১৫ জুল, ২০২৫

জুলাই ডায়েরি : ১৫ জুলাই



আজ ১৫ জুলাই।

২০২৪ সালের এই দিনে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ। রাত নয়টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

হামলা ও সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের পাশাপাশি সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার নেতা–কর্মীরা অংশ নেয়। তাঁদের হাতে ছিল হকিস্টিক, লাঠি, রড, জিআই পাইপসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্র। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায় অন্তত পাঁচজন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি গতকাল হামলার ঘটনা ঘটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব হামলার ঘটনাতেও ছাত্রলীগের নাম এসেছে। তবে মূল সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৫ জুলাই বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের খুঁজে খুঁজে পেটায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। পরে বিভিন্ন হলের কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে আন্দোলনকারীদের খুঁজতে থাকেন তারা। হামলার মুখে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ক্যাম্পাস ছেড়ে আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন।

হামলায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ছাড়া হামলার ছবি তুলতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে আহত ও তাঁদের সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা করে ছাত্রলীগের জঙ্গীরা। সন্ধ্যার পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরেও মারধরের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুরো হাসপাতালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা ছোটাছুটি করতে থাকেন।

১৫ জুলাই সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকেও আন্দোলনকারীরা বের হয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিপুলসংখ্যক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নেন। তখন খবর আসে, বিভিন্ন হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বের হতে বাধা দিচ্ছে ছাত্রলীগ। এ সময় বিজয় একাত্তর হল, জিয়াউর রহমান হল, শেখ মুজিবুর রহমান হল ও জসীমউদ্‌দীন হল থেকে রাজু ভাস্কর্যে থাকা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা চাওয়া হয়।

বেলা ২টা ২৫ মিনিটে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে পাশাপাশি থাকা ওই হলগুলোর দিকে যান। অন্য অংশটি টিএসসিতে অবস্থান করেন। আন্দোলনকারীরা প্রথমে মিছিল নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেন। হলের ভেতরের ফটকের সামনে গিয়ে তাঁরা রিকশায় থাকা মাইকে ‘বঙ্গবন্ধু হলের ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকজন হলের ভেতরে ঢুকে কক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের আনতে যান। মিনিট কয়েক পর মিছিলটি বের হয়ে আসে।

বঙ্গবন্ধু হল থেকে বের হয়ে আন্দোলনকারীদের মাইক থেকে বলা হয়, তাঁরা খবর পেয়েছেন যে কয়েকজন আন্দোলনকারীকে পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে আটকে রাখা হয়েছে। এরপর তাঁরা যান জিয়াউর রহমান হলে। হলের সামনে গিয়ে তাঁরা ‘দালালদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’সহ নানা স্লোগান দেন। আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ভেতরে থাকা শিক্ষার্থীদের আনতে হলের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় বাইরে নানা স্লোগান দেওয়া হয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আন্দোলনকারীদের মিছিলটি জিয়াউর রহমান হল থেকে বের হয়ে বিজয় একাত্তর হলের ফটকের দিকে যায়। মিছিলটি হলের ফটকে যাওয়ার পর মাইকে বলা হয়, আন্দোলনকারীদের কয়েকজনকে বিজয় একাত্তর হল সংসদের কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। একপর্যায়ে মাইকে শিক্ষার্থীদের একাত্তর হলের ভেতরে ঢোকার আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, সন্ত্রাসীদের ধরে নিয়ে আসুন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা হলের বাগানে ঢুকে পড়েন। তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ওপর থেকে প্লাস্টিকের বোতল ও ঢিল ছুড়ছিলো। আন্দোলনকারীরাও নিচ থেকে ইট ও পাথরের টুকরা, ছেঁড়া জুতা হলের বিভিন্ন তলায় থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতিহত করতে থাকেন।

এর মধ্যে বিজয় একাত্তর হলের বাগানে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের মারামারি বেঁধে যায়। এ সময় ছাত্রলীগের কিছু নেতা আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে এলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। পরে ছাত্রলীগের আরও কিছু নেতা-কর্মী হলের বিভিন্ন তলা থেকে লাঠিসোঁটা, কাঠ, লোহার পাইপ ও বাঁশ নিয়ে দল বেঁধে নিচে নেমে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। আন্দোলনকারীরা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। অনেকে দৌড়ে জসীমউদ্‌দীন হলের ভেতরে প্রবেশ করেন, অনেকে মল চত্বরের দিকে দৌড় দেন। এরপর ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিজয় একাত্তর হলে ঘটনার শুরু হলে ছাত্রলীগের আশপাশের হলগুলোর (বঙ্গবন্ধু হল ও জিয়াউর রহমান হল) নেতা-কর্মীরাও সংঘর্ষে যোগ দেয়। মল চত্বরে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয় মাস্টারদা সূর্য সেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। সংঘর্ষ চলাকালে দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে ইট ও পাথরের টুকরা ছুড়তে থাকে।

বেলা সোয়া তিনটার দিকে টিএসসি থেকেও আন্দোলনকারীরা এসে সংঘর্ষে যোগ দেন। তাঁরা একজোট হয়ে ইট-পাথর নিক্ষেপসহ ধাওয়া দিলে ছাত্রলীগ হলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় উত্তেজিত আন্দোলনকারীরা বাঁশ ও কাঠ দিয়ে বিজয় একাত্তর হলের ফটকে নিরাপত্তা প্রহরীদের বসার কক্ষের জানালার কাচ ভাঙচুর করেন।

এরপর জসীমউদ্‌দীন হলের ছাদে থাকা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি ইট-পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণের জন্য থেমে সাড়ে তিনটার দিকে আবার পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকজনকে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে বেদম পেটান। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু হলের কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী হলের ফটকে লাঠিসোঁটাসহ অবস্থান নেন। তাঁদের লক্ষ্য করে আন্দোলনকারীরা ইট-পাথরের টুকরা নিক্ষেপ করেন, তাঁরাও দু–একবার ইট ছোড়েন আন্দোলনকারীদের দিকে। এরপর আরও দুবার দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। পরে বিকেল পৌনে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলের পেছনের পকেট গেট দিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রবেশ করতে দেখা যায়।

বিকেল চারটার দিকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসে। মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও নেতা–কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনে ছাত্রলীগ। তাঁরা দেশি অস্ত্রসহ পুরো ক্যাম্পাসে মহড়া দিতে থাকে। উপাচার্যের বাসভবন এলাকা (ভিসি চত্বর), মল চত্বর, ফুলার রোড, নীলক্ষেত সড়ক, টিএসসি, কলাভবন এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁরা শিক্ষার্থীদের খুঁজে খুঁজে মারধর করতে থাকে।

ভিসি চত্বর এলাকায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে আহত করেন ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। যাঁদের পিটিয়ে আহত করা হয়েছে, তাঁদের বড় অংশই ছিলেন নারী শিক্ষার্থী। হামলায় যাঁরা অংশ নেন, তাঁদের বড় অংশই ছিলেন বহিরাগত। এখানে ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের একাধিক ক্যামেরা ও মুঠোফোন ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। মারধর করে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে।

বিকেল পাঁচটার কিছু আগে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে গিয়ে অবস্থান নেন। আর হলের বাইরে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। দুই পক্ষ নিজেদের অবস্থান থেকে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পাঁচটার দিকে ওই এলাকায় অন্তত পাঁচটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য দোয়েল চত্বর হয়ে শহীদুল্লাহ হলের সামনে আসেন। পুলিশের সামনেই ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলতে থাকে। পৌনে নয়টার দিকে ছাত্রলীগ চলে যাওয়ার পর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ‘অপমানজনক’ বক্তব্য প্রত্যাহার ও কোটার যৌক্তিক সংস্কারের এক দফা দাবিতে আগামীকাল (আজ) বেলা তিনটায় সারা দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বৃহত্তর গণ–আন্দোলনে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীরা যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ঢুকতে না পারে, সে জন্য হলে হলে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।’

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আরও অন্তত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চালানো এসব হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া যশোরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন হেলমেটধারীরা। আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল রাতে এক ছাত্রকে মারধর করেছেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা–কর্মী।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল দিবাগত রাত ১২টার পর দ্বিতীয় দফায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। এ হামলায় বহিরাগতসহ ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতা–কর্মী অংশ নেন বলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, হামলাকারী ব্যক্তিদের অধিকাংশের মাথায় হেলমেট ও হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল। এ সময় দুটি পেট্রলবোমা ছুড়তে দেখা যায়। হামলা থেকে বাঁচতে শিক্ষার্থীরা ফটক খুলে উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নেন। রাত সোয়া ১২টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে।

২০২৪ সালের এই দিন সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও আপামর সাধারণ ছাত্র পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যায়।

#জুলাই_ডায়েরি




0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন