দীর্ঘ আন্দোলন ও অরাজক পরিস্থিতির কারণে ইংরেজরা ভারতে তাদের শাসনকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। তার উপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে সেনা সংকট, অর্থ সংকট ইত্যাদি পরিস্থিতি ব্রিটিশদের সক্ষমতাকে দূর্বল করে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে ও ব্রিটিশদের পক্ষে রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৩৫ সালের 'ভারত শাসন আইন' নামে একটি আইন ব্রিটিশ সরকার তৈরি করে। এটা ছিল নামকাওয়াস্তে স্বায়ত্বশাসন প্রদানের আইন। শুরুতে কংগ্রেস নেতারা এই আইন মেনে না নিলেও পরবর্তীতে এই আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আইন তারা মেনে নেয়।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিলো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা ফেডারেল গভর্নমেন্ট। এতে বলা হয়, ভারত শাসন আইন অনুসারে ভারতে ব্রিটিশশাসিত প্রদেশ, দেশীয় রাজ্য এবং চিফ কমিশনার শাসিত প্রদেশগুলিকে নিয়ে এক সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পরিচালক হন গভর্নর জেনারেল । গভর্নর জেনারেল তাঁর মনোনীত তিনজন সদস্য নিয়ে একটি পরিষদ গঠন করবেন। এই তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিষদের সাহায্যে গভর্নর জেনারেল ভারতবর্ষের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, খ্রিস্টধর্ম প্রচার সংক্রান্ত বিষয় পরিচালনা করবেন। অন্যান্য বিষয়গুলি পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। মন্ত্রীগণ তাঁদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকবেন। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে, যেমন দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা ইত্যাদি ব্যাপার গভর্নর জেনারেল মন্ত্রিসভার পরামর্শ গ্রহণ নাও করতে পারবেন।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আইনসভা দুটি পরিষদ নিয়ে গঠিত হবে। উচ্চকক্ষের নাম হবে রাষ্ট্রীয় পরিষদ (Council of States) এবং নিম্নকক্ষের নাম হবে ব্যবস্থা পরিষদ (Federal Assembly)। রাষ্ট্রীয় পরিষদ একটি স্থায়ী সংসদ হবে এবং এর এক তৃতীয়াংশ সদস্যের প্রতি তিন বছর অন্তর কার্যকাল শেষ হবে এবং সেই জায়গায় নতুন সদস্য নেওয়া হবে। অবসর গ্রহণকারী সদস্যরা পুনর্নির্বাচিত হতে পারবেন। রাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা হবে অনধিক ২৬০। এদের মধ্যে ১৫৬ জন ব্রিটিশ শাসিত ভারত থেকে নির্বাচিত হবেন এবং অনধিক ১০৪ জন দেশীয় রাজ্যের শাসকদের দ্বারা মনোনীত হবেন। নিম্নকক্ষ ব্যবস্থা পরিষদ (Federal Assembly) পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হবে। এর সদস্য সংখ্যা হবে অনধিক ৩৭৫ । ব্রিটিশ শাসিত ভারত থেকে ২৫০ জন এবং দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে ১২৫ জন সদস্য পরিষদের জন্য নির্বাচিত হবেন।
আইনটিকে বিশ্লেষন করলে যা পাওয়া যায়
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে-
১- যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত গঠন। এই আইনে ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। দেশীয় রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেওয়া ঐচ্ছিক হিসাবে গণ্য করা হয়।
২- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। কেন্দ্রে পাঁচ বছর মেয়াদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের সিন্ধান্ত নেওয়া হয়। নিম্নকক্ষ ফেডারেল এসেম্বলি ৩৭৫ জন এবং উচ্চকক্ষ কাউন্সিল অব স্টেট ২৬০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে বলে ঘোষিত হয়।
৩- গভর্নর জেনারেলের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার দেওয়া হবে। মন্ত্রীরা কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন বলে জানানো হয়।
৪- গভর্নর জেনারেল তাঁর কাজের জন্য সরাসরি ভারত-সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন।
৫- শাসন ক্ষমতা বিভক্তিকরণ। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন ক্ষমতকে সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এই দুভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক, ব্যাংক ইত্যাদি সংরক্ষিত বিষয়ে গভর্নর জেনারেলের হাতে দেওয়া হয়।
৬- গভর্নর জেনারেল শাসন পরিচালনায় চূড়ান্ত ক্ষমতা লাভ করেন। এছাড়া 'সোচ্ছাধীন ক্ষমতা' ও 'স্ববিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা' ভোগ করতেন।
৭- কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতার তালিকা। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টনের উদ্দেশ্যে তিনটি পৃথক তালিকা তৈরি করা হয়। ক) কেন্দ্রীয় তালিকা, খ) প্রাদেশিক তালিকা, গ) যুগ্ম তালিকা।
প্রাদেশিক সরকারের ক্ষেত্রে-
১- প্রদেশগুলিতে দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বায়ত্তশাসন প্ৰতিষ্ঠা করা হয়।
২- বাংলা-সহ ছয়টি প্রদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং অবশিষ্ট পাচঁটিতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রাখা হয়।
৩- প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
৪- কেন্দ্রের অনুকরণে প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা, ধর্ম ইত্যাদির দায়িত্ব গভর্নরের হাতে দেওয়া হয়।
৫- গভর্নরকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রদেশের গভর্নর আইন প্রণয়ন ও নাকচ করার অধিকারী হবেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। বৃটিশ ভারতের জনগণের জাতীয়তাবোধের উত্তরোত্তর উন্মেষ, রাজনৈতিক চেতনা বিকাশ, দেশাত্মবোধের ক্রমবিকাশ ও ১৯১৯ সালের আইনের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার শ্বেতপত্র নামক সংস্কার ঘোষণা করে। এটাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এ আইনই পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ভিত্তি রচনা করে। এসব দিক থেকে বিচার করলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৯১৯ সালের মন্টফোর্ড আইন ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে বিফল হয়। ফলে এ আইনের বিরুদ্ধে কংগ্রেস থেকে তীব্র সমালোচনা আসে। এছাড়া ১৯২০-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৩০-৩৫ সালের আইন অমান্য আন্দোরন দ্বারা কংগ্রেস যথাক্রমে স্বরাজ ও পূর্ণ স্বরাজ দাবি করে। এতে বৃটিশ সরকার উপলব্ধি করে নতুন সংবিধান প্রবর্তন না করা পর্যন্ত কংগ্রেসের আন্দোলন দমানো যাবে না। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তদন্ত করার জন্য বৃটিশ সরকার ১৯২৮ সালের সাইমনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। কিন্তু কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য না থাকায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দল এ কমিশন বাতিল করে। সাইমন রিপোর্টের পাশাপাশি মতিলাল নেহুরুর সভাপতিত্বে একটি বেসরকারি কমিটি নেহেরু রিপোর্ট পেশ করে। এতে কংগ্রেসের আন্দোলনের কথাই প্রতিফলিত হলেও হিন্দু-মুসলিম অনৈক্য বড় আকারে দেখা দেয়।
১৯২৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর গান্ধী-ডারউইন বৈঠকে ভারতের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং দায়িত্বশীল সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে ভাইসরয় কোন আশ্বাস দিতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে ২৯ জন অনুসারিকে নিয়ে ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ গান্ধী সমুদ্র সৈকতের দিকে যাত্রা শুরু করেন। ২৪ দিনে ২০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করেন। এ মিছিল ডান্ডি মিছিল নামে পরিচিত। লবণ আইন ভঙ্গের মাধ্যমে গান্ধী দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরুর ইঙ্গিত দেন। আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে ছিল-
(ক) লবণ আইন ভঙ্গ করা
(খ) ছাত্রদের শিক্ষালয় এবং কর্মচারীদের সরকারি অফিস বর্জন
(গ) মদ, অফিম ও বিদেশি পণ্য বর্জন
(ঘ) কর খাজনা প্রদান বন্ধ ইত্যাদি।
ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য তিনটি গোলটেবিল বৈঠক ১৯৩০-৩২ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গোলটেবিল বৈঠকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এসকল বৈঠকের অনেক প্রস্তাব ও সুপারিশ ১৯৩৫ সালের আইনে রূপ লাভ করে। বৃটিশ সরকার ভারতের সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে তাদের সকল সিদ্ধান্ত ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে এক পার্লামেন্টারী শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এই শ্বেতপত্রে উল্লেখিত বিভিন্ন প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৩৪ সালে ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া প্রকাশিত হয়। এই খসড়ার ভিত্তিতেই ১৯৩৪ সালে সুবিখ্যাত ৩২টি ধারা সম্বলিত ভারত শাসন আইন প্রণীত হয়। সবশেষে আমরা বলতে পারি, ভারতের জনগণ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক দাবির মুখে বৃটিশ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়। এই আইনের ভিত্তিতে ১৯৩৭ সালে উপমহাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন