২২ সেপ, ২০১৮

যে মসজিদ উদ্বোধন করেন বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ

পুরাতন দিনের চকবাজার ও পেছনে চকবাজার শাহী মসজিদ। মাঝখানে বিবি মরিয়ম কামান, যা মির জুমলা ব্যবহার করেছেন।

দিনটা কিন্তু ভালোই ছিলো। ঝকঝকে রোদ না থাকলেও বৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল না। তাই বের হলাম মসজিদ দেখতে। যেহেতু একা যাবো তাই চিন্তা করেছি পাঠাও বাইক সার্ভিসে করেই যাবো। 

সেদিন একটা পত্রিকায় নিউজ পড়লাম এই পাঠাও এপ্সের পেছনে আছে তিন কারিগর। ওরা তিন বছর আগে সার্ভিস শুরু করেছিলো খাবারের হোম ডেলিভারি। উবার আসার পর তারা বাইক সার্ভিস ও কার সার্ভিসও চালু করে। মাত্র তিন বছরে ওরা এখন প্রচুর টাকার মালিক। ওদের লাভ ১০০ মিলিয়ন ডলার। 

যাই হোক তারা সেই একশ মিলিয়ন থেকে আমাকে কিছু দেয়ার জন্য মনস্থির করেছে। তারা আমাকে অফার করেছে আগামী ছয়টা রাইডে ১০০ টাকা করে ছাড় দিবে। আমার মতো গরীব মানুষ খুশিতে আটখান। দোয়া করে দিলাম আল্লাহ ওদের আরো পয়সাওয়ালা বানিয়ে দিক।

যাই হোক। রাস্তার মোড়ে এসে যে বাইক ডাকবো তখনই শুরু হলো ধুন্ধুমার বৃষ্টি। কোন বাইক আর রাজি না চকবাজার যেতে। টার্গেট চকবাজার শাহী মসজিদ। অবশেষে বৃষ্টি একটু থামলো। আমি আবারো পাঠাও এপ্সের মাধ্যমে বাইকারদের রিকোয়েস্ট পাঠালাম। 

একজন পাওয়া গেলো। তার বাইকের পেছনে উঠে বসলাম। বাইক চলা শুরু করলো। বাইকারের বাড়ি বরিশাল। গল্প করতে করতে চলে এলাম চকবাজার শাহী মসজিদের সামনে। 

বর্তমান চকবাজার শাহী মসজিদ

মসজিদের সামনে এসে বাইকার মাহফুজ ভাই রাইড ক্লোজ করে দেখলেন আসলো মাত্র ৮ টাকা। মূলত ১০৮ টাকা আসলো, ১০০ টাকা ছাড়। তাই আমাকে দিতে হবে মাত্র ৮ টাকা। মন খারাপ করে ফেললেন মাহফুজ ভাই। 

বিরক্তি নিয়ে বললেন, আগে জানলে এই বৃষ্টির মধ্যে আসতাম না। আমার নিজের কাছেও একটু গিল্টি ফিল হতে লাগলো। যদিও ওনার টাকা মার যাবে না। উনি পাঠাও থেকে পেয়ে যাবেন। কিন্তু সম্ভবত ওনার নগদ টাকার দরকার ছিল। 

কী আর করা! ২০ টাকার একটা চকচকে নোট মাহফুজ ভাইকে দিয়ে বললাম এটা রাখুন। মাহফুজ ভাই মন খারাপ করে ২০ টাকা নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন। আর আমি চকবাজার শাহী মসজিদের ১ নং গেইট দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। এই মসজিদটা আগে ভ্রমণ করা কর্তালাব শাহের মসজিদ থেকে বেশি দূরে না।  

ঢাকার পুরনো দিনের বাজারগুলোর মধ্যে চকবাজার অন্যতম ব্যস্ত একটি জনপদ। আগে চকবাজারকে চৌক বন্দর বলে ডাকা হতো। এই বাজারের পত্তন মোগল আমলে। মোগল আমলে সম্রাট বা সুবেদার যেখানে তাদের শিবির স্থাপন করতেন সেখানে শিবিরের প্রয়োজনেই একটি বাজার গড়ে উঠত। 

১৬০২ সালে ভাওয়াল থেকে রাজা মানসিংহ মোগল সম্রাটের হয়ে বিদ্রোহ দমনে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে এবং বর্তমানের কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপন করেছিলেন মোগল দুর্গ। সেই দুর্গের পাশেই দিনে দিনে গড়ে ওঠে আজকের চকবাজার। সেই আমলে চকবাজার ছিল ঢাকার অভিজাত এবং ধনী ব্যক্তিদের প্রধান বাজার। 

চকবাজারে ইফতারের বাজার

বাংলার সুবেদার হিসেবে শায়েস্তা খান যখন বাংলায় আসেন তখন তিনি চকবাজারে একটি মসজিদ স্থাপন করেন। তিনি ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মসজিদটি সম্ভবত বাংলাদেশে উঁচু প্লাটফর্মের উপরে নির্মিত প্রথম মসজিদ। এছাড়া খান মুহাম্মদ মৃধা ও কর্তালাব শাহের মসজিদও উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত মসজিদ। যেগুলো নিয়ে আগেও লিখেছি। 

এই মসজিদকে ঘিরেই একসময় চকবাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। তাই এখনও মসজিদটি চকবাজারের কেন্দ্রস্থলে বলে ধরা হয়। তবে শায়েস্তা খানের সেই যুগে চক মসজিদ ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। 

রমজান বা ঈদের চাঁদ দেখা দিলে এই মসজিদের সামনে থেকে তোপধ্বনি দেওয়া হতো। রমজান বা ঈদের চাঁদ দেখা দিলে এই মসজিদের সামনে থেকে তোপধ্বনি দেওয়া হতো বিবি মরিয়ম কামানের মাধ্যমে। বিবি মরিয়ম কামান একটি বৃহত্তম ও শক্তিশালী কামান মুঘলদের। এটি এখন উসমানী উদ্যানে সংরক্ষিত।

রমজান মাসে তারাবির নামাজের সময় মসজিদের ভেতরটায় ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত করা হতো। ইফতারির সময় বিভিন্ন বাড়ি ও দোকানপাট থেকে ইফতারি আসত মসজিদে। সবাই এখানে ইফতারি করতে আসতো। ইফতারি করতে এখানে মানুষ জড়ো হতো বিধায় ধীরে ধীরে এখানে ইফতারি মার্কেট গড়ে উঠে। আজ তাই ইফতারির আলোচনা আসলেই চকাবাজারের নাম উঠে আসে। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় ইফতারি মার্কেট চকবাজার। 

আরেকটি সামাজিক রীতি ছিলো চক মসজিদকে ঘিরে জুম্মার নামাজের দিন চারপাশের বাড়ি থেকে মিষ্টান্ন পাঠানো হতো। নামাজ শেষে বিতরণ করা হতো এই মিষ্টান্ন।

মসজিদটির একটি বাড়তি গুরুত্ব হলো, সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এই মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়েই চকবাজারের উদ্বোধন করেছিলেন। ঢাকার নায়েবে নাজিমরা চকবাজার জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তেন।

একসময় চক মসজিদের সামনে একটি খোলা আঙিনা ছিল। এখন আঙিনাকে ঘিরে মসজিদের আয়তন বাড়ানো হয়েছে। মসজিদের আয়তন এখন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। মূল মসজিদের উত্তর দেয়াল অপসারণ করা হয়েছে ও পূর্ব দিকের সম্প্রসারিত অংশে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। 

মসজিদের তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মূল আচ্ছাদন ভেঙে তার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি তল এবং এর ছাদে তিনটি নতুন গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মাঝের গম্বুজটি করা হয়েছে অনেক বড়। দেয়ালগুলোর পুরুত্ব হ্রাস করা হয়েছে, মিহরাব ও প্রবেশপথগুলোকে করা হয়েছে প্রশস্ত আর উত্তর ও দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথ দুটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

আজ যে ঝকঝকে আধুনিক মসজদি আমরা দেখছি, তাতে এটা যে প্রায় চারশ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে আছে তা বোঝার উপায় নেই। পূর্বের ঐতিহাসিক অস্তিত্বের চিহ্ন রাখার ব্যাপারে খুব সম্ভবত কর্তৃপক্ষের আগ্রহের খুব অভাব ছিলো। 

যাই হোক মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে যখন বের হলাম তখন দেখি চারদিকে স্ট্রিট ফুডের মেলা বসে গেলো। কোনটা রেখে কোনটা খাই এই অবস্থা! অবশেষে খাওয়া দাওয়া শেষে আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে পুরাতন কারাগারের সামনে এলাম। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। একসময় বাংলাদেশ যার কথায় পরিচালিত হতো তিনি আজ একা বন্দি এই কারাগারে! অথচ অতি ঠুনকো মামলা। যে মামলার কোন ভিত্তি নেই। 

1 টি মন্তব্য: