ভারতের পার্লামেন্টে সম্প্রতি পাস হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ নিয়ে তৈরি হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি খোদ ভারতের বিরোধী দলের নেতারাও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন। বলা হচ্ছে, এ আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের দানকৃত মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও আশ্রয়কেন্দ্রের মতো ধর্মীয় সম্পদগুলোয় সরকারি হস্তক্ষেপ ও দখলের পথ তৈরি করা হয়েছে।
গত ৩ এপ্রিল ভারতের লোকসভায় বিলটি পাস হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে বলছেন, লোকসভায় পাসকৃত বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী এবং মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, মালিকানা ও অধিকার হরণে বিজেপি সরকারের ধারাবাহিক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টারই আরেকটি বহিঃপ্রকাশ।
ওয়াকফ সম্পত্তি কী?
মুসলিমদের কল্যাণে মুসলিমদের বরাদ্দ করা সম্পত্তিকেই ওয়াকফ সম্পত্তি বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কৃষিজমি, দালানকোঠা, দরগাহ/মাজার ও কবরস্থান, ইদগাহ, খানকাহ, মাদ্রাসা, মসজিদ, প্লট, পুকুর, স্কুল, দোকানপাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ওয়াকফের প্রচলন ১২শ শতকে শুরু হয়, যখন মুসলিম শাসক মুহাম্মদ ঘোরি হিন্দুস্থানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং দুটি গ্রাম ওয়াকফ হিসেবে একটি লিখিত অনুদানের মাধ্যমে দান করেন। দিল্লি সালতানাতের শাসনামলে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। যেখানে ইলতুতমিশ, মুহাম্মদ বিন তুঘলক ও আলাউদ্দিন খলজি ওয়াকফ সম্পত্তি প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সময় ওয়াকফ ব্যবস্থার আরও প্রসার ঘটে।
আকবর ও শাহজাহান গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি ওয়াকফ করেন, যার মধ্যে তাজমহলও রয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রসার ও ধর্মান্তরের ফলে এই ব্যবস্থার বিস্তার গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াকফের জন্য অর্থায়ন মূলত ওয়াকফকৃত গ্রামের রাজস্ব থেকে আসত, যা প্রায়ই হিন্দুপ্রধান গ্রাম ছিল এবং এই অর্থ মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য ব্যবহার করা হতো।
ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে ওয়াকফ ব্যবস্থাকে আরও সংগঠিত ও আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়, যা বর্তমান ভারতীয় আইনের অধীন এখনো প্রযোজ্য। ১৯১৩ সালে ওয়াকফ বোর্ড গঠন করা হয়, এবং ১৯২৩ সালে "মুসলমান ওয়াকফ আইন" প্রণয়ন করা হয়, যা রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলোর কার্যক্রম ও সুষ্ঠু প্রশাসনের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করত। ওয়াকফ হল মুসলিম আইনে স্বীকৃত একটি স্থায়ী দান, যেখানে অস্থাবর বা স্থাবর সম্পত্তি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে দান করা হয়। এই অনুদানকে "মুশরুত-উল-খিদমত" বলা হয়, এবং যিনি এই দান করেন তাকে "ওয়াকিফ" বলা হয়।
ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫
ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫ ভারতীয় লোক সভায় ২০২৪ সালে ৮ই আগস্ট পেশ করা হয়। এই বিলে ১৯২৩ সালের মুসলমান ওয়াকফ আইন বাতিল এবং ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ওয়াকফ বোর্ড কতটুকু জমি আছে?
হিন্দুস্থানে ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে ৮.৭ লক্ষ সম্পত্তি আছে। ৯.৪ লক্ষ একর জমি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে ওয়াকফ। যার আনুমানিক মূল্য ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। ওয়াকফ বোর্ড ভারতীয় রেল এবং সশস্ত্র বাহিনীর পরে তৃতীয় বৃহত্তম জমির মালিক। মূলত এটাই বিজেপির মাথাব্যাথার কারণ। মুসলিমদের কল্যাণে ব্যবহার হওয়া এই বিপুল সম্পত্তি হস্তগত ও রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করার জন্য ওয়াকফ সংশোধনী বিল আনা হয়েছে।
বিজেপি সরকার কেন ওয়াকফ আইন সংশোধন করছে?
১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিলে বলা হয়েছিল, ওয়াকফ বোর্ডগুলিকে বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের সম্পত্তি জেলা কালেক্টরদের কাছে নথিভুক্ত করতে হবে, যাতে তাদের প্রকৃত মূল্যায়ন নিশ্চিত হয়। বর্তমানে, ওয়াকফ বোর্ডের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচিত হন, তবে নতুন বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পরে সমস্ত সদস্যকে সরকার মনোনীত করবে। আশঙ্কা রয়েছে যে এই বিধানটি ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের বোর্ডের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করবে। নতুন বিলে বলা হয়েছে, একজন অমুসলিমও সিইও হতে পারবেন এবং কমপক্ষে দুজন সদস্য অমুসলিম হতে হবে।
বর্তমান ওয়াকফ বিলের ৪০ নম্বর ধারার আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ বোর্ডের দখল করা সম্পত্তি বা জমিতে কোনো রকম সরকারি পর্যালোচনা বা রিভিউ করা যায় না। পর্যালোচনা ছাড়াই ওয়াকফ বোর্ড সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো সম্পত্তি নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ওয়াকফ বোর্ডের আইনি বিবাদ চললেও তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না সরকার। সংশোধিত বিলে সরকার মূলত ওয়াকফ অধিকার খর্ব করতে চাইছে। বিতর্কিত কোনো সম্পত্তির মালিকানা আদতে কার, তাও খতিয়ে দেখার আইনি এক্তিয়ার সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে।
এর মাধ্যমে একাধিক ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের একচ্ছত্র অধিকার খর্ব করা হতে পারে। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের সেই একচ্ছত্র অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনো সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে জেলাশাসক বা সমপদমর্যাদার কোনো অফিসারের হাতে। এ ছাড়াও রয়েছে একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ নিয়ন্ত্রণ করার প্রস্তাব। পুরোনো আইন অনুযায়ী কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা করলে চিরদিনের জন্য সেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবেই থেকে যেত। নতুন বিল পাস হলে এবার সেটাকেও চ্যালেঞ্জ করা যাবে। ফলে যে সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ডের বলে ঘোষণা করে, তাতে ইসলামিক ধর্মস্থান বা অন্য কোনো ইসলামিক প্রার্থনাস্থল তৈরি হলেও সেটাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে দাবি করা যেতে পারে।
সমালোচকরা বলছেন, নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন, অমুসলিমদের (মূলত হিন্দুদের) সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, কোন সম্পত্তি ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে কোনটা হবে না সরকারকে তা নির্ধারণের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ ওয়াকফকৃত সম্পদ পরিচালনা ও ভোগের একমাত্র হকদার মুসলমানরা। এই বিলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওয়াকফ আইনকে দুর্বল করে দেওয়া এবং ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও দখল করার আইনি পথ তৈরি করা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন