেই।

কেউ যদি কোনো কল্যাণমূলক কাজে বাধা দেয় তাহলে সে শুধু একটি মৌলিক অধিকারকেই হরণ করলো না, বরং একটি ফরয পালনেও বাধার সৃষ্টি করলো। সমাজ দেহের সুস্থতা বজায় রাখতে একজন মানুষের সর্বাবস্থায় এ অধিকার থাকতে হবে। পবিত্র কুরআন ইসরাঈলীদের পতনের যেসব কারণ বর্ণনা করেছে তার মধ্যে একটি হলো, তারা একে অপরকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতো না। (আল কুরআন, সূরা মায়িদা, আয়াত-৭৯)

১২. স্বাধীন বিবেক ও বিশ্বাসের অধিকার
ইসলাম দিয়েছে لا اِكـرَاهَ فِـى الـدّيـنِ (দীনের ক্ষেত্রে কোনো জবরদস্তির অবকাশ নেই) -এর নীতি। এ নীতি অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি কুফরি বা ঈমান এ দু’টি পথের যে কোনোটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা রাখে। বিবেক ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের সুযোগ ইসলামে নেই। ইসলামে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন থাকলে দু’টি ক্ষেত্রেই তা আছে।

একঃ ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও তার স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্য যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবিলার ক্ষেত্রে এবং
দুইঃ আইন-শৃঙ্খলা এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য অপরাধ ও ফিৎনা-ফাসাদ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে।

১৩. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত থেকে বাঁচার অধিকার
বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করুক এবং একে অপরের ধর্মীয় নেতাদের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করুক ইসলাম তার পক্ষপাতী নয়। কুরআন প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস এবং তার ধর্মীয় নেতাদের মর্যাদা দিতে শিখিয়েছে। কুরআন বলেঃ وَلا تَـسُـبُّـوا الَّـذِيـنَ يَـدعُـونَ مِـن دُونِ الـلّهِ ‘তারা আল্লাহ ছাড়া আর যেসব বস্তুকে উপাস্য বানিয়ে ডাকে তোমরা তাদের (সেসব উপাস্যকে) গাল মন্দ করো না।’ (আল কুরআন, সূরা ৬ আল আনআম। আয়াতঃ ১০৮)

অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্ম ও আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে কথা বলা এবং তার যুক্তিসংগত সমালোচনা করা অথবা মতানৈক্য প্রকাশ করা স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতিকে আহত করার জন্য কটুক্তি বা গাল-মন্দ করা অন্যায়।

১৪. অপরের কর্মকান্ডের দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যাহতির অধিকার
ইসলাম বলে, মানুষ শুধু নিজের কাজকর্ম এবং নিজের কৃত অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। অন্য কারো অপরাধ বা কৃতকর্মের জন্য তাকে পাকড়াও করা যাবেনা।
কুরআন প্রদত্ত মৌলনীতি হলোঃ
وّزرَ اُخـرَى. الانـعام : 164 وَلا تَـزِرُ وَازِرَةٌ
“কোনো বোঝা বহনকারী অন্য কারো বোঝা বহন করবে না” (সুরা ৬ আল আন’আমঃ আয়াত ১৬৪)। ইসলামী আইনে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কোনো সুযোগ নেই।

১৫. সন্দেহের শিকার হওয়া থেকে মুক্ত থাকার অধিকার
নিরঙ্কুশভাবে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া ছাড়া কারো বিরুদ্ধে সন্দেহ বশতঃ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। ইসলামে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এ অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। এ ব্যাপারে কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ হলো, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সে বিষয়ে তদন্ত করে দেখো। অজ্ঞতা প্রসূত কোনো ব্যবস্থা যেনো তার বিরুদ্ধে গ্রহণ না করো। কুরআন নির্দেশ দেয়ঃ
اَجـتَـنِـبُـوا كَـثِـيـرًا مّـن الـظَّـنّ
অর্থঃ ‘ধারণা প্রসূত বেশিরভাগ বিষয় থেকে বিরত থেকো।’ (সূরা ৪৯ আল হুজুরাতঃ আয়াত ১২)

বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে মানবতা থাকার মানে হলো
১. মানুষের অধিকার নষ্ট হয় এমন কোনো আইন বা বিধান সংবিধানে অন্তঃর্ভুক্ত হবে না।
২. মানবতার সাথে সাংঘর্ষিক যে কোনো বিধান বাতিল হবে
৩. মানুষ তার মানবিক মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে এদেশে বসবাস করতে পারবে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন