১৪ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৩ : মৌর্য্য শাসনামলে বাংলাদেশ

মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত অঞ্চল

গতকাল মহাপদ্ম নন্দ পর্যন্ত আলোচনা করেছিলাম। মহাপদ্ম নন্দ দ্রাবিড় জাতির লোক ছিলেন। আর্যদের তিনি বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মহাপদ্ম নন্দ মগধ অঞ্চলের শাসক ছিলেন। মগধ প্রাচীন ভারতে ষোলটি মহাজনপদ বা অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম। ষোলটি মহাজনপদের মধ্যে মগধ বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই রাজ্য বর্তমানের বিহারের পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। রাজগৃহ ছিল মগধের রাজধানী। পরে এর রাজধানী পাটালিপুত্রে স্থানান্তরিত হয় রাজা অজাতশত্রুর সময়ে।

মহাপদ্ম নন্দ নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজাদের তথা আর্যদের পরাজিত করে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত সামাজ্য বিস্তার করেন। তাকে ভারতের প্রথম সামাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়। সামাজ্য বিস্তারের জন্য তিনি ২,০০,০০০ পদাতিক, ২০,০০০ অশ্বারোহী, ২,০০০ রথ ও ৩,০০০ হস্তীবিশিষ্ট সুবিশাল বাহিনী গড়ে তোলেন। গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুটার্কের মতে তার বাহিনী আরো বড় ছিল। এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন মহাপদ্ম নন্দের ছেলে ধননন্দ। তিনিই ছিলেন নন্দ বংশের শেষ রাজা।

আর্যদের মধ্যে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ব্যক্তি চাণক্য এই নন্দ রাজবংশকে ধ্বংস করার জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি ক্ষত্রিয় রাজাদের একত্রিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব একটা সুবিধে করতে সক্ষম হননি। তিনি এক ক্ষত্রিয়কে অর্থশাস্ত্র, যুদ্ধনীতি, রাজনীতির জ্ঞান দেন এবং তাকে মগধ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এর জন্য গড়ে তোলেন তক্ষশীলা বিদ্যালয়ে। তক্ষশীলা হলো বর্তমান পাকিস্তানে পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডিতে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য সমস্ত জ্ঞান লাভ করে।

চন্দ্রগুপ্তকথা নামক গ্রন্থানুসারে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য ও চাণক্যের সেনাবাহিনী প্রথমদিকে নন্দ সাম্রাজ্যের কর্তৃক পরাজিত হয়। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত এরপর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে ধননন্দ ও তাঁর সেনাপতি ভদ্রশালাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন এবং অবশেষে পাটলিপুত্র নগরী অবরোধ করে ৩২১ খ্রিটপূর্বাব্দে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে নন্দ সাম্রাজ্য অধিকার করেন। এভাবেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য মৌর্য্য শাসনামল শুরু করেন।

চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজত্বের শেষ পর্যন্ত তামিল ও কলিঙ্গ অঞ্চল ব্যতিরেকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ স্থান অধিকার করতে বা পদানত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান, উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্য মালভূমি পর্যন্ত তার শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। ভারতের ইতিহাসে ইতিপূর্বে এর চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য নির্মিত হয়নি।

চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করেন। চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে চন্দ্রগুপ্ত একটী শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন গড়ে তোলেন। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতির সাথে সাথে এই সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ফলস্বরূপ একটি শক্রিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মেগাস্থিনিসের বর্ণনা অনুসারে, চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য্যের বিশাল সেনাবাহিনীতে ৪ লক্ষ সৈন্য ছিল।

ভারত উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় এলাকাজুড়ে শাসন করেছে মৌর্য বংশের রাজারা। এই মৌর্যদের সময়েই আর্যরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বাংলায় প্রবেশ করেছিল। এখনকার বাংলা অঞ্চল তখন একটি প্রদেশ ছিলো। প্রদেশকে তখন বলা হতো, 'ভুক্তি'। বাংলা অঞ্চলের এই ভুক্তিটির নাম হয় 'পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি'। এই ভুক্তিটির রাজধানী করা হয় আজকের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়। মৌর্য্য শাসনামলে এর নাম ছিল 'পুণ্ড্রনগর'।

মৌর্যবংশের রাজাদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১-২৯৮ অব্দ), বিন্দুসার (খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮-২৭২ অব্দ) এবং অশোক (খ্রিষ্টপূর্ব ২৭২-২৩২ অব্দ) ছিলো উল্লেখযোগ্য। অশোকের মৃত্যুর পর উল্লেখযোগ্য কোনো রাজা মৌর্য বংশে আসেনি।

২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের জৈন ধর্ম গ্রহন ও রাজ্য শাসন থেকে স্বেচ্ছা অবসরের পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার মাত্র বাইশ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। বিন্দুসার মৌর্য্য সাম্রাজ্যকে তিনি দক্ষিণ দিকে আরো প্রসারিত করেন এবং কলিঙ্গ, চের, পাণ্ড্য ও চোল রাজ্য ব্যতিরেকে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ছাড়াও উত্তর ভারতের সমগ্র অংশ তাঁর করায়ত্ত হয়। তাঁর রাজত্বকালে তক্ষশীলার অধিবাসীরা দুইবার বিদ্রোহ করেন কিন্তু বিন্দুসারের পক্ষে তা দমন করা সম্ভব হয়নি। তক্ষশীলার বিদ্রোহের মূল কারণ আর্যরা। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা মৌর্য্য শাসকদের নিজেদের মতো করে চালাতে চাইলেন কিন্তু তারা আর্যদের সব পরামর্শ মানতেন না বিশেষ করে জাতিভেদ মানতে চাইতেন না। এই নিয়ে আর্যরা বিদ্রোহ করে।

২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বিন্দুসারের মৃত্যু হলে উত্তরাধিকারের প্রশ্নে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিন্দুসার তাঁর অপর পুত্র সুসীমকে উত্তরাধিকারী হিসেবে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুসীমকে উগ্র ও অহঙ্কারী চরিত্রের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে বিন্দুসারের মন্ত্রীরা তাঁর অপর পুত্র অশোককে সমর্থন করেন। রাধাগুপ্ত নামক এক মন্ত্রী অশোকের সিংহাসনলাভের পক্ষে প্রধান সহায়ক হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অশোক শঠতা করে সুসীমকে একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন।

সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক পরবর্তী আট বছর তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁর করায়ত্ত হয়। তাঁর রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ মানুষ নিহত হন এবং দেড় লক্ষ মানুষ নির্বাসিত হন। অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত হয়েছে যে কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও তাঁদের আত্মীয় স্বজনদের অপরিসীম কষ্ট লক্ষ্য করে অশোক দুঃখে ও অনুশোচনায় দগ্ধ হন। এই ভয়ানক যুদ্ধের কুফল লক্ষ্য করে যুদ্ধপ্রিয় অশোক একজন শান্তিকামী ও প্রজাদরদী সম্রাট এবং বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মৌর্য্য সাম্রাজ্য নয়, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়। তাঁর পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।

সম্রাট অশোকের সময় বর্তমান বাংলা তৎকালীন পুণ্ড্রনগরের শাসকরা প্রজাদের প্রতি ভাল আচরণ করতেন। তাদের সুখে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তবুও স্বস্তি ছিল না বাংলার মানুষের। স্বাধীনতা প্রিয় বাংলার মানুষের এই পরাধীনতা ভাল লাগেনি। বাংলার কোনো কোনো অংশে সুযোগ পেলেই তারা স্বাধীনতা ঘোষণা করতো। এর প্রমাণ হচ্ছে গঙ্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা একটি স্বাধীন রাজ্য। গ্রিক লেখকরা এই রাজ্যটির নাম লিখেছেন 'গঙ্গারিডি'। হিসেব মতে বাঙালির এই স্বাধীন রাজ্যটি গড়ে উঠেছিল মৌর্য যুগে। এই শক্তিশালী রাজ্যের সৈন্যবাহিনীতে চার হাজার হাতির এক বিশাল বাহিনী ছিল।

অশোকের মৃত্যুর পরবর্তী পঞ্চাশ বছর দশরথ, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মণ, শতধনবান ও বৃহদ্রথ এই ছয় জন সম্রাটের রাজত্বকালে মৌর্য্য সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে।

মৌর্য্য শাসকেরা মূলত জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। জৈন ধর্মের প্রচারক মহাবীর আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক গৌতমের জীবনধারা এবং তাদের সত্য-সন্ধানের প্রক্রিয়া লক্ষ্য করে মওলানা আবুল কালাম আযাদসহ অনেক গবেষক মনে করেন যে, তারা হয়তো বিশুদ্ধ সত্য ধর্মই প্রচার করেছেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ও বিকৃতি তাদের সে সত্য ধর্মকে পৃথিবীর বুক থেকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে যে, তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া আজ অসম্ভব।

এ প্রসঙ্গে মান্নান তালিব লিখেছেন, “জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস আলোচনা করলে এ ষড়যন্ত্রের বহু ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। এ উভয় ধর্মই আর্যদের ধর্মীয় গ্রন্হ বেদকে ঐশী গ্রন্হ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তপস্যা, যাগযজ্ঞ ও পশুবলিকে অর্থহীন গণ্য করে। ব্রাহ্মণদের পবিত্রাত্মা ও নরশ্রেষ্ঠ হওয়ার ধারণাকে সমাজ থেকে নির্মূল করে দেয়। ফলে বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি নড়ে উঠে। স্বাভাবিকভাবে জনসাধারণ এ ধর্মদ্বয়ের আহ্বানে বিপুলভাবে সাড়া দেয়। দ্রাবিড় ও অন্যান্য অনার্য ছাড়া বিপুল সংখ্যক আর্যও এ ধর্ম গ্রহণ করে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মদ্বয়কে প্রথমে নাস্তিক্যবাদের অন্তর্ভুক্ত করে। নাস্তিক্যবাদের সংজ্ঞা তারা এভাবেই নিরুপণ করে যে, বেদবিরোধী মাত্রই নাস্তিক। কাজেই জৈন ও বৌদ্ধরাও নাস্তিক। অতঃপর উভয় ধর্মীয়দের নিরীশ্বরবাদী প্রবণতা প্রমাণ করার চেষ্টা চলে”। (বাংলাদেশে ইসলাম, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)

মৌর্য্যরা সরাসরি আর্যদের প্রতিনিধিত্ব না করলেও প্রচুর আর্য এসময় বাংলায় প্রবেশ করে। তারা তাদের কৃষ্টি, কালচার ও ধর্ম দিয়ে দ্রাবিড়দের প্রভাবিত করে। পরবর্তী গুপ্ত আমলে আর্যরা পুরোপুরিভাবে দ্রাবিড়দের সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়।

1 টি মন্তব্য: