যাকাতের খাত নির্ধারিত হয়েছে সূরা তাওবার ৬০ নং আয়াতের মাধ্যমে। এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত, যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
-সূরা তাওবা : ৬০
মূলত যাকাতের হিসেব করা, আদায় করা ও বন্টন করার জন্য সরকারের একটি কমিটি/ ফাউন্ডেশন/ মন্ত্রণালয় থাকবে। তারাই সেগুলো হিসেব, কালেকশন ও বন্টন করবে। যদি কল্যাণরাষ্ট্র হয় তবে এমনটা হবে। যাকাতবিহীন কোন রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্র হতে পারে না। যদিও ইদানিং কল্যাণরাষ্ট্রের নানান ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মুসলিমদের থেকেই। তারা কীভাবে যাকাত প্রতিষ্ঠা ছাড়া কল্যাণরাষ্ট্রের রূপরেখা দাঁড় করায় তা আমার দুর্বল মাথায় ধরে না।
যাই হোক, যদি সেরকম রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা না থাকে তবে প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। যাকাত কায়েমের চেষ্টা করা। এটা ফরজ। এটাকে আপনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাওহীদ প্রতিষ্ঠা, ইকামাতে দ্বীন, কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যা ইচ্ছে বলতে পারেন। তবে করতে হবে। যে সমাজে নামাজ, যাকাত প্রতিষ্ঠা নেই সে সমাজে বসবাস করে যদি আমি সন্তুষ্ট থাকি এবং এগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ না করি তবে বুঝতে হবে আপনি সঠিক পথে নাই। আমি ভুল পথে আছি। তাহলে আমাদের সবার এই বিষয়টা পর্যালোচনা জরুরি।
আচ্ছা এবার আসি খাত নিয়ে কথা। খাত নিয়ে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ক্লিয়ার করে দিয়েছেন। এর পরেও যা বলার তা হলো।
প্রথমত,
ফকির এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যে নিজের জীবিকার ব্যাপারে অন্যের উপর নির্ভরশীল। কোনো শারীরিক ত্রুটি বা বার্ধ্যক্যজনিত কারণে কেউ স্থায়ীভাবে অন্যের সাহায্যের নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে অথবা কোন সাময়িক কারণে আপাতত কোন ব্যক্তি অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে এবং সাহায্য সহায়তা পেলে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, এ পর্যায়ের সব ধরনের অভাবী লোকের জন্য সাধারণভাবে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাদের যাকাত দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত,
যারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপায়-উপকরণ লাভ করতে পারেনি, ফলে অত্যন্ত অভাব ও দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এর মধ্যে অনেকে আছে তাদের মর্যাদা সচেতনতার জন্য কারোর সামনে তাদের হাত পাততে পারে না। আরো সহজ করে বলতে চাইলে যারা তাদের বেসিক প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে পারে না। এদের যাকাত দিতে হবে।
তৃতীয়ত,
যারা যাকাত ম্যানেজমেন্টের সাথে জড়িত তাদের পারিশ্রমিক যাকাতের সম্পদ থেকে দেওয়া যাবে।
চতুর্থত,
এখানে নানান কারণে যাকাতের টাকা খরচ করা যেতে পারে। মোট কথা বিধর্মীদের মনোরঞ্জন করার জন্য যাতে করে ইসলামের উপকার হয়।
১- এরকম লোক যারা ইসলাম বিদ্বেষী তাদের যাকাতের টাকা থেকে কিছু উপহার বা বৃত্তি দিলে তাদের বিদ্বেষের পরিমাণ কিছুটা কমবে।
২- অমুসলিম দেশ বা গোষ্ঠীর কোনো গোয়েন্দা যার থেকে টাকার বিনিময়ে অমুসলিমদের তথ্য পাওয়া যাবে।
৩- এমন লোক যারা ইসলামের প্রতি আগ্রহী, যাকাত থেকে তাদের জন্য কিছু দিলে তারা ইসলাম কবুল করার সম্ভাবনা রয়েছে।
৪- অভাবী অমুসলিম যাদের বিপদে দাঁড়ালে তারা ইসলামের প্রতি দূর্বল হবে এমন।
৫- এই লোকদের জন্য ফকির মিসকিন বা অভাবী হওয়ার প্রয়োজন নেই। ধনী হলেও ইসলামের কল্যাণে তাদের জন্য যাকাত থেকে খরচ করা যাবে। আবার অভাবী হলেও খরচ করা যাবে।
পঞ্চমত,
দাসদেরকে দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। এটা এখন আর প্রয়োজন নেই।
ষষ্ঠত,
যারা ঋণগ্রস্থ এবং ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ রাখছেন না। ঋণের কারণে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাদের যাকাত থেকে সহায়তা করা যাবে।
সপ্তমত,
ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে অর্থব্যয় ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেসব সৎকাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এমন সমস্ত কাজই এর অন্তরভুক্ত। এ কারণে কেউ কেউ এমত পোষণ করেছেন যে, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে যাকাতের অর্থ যে কোন সৎকাজে ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথম যুগের ইমামগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যে মত পোষণ করেছে সেটিই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। তাদের মতে এখানে আল্লাহর পথে বলতে আল্লাহর পথে জিহাদ বুঝানো হয়েছে।
অর্থাৎ যেসব প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য কুফরী ব্যবস্থাকে উৎখাত করে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। যেসব লোক এ প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম রত থাকে, তারা নিজেরা সচ্ছল ও অবস্থাসম্পন্ন হলেও এবং নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করার প্রয়োজন না থাকলেও তাদের সফর খরচ বাবদ এবং বাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম ইত্যাদি সংগ্রহ করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে যারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সমস্ত সময় ও শ্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে এ উদ্দেশ্য নিয়োজিত করে তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যও যাকাতের অর্থ এককালীন বা নিয়মিত ব্যয় করা যেতে পারে।
জিহাদ জি সাবিলিল্লাহ যুদ্ধের চাইতে আরো ব্যাপকতর জিনিসের নাম। কুফরের বাণীকে অবদমিত এবং আল্লাহর বাণীকে শক্তিশালী ও বিজয়ী করা আর আল্লাহর দ্বীনকে একটি জীবন ব্যবস্থা হিসেবে কায়েম করার জন্য দাওয়াত ও প্রচারের প্রথমিক পর্যায়ে অথবা যুদ্ধ বিগ্রহের চরম পর্যায়ে যেসব প্রচেষ্টা ও কাজ করা হয়, তা সবই এ জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহর আওতাভুক্ত।
অষ্টমত,
বিপদ্গ্রস্থ মুসাফির। তিনি নিজের গৃহে ধনী হলেও সফরের মধ্যে যদি সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তাহলে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে।
এখন যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন কাকে যাকাত দিবো? সেক্ষেত্রে আমার উত্তর হবে প্রথমে আপনি দেখবেন আপনার আত্মীয়দের মধ্যে কেউ এই খাতগুলোর মধ্যে পড়েন কিনা। যদি পড়েন তবে অবশ্যই তাঁকে যাকাত দিবেন। এরপর দেখবেন আপনার প্রতিবেশিদের মধ্যে কেউ এই সমস্যায় আছে কিনা? যদি থাকে তবে তাদের দিবেন।
এরপর আপনার যাকাত পাওয়ার সর্বোচ্চ হক রয়েছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ খাত। আপনার আত্মীয় ও প্রতিবেশিদের মধ্যে যাকাতের হকদার থাকলেও কিছু অংশ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ'র জন্য অবশ্যই রাখবেন। এটি অতীব জরুরি। বর্তমান যাকাতবিহীন সমাজ উৎখাতে এবং যাকাত কায়েমের জন্য আপনার যাকাত ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ।
বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য :
অমুসলিমদের যাকাত দেওয়া হবে খাওয়ার জন্য, ভোগ করার জন্য। ম্যানেজমেন্ট করার জন্য নয়। আপনার যাকাত ম্যানেজমেন্ট করার জন্য কোনো অমুসলিম ও সেক্যুলার সংস্থাকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
সবচেয়ে ভালো নিজের যাকাত নিজেই অভাবীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আর না পারলে এমন কোনো সংস্থাকে দিতে হবে যারা 'ইসলামী রাষ্ট্র' কনসেপ্ট লালন করে এবং সেজন্য কাজ করে। এর বাইরে অন্য কাউকে ম্যানেজমেন্ট করতে দিলে আপনার যাকাত যথাযথভাবে আদায় হবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন