৩০ সেপ, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-১৮ : শাহ্‌ সুজা থেকে শায়েস্তা খানের শাসন


ইসলাম খান চিশতির পর ১৬১৩ থেকে ১৬৩৯ সাল পর্যন্ত প্রায় নয়জন সুবাহদার বাংলা শাসন করেন। তাদের এই শাসনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার ছেলে শাহ সুজাকে ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত করেন। ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ঊড়িষ্যা প্রদেশের দায়িত্বও অর্পণ করা হয়। ১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ বছরের কিছু অধিক সময় ধরে তিনি প্রদেশ দুটি শাসন করেন। এ সময়ে তাঁর শাসনের দুটি সংক্ষিপ্ত বিরতি ছিল প্রথম বিরতি হয় ১৬৪৭-৪৮ পর্যন্ত। প্রথম বিরতিতে আফগানিস্তানের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে তিনি সম্রাটের সঙ্গে ছিলেন, দ্বিতীয় বিরতি ঘটে ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে তখন তিনি এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাস কাল কাবুলে অবস্থান করেন। তাঁর সুবাহদারির শেষ দিকে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সিংহাসন দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে দু'বার তিনি রাজধানী দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হন।

শাহ সুজার নিযুক্তির সময় ঢাকা সুবাহ বাংলার রাজধানী ছিল। শাহ সুজার শাসনকালে বাংলা ও ঊড়িষ্যা প্রদেশ দুটিতে মোটামুটি শান্তি বিরাজ করছিল; কোন অংশেই কোন বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় নি। প্রকৃতপক্ষে জমিদার ও দুষ্কৃতিকারীরা সুবাহদার হিসেবে রাজকুমারকে দেখে হতবিহবল হয়ে পড়ে। তদুপরি সুজার উপর কেবল দুই প্রদেশের (বাংলা ও ঊড়িষ্যা) সুবাদারির দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে নি, তিনি কামরূপ ও আশ্রিত রাজ্য কুচবিহার দখল করেন, যা তৃতীয় আর এক প্রদেশের সমতুল্য ছিল এবং এটিও তাঁর অধীনে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে সুজা পূর্ব ভারতের শাসক ছিলেন।

শাহ সুজা ব্যাপক রাজ্য বিজয়ের জন্য খ্যাত ছিলেন না, তবে মনে হয় তিনি হিজলি ও ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন। বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত হিজলি অঞ্চলে বাহাদুর খান নামক এক স্বভাবগত বিদ্রোহী শাসন করতেন (পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর জেলা)। সুজার সময়ে বাহাদুর রাজস্ব পরিশোধে বিলম্ব করেন, এই বিলম্বের জন্য সুজা তড়িৎ ব্যবস্থা নেন। বাহাদুর খান পরাজিত হন এবং আগের চেয়ে আরও বেশি রাজস্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ক্ষমা লাভ করেন। ত্রিপুরার রাজবংশের ইতিহাস রাজমালায় ওই রাজ্যের সাথে সুজার যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা যুদ্ধে পরাজিত হন এবং বর্তমান কুমিল্লার সীমান্ত সংলগ্ন অংশবিশেষ ছেড়ে দিয়ে শান্তি স্থাপন করেন। একটি মসজিদ তৈরির মধ্যদিয়ে সুজা এই বিজয় স্মরণীয় করে তোলেন। মসজিদটি এখনও ভাল অবস্থায় আছে এবং সুজার নাম মনে করিয়ে দেয়। এটি কুমিল্লা শহরের অদূরে গোমতি নদীর তীরে অবস্থিত।

শাহ্‌ সুজা বড় নির্মাতা ছিলেন। ঢাকার প্রাচীন মোগল দালানগুলি তাঁর সময়েই নির্মিত হয়। দালানগুলি হলো বড় কাটরা, ঈদগাহ, হোসেনী দালান এবং চুড়িহাট্টা মসজিদ। চকবাজারের একটু দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরে বড় কাটরা তৈরি করা হয়। মনোমুগ্ধকর স্থাপনাটি মূলত যুবরাজের বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হয়, কিন্তু থাকার জন্য তিনি রাজমহল পছন্দ করায় বড়কাটরা ভ্রাম্যমাণ বণিকদের বাসের জন্য দেওয়া হয়, অর্থাৎ এটি কাটরা বা সরাইখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ঈদগাহ উঁচু ভিতের চারদিকে ঘেরা দিয়ে বানানো হয়। বছরে দুই ঈদে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য এটি ব্যবহার করা হতো। তার শাসনামলে সৈয়দ মুরাদ ১৬৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। এখানে শিয়া সম্প্রদায় জামাতে নামাজ আদায় করতেন, আর চুড়িহাট্টা মসজিদ ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করা হয়। রাজমহলে শাহ সুজা ‘সাঙ্গ-ই-দালান’ (পাথরের প্রাসাদ) নামে এক প্রাসাদ এবং মার্বেল পাথরের এক মসজিদ তৈরি করেন। ‘আনন্দ-সরোবর’ নামে এক দিঘি এখনও শাহ সুজার স্মৃতি বহন করে। পুকুরের চারদিকে তৈরি করা হয় দিউয়ান-ই-আম, দিউয়ান-ই-খাস, হাম্মাম (গোছল খানা), হাউজ (জলাধার) এবং ফোয়ারা (ঝর্ণা)। এর বাইরে গৌড়ে (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) তিনি তাহখানা, তিন গম্বুজ মসজিদ, সরাইখানা, দীঘি খননসহ নানান উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনকল্যাণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিষয়ে শাহ সুজা সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি বিদেশি বণিক ও ইউরোপীয় কোম্পানিদের সাদর আমন্ত্রণ জানান এবং অবাধে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ-সুবিধা করে দেন। তিনি পর্তুগিজদের এক ‘নিশান’ (যুবরাজের দেওয়া অনুমতি পত্র) প্রদান করেন, যার মাধ্যমে সম্রাটের ‘ফরমানে’ দেওয়া বাণিজ্যিক সুবিধাদি স্বীকার করা হয়। তিনি ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ডাচ কোম্পানিকেও অনুরূপ সুবিধাদি দেন। 

১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সমগ্র সাম্রাজ্যে গুজব রটে যে সম্রাট মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর বড় পুত্র দারাশিকো সিংহাসনে তাঁর অবস্থান দৃঢ়করণের জন্য তা গোপন রেখেছেন। বাকি তিন যুবরাজ সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী অভিমুখে যাত্রার প্রস্ত্ততি নিতে থাকেন। সুজা নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন ও রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেন। গঙ্গা নদীতে বহু সংখ্যক যুদ্ধের নৌকা সজ্জিত করে বিরাট বাহিনী নিয়ে তিনি রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হন। বাহাদুরপুরের তুমুল যুদ্ধে (আধুনিক উত্তর প্রদেশ, ভারত) দারার বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে আবার প্রস্ত্ততি নেওয়ার জন্য সুজা রাজমহলে ফিরে আসেন। ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব দুবার (ধর্মাট ও সামগড়ে) দারাকে পরাজিত করেন এবং তাঁকে বন্দি ও হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুজা আবারও রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হন। এবার তাঁর অভিযান ছিল আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ জানুয়ারি খাজোয়াতে (ফতেহপুর জেলা, উত্তর প্রদেশ, ভারত) যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধেও সুজা পরাজিত হন। তিনি বাংলার দিকে পশ্চাদপসরণ করেন। 

আওরঙ্গজেবের সেনানায়ক মীর জুমলার অধীন রাজকীয় বাহিনী দ্বারা ভীষণভাবে তাড়িত হলেও সুজা প্রতিটি জায়গায় তাদেরকে বাধা দিতে থাকেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধে তিনি পরাজয় বরণ করেন। প্রতিটি পরাজয়ের পর স্বীয় বাহিনীর সেনারা তাঁকে ছেড়ে যেতে থাকে কিন্তু তিনি তাতে হতোদ্যম হন নি। তিনি বরং নতুন উদ্যমে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন। কিন্তু তান্ডাতে যখন চারদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ছিলেন এবং সৈন্য পুনর্গঠিত করা আর সম্ভব নয় মনে করলেন তখন চিরকালের জন্য তিনি বাংলা (এবং ভারতবর্ষ) ত্যাগ করে আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সপরিবারে এবং দলবল নিয়ে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল তান্ডা ত্যাগ করে এপ্রিলের ১২ তারিখে ঢাকা পৌঁছেন। ৬ মে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ১২ মে নোয়াখালীতে দলবল নিয়ে আরাকানের পথে জাহাজে ওঠেন।

শাহ্‌ সুজার পর বাংলার নতুন সুবাহদার নিযুক্ত হন মীর জুমলা। তিনি সম্রাট আলমগীরের (আওরঙ্গজেব) প্রতিনিধি ছিলেন। মীর জুমলার শাসন ছিলো মাত্র তিন বছরের। কিন্তু তিনি যুদ্ধ জয় ও বাংলায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি প্রশাসনকে পুনর্গঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালে শাহ সুজার অনুপস্থিতির কারণে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল এবং সেখানে অবাধ্যতা এবং একগুঁয়েমি দেখা দিয়েছিল। তিনি সুজা কর্তৃক রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তর বাতিল করে ঢাকাকে তার পূর্বতন গৌরবে পুনঃঅধিষ্ঠিত করেন। এরপর তিনি বিচার বিভাগের প্রতি নজর দেন। তিনি অসৎ কাজী ও মীর আদলদের বরখাস্ত করে তাদের স্থলে সৎ ব্যক্তিদের নিয়োগ দান করেন।

মীর জুমলার গেট
ঢাকা ও শহরতলী এলাকায় মীরজুমলার নির্মাণ কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে দ্রুত সৈন্য চলাচল, যন্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ প্রেরণের জন্য এবং জনকল্যাণমূলক দুটি রাস্তা ও দুটি সেতু। কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনে তিনি কয়েকটি দুর্গও নির্মাণ করেন। একটি দুর্গ ছিল টঙ্গী জামালপুরে, যা ঢাকাকে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্তকারী (বর্তমানে ময়মনসিংহ রোড নামে পরিচিত) সড়কটির নিরাপত্তা বিধান করত। অন্য সড়কটি পূর্বদিকে চলে গিয়ে রাজধানীকে ফতুল্লার (পুরাতন ধাপা) সঙ্গে যুক্ত করেছে, যেখানে দুটি দুর্গ রয়েছে। আরও বিস্তৃত হওয়া এই সড়কটি দিয়ে খিজিরপুর পর্যন্ত যাওয়া যেত এবং সেখানেও দুটি দুর্গ অবস্থিত ছিল। ফতুল্লার অদূরে পাগলা সেতুটি এই রাস্তায় অবস্থিত। মীর জুমলা কর্তৃক নির্মিত সড়ক ও দুর্গগুলির কিছু অংশ এখনও বিদ্যমান।

বাংলায় মীরজুমলার শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তিনি সীমান্তবর্তী কামরূপ এবং আসাম রাজ্যগুলি জয় করেছিলেন। কুচবিহার ছিল সামন্ত রাজ্য, কিন্তু উত্তরাধিকার যুদ্ধের সুযোগে রাজা প্রাণ নারায়ণ আনুগত্য অস্বীকার করেন। আসামের রাজা জয়ধ্বজ সিংহ কামরূপ দখল করে নেন। এটা আগে বাংলা সুবাহর অঙ্গীভূত ছিল। এক বিশাল সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনী নিয়ে মীর জুমলা শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। সৈন্যবাহিনী ও নৌবাহিনীর মূল অংশ কামরূপের দিকে প্রেরণ করে তিনি নিজে কুচবিহারের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি নিকটবর্তী হলে প্রাণ নারায়ণ দেশ ত্যাগ করে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান। কুচবিহার দখল করতে দেড় মাসের মতো সময় লেগেছিল এবং সেখানকার প্রশাসনিক বন্দোবস্ত করে মীরজুমলা কামরূপের দিকে প্রেরিত অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগদান করেন। আসামের রাজা কামরূপ ত্যাগ করে যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় দান করেন। তবে মীরজুমলা আসাম জয়েরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখনকার দিনে আসাম ছিল একটি বড় ভূখন্ড এবং এর ভৌগোলিক প্রকৃতি ছিল বাংলা থেকে অনেকটা ভিন্নতর। কিন্তু কিছুই মীরজুমলাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। 

উসমানী উদ্যানে স্থাপিত মীর জুমলার কামান "বিবি মরিয়ম"
গৌহাটি থেকে যাত্রা শুরু করার পর ছয় সপ্তাহেরও কম সময়ে মীরজুমলা আসামের রাজধানী গড়গাঁও পর্যন্ত এলাকা জয় করেন। রাজা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই ভূখন্ডটি ছিল ঘোড়া ও সৈন্যদের পক্ষে দুর্গম উঁচু পাহাড়। বর্ষাকালে মুগল সৈন্যবাহিনী কিছু উঁচু ভূমিতে আটকে পড়ে, রাস্তাঘাট ডুবে যায় এবং ছোট ছোট নদী, এমনকি নালাগুলিও (নর্দমা) স্ফীত হয়ে বড় নদীর আকার ধারণ করে। অসমিয়াগণ চারদিক থেকে তাদের অভ্যাসগত রাত্রিকালীন আক্রমণ চালিয়ে মুগলদের নাজেহাল করে; রাস্তাগুলি প্লাবিত হওয়ার ফলে কোন কিছু পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়ে যার ফলে ঘাঁটি থেকে তাদের জন্য খাদ্য দ্রব্যাদি আসাও বন্ধ হয়ে যায়। শিবিরগুলিতে মানুষ ও পশুর জন্য প্রচন্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সৈন্যগণ যুদ্ধের জন্য সজ্জিত ঘোড়াগুলি হত্যা করতে শুরু করে এবং বহু কষ্টে মুগলগণ সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়। খাদ্যাভাব ছাড়াও দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর বায়ু এবং জলের কারণে মোগল শিবিরগুলিতে মহামারি দেখা দেয়। এর ফলে মীরজুমলার সৈন্যবাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মীরজুমলা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন।

দেশের অর্থনীতিতে ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের অবদান সম্পর্কে মীর জুমলা অবগত ছিলেন। বাংলার সুবাহদার হিসেবে তিনি ব্যবসায়ীদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলেন। তাঁর আমলে পর্তুগিজদের বাণিজ্যের অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু, তাদের স্থান নেওয়ার জন্য ওলন্দাজ ও ইংরেজ কোম্পানিগুলির আবির্ভাব ঘটেছিল। তারা তাঁর ক্ষমতায় ভীত ছিল এবং তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করত। রাজকীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইতোমধ্যে তাদেরকে প্রদত্ত বাণিজ্যিক সুবিধাদি ভোগ করার জন্য তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিসহ বিদেশী বণিকদের সাহায্য করেছিলেন।

নিজের চেষ্টায় সামান্য অবস্থা থেকে অতি উচ্চপদে উন্নীত মানুষ মীরজুমলা ছিলেন সতেরো শতকে ভারতের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি ছিলেন উদ্যোগী এবং নম্র ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। একজন সাধারণ কেরানি হিসেবে জীবন শুরু করে তিনি মুগল সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সুবাহদার হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালক এবং দূরদর্শী ব্যক্তি। একজন ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু মোগল সুবাহদার হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।

মীর জুমলার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত করেন সম্রাট আলমগীর। শায়েস্তা খান ৬৩ বছর বয়সে প্রথম বাংলায় আসেন। তাঁর ছয়জন দক্ষ পুত্র শাসনকাজে তাঁকে সহায়তা করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই এক বা একাধিক সরকারের ফৌজদারের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। যার ফলে একই পরিবার বাংলার সব বিভাগ কার্যকরভাবে শাসন করেছিলেন। সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ তাঁর প্রশাসনিক সংস্কারসমূহ, কর্মচারীদের দুর্নীতি দমন এবং অন্যায় কর বিলোপ করে জনগণকে স্বস্তিদানের জন্য শায়েস্তা খানের প্রশংসা করেছেন। মীরজুমলার মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে স্থলাভিষিক্ত কর্মকর্তাদের শাসনকালে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। সুতরাং শায়েস্তা খান প্রশাসনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় তাঁর শক্তি নিয়োজিত করেন। সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্ক এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক সততার ফলে অসৎ কর্মকর্তা ও অবাধ্য জমিদাররা ভীত হয়ে পড়েছিল, যার ফলে প্রশাসনের সকল শাখায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল।

লালবাগ কেল্লা
প্রধানত চট্টগ্রাম জয়ের জন্যই বাংলায় শায়েস্তা খানের বিশাল খ্যাতি। মোগলদের বাংলা বিজয়ের আগে চট্টগ্রাম আরাকানিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সুবাহদার ইসলাম খান চিশতি বাংলা ও আরাকানের মধ্যে সীমানা নির্ধারণকারী ফেনী নদী পর্যন্ত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের কয়েকজন সুবাহদার চট্টগ্রাম দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আরাকানি সৈন্যরা নৌ-চালনা ও নৌ-যুদ্ধে দক্ষ ছিল। যার ফলে আরাকানের রাজাগণ কখনোই মোগল সুবাহদারদের শান্তিতে থাকতে দেন নি। মাঝে মাঝেই তারা বাংলায় নৌ-অভিযান পাঠাতেন এবং তাদের গতিপথের অন্তর্ভুক্ত এলাকার যে কোন অংশে লুঠপাট চালাতেন। এমনকি কখনও কখনও তারা রাজধানী শহর ঢাকায়ও আক্রমণ করতেন। ওলন্দাজ ও ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের বাণিজ্যিক প্রাধান্য হারিয়ে ফেলার পর পর্তুগিজরাও সতেরো শতকের গোড়া থেকে জলদস্যুতা শুরু করেছিল। পর্তুগিজ জলদস্যুরা আরাকানে আশ্রয় লাভ করত। আরাকানের রাজা তার শত্রুর অধীন বাংলার সীমান্ত অঞ্চল লুঠ করার জন্য মগ জলদস্যুদের সঙ্গে পর্তুগিজদেরও নিযুক্ত করতেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত জলদস্যুদের যাত্রাপথে নদীগুলির দুই তীর অর্থাৎ উপকূলীয় জেলাগুলি প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছিল। জলদস্যুরা ধনসম্পদের সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান, পুরুষ, নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে যেত এবং ওলন্দাজ, ইংরেজ এবং ফরাসিদের মতো বিদেশী বণিকদের কাছে এবং দাক্ষিণাত্যের বন্দরগুলিতে বন্দিদের দাস হিসেবে বিক্রি করত।

কাজেই বাংলায় পৌঁছে শায়েস্তা খান প্রথমেই আরাকানীদের বিপজ্জনক মনোভাবের প্রতি মনোযোগী হন। শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল। পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য সুবাহদার ত্রিমুখী কর্মসূচি প্রণয়ন করেন: 

প্রথমত, তিনি নওয়ারা বা রণতরীগুলি পুনর্গঠিত করেন, 

দ্বিতীয়ত, পর্তুগিজদের নিজের দলে টেনে আনার চেষ্টা করেন, এবং 

তৃতীয়ত, তারা যেন তাঁকে সাহায্য করে অথবা অন্তঃতপক্ষে নিরপেক্ষ থাকে এ উদ্দেশ্যে তিনি ওলন্দাজ কোম্পানিকে তাঁর দলে টানার চেষ্টা করেন। 

শায়েস্তা খান মুগল সরকারের পূর্ববর্তী নৌ-বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। তাছাড়া পুরানো নৌকাগুলিকে মেরামত করা হয় এবং ঢাকা ও যশোরের জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কারখানায় এবং অন্যান্য নদীবন্দরে নতুন নৌকা তৈরি করা হয়।

সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে শায়েস্তা খান প্রথমে সন্দ্বীপ দ্বীপটি জয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে অভিযানের ঘাঁটি ছিল ভুলুয়া (নোয়াখালী), তবে এটা ছিল স্থলবাহিনীর জন্য ঘাঁটি। পক্ষান্তরে আরাকান ছিল মূলত একটি নৌ-শক্তি। স্থল ও জল উভয় দিক থেকেই চট্টগ্রাম আক্রমণ করা ছিল আবশ্যক। সুতরাং নৌ-বাহিনীর জন্য একটি ঘাঁটির প্রয়োজন ছিল এবং সন্দ্বীপ ছিল একটি আদর্শ নৌ-ঘাঁটি। শায়েস্তা খান তাঁর নৌ-সেনাপতিকে সন্দ্বীপ আক্রমণের আদেশ দেন এবং তিনি ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে সন্দ্বীপ আক্রমণ করেন। সন্দ্বীপের শাসক ছিলেন মোগলদের এক পলাতক প্রাক্তন নাবিক, ৮০ বছর বয়স্ক দিলওয়ার খান। তিনি শৌর্য ও দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হন। সন্দ্বীপ দখল করে মোগলদের শাসনাধীন করা হয়। 

সাত গম্বুজ মসজিদ
ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিরাও মোগলদের পক্ষে চলে আসে। মোগলদের জন্য সৌভাগ্যক্রমে তখন চট্টগ্রামের মগ রাজা ও সেখানকার পর্তুগিজদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আরাকানি রাজার তীব্র রোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্তুগিজরা তাদের পরিবার, জাহাজ এবং কামান নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে এসে ভুলুয়ার (নোয়াখালী) মোগল সেনাপতির কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। শায়েস্তা খান পর্তুগিজ সেনাপতিকে অভ্যর্থনা ও সম্মান জানান। তিনি তাকে নগদ ২০০০ টাকা পুরস্কার ও ৫০০ টাকা মাসিক বেতন প্রদান করেন। তার অনুগামীদেরও উপযুক্ত বেতন-ভাতাসহ মুগল সরকারের চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়। বাটাভিয়ার ওলন্দাজ গভর্নর জেনারেল তার কোম্পানির সাহায্যের ব্যাপারেও শায়েস্তা খানকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তারা আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ তাদের বাণিজ্য কুঠি বন্ধ করে দেয়, তাদের কর্মচারীদের প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের জাহাজগুলির গতিপথ আরাকান থেকে অন্যান্য স্থানে পাল্টে দেয়। চট্টগ্রাম অভিযানে কাজে লাগানোর জন্য ওলন্দাজ কোম্পানি শায়েস্তা খানকে দুটি জাহাজ পাঠান। তবে সেগুলি এসে পৌঁছার আগেই শায়েস্তা খান চট্টগ্রামে আরাকানিদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন।

শায়েস্তা খান ১৬৬৫ খিস্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তাঁর দীর্ঘ দিন ধরে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম অভিযান প্রেরণ করেন। তাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে সার্বিক নেতৃত্ব দেওয়া হয় এবং নৌ-সেনাপতি ইবনে হোসেনকে নৌ-বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করা হয়। সুবাহদার নিজে রসদ সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনী একই সময়ে একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে স্থল ও সমুদ্রপথে যাত্রা করে। স্থল বাহিনীকে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করে অগ্রসর হতে হয়েছিল। সমুদ্রে এবং পরে কর্ণফুলী নদীতে একটি বড় যুদ্ধে পর্তুগিজদের সাহায্য নিয়ে মুগলরা বিজয়ী হয়। আরাকানী নৌ-বাহিনী পরাজিত হলে তাদের নাবিকরা পালিয়ে যায় এবং তাদের কেউ কেউ দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। চট্টগ্রাম দুর্গ অবরোধ করা হয় এবং ১৬৬৬ খিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি তা মোগল অধিকারে আসে। পরের দিন বুজুর্গ উমেদ খান দুর্গে প্রবেশ করেন এবং চট্টগ্রামকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এটি একজন ফৌজদারের অধীনে মোগল প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং সম্রাটের অনুমতি সাপেক্ষে এর নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখা হয়। প্রধানত মগ-পর্তুগিজ জলদস্যুদের লুটতরাজ, অত্যাচার নিপীড়ন থেকে মানুষ রক্ষা পাওয়ায় চট্টগ্রাম জয় সারাদেশে অবর্ণনীয় আনন্দ বয়ে আনে। হাজার হাজার অপহৃত ও ক্রীতদাসে পরিণত বাঙালি কৃষকদের মুক্তিলাভ ছিল এই বিজয়ের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল।

শায়েস্তা খান ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিসাধনে সহায়তা করেছিলেন। তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ব্যবসাকে উৎসাহিত করেন এবং তাদের স্বার্থের নিরাপত্তার জন্য রাস্তা ও নদীগুলিকে ডাকাতমুক্ত করেন। রাজকীয় ফরমানগুলির শর্তানুসারে তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে বিশেষ অধিকার প্রদান করেছিলেন। কিন্তু কখনও কখনও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি তাদের বিশেষ অধিকারগুলির অপব্যবহার করত এবং তাদের কুঠিয়াল ও নাবিকরা রাজকীয় ফরমান দ্বারা নিষিদ্ধকৃত ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত হতো। কাজেই মাঝে মাঝে বিশেষত শুল্ক দাবি ও প্রদান নিয়ে বন্দর ও শুল্ক বিভাগের মোগল কর্মকর্তা ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত ঘটত। সম্রাট বাণিজ্যের প্রসারকে উৎসাহিত করতেন, কারণ বাণিজ্য, বিশেষত রপ্তানি বাণিজ্য আয় বৃদ্ধি ঘটায়। 

শায়েস্তা খান একজন নির্মাতাও ছিলেন। তিনি রাজধানী শহর ঢাকা ও তার বাইরে বেশ কয়েকটি মসজিদ, সমাধি এবং অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ঢাকাকে স্থানীয় বাণিজ্য, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে যান। তাঁর কল্যাণে ঢাকা একটি ছোট দাপ্তরিক কেন্দ্র থেকে বৃহৎ ও উন্নত শহরে পরিণত হয়। শয়েস্তা খাঁ মসজিদটি তার তৈরি একটি সুবৃহৎ কীর্তি। বাংলা ও মুঘল স্থাপত্য কীর্তির মিশ্রণে তৈরি এই ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত হয়েছে। এছাড়াও তার আমলে লালবাগ কেল্লা, হোসনী দালান, ছোট কাটরা, সাত গম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা নির্মিত হয়।

তাঁর দক্ষ সেনাপতিত্ব, ন্যায়বিচার এবং জনকল্যাণের অগ্রগতি সাধনের জন্য সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকবৃন্দ শায়েস্তা খানের প্রশংসা করেছেন। তাঁর উদারতা, বদান্যতা এবং ধর্মপ্রাণতার উপরও তাঁরা গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি একজন কবি ও পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর নির্মাণ কার্যাবলি পরবর্তীকালে শায়েস্তা খানী রীতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। মোগল আমলে সুবাহ বাংলার দায়িত্ব পাওয়া সুবাহদারদের মধ্যে অনন্য কীর্তিতে উজ্জ্বল ছিলেন শায়েস্তা খান। তার জীবদ্দশায় তিনি দুই পর্বে বাংলার সুবাদারির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একই সাথে সবচেয়ে বেশি সময় বাংলার সুবাদারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর প্রথম দীলির খান ও দাউদ খান অস্থায়ী সুবাদার রূপে বাংলাদেশ শাসন করেন। 

১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খান সুবাদারের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় আসেন। ১৬৭৬ সালে উড়িষ্যা তার সুবেদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। টানা ১৪ বছর পর ১৬৭৮ সালে জাহাঙ্গীরের আদেশে এক বছরের জন্য তিনি দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। ১৬৭৯ সালে সেপ্টেম্বরে তিনি আবার দ্বিতীয়বারের কত বাংলায় ফিরে আসেন। শায়েস্তা খান প্রায় ২২ বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। শায়েস্তা খান একদিকে ছিলেন সুশাসক, অন্যদিকে একজন বিজয়ী যোদ্ধা ও নিপুণ নির্মাতা। ১৬৮৮ খৃস্টাব্দের জুন মাসে এইই শাসব দিল্লির উদ্দেশ্যে বাংলা ত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় শায়েস্তা খানের সোনালি যুগ।

২৮ সেপ, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-১৭ : বাংলায় মোগল শাসনের সূত্রপাত, বারো ভুঁইয়া ও ঢাকার গোড়াপত্তন



১৫৭৬ সালে বাংলার আফগান সুলতান দাউদ খান কররানী পরাজয়ের পর বাংলা মোগল সম্রাট আকবরের অধীনে চলে আসে। সম্রাট আকবর বারো সুবাহর একটি হিসেবে বাংলার নাম ঘোষণা করেন। এরপর থেকে বাংলার নাম হয়ে যায় সুবাহ বাংলা। যার সীমানা ছিল বর্তমান বিহার, ওড়িশা, বাংলা হয়ে আরাকান পর্যন্ত।

১৫৭৬ সাল থেকে ১৭১৭ সাল পর্যন্ত বাংলা মোগলদের অধীনে ছিলো। ১৭শ শতাব্দীতে মোগলগণ বারো-ভুইয়া ভুস্বামীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হোন, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ঈসা খান। মোগল আমলে বাংলা একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যে পরিণত হয় এবং বহুত্ববাদী সরকারের নীতির কারণে তা শক্ত অবস্থান লাভ করে। মোগলেরা ১৬১০ সাল থেকে ঢাকায় নতুন মহানগরী গড়ে তোলে, যেখানে ছিল সুবিন্যস্ত বাগান, দুর্গ, সমাধি, প্রাসাদ এবং মসজিদ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে শহরটি তার নামে নামকরণ করা হয়। ঢাকা মোগল সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে আবির্ভূত হয়, জানা যায় সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ রপ্তানি কেন্দ্র ছিল মসলিন বস্ত্রকে ঘিরে। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রামে মোগলেরা যুদ্ধে জয় লাভ করে আরাকান রাজ্য দখল করে এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় নিয়ে নেয়, যার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল ইসলামাবাদ। 

দাউদ খান কররানীর পরাজয়ের পর হোসেন কুলি বেগ খান জাহান উপাধি নিয়ে সুবাহ বাংলার শাসক নিযুক্ত হন। তিনি ১৫৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলার শাসক ছিলেন। এরপর ১৫৭৮ থেকে ১৫৯৪ সাল পর্যন্ত ছয়জন সুবাহদার বাংলা শাসন করেছেন। এরপর ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত হন। 

মানসিংহ ছিলেন রাজা ভগবান দাসের পালক পুত্র। আম্বরে জন্মগ্রহণকারী মির্জা রাজারূপে পরিচিত মানসিংকে সম্রাট আকবর ফরজন্দ খেতাবে ভূষিত করেন। ভগবান দাস পাঞ্জাবের সুবাহদার নিযুক্ত হলে মানসিংহ সিন্ধু নদের তীরবর্তী জেলাগুলি নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রদেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে কাবুলে পাঠানো হয় এবং ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিহারের সুবাহদার নিযুক্ত হন। তখন পর্যন্ত কুনওয়ার রূপে পরিচিত মানসিংহকে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ‘রাজা’ উপাধি এবং পাঁচ হাজারি মনসব প্রদান করা হয়। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ তাঁকে বাংলার সুবাহদার নিয়োগ করা হয়। ১৫৯৪-১৫৯৮, ১৬০১-১৬০৫ এবং ১৬০৫-১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিন মেয়াদে সুবাহদারের দায়িত্ব পালন করেন।

আফগান নেতাদের এবং ঈসা খানের নেতৃত্বাধীন ভূঁইয়াদের দমন করা ছিল বাংলায় রাজা মানসিংহের প্রধান কাজ। তান্ডা থেকে প্রস্ত্ততিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তিনি চারদিকে কয়েকটি পরীক্ষামূলক অভিযান পরিচালনা করেন এবং ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর তান্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তর করেন। নতুন রাজধানীর তিনি নামকরণ করেন আকবরনগর। মানসিংহের পুত্র হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে এক পরীক্ষামূলক অভিযানে ঈসা খানের মিত্র কেদার রায়ের নিকট থেকে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২ এপ্রিল ভূষণা দুর্গ দখল করা হয়। ঈসা খানের নিকট থেকে ভাটি জয়ের উদ্দেশ্যে ১৫৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর মানসিংহ নিজেই নতুন রাজধানী থেকে যাত্রা করেন। মানসিংহ নিকটবর্তী হলে ঈসা খান ব্রহ্মপুত্রের অপর তীরে পশ্চাদপসরণ করেন। মানসিংহ শেরপুর মোর্চায় (বগুড়া জেলায়) শিবির স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি এই স্থানের নামকরণ করেন সেলিমনগর এবং বর্ষাকালটা তিনি সেখানেই কাটান। ইতোমধ্যে ঈসা খানের মিত্র খাজা সুলায়মান খান নুহানী এবং কেদার রায় মুগলদের কাছ থেকে ভূষণা দুর্গ পুনর্দখল করেন। মানসিংহ তাঁর পুত্র দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে এক অভিযান প্রেরণ করেন এবং প্রচন্ড লড়াইয়ের পর ১৫৯৬ সালের ২০ জুন তিনি দুর্গটি পুনর্দখল করতে সক্ষম হন। ১৫৯৬ সালে মানসিংহ ঘোড়াঘাটে তাঁর শিবির স্থাপন করেন। তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তবে সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঈসা খান ও তাঁর মিত্রদের বিরুদ্ধে হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে একটি ছোট সৈন্যদল পাঠান। হিম্মত সিংহ নিকটবর্তী হলে ঈসা খান এগারসিন্ধুর এর দিকে পশ্চাদপসরণ করেন।

১৫৯৭ সালে সেপ্টেম্বরে মানসিংহ স্থল ও জলপথে ঈসা খানের বিরুদ্ধে দুটি বিরাট বাহিনী পাঠান। দুর্জন সিংহের অধিনায়কত্বে মোগল সেনাবাহিনী প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য লাভ করে, এমনকি তারা ঈসা খানের রাজধানী কাত্রাবোও (নারায়ণগঞ্জ) আক্রমণ করে। কিন্তু শেষে ৫ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর থেকে ২০ কি.মি. দূরে এক নৌ-যুদ্ধে দুর্জন সিংহ নিহত হন এবং মুগল বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। এভাবে ঈসা খানের বিরুদ্ধে মানসিংহের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং হতোদ্যম সুবাহদার ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে আজমীরের উদ্দেশে বাংলা ত্যাগ করেন।

১৬০১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে মানসিংহ দ্বিতীয়বার সুবাহদার হিসেবে বাংলায় আসেন এবং ১২ ফেব্রুয়ারি শেরপুর আতাই-এর যুদ্ধে আফগান বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন। পরের বছর তিনি ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং শ্রীপুরের জমিদার কেদার রায়কে মোগলদের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। উত্তরবঙ্গের মালদহ পর্যন্ত এলাকায় হামলাকারী জালাল খান ও কাজী মুমিনের মতো আফগান দলপতিদের বিরুদ্ধে মানসিংহ ঘোড়াঘাট থেকে তাঁর পৌত্র মহাসিংহের অধীনে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। মানসিংহ সে অঞ্চল থেকে আফগান দলপতিদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। ইতোমধ্যে বোকাইনগরের খাজা উসমান খান নুহানী ময়মনসিংহের মুগল থানাদার বজ বাহাদুর কলমাককে ভাওয়ালে বিতাড়িত করেন। ঘটনার এ গতি পরিবর্তনে মানসিংহ দ্রুত ঢাকা থেকে ভাওয়াল অভিমুখে অগ্রসর হয়ে উসমান খানকে পরাজিত করেন। এর অল্পকাল পরেই ইছামতি নদীর তীরে মানসিংহের সঙ্গে মুসা খান ও তাঁর ভাই দাউদ খান, উসমান খান ও কেদার রায়ের সম্মিলিত বাহিনীর আরেকটি যুদ্ধ হয়। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ বহু কষ্টে ত্রিমোহিনীর মোগল দুর্গে মগ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করেন। মগদের সহায়তায় কেদার রায় শ্রীনগরে মোগল ঘাঁটি আক্রমণ করেন। মানসিংহ উসমান খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভাওয়ালে ফিরে এলে উসমান খান পালিয়ে যান। ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মানসিংহ আগ্রার উদ্দেশে বাংলা ত্যাগ করেন। এরপর কুতুবুদ্দিন কোকা ও জাহাঙ্গীর কুলি বেগ কিছুদিন বাংলা শাসন করেন। এরপর বাংলা শাসন করেন সুবাহদার ইসলাম খান।

ইসলাম খান চিশতি পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ের জন্য বাংলার মুগল সুবাহদার ছিলেন। তার মূল নাম নাম শেখ আলাউদ্দীন চিশতি। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে ইসলাম খান উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। আগের মোগল সেনানয়কেরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেখানে চট্টগ্রাম ছাড়া সমগ্র বাংলা জয় করে মোগলদের নিয়ন্ত্রণে আনার সাফল্য লাভ করায় বাংলার সুবাহদার হিসেবে ইসলাম খান খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৫৭৬ থেকে ১৬০৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আকবর প্রায় বারোজন দক্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে বাংলা জয় করার জন্য পাঠালেও রাজধানী নগরী তান্ডা এর আশে পাশের কিছু অংশ মাত্র দখল করতে সফল হয়েছিলেন। স্থানীয় রাজা, ভূঁইয়া, জমিদার ও আফগান নেতা তখন বাংলাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে শাসন করছিলেন। আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীর তরুণ ও উদ্যমী ইসলাম খানকে তিনি বাংলা জয়ের জন্য নির্বাচিত করেন ও সুবাহদার হিসেবে ১৬০৮ সালে বাংলায় প্রেরণ করেন।

ইসলাম খান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বাংলার ভূ-রাজনীতি পরীক্ষা করে দেখেন এবং সম্রাটের প্রবীণ যোদ্ধাদের সহযোগিতায় তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তৈরি করেন। বিদ্রোহী বাংলা প্রদেশে মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সুসজ্জিত, সুপ্রশিক্ষিত, অনুগত, বিশ্বাসী ও কর্তব্যপরায়ণ সামরিক শক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। ভাটি অঞ্চলে বারো ভূঁইয়া এবং খাজা উসমান ও তার ভাইদের নেতৃত্বাধীন আফগানরা মোগল কর্তৃক বাংলা বিজয়ে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল বলে তিনি মনে করতেন। আফগানরা বুকাইনগর দখল করে নিয়েছিল। ফলে ইসলাম খান সর্বপ্রথম ভাটি ও বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। তিনি ছোট-বড় নদী ও খালে পরিপূর্ণ ভাটির নিম্নাঞ্চলে যুদ্ধে কার্যকর ফললাভের জন্য শক্তিশালী নৌ-বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। সুতরাং ইসলাম খান মুগল নৌ-বাহিনীকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি এটাও উপলব্ধি করেন যে, তদানীন্তন রাজধানী রাজমহল ছিল বাংলা প্রদেশের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এবং গোলযোগপূর্ণ পূর্ব বাংলা থেকে রাজমহলের দূরত্বও ছিল অনেক। সুতরাং তিনি ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। কারণ ঢাকা ছিল ভাটি অঞ্চলের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং বারো ভূঁইয়াদের সদর দফতরের সঙ্গে নদী দ্বারা উত্তম যোগাযোগের জন্য সুবিধাজনক স্থান।

সৈন্যবাহিনী ও নৌ-বাহিনী পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ইসলাম খান সম্রাটের কাছ থেকে সহায়তা লাভ করেন। মোগল সম্রাট ইতিমাম খানকে মীর বহর (নৌ-সেনাপতি) এবং মুতাকিদ খানকে দিউয়ান নিযুক্ত করেন। এ দুজনই ছিলেন অভিজ্ঞ এবং স্ব স্ব বিভাগের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং ইসলাম খান তাদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ইসলাম খান রাজমহল থেকে যাত্রা শুরু করে ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে ঘোড়াঘাট পৌঁছেন। বর্ষাকালটা সেখানে কাটিয়ে তিনি অক্টোবর মাসে ভাটির দিকে অগ্রসর হন। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের জুন-জুলাই মাসের দিকে ঢাকা পৌঁছার আগে তিনি সে বছরের প্রথম কয়েক মাস বারো ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটান। ঈসা খাঁ'র পুত্র মুসা খান ছিলেন বারো ভূঁইয়াদের নেতা। তাঁর নেতৃত্বে বারো ভূঁইয়াগণ প্রতিটি দুর্গে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে ব্যর্থ হন। ইসলাম খান ঢাকা দখল করে সেখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন এবং সম্রাটের নামানুসারে এ স্থানের নতুন নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। তখনো পর্যন্ত ভূঁইয়াদের সম্পূর্ণরূপে দমন করা সম্ভব হয় নি। তারা শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে তাদের অবস্থানগুলিকে সুরক্ষিত করে রেখেছিলেন। ইসলাম খান ঢাকাকে সুরক্ষিত করে তিনি ভূঁইয়াদের সব অবস্থানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন এবং ১৬১১ খ্রিস্টাব্দেই মুসা খানসহ বারো ভূঁইয়াদের সবাই ইসলাম খানের নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন। সুবাহদার যশোরের প্রতাপাদিত্য, বাকলার (বরিশাল) রামচন্দ্র এবং ভুলুয়ার (নোয়াখালী) অনন্তমাণিক্যকেও পরাজিত করেন এবং তাদের রাজ্যগুলি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।

এরপর তিনি খাজা উসমানের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন আফগানদের বুকাইনগরে (ময়মনসিংহ) পরাজিত করেন। আফগানরা উহারে (মৌলভীবাজারে) পালিয়ে যায়, তবে তারা তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। ইসলাম খানের অনুরোধে উসমানের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে সুজ্জাত খানকে সম্রাট প্রেরণ করেন। আফগানদের সঙ্গে এ যুদ্ধের ফলাফল প্রায় অনিশ্চিত হতে যাচ্ছিল। কিন্তু উসমানের আকস্মিক মৃত্যু মোগলদের অপ্রত্যাশিত বিজয় এনে দেয়। রাতের অন্ধকারে আফগানরা পালিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে তারা মুগলদের বশ্যতা স্বীকার করে। সিলেটে বায়েজীদ কররানী এর নেতৃত্বাধীন আফগাদেরও বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়। এভাবে সমগ্র বাংলা মুগলদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বাংলার দক্ষিণ পূর্ব সীমান্ত নির্ধারিত হয় ফেনী নদী, যার পরেই ছিল আরাকান রাজ্য।

এরপর ইসলাম খান কুচবিহার, কামরূপ এবং কাছাড় রাজ্যের দিকে মনোযোগ দেন। কুচবিহারের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ সর্বদাই ছিলেন মুগলদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, কিন্তু রাজা পরীক্ষিৎ নারায়ণ মুগলদের অগ্রগতির বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পর তিনি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন এবং তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীকালে তাঁকে সম্রাটের দরবারে প্রেরণ করা হয় এবং কামরূপ মুগল সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত হয়। কাছাড়ের পরাজিত রাজাও মোগলদের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন।

ইসলাম খান সমগ্র বাংলা জয় করতে এবং সীমান্তরাজ্য কামরূপ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এক এক করে প্রতিপক্ষদের পরাজিত করে তিনি তাঁদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেন নি। ভূঁইয়া ও সামন্ত রাজাদের দ্বিধাবিভক্ত করে শাসন করা ছিল তার রাজনৈতিক কৌশল। পরাজিত জমিদার, ভূঁইয়া এবং সামন্তরাজাদের তিনি তাঁদের স্ব স্ব এলাকায় বিনা শর্তে ফিরে যেতে অনুমতি প্রদান করেন নি। তাদের এলাকা ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে তিনি তাদের সৈন্যদেরকে মোগল সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করেন এবং রণতরীগুলি বাজেয়াপ্ত করেন। মোগল সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে তাদের সমগোত্রীয় জমিদার ও ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে হতো। এ ভাবে কৌশলগত পরিকল্পনা ও অব্যাহত প্রচেষ্টার দ্বারা ইসলাম খান সাফল্য অর্জন করেন এবং সম্রাট কর্তৃক তাঁর ওপর ন্যস্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন। দাউদ খান কররানীর পতনের বত্রিশ বছর পরেও আকবরের বিখ্যাত সেনাপতিগণ যে কাজ করতে পারেন নি ইসলাম খান পাঁচ বছরের কম সময়েই তা সুসম্পন্ন করেতে সক্ষম হন। এরপর ভূঁইয়া, জমিদার এবং আফগান দলপতিগণ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেন নি। আফগানশক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং ভূঁইয়া, জমিদার ও স্থানীয় রাজাগণ মোগলদের অধীনস্থ জমিদারে পরিণত হন।

ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করা ছিল ইসলাম খানের আরেকটি বড় কৃতিত্ব। ইসলাম খান ছিলেন প্রথম সুবাহদার যিনি মোগলদের সৈন্য ও যুদ্ধ পরিচালনায় পূর্ব বাংলার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। এ জন্যই তিনি সে এলাকার কেন্দ্রস্থলে রাজধানী স্থানান্তর করেন। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, ইসলাম খানই প্রকৃতপক্ষে মোগলদের জন্য বাংলা জয় করেছিলেন। তার দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি বাংলায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাকে মোগল সাম্রাজ্যের একজন নির্মাতা এবং বাংলা প্রদেশের শ্রেষ্ঠ সুবাহদার হিসেবে গণ্য করা হয়। 

২৬ সেপ, ২০১৯

খিলাফত রাষ্ট্র বা ইসলামী রাষ্ট্র কী? জামায়াত কী চায়?


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যে ইসলামী রাষ্ট্র বা ইসলামী খিলাফতের কথা বলে তার উদাহরণ হিসেবে তারা দুইটি শাসন ব্যবস্থাকে স্থির করেছে। সেগুলো হলো নববী শাসন ও খেলাফতে রাশেদা। এই দু'টি শাসন ব্যবস্থা থেকে আমরা কিছু মূলনীতি পাই যা দ্বারা আমরা আমাদের সমাজ ও অধীনস্থ এরিয়া পরিচালনা করতে পারি।

নববী শাসন
ইসলামের অভ্যুদয়ের পর যে মুসলিম সমাজ অস্তিত্ব লাভ করে এবং হিজরতের পর রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করে তা যে রাষ্ট্রের রূপ গ্রহন করে, তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল কুরআনের রাজনৈতিক শিক্ষার উপর। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নিন্মোক্ত মূলনীতিগুলো আমরা নববী শাসন থেকে পাই।

১. আল্লাহর আইনের কর্তৃত্ব
এ শাসনের প্রথম মূলনীতি ছিলো এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং ঈমানদারদের শাসন হচ্ছে মূলত খিলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল শাসন। কাজেই বলগাহীনভাবে কাজ করার তার কোনো অধিকার নেই। বরং আল্লাহর কিতাব ও তার রসূলের সুন্নাহর উৎস থেকে উৎসারিত আল্লাহর আইনের অধীনে কাজ করা তার অপরিহার্য কর্তব্য। কুরআন মাজীদের যেসব আয়াতে এ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে সেগুলো হলো, সূরা নিসাঃ ৫৯, ৬৪, ৬৫, ৮০, ১০৫; আল-মায়েদাঃ ৪৪, ৪৫, ৪৭; আল-আরাফঃ ৩; ইউসুফঃ ৪০; আন-নূরঃ ৫৪, ৫৫; আল-আহযাবঃ ৩৬ এবং আল-হাশরঃ ৭।

নবী সা.ও তার অসংখ্য বাণীতে এ মূলনীতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘‘আল্লাহর কিতাব মেনে চলা তোমাদের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহর কিতাব যা হালাল করে দিয়েছে, তোমরা তাকে হালাল মানো, আর যা হারাম করেছে, তোমরা তাকে হারাম করো।’’ [কানযূল ওম্মাল, ত্বাবরানী এবং মুসনাদে আহমদের উদ্ধৃতিতে, ১ম খন্ড, হাদীস নং-৯০৭-৯৬৬; দায়েরাতুল মায়ারেফ, হায়দারাবাদ সংস্করণ ১৯৫৫]
‘‘আল্লাহ্ তায়ালা কিছু করণীয় নির্ধারন করে দিয়েছন, তোমরা তা নষ্ট করোনা, কিছু হারাম বিষয় নির্দিষ্ট করেছেন, তোমরা তাতে ঢুকে পড়োনা, কিছু সীমা নির্ধারন করেছেন, তোমরা তা অতিক্রম করোনা, ভুল না করেও কিছু ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করেছেন, তোমরা তার সন্ধানে পড়োনা। ’’ [মিশকাত, দারেকুতনীর উদ্ধৃতিতে-বাবুল ইতিসাম বিল কিতাবে ওয়াস সুন]

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব মেনে চলে, সে দুনিয়ায় পথভ্রষ্ট হবেনা, পরকালেও হবেনা সে হতভাগা।’’[ মিশকাত, রাযীন-এর উদ্ধৃতিতে উল্লেখিত অধ্যায়।]
‘‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষণ তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে থাকবে, কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা,- আল্লাহর কিতাব এবং তার রসূলের সুন্নাহ।’’[ মিশকাত মুয়াত্তর উদ্ধৃতিতে, আলোচ্য অধ্যায়, কানযুল ওম্মাল, ১ম খন্ড হাদীস নং-৮৭৭, ৯৪৯, ৯৫৫, ১০০১।]

২. সকল মানুষের প্রতি সুবিচার
দ্বিতীয় যে মূলনীতির ওপর সে রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা ছিলো, কুরআন সুন্নাহর দেয়া আইন সকলের জন্য সমান, রাষ্ট্রের সামান্যতম ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট পধান পর্যন্ত সকলের উপর তা সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তাতে কারো জন্য কোনো ব্যতিক্রমধর্মী আচরণের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবীকে একথা ঘোষণা করার নির্দেশ দিচ্ছেনঃ
‘এবং তোমাদের মধ্যে সুবিচার কায়েম করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’’ [সূরা আশ শুরা ১৫]

অর্থাৎ পক্ষপাতমুক্ত সুবিচার নীতি অবলম্বন করার জন্য আমি আদিষ্ট ও নিয়োজিত। পক্ষপাতিত্বের নীতি অবলম্বন করে কারো পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়া আমার কাজ নয়। সকল মানুষের সাথে আমার সমান সম্পর্ক- আর তা হচ্ছে আদল ও সুবিচারের সম্পর্ক। সত্য যার পক্ষে, আমি তার সাথী; সত্য যার বিরুদ্ধে, আমি তার বিরোধী। আমার দ্বীনে কারো জন্য কোনো পার্থক্যমূলক ব্যবহারের অবকাশ নেই। আপন পর, ছোট বড়, শরীফ কমীনের জন্য পৃথক পৃথক অধিকার সংরক্ষিত নেই। যা সত্য তা সকলের জন্যই সত্য; যা গুনাহ, তা সকলের জন্যই গুনাহ; যা হারাম, তা সকলের জন্যই হারাম; যা হালাল, তা সকলের জন্যই হালাল; যা ফরয, তা সকলের জন্যই ফরয। আল্লাহর আইনের এ সর্বব্যাপী প্রভাব থেকে আমার নিজের সত্বাও মুক্ত নয়, নয় ব্যতিক্রম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এ মূলনীতি বর্ণনা করেছেনঃ ‘‘ তোমাদের পূর্বে যেসব উম্মত অতিক্রান্ত হয়েছে, তারা এজন্য ধ্বংস হয়েছে যে, নিন্ম পর্যায়ের অপরাধীদেরকে আইন অনুযায়ী শাস্তি দান করতো, আর উচ্চ পর্যায়ের অপরাধীদেরকে ছেড়ে দিত। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ নিহিত, ফাতেমাও যদি চুরি করতো, তবে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে ফেরতাম।’’[ বুখারী, কিতাবুল হুদুদ, অধ্যায়১১-১২।]

৩. মুসলমানদের মধ্যে সাম্য
এ রাষ্ট্রের তৃতীয় মূলনীতি ছিলো, বংশ, বর্ণ, ভাষা এবং দেশকাল নির্বিশেষে সকল মুসলমানের অধিকার সমান। এ রাষ্ট্রের পরিসীমায় কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, বংশ বা জাতি কোনো বিশেষ অধিকার লাভ করতে পারেনা, অন্যের মুকাবিলায় করো মর্যাদা খাটোও হতে পারেনা ।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, ‘‘মুমিনরা একে অন্যের ভাই।’’ [সূরা হুজরাত ১০] ‘‘হে মানব মন্ডলী! এক পুরুষ এবং এক নারী থেকে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের নানা গোত্র, নানা জাতিতে বিভক্ত করেছি, যেনো তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। মূলত আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী সন্মানার্হ, যে সবচেয়ে বেশী আল্লাহকে ভয় করে।’’ [সূরা হুজরাত ১৩]

নবী সা.-এর নিম্মোক্ত উক্তি এ মূলনীতিকে আরও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছে, ‘‘আল্লাহ তোমাদের চেহারা এবং ধন সম্পদের দিকে তাকাননা বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কার্যাবলীর দিকে তাকান।’’ [তাফসীরে ইবনে কাসীর, মুসলিম এবং ইবনে মাজার উদ্ধৃতিতে, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-২১৭, মুস্তফা মুহাম্মাদ প্রেস, মিসর-১৯৩৭।]

৪. সরকারের দায়িত্ব ও জবাবদিহি
এ শাসনের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিল, শাসন কর্তৃত্ব এবং তার ক্ষমতা ইখতিয়ার ও অর্থ সম্পদ আল্লাহ এবং মুসলমানদের আমানত। আল্লাহভীরু, ঈমানদার এবং ন্যায়পরায়ণ লোকদের হাতে তা ন্যস্ত করতে হবে। কোনো ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামতো এই আমানতে খেয়ানত করার অধিকার রাখেনা। এ আমানত যাদের সোপর্দ করা হবে তারা এজন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে বলেন, ‘‘আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন। আন যখন মানুষের মধ্যে ফায়সালা করবে ন্যায়নীতির সাথে ফায়সালা করবে আল্লাহ্ তোমাদের ভালো উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চই আল্লাহ্ সবকিছু শোনেন ও দেখেন। [সূরা নিসা ৫৮]

রাসূল সা. বলেন, ‘‘সাবধান! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় নেতা-যিনি সকলের উপর শাসক হন তিনিও দায়িত্বশীল তাঁকেও তাঁর সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’’[ বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-১। মুসলিম কিতাবুল ইমারাত, অধ্যায়-৫।]

‘‘মুসলিমদের কাজ করাবারের প্রধান দায়িত্বশীল কোনো শাসক যদি তাদের সাথে প্রতারণা এবং খিয়ানতকারী অবস্থায় মারা যায় তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’’[বুখারী, কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৮। মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়-৬১; কিতাবুর ইমারাত, অধ্যায়-৫।]

‘‘মুসলিম রাষ্ট্রের কোনো পদাধিকারী শাসক যে নিজের পদের দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রাণপণ চেষ্ঠা সাধনা করেনা, নিষ্ঠার সাথে কাজ করেনা; সে কখনো মুসলমানদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবেনা।’’ [মুসলিম, কিতাবুল ইমারাত, অধ্যায়-৫।]

[নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যরকে বলেন] ‘‘আবু যর। তুমি দুর্বল মানুষ, আর সরকারের পদ মর্যাদা একটি আমানত। কিয়ামতের দিন তা লজ্জা এবং অপমানের কারণ হবে; অবশ্য তার জন্য নয়, যে পুরোপুরি তার হক আদায় করে এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে।’’ [ কানযুল ওম্মাল, ষষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩৮, ১২২।]

‘‘যে ব্যক্তি আমাদের রাষ্ট্রের কোনো পদ গ্রহন করে, তার স্ত্রী না থাকলে বিবাহ করবে, খাদেম না থাকলে একজন খাদেম গ্রহন করবে, ঘর না থাকলে একখানা ঘর করে নেবে,[যাতায়াতের] বাহন না থাকলে একটা বাহন গ্রহন করবে। যে ব্যক্তি এর চেয়ে বেশী অগ্রসর হয়, সে খিয়ানতকারী অথবা চোর।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩৪৬।]

৫. শুরা বা পরামর্শ
এ রাষ্ট্রের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি ছিলো মুসলমানদের পরামর্শ এবং তাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে রাষ্ট্র প্রধান নিযুক্ত হতে হবে। তাঁকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনাও করতে হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, ‘‘আর মুসলমানদের কাজকর্ম [সম্পন্ন হয়] পারস্পরিক পরামর্শক্রমে।’’[সূরা শুরাঃ ৩৮] ‘‘হে নবী! কাজ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো।’’[সূরা আলে ইমরানঃ ১৫৯]
হযরত আলী রা. বলেন, আমি রাসূল সা.-এর খিদমতে আরয করি যে, আপনার পর আমাদের সামনে যদি এমন কোনে বিষয় উপস্থিত হয়, যে সম্পর্কে কুরআনে কোনো নির্দেশ না থাকে এবং আপনার কাছ থেকেও সে ব্যাপারে আমরা কিছু না শুনে থাকি, তখন আমরা কি করবো? তিনি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে দীনের জ্ঞান সম্পন্ন এবং ইবাদত গুযার ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করো এবং কোনো ব্যক্তি বিশেষের রায় অনুযায়ী ফায়সালা করবেনা।’’

হযরত উমর রা. বলেন, ‘‘মুসলমানদের পরামর্শ ছাড়া যে ব্যক্তি তার নিজের বা অন্য কারো নেতৃত্বের [ইমারাত] প্রতি আহবান জানায়, তাকে হত্যা না করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৫৭৭। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির জোর পূর্বক চেপে বসার চেষ্টা করা এক মারাত্নক অপরাধ, তা বরদাস্ত করা উম্মতের উচিত নয়।] অপর এক বর্ণনায় হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ উক্তি বর্ণিত আছে, ‘‘পরামর্শ ব্যতীত কোনো খেলাফত নেই।’’[২৪. কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২৩৫৪।]

৬. ভালো কাজে আনুগত্য
৬ষ্ঠ মূলনীতি-যার ওপর এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল-এই ছিল যে, কেবল মাত্র মারুফ বা ভালো কাজেই সরকারের আনুগত্য অপরিহার্য। পাপাচারে [মা’সিয়াত] আনুগত্য পাওয়ার অধিকার কারোর নেই। অন্য কথায়, এ মূলনীতির তাৎপর্য এই যে, সরকার এবং সরকারী কর্মকর্তাদের কেবল সেসব নির্দেশই তাদের অধীন ব্যক্তিবর্গ এবং প্রজাবৃন্দের জন্য মেনে চলা ওয়াজিব, যা আইনানুগ। আইনের বিরুদ্ধে নির্দেশ দেয়ার তাদের কোনো অধিকার নেই; তা মেনে চলাও কারো উচিত নয়। কুরআন মাজীদে স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাইয়াত- আনুগত্যের শপথ গ্রহনকেও মারুফে আনুগত্যের শর্তে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অথচ তাঁর পক্ষে কোনো মা’সিয়াত বা পাপাচারের নির্দেশ আসার প্রশ্নই ওঠেনা।

রাসূল সা. বলেন, ‘‘একজন মুসলমানের উপর তার আমীরের আনুগত্য করা শোনা এবং মেনে চলা ফরয; তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যতক্ষণ তাকে কোনো মা’সিয়াত বা পাপাচারের নির্দেশ না দেয় হয়। মা’সিয়াতের নির্দেশ দেয়া হলে কোনো আনুগত্য নেই।’’[বুখারী কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৪ মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮। আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৩। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল জিহাদ, অধ্যায়-৪০।]

‘‘আল্লাহর নাফরমানীতে কোনো আনুগত্য নেই; আনুগত্য কেবল মারুফ কাজে।’’[ মুসলিম, কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৮ আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ, অধ্যায়-৯৫। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৩]
নবী সা.-এর বিভিন্ন উক্তিতে বিভিন্নভাবে এ বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছে। কোথাও তিনি বলেছেনঃ ‘‘যে আল্লাহর নাফরমানী করে, তার জন্য কোনো আনুগত্য নেই,’’ কখনো বলেছেন, স্রষ্ট্রার নাফরমানীতে সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই,’’ কখনো বলেছেন, ‘‘যে আল্লাহর আনুগত্য করেনা তার জন্য কোনো আনুগত্য নেই, কখনো বলেছেনঃ ‘’যে শাসক তোমাকে তোমাকে কোনো মা’সিয়াতের নির্দেশ দেয়, তার আনুগত্য করোনা।’’[ কানযুল ওম্মাল ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২৯৩, ২৯৪, ২৯৫, ২৯৬, ২৯৯, ৩০১।]

৭. পদমর্যাদার দাবী ও লোভ নিষিদ্ধ
এটাও সে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিলো যে, সাধারনত রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণে পদ বিশেষত খেলাফতের জন্য সে ব্যক্তি বেশী অযোগ্যে-অনুপযুক্ত, যে নিজে পদ লাভের অভিলাষী এবং সে জন্য সচেষ্ট।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদে বলেনঃ
‘‘আখেরাতের ঘর আমি তাদেরকে দেবো, যারা জমিনে নিজের মহত্ত্ব খুঁজে বেড়ায়না, বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায়না।’’ [সূরা কাসাসঃ ৮৩]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
‘‘আল্লাহর শপথ, এমন কোনো ব্যক্তিকে আমরা এ সরকারের পদ মর্যাদা দেইনা, যে তা চায় এবং তার জন্য লোভ করে।’’[বুখারী কিতাবুল আহকাম, অধ্যায়-৭। মুসলিম কিতাবুল এমারত, অধ্যায়-৩।]
‘‘যে ব্যক্তি নিজে তা সন্ধান করে, আমাদের নিকট সে-ই সবচেয়ে বেশী খেয়ানতকারী।’’[ আবু দাউদ, কিতাবুল এমারাত, অধ্যায়-২]
‘‘আমরা এমন কোনো ব্যক্তিকে আমাদের সরকারী কর্মচারী হিসেবে গ্রহন করিনা, যে নিজে উক্ত পদের অভিলাষী।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড,হাদীস নং ২০৬।]
‘‘আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রাদিয়াল্লহু তায়ালা আনহুকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবদুর রহমান সরকারী পদ দাবী করোনা। কেননা চেষ্টা তদবীর করার পর যদি তা তোমাকে দেয়া হয়, তবে তোমাকে তার হাতে সঁপে দেয়া হবে, আর যদি চেষ্টা তদবীর ছাড়াই তা লাভ করো, তবে তার হক আদায় করার ব্যপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাকে সাহায্য করা হবে।’’[ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-২০৬।

৮. রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য
এ রাষ্ট্রের শাসক এবং তার সরকারের সর্ব প্রথম কর্তব্য এই সাব্যস্ত হয়েছিল যে, কোনো রকম পরিবর্তন-পরিবর্ধন ছাড়াই যথাযথভাবে সে ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করবে, ইসলামের চারিত্রিক মানদন্ডানুযায়ী ভালো ও সৎ-গুণাবলীর বিকাশ এবং মন্দ ও অসৎ গুনাবলীর বিনাশ সাধন করবে। কুরআন মাজীদে এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
‘‘[মুসলমান তারা] যাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, ভালো কাজের নির্দেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে বারণ করে।’’[সূরা হজ্জঃ৪১]
কুরআনের দৃষ্টিতে মুসলিম মিল্লাতের অস্তিত্বের মূল লক্ষও এটিই।
‘‘এমনি করে আমি তোমাদের একটি মধ্যপন্থী উম্মত [বা ভারসাম্যপূর্ণ পথে অবিচল উম্মাত] করেছি, যেনো তোমরা লোকদের উপর সাক্ষী হও আর রাসূল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর।’’[সূরা বাকারাঃ ১৪৩]
‘‘তোমরা যে সর্বোত্তম উম্মাত, মানুষের [সংশোধন এবং পথ প্রদর্শনের] জন্য যাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে, মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।’’
এতদ্ব্যতীত যে কাজের জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার পূর্বেকার সকল নবী-রাসূল আদিষ্ট ছিলেন, কুরআনের দৃষ্টিতে তা ছিলো এইঃ
‘‘দীন কায়েম করো এবং তাতে বিচ্ছিন্ন হয়োনা।’’ [সূরা শুরাঃ ১৩]
অমুসলিম বিশ্বের মুকাবিলায় তার সকল চেষ্টা সাধনাই ছিলো এ উদ্দেশ্যেঃ
‘‘দ্বীন যেনো সর্বতোভাবে আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত হয়ে যায়।’’ (সূরা আনফাল ৩৯)

৯. আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের অধিকার এবং কর্তব্য
এ রাষ্ট্রের সর্বশেষ মূলনীতি যা তাকে সঠিক পথে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দেয় তা ছিলো, মুসলিম সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি সত্যবাক্য উচ্চারণ করবে, নেকী ও কল্যানের সহায়তা করবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের যেখানেই কোনো ভুল এবং অন্যায় কার্য হতে কেখবে, সেখানেই তাকে প্রতিহত করতে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা করবে। মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্যের এটা শুধু অধিকারই নয়, অপরিহার্য কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদের নির্দেশ হচ্ছে, ‘‘নেকী এবং তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করো এবং গুনাহ ও অবাধ্যতার কাজে সাহায্য করোনা।’’ {সূরা মায়েদা ২} ঈমানদাররা! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। {আহযাব ৭০} ‘‘ঈমানদাররা! তোমরা সকলে ন্যায় বিচারে অটল অবিচল থাকো এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দাতা হও, তোমাদের সাক্ষ্য স্বয়ং তোমাদের নিজেদের বা তোমাদের পিতা মাতা বা নিকটাত্নীয়দের বিরুদ্ধে যাকনা কেন।’’ {সূরা নিসা ১৩৫}

এ ব্যাপারে নবী সা.-এর এরশাদ হলো, ‘‘তোমাদের কেউ যদি কোনো মুনকার {অসৎ কাজ} দেখে, তবে তার উচিত হাত দিয়ে তা প্রতিহত করা। তা যদি না পারে, তবে মুখ দ্বারা বারণ করবে, তাও যদি না পারে, তবে অন্তর দ্বারা {খারাপ জানবে এবং বারণ করার আগ্রহ রাখবে}, আর এটা হচ্চে ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অধ্যায় -২০ । তিরমিযী, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। আবু দাউদ; কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭ ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০।]

‘‘যালেম শাসকের সামনে ন্যায় {বা সত্য কথা} বলা সর্বোত্তম জিহাদ।’’ [আবু দাউদ, কিতাবুল মালাহেম, অধ্যায়-১৭। তিরমিযী, কিতাবুল ফিতান, অধ্যায়-১২। নাসায়ী, কিতাবুল বাইয়াত, অধ্যায়-৩৬। ইবনে মাজা, আবওয়াবুল ফিতান, অধ্যায়-২০]

‘‘যে ব্যক্তি কোনো শাসককে রাযী করার জন্য এমন কথা বলে, যা তার প্রতিপালককে নারাজ করে, সে ব্যক্তি আল্লাহর দীন থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছে।’’ [ কানযুল ওম্মাল, ৬ষ্ঠ খন্ড, হাদীস নং-৩০৯।]

খিলাফতে রাশেদা ও তার বৈশিষ্ট্য
নববী শাসনের মূলনীতির ওপর খিলাফতে রাশেদিনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজের স্থলাভিষিক্তের ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ সা. কোনো ফায়সালা না দিয়ে গেলেও ইসলাম একটি শুরাভিত্তিক খিলাফত দাবী করে, মুসলিম সমাজের সদস্যরা এ কথা অবগত ছিলো। তাই সেখানে কোনো বংশানুক্রমিক বাদশাহী প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বল প্রয়োগে কোনো ব্যক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়নি, খিলাফত লাভ করার জন্য কেউ নিজের তরফ থেকে চেষ্টা তদবীর করেনি বা নামমাত্র প্রচেষ্টাও চালায়নি। বরং জনগন তাদের স্বাধীন মর্জিমতো পর পর চারজন সাহাবীকে তাদের খলীফা নির্বাচিত করে। মুসলিম মিল্লাত এ খিলাফতকে খিলাফতে রাশেদা {সত্যাশ্রয়ী খিলাফত} বলে গ্রহন করেছে। এ থেকে আপনা আপনিই প্রকাশ পায় যে, মুসলমানদের দৃষ্টিতে এটিই ছিলো খিলাফতের সত্যিকার পদ্ধতি। এই শাসন ব্যবস্থা থেকেও আমরা কিছু মূলনীতি পাই।

১. নির্বাচনী খেলাফত
নবী সা.-এর স্থলাভিষিক্তের জন্য হযরত ওমর রা. হযরত আবু বকর রা.-এর নাম প্রস্তাব করেন। মদীনার লোকেরা {বস্তুত তখন তারা কার্যত সারা দেশের প্রতিনিধির মর্যাদার অভিষিক্ত ছিলো} কোনো প্রকার চাপ, প্রভাব এবং প্রলোভন ব্যতীত নিজেরা সন্তুষ্টচিত্তে তাঁকে পছন্দ করে তাঁর হাতে আনুগত্যের শপথ করেন।

হযরত আবুবকর রা. তাঁর ওফাতকালে হযরত ওমর রা. সম্পর্কে অসীয়াত লিখান, অতঃপর জনগনকে মসজিদে নববীতে সমবেত করে বলেন, ‘‘আমি যাকে স্থলাভিষিক্ত করছি তোমরা কি তার ওপর সন্তুষ্ট? আল্লাহর শপথ! সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য বুদ্ধি বিবেক প্রয়োগে আমি বিন্দুমাত্র ত্রুটি করিনি। আমার কোনো আত্মীয় স্বজনকে নয় বরং ওমর ইবনুল খাত্তাবকে আমার স্থলাভিষিক্ত করেছি। সুতরাং তোমরা তার নির্দেশ শুনবে এবং আনুগত্য করবে।’’ সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, আমরা তার নির্দেশ শুনবো এবং মানবো।[ আততাবারী-তারীখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬১৮। আল-মাতবায়াতুল ইস্তিকামা, কায়রো ১৯৩৯।]

মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় হযরত ওমর রা. বলেছেন, মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি কোনো আমীরের হাতে বাইয়াত করে, তার কোনো বাইয়াত নেই; এবং যার হাতে বাইয়াত করে, তারও কোনো বাইয়াত নেই। অপর এক বর্ননায় হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর এ বাক্যও দেখা যায়-পরামর্শ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে ইমারাত দেয়া হলে তা কবুল করা তার জন্য হালাল নয়। {ইবনে হাযার, ফাতহুল বারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠ-১২৫, আল-মাতবায়াতুল খাইরিয়া, কায়রো, ১৩২৫ হিজরী।]

হযরত ওমর রা. খিলাফতের ফায়সালা করার জন্য তার ওফাতকালে একটি নির্বাচন কমিটি গঠন করে বলেনঃ ‘মুসলমানদের পরামর্শ ব্যতীত যে ব্যক্তি জোর করে আমীর হওয়ার চেষ্টা করবে, তাকে হত্যা করো।’ খিলাফত যাতে বংশানুক্রমিক পদাধিকারে পরিণত না হয়, সে জন্য তিনি খিলাফত লাভের যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা থেকে নিজের ছেলের নাম সুস্পস্টভাবে বাদ দিয়ে দেন। [ আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯২। ইবনুল, আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৪-৩৫। ইদারাতুল তিবরাতিল মুনীরিয়া, মিসর, ১৩৫৬ হিজরী] ওমর রা. ছয় ব্যক্তিকে নিয়ে এ নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়।

কমিটির সদস্য আবদুর রহমান ইবনে আওফকে কমিটি শেষ পর্যন্ত খলিফার নাম প্রস্তাব করার ইখতিয়ার দান করে। সাধারণ লোকদের মধ্যে ঘোরাফেরা করে তিনি জানতে চেষ্টা করেন, কে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয়। হজ্জ শেষ করে যেসব কাফেলা বিভিন্ন এলাকায় ফিরে যাচ্ছিলো, তিনি তাদের সাথেও আলোচনা করেন। এ জনমত যাচাইয়ের ফলে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অধিকাংশ লোকই হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর পক্ষে।[ আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৯৬। ইবনুল আসীর, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৭ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৬।] তাই তাকেই খিলাফতের জন্য নির্বাচিত করা হয়। সাধারণ জনসমাবেশে তার বাইয়াত হয়।

হযরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর শাহাদাতের পর কিছু লোক হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে খলীফা করতে চাইলে তিনি বললেনঃ‘‘ এমন করার ইখতিয়ার তোমাদের নেই। এটা তো শুরার সদস্য এবং বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাজ। তারা যাঁকে খলীফা করতে চান, তিনিই খলীফা হবেন। আমরা মিলিত হবো এবং এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করবো।’’[ ইবনে কুতাইবা, আল-ইমামা ওয়াস সিয়াসা, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪১।] তাবারী হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, তা হচ্ছেঃ ‘‘ গোপনে আমার বাইয়াত অনুষ্ঠিত হতে পারেনা, তা হতে হবে মুসলমানদের মর্জী অনুযায়ী।’’[আততাবারী, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫০।]

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর ওফাতকালে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, আমরা আপনার পুত্র হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর হাতে বাইয়াত করবো? জবাবে তিনি বলেনঃ ‘‘ আমি তোমাদেরকে নির্দেশও দিচ্ছিনা, নিষেধও করছিনা। তোমরা নিজেরাই এ ব্যাপারে বিবেচনা করতে পারো।’’[ আততাবারী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১১২।

এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, খিলাফত সম্পর্কে খোলাফায়ে রাশেদীন এবং রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের সর্বসম্মত মত এই ছিলো যে, খিলাফত একটা নির্বাচন ভিত্তিক পদমর্যাদা। মুসলমানদের পারস্পরিক পরামর্শ এবং তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের মাধ্যমেই তা কায়েম করতে হবে। বংশানুক্রমিক বা বল প্রয়োগের দ্বারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া, কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব করা তাঁদের মতে খিলাফত নয় বরং তা সৈরতন্ত্র। খিলাফত এবং রাজতন্ত্রের যে স্পষ্ট ও দ্ব্যতহীন ধারনা সাহাবায়ে কিরামগণ পোষণ করতেন, হযরত আবু মুসা আশয়ারী হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তা ব্যক্ত করেন নিম্মোক্ত ভাষায়, ‘‘ইমারাত {অর্থাৎ খিলাফত} হচ্ছে তাই, যা প্রতিষ্ঠা করতে পরামর্শ নেয়া হয়েছে। আর তরবারীর জোরে যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হচ্ছে বাদশাহী বা রাজতন্ত্র।’’[ তাবকাতে ইবনে সা’দ, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-১১৩।]

২. শুরাভিত্তিক সরকার
এ খলীফা চতুষ্টয় সরকারের নির্বাহী এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে জাতির বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের অধিকারী ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ না করে কোনো কাজ করতেননা। সুনানে দারামীতে হযরত মাইমুন ইবনে মাহরানের একটি বর্ণনা আছে যে, হযরত আবু বকর রা.-এর নীতি ছিলো, তাঁর সামনে কোনো বিষয় উত্থাপিত হলে তিনি প্রথমে দেখতেন আল্লাহর কিতাব কি বলে। সেখানে কোনো নির্দেশ না পেলে এ ধরনের ব্যাপারে রাসূল সা. কী ফয়সালা দিয়েছেন, তা জানতে চেষ্টা করতেন। রসূলের সুন্নায়ও কোনো নির্দেশ না পেলে জাতীয় পরামর্শক্রমে যে মতই স্হির হতো, তদানুযায়ী ফায়সালা করতেন। [ সুনানে দারামী, বাবুল ফুতইয়া ওয়ামা ফীহি মিনাশ শিদ্দাহ।] হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর কর্মনীতিও ছিলো অনুরূপ। [ কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস-২২৮১। ] পরামর্শের ব্যাপারে খোলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টিভংগি ছিলো, শুরার সদস্যদের সম্পূর্ণ স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। এ ব্যাপারে ওমর রা. এক পরামর্শ সভার উদ্ধোধনী ভাষণে খিলাফতের পলিসি ব্যক্ত করেছেন এভাবে,
‘‘আমি আপনাদের যে জন্য কষ্ট দিয়েছি, তা এছাড়া আর কিছু নয় যে, আপনাদের কার্যাদির যে ভার আমার ওপর ন্যস্ত হয়েছে তা বহন করার কাজে আপনারাও আমার সঙ্গে শরীক হবেন। আমি আপনাদের মধ্যাকরই এক ব্যক্তি। আজ আপনারাই সত্যের স্বীকৃতি দানকারী। আপনাদের মধ্য থেকে যাদের ইচ্ছা, আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন; আবার যাদের ইচ্ছা আমার সাথে একমতও হতে পারেন। আপনাদের যে আমার মতামতকে সমর্থন করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই এবং আমি তা চাই-ও না।‘‘[ ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-২৫।]

৩. বাইতুল মাল একটি আমানত
খুলাফায়ে রাশেদিনরা বাইতুলমালকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানত মনে করতেন। বেআইনীভাবে বাইতুলমালের মধ্যে কিছু প্রবেশ করা ও বেআইনীভাবে তা থেকে কিছু বের হয়ে যাওয়াকে তারা জায়েয মনে করতেননা। শাসক শ্রেণীর ব্যক্তিগত স্বার্থে বাইতুলমাল ব্যবহার তাদের মতে হারাম ছিলো। তাদের মতে খিলাফত এবং রাজতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্যৈই ছিলো এই যে, রাজা বাদশাহরা জাতীয় ভান্ডারকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে নিজেদের খাহেশ মতো স্বাধীনভাবে তাতে তসরুফ করতো, আর খলীফা তাকে আল্লাহ এবং জনগণের আমানত মনে করে সত্য ন্যায় নীতি মোতাবেক এক একটি পাই পয়সা উসূল করতেন, আর তা ব্যয়ও করতেন সত্য ন্যায় নীতি অনুসারে। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একদা হযরত সালমান ফারসীকে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘‘ আমি বাদশাহ, না খলীফা?’’ তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দেনঃ ‘‘মুসলমানদের ভূমি থেকে আপনি যদি এক দিরহামও অন্যায়ভাবে উসূল এবং অন্যায়ভাবে ব্যয় করেন তাহলে আপনি খলীফা নন; বাদশা।’’

৪. রাষ্ট্রের ধারণা
রাষ্ট্র সম্পর্কে খুলাফায়ে রাশেদিনের ধারণা কী ছিলো? রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নিজের মর্যাদা এবং কর্তব্য সম্পর্কে তারা কী ধারনা পোষণ করতেন, স্বীয় রাষ্ট্রে তারা কোন্ নীতি মেনে চলতেন? খিলাফতের মঞ্চ থেকে ভাষণ দান প্রসঙ্গে তাঁরা নিজেরাই প্রকাশ্যে এসব বিষয় ব্যক্ত করেছেন। মসজিদে নববীতে গণ বাইয়াত ও শপথের পর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে আপনাদের শাসক নিযুক্ত করা হয়েছে। অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন ন্যস্ত, আমি নিজে ইচ্ছা করে এ পদ গ্রহণ করিনি। অন্যের পরিবর্তে আমি নিজে এ পদ লাভের চেষ্টাও করিনি, এজন্য আমি কখনো আল্লাহর নিকট দোয়াও করিনি। এজন্য আমার অন্তরে কখনো লোভ সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ এবং আরবদের মধ্যে ধর্ম ত্যাগের ফেতনার সূচনা হবে- এ আশংকায় আমি অনিচ্ছা সত্বে এ দায়িত্ব গ্রহন করেছি। এ পদে আমার কোনো শান্তি নেই। বরং এটা এক বিরাট বোঝা, যা আমার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ বোঝা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। অবশ্য আল্লাহ যদি আমাকে সাহায্য করেন। আমার ইচ্ছা ছিলো, অন্য কেউ এ দায়িত্বভার বহন করুক।

এখনোও আপনারা ইচ্ছা করলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে হতে কাউকে এ কাজের জন্য বাছাই করে নিতে পারেন। আমার বাইয়াত এ ব্যাপারে আপনাদের প্রতিবন্ধক হবেনা। আপনারা যদি আমাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানদন্ডে যাচাই করেন, তবে তার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ, তিনি শয়তান থেকে নিরাপদ ছিলেন, তাঁর ওপর ওহী নাযিল হতো। আমি সঠিক কাজ করলে আমার সহযোগিতা করবেন, অন্যায় করলে আমাকে সোজা করে দেবেন। সততা হচ্ছে একটি আমানত। আর মিথ্যা একটি খেয়ানত। তোমাদের দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট সবল। আল্লাহর ইচ্ছায় যতক্ষণ আমি তার অধিকার তাকে দান না করি।

আর তোমাদের মধ্যকার সবল ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল-যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তার কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে না পারি। কোনো জাতি আল্লাহর রাস্তায় চেষ্টা সাধনা ত্যাগ করার পরও আল্লাহ তার ওপর অপমান চাপিয়ে দেননি-এমনটি কখনো হয়নি। কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করার পর আল্লাহ তাদেরকে সাধারণ বিপদে নিপতিত করেননা-এমনও হয়না। আমি যতক্ষণ আল্লাহ্ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুগত থাকি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। আমি আল্লাহ্ ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হলে আমার ওপর তোমাদের কোনো আনুগত্য নেই। আমি অনুসরণকারী, কোনো নতুন পথের উদ্ভাবক নই।’’[ আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫০। ইবনে হিশাম, আস সীরাতুন নববিয়্যা, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩১১, মাতবায়াতু মুস্তফা আল-বাবী, মিসর-১৯৩৬, কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং-২২৬১, ২২৬৪, ২২৬৮, ২২৭৮, ২২৯১, ২২৯৯। ] প্রায় একইরূপ কথা বলেছেন অন্যান্য খলীফারা।

৫. আইনের প্রাধান্য
এ খলীফারা নিজেদেরকে কখনোই আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতেননা। বরং আইনের দৃষ্টিতে নিজেকে এবং দেশের একজন সাধারন নাগরিককে {সে মুসলমান হোক বা অমুসলিম যিম্মি} সমান মনে করতেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁরা নিজেরা বিচারপতি {কাযী} নিযুক্ত করলেও খলীফাদের বিরুদ্ধে রায় দানে তারা ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাধীন, যেমন স্বাধীন ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যাপারে।

৬. বংশ-গোত্রের পক্ষপাতমুক্ত শাসন
ইসলামের প্রাথমিক যুগের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, ইসলামের নীতি এবং প্রাণশক্তি অনুযায়ী তখন বংশ গোত্র দেশের পক্ষপাতের উর্ধ্বে উঠে সকল মানুষের সাথে সমান আচরণ করা হতো, কারো সাথে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব করা হতোনা। আল্লাহর রসূলের ওফাতের পরে আরবের গোত্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নবুয়্যতের দাবীদারদের অভ্যুদয় এবং ইসলাম ত্যাগের হিড়িকের মধ্যে এ উপাদান ছিলো সবচেয়ে ক্রিয়াশীল। খুলাফায়ে রাশেদিনরা গোত্রবাদকে কখনোই প্রশ্রয় দিতেন না। গোত্রের লোকদের প্রশ্রয় দিতে গিয়েই ইসলামী খিলাফত ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

৭. গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি
সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাই ছিলো এ খিলাফতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরাজির অন্যতম। খলীফারা সবসময় জনগনের নাগালের মধ্যে থাকতেন। তাঁরা নিজেরা শুরার অধিবেশনে বসতেন এবং আলোচনায় অংশ গ্রহন করতেন। তাঁদের কোনো সরকারী দল ছিলোনা। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো দলের অস্তিত্ব ছিলোনা। মুক্ত পরিবেশে সকল সদস্য নিজ নিজ ঈমান এবং বিবেক অনুযায়ী মত প্রকাশ করতেন। চিন্তাশীল, উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সামনে সকল বিষয় যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা হতো। কোনো কিছুই গোপন করা হতোনা। ফায়সালা হতো দলীল প্রমানের ভিত্তিতে, কারোর দাপট, প্রভাব প্রতিপত্তি, স্বার্থ সংরক্ষণ বা দলাদলির ভিত্তিতে নয়। কেবল শুরার মাধ্যমেই খলীফারা জাতির সম্মুখে উপস্থিত হতেননা; বরং দৈনিক পাঁচবার সালাতের জামায়াতে, সপ্তাহে একবার জুময়ার জামায়াতে এবং বৎসরে দুবার ঈদের জামায়াতে ও হজ্জের সম্মেলনে তাঁরা জাতির সামনে উপস্থিত হতেন। অন্যদিকে এসব সময় জাতিও তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতো। তাঁদের নিবাস ছিলো জনগণের মধ্যেই। কোনো দারোয়ান ছিলোনা তাঁদের গৃহে। সকল সময় সকলের জন্য তাঁদের দ্বারা খোলা থাকতো। তাঁরা হাট বাজারে জনগণের মধ্যে চলাফেরা করতেন। তাঁদের কোনো দেহরক্ষী ছিলোনা, ছিলোনা কোনো রক্ষী বাহিনী। এসব সময়ে ও সুযোগে যে কোনো ব্যক্তি তাঁদের প্রশ্ন করতে, সমালোচনা করতে ও তাঁদের নিকট থেকে হিসেবে চাইতে পারতো। তাঁদের নিকট থেকে কৈফিয়ত তলব করার স্বাধীনতা ছিলো সকলেরই। এ স্বাধীনতা ব্যবহারের তাঁরা কেবল অনুমতিই দিতেননা বরং এজন্য লোকদেরকে উৎসাহিতও করতেন।

আমরা দুটি শাসন ব্যবস্থার মূলনীতিগুলোকে সামনে রেখে একটি সমাজ কায়েম করতে চাই যাকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফত রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করছি। অনেকে এই বিষয়গুলোকে অলীক বা কল্পনাবিলাস বলতে চান। তারা বলতে চান আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে এই ধরণের শাসনব্যবস্থা চালু করা অবাস্তব। আসলে সবকিছুই নির্ভর করে নিয়ত, যোগ্যতা ও ক্ষমতার উপর। আমরা এই মূলনীতিগুলোকে ধারণ করি ও প্রতিষ্ঠা করতে চাই বিধায় আমরা আমাদের জামায়াতের গণ্ডির মধ্যে তা কায়েম করেছি। আলহামদুলিল্লাহ। একইভাবে আল্লাহ চাহে তো আমরা আরো বড় পরিসরে এই শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে পারবো। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। আপনিও আসুন, আমাদের সাথে শরিক হোন। আপনার উপর আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত ফরয দায়িত্ব পালন করুন।

প্রবন্ধটি মাওলানা মওদূদীর ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান বই থেকে সংকলন করা হয়েছে। 

২৪ সেপ, ২০১৯

মাওলানা আবদুর রহীম কেন জামায়াত ছেড়েছেন?

মাওলানা আব্দুর রহীম

মাওলানা আব্দুর রহীম কেন জামায়াত ত্যাগ করেছেন?

সময়টা ১৯৭৬ সাল। শেখ মুজিবের ভূমিধ্বস পতনে এদেশের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সবচেয়ে বেশি উপকার হয় ৭১ সালের পরাজিত শক্তি এদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর। ১৯৭২ সালে মুজিব সবগুলো ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ করে দেয়। এর মধ্যে একমাত্র জামায়াত ছাড়া আর কেউই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সমর্থ হয়নি। দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো যথাক্রমে নেজামে ইসলামী পার্টি, খেলাফতে রব্বানী ও জামায়াতে ইসলামী।

চার-পাঁচ বছর নিষিদ্ধ থাকার পর দেখা গেলো দলগুলো নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে একমাত্র জামায়াত ছাড়া। জামায়াত ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন হওয়া এবং রাজনীতির বাইরে লোক তৈরির এজেন্ডা থাকায় তারা গোপনে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বেগ পেতে হয়নি।

মুজিবের পতনের পর ইসলামী দলগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে উঠে জামায়াত। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই তাদের কার্যক্রম অব্যাহত ছিলো। জামায়াতের গোপনে তাদের প্রতিটি ইউনিটকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে নেজামে ইসলামী ছিলো আলেম ওলামা ভিত্তিক রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বাইরে দাওয়াত, লোক গঠন বা ইসলামী আদর্শের জন্য লোক প্রস্তুতির কোনো এজেন্ডা তাদের ছিলো না। ফলশ্রুতিতে দেখা গেলো মুজিবের পতনের পর তাদের কোনো কর্মী আর অবশিষ্ট নেই।

আবার খেলাফতে রব্বানী ছিলো জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের সংগঠন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে তারা প্রচুর সেমিনার ও পাঠচক্র করতেন। কিন্তু ইসলামের জন্য জীবন দেয়ার উপযোগী লোক তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ায় তারাও কর্মীশূন্য হয়ে পড়ে। তারা ইসলামী কম্যুনিজম নামে একটি জগাখিচুড়ী টাইপের আদর্শ দাঁড় করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।

এবার ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের (IDL) প্রসঙ্গে আসা যাক। মাওলানা আব্দুর রহীম ছিলেন এর রূপকার। ১৯৭৬ সালে মে মাসে সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ধর্মীয় রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ঐ বছরই আগস্ট মাসে আইডিএল গঠিত হয়।

১৯৭৬ সালের ২৪ আগষ্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেযামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (IDL) নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গড়ে তোলেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ছিলো নিম্নরূপ।

চেয়ারম্যান - মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (নেজামে ইসলাম)
ভাইস চেয়ারম্যান - মাওলানা আব্দুর রহীম (জামায়াত)
ভাইস চেয়ারম্যান - এড. সা'দ আহমদ (জামায়াত)
ভাইস চেয়ারম্যান - মাওলানা আব্দুস সুবহান (জামায়াত)
সেক্রেটারি - এড. শফিকুর রহমান (ডেমোক্রেটিক পার্টি)

(সা'দ আহমদ ছিলেন কুষ্টিয়ার জামায়াত নেতা। এর আগে তিনি মুসলিম লীগ, অতঃপর আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ৬২ সালে কারাবরণের সময় তিনি সেখানে জামায়াত নেতাদের সাক্ষাত লাভ করেন। মাওলানা মওদূদীর বইগুলো তার চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনে। অবশেষে ১৯৬৬ সালে তিনি জামায়াতে যোগ দেন। ৭১-এ তিনি কট্টর স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন। এই কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়। তিনি একটি বই লিখেন মুজিবের কারাগারে পৌনে সাতশ দিন। ইতিহাস অনুসন্ধানীদের জন্য বইটি পড়া আবশ্যক।)

এর মধ্যে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জামায়াত আইডিএলের ব্যানারে অংশগ্রহণ করে। আইডিএল ২০ টি আসন লাভ করে। এর মধ্যে জামায়াতের ছিলো ৬ জন। যাই হোক আইডিএলের সাফল্য আইডিএলের নেতাদের ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করে।

সেই ছয়জন হলেন,
১। মাওলানা আবদুর রহীম, এম.এম (বরিশাল)
২। অধ্যাপক সিরাজুল হক, এম.এ (কুড়িগ্রাম)
৩। মাওলানা নুরুন্নবী ছামদানী, এম.এম (ঝিনাইদহ)
৪। মাষ্টার মোঃ শফিক উল্লাহ, বি.এ বিএড (লক্ষ্মীপুর)
৫। এএসএম মোজাম্মেল হক, আলিম (ঝিনাইদহ)
৬। অধ্যাপক রেজাউল করিম, এম.এ (গাইবান্ধা)

মাওলানা আব্দুর রহীম ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আমলে মাওলানা আব্দুর রহীম ১৩ বছর পূর্ব পাকিস্তানের আমীর ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি নিখিল পাকিস্তানের নায়েবে আমীর মনোনীত হন। আর এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের আমীর হন অধ্যাপক গোলাম আযম। ১৯৭১-এ পট পরিবর্তনের ফলে মাওলানা আব্দুর রহীম আর এদেশে আসতে পারেননি। আর তাছাড়া তিনি নায়েবে আমীরের দায়িত্বও পালন করছিলেন।

১৯৭৪ সালে তিনি পাকিস্তান জামায়াত থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজ দেশ বাংলাদেশে ফিরে আসেন ও বাংলাদেশ জামায়াতে যোগ দেন। তখন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান। জামায়াত আন্ডারগ্রাউন্ডে একটিভ ছিলো। পরের বছর মাওলানা আব্দুর রহীম আমীর নির্বাচিত হন ও দুই বছর আন্ডারগ্রাউন্ড জামায়াতের আমীর ছিলেন।

১৯৭৬ সালে মাওলানা আব্দুর রহীম জামায়াতের হয়ে আইডিএল গঠন করেন। আইডিএল কোনো দল ছিলো না, এটি ছিলো একটি জোট। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সুবাদে জামায়াত আবারো প্রকাশ্যে কাজ করার চেষ্টা শুরু করে।

১৯৭৯ সালে জামায়াত আবার প্রকাশ্যে সংগঠন ও রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উপলক্ষে ইডেন হোটেলে তিনদিনব্যাপী রুকন সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। রুকন সম্মেলনে নানান বিষয়ে চুলছেরা বিশ্লেষণ শেষে জামায়াত রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর একদিন সংগ্রাম অফিসে অধ্যাপক গোলাম আযমের উপস্থিতিতে এড. সা'দ আহমদ বলেন, জামায়াত ও আইডিএল দুইটি প্রতিষ্ঠানই রাজনীতির ময়দানে থাকলে বিভ্রান্তি হতে পারে। জামায়াত এই ক'বছর যেভাবে আমাদের চার দফার তিন দফা নিয়ে কাজ করেছে সেভাবে লোক তৈরির কাজ করে যাওয়া উচিত। আর রাজনীতি আইডিএলের মাধ্যমেই হওয়া দরকার। গোলাম আযম বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, কিছুদিন আগে সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তার বাইরে এখন নতুন কথা গ্রহনযোগ্য হবে না। তখন সা'দ আহমদ বলেছেন, আমাকে রুকন সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিলে আমি এই বিষয়টি নিয়ে রুকনদের কনভিন্স করতে পারতাম।

এডভোকেট সা'দ আহমদ বিষয়টি নিয়ে নানা স্থানে বলছেন। প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও গোলাম আযম এই বিষয়কে গুরুত্ব দিলেন। তিনি একান্তে মাওলানা আব্দুর রহীমকে বললেন, সা'দ ভাইকে থামানো উচিত। এর প্রেক্ষিতে মাওলানা আব্দুর রহীম সা'দ আহমদ সাহেবের কথার পক্ষেই যুক্তি দিলেন। গোলাম আযম এটিকে সিরিয়াস সাংগঠনিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে দ্রুত এর সমাধান চাইলেন। তিনি কর্মপরিষদের মিটিং ডাকলেন।

১২ জন কর্মপরিষদের মধ্যে ১০ জন সা'দ আহমদ সাহেবের প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেন। বাকী মাওলানা আব্দুর রহীম ও পাবনার মাওলানা আব্দুস সুবহান প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন। এই নিয়ে উভয়পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হলো। এর প্রেক্ষিতে কর্মপরিষদ শুরা সদস্যদের মতামত নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো।

তখন রমজান মাস চলছিল। দুই মাস আগে রুকন সম্মেলন হয়ে গেল। এর মধ্যে এখন সারাদেশ থেকে শুরা সদস্যদের ঢাকায় আসার ঘোষণায় অনেকেই অবাক হয়েছিল। কিন্তু শুরা মিটিং-এ যোগ দিয়ে তারা এর গুরুত্ব অনুধাবন করলেন। এডভোকেট সা'দ আহমদ শুরা মেম্বার না হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু তিনি এই প্রস্তাব অনানুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করে দুইজন কর্মপরিষদকে কনভিন্স করেছেন তাই তাঁকে শুরার সম্মেলনে দাওয়াত দেওয়া হয়।

শুরার সদস্য ছিল ৪২ জন। এর মধ্যে মাস্টার শফিকুল্লাহ অসুস্থ থাকায় হসপিটালে ছিলেন। শুরায় প্রথমেই সা'দ আহমদ সাহেব তাঁর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তিনদিন ধরে শুরার অধিবেশন চলে। যাদের কথা ছিল তারা কথা বলেন। সবশেষে দেখা গেল শুরার মধ্যে মাওলানা আব্দুর রহীম ও মাওলানা আব্দুস সুবহান ছাড়া বাকি সবাই রুকন সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ওপর ইস্তেকামাত ছিলেন।

মাস্টার শফিকুল্লাহর মতামত হাসপাতালে গিয়ে নেওয়া হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় আগের সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে। গোলাম আযম ইতেকাফে যান। সেখানে থেকেই মাওলানা আব্দুর রহীমকে রিকোয়েস্ট করে চিঠি লিখেন তিনি যাতে শুরার সিদ্ধান্ত মেনে নেন। মাওলানা আব্দুর রহীম মসজিদে এসে গোলাম আযমের সাথে দেখা করেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে মাওলানা তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন।

দুইজন বাদে বাকী শুরা সদস্যদের মতামত ছিল, আইডিএল থাকবে জোট হিসেবে (যেভাবে আছে)। আর জামায়াত তার নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হবে। জামায়াতের এজেন্ডা কখনোই আইডিএলে বাস্তবায়ন করা যাবে না। অতএব শুরায় জামায়াত নিজ নামে কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ শুরা মেম্বার মত দেন।

জামায়াতের শুরার এই মতামত মেনে নিতে পারেননি মাওলানা আব্দুর রহীম। ওনার সহযোগী হিসেবে ছিলেন এড. সা'দ আহমদ, মাওলানা আব্দুস সুবহান এবং আরো কয়েকজন রুকন। এভাবেই তিনি জামায়াত থেকে চলে যান। তিনি ভেবেছেন আইডিএলের মাধ্যমে সহজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

ইদানিং অনলাইনে বিভিন্ন লেখকের লেখায় দেখলাম বলা হচ্ছে মাওলানা আব্দুর রহীম জামায়াতের কর্মকান্ড ও লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে বিরোধ করে বেরিয়ে গেছেন। অনেকে বলছেন মাওলানা মওদূদীর সাথে বিরোধে জড়িয়ে জামায়াত ত্যাগ করেছেন। অনেকে বলেন গণতন্ত্র ইস্যুতে বের হয়েছেন। এগুলো সঠিক নয়। উনি জামায়াত থেকে বের হয়েও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও নির্বাচন করেছেন।

আবার কেউ কেউ শহীদ অধ্যাপক গোলাম আযমের চরিত্র হনন করে বলতে চান মাওলানাকে অধ্যাপক সাহেব জামায়াত থেকে বের করে দিয়ে তাঁর অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ সবই অবান্তর, বিদ্বেষপ্রসূত ও অজ্ঞতাপ্রসূত।

২২ সেপ, ২০১৯

বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ.


সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী চিন্তাবিদ, মুজাদ্দিদ ও দার্শনিক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি জামায়াতে ইসলামী নামে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম স্কলারদের মধ্যে একজন। তিনি ইতিহাসের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ব্যক্তি যার গায়েবানা জানাজার নামাজ পবিত্র কাবাতে পড়া হয়।

জন্ম : 
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে ভারতের হায়দরাবাদ দাক্ষিণাত্যের শহর আওরঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তার বাবা মাওলানা আহমদ হাসান এর তিন সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর পিতা ছিলেন চিশতি ধারার বংশধর। তাঁর পিতা ও মাতা উভয়ের পরিবার আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন। 

শিক্ষা ও ক্যারিয়ার : 
শৈশবে নয় বছর পর্যন্ত মওদূদীকে গৃহশিক্ষা দেওয়া হয়, তিনি তার পিতার হাতে এবং তার দ্বারা নিযুক্ত বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। এই শিক্ষার মধ্যে ছিল আরবি, ফারসি, ইসলামী আইন ও হাদীস শিক্ষা। তিনি মানতিক (যুক্তিবিদ্যা) বইগুলিও অধ্যয়ন করেন। এগারো বছর বয়সে তিনি আরবি থেকে উর্দু ভাষায় কাশিম আমিনের আল মারহা আল-জাদিদাহ অনুবাদ করেছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি দিল্লির মাওলানা আব্দুস সালাম নিয়াজির কাছে আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ শিক্ষা গ্রহণ করেন। মাওলানা মওদূদী ১৯২৬ সালে দিল্লির 'দারুল উলুম ফতেহপুরি' থেকে 'উলুম-এ-আকালিয়া ওয়া নাকালিয়া' সনদ লাভ করেন। ১৯২৮ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে 'জামে তিরমিযি' এবং 'মুয়াত্তা ইমাম মালিক' সনদ লাভ করেন।

ছোটবেলা থেকেই মাওলানা সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার তৈরি করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বিজনোরের একটি পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯২০ সালে 'তাজ' পত্রিকার এডিটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯২১ সালে 'দৈনিক মুসলিম' পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ১৯২৫ সালে 'আল জামিয়াহ' পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এটি ছিলো মুসলিমদের জনপ্রিয় পত্রিকা। ১৯৩৩ সালে ভারতের হায়দারাবাদ থেকে নিজেই 'তরজুমানুল কুরআন' নামক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি তার চিন্তা প্রচার করতে শুরু করেন। 

জামায়াত প্রতিষ্ঠা : 
২৬ আগস্ট ১৯৪১ সাল। পাক-ভারত বাংলা তথা গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশের কিছু বিশিষ্ট লোক, যারা আগে থেকেই মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.)-এর অতীব জ্ঞানগর্ভ লেখায় প্রভাবিত ছিলেন এবং তার সম্পাদনাধীন মাসিক ‘তারজুমানুল কুরআন'-এর মাধ্যমে তার চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি  এ ব্যক্তিত্বের চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ অবহিত, তারই আহবানে তারা লাহোরে সমবেত হন। ঐ সভাতেই ‘জামায়াতে ইসলামী' নামক একটি ছোট্ট সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েক বছর ধরে মাওলানা মওদূদীর ব্যক্তিগত বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেই দলটি চলতে থাকে।

তখন খোদ বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ ও এই সংগঠনের চালিকা শক্তিরূপে কাজ করে। মাওলানা মওদূদী (রহ.) এবং কবি আল্লামা ইকবালের মধ্যে কি গভীর সম্পর্ক ছিল এ থেকেই তা অনুমেয় যে, জামায়াতে ইসলামীর প্রথম কেন্দ্রটি পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট সংলগ্ন ‘দারুল ইসলাম' নামক একটি বস্তি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা মওদূদীই জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসের জন্যে দারুল ইসলামকে বেছে নেন। দারুল ইসলামের এ ভূমিটি ছিল পাঞ্জাবের জনৈক জমিদার মরহুম চৌধুরী নিয়াজ আলীর তিনি আল্লামা ইকবালকে এই লক্ষ্যে কমিটি প্রদান করেছিলেন, যেন কবি ইসলামী কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে তা ব্যবহার করেন। আল্লামা ইকবাল মাওলানা মওদূদীকে (রহ.) এই মর্মে আহবান জানালেন, তিনি যেন এখানে একটি ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করেন। 

ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন : 
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এই কথা বলে প্রচার চালিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ হাতে পেলে তাঁরা দেশটিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। এতে সাধারণ মুসলিম তাদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাবার পর তারা সেইসব কথা ভুলে যেতে থাকেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা। 

১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।
দফাগুলো হচ্ছে
১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।
এইভাবে জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে। আরো জানতে ক্লিক করুন। 

কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার আন্দোলন :
১৯৫৩ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাজলিসে আহরার, জমিয়তে আহলে হাদীস, মুসলিম লীগ, আনজুমানে তাহাফ্ফুযে হুকুকে শিয়া প্রভৃতি দল করাচিতে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়। জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাব করে যে কাদিয়ানী ইস্যুটিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে নেওয়া হোক। সেই সম্মেলনে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হলো না।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদের মিটিং ডাকা হয়। এই মিটিংয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনের’ পক্ষে প্রবল মত প্রকাশ পায়। জামায়াতে ইসলামী গোড়া থেকেই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলো বিধায় ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশনের’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসে।

১৯৫৩ সনের মার্চ মাসে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কতিপয় দলের ডাইরেক্ট এ্যাকশনের ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই অবনতি পাঞ্জাবেই ঘটেছিলো বেশি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মার্শাল ল’ ঘোষণা করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যায়।

মাওলানা মওদুদীর গ্রেফতার ও ফাঁসির আদেশ : 
যদিও ডাইরেক্ট এ্যাকশনের বিপক্ষে ছিল জামায়াত তারপরও ১৯৫৩ সনের ২৮শে মার্চ মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার, সামরিক ট্রাইব্যুনাল ১৯৫৩ সনের ৮ই মে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদীকে ফাঁসির হুকুম দেয়। জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি এবং সকল শ্রেণীর ইসলামী ব্যক্তিত্ব এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ আন্দোলনে নেমে পড়ে। ফলে সরকার মৃত্যুদণ্ড রহিত করে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীর চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা ঘোষণা করে।

তবে দুই বছর একমাস জেলে থাকার পর ১৯৫৫ সনের ২৯শে এপ্রিল সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী মুক্তি লাভ করেন। তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্তের আসল লক্ষ্য ছিলো ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠতম কণ্ঠটিকে স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ছিলো ভিন্ন। তিনি মুক্তি পান। আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গণদাবির মুখে গণপরিষদ ১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্রুয়ারি একটি শাসনতন্ত্র পাস করে।

শাসনতন্ত্র বাতিল ও পুনরায় আন্দোলন : 
১৯৫৮ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান সরকারের প্রতি আস্থা ভোটের জন্য পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে। অধিবেশনে স্পিকার আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়। স্পিকারের দায়িত্ব লাভ করেন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী। পরিষদে হট্টগোল চলতে থাকে। উত্তেজিত সদস্যদের আঘাতে শাহেদ আলী পাটোয়ারী মারাত্মক আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি হাসপাতালে মারা যান।

১৯৫৮ সনের ৭ই অকটোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার আলী মির্যা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদসমূহ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলো ভেঙ্গে দেন। নয় বছরের চেষ্টাসাধনার ফসল শাসনতন্ত্রটি বাতিল করে দেন।

প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত হন সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খান। ২৭ অক্টোবর আইউব খান প্রেসিডেন্ট পদটিও দখল করেন। চলতে থাকে এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন। ১৯৬২ সনের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান দেশের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র জারি করেন। এটি না ছিলো ইসলামিক, না ছিলো গণতান্ত্রিক। এতে বিধান রাখা হয়, দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’দের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। আর ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হবেন পূর্ব পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন। অর্থাৎ ৮০ হাজার ব্যক্তি ছাড়া দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।এই আজগুবী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলে জামায়াতে ইসলামী।

১৯৬২ সনে রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এতে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ক্ষেপে যান। তাঁরই নির্দেশে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে। আমীরে জামায়াত সহ মোট ৬০ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।

বন্দিদের মধ্যে ছিলেন- আমীরে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, নাঈম সিদ্দিকী, নাসরুল্লাহ খান আযিয, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মাদ, মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ, মাওলানা আবদূর রহীম, অধ্যাপক গোলাম আযম, জনাব আবদুল খালেক, ইঞ্জিনিয়ার খুররম জাহ মুরাদ, অধ্যাপক হেলালুদ্দীন, মাস্টার শফিকুল্লাহ, মাওলানা এ.কিউ.এম. ছিফাতুল্লাহ, অধ্যাপক ওসমান রময্, মাস্টার আবদুল ওয়াহিদ (যশোর), আবদুর রহমান ফকির, জনাব শামসুল হক, মাওলানা মীম ফজলুর রহমান প্রমুখ।

জনাব আব্বাস আলী খান, জনাব শামসুর রহমান ও মাওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন বিধায় গ্রেফতার হননি। এবারও জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি উচ্চমানের ধৈর্যের উদাহরণ পেশ করেন।

জামায়াতে ইসলামী সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। স্বনামধন্য আইনজীবী মি. এ.কে. ব্রোহীর নেতৃত্বে একটি টিম মামলা পরিচালনা করে। পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। ১৯৬৪ সনের ৯ই অকটোবর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ : 
১৯৬৪ সনের ২০শে জুলাই ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইউব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই জোটের নাম দেওয়া হয় ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’। এতে শরীক ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নেযামে ইসলাম পার্টি।

১৯৬৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ ১৯৬৫ সনের ২রা জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউব খানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মি. মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহকে নমিনেশন দেয়।

এই সময় জামায়াতে ইসলামী ছিলো বেআইনী ঘোষিত। নেতৃবৃন্দ ছিলেন জেলখানায়। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মাজলিসে শূরার যেইসব সদস্য জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা ১৯৬৪ সনের ২ অক্টোবর একটি মিটিংয়ে একত্রিত হন। ‘আলোচনান্তে মাজলিসে শূরা অভিমত ব্যক্ত করে যে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা সমীচীন নয়। কিন্তু এখন দেশে চলছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা। স্বৈরশাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে মিস ফাতিমা জিন্নাহর কোন বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় সার্বিক অবস্থার নিরিখে জামায়াতে ইসলামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতিমা জিন্নাহকেই সমর্থন করবে।’

স্বৈরাচারী আইয়ুবের কবলে জামায়াতে ইসলামী : 
আইয়ুবের শাসনামলে জামায়াতের আমীর মাওলানা মওদূদীকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৬৪ সালে জাময়াতে ইসলামীকে হঠাৎ বেআইনী ঘোষণা করা হলো। জামায়াতে ইসলামী ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের দাবিতে সমগ্র দেশব্যাপী স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করে। এ অভিযানের ফলে মৌলিক অধিকারের দাবি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আইনের খসড়া বিল পরিষদে গৃহীত হওয়া সত্ত্বে ও প্রেসিডেন্ট ইচ্ছাপূর্বক তাতে স্বাক্ষর দিতে বিলম্ব করেন। 

১৯৬৪ সালের ৬ই জানুয়ারী জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নেতাদের গ্রেফতার করে তারপর ১০ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট উক্ত বিলে স্বাক্ষর করে। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তার এ পদক্ষেপও জামায়াতকে খতম করতে সক্ষম হয়নি। হাইকোর্ট জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারী এবং সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিষিদ্ধকরণের নিদের্শকে বাতিল ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৫৮ সালেও সামরিক আইনে জামায়াত ৪৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলো। 

ইসলামী সাহিত্য : 
মাওলানা মওদূদী ইসলামকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য বহু গ্রস্থ রচনা করেছেন। তিনি প্রথম একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন ১৯২৭ সালে, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২৪ বছর। আল জিহাদ ফিল ইসলাম ছিলো বইটির নাম। তিনি কুরআন, হাদীস, ইসলামী জীবন ও দর্শন, আইন, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা, ইসলামী আন্দোলন, অর্থনীতি, ব্যাংক ব্যবস্থা, দাম্পত্য জীবন, তাজকিয়ায়ে নফস, সীরাত ইত্যাদি বিষয়ে শতাধিক বই রচনা করেন। তার বড় অবদান ছিলো তিনি তাফহীমুল কুরআন রচনা করেছেন। এই তাফসীর গ্রন্থ তিনি প্রায় তিরিশ বছর ধরে রচনা করেন। তার সর্বশেষ গ্রন্থ সীরাতে সরওয়ারে আলম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। 

শেষ জীবন : 
মাওলানা মওদূদী ১৯৭২ সালে জামায়াতের আমীরের পদ থেকে ইস্তফা দেন। এই বছরেই তিনি তাফহীমুল কুরআন রচনা শেষ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাকিস্তান থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়। সেখানেই ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ সালে ইন্তেকাল করেন যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী। সারা পৃথিবীতে বহুস্থানে এমনিকি কা'বার সামনে তার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। লাহোরে বিশাল জানাজা শেষে সেখানেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। 

২১ সেপ, ২০১৯

বঙ্গকথা পর্ব-১৬ : বাংলায় আফগানীদের শাসন

সুরি সাম্রাজ্যের মানচিত্র
শের শাহ সুর ১৫৩৮ সালে ৬ এপ্রিল সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহকে পরাজিত করে বাংলা দখল করে নেন। সেই থেকে বাংলায় স্বাধীন সুলতানী আমলের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং একই সাথে বাংলায় আফগানদের শাসন শুরু হয়। সেই থেকে শুরু করে ১৫৭৬ সালে দাউদ খান কররানী মোগলদের হাতে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত বাংলায় আফগানীদের শাসন জারি থাকে। শের শাহ ছিলেন বাবরের একজন সেনানায়ক। তিনি ১৫২২ সালে মোগল শাসনের অধীনের বিহারের গভর্নর নিযুক্ত হন।

১৫৩৮ সালে নতুন মুঘল সম্রাট হুমায়ুন যখন অন্যত্র অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময় শের শাহ সুরি বাংলা জয় করে সুরি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে নতুন সম্রাট ঘোষণা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মোগল সম্রাট হুমায়ুন বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হলে শের শাহ বাংলা ত্যাগ করেন। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে (বক্সারের নিকটে) হুমায়ুনকে পরাভূত করে তিনি ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং বাংলা পুনর্দখল করে খিজির খানকে এর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পরবর্তী বছর পুনরায় হুমায়ুনকে পরাজিত ও ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে তিনি দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন।

হিন্দুস্তানের শাসনক্ষমতা লাভের পর নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার কাজে মনোযোগ দিলেন শের শাহ। তার শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো নিজেকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ, সম্রাটই ছিলেন শাসন ব্যবস্থার মূলে। শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আর প্রশাসনিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে পরামর্শের জন্য অভিজাত আর বিজ্ঞদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি পরামর্শক কাউন্সিল।

দিউয়ান-ই-ওয়াজির, দিউয়ান-ই-আরীজ, দিউয়ান-ই-রসলত আর দিউয়ান-ই-ইনশাহ, এই চারটি পদ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো শের শাহের মন্ত্রীসভা। দিউয়ান-ই-ওয়াজির বা উজির সাম্রাজ্যের সকল বিষয়ই দেখাশোনা করতেন। মন্ত্রীসভার কাজ তদারক করাও তার দায়িত্বের মাঝে অন্তর্ভূক্ত ছিলো। দিউয়ান-ই-আরীজ বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিলো সেনাবাহিনীকে নিয়ে। সেনাবাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, অস্ত্র-শস্ত্র জোগান দেয়া, যুদ্ধপরিকল্পনা করা, নতুন সৈন্য ভর্তি, সেনাবাহিনীর রসদ জোগান ইত্যাদি বিষয় তদারক করতো এই মন্ত্রণালয়। শের শাহ প্রায়ই এই মন্ত্রণালয়ের কাজ নিজে ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন।

দিউয়ান-ই-রসলত পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখতো আর রাষ্ট্রীয় বার্তা, ঘোষণা ইত্যাদি প্রচারের দায়িত্ব ছিলো দিউয়ান-ই-ইনশাহ এর। শের শাহ তার পুরো সাম্রাজ্যকে ৬৬টি সরকারে ভাগ করে দিয়েছিলেন। সরকার আবার কতগুলো পরগণায় এবং পরগণা কতগুলো গ্রামে বিভক্ত থাকতো। প্রতিটি পর্যায়েই প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য একজন করে প্রধান নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। সরকার বা পরগণা বা গ্রামের সমস্ত দায়িত্ব সেই প্রধানের উপরই বর্তাতো।

সড়ক-ই-আযম
শেরশাহ মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার সাধন এবং হয়রানিমূলক কর রহিত করে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি বিধান করেন। সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকার সঙ্গে রাজধানী আগ্রার চমৎকার সংযোগ-সড়ক নির্মাণ করে এবং এই সড়কের ধারে নির্দিষ্ট দূরত্বে সরাইখানা, মসজিদ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করে তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার অভিনব উন্নতি সাধন করেন। তাঁর নির্মিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ছিল সড়ক-ই-আযম (মহাসড়ক)। তিন হাজার মাইল দীর্ঘ এই মহাসড়ক আরাকান থেকে আগ্রা, দিল্লি ও লাহোর হয়ে মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং এর দুপাশে ছিল ছায়াদানকারী বৃক্ষশ্রেণি। ইংরেজ আমলে এই সড়ক গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিতি লাভ করে। রাজধানী থেকে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং বাইরে থেকে রাজধানীতে সহজে ও দ্রুত সরকারি নির্দেশ ও সংবাদ আদান প্রদানের জন্য যাত্রাপথে পর্যায়ক্রমে সংবাদ-বাহকের ঘোড়া বদল করার এক অভিনব পদ্ধতি তিনি চালু করেন। পথের পাশের সরাইখানাগুলি সংবাদবাহী ঘোড়া বদলের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো সাম্রাজ্য, রাজ্য বা দেশ টিকে থাকতে পারে না। শের শাহ তাই তার সাম্রাজ্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছিলেন। প্রশাসন পরিচালনা কিংবা বিচারকার্যে শের শাহ ছিলেন সম্পূর্ণরুপে নিরপেক্ষ। দুর্নীতি করলে বা অন্য কোনো অপরাধ করলে তিনি কাউকে ছাড় দিতেন না। এক্ষেত্রে তিনি কে আমির আর কে প্রজা, কে আমিরের ছেলে আর কে মুচির ছেলে এসব কিছুই দেখতেন না। সবার জন্যই একই আইন ছিলো। বিচারের শাস্তি দেয়া হলে তা বাস্তবায়নেও তিনি কখনো পিছপা হননি।

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাম্রাজ্যজুড়ে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন অসংখ্য বিচারক। ‘কাজী’ আর ‘মুনসিফ’রা দিউয়ানী মামলার বিচার করতেন। ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন ‘শিকদার’রা। গ্রামাঞ্চলে বিচারের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত গঠিত হয়েছিলো। গ্রাম পঞ্চায়েত দিউয়ানি আর ফৌজদারি দুই ধরনের মামলারই বিচার করতে পারতো। তাছাড়া সাম্রাজ্যের রাজস্ব সম্পর্কিত বিচারের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা ছিলো। বিচার ব্যবস্থায় শের শাহ তেমন নতুন কিছু যোগ করেননি। পূর্বের বিচার কাঠামোর মাঝেই তিনি মূলত জোর দিয়েছিলেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি।

শের শাহের জনহিতকর কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল দাতব্য প্রতিষ্ঠানে মুক্ত হস্তে অর্থদান, দরিদ্রদের জন্য লঙ্গরখানা স্থাপন, মাদ্রাসা, মসজিদ, গুরুত্বপূর্ণ ইমারত, বাগবাগিচা, হাসপাতাল ও সরাইখানা নির্মাণ। সাসারামে নিজের অনুপম সমাধিসৌধ, নির্মাতা হিসেবে তাঁর উন্নত রুচির পরিচায়ক। শেরশাহ ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। হিন্দুদের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই সহনশীল। তাঁর মধ্যে একজন সমরনেতা, একজন বিচক্ষণ নৃপতি এবং একজন যোগ্য ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল।

১৫৪৫ সালে চান্দেল রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কালিঞ্জর দুর্গে বারুদের বিস্ফোরণে শের শাহ সুরির মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র জালাল খান ইসলাম শাহ সুরি নাম গ্রহণ করে সুরি সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। সাসারামে একটি কৃত্রিম হ্রদের মাঝখানে তাঁর ১২২ ফুট উঁচু নয়নাভিরাম সমাধিসৌধটি আজও বিদ্যমান। তাঁর মৃত্যুর পর হুমায়ুনের নেতৃত্বে ভারতে মোগল সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে সুরি শাসন অব্যাহত থাকে।

ইসলাম শাহ সুরি সাম্রাজ্যের ২য় শাসক। তিনিও তাঁর পিতার মতো দক্ষতার সাথে শাসন করেন। তবে তার সময়ে হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। ১৫৫৪ সালে তিনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে নিহত হন। তারপরে ফিরোজ শাহ সুরি ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু বাংলায় যিনি গভর্নর ছিলেন তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলার শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ খান সুর। তিনি বছর দুয়েকের মাথায় সুরি শাসক আদিল শাহের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। এরপর তার ছেলে গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহ ক্ষমতায় আসেন। তিনি ১৫৬১ সাল পর্যন্ত বাংলার শাসক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার ভাই গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহ ক্ষমতায় আসেন এবং ১৫৬৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ১৫৬৩ সালে তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন শাহ ক্ষমতায় আসেন। তিনি ছিলেন জালাল শাহের পুত্র।

১৫৬২ সালে শুরুতে আফগান কররানী রাজবংশের তাজ খান কররানি বাংলার একটি বড় অংশ দখল করে নেন। ১৫৬৪ সালে তৃতীয় গিয়াসউদ্দিনকে পরাজিত করে তাজ খান কররানী নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তাজখান কররানী ছিলেন শেরশাহের অন্যতম উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তিনি শেরশাহের পুত্র ইসলাম শাহের সময়ে দক্ষিণ বিহারের শাসনকর্তা ছিলেন। আদিল শাহের শাসনামলে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমীর। গোয়ালিয়রে আদিলশাহের দরবারে রাজনৈতিক অরাজকতার কারণে তাজখান সেখান থেকে পলায়ন করেন এবং গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে নিজের কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে আদিলশাহের সেনাপতি হিমুর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নিকট তারা পরাস্ত হন। তাজ খান ও সুলায়মান কররানী বাংলায় পালিয়ে যান। বাংলার আফগান দলপতিদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে নানা উপায়ে তাজখান ও সুলায়মান নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেন। অবশেষে তাজখান সুলতান তৃতীয় গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৫৬৪ সালে কররানী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তাজ খান বেশিদিন তাঁর সুফল ভোগ করতে পারেন নি। ১৫৬৪ সালে তার মৃত্যু হয়।

তাঁর ভাই সুলায়মান কররানী তার উত্তরাধিকারী হন এবং গৌড় থেকে তান্ডায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। মোগলগণ উত্তর ভারত দখল করার পর সেখান থেকে এসে তার রাজধানীতে একত্রিত হওয়া আফগানদের নিয়ে তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। একজন বিচক্ষণ কুটনীতিবিদ সুলায়মান কররানী সব সময়ই আকবরের সাথে প্রকাশ্য বিরোধিতা এড়িয়ে চলেন। তিনি মোগল রাজদরবারে নিয়মিত উপহার পাঠাতেন এবং কখনোই প্রকাশ্যে স্বাধীনতা দাবি করেন নি। তিনি আকবরের নামে খুৎবা পাঠ করান ও মুদ্রা প্রচলন করেন। বাহ্যত সুলায়মান কররানী মুগলদের আধিপত্য স্বীকার করলেও তিনি হযরত-ই-আলা উপাধি নেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, কার্যত তিনি একজন স্বাধীন শাসক ছিলেন।

পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সুলায়মান কররানী উড়িষ্যা জয় করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর পুত্র বায়েজীদ কররানীকে ১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে একটি শক্তিশালী সৈন্যদলসহ ওই দেশের বিরুদ্ধে পাঠান। যুদ্ধে বায়েজীদ উড়িষ্যার রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করেন। ইতোমধ্যে সুলায়মান কররানী স্বয়ং উড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হন এবং এর রাজধানী তাজপুর দখল করেন। সুলায়মান কররানীর নির্ভীক সেনাপতি কালাপাহাড় পুরী পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং প্রত্যন্ত এলাকাসমূহ দখল করেন। এভাবে উড়িষ্যা সরাসরি কররানী শাসনাধীনে আসে।

সুলায়মান কররানী আট বছর বাংলা শাসন করেন। তাঁর রাজ্য উত্তরে কোচবিহার থেকে দক্ষিণে পুরী পর্যন্ত এবং পশ্চিমে শোন নদী থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর সুলায়মান কররানীর মৃত্যু হয়। সুলায়মান কররানীর জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়েজীদ কররানী তাঁর উত্তরাধিকারী হন। তিনি তাঁর পিতার নীতি পরিহার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি নিজের নামে খুৎবা পাঠ এবং মুদ্রা প্রচলন করেন।

বায়েজীদ কররানী মাত্র অল্প কয়েকমাস বাংলা শাসন করেন। তাঁর চাচাত ভাই এবং ভগ্নীপতি হান্সু তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেন এবং ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু শীঘ্রই সুলায়মান কররানীর বিশ্বস্ত উজির লোদী খান কিছু সংখ্যক আমীরের সহায়তায় হান্সুকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁকে হত্যা করেন। অতঃপর তারা ১৫৭৩ সালে বায়েজীদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা দাউদ খান কররানীকে বাংলার সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। দাউদ তাঁর ভাইয়ের স্বাধীন নীতি অনুসরণ করে নিজের নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা প্রচলন করেন।

দাউদ কররানী উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বিশাল সৈন্য বাহিনী ও বিপুল ধন সম্পদ লাভ করেন। এর সাহায্যে তিনি আকবরের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং গাজীপুরের নিকট জামানিয়া অবরোধ করেন। বাদশাহ আকবর জৌনপুরের শাসক মুনিম খানকে দাউদ কররানীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার জন্য আদেশ দেন। মুনিম খান পাটনায় পৌঁছে লোদীখানের মুখোমুখি হন এবং সহজ শর্তে সন্ধি সম্পাদন করে সন্তুষ্ট হন। আকবর অথবা দাউদ কেউই এ সন্ধিতে খুশী হন নি। দাউদ তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। অপর দিকে বাদশাহ মুনিম খানকে আবার বাংলা ও বিহার আক্রমণের আদেশ দেন। তদানুসারে মুনিম খান বিহারে পৌঁছান এবং পাটনা অবরোধ করেন। এ অবস্থায় ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর স্বয়ং দাউদ খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি সরাসরি হাজীপুর আক্রমণ করে সহজেই তা দখল করেন। সম্রাট পাটনা দখল করে মুনিম খানকে বিহার ও বাংলার শাসক নিযুক্ত করেন এবং দাউদ কররানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যহত রাখার নির্দেশ দিয়ে দিল্লি অভিমুখে রওনা হন।

মুনিম খান বাংলার বিরুদ্ধে তার অভিযান চালু রাখেন। তিনি তান্ডা ও সাতগাঁও দখল করে নেন। দাউদ খান উড়িষ্যায় পালিয়ে যান। মুনিম খান ও টোডরমল দাউদের পশ্চাদ্ধাবন করে উড়িষ্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। বালাশোর জেলার তুকারয়ে সংঘটিত যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন (১৫৭৫ খ্রি.)। দাউদ কররানী ও মুগলদের মধ্যে অতঃপর কটকে একটি শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। দাউদ কররানী বাংলা ও বিহার মোগলদেরকে ছেড়ে দেন এবং শুধু উড়িষ্যা নিজের দখলে রাখেন।

১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে মুনিম খানের আকস্মিক মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে, দাউদ কররানী বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং তেলিয়াগড়ি গিরিপথ পর্যন্ত দখল করেন। এ পরিস্থিতিতে আকবর হোসেন কুলী বেগকে খানজাহান উপাধি দিয়ে বাংলার শাসক নিযুক্ত করেন ও দাউদ কররানীকে আক্রমণ করার আদেশ দেন। খানজাহান টোডরমলকে সঙ্গে নিয়ে দাউদের রাজধানী তান্ডা অভিমুখে যাত্রা করেন। উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গা এবং দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়ের মধ্যবর্তী রাজমহল এর সংকীর্ণ প্রবেশ পথে কররানী তাদের পথ অবরোধ করেন। খান জাহান প্রথমে তেলিয়াগড়িতে আফগানদের সম্মুখীন হন এবং যুদ্ধের পর এটি অধিকার করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত ও নিহত হন। দাউদ কররানীর মৃত্যুদন্ডের ফলে বাংলায় আফগান শাসনের অবসান ও মোগল শাসনের সূচনা হয়।