২২ ডিসে, ২০১৯

ডলার কূটনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে চার মুসলিম নেতা



১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মূলত ডলার কূটনীতি কার্যকরভাবে ফাংশন করতে শুরু করলো। বেচাকেনার একদম শুরুতে এটা ছিল স্রেফ দ্রব্যাদির বিনিময়। তারপর আবিস্কৃত হলো যে স্বর্ণের সর্বজনীন আকর্ষণ আছে, এবং ভার-ভারিক্কি দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থার বদলি হিসাবে এটা সুবিধাজনক। দ্রব্য ও সেবার বিনিময়ের সুবিধে করে দিল স্বর্ণ, পাশাপাশি যারা দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করতে চাইতো তাদের জন্য স্বর্ণ মূল্যের মজুদ হয়েও থাকতে পারে। ওদিকে বাজারে স্বাভাবিকভাবেই অর্থ ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে থাকলো। ক্ষমতার ওপর সরকারের দখল বাড়ার সাথে সাথে তারা অর্থের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে বসলো। স্বর্ণের গুণগত মান এবং ভেজালমুক্ততা নিশ্চিতকরণে সরকারগুলো কখনো কখনো সফল হলেও, এটা নিয়ে তারা খুশী ছিল না। একসময় তারা নিজেদের রাজস্ব আয় বাড়ানোর অন্য উপায় শিখে ফেললো। নতুন কর আরোপ কিংবা করের হার বৃদ্ধি সবসময়ই জনগণকে নাখোশ করে। সুতরাং শাসকরা শিখলো যে কিভাবে প্রতিটি চাকতির স্বর্ণের পরিমাণ কমিয়ে নিজেদের মুদ্রার পরিমাণ স্ফীত করা যায়।

যখন স্বর্ণ বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতো এবং আইন-কানুন সৎ বাণিজ্যের সুরক্ষা দিতো, তখন উৎপাদনশালী দেশ বিস্তার লাভ করতো। যখনই সম্পদশালী জাতিসমূহ-- যাদের শক্তিশালী সব সেনাদল ও স্বর্ণসম্ভার ছিলো-- যারা শুধু সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে এবং নিজের দেশে কল্যানমূলক খরচ করতে ব্যতিব্যস্ত ছিলো-- তারা জাতি হিসাবে ব্যর্থ হতে লাগলো। নীতিসমূহ আজও আগের মতোই আছে, কিন্তু প্রক্রিয়া একেবারেই বদলে গেছে। স্বর্ণ আর মুদ্রা নয়, মুদ্রা হচ্ছে কাগজ। অন্তত এই সময়ের জন্য সত্য হচ্ছে, ‘যে টাকা ছাপায় সে শাসন করে’। স্বর্ণের ব্যবহার না থাকলেও আর্থিক লাভের ব্যাপার আগের মতোই আছে; অন্য দেশগুলোকে উৎপাদন করতে এবং তাদের সামরিক শক্তি কমাতে বাধ্য করো এবং নিজেদের মুদ্রাব্যবস্থার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কমাও। যেহেতু কাগুজে মুদ্রা হলো স্রেফ প্রতারণা, ‘প্রকৃত মূল্যহীন’, সুতরাং যেই দেশ আর্ন্তজাতিক মুদ্রার মালিক হবে সেই দেশের অবশ্যই প্রচুর সামরিকশক্তি থাকতে হবে যাতে করে পুরো ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখা যায়।

মূলত বিশ্ব-মুদ্রা বলতে যা বোঝায়, সেই মুদ্রার মালিক দেশের জন্য এটা একটা সম্পদ বা বিত্ত বাড়ানোর একটি চমৎকার ও চিরস্থায়ী পদ্ধতি। কংগ্রেস ১৯১৩ সালে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম চালু করে। এরপর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিরাপদ মুদ্রা’র নীতি পদ্ধতিগতভাবেই অবহেলা করা হয়েছে। এই পুরোটা সময়জুড়ে যুদ্ধে অর্থের যোগান দেয়া ও অর্থনীতিকে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালানোর জন্য খুব সহজ একটি কাজ করেছে ফেডারেল রিজার্ভ-- তারা যখন ইচ্ছে তখনই বাজারে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ বাড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্ন্তজাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের আধিপত্য একলাফে বহুগুণ বেড়ে যায়।

আমেরিকা দুনিয়ার অনেক দেশে বিধ্বংসী হামলা চালায়, ওই দেশগুলো দুর্ভোগের শিকার হয়, কিন্তু তাদের স্বর্ণে মার্কিন সিন্দুকগুলো ভরপুর হযে ওঠে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো দেশ স্বর্ণমান ভিত্তিক পদ্ধতিতে ফিরতে আগ্রহী হয় নি। দেনা পরিশোধের লক্ষ্যে কর আদায় করা কিংবা অপ্রয়োজনীয় খরচ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে কাগুঁজে মুদ্রা ছাপানোর সিদ্ধান্ত তখন অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। তাতে করে অল্প মেয়াদে উপকার পাওয়া গিয়েছিল সত্য কিন্তু দশকের পর দশক ধরে এই ভারসাম্যহীনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।

১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তিতে ব্রিটিশ পাউন্ডের বদলে দুনিয়ার প্রধানতম রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ডলারকে ধার্য করা হয। মূলত মার্কিন রাজনৈতিক শক্তি, সামরিক শক্তি ও তাদের হাতে থাকা প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণের প্রতি খেয়াল রেখেই দেশগুলো ডলারের পক্ষ নেয়। প্রতি ৩৫ ডলার হচ্ছে ১ আউন্স স্বর্ণের সমমূল্য- এই হারে। ডলারকে বলা হলো ‘স্বর্ণের মতো সুবর্ণ’ এবং ১/৩৫ হারে দুনিয়ার যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার বিনিময়ের সুযোগ হলো। স্বর্ণ বিনিময়ের এই ১/৩৫ হার থেকেই পতনের যাত্রা শুরু হলো। সবাই যা আন্দাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ঠিক তা-ই করলো। বিপরীতে কোনো স্বর্ণ গচ্ছিত না রেখেই সে ডলার ছাপাতে থাকলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৬০ সালে নতুন প্রশ্ন না ওঠানো পর্যন্ত দুনিয়া ওই ডলারের ওপর রাজি-খুশি ছিল। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স এবং আরো কয়েকটি দেশ দাবি করলো; আমাদের ট্রেজারিতে তাদের জমা দেয়া প্রতি ৩৫ ডলারের বদলে ১ আউন্স করে স্বর্ণ দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি মার্কিনিরা দিয়েছিলো তা যেন তারা ফিরিয়ে দেয়। ওই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গিয়ে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণ বাইরে চলে গেল এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাজানো ‘কাল্পনিক স্বর্ণমান’ ব্যবস্থা ধাক্কা খেলো।

১৯৭১ এর ১৫ আগস্ট ওই ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটালো আমেরিকা। নিক্সন সেদিন স্বর্ণ বিনিময় বন্ধ করে দিলেন এবং কোষাগারে অবশিষ্ট ২৮০ মিলিয়ন আউন্স স্বর্ণ হতে আর কোনো পাওনা পরিশোধ করতে অস্বীকার করলেন। যে অস্বীকৃতির মূল কথা হলো; আমেরিকা তাদের অস্বচ্ছলতা ও প্রতারণার ঘোষণা দিলো এবং সব দেশই উপলদ্ধি করলো যে মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে অন্য কোনো মুদ্রব্যাবস্থা সাজাতে হবে। বিস্ময়করভাবে এমন এক নতুন ব্যবস্থা সাজানো হলো; যে ব্যবস্থায় কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই দুনিয়ার প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে কাগুজে ডলার ছাপানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুমতি পেয়ে গেল-- কাল্পনিক স্বর্ণমানে ডলার রূপান্তরযোগ্য হবে কিংবা এ ধরনের কোনো শর্ত ছাড়াই! ১৯৭১ সালে ঘোষণা করলো তারা আর ব্রিটন উডস সিস্টেম মানবে না, তারা নির্দিষ্ট কোন ডলার রেটে স্বর্ণ বেচাকেনা করবে না। স্বর্ণের দাম হবে অনির্দিষ্ট। মানে মার্কেট অটোমেটিকালী স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করবে। সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ডলার হয়ে গেলে ভাসমান মুদ্রা, এর এখন থেকে গোল্ডের উপর কোন ডিপেন্ডেন্সি নাই। ডলার তখন থেকে স্বর্ণ হতে স্বাধীনতা পেল।

এই নতুন ব্যবস্থা যদিও আগেকারটির চেয়ে আরো বেশি দুর্বল ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও এর ফলেও ডলার-আধিপত্য বিস্তারের দরজা খুলে দিল। কিন্তু নতুন ব্যবস্থার প্রতি দেশগুলোর সংশয়ভাব রয়েছে এবং সবাই নতুন কিছু একটা চাইছে এটা বুজতে পরে শীর্ষ মুদ্রা ব্যবস্থাপকরা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জোর সমর্থন পেয়ে একটা আচানক কাজ করে বসলো। তারা ওপেক-এর সাথে চুক্তি করলো যে, দুনিয়াজুড়ে তেল বেচা-কেনার ক্ষেত্রে শুধু মাত্র ডলারকেই বিনিময় মুদ্রা হিসাবে গ্রহণ করা হবে। দুনিয়ার মুদ্রাগুলোর মধ্যে ডলারকে একটা বিশেষ জায়গা করে দিল এই চুক্তি। ডলার তেলের ওপর উঠে দাঁড়াল। চুক্তিতে এই সুবিধার বদলে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিল যে, তারা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের এই দেশগুলোকে অন্য রাষ্ট্রের আগ্রাসন ও আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে সুরক্ষা দেবে। এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান করার মাধ্যমে ডলারকে কৃত্রিম শক্তি যোগাল। যার ফলে বিশ্ববাজারে ডলারের প্রভাব বাড়লো এবং যুক্তরাষ্ট্র বিশাল ছাড়কৃত মূল্যে তেল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি আমদানি করে নিজেদের মুদ্রাস্ফীতি রপ্তানি করার সুযোগ পেলো।

১৯৮০ তে সত্যিকারের ‘ডলার আধিপত্যের’ জমানা শুরু হলো। যে জমানা এখনো শেষ হয় নি। সব দেশকে ফরেইন রিজার্ভ আগে রাখতে হতো গোল্ডে। এখন সবাই রাখে ডলারে। গোল্ড থাকে আমেরিকায়। আমাদের ভল্টে থাকে শুধুই ডলার, যাহা কাগজ ছাড়া কিছুই নয়। এখন মনে করুন, বাংলাদেশে ফরেইন রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার। এই ৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রকৃত মূল্য ধরে নিন ২ টন গোল্ড। এখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ধার-দেনা, যুদ্ধব্যায়ে তাদের ইচ্ছেমতো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ছাপায়, এরপর এই ডলার সারাদুনিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ডলার ছাপানোয়, ডলারের মান কমে যায়, ব্যাপক ইনফ্লেইশন হয়। ফলে মনে করেন, মাত্র দশ মাসের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মূল্য কমে মাত্র ১ টন গোল্ড হয়ে যেতে পারে। মানে অন্য কথায়, যেকোন পণ্যের দাম ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে প্রায় দ্বিগুন হয়ে যাতে পারে। মানে আপনার জমাকৃত অর্থের মূল্য বিপদজনকভাবে কমে যেতে পারে এবং তা কমছেও। এটা বড় ধরনের জুলুম। যা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীবাসী ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ভার বহন করে আসছে।

এটার বিপরীতে নিজেকে আলাদা করে রেখেছে ইরান। তারা আন্তর্জাতিক ব্যবসা করে স্বর্ণ বা পণ্যের মাধ্যমে। সম্প্রতি কুয়ালালামপুর সামিটে চার মুসলিম নেতা নিজেদের মধ্যে ব্যবসায়ে কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ ও পণ্যের বিনিময়ে বেচাকেনা শুরুর চিন্তাভাবনা করছে। দেশগুলো হলো ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও কাতার। এই জোটে শামিল হওয়ার কথা ছিলো পাকিস্তানেরও। কিন্তু সৌদি হুমকির কারণে অন্যতম আয়োজক হওয়া সত্ত্বেও এটেইন করতে পারেনি ইমরান খান। দেখা যাক তারা ডলার কূটনীতিকে কীভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন