১১ সেপ, ২০১৭

অন্ধকারের গল্প



রহিমা... রহিমা... 
ঘুম থেকে উঠেই এই ডাকটিই ডাকতে হয় ছেরাজ মিয়াকে। বাবা মা নামটা সিরাজ রাখলেও সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়ে এখন এটা ছেরাজে পরিণত হয়েছে। ছেরাজের চোখে আলো নেই। উঠেই স্ত্রীকে ডাকে সে। স্ত্রী রহিমা যেখানেই থাকে এই ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে আসে। ছেরাজের হাত ধরে বিছানা থেকে নামায়। টয়লেটে পৌঁছে দেয়, নাস্তা করায়। শীতের দিনে বাইরে হালকা রোদে একটি পিঁড়ি পেতে বসিয়ে দেয়। আর গরমের দিনে গাছের ছায়ায়। বৃষ্টির দিনে ক্ষয়ে যাওয়া বারান্দায়। সারাদিন ছেরাজ নীরবে বসে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না। সত্য বলতে কি কেউ তার সাথে কথা বলতে আসে না। একটু দূরে স্টেশনে রহিমা চা বিক্রি করে। 

আমি এই স্টেশনের নিয়মিত যাত্রী। এই স্টেশনে নেমেই আমাকে কলেজে যেতে হয়। রহিমার দোকানের কোন নাম বা কোন সাইনবোর্ড না থাকলেও কলেজের সব ছাত্র রহিমা খালার দোকান বললে এক নামেই চেনে। ভালো চা বানায় রহিমা খালা। ট্রেন আসা পর্যন্ত আমি ঠায় বসে থাকি রহিমা খালার দোকানে। পুনঃ পুনঃ চা খাওয়া আমার অভ্যাস। চা এর সুবাধে খালার সাথে ভালো পরিচয় থাকলেও কোনদিন জানতে চাই নি খালার বৃত্তান্ত। রেললাইনের পাশে শত রহিমা খালার বসবাস। কে কার খবর রাখে? 

একদিন পড়ন্ত বিকেলে বসে চা খাচ্ছি অলসভাবে। হঠাৎ এক রহিমা বলে আর্ত চিৎকার! তাকিয়ে দেখি এক প্রায় বৃদ্ধ লোক হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। রহিমা খালা ছুটে গেল। হাত ধরে নিয়ে বস্তির একটি ঘরের ভেতর ঢুকে গেল । বুঝলাম, লোকটা অন্ধ। একটা হাহাকার সৃষ্টি হলো মনে। আমার কাছে মনে হয় অন্ধ লোকরাই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায়। অন্ধ লোক দেখলেই শিউরে উঠি। অজান্তেই নিজের চোখে হাত চলে যায়। স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞ হই, আমার চোখে তিনি আলো দিয়েছেন। খালা বেরিয়ে এলেন বস্তি থেকে। আবার দোকানের কাজ করতে থাকলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, খালা উনি কে? সলজ্জ মুখে খালা বললেন, সোয়ামী। 

কলেজের বেতন, পরীক্ষার ফি বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। দ্বিগুণের চাইতেও বেশি। আমাদের মত টিউশনি করে চলা ছাত্রদের জন্য এটা ছিল বড় ধরণের ধাক্কা। ছাত্ররা সবাই বললো আন্দোলন হবে। এভাবে চললে আমাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে। কলেজের কোন হোস্টেল নেই। থাকতে হয় মেস করে। সেখানেও ভাড়া বাড়ায় বাড়িওয়ালা। দ্রব্যমূল্যেতো হু হু করে বাড়ছে। এর মধ্যে বেতন বাড়ানো আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে সবাই ক্লাস বর্জন করলো। ছাত্ররা সবাই মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হলো। সবার সাথে আমিও বের হলাম। 

পুলিশ অতর্কিতে আমাদের উপর আক্রমণ করলো। টিয়ার শেল নিক্ষেপ হচ্ছে। ভীষণ ধোঁয়া। চারদিকে অন্ধকার। চোখ জ্বলছে। হঠাৎ আমার কপালে ভীষণ আঘাত পেলাম। পড়ে গেলাম রাস্তায়। এরপর আর মনে নেই। 

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি এক মাঝবয়সি লোক আমার মাথার পাশে বসা। আমার কপাল তিনি ভিজা রুমাল দিয়ে মুছে দিচ্ছেন। লোকটি কালো সানগ্লাস পরা। আরেকটু ভালো করে খেয়াল করতে যেই মাথা একটু তুলেছি বুঝতে পেরেছি মাথায় ভীষণ চোট। উহ শব্দ করে উঠলাম। লোকটি বললো, তুমি জেগেছ বাবা? জ্ঞান ফিরেছে বাবা? রহিমা... রহিমা... 

চট করে বুঝে ফেললাম, লোকটা রহিমা খালার অন্ধ স্বামী। রহিমা খালা তখন উচ্চস্বরে কারো সাথে ঝগড়া করছে বলে মনে হচ্ছে। কান পেতে বুঝার চেষ্টা করলাম। পুলিশ সন্দেহ করছে রহিমা খালার ঘরের মধ্যে কোন প্রতিবাদকারী ছাত্র লুকিয়ে আছে। তারা সেই লুকিয়ে থাকা প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তার করতে চায়। কিন্তু রহিমা খালা মিথ্যা বলে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। অবশেষে সফল হলেন রহিমা খালা। পুলিশদের সাথে ঝগড়া করে তাদের ফিরিয়ে দিলেন। ঢুকতে দিলেন না ঘরে। 

রহিমা খালা আমাকে লুকিয়ে ফেললেন চৌকির ওপাশে ছোট্ট একটু জায়গা করে। জানতে পারলাম গোলাগুলি দেখে রহিমা খালা ছুটে যান। দেখেন আমি পড়ে আছি রাস্তায়। তিনি আরো কয়েকজনের সহায়তায় আমাকে তার বাড়িতে টেনে নিয়ে আসলেন। এভাবে ছিলাম দুই দিন। এই দুই দিনে আমার একান্ত সঙ্গি ছিলেন ছেরাজ মিয়া। স্বল্পভাষী ছেরাজ মিয়ার সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা উচ্চারণ করেন তা হল “রহিমা”। দুদিন পর আমি অনেকটা সুস্থ। ছেরাজ মিয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনি চোখ হারালেন কী করে? 

বলতে শুরু করলেন ছেরাজ মিয়া। সেদিন ছিল শুক্রবার। রহিমার বাবা দাওয়াত দিলেন আমাদের। দুপুরের খানা খেতে। আমি তখন ছোট্ট মুদি দোকান করি টাঙ্গাইলে। শ্বশুর বাড়ি পাশের গ্রামেই। সকালে রওনা হই শ্বশুর বাড়ি। আমি রহিমা আর আমাদের ছোট্ট মেয়ে শরিফা। বিকালে ফিরতে চাইলে শাশুড়ি জোর করে বললো একদিন থেকে যেতে। অগত্যা থেকে গেলাম। সন্ধ্যায় রহিমা বললো শরিফার জন্য দুধ কিনে আনতে। বাড়িতে দুধ নাই। 

বের হতে যাব এমন সময় দেখলাম একদল পুলিশ আসছে। তারা বহুদিন ধরেই আমার শ্বশুরের কাছে চাঁদা চেয়ে আসছে। সেই চাঁদা নিতেই রহিমাদের বাড়ি আসলো। শ্বশুর তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তাদের দাবীকৃত এত টাকা দেয়ার সামর্থ নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারা আমার শ্বশুরকে এরেস্ট করতে চাইলো। আমি বাধা দিলাম। প্রতিবাদ করলাম তাদের এই ডাকাতির। 

তারা অবশেষে আমাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল। এবার টাকার অংক আরো বেড়ে গেল। পাঁচ লাখ টাকা চাইলো। আমরা গরীব মানুষ পাঁচ লাখ টাকা দূরের কথা এক লাখ টাকা দেয়ারও সামর্থ ছিল না। রহিমা এর ওর কাছ থেকে ধার করে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুলিশকে দিয়েছিল। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করে যে অপরাধ করেছি তার কোন প্রায়শ্চিত্য এই টাকায় হবে না। 

সারারাত ধরে চললো নির্যাতন। মার খেতে খেতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আবার জ্ঞান ফিরে। আমার মার খাই। আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলেই শুনি বাইরে রহিমা আর আমার মেয়ে শরিফা কান্না করছে। মাফ চাই পুলিশের পা ধরে। আর কোনদিন পুলিশের সাথে বেয়াদবি করবো না এসব কথা বার বার বলি। তবুও মাফ হয় না আমার অপরাধের। অবশেষে শেষরাতে থানার ওসি আসলো। আমি ভাবলাম পা ধরে মাফ চাইলে তিনি হয়তো আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি আমার দোকান বিক্রি করে সব টাকাও দিতে চাইলাম। 

কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ওসি একটা স্ত্রু ড্রাইভার নিয়ে এলেন। নিজ হাতেই গেলে দিলেন আমার ডান চোখ। ভীষণ যন্ত্রনায় চিৎকার করলাম। গগনবিদারী সেই চিৎকারে থানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রহিমা আর মেয়ে শরিফা ছুটে এলো। একনজর তাদের দেখলাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। তিনি আমাকে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে রহিমা আর শরিফার চেহারা দেখালেন। এই দু’টি চেহারাই আমার দুনিয়াতে সবচেয়ে প্রিয়। বাবা-মাকে কবে হারিয়েছি মনে নেই। বড় হয়েছি এতিমখানায়। আমার স্বজন বলতে এই রহিমা আর শরীফাই।

ডান চোখের ভয়ংকর যন্ত্রনা সামলাতে না সামলাতেই ওসির সেই ভয়ানক স্ক্রু ড্রাইভার এবার আক্রমণ করলো আমার বাম চোখ। দপ করে আমার আলো নিভে গেল। সেদিন থেকে অন্ধকার। ভীষণ অন্ধকার। আজ বাংলাদেশে শুধু আমি অন্ধ নই, স্বৈরাচারের দেশে গোটা দেশই যে আজ অন্ধ।

1 টি মন্তব্য:

  1. ভাই মন্তব্য করার ভাষা হারিয়ে ফেলছি সেই পুরানো কথা লেখক এর সবচাইতে বড়র ক্রেডিট পাঠকে আবেগ আপ্লুত করা আপনি পারছেন হামদান লিল্লাহ

    উত্তরমুছুন