৫ মার্চ, ২০২০

আমেরিকা - তালেবানের চুক্তি ও কিছু কথা



আমেরিকা ও তালেবানের সাথে চুক্তি হয়েছে দীর্ঘদিন আলোচনার ইতি টেনে। তালেবান নিয়ে আমার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যারা আমার আগের লেখাগুলো পড়েছেন তারা তা জানেন। সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমার আরো আগেই এই চুক্তি বিষয়ে লিখা উচিত ছিল, কিন্তু পারিবারিক ব্যস্ততা আমাকে সে সুযোগ দেয়নি।  

যাই হোক, আমেরিকান ও তালেবানরা যে চুক্তি স্বাক্ষর করলো, সেটার মাধ্যমে গেরিলা গ্রুপ ও কাবুল সরকারসহ অন্যান্য আফগান গ্রুপের মধ্যে আলোচনার দরজা খুলে গেলো বলে অনেকে মনে করছেন। যদিও আমি এখানে আশার কিছু দেখছি না।  

চুক্তিতে যা পাওয়া গেছে...  
১. ধারাবাহিক মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে। এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১২ হাজার সেনা রয়েছে। তাদের সাথে রয়েছে ন্যাটো মিত্র বাহিনীর আরও কয়েক হাজার সেনা। আগামী পাঁচ মাসে ৫০০০ সেনা প্রত্যাহার হবে।  
২. এই ১৫ মাস আমেরিকান সেনারা আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারকে নিরাপত্তা দিবে। 

৩. তালেবানরা আল কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে আফগান ভূমি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে কোন হামলা পরিচালনা করতে দেবে না। 

৪. যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানরা কাতারে একটি যৌথ পর্যালোচনা কমিটি গঠন করবে, এবং এই কমিটি চুক্তির বিভিন্ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে।  

৫. আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তানের সরকার, বিভিন্ন আফগান পক্ষ, এবং  তালেবানদের সাথে ক্ষমতা  কিভাবে শেয়ার করবে সেই ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত চুক্তিতে আসবে সকল পক্ষ মিলে। এই ব্যাপারে আগামী ১০ দিনের মধ্যেই সকল পক্ষ আলোচনা শুরু করবে।

৬. আফগান সরকারের কাছে থাকা ৫ হাজার তালেবান বন্দি আছে তাদের মুক্তি দিতে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করবে, সেই সাথে তালেবানেরা মুক্তি দিবে তাদের হাতে আটক ১ হাজার আফগান বন্দিকে।  

তালেবানের সাবেক প্রধান মোল্লা ওমরের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল গনি। ২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে আটক হয়েছিলেন পাকিস্তানের করাচিতে। আট বছর পর ছেড়ে দেওয়া হয় সিআইএর অনুরোধে। এখন তার সাথেই চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। চুক্তির কথাগুলো সবই পরস্পর সম্পর্কিত ও শর্তসাপেক্ষ। 

পর্যালোচনা 
চুক্তির ভাষা থেকে যা বুঝা যায় তা হলো বর্তমান সমঝোতা কেবল একটা সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির প্রাথমিক শর্ত মাত্র। এটা কোনো শান্তিচুক্তি নয়। বরং চুক্তির একটি ধাপ মাত্র। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকেরা তাৎক্ষণিকভাবে চলে যাবে না। তালেবানও এখনই তাদের হারানো ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান’ আবার গড়তে পারছে না। দুটিই অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয় হবে। এমনকি চুক্তিতে বারবার বলা হয়েছে, তালেবানের ‘ইসলামিক আমিরাতকে’ যুক্তরাষ্ট্র কোনো বৈধ সরকার বলে স্বীকারও করছে না।

তালেবান আর আমেরিকার এই ধরনের শান্তি চুক্তি অথবা চুক্তির নামে নাটক নতুন কিছু নয়, সময় সময়ে তারা তাদের দ্বিপাক্ষিক প্রয়োজনে তারা এমন চুক্তির মহড়া দিয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ২০০৭-এ তালেবানের দিকে আলোচনার হাত বাড়িয়েছিলেন সর্বপ্রথম। আফগান থেকে মার্কিন সৈন্যদের যাওয়ার প্রধান ব্যাপার হলো আফগানে শান্তি আসা। আর সেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করতে হবে আফগানদের। এই শান্তির পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা হলো তালেবান আর মার্কিনীরা। শান্তি প্রতিষ্ঠা হলো মার্কিনীদের জন্য সবচেয়ে খারাপ খবর। তাই অশান্তি জিইয়ে রাখতে তাদের নিরঙ্কুশ সহযোগিতা করে যাচ্ছে তালেবানরা। কিন্তু মার্কিনীরা এমন ভাব নেয় যেন তাদের কোনো দোষ নেই। তারা শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু আফগানেরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে। 

এই শান্তি প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কার্যকর কাজ করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী। ওবামা চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ফেইক সদিচ্ছা প্রমাণ করতে দুই হাজার সেনা তৎক্ষণাৎ প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তালেবানকে দিয়ে আবার প্রেসিডেন্ট রব্বানীকে খুন করিয়ে আরো বাড়তি সেনা প্রেরণ করে। 

এ চুক্তিতে সবচেয়ে খুশি দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং সাধারণ আফগানরা। উভয়ের খুশির কারণ অবশ্যই এক নয়। ট্রাম্পের সামনে নির্বাচন। সেখানে সে জাতিকে দেখাবে আমি যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। যে কারণে যুদ্ধ হয়েছে আমি সেই কারণ জয় করেছি। যুদ্ধ শুরু হয়েছে আল কায়েদাকে হোস্ট করার জন্য আজ আর সেই কারণ নেই। আজ তালেবান স্বীকার করে নিয়ে আল কায়েদা সন্ত্রাসী এবং তারা আল কায়েদাকে হোস্ট করবে না। কিছু সেনা প্রত্যাহার হবে। আর সেই প্রত্যাহার ট্রাম্পের নির্বাচনের একটি ভালো প্রচারণা হবে। আফগানিস্তানের শান্তির চেয়েও ট্রাম্পের জন্য জরুরি ছিল এই চুক্তিটি। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধ চায় না। তারা যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে করতে ক্লান্ত।  

এই চুক্তিতে বড় লাভ যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর। চুক্তির পরই ন্যাটো সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়তে হচ্ছে না। তালেবানকে এখন তারা বর্তমান আফগান সরকারের দিকে ঠেলে দিলো। ফলে ভবিষ্যতের যেকোনো সহিংসতার দায় ওয়াশিংটন ওই দুই পক্ষের ওপর বর্তাতে পারবে। এবং তাই হবে। 

এই চুক্তিতে শান্তি আসার খুব একটা সম্ভাবনা নেই কারণ তালেবানরা আফগানের একমাত্র পক্ষ তো নয়ই বরং ছোট পক্ষ। এরা পশতুনদের একটা গ্রুপ। পশতুনদের আরো একটি গ্রুপ হলো হিজবে ইসলাম। এর বাইরে আছে তাজিক, হাজারা ও উজবেক জনগোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে তালেবানের সাপোর্ট নেই। পশতুনদের মধ্যে যারা দেওবন্দের অনুসারী তারাই কেবল তালেবানের সমর্থক।  

আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটিতে শান্তি আনতে চাইলে আফগানিস্তানের পাঁচ প্রতিবেশীকেও শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আফগান নেতারা একমত হতে পারে। কিন্তু তালেবানের মত গোঁড়া দিয়ে সেই আশা করা একটু কঠিন। তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বর্তমান সরকারকে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে এবং একইসাথে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে। 

কিন্তু আমরা কী দেখলাম! 
ট্রাম্প জানিয়েছে, তার সাথে তালেবান নেতার খুবই ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। কথাবার্তার ডিউরেশন ছিলো ৩৫ মিনিট। ফোনকলের পরপরই আমরা জানতে পারলাম তালেবান আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে অন্তত ১৫টিতে ৩০টি হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে কুন্দুজ প্রদেশে ১০ আফগান সেনা, ৪ আফগান পুলিশ ও ৬ আফগান বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এবং এর প্রতিবাদে আমেরিকা হেলমান্দে বিমান হামলা চালিয়েছে। 

অতএব পুরো ব্যপারটাই আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা নাটক। যা আরো কয়েকবার মঞ্চস্থ করেছে আমেরিকা ও তালেবান। তবে চুক্তি অনুযায়ী যদি আমেরিকা আফগান ছাড়ে তবে এটা আফগানিস্তানের জন্য বড় রহমত হতে পারে এবং সেটাই কামনা করি। তবে এই বিষয়টা যদি তালেবান ১৯ বছর আগে বুঝতো তাহলে হয়তো এতো কঠিন যুদ্ধ এড়ানো যেত। 

টুইন টাওয়ারে বেসামরিক মানুষ হত্যা করা ইসলামসম্মত নয়। আল কায়েদা এই হত্যার দায় স্বীকার করে ইসলামের ক্ষতি করেছে। তালেবান তাদের সাপোর্ট করে ও হোস্ট করে আফগান মুসলিম ও বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের অনেক ক্ষতির সম্মুখিন করেছে। পুরো মুসলিম জাতিকে আমেরিকার সন্ত্রাসীদের মুখোমুখি করে দিয়েছে।

1 টি মন্তব্য: