১৪ জুন, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-০৪ : বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শাসন শুরু হয়েছিলো যেভাবে

শুঙ্গ ও সাতবাহন সাম্রাজ্যের মানচিত্র
গতকাল সম্রাট অশোক পর্যন্ত বলেছিলাম। তিনি ছিলেন মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শেষ শক্তিশালী শাসক। তার মৃত্যুর পর মৌর্য্য সাম্রাজ্য ভেঙে যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শাসক শাসন করতে থাকেন। বাংলা, বিহার, নেপাল এই অঞ্চল শেষ পর্যন্ত মৌর্য্যদের অধীনে ছিলো। মৌর্য্যদের শেষ শাসক ছিলেন বৃহদ্রথ। 

১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য্য রাজবংশের নবম সম্রাট বৃহদ্রথের প্রধান সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্য্য সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজে শক্তি প্রদর্শনের সময় তাঁকে হত্যা করে মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটান ও শুঙ্গ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্য্যদের সেনাপতি থাকলেও তিনি ছিলেন একজন আর্য ও ব্রাহ্মণ। মৌর্য্যদের সাথে তার বিবাদের মূল কারণ তার ধর্মীয় প্রার্থক্য। শেষদিকের সব মৌর্য্য সম্রাটরাই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন যেটা আর্য তথা ব্রাহ্মণদের চক্ষুশূল ছিলো। 

মৌর্য্য সাম্রাজ্যের নয়জন শাসক ছিলেন। তারা হলেন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য, বিন্দুসার, অশোক, দশরথ, সম্প্রতি, শালিশুক, দেববর্মণ, শতধনবান, বৃহদ্রথ। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলায় খৃস্টপূর্ব ১৮৫ সাল থেকে সরাসরি আর্য শাসন তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন শুরু হয়। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ছিলেন শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী পাটালিপুত্রে (বিহার)। পরে তারা তাদের রাজধানী বিদিশাতে স্থানান্তর করেন। বিদিশা ভারতের মধ্য প্রদেশের একটি জেলার নাম। 

শুঙ্গ সাম্রাজ্য প্রায় ১১০ বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ে তারা বৌদ্ধদের উপর ভয়ংকর নির্যাতন করে। মৌর্য বংশের পর প্রথম ব্রাহ্মণ সম্রাট ছিলেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ এবং প্রায় সব ঐতিহাসিক মনে করেন তিনি বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচার করতেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের মাধ্যমে এই সময় বৌদ্ধধর্মকে কাশ্মীর, গান্ধার ও ব্যাকট্রিয় অঞ্চলে তাড়িয়ে দেন। দিব্যবদান গ্রন্থের অশোকবদান, প্রাচীন তিব্বতী ঐতিহাসিক তারানাথের রচনা প্রভৃতি বৌদ্ধশাস্ত্রের মাধ্যমে বৌদ্ধদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী পাওয়া যায়। শুঙ্গ রাজারা বৌদ্ধ মঠ পুড়িয়ে দেন, বৌদ্ধস্তুপগুলি ধ্বংস করেন, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নির্বিচারে হত্যা করেন এবং তাদের মাথার জন্য পুরস্কার ধার্য করেন।

অশোকবদানে উল্লেখ রয়েছে, পুষ্যমিত্র চারশ্রেণীর সেনা সজ্জিত করেছিলেন, এবং বৌদ্ধধর্মকে ধ্বংস করবার জন্যে তিনি কুক্কুতরম (পাটলিপুত্রে) যাত্রা করেছিলেন....অতঃপর পুষ্যমিত্র সংঘরম ধ্বংস করলেন, সেখানকার সন্ন্যাসীদের হত্যা করলেন, এবং সেখান থেকে প্রস্থান করলেন....কিছু সময় পর, তিনি শাকলে উপনীত হলেন এবং ঘোষণা করলেন যে ব্যক্তি তাঁকে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর মাথা উপহার দিতে পারবে তিনি তাকে পুরস্কৃত করবেন।” (দিব্যবদান গ্রন্থের অশোকবদান : ২৯৩)

ভারতীয় পৌরাণিক সূত্রও, যেমন, ভবিষ্য পুরাণের প্রতিসর্গ পর্বে মৌর্য যুগের পর ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের কথা বলা হয়েছে এবং সেখানে লক্ষ লক্ষ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে হত্যার কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে। “এই সময়ে (চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার ও অশোকের শাসনের পর) কাণ্বকুব্জ নামক সর্বশ্রেষ্ঠ এক ব্রাহ্মণ অর্বুদ পর্বতের শিখরে বলিযজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। বৈদিক মন্ত্রের প্রভাবে যজ্ঞানুষ্ঠান (বলি) থেকে চারজন ক্ষত্রিয়ের আবির্ভাব হয়। (...) তাঁরা অশোককে তাঁদের অধীনে রাখেন এবং সকল বৌদ্ধদের নির্মুল করেন। মনে করা হয়, সেখানে ৪০ লক্ষ বৌদ্ধ ছিলেন এবং তাঁদের সকলকে বিরল অস্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়।
- প্রতিসর্গ পর্ব।

পুষ্যমিত্র ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের আধিপত্য এবং পশুবলি (যজ্ঞ) পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন বলে জানা যায়; এই পশুবলি অশোকের সময় থেকে নিষিদ্ধ ছিলো করেছিলেন। শুঙ্গ রাজবংশের সময় আর্যরা তাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলা অঞ্চলে দ্রাবিড় ও বৌদ্ধদের সকল পাঠশালা বন্ধ ও ধ্বংস করে। সেখানে তারা তাদের বিদ্যালয় স্থাপন করে। বাংলা থেকে একেশ্বরবাদের অনুসারীদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া শুঙ্গ আমল থেকে শুরু হয়।  

দেবভূতি ছিলেন শুঙ্গ রাজবংশের শেষ সম্রাট। শুঙ্গ সম্রাট ভগভদ্রের পরে তিনি ৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসন করেন। দেবভূতি একজন দুশ্চরিত্র শাসক ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বেদ অনুসারে চলতেন না। ফলে তার ব্রাহ্মণ মন্ত্রী বাসুদেব কাণ্ব তাঁকে হত্যা করে শাসনক্ষমতা দখল করেন। যার ফলে শুঙ্গ রাজবংশের শাসনের অবসান ঘটে ও কাণ্ব রাজবংশের শাসন শুরু হয়। শাসনের প্রকৃতি অনুসারে শুঙ্গ ও কাণ্ব রাজাদের মধ্যে কোনো প্রার্থক্য ছিলো না। তারা উভয়েই বেদ অনুসরণ করতেন এবং ব্রাহ্মণ ছিলেন। কাণ্ব বংশে ৪ জন রাজা ছিলেন। তারা খৃস্টপূর্ব ৩০ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। সাতবাহন শাসক দ্বারা তাদের পরাজয় হয়।  

মৌর্য্য শাসনামলে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ভিত্তিক সামন্তরাজা সাতবাহনরা মৌর্য্যদের অনুগত ছিলো। অশোকের মৃত্যুর পর তারা স্বাধীনভাবে দক্ষিণ ভারত শাসন করতো। তাদের হাতে বাংলা দখল হয় খৃস্টপূর্ব ৩০ সালে এবং কাণ্বরা পরাজিত হয়। সাতবাহনের রাজারা নিজেদের হিন্দু ধর্মের দাবি করলেও তারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের ব্যাপারে ছিলো বেশ উদার।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন