১৭ অক্টো, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৫৬ : ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ভাসানীর বিশ্বাসঘাতকতা

১৯৬৪ সাল। পাকিস্তানের ১ম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী আচরণের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল একাট্টা। রাজনীতি থেকে অভিমান করে বিদায় নেয়া বাংলার অন্যতম প্রধান নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন কাছে হাজির হয়েছে সমসাময়িক অনেক নেতা। এর মধ্যে আওয়ামীলীগ সভাপতি আ. রশিদ তর্কবাগীশ, শেখ মুজিবসহ রয়েছেন অনেকে। 


তাদের দাবি পাকিস্তানকে রক্ষায় নাজিমুদ্দিন যেন আবার রাজনীতিতে ফিরে আসেন। আইয়ুবের বিরুদ্ধে যেন প্রেসিডেন্ট ইলেকশন করেন। বৃদ্ধ নাজিমুদ্দিন রাজি হননি। তবে তিনি আইয়ুব বিরোধী জোট গঠনে মধ্যস্থতা করতে রাজি হন। তিনি তার বাসায় কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী এই দলগুলোর নেতাদের ডাকেন। 


সব দল মিলে কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজ নামে একটি জোট করেন। জোটের নেতা হিসেবে থাকেন নাজিমুদ্দিন। ন্যাপের ভাসানী ওপরে আইয়ুব বিরোধী হলেও তিনি আইয়ুবের সমর্থক। কারণ আইয়ুব চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে যা আর কেউ করে নি। কম্বাইন্ড অপজিশনের সিদ্ধান্তগুলো আইয়ুবের কাছে মশিউর রহমান জাদু মিয়ার মাধ্যমে ফাঁস করে দেওয়া ছিল ভাসানীর অন্যতম কাজ। 


নাজিমুদ্দিন একটি গোপন পরিকল্পনা করেন। যেহেতু আইয়ুব সেনা অফিসার হিসেবে বেতন নেয় তাই প্রার্থীতা ঘোষণা করার পর তার প্রার্থীতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের করা হবে। এতে তার প্রার্থীতা বাতিল হবে। এই তথ্য পৌঁছে যায় আইয়ুবের কাছে। ব্যাস! আইয়ুব আগেই বেতন নেয়া বন্ধ করে দেয় এবং পেছনের তারিখ দিয়ে বেতন বন্ধের কার্যকারিতা অনুমোদন করে নিজেকে বাধামুক্ত করেন। 


এরপর আসলো বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের পালা। আইয়ুবের এজেন্সির পরামর্শক্রমে ভাসানী নাম প্রস্তাব করলেন ফাতিমা জিন্নাহ। এর কারণ ছিল ফাতিমা জিন্নাহর নাম শুনলে কেউ প্রস্তাব ফেলতে পারবে না তার ব্যাক্তিত্বের কারণে। তবে তিনি রাজনৈতিক নেতা নন। ক্যারিশমাটিক নেতাও নন। আবার সম্মানের কারণে তার প্রতি রাজি হলেও আদর্শিক কারণে জামায়াত ও নেজামে ইসলাম রাজি হবে না। 


ভাসানীর প্রস্তাবে তার দল ন্যাপ, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ রাজি হলো। নেজামে ইসলামও এক পর্যায়ে রাজি হলো। জামায়াতের গোলাম আযম রাজি হননি। তিনি সময় চেয়ে নেন। সেসময় মাওলানা মওদূদী কারাগারে ছিলেন বলে অধ্যাপক গোলাম আযমই জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। 


গোলাম আযম পাকিস্তানের তৎকালীন বিখ্যাত আলেম মাআরেফুল কুরআনের লেখক মুফতি শফির কাছে এই বিষয়ে জানতে চান। তিনি সংকটকালীন মুহুর্ত উত্তরণের জন্য কিছু সময়ের জন্য এই নেতৃত্ব মেনে নেওয়া জায়িজ বলে ফতোয়া দেন। উল্লেখ্য, ফাতিমা জিন্নাহ শর্তারোপ করেন, যদি তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তবে এক বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করবেন না। এক বছরের মধ্যেই সকলের ভোটাধিকার ফেরত এনে তিনি নতুন নির্বাচন দিবেন। তাই মুফতি শফি এই ফতোয়া দেন।


তারপর গোলাম আযম যান জেলখানায় মাওলান মওদূদীর কাছে। মাওলানা মওদূদী উত্তর করেন, জামায়াত ছাড়া যদি সবাই ঐক্যমত পোষণ করে তবে আমরাও ফাতিমা জিন্নাহর প্রতি সমর্থন দিতে পারি। কারণ, আইয়ুবের পুরুষ হওয়া কোনো গুণ নেই অন্যদিকে ফাতিমা জিন্নাহর মহিলা হওয়া ছাড়া কোনো দোষ নেই। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ফাতিমা জিন্নাহ ছাড়া আইয়ুবের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো অন্য কোনো সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিকল্প ইসলাপন্থীদের কাছে ছিল না। 


রাজনীতিবিদদের একটি সংকট তৈরি করেছে আইয়ুব ক্ষমতায় এসেই। ১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট প্রেসিডেন্ট আইয়ুব দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন। একটি হলো PODO, অন্যটি EBDO. পোডো মানে হলো পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার। আর এবডো মানে হলো ইলেক্টিব বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার। পোডো আইন প্রয়োগ করে অনেক রাজনীতিবিদের প্রতি অভিযোগ আনে আইয়ুব। সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয় রাজনীতিবিদদের। 


বিগত আমলে ঘটে যাওয়া কিছু দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে ফেলা আগে ক্ষমতায় থাকা অনেক রাজনীতিবিদদের। একতরফা সামরিক বিচারে অনেকেই হেনস্তা হন। যারা পোডো আইনে অভিযুক্ত হবে তারা এবডো আইনে ১৯৬৬ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে ও সরকারি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। এভাবে পুর্ব পাকিস্তানের ৪২ জন বাঙালি নেতা রাজনীতিতে অযোগ্য হয়ে পড়েন। 


তবে দুঃখজনক হলেও সত্য পোডো এবং এবডোর মুখোমুখি হতে চাননি ক্ষমতার শীর্ষে  থাকা তিন বাঙ্গালি নেতা। তারা হলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি এবং ফরিদপুরের মুসলিম লীগ নেতা মৌলভি তমিজুদ্দিন। মৌলভি তমিজুদ্দিন দীর্ঘদিন পাকিস্তান গণপরিষদের স্পিকার ছিলেন। তারা নিজেদের আত্মসমর্পন করে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ফজলুল হক আর রাজনীতিতে ফিরতে পারেন নি। সোহরাওয়ার্দি রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও আইয়ুব বিরোধী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। 


এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে পোডো প্রয়োগ হয়। সরকার দুর্নীতি প্রমাণ করে এবং এরপর এবডো প্রয়োগ হয়। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ম্যাসিভ দুর্নীতি প্রমাণ হয় এবং দুর্নীতির কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন। এভাবে আইয়ুব সারা পাকিস্তানে রাজনীতি শূন্য করে ফেলেন। এক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আলাদা থাকে না। তবে পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা অন্যান্য প্রদেশের চাইতে অধিক ক্ষমতায় ছিলেন বলে তারাই বেশি আক্রান্ত হয়েছেন।


আইয়ুব কোনোভাবেই জামায়াতকে আটকাতে পারে নি। রাজনীতি শূন্য অবস্থায় যখন মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগ চুপসে গেছে তখন আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে কন্ঠ উচ্চকিত রেখেছেন মাওলানা মওদূদী। তাকে কোনো আইনের মাধ্যমে ধরতে না পেরে জামায়াতের বিরুদ্ধে আইয়ুব রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনে। তার দাবি জামায়াত পাকিস্তানে বিশ্বাসী না। তাই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে। 


উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে বাকী থাকে ভাসানী ও খাজা নাজিমুদ্দিন। খাজা নাজিমুদ্দিন অনেক আগেই রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন বলে আইয়ুবের আক্রমণের শিকার হন নি। আর তাছাড়া তিনি বৃদ্ধও হয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে ভাসানী আর আইয়ুবের সম্পর্ক তো ছিল অন্যমাত্রায়। সেখানে ভাসানী তার আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা না।    


তাই অন্য কোনো ভালো বিকল্প না থাকায় সর্বসম্মতিক্রমে ফাতিমা জিন্নাহ কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন ফাতিমা জিন্নাহ। আইয়ুবের চিন্তা তাকে ভালো ফল এনে দিল।  আইয়ুব তার পক্ষের আলেমদের দিয়ে প্রচার করতে লাগলেন ইসলামী দলগুলো ইসলামবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছে। তারা নারী নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। পাকিস্তানের ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীই কেবল ভোটার। তাদের মধ্যে অনেকেই এই প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছিলো। 


১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুব নির্বাচনে জিতে যান। অবশ্য নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এমন অভিযোগ করতে পারেনি বিরোধী দলগুলো। ইত্তেফাক পত্রিকা রিপোর্ট করেছিলো দশ কোটি মানুষের পরাজয়। 


আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে ৫৩.১২ শতাংশ ভোট পেয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৭৩.৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ বাঙ্গালি সব দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিও বাঙালি মৌলিক গণতন্ত্রীদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। ফাতিমা জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে ৪৬.৬০ শতাংশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২৬.০৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে। তিনটি বিভাগে ফাতিমা আইয়ুবের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। সেগুলো হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং করাচি। 


ফাতিমা হেরে যাওয়ার কারণ দুটি। এক. ইসলামপন্থীরা ফাতিমা জিন্নাহর প্রতি একমত হতে পারে নি। দুই. ন্যাপের মৌলিক গণতন্ত্রীরা আইয়ুবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ইসলামপন্থীরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রের শুরুতে জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সময় ২২ দফা মূলনীতি তৈরি করেছিলো। সেখানে নারী নেতৃত্ব নিষিদ্ধ করার কথা বলেছিল। সেই জামায়াত ও নেজামে ইসলাম যখন ফাতিমা জিন্নাহর পক্ষে সমর্থন দেয় তখন মৌলিক গণতন্ত্রীদের কাছে ইসলামপন্থীদের উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর ন্যাপ ও আওয়ামীলীগের চীনপন্থীরা তাদের নেতা মূল নেতা মাও সে তুং এবং এদেশীয় নেতা ভাসানীর ইশারায় আইয়ুবকেই ভোট দিয়েছে। কম্বাইন্ড অপজিশনে একটি শক্তিশালী দল ছিল ন্যাপ। আর তারাই ছিল বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায়। 


ভাসানীর সহায়তায় ও ইসলামপন্থীদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে পাকিস্তানে আরো বেশি জেঁকে বসেছে স্বৈরাচারী সেনাশাসন।     

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন