৩ মার্চ, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-২৯ : সাতান্ন সালের বিদ্রোহ ও তার আফটারম্যাথ


১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ আসলে কেমন যুদ্ধ ছিল তা একটু আলোচনা করা যেতে পারে। আগের বিদ্রোহগুলোর সাথে এই বিদ্রোহের একটি বেসিক পার্থক্য আছে। ১৮৫৭ সালের আগে যে বিদ্রোহগুলো হয়েছিলো সেগুলো সবগুলোই হয়েছে তাদের দ্বারা যারা ইংরেজদের বিরোধী ছিল। আর এই বিদ্রোহ হয়েছে ইংরেজদের দালাল দ্বারা। যারা ইংরেজদের সৈনিক ছিল, ইংরেজদের অধীনে চাকরি করতো এবং ইংরেজদের নিরাপত্তায় ছিল। পলাশীর ট্রাজেডির বরাবর ১০০ বছর পর এমন একটি বিদ্রোহ জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রচুর সাধারণ মানুষও সিপাহিদের সাথে বিদ্রোহে এটেইন করেছে। বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। শুরুতে এদেশের অনেকে ইংরেজদেরকে অন্যান্য বিদেশি শাসকদের মতোই মনে করেছিলো। কিন্তু তারা ছিল অত্যাচারী ও জুলুমবাজ। তাই তাদের সৈনিকরাই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল।  ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। 

প্রথমত
ইংরেজদের অর্থনৈতিক আগ্রাসন। উপমহাদেশ দখলের শুরু থেকেই তারা দেশীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে তার উপর ঔপনিবেশিক অর্থনীতি চাপিয়ে দেয়। তারা এদেশের প্রচলিত ব্যবসা বাণিজ্য নষ্ট করে, কুটির শিল্পগুলি ধ্বংস এবং দেশের যাবতীয় মূলধন ও সম্পদ হস্তগত করে এদেশের অর্থনীতির উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশীয় ব্যবসা বাণিজ্যের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এবং কুটির শিল্পগুলি ধ্বংস হওয়ার ফলে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। দেশে বেকার ও দারিদ্র বৃদ্ধি পায় । প্রজাসাধারণ কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কোম্পানির ভ্রান্ত নীতির ফলে একদিকে যেমন জমিদার ও মহাজন শ্রেণির উদ্ভব হয়, তেমনি অন্যদিকে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির কর্মচারী এবং জমিদার ও মহাজনদের শোষণ ও অত্যাচারে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয়ত
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ইংরেজদের দালালশ্রেণির আগ্রহের বাড়াবাড়িতে ব্রিটিশ শাসকবর্গ সামাজিক কুপ্রথা এবং কুসংস্কারের অবসান কল্পে একের পর এক বিধি প্রণয়ন করতে থাকেন। সতীদাহ প্রথার অবলুপ্তি, বিধবাবিবাহ প্রচার, স্ত্রী-শিক্ষার প্রবর্তন, বাল্যবিবাহ নিবারণ প্রভৃতি ব্যবস্থা রক্ষণশীল হিন্দুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতির প্রভাবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন হয়। এতে রক্ষনশীল ভারতীয়দের মনে ইংরেজদের উদ্দেশ্যে সন্দেহ জাগে। তাদের ধারণা হয়, সমগ্র ভারতবর্ষকে ধর্মান্তরিত করার জন্য ইংরেজগণ পরিকল্পিতভাবে তোড়জোড় শুরু করছিল। তদুপরি সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের প্রতি বৃটিশের অবজ্ঞা এবং উপেক্ষা, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। ভারতীয়দের সেই বিরূপ মনোভাব সিপাহী বিদ্রোহে পরোক্ষ ইন্ধন জোগায়। সামাজিক এই সংস্কারের ফলে হিন্দু সমাজ যারা শুরু থেকেই মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সহায়তা করেছিল তারা বেঁকে বসে।   

তৃতীয়ত
ইংরেজরা একের পর এক দেশীয় রাজ্যগুলো গ্রাস করতে থাকে এবং রাজবংশের উচ্ছেদ করতে থাকে, তাতে দেশীয় রাজন্যবর্গ এবং তাদের কর্মচারিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। দুচার জন বাদে ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে লর্ড ডালহৌসি পর্যন্ত সকলেই সমস্ত প্রকার রীতিনীতি ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় রাজ্যগুলি অধিকার করেন। লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগের ফলে বহু রাজবংশের উচ্ছেদ হয়। মোগল বাদশাহের অপসারণ মুসলিমদের মনে দারুন আঘাত হানে। পেশোয়ায় নানা সাহেবের বৃত্তি বন্ধ করে ইংরেজগণ মারাঠাদের উত্তেজিত করে তোলেন। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত রাজন্য বর্গের সঙ্গে এইসব অসন্তুষ্ট মানুষ হাত মেলালে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে।

চতুর্থত
ভারতের খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ সামগ্রিকভাবে রক্ষনশীল ভারতীয়দের মনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের জন্ম দেয়। তাদের মিশনারি কার্যকলাপ মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে প্রচন্ড আঘাত হানে। মুসলিমগণ যারা দীর্ঘকাল রাজ্যশাসনের দায়িত্বে ছিলেন তারা অপসারিত হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ও ব্রিটিশের প্রতি চাপা অসন্তোষ পোষণ করতে থাকেন । তাদের ক্ষমতাচ্যুতি এবং দুরাবস্থার জন্য তারা ইংরেজদের দায়ী করেন। আর মুসলিমরা তো গোড়া থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং একের পর এক বিদ্রোহ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। তারাও দেখেছিলো যে ইংরেজদের দমননীতির ফলে বন্ধ হয়ে যায় মাদরাসাগুলো। ফলে মুসলিমদের মধ্যে শির্ক ও বিদআতের প্রচলন শুরু হয়। এজন্য এদেশে ওয়াহাবী আন্দোলন জমে উঠেছিলো। তারই প্রেক্ষিতে জিহাদী মানসিকতা তৈরি হয় মুসলিমদের মধ্যে। 

পঞ্চমত 
সেনাবিভাগে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বেতন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতের সৈন্যদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সিন্ধু ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত সেনাদলকে বিশেষ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ভারতীয় সেনাগণ তা থেকে বঞ্চিত হতেন। তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে মর্যাদা না দিয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের যত্রতত্র বদলি ও নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। জাত ও ধর্ম হারাবার ভয়ে সিপাহিগণ কালাপানি পার হয়ে ব্রহ্মদেশ বা অন্যত্র যেতে অস্বীকৃত হন। অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে যখন তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ ও উত্তেজিত তখনই লর্ড ক্যানিং -এর প্রবর্তিত সামরিক নিয়োগ বিধি আগুনে ঘি ঢালার ব্যবস্থা করে। এই নিয়মানুসারে ভারতীয় সিপাহিদের যেকোনো কাজ করতেও বাধ্য করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দ) ইংল্যান্ডের জয়লাভ সত্ত্বেও ব্রিটিশ সামরিক বিভাগের দুর্বলতা ভারতীয় সেনাদের উৎসাহিত করে তোলে। তাদের ধারণা হয়, ভারতে অনুরূপ ব্যাপক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারলে সেই অভ্যুত্থান দমন করা ইংরেজ বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে তারা গোপনে প্রস্তুত হতে থাকেন। অন্য একটি বদ্ধমূল ধারণা এক্ষেত্রে কাজ করেছিল, যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন একশো বছর স্থায়ী হবে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সেই শাসনেরই শতবর্ষ পূর্তির বছর। অতএব সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যেও ভারতীয় সিপাহিগণ তৎপর হন।                        
ষষ্ঠত
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেল। বিভিন্ন কারণে সিপাহিদের মধ্যে যখন ক্ষোভ ক্রমশ পূঞ্জীভূত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে এনফিল্ড রাইফেল নামে এক নতুন ধরনের রাইফেলের প্রবর্তন তাদের ক্ষোভ কে বিদ্রোহে পরিণত করে। এনফিল্ড রাইফেলে যে কার্তুজ (Cartridge) ব্যবহার করা হতো, তার খোলসটি দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত । গুজব রটে যায় যে, এই কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে । ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোম্পানির সেনাবাহিনীর হিন্দু ও মুসলমান সিপাহিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে।

তবে মূল কথা হলো এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হলেও একে প্রধান কারণ বলা যায় না। কারণ, চর্বি মাখানো টোটাই যদি এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ হতো, তাহলে টোটা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকারি নির্দেশ জারি করার পরেই এই বিদ্রোহের অবসান ঘটতো। কিন্তু তা না হয়ে বিদ্রোহ চলতে থাকে এবং ইংরেজদের হটানোই মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহিরা চর্বি মাখানো এই টোটাই ব্যবহার করেছিল।

সিপাহী বিদ্রোহ প্রথমে শুরু হয় মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে কলকাতার উত্তরে ব্যারাকপুরে। এই বিদ্রোহের সংবাদ লক্ষ্ণৌ-এর সিপাহিদেরও সংক্রামিত করেছিল। লক্ষ্ণৌ-এর পরে বিদ্রোহ মীরাটে প্রসারিত হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে এপ্রিল মীরাট সেনা ছাউনিতে ৮০ জন সৈনিক প্রকাশ্যে ওই কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মীরাট থেকে এই বিদ্রোহ দ্রুত গতিতে দিল্লীতে ছড়িয়ে পড়ে । দিল্লীতে সিপাহিরা স্ত্রী-পুরুষ-শিশু নির্বিচারে ইংরেজদের হত্যা করে । দিল্লি পৌঁছে বিদ্রোহীরা লাল কেল্লা দখল করে । পরে বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে সিংহাসনে বসিয়ে তাঁকে দিল্লির বাদশারূপে ঘোষণা করেন। এর পর বিদ্রোহ গাঙ্গেয় প্রদেশগুলিতে ও মধ্যভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ফিরোজপুর, মজফ্‌ফর নগর ও আলিগড়ে সিপাহিরা বিদ্রোহী করে। এরপর পাঞ্জাবের বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করে। অযোধ্যা ও উত্তরপ্রদেশের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। অযোধ্যার সম্পত্তিচ্যুত তালুকদাররা বিদ্রোহে যোগ দেন। রোহিলাখন্ডের সর্দাররা এই বিদ্রোহে যোগ দেন। এদের মধ্যে বেরিলির খান বাহাদুর, নাজিরাবাদের মহম্মদ খাঁ, গোরখপুরের মহম্মদ হাসান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলার চট্টগ্রামের সিপাহিরা বিদ্রোহী হন। কিন্তু সেখানে জনসাধারণের সমর্থন না পাওয়ায় সিপাহিরা পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।

নর্মদা নদীর দক্ষিণাঞ্চলে শান্তি একরকম অক্ষুন্নই ছিল, যদিও সিপাহিদের মধ্যে উত্তেজনার অভাব ছিল না।রাজস্থানেও বিদ্রোহ সংক্রামিত হয়। কিন্তু রাজপুত শাসকরা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থাকায় সেখানে বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারেনি। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ভারতীয় সিপাহিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংগ্রামে নামা ছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের গণবিদ্রোহের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রামাঞ্চলে কোম্পানি প্রবর্তিত নতুন ভূমিরাজস্ব আইন দ্বারা সুরক্ষিত সুদখোর মহাজন ও নতুন জমিদারদের  বাড়িঘর ও কাছারি লুঠ করা হয় । যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় ডাকাতরাও এই সব লুঠতরাজে অংশ নিয়েছিল। ব্যবসায়ী ও মহাজনদের ওপর কর বসিয়ে বিদ্রোহী সিপাহিদের খাদ্যশস্য ও যুদ্ধের রসদপত্র কেনা হয়।

তারপরও ব্যর্থ এই বিদ্রোহ
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত নানান ক্ষোভ ও অসন্তোষকে কেন্দ্র করেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সূচনা হয় । বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর সমর্থন, জনগণের সক্রিয় সমর্থন ও সহানুভূতি থাকা সত্বেও মহাবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার মূলে একাধিক কারণ ছিল।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো এই বিদ্রোহের কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা ছিলো না। সিপাহিরা যার যার ইচ্ছেমতো বিদ্রোহ করেছে। কোনো দিক-নির্দেশনা ও গাইডলাইন ছিলো না। বিদ্রোহের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় প্রথম থেকেই এর সাফল্য লাভের সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। সিপাহি বা জনগণের নেতৃবর্গ কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তুলে ধরতে পারেন নি। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ সংগঠিত হওয়ায় বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজ প্রশাসনের বিশেষ কোনো অসুবিধার সন্মুখীন হতে হয়নি। সিপাহিরা বাহাদুর শাহকে নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে কিন্তু সিপাহী ও বাহাদুর শাহের মধ্যে যোগাযোগ ছিলো না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো সিপাহিরা বেশিরভাগ ছিলেন হিন্দু অপরদিকে মুসলিম বাহাদুর শাহকে করা হয়েছে নেতা। 

সমগ্র ভারতে বিদ্রোহ প্রসারিত হলেও মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের বিহার, দিল্লী, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশেই সীমাবদ্ধ ছিল, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিদ্রোহের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। ভারতের সমস্ত অঞ্চলে বিদ্রোহ না হওয়ায় কোম্পানি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে এসে তাদের অন্যত্র বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত করে। ভারতের বিভিন্ন জাতি ও দেশীয় রাজারা বিদ্রোহের বিরোধিতা করে ব্রিটিশদের সমর্থন করেন। এরমধ্যে রয়েছে হায়দ্রাবাদের নিজাম, কাশ্মীরের মহারাজা, সিন্ধিয়া, পাতালিয়া ও গুর্খা বীর স্যার জঙ্গবাহাদুর প্রভৃতি দেশীয় রাজা ও অসংখ্য ছোটো-বড়ো জমিদার বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিল।

১৮৫৭ সালের ফলাফল
ইংরেজরা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ দমাতে সক্ষম হলেও তাদের টনক নড়ে। তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে লুটতরাজ চালাচ্ছে তাতে ভারত শাসন কঠিন হয়ে যাবে। তাই বিদ্রোহ দমনের পর ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া ১ নভেম্বর থেকে নিজের হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং কোম্পানী শাসন বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এর মধ্যমে ভারতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে। এছাড়া তিনি আরো ঘোষণা নিয়ে এক ঘোষণাপত্র প্রেরণ করেন। যার মাধ্যমে তিনি ভারতীয়দের নানানভাবে আশ্বস্ত করেন।

এই ঘোষণাপত্রে বলা হয় — 
১. ভারতবাসীর ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। 
২. জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতাসম্পন্ন ভারতীয়দের চাকরিতে নিযুক্ত করা হবে। 
৩. স্বত্ববিলোপ নীতি ও অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি পরিত্যক্ত হবে। 
৪. স্বাক্ষরিত সন্ধি ও চুক্তিগুলিকে মান্য করা হবে। 
৫. বন্দি সিপাহী ও ভারতীয়দের মুক্তি দেওয়া হবে।

প্রশাসনিক পরিবর্তন 
বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে ভিক্টোরিয়া ভারত শাসন আইন পাশ করেন। ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রিসভার ও পার্লামেন্ট মহাসভার অধীনে ভারতের শাসনকে আনা হয়। ব্রিটিশ মন্ত্রীসভায় একজন ভারত বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। তার খেতাব হয় "ভারত সচিব"। তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার পক্ষে ভারতবাসীর প্রধান হন। ভারত সচিবকে পরামর্শ দানের জন্য ১৮৫৮ সালে আইনে একটি কাউন্সিল গঠন করা হয়। আগের মতো বড়লাট তার ক্ষমতায় থাকেন। তবে তার উপাধি হয় গভর্ণর জেনারেল ও ভাইসরয়। প্রথম ভাইসরয় হয় লর্ড ক্যানিং।

আগের ডিরেক্টর সভা ও বোর্ড অব কন্ট্রোল-এর যাবতীয় ক্ষমতা দেওয়া হয় ভারত সচিব নামে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার এক ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে। ভারত সচিবকে সাহায্যের জন্য ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠন হয় ইন্ডিয়ান কাউন্সিল। ১৮৬১ সালের কাউন্সিল আইন পাশ করে ভাইসরয়ের আইন পরিষদে ৬-১২ জন সদস্যের মধ্যে বেসরকারি ইংরেজ ও ভারতীয়নের সংখ্যা অর্ধেক হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে লর্ভ মেয়ো, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে লর্ড লিটন ও ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ক্যানিং বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করে প্রাদেশিক শাসন পরিষদ ও আইনসভাগুলিকে কিছু কিছু ক্ষমতা দান করেন।

প্রদেশগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষমতা দান করায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় উন্নতি হয়। স্থানীয় পৌরসভা ও জেলা বোর্ডগুলি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জলের বন্দোবস্ত প্রভৃতি উন্নতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার উন্নতিতে লর্ড রিপনের নাম স্মরণীয়। ১৮৭৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতসম্রাজ্ঞী বলে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে ভারতীয় রাজন্যবর্গ হন তার অধীনস্থ সামন্ত বা প্রজা।

সামরিক বিভাগের পরিবর্তন 
ভারতের সামরিক বিভাগকে নতুন করে গঠন করা হয়। দেশীয় সৈন্যসামন্তের সংখ্যা হ্রাস করে ইংরেজ সৈন্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। প্রেসিডেন্সি সেনাবাহিনীকে পৃথক করা হয়। গোলন্দাজ বাহিনীতে ভারতীয়দের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়। সীমান্তরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার দায়িত্ব ইউরোপীয় সামরিক কর্মচারীদের উপর অর্পণ করা হয়। বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ বন্দি অবস্থায় রেঙ্গুনে প্রেরিত হন এবং তার পুত্র ও পৌত্রগণকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এভাবে মুঘল বংশের অবসান ঘটে। একইসাথে অনেক মুসলিম স্বাধীনতাকামী নেতাদের নির্বাসন ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে ইংরেজ সরকার। 

ভারতে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ 
বিদ্রোহ ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে সাধারণ ভারতবাসী তার রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠলো এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে ক্রমশ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে সিপাহী বিদ্রোহ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করে। ভারতবাসীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ে। ডাক-তার-রেল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ও আদানপ্রদান বৃদ্ধি পেল। জেগে উঠল সংঘ চেতনা। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী রাজনীতি সম্প্রসারিত হওয়া শুরু করেছিলো। একইসাথে ইংরেজদের পক্ষের সুবিধাভোগী শিক্ষিত শ্রেণিও তৈরি হয়েছিলো।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন