৩০ নভে, ২০২০

যে নারীর চারিত্রিক পবিত্রতার সাক্ষী হয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা।


 

মুনাফিকদের অব্যাহত অপবাদে এক সম্মানিতা নারীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে পরিক্ষায় ফেলেছেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে তাঁর ধৈর্য দ্বারা তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার চরিত্রের নিষ্কলুষতা প্রমাণে মহান রব সূরা নূরের ১১ থেকে ২০ নং আয়াত নাজিল করেছেন। 


আসুন আমরা সেই ঘটনা ভিকটিমের মুখেই শুনি।  


সফরে যাওয়ার সময় তিনি (রাসূল সা.) তাঁর স্ত্রীদের নামে লটারী ফেলতেন। লটারীতে যার নাম উঠতো তাকে তিনি সাথে নিয়ে যেতেন। ঘটনাক্রমে বনু মুস্তালিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গমনের সময় লটারীতে আমার নাম ওঠে। আমি তাঁর সাথে গমন করি। আমি আমার পালকিতে বসে থাকতাম। যখন কাফেলা কোনো জায়গায় অবতরণ করতো তখন আমার পালকি নামিয়ে নেওয়া হতো। আমি পালকিতেই থাকতাম। আবার যখন কাফেলা চলতে শুরু করতো তখন আমার পালকি উটের ওপর উঠিয়ে দেয়া হতো। 


যাই হোক যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর আমরা মদিনার পথে ফিরতে শুরু করি। আমরা মদীনার নিকটবর্তী এক স্থানে পৌঁছলে রাত্রে যাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ভোরে আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ি এবং সেনাবাহিনীর তাবু থেকে বহু দূরে চলে যাই। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করে আমি আবার ফিরে আসি। সেনাবাহিনীর তাঁবুর নিকটবর্তী হয়ে আমি গলায় হাত দিয়ে দেখি যে, গলায় হার নেই। আমি তখন হার খুঁজবার জন্যে আবার ফিরে যাই এবং হার খুঁজতে থাকি। 


এদিকে সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করে দিলো। যে লোকগুলো আমার পালকি উঠিয়ে দিতো তারা মনে করলো যে, আমি পালকির মধ্যেই রয়েছি, তাই তারা আমার পালকিটি উটের পিঠে উঠিয়ে দিলো এবং চলতে শুরু করলো। এখানে উল্লেখ্য যে, আমি খুবই শীর্ণকায় ও হালকা ছিলাম। তাই আমাকে বহনকারীরা পালকির মধ্যে আমার থাকা বা না থাকার বিষয়টি টেরই পেলো না। তাছাড়া আমি ছিলাম ঐ সময় খুবই অল্প বয়সের মেয়ে। 


যাই হোক দীর্ঘক্ষণ পর আমি আমার হারানো হারটি খুঁজে পেলাম। সেনাবাহিনীর বিশ্রামস্থলে এসে আমি কোন মানুষের নাম নিশানাও পেলাম না। আমার চিহ্ন অনুযায়ী আমি ঐ জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে আমার উটটি বসা ছিল। সেখানে আমি এ অপেক্ষায় বসে পড়লাম যে, তিনি (রাসূল সা.) ও সেনাবাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে যখন আমার না থাকার খবর পাবেন তখন অবশ্যই এখানে লোক পাঠাবেন। বসে থাকতে থাকতে আমার ঘুম এসে যায়। 


হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল রা. যিনি মূল কাফেলা থেকে পিছনে ছিলেন এবং তার দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া কিছু থাকলে নিয়ে আসা। তিনি যখন একজন আসলেন তখন আমাকে দেখতে পেলেন। পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন বলে দেখামাত্রই চিনে ফেলেন এবং উচ্চ স্বরে বললেন, ইন্নালিল্লাহ। তার এ শব্দ শোনা মাত্রই আমার চক্ষু খুলে যায় এবং আমি চাদর দিয়ে আমার মুখটা ঢেকে ফেলে নিজেকে সামলিয়ে নিই। 


তৎক্ষণাৎ তিনি তার উটটি বসিয়ে দেন এবং আমাকে উটে উঠতে বলেন। আমি উঠে উটের উপর সওয়ার হয়ে যাই। তিনি উটকে উঠিয়ে চালাতে শুরু করেন। আল্লাহর শপথ! তিনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি এবং আমিও তার সাথে কোন কথা বলিনি। প্রায় দুপুর বেলায় আমরা আমাদের যাত্রীদলের সাথে মিলিত হই। এটুকু ঘটনাকে কেন্দ্র করেই অভিশপ্তরা তিলকে তাল করে প্রচার শুরু করে দেয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা রচনাকারী ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। 


মদীনায় এসেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং এক মাস পর্যন্ত রোগে ভুগতে থাকি। এই সময়ে বাড়িতেই অবস্থান করি। এই সময়ের মধ্যে আমি নিজেও কিছু শুনিনি এবং কেউ আমাকে কোনো কথা বলেওনি। আলোচনা সমালোচনা যা কিছু হচ্ছিল তা লোকদের মধ্যেই হচ্ছিল। আমি ছিলাম এ থেকে সম্পূর্ণরূপে বে-খবর। তবে মাঝে মাঝে এরূপ ধারণা আমার মনে জেগে উঠতো যে, আমার প্রতি রাসূলুল্লাহ সা.-এর যে প্রেম ও ভালবাসা ছিল তা কমে যাওয়ার কারণ কি! অন্যান্য সময় আমি রোগাক্রান্তা হলে তিনি আমার প্রতি যে ভালবাসা দেখাতেন, এই রোগের অবস্থায় আমি তা পেতাম না। এজন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখ হতাম, কিন্তু এর কোন কারণ খুঁজে পেতাম না। তিনি আমার কাছে আসতেন, সালাম দিতেন এবং অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন। এছাড়া তিনি আর কিছু বলতেন না। এতে আমি অত্যন্ত দুঃখ পেতাম। কিন্তু অপবাদদাতাদের অপবাদ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। 


ঐ সময় পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে পায়খানা নির্মিত হয়নি এবং আরবদের প্রাচীন অভ্যাসমত আমরা আমাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার জন্যে দূরের মাঠে গমন করতাম। স্ত্রী-লোকেরা সাধারণত রাত্রেই যেতো। বাড়িতে পায়খানা তৈরি করতে মানুষ সাধারণভাবে ঘৃণাবোধ করতো। অভ্যাসমত আমি উম্মে মিসতাহ'র সাথে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার জন্যে গমন করি। ঐ সময় আমি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এই উম্মে মিসতাহ আমার আব্বার খালা ছিলেন।  


আমরা যখন বাড়ি ফিরতেছিলাম তখন হযরত উম্মে মিসতাহর পা তার চাদরের আঁচলে জড়িয়ে পড়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে যে, মিসতাহ্ ধ্বংস হোক। এটা আমার কাছে খুবই খারাপবোধ হয়। আমি তাকে বলি, তুমি খুব খারাপ কথা উচ্চারণ করেছ, সুতরাং তাওবা কর। তুমি এমন লোককে গালি দিলে যে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তখন উম্মে মিসতাহ বলে, “হে সরলমনা মেয়ে! আপনি কি কিছুই খবর রাখেন না?” 


আমি বলি, ব্যাপার কী? সে উত্তরে বলে, “যারা আপনার উপর অপবাদ আরোপ করেছে তাদের মধ্যে সেও একজন। তার একথায় আমি খুবই বিস্ময়বোধ করি এবং তাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি খুলে বলতে অনুরোধ করি। সে তখন অপবাদদাতাদের সমস্ত কার্যকলাপ আমার কাছে খুলে বলে। এতে আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার উপর দুঃখ ও চিন্তার পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। এই চিন্তার ফলে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ি। 


আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, বাবার বাড়ি গিয়ে খবরটা ভালোভাবে জানবো। সত্যিই কি আমার বিরুদ্ধে এসব গুজব রটে গেছে! কি কি খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা আমি সঠিকভাবে জানতে চাই। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সা. আমার নিকট আগমন করেন এবং সালাম দিয়ে আমার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। আমি তাঁকে বললাম, আমাকে আপনি আমার পিতার বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিন! তিনি অনুমতি দিলেন এবং আমি পিতার বাড়ি চলে গেলাম। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মাজান! লোকদের মধ্যে আমার সম্পর্কে কি কথা ছড়িয়ে পড়েছে? উত্তরে তিনি বলেনঃ “হে আমার কলিজার টুকরো! এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। এতে তোমার মন খারাপ করার কোনই কারণ নেই। যে স্বামীর কাছে তার কয়েকজন স্ত্রীর মধ্যে কোন একজন স্ত্রী খুবই প্রিয় হয় সেখানে এরূপ ঘটনা ঘটে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।” 


তখন আমি শোকে ও দুঃখে এতো মুষড়ে পড়ি যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তখন থেকে যে আমার কান্না শুরু হয়, তা ক্ষণেকের জন্যেও বন্ধ হয়নি। আমি মাথা নীচু করে শুধু কাঁদতেই থাকি। কারণ আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি রাসূল সা.-এর আচরণ পরিবর্তন করার কারণ অভিশপ্তদের অপবাদ। পানাহার, শোয়া, বসা, কথা বলা সবকিছুই বাদ দিয়ে আমার একমাত্র কাজ হয় চিন্তা করা, আর না হয় কাঁদা। সারারাত এভাবেই কেটে যায়। এক মুহূর্তের জন্যেও আমার অশ্রু বন্ধ হয়নি। দিনেও ঐ একই অবস্থা। 


রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাছে ওহি আসতে বিলম্ব হয়। তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ছিলেন। তাই তিনি পরামর্শ করার জন্য হযরত আলী রা. ও হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রা.-কে ডেকে পাঠান। তিনি আমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নিবেন তার ব্যাপারে এ দু’জনের সাথে পরামর্শ করেন। হযরত উসামা রা. স্পষ্টভাবে বলে দেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আপনার এ স্ত্রীর কোনো মন্দগুণ আমার জানা নেই। আমাদের হৃদয় তাঁর মহব্বত, মর্যাদা ও তার সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে সদাবিদ্যমান রয়েছে। 


তবে হযরত আলী রা. বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আপনার ওপর কোন সংকীর্ণতা নেই। তিনি ছাড়া আরও বহু স্ত্রীলোক রয়েছে। আপনি তাঁকে তালাক দিয়ে অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। (হযরত আলী রা.-এর এই মন্তব্য এজন্য নয় যে, তিনি আয়িশা রা.-কে সন্দেহ করেছেন। বরং এজন্য যে, তাঁকে নিয়ে ব্যাপক কথা হচ্ছে। এজন্য রাসূল সা. বিচলিত হয়ে আছেন। এমতাবস্থায় তাঁকে তালাক দিয়ে রাসূল সা. যাতে এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারেন। কিছু উগ্রপন্থী শিয়ারা আলী রা.-এর এই মন্তব্যকে পুঁজি করে আয়িশা রা.-কে এখনো অপবাদ দেন। এটা সুস্পষ্ট কুফুরি। কারণ আয়িশা রা. চরিত্রের নিষ্কলুষতা কুরআন দ্বারা স্বীকৃত)


আলী রা. রাসূল সা.-কে আরো বলেন, আপনার বাড়ীর চাকরানীকে জিজ্ঞেস করলে তার (আয়িশা) সম্পর্কে আপনি সঠিক তথ্য জানতে পারবেন। রাসূলুল্লাহ সা. তৎক্ষণাৎ বাড়ির চাকরানী হযরত বুরাইরা রা.-কে ডেকে পাঠান। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তোমার সামনে আয়েশা রা.-এর এমন কোনো কাজ কি প্রকাশ পেয়েছে যা তোমাকে সন্দেহের মধ্যে ফেলেছে? উত্তরে হযরত বুরাইরা রা. বলেন, “আল্লাহর শপথ! তার এ ধরনের কোনো কাজ আমি কখনো দেখিনি। হ্যাঁ, তবে এটুকু শুধু দেখেছি যে, তাঁর বয়স অল্প হওয়ার কারণে মাঝে মাঝে আটা মাখাতে গিয়ে  ঘুমিয়ে পড়েন এবং এই সুযোগে বকরি এসে ঐ আটা খেয়ে নেয়। এছাড়া তাঁর অন্য কোনো ত্রুটি আমার চোখে ধরা পড়েনি। 


এ ঘটনার কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না বলে ঐ দিনই রাসূলুল্লাহ সা. মিম্বরে ওঠে জনগণকে সম্বোধন করে বলেন, “কে এমন আছে। যে আমাকে ঐ ব্যক্তির অনিষ্ট ও কষ্ট থেকে বাঁচাতে পারে যে আমাকে কষ্ট দিতে দিতে ঐ কষ্ট আমার পরিবার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে শুরু করেছে? আল্লাহর শপথ! আমার জানামতে আমার এ পত্নীর মধ্যে ভাল গুণ ছাড়া মন্দ গুণ কিছুই নেই। তার সাথে যে ব্যক্তিকে তারা এ কাজে জড়িয়ে ফেলেছে তার মধ্যেও সততা ছাড়া আমি কিছুই দেখিনি। সে আমার সাথেই আমার বাড়ীতে প্রবেশ করতো।” 


রাসূলুল্লাহ সা.-এর একথা শুনে হযরত সা'দ ইবনে মুয়াজ রা. দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমি প্রস্তুত রয়েছি। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তবে এখনই আমি তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। আর যদি সে আমাদের খাযরাজী ভাইদের মধ্যকার লোক হয় তবে আপনি নির্দেশ দিন, আমরা আপনার নির্দেশ পালনে মোটেই ত্রুটি করবো না।” 


তার একথা শুনে হযরত সা’দ ইবনে উবাদা রা. দাড়িয়ে যান। তিনি খাযরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন। তিনি খুবই সৎ লোক ছিলেন। কিন্তু হযরত সা'দ বিন মুয়াজের রা.-এর ঐ সময়ের ঐ উক্তির কারণে তার গোত্রীয় মর্যাদায় আঘাত লাগে। তাই তিনি হযরত সা’দ ইবনে মুয়াজ রা.-কে সম্বোধন করে বলেনঃ “তুমি মিথ্যা বললে। না তুমি তাকে (আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই) হত্যা করবে, না তুমি তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে। সে যদি তোমার গোত্রের লোক হতো তবে তুমি তার নিহত হওয়া কখনো পছন্দ করতে না।” 


তাঁর একথা শুনে হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়ের রা. দাড়িয়ে যান। তিনি ছিলেন হযরত সা'দ ইবনে মুআয রা.-এর ভাতুস্পুত্র। তিনি বলতে শুরু করেনঃ “হে সা’দ ইবনে উবাদা। আপনি মিথ্যা বললেন। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করবো। আপনি মুনাফিক বলেই মুনাফিকদের পক্ষপাতিত্ব করছেন। এভাবে পাল্টাপাল্টি কথাবার্তায় আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়। রাসূলুল্লাহ সা. মিম্বরের ওপর থেকেই তাদের থামিয়ে দেন। অবশেষে উভয় দল নীরব হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও নীরবতা অবলম্বন করেন। 


আর এদিকে আমার অবস্থা এই ছিল যে, সারাদিন আমার কান্নাতেই কেটে যায়। আমার পিতা-মাতা ধারণা করলেন যে, এ কান্না আমার কলেজা ফেড়েই ফেলবে। বিষণ্ণ মনে আমার পিতা-মাতা আমার নিকট বসেছিলেন এবং আমি কাঁদছিলাম। এমন সময় আনসারের একজন স্ত্রীলোক আমাদের নিকট আগমন করে এবং সেও আমার সাথে কাঁদতে শুরু করে। আমরা সবাই এভাবেই বসেছিলাম এমতাবস্থায় অকস্মাৎ রাসূলুল্লাহ সা.-এর সেখানে আগমন ঘটে। তিনি সালাম দিয়ে আমার পাশে বসে পড়েন। 


আল্লাহর কসম! যখন থেকে এই অপবাদ ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকে নিয়ে ঐ দিনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আমার পাশে বসেননি। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর অবস্থা ঐরূপই ছিল। এ সময়ের মধ্যে তাঁর ওপর কোনো ওহী অবতীর্ণ হয়নি। কাজেই কোনো সিদ্ধান্তেই তিনি পৌঁছতে পারেননি। বসেই তিনি তাশাহহুদ পাঠ করেন। অতঃপর বলেনঃ “হে আয়েশা! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এ খবর পৌঁছেছে। যদি তুমি সত্যিই সতী-সাধ্বী থেকে থাকো তবে আল্লাহ তা'আলা তোমার পবিত্রতা ও সতীত্বের কথা প্রকাশ করে দিবেন। আর যদি প্রকৃতই তুমি কোনো পাপে জড়িয়ে পড়ে থাকো তবে আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাওবা করো। কারণ বান্দা যখন কোন পাপ কার্যে লিপ্ত হবার পর তা স্বীকার করে নিয়ে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে ও তাঁর কাছে ক্ষমা চায় তখন তিনি তাকে ক্ষমা করে থাকেন।” 


রাসূলুল্লাহ সা. এটুকু বলার পর নীরব হয়ে যান। তাঁর একথা শুনেই আমার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। অশ্রু শুকিয়ে যায়। এমন কি এক ফোঁটা অশ্রুও চোখে ছিল না। প্রথমে আমি আমার পিতাকে বললাম যে, তিনি যেন আমার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ সা.-কে জবাব দেন। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি তাঁকে কী জবাব দেবো তা বুঝতে পারছি না।” তখন আমি আমার মাতাকে লক্ষ্য করে বলি, আপনি আমার পক্ষ থেকে তাঁকে উত্তর দিন। কিন্তু তিনিও বলেন, “আমি তাঁকে কী উত্তর দেবো, তা খুঁজে পাচ্ছি না। 


তখন আমি নিজেই জবাব দিতে শুরু করলাম। আমার বয়সতো তেমন বেশী ছিল না এবং কুরআনও আমার বেশি মুখস্ত ছিল না। আমি বললাম, আপনারা সবাই একটা কথা শুনেছেন এবং মনে স্থান দিয়েছেন। আর হয়তো ওটা সত্য বলেই মনে করেছেন। এখন আমি যদি বলি যে, আমি এই বেহায়াপনা কাজ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং আল্লাহ তা'আলা খুব ভাল জানেন যে, আমি আসলেও এ পাপ থেকে সম্পূর্ণরূপেই মুক্ত, কিন্তু আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। অথচ আল্লাহ তা'আলা খুব ভালো করে জানেন যে, আমি সম্পূর্ণরূপে নিষ্পাপ। আল্লাহ বললেই আপনারা আমার কথা মেনে নিবেন। 


এখন আমার ও আপনাদের দৃষ্টান্ত তো সম্পূর্ণরূপে আবু ইউসুফের (হযরত ইউসুফের আ. পিতা হযরত ইয়াকুবের আ.) মতো। তিনি বলেছেন, ‘সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছে সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল।" (১২:১৮)। এটুকু বলেই আমি পার্শ্ব পরিবর্তন করি এবং আমার বিছানায় শুয়ে পড়ি। 


আল্লাহর কসম! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যেহেতু আমি পবিত্র ও দোষমুক্ত, সেহেতু আল্লাহ তা'আলা আমার দোষমুক্ত থাকার কথা রাসূল সা.-কে অবহিত করবেন। কিন্তু আমি এটা কল্পনাও করিনি যে, আমার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হবে। তবে আমার ধারণা এরূপ হতো যে, আল্লাহ নবী সা.-কে হয়তো স্বপ্নযোগে আমার দোষমুক্ত হওয়ার কথা জানিয়ে দিবেন। 


আল্লাহর শপথ! তখনও রাসূলুল্লাহ সা. নিজের জায়গা থেকে সরেননি এবং বাড়ির কোন লোকও বাড়ি হতে বের হননি এমতাবস্থায় তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হতে শুরু হয়ে যায়। তাঁর মুখমণ্ডলে ঐসব নিদর্শন প্রকাশ পায় যা ওহীর সময় প্রকাশিত হয়ে থাকে। ওহী অবতীর্ণ হওয়া শেষ হলে আমরা দেখতে পাই যে, তার চেহারা মুবারক খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সর্বপ্রথম তিনি আমার দিকে চেয়ে বলেন, 


“হে আয়েশা! তুমি খুশি হও। কারণ মহান আল্লাহ তোমার দোষমুক্ত হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।” তৎক্ষণাৎ আমার মা আমাকে বলেন, “হে আমার প্রিয় কন্যা! আল্লাহর রাসূল সা.-এর সামনে দাঁড়িয়ে যাও।” আমি উত্তরে বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি তাঁর সামনে দাঁড়াবো না এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করবো না। তিনিই আমার দোষমুক্তি ও পবিত্রতার আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। 


আমার এই ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর স্ত্রী হযরত যয়নব রা.-কেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা.-এর সমস্ত স্ত্রীর মধ্যে হযরত যয়নব রা. আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কিন্তু তার আল্লাহর ভীতির কারণে তিনি আমার প্রতি কলংক আরোপ করা হতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রশ্নের উত্তরে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমি আমার কর্ণ ও চক্ষুকে রক্ষিত রাখছি, আল্লাহর কসম! আমি তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না।” 


অথচ তার বোন হিমনাহ বিনতে জাহাশ আমার সম্পর্কে বহুকিছু বলেছিল এবং আমার বিরুদ্ধে তার বোনকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল। তারপরও হযরত যয়নব বিনতে জাহাশ রা. আমার সম্পর্কে একটিও মন্দ কথা উচ্চারণ করেননি। তবে তার ভগ্নী আমার অপবাদ রচনায় বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছিল এবং সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।” 


এভাবেই আমাদের মা আয়িশা রা. তার ওপর আরোপিত অপবাদের ঘটনার বর্ণনা দেন। মহান রাব্বুল আলামীন এই ব্যাপারে সূরা নূরের ১১ নং আয়াতে বলেন, 

//যারা এ মিথ্যা অপবাদ তৈরী করে এনেছে তারা তোমাদেরই ভিতরের একটি অংশ। এ ঘটনাকে নিজেদের পক্ষে খারাপ মনে করো না বরং এও তোমাদের জন্য ভালই। যে এর মধ্যে যতটা অংশ নিয়েছে সে ততটাই গোনাহ কামাই করেছে আর যে ব্যক্তি এর দায়-দায়িত্বের বড় অংশ নিজের মাথায় নিয়েছে তার জন্য তো রয়েছে মহাশাস্তি।//


হাদীসে মাত্র কয়েকজন লোকের নাম পাওয়া যায়। তারা এ গুজবটি ছড়াচ্ছিল। তারা হচ্ছে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে উবাই, যায়েদ ইবনে রিফা’আহ, মিস্‌তাহ ইবনে উসামাহ, হাস্‌সান ইবনে সাবেত ও হামনা বিনতে জাহশ। এর মধ্যে প্রথম দু’জন ছিল মুনাফিক এবং বাকি তিনজন মু’মিন। মু’মিন তিন জন বিভ্রান্তি ও দুর্বলতার কারণে এ চক্রান্তের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরা ছাড়া আর যারা কমবেশী এ গোনাহে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাদের নাম হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে পাওয়া যায় না। 


এই ধরনের অপবাদ ছড়ানো এবং কেউ ছড়ালে মুমিন কী করা উচিত তা নিয়ে সূরা নূরের ১২ থেকে ২১ আয়াতে বলেন,

//যখন তোমরা এটা শুনলে, তখন কেন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা তাদের নিজদের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করলো না এবং বলল কেন না, ‘এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ’? তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী নিয়ে আসল না? সুতরাং যখন তারা সাক্ষী নিয়ে আসেনি, তখন তারাই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী।আর যদি দুনিয়া ও আখেরাতে তোমাদের উপর আল্লাহর দয়া ও তাঁর অনুগ্রহ না থাকত, তবে তোমরা যাতে লিপ্ত ছিলে, তার জন্য তোমাদেরকে অবশ্যই কঠিন আযাব স্পর্শ করত।


যখন এটা তোমরা তোমাদের মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং তোমরা তোমাদের মুখ দিয়ে এমন কথা বলছিলে, যাতে তোমাদের কোন জ্ঞান ছিল না; আর তোমরা এটাকে খুবই তুচ্ছ মনে করছিলে, অথচ এটা আল্লাহর নিকট খুবই গুরুতর।আর তোমরা যখন এটা শুনলে, তখন তোমরা কেন বললে না যে, ‘এ নিয়ে কথা বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি অতি পবিত্র মহান, এটা এক গুরুতর অপবাদ’।


আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন যে, যদি তোমরা মুমিন হও, তাহলে আর কখনো এর পুনরাবৃত্তি করবে না। আর আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করছেন এবং আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। আর যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকত, (তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে) আর নিশ্চয় আল্লাহ বড় মেহেরবান, পরম দয়ালু।


হে মুমিনগণ, তোমরা শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করো না। আর যে শয়তানের পদাঙ্কসমূহ অনুসরণ করবে, নিশ্চয় সে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেবে। আর যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না থাকত, তাহলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হতে পারত না; কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, পবিত্র করেন। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।//


এই পুরো ঘটনায় যে লোকটি লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে গিয়েছেন তিনি হলেন আমাদের মা হযরত আয়িশা রা.-এর পিতা আবু বকর রা.। সাহাবারা এমনকি তাঁর আত্মীয়রাও যখন এসব নিয়ে কথা বলছে তখন তিনি নীরবে চোখের পানি ফেলতেন। এরমধ্যে মিস্‌তাহ ইবনে উসামাহ ছিল অপবাদকারীদের মধ্যে অন্যতম। অথচ এই মিসতাহ আবু বকর রা.-এর আত্মীয় এবং তাঁর অনুগ্রহে জীবিকা নির্বাহ করেন। আল্লাহর ঘোষণার মাধ্যমে মিসতাহ মিথ্যেবাদী প্রমাণিত হওয়ায় আবু বকর রা. তাকে যে সাহায্য করে আসছিলেন এবং তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আসছিলেন তা বন্ধ করে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। 


এই ঘোষণার কারনে আল্লাহ তায়ালা পরে আরেকটি আয়াত অর্থাৎ সূরা নূরের ২২ নং আয়াত নাজিল করেন। সেখানে তিনি বলেন, //আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।// 


তাঁর কসমের প্রেক্ষিতে এই আয়াত নাজিল হয়েছে শুনেই হযরত আবু বকর রা. সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, ‘আল্লাহর কসম, অবশ্যই আমরা চাই, হে আমাদের রব! আপনি আমাদের ভুল-ভ্রান্তি মাফ করে দিবেন।’ কাজেই তিনি আবার মিসতাহকে সাহায্য করতে থাকেন এবং এবার আগের চেয়ে বেশি করে করতে থাকেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, হযরত আবু বকর রা. ছাড়াও আরো কয়েকজন সাহাবীও এ কসম করেছিলেন যে, যারা মিথ্যা অপবাদ ছড়াতে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে তাঁরা আর কোনো সাহায্য-সহায়তা দেবেন না। এ আয়াতটি নাযিল হবার পর তারা সবাই নিজেদের কসম ভেঙ্গে ফেলেন। এভাবে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইসহ মুনাফিক দ্বারা সৃষ্ট এ ফিতনার ফলে মুসলিম সমাজে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল তা এক মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়।

২৭ নভে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৬৭ : শেখ মুজিব কেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন না?




এদেশে প্রচলিত আছে ইয়াহিয়া খান সরকার শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নি বা করতে চায় নি। যা সর্বৈব মিথ্যে কথা। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো দুজনকেই অভিনন্দন জানিয়ে ইয়াহিয়া বার্তা পাঠিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে সামরিক আদালতে যারা বিভিন্ন অভিযোগে দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাদের অনেককেই সাধারণ ক্ষমার আওতায় ছেড়ে দেওয়া হয় । 

ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে খুবই উদগ্রীব ছিলেন। এ জন্য তিনি তার মন্ত্রিসভার সদস্য মাহমুদ হারুনকে ঢাকায় পাঠান। মাহমুদ হারুন হলেন ইউসুফ হারুনের ভাই এবং শেখ মুজিবের একজন আস্থাভাজন ব্যক্তি। শেখ মুজিবকে ইসলামাবাদে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়। পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রেসিডেন্ট তাকে রাজধানীতে স্বাগত জানাতে চেয়েছিলেন। তিনি মুজিব সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাজধানী বা ইসলামাবাদে যেতে অপারগতা জানান।  

এদিকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে এদেশীয় মুসলিম লীগের তিন পক্ষ, পিডিপি ও নেজামে ইসলামের নেতারা। তারা আগে থেকে নির্বাচিত হওয়া জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। কিন্তু অভিনব কেন্দ্র দখলের বিরুদ্ধে তাদের প্রস্তুতি ছিল না। কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনের একটি স্বীকারোক্তি আছে তা কমেন্টে দেওয়া হলো। ভুট্টো প্রথমে এদের অভিযোগকে আমলে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচন পুনরায় দাবি করেন। ইয়াহিয়া খান এসব অভিযোগে কান দেননি। কিন্তু যখন মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে অস্বীকার করলো তখন 'এদিক আমার ওদিক তোমার' বলে দেশকে বিচ্ছিন্ন করার ইঙ্গিত দিলেন তখন ভুট্টো পুর্ব পাকিস্তানের পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি থেকে সরে এসে মুজিবকে স্বাগত জানালো। 

অনেকেই বলে থাকেন মুজিব ঢাকাকে পাকিস্তানের কেন্দ্র বা রাজধানী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। তাই তিনি ইসলামাবাদ যাননি। এই দাবিটিও মিথ্যে। কারণ মুজিব নির্বাচনের পর বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু কখনো সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতেও বলেননি তিনি ঢাকাকে পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে দেখতে চান। অতএব পাকিস্তানে না যাওয়াটা ছিল তার ষড়যন্ত্রের ফল অথবা তার রাজনৈতিক দুর্বলতা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারার জন্য প্রথমে শেখ মুজিব নিজেই দায়ি। হয় তিনি ভারতীয় ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত অথবা তিনি পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেননি।  

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো মনে করতেন, তার সঙ্গে সমঝোতা না করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারবে না। ২০ ডিসেম্বর লাহোরে পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলি চেম্বারসের সামনে পিপিপির এক সমাবেশে তিনি বলেন, তার দলের সহযোগিতা ছাড়া সংবিধান ও কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা যাবে না। জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের আসনে বসার জন্য পিপিপি প্রস্তুত নয়। তিনি আরও বলেন, পিপিপির পক্ষে আরও পাঁচ বছর (পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত) অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।' 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মানুষ জীবন বাজি রেখে আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছে শেখ মুজিবকে নেতা হিসেবে পাওয়ার জন্য নয়। তাই শুরু থেকেই পিপলস পার্টি মুজিবের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা ছাড়া সংসদে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা স্পষ্ট করে। পরদিন ভুট্টোর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণের রায় পেয়েছে এবং আওয়ামী লীগ একাই সংবিধান তৈরি ও কেন্দ্রে সরকার গঠনের ক্ষমতা রাখে। পাকিস্তানে বিজয় লাভ করার পরও প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার ২য় কারণ ভুট্টো ও পিপলস পার্টি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ১২ জন জেনারেল শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধী ছিলেন বলে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তথ্য দিয়েছেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আকবর খান শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে বিরোধী ছিলেন। তাদের কাছে ১৯৬৭ সালে ক্যু-এর পূর্ণাঙ্গ তথ্য ছিলো। যার মাধ্যমে লে. ক. মোয়াজ্জেম ভারতের কাছে পুর্ব পাকিস্তানের ক্যান্টনম্যান্ট হস্তান্তরের ষড়যন্ত্র করেছিলো। 

সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের কাছে মুজিবের ভারত কানেকশনের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ ছিল। তারা তাই ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিবের কাছে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছাড়তে বারণ করেছিলো। তারা নিশ্চিত ছিল ক্ষমতা পেলে মুজিব ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, এমনও হতে পারে পাকিস্তান ভারতের অধিনস্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মনে করতেন ভারতের সাথে ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী আওয়ামীলীগের কিছু চরমপন্থী সদস্য। তিনি মনে করতেন মুজিব চাইলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাই তিনি বিভিন্ন আলাপচারিতায় মুজিবকে চরমপন্থী ও ভারতপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত না হতে অনুরোধ করেছেন। পাকিস্তানে বিজয় লাভ করার পরও প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার ৩য় কারণ সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য। 

নির্বাচনের পরে ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক জনসভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে দলীয় শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন শেখ মুজিব। নৌকা আকৃতির একটি বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সবাই মঞ্চে ছিলেন। শপথনামায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছয় দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনসংবলিত সংবিধান তৈরি করতে অঙ্গীকার করেন। শপথ নেওয়া শেষ হলে শেখ মুজিব উপস্থিত জনতাকে আহ্বান করে বলেন, কেউ যদি বাংলার মানুষের সঙ্গে বেইমানি করে তবে তোমরা তাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।' শেখ মুজিব জয় বাংলা’ ও ‘জয় পাকিস্তান' বলে ভাষণ শেষ করেছিলেন।

শপথ অনুষ্ঠানে বিদেশি কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মঞ্চের সামনে সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত স্থানের পাশে তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, ভারত ও ইরান দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। চীন ও রাশিয়ার দূতাবাস প্রতিনিধির অনুপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রমনার বটমূলে ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক সদস্যদের একটি সম্মিলনের আয়োজন করা হয়। প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন। অনুষ্ঠানে সদ্যনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ উপস্থিত হতে পারেননি। তার বদলে ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আ ফ ম মাহবুবুল হক সভা পরিচালনা করেন। সভা শুরু হওয়ার আগে ২০-২৫ জনের একটি দল স্লোগান দিতে দিতে সভা প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করে। তাদের স্লোগানগুলো ছিল : 
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো, 
মুক্তিফৌজ গঠন করো—বাংলাদেশ স্বাধীন করো, 
লাল সূর্য উঠেছে—বীর জনতা জেগেছে, 
মুক্তির একই পথ—সশস্ত্র বিপ্লব, 
স্বাধীন করো স্বাধীন করো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো, 
শেখ মুজিবের মন্ত্র-সমাজতন্ত্র। 

খেয়াল করে দেখুন, তারিখটা ৪ জানুয়ারি। তখনো নির্বাচন পুরোপুরি শেষ হয় নি। অনেক দুর্গত অঞ্চলে ডিসেম্বরে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। তখনো আরো নয়টি আসনে নির্বাচন বাকী। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কি করবে না এমন আশংকা তখনো দেখা দেয় নি, এমন সময় ছাত্রলীগের একদল সদস্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সামনে রেখে দেশ বিরোধী জঙ্গী শ্লোগান দিয়ে দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলো। এরাই নিউক্লিয়াস। 

নিউক্লিয়াস চেয়েছিলো মুজিব যাতে প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতা পায়। তাই তারা প্রচুর ভোট ডাকাতি করেছিলো। কিন্তু ডাকাতির ফল হিসেবে মুজিব পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ম্যান্ডেট পেয়ে যায়। তারা যখন দেখলো শেখ মুজিব টোটাল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছে তখন তারা তা ঠেকাতে চেয়েছিলো। কারণ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে বাংলাকে আলাদা করে তাদের সমাজতন্ত্র কায়েমের খায়েস ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই তারা কোনো প্রয়োজন ছাড়াই দেশবিরোধী জঙ্গী কার্যক্রম শুরু করে। পাকিস্তানে বিজয় লাভ করার পরও প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার ৪র্থ কারণ সমাজতন্ত্রী নিউক্লিয়াস।  

নিউক্লিয়াসের এই শ্লোগানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের শুধু একজন নেতা কথা বলেছিলেন। তিনি হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি ছেলেদের দেশবিরোধী কথা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন ও ধমক দিয়েছেন। নিউক্লিয়াসের ছেলেদের সমর্থন দিয়েছেন তাজউদ্দিন আহমদ। শেখ মুজিব পুরো বিষয়কে ইচ্ছেকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন। আমার ধারণা তিনি তখনো ঠিক করতে পারেননি নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে প্রধানমন্ত্রী হবেন নাকি দেশ ভাগ করে ফেলবেন! 

৯ জানুয়ারি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইলের সন্তোষে একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকেন। সম্মেলনে তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি করেন। উল্লেখ্য, নির্বাচনের আগে নভেম্বরে পল্টনের এক জনসভায়ও তিনি এ দাবি উচ্চারণ করেছিলেন। তবে তার এসব কথাবার্তাকে আর গুরুত্ব দেওয়ার কিছু ছিল না। তিনি ইতোমধ্যে তার আজব কর্মকাণ্ড ও প্রতারণার কারণে জনগণের রোষানলে ছিলেন। ভোটের বাক্সে লাথি মারার ঘোষণা দিয়ে তিনি রাজনীতি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। 

নির্বাচনের সব কর্মকাণ্ড শেষ হওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিজয়ী প্রধান দুটি দলের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু মুজিব রাজধানী যেতে চায় নি তাই প্রেসিডেন্ট নিজেই ঢাকায় এসেছেন ১১ জানুয়ারি। এতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়। তার সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন সেনাসদরের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল সৈয়দ গোলাম মোহাম্মদ মহিউদ্দিন পীরজাদা, ব্রিগেডিয়ার ইস্কান্দার উল করিম ও লে. কর্নেল মাহমুদ। করিম ও মাহমুদ দুজনই ছিলেন বাঙালি। করিম প্রেসিডেন্টের সচিবালয়ে বসতেন এবং মাহমুদ ছিলেন পীরজাদার স্টাফ অফিসার। করিমকে পীরজাদার ডান হাত মনে করা হতো।

ইয়াহিয়া খান রওনা হওয়ার আগে করাচি বিমানবন্দরে এবং ঢাকায় পৌছে সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ খোলামেলাভাবেই বলেন, তিনি ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে উৎসুক। ঢাকায় পৌঁছে ইয়াহিয়া তার সাহায্যকারী দলের সঙ্গে প্রস্তুতিমূলক সভা করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন লে. জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার ইস্কান্দার করিম। 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন কামাল হোসেন, তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মোশতাক আহমদ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সঙ্গে কোলাকুলি করলেন। প্রেস ফটোগ্রাফারদের ফটোসেশন চলল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করলেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর মানসিকতা, ইসলামাবাদসহ পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের অবস্থান ইত্যাদি বিষয় বিবেচনার আলোকে সমাধানের তিনটি বিকল্প প্রস্তাব রাখেন। প্রথমত সেনাবাহিনীর সহায়তায় শেখ মুজিব পাকিস্তান পরিচালনা করবে। দ্বিতীয়ত ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সরকার গঠন। তৃতীয়ত পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টোর দল ছাড়া অন্য দলগুলোর সাথে জোট করে ক্ষমতা শেয়ার করা।   

যেহেতু মুজিবের পশ্চিমের অর্থাৎ মূল ভুখণ্ডে কোনো অবস্থান নেই তাই তিনি ভালো করেই জানতেন এই বিকল্প প্রস্তাবের বাইরে একা পাকিস্তান শাসন করা তার জন্য সম্ভব না। তাই তিনি শুরুতেই ১ম প্রস্তাবে রাজি হলেন। এই প্রস্তাবের আওতায় ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ও মুজিব প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। প্রেসিডেন্টের কাছে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, বিচারবিভাগ ও অর্থের দায়িত্ব রাখতে চেয়েছে ইয়াহিয়া ও সেনাবাহিনী। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীর যে উদ্বেগ রয়েছে মুজিবের প্রতি তা দূর হবে।  

শেখ মুজিব তার দলের অন্যান্য নেতাদের সাথে প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করলেন। এরপর পুনরায় ১৪ জানুয়ারি আবার দেখা করতে চেয়েছেন প্রেসিডেন্টের সাথে। সে মিটিং-এ মুজিব স্পষ্ট করেন তার ও তার দলের পক্ষে ইয়াহিয়া খানকে নামেমাত্র প্রেসিডেন্ট ছাড়া আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে মুজিব ভারতের প্রেসিডেন্টের কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর আর আলোচনা আগায় নি। ইয়াহিয়া খান ২য় প্রস্তাবের দিকে অগ্রসর হন। ১৫ জানুয়ারি তিনি ফিরে যান পশ্চিমে। সেখানে করাচি বিমানবন্দরে তিনি মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন। 

এরপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বিজয়ী প্রার্থী ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট ভবনে ডাকেন ও মুজিবের সাথে সমঝোতায় রাজি হতে অনুরোধ করেন। আলোচনা আরো চলতে থাকে ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার মধ্যে। লারকানায় ভুট্টোর পৈত্রিক বাড়িতে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে মুজিবের সাথে আলোচনা করে ক্ষমতা ভাগাভগি করার ব্যাপারে রাজি করেন। ২৭ জানুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় এসে মুজিবের সাথে আলোচনা শুরু করেন। 

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করার মতো। যেহেতু মুজিব নির্বাচনে জিতেছেন তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে শেখ মুজিবের ভূমিকা থাকা উচিত ছিল একটিভ ভূমিকা। তার পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু তা মোটেও দেখা যায়। তার ভূমিকা ছিল প্যাসিভ। সে ঢাকায় বসে আছে। কারো সাথেই আলোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে না। এই সমস্যাকেই আমি ১ম সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছি।    

ভুট্টো-মুজিব আলোচনা এগোয়নি। আসলে মুজিব কী চাচ্ছিলেন তা তিনি নিজেও জানতেন না। তিনি ভুট্টোর সাথে কোয়ালিশন করতে রাজি হয়েছেন অথচ ভুট্টোকে কোনো ক্ষমতার অংশীদার করতে চান নি। এই সমস্যা কী মুজিবের একার ছিল? আমরা যদি একটু পেছনের দিকে যাই দেখতে পাবো ১৯৩৭ সাল থেকে এই বাংলায় নির্বাচনে যারাই জিতেছে কেউ তাদের অংশীদারদের ছাড় দিতে পারে নি বলে স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারে নি। ইংরেজ আমলে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দি প্রায়ই মন্ত্রীসভা গড়তেন আর ভাঙতেন। পাকিস্তান আমলে ৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে জেতার পর শেরে বাংলা ও আতাউর রহমান খান তিন বছরে পাঁচের বেশি মন্ত্রীসভা তৈরি করতে হয়েছে। অবশেষে স্পিকারকে খুন করে গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে। 

ভুট্টো মুজিবের কাছে প্রথমে উপপ্রধানমন্ত্রী পদ চেয়েছেন। মুজিব রাজি না হওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ চেয়েছেন। মুজিব তাতেও রাজি ছিলেন না। ভুট্টোকে ব্যবহার করে মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন বিনিময়ে শুধু একটি মন্ত্রনালয় (কৃষিমন্ত্রী) দিতে চেয়েছেন। ভুট্টো শুধু একটি মন্ত্রীতে রাজি হয়েছেন যদি পররাষ্ট্র হয়। আর তা না হলে মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমান সংখ্যক মন্ত্রী চেয়েছেন। মুজিব কৃষি ছাড়া আর কোনো মন্ত্রনালয় দিতে রাজি হননি। ভুট্টো ফিরে যান। 

ইয়াহিয়া খান দুই দলকেই দ্রুত সমঝোতায় আসতে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের সাথে একটি বিমান ছিনতাই নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয় এবং বিমান চলাচল কিছুদিন বন্ধ থাকে। তাই ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কিছুদিন বন্ধ থাকে। 

ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে সমস্যা নিরসনে মুজিব একটিভ ভূমিকা নিতে চান। তিনি মার্কিন দূতের কাছে যান আলোচনা করতে। তাকে সমঝোতার মধ্যস্থতাকারী মানতে চান। মুজিব ভুট্টোর ক্ষমতাকে ছোট করে দেখেছেন। ভুট্টো পশ্চিমে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে ফেলেছে আন্দোলন করে। ইয়াহিয়া খানের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করছে। চাপের মুখে ইয়াহিয়া খান তার মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেন। এর মাধ্যমে ইয়াহিয়া ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করেন। রাজনীতিবিদেরা যদি সমঝোতা করতে না পারে আবারো সেনা শাসন আসার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হলো। মুজিবও দেখতে পারলেন ভুট্টোর অব্যাহত আন্দোলনে তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান হারাম হয়ে যাচ্ছে। এদিকে মার্কিন দূত আর্চার ব্লাডের কাছে যাওয়ায় নিউক্লিয়াস অত্যন্ত ক্ষেপে গিয়েছে। 

যাই হোক ১ মার্চ বেলা একটায় রেডিওতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। রেকর্ডকৃত ঘোষণাটি প্রেসিডেন্টের নামে পাঠ করা হলেও প্রেসিডেন্ট এতে কণ্ঠ দেননি। বেতার ঘোষণার অংশবিশেষ ছিল এ রকম:

//বিগত কয়েক সপ্তাহে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরিবর্তে আমাদের কোনো কোনো নেতা অনমনীয় মনোভাব দেখিয়েছেন। এটি দুর্ভাগ্যজনক। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক মোকাবিলা একটি দুঃখজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

...সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া ভারত কর্তৃক সৃষ্ট সাধারণ উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সার্বিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অতএব, আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান পরবর্তী কোনো তারিখের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমি বারবার উল্লেখ করেছি যে শাসনতন্ত্র কোনো সাধারণ আইন নয়, বরং এটি হচ্ছে একত্রে বসবাস করার একটি চুক্তিবিশেষ। অতএব, একটি সুষ্ঠু ও কার্যকর শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়ের পর্যাপ্ত অংশীদারি থাকা প্রয়োজন।

...শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে যুক্তিসংগত সমঝোতায় উপনীত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের আরও কিছু সময় দেওয়া উচিত। এ সময় দেওয়ার পর আমি একান্তভাবে আশা করি যে তারা একে কাজে লাগাবেন এবং সমস্যার একটি সমাধান বের করবেন। আমি পাকিস্তানি জনগণকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে ইতিপূর্বে বর্ণিত পরিস্থিতি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পক্ষে সহায়ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি, অনতিবিলম্বে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে কোনোরূপ ইতস্তত করব না।//

৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত হলে পূর্ব পাকিস্তানে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। শেখ মুজিব হরতাল ঘোষণা করেন। সারা বাংলাকে নরকে পরিণত করে নিউক্লিয়াসের পরিকল্পনায় আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতের বিহার থেকে আসা মুহাজিরদের ওপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও গণহত্যা।       

এতো এতো খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও হাল ছাড়েননি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি ১৫ মার্চ ঢাকায় উড়ে এলেন। ১৬ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া একান্ত বৈঠক হলো এক ঘণ্টা। ১৭, ১৯ ও ২০ মার্চও দুজনের মধ্যে কথা হয়। তাঁদের দুজনের সঙ্গেই ছিল নিজ নিজ পরামর্শক টিম। তারা জানাল, কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট একটা ফরমান জারি করবেন। ২১ মার্চ ভুট্টো ঢাকায় আসেন। এবার ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে ভুট্টো ও মুজিবের মধ্যে সমঝোতা করে দিতে চান ইয়াহিয়া। আলোচনা অনেক এগিয়েছে। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। 
 
এরপর কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটল। শেখ মুজিবের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা যুবনেতা আবদুর রাজ্জাককে (নিউক্লিয়াস প্রতিষ্ঠাতাদের একজন) ডেকে বললেন, ‘তোমরা এখনো বসে আছ? তোমাদের নেতা কিন্তু আপস করে ফেলেছে।’ এতে  নিউক্লিয়াসের মধ্যে তৎপরতা শুরু হলো। ২২ মার্চ রাতে তাঁরা ধরনা দিলেন শেখ মুজিবের কাছে। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁদের আলাপচারিতা উঠে এসেছে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের বয়ানে:

২২ মার্চ রাতে আমরা ৩২ নম্বরে গেলাম। রাত তখন ১০টা হবে। বঙ্গবন্ধু স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে খাটে শুয়ে আছেন। আমরা মেঝের ওপর বসলাম। তিনি এক হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে কাত হয়ে আধশোয়া অবস্থায় কথা বলতে লাগলেন। আমি বললাম, ‘স্বাধীনতা ঘোষণা করে দ্যান।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘অনেক ভেবেছি, কোথাও সাপোর্ট নাই। ইন্ডিয়া সাপোর্ট দিতে পারে, নাও পারে। রাশিয়া দিবে কি না জানি না। আমেরিকা সাপোর্ট দিবে না। চায়না-হুজুরকে (মওলানা ভাসানী) বলছি, নেগেটিভ।’ ঠিক এই সময় সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) উঠে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন ৪০-৪৫ মিনিট পর। বললেন, ‘কনফেডারেশনের প্রস্তাব দিলে কেমন হয়? এতে পাকিস্তান থাকবে, কিন্তু ইয়াহিয়া এটা মানবে না। সুতরাং, আমাদের কাজটা হয়ে যাবে।’ বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে সিরাজ ভাইকে বললেন, ‘অ, তুই বুঝি মোস্তাকের (খন্দকার মোশতাক আহমদ) কাছে গেছিলি?’ 

একটা চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ছাত্রসমাজের একটি অংশের চাপ ছিল। ছাত্রদের দাবি ছিল, গণ-আন্দোলন নিয়ে কোনো আপোস চলবে না। শেখ মুজিব কেন্দ্রের ক্ষমতা নেওয়া অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘোর বিরোধী ছিল নিউক্লিয়াস। প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাকেই তারা আপোষ হিসেবে দেখেছে।

চরম সিদ্ধান্ত নেয় নিউক্লিয়াস। তারা মুজিবের ওপর ভরসা রাখে না। কারণ মুজিব ভুট্টোর সাথে কোয়ালিশন করে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। ২৩ তারিখ ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার মিডিয়ায় একটি খবর লিড নিউজ করে ছাপা হয়। বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। প্রমাণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্র হাতে প্যারেডরত ছাত্র-ছাত্রীদের একটি ছবি প্রকাশিত হয়। এই নিয়ে শুধু পাকিস্তান নয় সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তৈরি হয়। ভুট্টোর কথা সত্য প্রমাণিত হয়। ভুট্টো এতো দিন বলে আসছিল আওয়ামী লীগ গোঁয়ার্তুমি ও আলোচনা নামে সময় ক্ষেপন করছে। তারা পাকিস্তান ভেঙে দিতে চায়। তারা মুশরিকদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়।  

ইয়াহিয়া খান হতাশ হয়ে পড়লেন। ২২ তারিখের ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল প্রক্রিয়া ২৪ তারিখে বন্ধ হয়ে গেল। ভুট্টো মুজিবের সাথে আর কোনো আলোচনা করতে রাজি না থেকে পশ্চিমে চলে যান। ২৪ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টায় আওয়ামী লীগের আলোচক দল ইয়াহিয়ার পরামর্শক দলের সঙ্গে আবার বৈঠক করে। ওই বৈঠকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ হতে হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই মিটিং-এ শেখ মুজিব ছিল না। ইয়াহিয়া খান ধৈর্য ধরে ঢাবির ঘটনা জানতে চান। তারা এটাকে কিছু উগ্রবাদীদের কাজ বলে উল্লেখ করেন। 

মুজিব পড়ে যায় বিপদে। নিউক্লিয়াস বিদেশি মিডিয়ার কাছে ছবি পাঠিয়ে মুজিবের সমস্ত রাজনৈতিক কাজের ইতি ঘটিয়ে দিল। মুজিব পালিয়ে না গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। ইয়াহিয়া খান সকল আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। আর সেনাবাহিনী দেশদ্রোহীদের খোঁজার জন্য অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে। মুজিব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যে চারটি সমস্যা ছিল। এর মধ্যে ইয়াহিয়া খান তার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে ১ম তিনটি সমস্যা দূর করে ফেলেছেন। কিন্তু ৪র্থ বাধা নিউক্লিয়াসের কাছে হেরে যান মুজিব ও ইয়াহিয়া খান। তারা মুজিবকে দেশদ্রোহী হিসেবে প্রমাণ করেছে। একজন দেশদ্রোহী তো আর দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে না! 

২৫ নভে, ২০২০

ধন-সম্পদে উন্নতি কখনোই সফলতার মানদণ্ড নয়


মিশরে বাস করতো হজরত মুসা আ.-এর চাচাতো ভাই। তার গলার স্বর ছিল খুবই মিষ্ট। সে সুমিষ্ট সুরে তাওরাত পাঠ করতেন। তার সাথে মুসা আ.-এর সখ্যতা ছিল অপরাপর বনী ইসরাঈলের মতোই উত্তম। কারণ মুসা আ. তাদেরকে ফিরাউনের হাত হতে রক্ষা করেছিলেন। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা তাকে অনেক বেশি ধনসম্পদ দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন ও পরিক্ষা করেছেন। 


কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসা আ.-এর চাচাতো ভাই মুনাফিকে পরিণত হয়েছে। সে বড় সম্পদশালী ছিল বলে সম্পদের গর্বে গর্বিত হয়েছিল এবং তার সৃষ্টিকর্তার শক্তি সম্পর্কে বেখবর হয়ে পড়েছিল। মহান রবের দেওয়া ছাড়কে সে আল্লাহর দুর্বলতা ভেবে ভুল করেছিল। তার জাতির মধ্যে সাধারণভাবে যে পোশাক প্রচলিত ছিল, সে তার চেয়ে অর্ধহাত লম্বা করে পোষাক বানিয়েছিল, যাতে তার গর্ব ও ঐশ্বর্য প্রকাশ পায়। 


তার এতো বেশি ধন-সম্পদ ছিল যে, তার কোষাগারের চাবিগুলো উঠাবার জন্যে শক্তিশালী লোকদের একটি দল নিযুক্ত ছিল। তার অনেকগুলো কোষাগার ছিল এবং প্রত্যেক কোষাগারের চাবি ছিল পৃথক পৃথক। যখন ঐ চাবিগুলো বহন করার প্রয়োজন হতো তখন এর জন্যে ৬০ টি খচ্চর নির্ধারিত থাকতো। অর্থাৎ ৬০ টি খচ্চর শুধুমাত্র তার কোষাগারের চাবি বহন করতো! 

মুসা আ. তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে সাদাকার কথা বলতেন। তাকে দান করতে বলতেন। তার সম্পদে দরিদ্রের হক আছে বলে তাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। কিন্তু সে সম্পদ দান করতে চাইতো না। এক পর্যায়ে সে মুসা আ.-এর কাছে তার উত্তরসূরি হওয়ার আবদার করলো। সে মুসা আ.-কে বললো আমি সম্পদশালী, প্রভাবশালী। অতএব তুমি যদি আমাকে নবী হিসেবে মনোনয়ন দাও তবে আমি তোমার কথামতো সম্পদ দান করবো। 


মুসা আ. তাকে বুঝাতে চাইলেন, নবী হওয়া নিজের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। মহান রব যাকে চাইবেন কেবল তিনিই নবী হবেন। মুসা আ.-এর অব্যাহত নসীহতে সে খুবই বিরক্ত হতো। তাই মুসা আ. থেকে বাঁচার জন্য সে ফন্দি আঁটলো। সে মুসা আ.-এর চরিত্র হনন করতে চাইলো এবং এর মাধ্যমে মুসা আ.-কে বনী ইসরাঈল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলো।


সে এক এক ব্যভিচারিণী নারীকে বহু সম্পদ ঘুষ দিয়ে এই কাজে প্ররোচিত করে যে, যখন মুসা আ. বনী ইসরাঈলের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তা'আলার কিতাব পাঠ করতে শুরু করবেন ঠিক ঐ সময়ে যেন সে জনসম্মুখে বলে, “হে মুসা! তুমি আমার সাথে এরূপ এরূপ করেছো। তুমি তো চরিত্রহীন” কারূনের এই কথামত ঐ স্ত্রীলোকটি তা-ই করে। অর্থাৎ কারূনের শিখানো কথাই বলে। তার একথা শুনে হযরত মুসা আ. কেঁপে ওঠেন এবং তৎক্ষণাৎ দু'রাকআত নামায আদায় করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চান।


এরপর ঐ স্ত্রীলোকটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, “আমি তোমাকে ঐ আল্লাহর কসম দিচ্ছি যিনি সমুদ্রের মধ্যে রাস্তা করে দিয়েছিলেন, তোমার জাতিকে ফিরাউনের অত্যাচার হতে রক্ষা করেছেন এবং আরো বহু অনুগ্রহ করেছেন, সত্য ঘটনা যা কিছু রয়েছে সবই তুমি খুলে বলো। সেই আল্লাহকে ভয় করো যিনি সবার ওপর শক্তিশালী।” 


স্ত্রীলোকটি তখন বললো, “হে মুসা! আপনি যখন আমাকে আল্লাহর কসমই দিলেন তখন আমি সত্য কথাই বলছি। আপনার চাচাতো ভাই আমাকে বহু টাকা-পয়সা দিয়েছে এই শর্তে যে, আমি যেন বলি আপনি আমার সাথে এরূপ এরূপ কাজ করেছেন। আমি আপনাকে তা-ই বলেছি। এজন্যে এখন আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তার কাছে তাওবা করছি।”

মুসা আ. আবারো আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদায় নত হন ও চাচাতো ভাইয়ের শাস্তি কামনা করেন। আল্লাহ তায়ালা তার দু'আ কবুল করেন। বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা সাচ্চা মুসলিম ছিল এবং যারা আলেম ছিল তারা তার দম্ভ এবং ঔদ্ধত্য চরম সীমায় পৌঁছতে দেখে উপদেশ দিতে লাগলেন। তারা বললেন “এতো দাম্ভিকতা প্রকাশ করো না, আল্লাহর অকৃতজ্ঞ বান্দা হয়ো না, অন্যথায় তুমি আল্লাহর কোপানলে পতিত হবে। জেনে রেখো যে, আল্লাহ দাম্ভিকদেরকে পছন্দ করেন না।” 


উপদেশদাতাগণ তাকে আরো বলতেন, “আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত যে তোমার নিকট রয়েছে তার দ্বারা রবের সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করো এবং তার পথে ওগুলো হতে কিছু কিছু খরচ করো যাতে তুমি আখিরাতের অংশও লাভ করতে পার। আমরা একথা বলছি না যে, দুনিয়ায় তুমি সুখ ভোগ মোটেই করবে না। বরং আমরা বলি যে, তুমি দুনিয়াতেও ভালো খাও, ভালো পান করো, ভালো পোশাক পরিধান করো, বৈধ নিয়ামত দ্বারা উপকৃত হও এবং ভালো বিবাহ দ্বারা জৈবিক চাহিদা নিবারণ করো। 


কিন্তু নিজের চাহিদা পূরণ করার সাথে সাথে তুমি আল্লাহর হক ভুলে যেও না। তিনি যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন তেমনি তুমি তাঁর সৃষ্টজীবের প্রতি অনুগ্রহ করো। জেনে রেখো যে, তোমার সম্পদে দরিদ্রদেরও হক রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক হকদারের হক তুমি আদায় করতে থাকো। আর তুমি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। মানুষকে কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকো এবং জেনে রেখো যে, যারা আল্লাহর মাখলুককে কষ্ট দেয় এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে তাদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন না।”


মুসা আ.-এর এই চাচাতো ভাইকে আমরা সবাই মোটামুটি জানি। তার নাম কারুন। বনী ইসরাঈলের আলেমদের উপদেশবাণী শুনে কারুন জবাব দিল, “তোমাদের উপদেশ তোমরা রেখে দাও। আমি খুব করে ভালো জানি যে, আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন আমি তার যথাযোগ্য হকদার। আর আল্লাহ এটা জানেন বলেই আমাকে এই সব দান করেছেন।” 


কারুনের এমন কথাবার্তায় মুসলিমরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। তারা ভাবতে লাগলো আল্লাহ সত্যিই কারুনকে নেয়ামত ও রহমত করেছেন। সাফল্য দান করেছেন। তারা অনেকেই কারুনের মতো হতে চাইলো। তার সুপ্রসন্ন ভাগ্যের প্রতি ইর্ষা করতে লাগলো। 


একদিন কারুন অতি জাঁকজমকের সাথে ও দম্ভ নিয়ে পথ চলতে শুরু করে। সে অত্যন্ত মূল্যবান পোশাক পরিহিত হয়ে একটি অতি মূল্যবান সাদা খচ্চরের উপর আরোহণ করে চলছিল। তার সাথে তার দাসগুলোও ছিল, যারা সবাই রেশমি পোশাক পরিহিত ছিল। আর অন্যদিকে হযরত মূসা আ. বনী ইসরাঈলের সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। মুসা আ. তাকে জিজ্ঞেস করেন, “হে কারুন! আজ এমন শান-শওকতের সাথে গমনের কারণ কি?” 


সে উত্তরে বলে, “ব্যাপার এই যে, আল্লাহ তোমাকে একটি নেয়ামত দান করেছেন এবং আমাকেও তিনি একটি নেয়ামত দান করেছেন। যদি তিনি তোমাকে নবুয়্যত দান করে থাকেন তবে আমাকে তিনি দান করেছেন ধন-দৌলত ও মান-মর্যাদা। যদি আমার মর্যাদা সম্পর্কে তুমি সন্দেহ পোষণ করে থাকো তবে আমি প্রস্তুত আছি যে, চলো, আমরা দু’জন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, দেখা যাক আল্লাহ কার দু'আ কবুল করেন!” কারুনের কথায় দুর্বল মুসলিমরা বিভ্রান্ত হয়।


তাই হযরত মুসা আ. কারুনের এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে যান এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হন। অতঃপর তিনি তাকে বলেন, “হে কারুন! আমি প্রথমে প্রার্থনা করবো, না তুমি প্রথমে করবে?” সে জবাবে বলে, “আমিই প্রথমে দু'আ করবো।” একথা বলে সে দু'আ করতে শুরু করে। কিন্তু তার দু'আ কবুল হলো না। হযরত মুসা আ. তখন তাকে বললেন, “তাহলে আমি এখন দু'আ করি?” 


সে উত্তরে বলে, “হ্যাঁ, করো।” অতঃপর হযরত মুসা আ. আল্লাহ তা'আলার নিকট দু'আ করেন, “হে আল্লাহ! আপনি জমিনকে নির্দেশ দিন যে, আমি তাকে যে হুকুম করবো তাই যেন সে পালন করে।” 


আল্লাহ তা'আলা তাঁর দু'আ কবুল করেন এবং তাঁর নিকট অহী অবতীর্ণ করেন, “হে মুসা! জমিনকে আমি তোমার হুকুম পালনের নির্দেশ দিলাম।” হযরত মুসা আ. তখন জমিনকে বললেন, “হে জমিন! তুমি কারুন ও তার লোকদেরকে ধরে ফেলো।” 


তাঁর একথা বলা মাত্রই তাদের পাগুলো মাটিতে গেঁথে যায়। তিনি আবার বলেন, “আরো ধরো।” তখন তাদের হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে গেঁথে যায়। পুনরায় তিনি বলেন “আরো পাকড়াও করো।” ফলে তাদের কাঁধ পর্যন্ত মাটিতে গেঁথে যায়। তারপর তিনি জমিনকে বলেন, “তার সম্পদ ও তার কোষাগারও পুঁতে ফেলো।” সাথে সাথে কারুন তার দলবল, প্রাসাদ, ধন-দৌলত এবং কোষাগারসহ জমিনে দেবে গেলো। এভাবে তার ধ্বংস সাধিত হলো। জমিন যেমন ছিল তেমনই হয়ে গেল।


এই ঘটনা আল্লাহ তায়ালা সূরা কাসাসে বর্ণনা করেছেন। তিনি ৭৬ থেকে ৭৮ নং আয়াতে বলেন, 

//কারুন ছিল মুসার সম্প্রদায়ের লোক, তারপর সে নিজের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। আর আমি তাকে এতটা ধনরত্ন দিয়ে রেখেছিলাম যে, তাদের চাবিগুলো বলবান লোকদের একটি দল বড় কষ্টে বহন করতে পারতো। একবার যখন এ সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে বললো, “অহংকার করো না, আল্লাহ‌ অহংকারকারীদেরকে পছন্দ করেন না।

আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা দিয়ে আখেরাতের ঘর তৈরি করার কথা চিন্তা করো এবং দুনিয়া থেকেও নিজের অংশ ভুলে যেয়ো না। অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ‌ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করো না। আল্লাহ‌ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”


“এসব কিছু তো আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি তার ভিত্তিতে আমাকে দেয়া হয়েছে।” সে কি এ কথা জানতো না যে, আল্লাহ‌ এর পূর্বে এমন বহু লোককে ধ্বংস করে দিয়েছেন যারা এর চেয়ে বেশী বাহুবল ও জনবলের অধিকারী ছিল? অপরাধীদেরকে তো তাদের গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় না। 


কারুনের এ উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা আমাদের জানিয়ে, "কারুনের দাবি ভুল। সে ভেবেছিলো ধন সম্পদ তার হক। আল্লাহ তা'আলা যার প্রতি সদয় হন তাকেই তিনি সম্পদশালী করে থাকেন এটা মোটেই ঠিক নয়। তার পূর্বে তিনি তার চেয়ে বেশী শক্তিশালী ও প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।// 


এরপর আল্লাহ তায়ালা ৭৯ থেকে ৮৩ নং আয়াতে বলেন, 

//একদিন সে তার সম্প্রদায়ের সামনে বের হলো পূর্ণ জাঁকজমক সহকারে। যারা দুনিয়ার জীবনের ঐশ্বর্যের জন্য লালায়িত ছিল তারা তাকে দেখে বললো, “আহা! কারুণকে যা দেওয়া হয়েছে তা যদি আমরাও পেতাম! সে তো বড়ই সৌভাগ্যবান।” কিন্তু যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তারা বলতে লাগলো, “ধিক তোমাদের! আল্লাহর উত্তম প্রতিদান রেখেছেন তার জন্য যে ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আর এ সম্পদ সবরকারীরা ছাড়া আর কেউ লাভ করে না।”


শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ও তার গৃহকে ভূগর্ভে পুঁতে ফেললাম। তখন আল্লাহর মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসার মতো সাহায্যকারীদের কোনো দল ছিল না এবং সে নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে পারলো না। যারা আগে তার মতো মর্যাদা লাভের আকাংখা পোষণ করছিলো তারা বলতে লাগলো, “আফসোস, আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে, আল্লাহ‌ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তার রিযিক প্রসারিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাকে সীমিত রিযিক দেন। যদি আল্লাহ‌ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করতেন, তাহলে আমাদেরও ভূগর্ভে পুঁতে ফেলতেন। আফসোস, আমাদের মনে ছিল না, কাফেররা সফলকাম হয় না”


সে আখেরাতের বাসস্থান তো আমি তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেবো যারা পৃথিবীতে নিজেদের বড়াই চায় না এবং চায় না বিপর্যয় সৃষ্টি করতে। আর শুভ পরিণাম রয়েছে মুত্তাকিদের জন্যই।//


তাহলে বুঝা গেল যে, মানুষের সম্পদশালী হওয়া তার প্রতি আল্লাহর ভালবাসার নিদর্শন নয়। যে আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয় এবং কুফরির উপর অটল থাকে তার পরিণাম মন্দ হয়ে থাকে। কারুনের ধারণা ছিল যে, তার মধ্যে মঙ্গল ও সততা রয়েছে বলেই আল্লাহ তা'আলা তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তার বিশ্বাস ছিল যে, সে ধনী হওয়ার যোগ্য। তার মতে তাকে আল্লাহ তাআলা ভাল না বাসলে এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট না থাকলে তাকে এ নিয়ামত প্রদান করতেন না। কিন্তু সেটি সঠিক ছিল না। মূলত সফলকাম তারাই যারা আল্লাহর আনুগত্য করে। নবীর আনুগত্য করে, ঈমান আনে ও ধৈর্য ধারণ করে। 


হযরত ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের মধ্যে চরিত্রকে ঐভাবে বন্টন করেছেন, যেমনিভাবে তোমাদের মধ্যে রিজিক বন্টন করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ভালবাসেন তাকেও দুনিয়া (অর্থাৎ ধন-দৌলত) দান করেন এবং যাকে ভালবাসেন না তাকেও দান করেন। আর দ্বীন একমাত্র ঐ ব্যক্তিকে দান করেন যাকে তিনি ভালবাসেন।”


আমাদের বর্তমান সমাজেও আমরা সফলতার মানদণ্ড হিসেবে মনে করি দুনিয়ার ক্ষমতা, সম্পদ ইত্যাদিকে। আমরা এগুলো অর্জনের জন্য আমাদের বেশিরভাগ শ্রম বিনিয়োগ করি। অথচ মূল সফলতা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল ও আখিরাতের সাফল্য। আল্লাহ তায়ালা কুরআন থেকে হিদায়াত গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন।

২৩ নভে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৬৬ : পাকিস্তানের ১ম সাধারণ নির্বাচন ও ইয়াহিয়া খান


আমাদের দেশে প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী আইয়ুব খানকে যতটা ভিলেন হিসেবে দেখানো হয় তার চাইতে বেশি ভিলেন দেখানো হয় ইয়াহিয়া খানকে। কিন্তু এই ইয়াহিয়া খানই বাঙালিদেরকে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক অধিকার দেন। পাকিস্তানের সকল জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেন। স্বৈরাচারমুক্ত পাকিস্তান গঠনে আমার দৃষ্টিতে তাঁর আন্তরিকতা ছিল অসাধারণ। তার হাত ধরে পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের জন্য নেতা নির্বাচনের সুযোগ পায়।  


১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের কাছে থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে যত শীঘ্র সম্ভব তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশকে একটি ব্যবহারযোগ্য শাসনতন্ত্র দেওয়া এবং যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়েছে তার একটা সমাধান বের করা। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেন। 


আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ফেডারেল পার্লামেন্টারি ধরনের সরকারব্যবস্থা চালু করেন। প্রাপ্তবয়স্ক সকল পাকিস্তানী নাগরিকের ভোটাধিকারভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দান এবং আইন-আদালতের মাধ্যমে এই অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং তাকে শাসনতন্ত্র রক্ষকের ভূমিকা দেয়া। যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটি ইসলামী ভাবাদর্শভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে, ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর দেশে জাতীয় পরিষদের এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত জাতীয় পরিষদের কাজ হবে দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। তিনি ১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে উক্ত নির্বাচনের Legal frame work order-এর মূলধারাগুলো ঘোষণা করেন। উক্ত আদেশে নির্বাচন ও জাতীয় পরিষদ গঠন ও এর কার্যাবলি কেমন হবে তা ঘোষণা করেন। 


১. পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ৩১৩ জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১৩টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। 


২. মহিলারা সাধারণ আসনে নির্বাচনের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দও প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যগণ স্ব-স্ব প্রদেশের সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রার্থীগণকে নির্বাচিত করবেন। 


৩. প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ সেই প্রদেশের জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রার্থীগণকে নির্বাচিত করবেন। জাতীয় পরিষদের কোনো আসন শূন্য হলে তিন সপ্তাহের মধ্যে উক্ত শূন্য আসন নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। 


৪. ২৫ বৎসর বয়স্ক যে কোনো পাকিস্তানী নাগরিক যার নাম ভোটার তালিকায় লিপিবদ্ধ আছে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। (তবে আদালত কর্তৃক ঘোষিত বিকৃত মস্তিষ্ক কোনো ব্যক্তি, কিংবা আদালত কর্তৃক দুই বছরের বেশি সময়ের সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি সাজা ভোগের পর পাচ বছর সময় অতিবাহিত না হয়ে থাকলে, কিংবা ১৯৬৯ সালের ১ আগস্টের পর কোনো- না-কোনো সময় মন্ত্রী ছিলেন অথচ মন্ত্রিত্বের অবসানের পর দুই বছর অথবা কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের অনুমতি অনুসারে ২ বছরের কম কোনো নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে থাকে এমন ব্যক্তি, কিংবা সরকারি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি, কিংবা সরকারি চাকুরি থেকে বহিস্কৃত কোনো ব্যক্তি যদি বহিষ্কারের পর অন্তত পাঁচ বছর কিংবা কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের অনুমতি অনুসারে ৫ বছরের কম কোনো নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত না হয়ে থাকে, কিংবা পাকিস্তানের কোনো সরকারি চাকুরের স্বামী বা স্ত্রী হন, কিংবা তিনি আগে দেউলিয়া হন এবং আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হবার পর ১০ বছর অতিক্রান্ত না হয়ে থাকে, ইত্যাদি এমন সকল প্রার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।) 


৫. কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে জাতীয় পরিষদের ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী হতে পারবেন না। 


৬. কেউ একই সঙ্গে কোনো পরিষদের একাধিক নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী হতে পারবেন তবে একাধিক আসনে নির্বাচিত হলে তাকে নির্বাচনের সরকারি ফলাফল ঘোষণার পনেরো দিনের মধ্যে একটি আসন রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি তা করতে ব্যর্থ হলে তার নির্বাচিত সবগুলি আসন শূন্য বলে বিবেচিত হবে। 


৭. কোনো সাংসদ স্পিকার বরাবর স্বহস্তে লিখিত চিঠির মাধ্যমে পদত্যাগ করতে পারবেন। কোনো সদস্য স্পিকারের নিকট থেকে ছুটি না নিয়ে একাদিক্রমে পনেরোটি কার্যদিবসে অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হয়ে যাবে। কোনো সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদের প্রথম অধিবেশনের সাত দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে তার সদস্যপদ শূন্য বলে গণ্য হবে। তবে স্পিকার নির্বাচনে বিলম্ব ঘটলে উপরিউক্ত সময়কাল বাড়ানো যাবে। 


৮. জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট তার পছন্দমতো দিন, সময় ও স্থানে জাতীয় পরিষদের সভা আহবান করবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে পারবেন। জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করবেন।


৯. স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকার পদ শূন্য হলে জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ অন্য আরেকজন সদস্যকে স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচিত করবেন। স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনার জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন। স্পিকারের পদ শূন্য হলে ডেপুটি স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য হলে উক্ত পদ পূরণ না-হওয়া পর্যন্ত কমিশনার স্পিকার/ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করবেন। 


১০. জাতীয় পরিষদের কোনো অধিবেশনে ১০০ জনের কম সংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকলে অধিবেশনের কাজ চালানো যাবে না, অধিবেশন চলতে চলতে সদস্য সংখ্যা ১০০ জনের কম হয়েছে বলে কোনো সদস্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কোরাম পূর্ণ না-হওয়া পর্যন্ত অধিবেশন স্থগিত রাখবেন কিংবা মুলতবি করে দিবেন। সদস্যরা পরিষদে বাংলা, উর্দু কিংবা ইংরেজিতে বক্তৃতা দিবেন। পরিষদের কার্যবিবরণীর সরকারি রেকর্ড উর্দু, বাংলা এবং ইংরেজিতে রক্ষিত হবে। 


১১. ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বিন্যাস করা করা হবে। (এর ফলে বাঙালিরা লাভবান হয়, তবে এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়। শুধু মাত্র বাংলার আসন দিয়েই পুরো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে বাংলা পায় ১৬২ টি আসন) 


ইয়াহিয়া খান ঘোষিত সিদ্ধান্তগুলো সকল বিরোধী দল সাদরে গ্রহণ করে। ভাসানী ন্যাপ বাদে অন্য দলগুলি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভাসানী মাওবাদী ছিলেন। গণতন্ত্র বাদে সশস্ত্র বিপ্লবে তিনি বিশ্বাস করতেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তিনি এবং তার দল সব সময় একটি অশান্ত পরিবেশ চাইতেন যাতে করে সেই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে ভুল বঝিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যায়। একই উদ্দেশ্য নিউক্লিয়াসেরও ছিল। তারা ভেবেছিলো যদি ইলেকশন হয় ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা কঠিন হবে। তাই ভাসানী নির্বাচনের বিরোধীতা করে আন্দোলন শুরু করে। এই সময় তিনি তার বিখ্যাত উক্তি করেন "ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো"। তবে জনগণ তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নি। এমনকি তার দলের মধ্যেও এই নিয়ে ভাঙন তৈরি হয়। ভাসানীর এই দূরাবস্থা দেখে নিউক্লিয়াসও দমে যায়। তাছাড়া ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ক্ষতও তাদের দূর্বল করে রাখে।  


১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে ১ম সাধারণ নির্বাচন। বেশ উৎসাহ উদ্দীপনায় সব দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ভাসানীর দল বাদে পাকিস্তানের প্রায় এগারোটি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তবে প্রায় সকল প্রধান দলসমূহ, যেগুলি সেসময় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হতো- সেগুলো মূলত ছিল আঞ্চলিক। যেমন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এর কোনো সমর্থন ছিল না। তদনুরূপ ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পাটির জনসমর্থন ছিল সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশদ্বয়ে, অন্যত্র তার সমর্থন ছিল না। ওয়ালী ন্যাপের সমর্থন বেশি ছিল বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। অপরদিকে সর্বপাকিস্তান ভিত্তিক যে-দলগুলি তখন ছিল সেগুলি কেবল নামেই ছিল সর্বপাকিস্তানী, বাস্তবে কোনো প্রদেশেই এগুলির ব্যাপক জনসমর্থন ছিল না। 


নির্বাচনে যাতে সকল রাজনৈতিক দল ভালোভাবে এটেইন করতে পারে সেজন্য ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ফলে সেদিন থেকেই নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সকল মতের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। ফলে তারা নির্বাচনী মেনিফোস্টেতে ৬ দফার কথা উল্লেখ করলেও বক্তব্য বিবৃতিতে তা উহ্য রাখে। বরং শেখ মুজিব ইসলামী কানুন প্রতিষ্ঠার কথা বলে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করা শুরু করে। 


১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ভেঙে ন্যাপ গঠিত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তা জনপ্রিয়তা লাভ করে। ৬০ দশকে সারা পৃথিবীর সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। পাকিস্তানেও তার ব্যাতিক্রম হয় না। ১৯৬৭ সালের কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে মস্কোপন্থী নেতারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা চালায়। তাই মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পরামর্শে রংপুরে কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের পর দেশিয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে ন্যাপ চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের আবদুল ওয়ালী খান। পূর্ব পাকিস্তান ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ বাংলায় মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত হয়।   


মোজাফফর ন্যাপ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে অগ্রাধিকার দিলেও ক্ষমতার বন্টন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ছয়দফা থেকে তাদের দাবি অনেক নমনীয় ছিল। ন্যাপ (ওয়ালী) কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় ও মুদ্রা রেখে বাকি বিষয়গুলি প্রদেশের হাতে দেয়ার পক্ষপাতী ছিল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ এই যে, এই দলটি বাঙালি বুর্জোয়াদের দল এবং তারা পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়া গোষ্ঠীর একচেটিয়া সুযোগ সুবিধার অংশীদারিত্ব চায়। ন্যাপ (ওয়ালী) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। তবে তা অর্জনের লক্ষ্যে তারা একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের নির্বাচনী শ্লোগান ছিল : বাংলার কৃষক-শ্রমিক জাগো’। 


মওলানা ভাসানী নির্বাচনের ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। তিনি একদিকে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, আবার ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগানও উত্থাপন করেন। তিনি নির্বাচনে তার দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারে দুই পূর্বশর্ত আরোপ করেন : এক, জাতীয় সংসদে কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য আসন নির্দিষ্ট করতে হবে; দুই. নির্বাচনের পূর্বেই ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আলোকে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। এর মধ্যে নির্বাচনের আগে নানান দাবি দাওয়া উদ্ভট আন্দোলন শুরু করেন। এর মধ্যে চোর খেদাও অন্যতম। উনি হঠাৎ করে ঘোষণা করলেন গ্রাম-বাংলার চোর ডাকাত সমস্যা বড় সমস্যা। ভোটের আগে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। এই বলে তার কর্মীদের দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চোর নির্মুল কমিটি গঠন করলেন ও মব জাস্টিস সৃষ্টি করে কিছু খুন করলেন। শেষপর্যন্ত মওলানা ভাসানীর দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। 


পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) কেন্দ্রকে শক্তিশালী রেখে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, অর্থ, মুদ্রা, প্রাদেশিক ও বৈদেশিক বাণিজ্য এবং যোগাযোগ বিষয়ক ক্ষমতা অর্পণের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। পার্টি মেনিফেস্টোতে দাবি করা হয় যে, দুই প্রদেশের মধ্যে সকল ধরনের বৈষম্য যেন দশ বছরে দূর করা যায় সে লক্ষ্যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সংবিধানে উল্লেখ করা উচিত। এই দল বিশ্বাস করত যে কেবলমাত্র ধর্মীয় বন্ধনে পাকিস্তানের। উভয় অংশের ঐক্য অটুট রাখা সম্ভব। পিডিপি নেতা নূরুল আমিন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদিতার অভিযোগ উত্থাপন করে। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবিকে নির্বাচনী রেফারেন্ডাম হিসেবে গণ্য করায় আওয়ামী লীগ যদি পূর্ব পাকিস্তানে জনসমর্থন অর্জন সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে জনসমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্য অটুট রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।


জামায়াতে ইসলামি এই দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা অপরাপর ইসলামি দল এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ উত্থাপন করে যে ঐ সকল দল ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। জামায়াতে ইসলামির মতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসৃত ভুল নীতির কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। জামায়াত ১৯৫৬ সালের সংবিধানের কিছু পরিবর্তন করে উক্ত সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করে । পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রশ্নে জামায়াতের অভিমত ছিল যে বিভিন্ন প্রদেশকে এতটুকু স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা উচিত যা দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করবে না। 


জামায়াত ইসলামী আওয়ামী লীগের ছয়দফার সমালোচনা করে বলে যে ছয়দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করবে। পূর্ব পাকিস্তান জামাতের নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করে বলেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পাকিস্তানের অখন্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। জামায়াত দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান সমাজতান্ত্রিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচির দ্বারা সম্ভব নয়, কেবলমাত্র ইসলামী অর্থনীতিই পারে পাকিস্তানের সকল সমস্যার সমাধান করতে।


কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান পাঞ্জাবের মিঞা মমতাজ দৌলতানা পাকিস্তানে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের ছয়দফার কঠোর সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, ছয়দফার বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল ক্ষমতাহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়বে। এই দল যে-কোনো ধরনের সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল। দলের নেতৃবৃন্দ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির কঠোর সমালোচনা করে।


কনভেনশন মুসলিম লীগ শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা পাকিস্তানে ইসলামি আদর্শ অনুসরণের পক্ষপাতী ছিল। অন্য দুই মুসলিম লীগের ন্যায় এই দলও ভারত-বিরোধী পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী ছিল। এই দলের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন।


কাইয়ুম মুসলিম লীগ এই দলও ভারত-বিরোধী ছিল। দলের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানকে এই বলে অভিযুক্ত করেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করতে চান। এই দল শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষপাতী ছিল। দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাই দলের লক্ষ্য বলে প্রচার করা হয়। উপরে উল্লেখিত দলসমূহের কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়- প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী দল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দল ও ডানপন্থী দলসমূহ যারা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার এবং ইসলামী ভাবধারার শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিল।


১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আসনসংখ্যা ছিল সাধারণ ৩০০ এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল সাধারণ ১৬২ এবং মহিলা ৭টি। 


১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৯৭১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। ৩০০ টি আসনে মোট ১,৯৫৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর পর কিছু প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেয়। মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে ১,৫৭৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করে। আওয়ামী লীগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১৬২টি আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং অবশিষ্ট ৮ জন প্রার্থী দেয় পশ্চিম পাকিস্তানে। জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দেয়। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ১৫১। পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ১২০ আসনে প্রার্থী দেয়। তার মধ্যে ১০৩ টি ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা কোন প্রার্থী দেয়নি। পিএমএল (কনভেনশন) ১২৪ আসনে, পিএমএল (কাউন্সিল) ১১৯ আসনে এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ১৩৩ আসনে প্রতিদ্বন্দীতা করে।


নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রায় ৬৫% ভোট পড়েছে বলে সরকার দাবী করে। সর্বমোট ৫৬,৯৪১,৫০০ রেজিস্টার্ড ভোটারের মধ্যে ৩১,২১১,২২০ জন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ২৩,৭৩০,২৮০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটার।


জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সাথে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে।


আওয়ামী লীগ ৩৮.৩% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ১৬০

পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯.৫% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৮১

পিএমএল (কাইয়ুম) ৪.৫% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৯

পিএমএল (কনভেনশন) ৩.৩% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৭

জমিয়ত উলেমা -ই- ইসলাম ৪.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৭

মারকাজি জমিয়তন-উলেমা-পাকিস্তান ৪.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৭

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) ২.৩% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৬

জামায়াত-ই-ইসলামী ৬.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৪

পিএমএল (কাউন্সিল) ৬.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ২

পিডিপি ২.৯% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ১। 


প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল 

পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে ভুট্টোর পিপলস পার্টি দুইটি প্রদেশে, খান ওয়ালির ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দুইটি প্রদেশে ও শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ একটি প্রদেশে ভালো করেছে। 

পাঞ্জাবের মোট ১৮০ টি আসনের মধ্যে পিপলস পার্টি পেয়েছে ১১৩ টি। সিন্ধু প্রদেশের মোট ৬০ টি আসনের মধ্যে ২৮ টি পেয়েছে পিপলস পার্টি। বেলুচিস্তানের ২০ টি আসনের মধ্যে ন্যাপ (ওয়ালি) পেয়েছে ৮ টি আসন। সীমান্ত প্রদেশের ৪০ টি আসনের মধ্যে ন্যাপ (ওয়ালি) পেয়েছে ১৩ টি আসন। পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। 


এই নির্বাচনে সরকারের পক্ষ থেকে কারচুপি হয়েছে এমন অভিযোগ আনেনি কোনো রাজনৈতিক দল। অথবা পাকিস্তানী সেনাশাসকরা নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করেছেন এমন অভিযোগও পাওয়া যায়নি। তবে সরকারের প্রতি যে অভিযোগ এসেছে তা হলো পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর কেন্দ্র দখলের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ, ইয়াহিয়া খান তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন। 


আমার পর্যবেক্ষণে এটা সঠিক নয় যে, ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের প্রতি প্রীতি দেখিয়ে তাকে দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। বরং বলা যায় ইয়াহিয়া খান কেন্দ্র দখলের মতো পরিস্থিতি হবে এমন ধারণা করতে পারেননি বলে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর কারণ এটি একটি নতুন সংস্কৃতি যা আওয়ামী লীগের হয়ে নিউক্লিয়াস চালু করেছিল। এবং তা থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।   

২০ নভে, ২০২০

কুরআনের ভবিষ্যতবাণী ও আবু বকর রা.-এর বাজি


আমাদের মহানবী তখনো নবুয়্যত পাননি। তাঁর বয়স আনুমানিক ৩২ সেই সময়ের ঘটনা। তখন পৃথিবীর বড় সাম্রাজ্য ছিল দুইটা। রোম সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্য। রোমানরা ঈসা আ.-এর অনুসারী আর পারসিকরা ছিল অগ্নিপূজারক বা মুশরিক। রোমানরাও ঈসা আ.-এর নসিহতকে সঠিকভাবে মান্য করতো না বরং বিকৃত করে ঈসা আ.-কে আল্লাহর সাথে শরিক করতো। যাই হোক মুহাম্মদ সা. নবুয়্যত পাওয়ার প্রায় আট বছর আগে রোমের কায়সার মরিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়। ফোকাস নামক এক ব্যক্তি রাজ সিংহাসন দখল করে।

ফোকাস ছিল মরিসের সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডার। সে কায়সার মরিসের চোখের সামনে তার পাঁচ পুত্রকে হত্যা করে। তারপর নিজে কায়সারকে হত্যা করে পিতা ও পুত্রদের কর্তিত মস্তকগুলো কনস্ট্যান্টিনোপলে (ইস্তাম্বুল) প্রকাশ্য রাজপথে টাঙিয়ে দেয়। এর কয়েকদিন পর সে কায়সারের স্ত্রী ও তাঁর তিন কন্যাকেও হত্যা করে। সে সময় কনস্ট্যান্টিনোপল ছিল রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্র। 

এ ঘটনার ফলে পারস্যের (ইরান) বাদশাহ খসরু পারভেজ রোম আক্রমণ করার নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পান। কায়সার মরিস ছিলেন তার কূটনৈতিক বন্ধু। তার সহায়তায় পারভেজ ইরানের সিংহাসন দখল করেন। তাই খসরু মরিসকে নিজের পিতা বলতেন। এ কারণে তিনি ঘোষণা করেন, বিশ্বাসঘাতক ফোকাস আমার পিতৃতুল্য ব্যক্তি ও তার সন্তানদের প্রতি যে জুলুম করেছে আমি তার প্রতিশোধ নেবো। ফোকাস রোমের ক্ষমতা দখল ৬০২ সালে।  

৬০৩ সালে খসরু রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এবং কয়েক বছরের মধ্যে ফোকাসের সেনাবাহিনীকে একের পর এক পরাজিত করে একদিকে এশিয়া মাইনরের এডেসার (বর্তমান উরফা) এবং অন্যদিকে সিরিয়ার হালব ও আন্তাকিয়ায় পৌঁছে যায়। রোমের রাজ উপদেষ্টা পরিষদ যখন দেখলো ফোকাস দেশ রক্ষা করতে পারছে না তখন তারা আফ্রিকার গভর্ণরের সাহায্য চাইলো। আফ্রিকা রোমানদের অন্তর্গত ছিল। গভর্ণর তার পুত্র হিরাক্লিয়াসকে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী সহকারে কনস্ট্যান্টিনোপলে পাঠান। 

তারা সেখানে পৌঁছালে ফোকাস পদত্যাগ করেন। কারণ ততদিনে (প্রায় আট বছরে) নিশ্চিত হয় তার দ্বারা সাম্রাজ্য রক্ষা পাবে না, ফলে রাজধানীতে কেউ তাকে সাপোর্ট দিচ্ছিল না। আফ্রিকার গভর্নরের ছেলে হিরাক্লিয়াসকে কায়সার পদে অভিষিক্ত করা হয়। সে ক্ষমতাসীন হয়েই ফোকাসের সাথে একই ব্যবহার করেন যা সে ইতোপূর্বে মরিসের সাথে করেছিল। এটি ছিল ৬১০ খৃষ্টাব্দের ঘটনা এবং এ বছর নবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়্যত লাভ করেন।

খসরু পারভেজ যে অজুহাত ও নৈতিকতার ভিত্তিতে যুদ্ধ শুরু করেছিলো, ফোকাসের পদচ্যুতি ও তার হত্যার পর তার আর দরকার থাকে না। যদি সত্যিই বিশ্বাসঘাতক ফোকাসের থেকে তার জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করাই তার উদ্দেশ্যে থাকতো তাহলে তার নিহত হবার পর নতুন কায়সারের সাথে পারভেজের সন্ধি করে নেয়াই ছিল যুক্তিযুক্ত। কিন্তু খসুরুর মনে ছিল অন্য চিন্তা। সে এই সুযোগে রোমানদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করলো। খসরু এরপরও যুদ্ধ জারি রাখেন। শুধু তাই নয় খসরু এই যুদ্ধকে ধর্মীয় রূপ দেয়। ফলে যুদ্ধ অগ্নি উপাসক ও খৃষ্টবাদের মধ্যে ধর্মীয় যুদ্ধের রূপ নেয়। 

খৃষ্টানদের যেসব সম্প্রদায়কে ধর্মচ্যুত ও নাস্তিক গণ্য করে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় গীর্জা বছরের পর বছর ধরে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছিল (অর্থাৎ নাস্তুরী, ইয়াকূবী ইত্যাদি) তারাও আক্রমণকারী অগ্নি উপাসকদের প্রতি সর্বাত্মক সহানুভূতি দেখাতে থাকে। এদিকে ইহুদীরাও অগ্নি উপাসকদেরকে সমর্থন দেয়। এমন কি খসরু পারভেজের সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণকারী ইহুদী সৈন্যদের সংখ্যা ২৬ হাজারে পৌঁছে যায়।

হিরাক্লিয়াস এসে রোমানদের বিরুদ্ধে এই বাঁধভাঙ্গা স্রোত রোধ করতে পারে নি। সিংহাসনে আরোহণের পরপরই পূর্বদেশ থেকে প্রথম যে খবরটি তার কাছে পৌঁছে সেটি ছিল পারসিকদের হাতে আন্তাকিয়ার পতন। তারপর ৬১৩ খৃষ্টাব্দে তারা দামেশক দখল করে। ৬১৪ খৃষ্টাব্দে বায়তুল মাকদিস দখল করে পারসিকরা সমগ্র খৃষ্টান জগতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ৯০ হাজার খৃস্টানকে এই শহরে হত্যা করা হয়। তাদের সবচেয়ে পবিত্র আল কিয়ামাহ গীর্জা ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আসল ক্রুশ দণ্ডটি, যে সম্পর্কে খৃস্টানদের বিশ্বাস হযরত ঈসা আ.-কে তাতেই শূলবিদ্ধ করা হয়েছিল, পারসিকরা তা নিয়ে নিল। 

আর্চবিশপ জাকারিয়াকেও পাকড়াও করা হয় এবং শহরের সমস্ত বড় বড় গীর্জা তারা ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। খসরু পারভেজ দখলের নেশায় যেভাবে পাগলপারা হয়ে গিয়েছিল তা বায়তুল মাকদিস থেকে হিরাক্লিয়াসকে সে যে পত্রটি লিখেছিল তা থেকে আন্দাজ করা যায়। তাতে সে উল্লেখ করে,

“সকল খোদার বড় খোদা, সমগ্র পৃথিবীর অধিকারী খসরুর পক্ষ থেকে তার নীচ ও মূর্খ অজ্ঞ বান্দা হিরাক্লিয়াসের নামে-

“তুমি বলে থাকো, তোমার খোদা আল্লাহর প্রতি তোমার আস্থা আছে। তোমার খোদা আমার হাত থেকে জেরুজালেম রক্ষা করলেন না কেন?”

এ বিজয়ের পর এক বছরের মধ্যে মুশরিক সেনাদল জর্ডান, ফিলিস্তিন ও সমগ্র সিনাই উপদ্বীপ দখল করে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা মিসর পর্যন্ত বিস্তৃত করে। এটা এমন এক সময় ছিল যখন মক্কায় আল্লাহর রাসূল সা. ও তার অনুসারীদের ওপর নির্যাতন চলছে। নির্যাতনের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, ৬১৫ খৃষ্টাব্দে অনেক মুসলমানকে স্বদেশ ত্যাগ করে হাবশার (ইথিওপিয়া) খৃস্টান রাজ্যে (রোম সাম্রাজ্যের মিত্র দেশ) আশ্রয় নিতে হয়। 

রোম সাম্রাজ্যে পারস্যের বিজয় অভিযানের কথা ছিল সবার মুখে মুখে। মক্কার মুশরিকরা এসব কথায় আহলাদে আটখানা হয়ে উঠেছিল। তারা মুসলমানদের বলতো, দেখো, ইরানের অগ্নি উপাসকরা বিজয় লাভ করেছে। ওহী ও নবুয়্যত অনুসারী খৃস্টানরা একের পর এক পরাজিত হয়ে চলছে। অনুরূপভাবে আমরা আরবের মূর্তিপূজারীরাও তোমাদেরকে এবং তোমাদের দ্বীনকে ধ্বংস করে ছাড়বো। তারা বাইতুল্লাহর রক্ষক এবং আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন এমন দাবিও তারা করেছিলো। তারা এই ঘটনাবলী দিয়ে মুসলিমদের টিটকারী করছিলো।

এমন একটি সময়ে আল্লাহ তায়ালা সূরে রুম নাজিল করেন। সেখানে তিনি বলেন, 

১) আলিফ-লাম-মীম।

২) রোমানরা পরাজিত হয়েছে। 

৩) তাদের নিকটবর্তী অঞ্চলে। আর তারা তাদের এ পরাজয়ের পর অচিরেই বিজয়ী হবে। 

৪) কয়েক বছরের মধ্যেই। পূর্বের ও পরের সব ফয়সালা আল্লাহরই। আর সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে। 

৫) আল্লাহর সাহায্যে। তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।

৬) আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা খেলাফ করেন না। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।

৭) তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে জানে, আর আখিরাত সম্পর্কে তারা গাফিল। 

আল্লাহ তায়াল আল্লাহর রাসূল সা.-কে দিয়ে একটি ঘটনাকে সামনে রেখে দুটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। একটি হচ্ছে, রোমানরা জয়লাভ করবে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মুসলমানরাও একই সময় বিজয় লাভ করবে। আপাত দৃষ্টিতে এ দুটি ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো একটিরও কয়েক বছরের মধ্যে সত্যে পরিণত হবার দূরতম সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছিল না। একদিকে ছিল মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুসলমান। তারা মক্কায় নির্যাতিত হয়ে চলছিল। এ ভবিষদ্বাণীর পরও আট বছর পর্যন্ত কোনো দিক থেকে তাদের বিজয় লাভের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। 

অন্যদিকে রোমের পরাজয়ের বহর দিনের পর দিন বেড়েই চলছিল। ৬১৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র মিশর পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে চলে এসেছিল। অগ্নি উপাসক সেনাদল লিবিয়ার ত্রিপোলির সন্নিকটে পৌঁছে তাদের পতাকা গেঁড়ে দিয়েছিল। এশিয়া মাইনরে পারস্য সেনাদল রোমানদের বিতাড়িত ও বিধ্বস্ত করতে করতে বসফোরাস প্রণালীতে পৌঁছে গিয়েছিল। 

৬১৭ সালে তারা কনস্ট্যান্টিনোপলের সামনে খিলকদুন দখল করে নিয়েছিল। কায়সার খসরুর কাছে দূত পাঠিয়ে অত্যন্ত বিনয় ও দীনতা সহকারে আবেদন করলেন, আমি যে কোনো মূল্যে সন্ধি করতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি জবাব দিলেন, “এখন আমি কায়সারকে ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তা দেবো না যতক্ষণ না তিনি শৃঙ্খলিত অবস্থায় আমার সামনে হাজির হন এবং তার শূলীবিদ্ধ ঈশ্বরকে ত্যাগ করে অগ্নি খোদার উপাসনা করেন।” অবশেষে কায়সার হিরাক্লিয়াস এমনই পরাজিত মনোভাব সম্পন্ন হয়ে পড়লেন যে, তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল ত্যাগ করে কার্থেজে (তিউনিস) চলে যাবার পরিকল্পনা করলেন। 

কুরআন মাজীদের এ আয়াতগুলো নাযিল হলে মক্কার কাফেররা এ নিয়ে খুবই ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে থাকে। হাসি তামাশা করতে থাকে। কুরআন ও আল্লাহর রাসূল সা.-এর ওপর আবু বকরের রা.-এর বিশ্বাস ছিল চূড়ান্ত। তাই মুশরিকদের বিদ্রুপ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি মুশরিকদের বাজি লাগানোর জন্য আহ্বান করেন। এতে উবাই ইবনে খালফ হযরত আবু বকর (রা.)-এর সাথে বাজি রাখে। সে বলে, যদি তিন বছরের মধ্যে রোমানরা জয়লাভ করে তাহলে আমি তোমাকে দশটা উট দেবো অন্যথায় তুমি আমাকে দশটা উট দেবে। নবী (সা.) এর বাজীর কথা জানতে পেরে বলেন, কুরআনে বলা হয়েছে فِي بِضْعِ سِنِينَ আর আরবী ভাষায় بضع শব্দ বললে দশের কম বুঝায়। কাজেই দশ বছরের শর্ত রাখো এবং উটের সংখ্যা দশ থেকে বাড়িয়ে একশো করে দাও। তাই হযরত আবু বকর (রা.) উবাইর সাথে আবার কথা বলেন এবং নতুনভাবে শর্ত লাগানো হয় যে, দশ বছরের মধ্যে উভয় পক্ষের যার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হবে সে অন্যপক্ষকে একশোটি উট দেবে।

৬২২ সালে একদিকে নবী (সা.) হিজরত করে মদীনায় চলে যান। অন্যদিকে কায়সার হিরাক্লিয়াস নীরবে কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে বের হয়ে কৃষ্ণসাগরের পথে আর্মেনিয়ার দিকে রওয়ানা দেন। সেখানে গিয়ে তিনি পেছন দিক থেকে ইরানের ওপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই প্রতি আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য কায়সার গীর্জার কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন জানান। ফলে খৃস্টীয় গীর্জার প্রধান বিশপ সারজিয়াস খৃস্টবাদকে মাজুসীবাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গীর্জাসমূহে ভক্তদের নজরানা বাবদ প্রদত্ত অর্থ সম্পদ সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেন।

হিরাক্লিয়াস ৬২৩ খৃষ্টাব্দে আর্মেনিয়া থেকে নিজের আক্রমণ শুরু করেন। দ্বিতীয় বছর ৬২৪ সালে তিনি আজারবাইজানে প্রবেশ করে জরথুস্ট্রের জন্মস্থান আরমিয়াহ ধ্বংস করেন এবং পারসিকদের সর্ববৃহৎ অগ্নিকুণ্ড বিধ্বস্ত করেন। আল্লাহর কি অপার মহিমা! এই বছরেই মুসলমানরা বদর নামক স্থানে মুশরিকদের মোকাবিলায় প্রথম বিজয় লাভ করে। এভাবে সূরা রূমে উল্লেখিত দু’টি ভবিষ্যদ্বাণীর দশ বছরের সময়সীমা শেষ হবার আগেই একই সঙ্গে সত্য প্রমাণিত হয়।

এরপর রোমান সৈন্যরা অনবরত ইরানীদেরকে পর্যুদস্ত করে যেতেই থাকে। ৬২৭ খৃষ্টাব্দে নিনেভার যুদ্ধে তারা পারস্য সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়। এরপর পারস্য সম্রাটদের আবাসস্থল বিধ্বস্ত করে। হিরাক্লিয়াসের সৈন্যদল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং তারা তদানীন্তন পারস্যের রাজধানী তায়াসফুনের (এখন বাগদাদের একটি এলাকা) দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। ৬২৮ সালে খসরু পারভেজের পরিবার তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাকে বন্ধী করা হয়। কয়েকদিন পরে কারা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সে নিজেও মৃত্যুবরণ করেন। এ বছরই হুদাইবিয়ার চুক্তি সম্পাদিত হয়, যাকে কুরআন মহাবিজয় নামে আখ্যায়িত করেছে এবং এ বছরই খসরুর পুত্র দ্বিতীয় কুবাদ সমস্ত রোম অধিকৃত এলাকার ওপর থেকে অধিকার ত্যাগ করে এবং আসল ক্রুশ ফিরিয়ে দিয়ে রোমের সাথে সন্ধি করে। 

৬২৯ সালে খ্রিস্টানদের “পবিত্র ক্রুশ”কে স্বস্থানে স্থাপন করার জন্য কায়সার নিজে “বায়তুল মাকদিস” যান এবং এ বছরই নবী (সা.) কাযা উমরাহ আদায় করার জন্য হিজরতের পর প্রথম বার মক্কায় প্রবেশ করেন।

এরপর কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী যে, পুরোপুরি সত্য ছিল এ ব্যাপারে কারো সামান্যতম সন্দেহের অবকাশই ছিল না। এই ঘটনাকে সাক্ষী করে আরবের বিপুল সংখ্যক মুশরিক কুরআন ও আল্লাহর রাসূল সা.-এর প্রতি ঈমান আনে। উবাই ইবনে খালফের উত্তরাধিকারীদের পরাজয় মেনে নিয়ে হযরত আবু বকর (রা.)-কে বাজির একশো উট দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। 

তিনি সেগুলো নিয়ে মুহাম্মদ সা.-এর খেদমতে হাজির হন। নবী (সা.) হুকুম দেন, এগুলো সাদকা করে দাও। কারণ বাজি যখন ধরা হয় তখন শরীয়াতে জুয়া হারাম হবার হুকুম নাজিল হয়নি। কিন্তু এখন তা হারাম হবার হুকুম এসে গিয়েছিল। তাই জুয়ার অর্থ সাদকা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

১৭ নভে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৬৫ : পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান



 আমাদের প্রচলিত ইতিহাসে পাকিস্তান আমল সম্পর্কে আমাদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন পাকিস্তানীরা ব্রিটিশদের মতো আমাদের ওপর চেপে বসেছে অথবা আমাদের দেশ দখল তারা আমাদের শাসন করেছে। বস্তুত এটা মোটেই সত্য নয়। বরং পাকিস্তান তৈরি হওয়া থেকে নিয়ে পাকিস্তানের ২৪ বছর আমলে বাঙালিরা শাসকগোষ্ঠীর সাথে ছিলেন। পাকিস্তান আমলকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক গণতান্ত্রিক পাকিস্তান ও দুই সেনাশাসনের পাকিস্তান। গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের সময় ছিলো সাড়ে এগারো বছরের মতো। এই সময়ে ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মতো বাঙালি নেতারা। 

সেসময় পাকিস্তানের বড় জাতিগোষ্ঠী ছিল বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পশতুন ও কাশ্মিরী। গণতান্ত্রিক পাকিস্তানে ৭ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ৩ জন প্রধানমন্ত্রী ছিল বাঙালি, ৩ জন ছিলেন পাঞ্জাবি, বাকী একজন হলেন গুজরাটের (ভারত হতে আগত)। তাছাড়া ৭ জনের প্রতিটি মন্ত্রীসভায় বাঙালিদের উপস্থিতি ছিল বেশ ভালো। তাই পাকিস্তানে বাঙালিদের শাসন ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা হয়েছে এমন ধারণা অমূলক। 

পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের মধ্যে সাড়ে ১২ বছর ছিল সেনাশাসন। এর মধ্যে আইয়ুব খান সাড়ে ১০ বছর আর ইয়াহিয়া খান ২ বছর। আইয়ুব খান শুধু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সমস্যা ছিলেন না বরং সমগ্র পাকিস্তানের জন্যই সমস্যা ছিলেন। বেশি সমস্যা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। আর এজন্য তারা আইয়ুবের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন করে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে। অন্যদিকে আইয়ুব বাঙালিদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছে এবং ঢাকাকে সেকেন্ড ক্যাপিটাল হিসেবে গড়ে তুলেছে। তাই আইয়ুবের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন করেনি বাঙালিরা। বরং ভাসানীর মতো জনপ্রিয় নেতা আইয়ুবের হয়ে কাজ করেছেন। সময়ে সময়ে শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগও আইয়ুবের সাথে ষড়যন্ত্রের অংশিদার হয়েছে। আইয়ুবের মন্ত্রীসভায়ও বাঙালিদের আধিক্য ছিল। 

বস্তুত ১৯৪৭ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আমল থেকেই এ অঞ্চলের উন্নয়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়। জিন্নাহ বিমান বা স্থল বাহিনীর পাশাপাশি নৌ-বাহিনীকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংযোগ রক্ষার জন্য নৌ-পথই একমাত্র উপায় বলে সম্ভবত নৌ বাহিনীকে শক্তিশালী করার আগ্রহ তাঁর বেশী ছিল। রিয়ার এডমিরাল জে. ডব্লিউ জেফোর্ড হাজার মাইল দূরে পূর্ব পাকিস্তানে কোন নেভাল বেস না থাকায় ক্রুসহ একটি গোটা বেতার ষ্টেশন চট্টগ্রামে আকাশ পথে নিয়ে এসে বসালেন।

দেশের শিল্পোন্নয়নের জন্য আমাদেরকে যেমন চীন-কোরিয়ানদেরকে Foreign Direct Investment করার জন্য আহ্বান জানাতে হচ্ছে, তাদেরকে বিভিন্ন tax rebate দিতে হচ্ছে। পাকিস্তান হবার পর ইস্পাহানী, আদমজী, বাওয়ানীসহ বড় বড় শিল্পোদ্যক্তাদেরকে দেশের এ অঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য আহ্বান জানানো হয়। তারা প্রতিষ্ঠিত করেন আদমজী, ইস্পাহানী ও বাওয়ানী জুট মিল এবং এদের পথ অনুসরণ করে বাংলাভাষী মুসলমানরা ১৯৭১ সনের মধ্যে গড়ে তুলে পাটকল ৭৬টি, বস্ত্রকল ৫৯টি ও চিনি কল পূর্বের ৪টিসহ ১৫টি।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এই অঞ্চলে রেলপথের প্রসার, টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাফ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। তবে বাংলার উন্নয়নের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন তাল মেলাতে পারে নি কারণ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের শোষণের ফলে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পার্থক্য ছিল অনেক বেশি। ইংরেজ আমলে সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার হয়েছে পূর্ব বাংলা। এখানে শিল্প কারখানা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে চলেছে ১০০ বছর। এই ১০০ বছর কোম্পানী শাসনে চলেছিলো। পরবর্তী ৮০-৯০ পশ্চিম পাকিস্তান পুরোপুরি ব্রিটিশদের কবলে আসে। কিন্তু ততক্ষণে ব্রিটিশরা তাদের বর্বরতা থেকে অনেকটাই সরে এসেছিলো। এরপরও পূর্ব বাংলায় উন্নয়ন হয় নি হিন্দুদের কঠোর বিরোধীতায়। তাই ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার অবস্থান ছিল পুরো ভারতের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা।  

সেখান থেকে পূর্ব বাংলাকে কামব্যাক করার সুযোগ দিয়েছেন পাকিস্তান আমলের শাসকেরা। ২৪ বছরে উন্নয়নের হার পাকিস্তানের অন্য অঞ্চলগুলোর চাইতে অবিশ্বাস্যরকম বেশি ছিলো। এই ২৪ বছরে তাই আপনি একটি আন্দোলনও দেখাতে পারবেন না যেখানে বৈষম্যের জন্য আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলন যা হয়েছে সব ছিলো রাজনৈতিক আন্দোলন। জাতিগত আন্দোলন হয়েছে শুধু একটা আর সেটা হলো ভাষা আন্দোলন। কিন্তু মজার বিষয় হলো পূর্ব বাংলার বেশিরভাগ জনগণ ভাষা আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। 

পাকিস্তান আমলের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো  

০১. বাংলাদেশ সচিবালয় (১৯৭১ সনের পর এ সচিবালয়ের পুরাতন ৬ নং ভবনটি ভেঙে ২০ তলা ভবন তৈরী করা হয়) 
০২. পাকিস্তানের Second capital হিসাব শেরেবাংলা নগরকে পরিকল্পিতভাবে তৈরী (যার সুবিধা আমরা এখন নিচ্ছি)
০৩. সংসদ ভবন (পাকিস্তানের গণপরিষদের জন্য তৈরি বিশাল কমপ্লেক্স)
০৪. বায়তুল মোকাররম মসজিদ (পাকিস্তানের জন্য আইকনিক ও সবচেয়ে বড় মসজিদ) 
০৫. বাংলা একাডেমি (বাংলা ভাষা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য)
০৬. ইসলামিক একাডেমি (বর্তমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
০৭. পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়াপদা) 
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকরা চলে যাবার সময় ঢাকায় কোনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল না। অথচ ভারতের প্রায় সব শহরেই তখন কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা ছিল। ঢাকার নবাব পরিবারের জন্য তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দুটি জেনারেটরের ব্যবস্থা ছিল। ১৯৪৮ সালে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিস্থিতির পরিকল্পনা ও উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অধিদপ্তর তৈরি করা হয়। ১৯৫৯ সালে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়াপদা) তৈরি করা হয়। ১৯৬০ সালে উচ্চতর ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয় সিদ্ধিরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় (সর্বোচ্চ উচ্চক্ষমতার কেন্দ্রের আকার ছিল সিদ্ধিরগঞ্জে ১০ মেগাওয়াটের স্টিম টারবাইন)। তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়ায় ০ মেগাওয়াট থেকে ৪৭৫ মেগাওয়াট। যার অধিকাংশই উৎপাদিত হত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল চালিত জেনারেটর দ্বারা, স্টিম টারবাইন জেনারেটর দ্বারা এবং জল বিদ্যুৎ থেকে।
০৮. কমলাপুর রেল ষ্টেশন (পূর্বতন রেল ষ্টেশনটি ছিল গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়ায়) 
০৯. মিরপুর চিড়িয়াখানা (পূর্বতন চিড়িয়াখানায় বর্তমানে জাতীয় ঈদগাহ, সুপ্রীম কোর্টের প্রবেশদ্বারসহ প্রাঙ্গণ, বার কাউন্সিল, সড়ক ভবন নির্মিত হয়েছে) 
১০. কুর্মিটোলা বিমানবন্দর (ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) 
১১. যমুনা সেতু (১৯৬৬ সনে একনেকে অনুমোদিত) 
১২. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (১৯৬১ সনে এটির পরিকল্পনা গ্রহণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক কর্মকর্তাকে বিদেশে প্রশিক্ষণে প্রেরণ করা হয়, যারা বর্তমানে ইরান-ইরাকে কর্মরত। ১৯৭২ সনে প্রকল্পটি শেখ মুজিব বন্ধ করে দেয়া হয়) 
১৩. জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় 
১৪. বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ 
১৫. শেরে বাংলা কৃষি কলেজ (এখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) 
১৬. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়  
১৭. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
১৮. ইস্ট পাকিস্তান হেলিকপ্টার সার্ভিস (বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, মংলা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, চাঁদপুর, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, ফরিদপুর এই স্থানগুলোর সাথে ঢাকার যোগাযোগ দ্রুত করতেই এই সার্ভিসের আয়োজন করে পাকিস্তান। এই সার্ভিস সরকারি ভর্তুকি দিয়ে পরিচালনা করা হতো। অথচ এরকম সার্ভিস পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল না ) 
১৯. শাহজীবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র 
২০. আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র 
২১. কর্ণফুলী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র 
২২. হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল 
২৩. গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প 
২৪. রামপুরা টেলিভিশন ভবন (পাকিস্তানের টেলিভিশন সেন্টার লাহোরে ও ঢাকায় একইসাথে স্থাপন করা হয়। লাহোরে সম্প্রচার শুরু হওয়ার একমাস পরে ঢাকায় সম্প্রচার শুরু হয়)
২৫. ঢাকা স্টেডিয়াম (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) 
২৬. জাতীয় যাদুঘর (পূর্বতন যাদুঘরটি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে) 
২৭. WAPDA এবং এর অধীন শতশত বাধ ও সেচ প্রকল্প 
২৮. ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (যা বর্তমানে রাজউক নামে পরিচিত। ঢাকাকে আধুনিক ও পরিকল্পিত নগর করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গুলশান, বনানী প্রভৃতি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গঠন ও নগরায়ন। ঢাকা রক্ষা বাঁধসহ বহু উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া ও বাস্তবায়ন করা হয়) 
২৯. শত শত পাট ও কাপড়ের কল যা বাংলাদেশ হওয়ার পর জাতীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয় 
৩০. শিল্পায়নের জন্যে গড়ে তোলা হয় East Pakistan Industrial Development Corporation (EPIDC) 
৩১. গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানা (Ordinance Factory) 
৩২. গাজীপুর মেশিন টুলস ফেক্টরি 
৩৩.The Mercantile Marine Academy পরবর্তীত নাম Bangladesh Marine Academy 
৩৪. Institute of Postgraduate Medicine and Research (পিজি হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়)  
৩৫. মংলা সামুদ্রিক বন্দর  
৩৬. ঢাকার নিউ মার্কেটসহ বিভাগীয় শহরে এক একটি নিউ মার্কেট তৈরী। 
৩৭. রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, সিলেট বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
৩৮. পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (নৌ-পথে যাত্রী ও মালামাল পারাপারের জন্য এটি তৈরি করা হয়, বর্তমান নাম বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ। অব্যাহত দুর্নীতির ফলে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখে নি। অথচ পাকিস্তান আমলে তা লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল)
 
তারপরও মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে এ অঞ্চলের মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি করা হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা এ অঞ্চলের মানুষকে কেবল শাসন-শোষন করছে, উন্নয়নমূলক কোন কাজ করেনি। এছাড়া সকল ক্ষেত্রের উন্নয়নের পরিকল্পনাকে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করা হয়। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের জন্য ১৯৭১ সালের পরে যে তত্ত্বকথা ও যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছিল তা ছিল দু’অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দৃশ্যমান বৈষম্য ও বিভিন্নতা। পূর্ব পাকিস্তানকে দেখানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানী জনগোষ্ঠীর শোষণের ক্ষেত্র হিসেবে। 

আমরা যে পরিসংখ্যানগুলো জানি, তা মূলত ষাট-এর দশকের শেষ দিকে প্রাপ্ত কিছু সংখ্যা ও সংখ্যাতত্ত্ব। এর মধ্যে উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের তথা কেন্দ্রীয় সুপিরিয়ার সার্ভিস (সিএসএস) ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলকভাবে কম থাকা। উপস্থাপিত পরিসংখ্যানে এটাও দেখানো হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় উন্নয়ন খাতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কম অর্থ বরাদ্দ করা। যদিও উপস্থাপিত ঐ পরিসংখ্যান অসত্য ছিলনা; কিন্তু জনগণের সামনে যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং প্রচারণা সেই পরিসংখ্যান নিয়ে চালানো হয়েছে, তা মোটেই সত্যি ও বাস্তব নির্ভর ছিল না। ঐসব পরিসংখ্যানকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রচারণা সর্বোতভাবে সত্যি ছিল না; হয়তো কিয়দাংশ ছিল ব্যতিক্রম এবং তাও ছিল অর্ধসত্য।

পুরো পরিসংখ্যান সহজ হয়ে যাবে যদি আপনি কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করেন। তখন আপনার দিব্যচোখে যে বৈষম্য দেখছেন তা বৈষম্য থাকবে না। অনেকক্ষেত্রে উদারতা মনে হবে।

প্রথমত,
তৎকালীন পাকিস্তানে প্রদেশ ছিল পাঁচটি। বরাদ্দ হয়েছে প্রদেশভিত্তিক। প্রদেশভিত্তিক উন্নয়ন বরাদ্দ যদি আপনি ধরেন তাহলে আপনি আপনি মোট বরাদ্দকৃত অর্থকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করুন। তাহলে দেখা যাবে বেশী বরাদ্দ ছিল পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের জন্য।

এখানে আমি বলতে চাই না বাংলাদেশের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। সাধারণত বরাদ্দ দেয়া হয় প্রয়োজন অনুসারে। পাকিস্তানের এই অংশ আকারে ছোট হলেও এর এখানে মানুষ ছিল বেশী। পাকিস্তানের একটি প্রদেশ বাংলাদেশে ছিল অধিকাংশ মানুষ। সেই হিসেবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এখানে বরাদ্দ কিছুটা বেশী লাগবে এটাই স্বাভাবিক। 

বরাদ্দের ক্ষেত্রে সমান হতে হবে এই ধারণা অবান্তর। বাংলাদেশের প্রতিটা জেলায় কি সমান বরাদ্দ হয়? বাংলাদেশের প্রতিটা বিভাগে কি সমান বরাদ্দ হয়? আবার কিছু কিছু বরাদ্দ আছে দূর্যোগকালীন। দূর্যোগ হলে বরাদ্দ হয়, খরচ হয়। আবার দূর্যোগ না হলে খরচ হয় না। এভাবেই চলে। এই নিয়ে প্রতিবেদন দাঁড় করানো অন্যায়, অযৌক্তিক। 

দ্বিতিয়ত 
যে কোন দেশের উন্নয়ন হয় রাজধানী কেন্দ্রীক। একটা পরিসংখ্যান দাঁড় করানো হয় পাট, পাটজাতীয় দ্রব্য ও অন্যান্য খাদ্যশস্য বেশী উৎপন্ন হয় বাংলাদেশে। কিন্তু উন্নয়ন বেশী হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। মূল কথা হল সারা পশ্চিম পাকিস্তানজুড়ে উন্নয়ন বেশী হয় নি। উন্নয়ন হয়েছে রাজধানী কেন্দ্রীক। এটা খুবই স্বাভাবিক। এটাকে আপনি যদি বৈষম্য বলেন তাহলে বলতে হয় বর্তমান বাংলাদেশে এর চাইতেও বেশী বৈষম্য হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যে কোন উৎপাদনের দিক দিয়ে (কাঁচামাল ও শিল্পজাত) সবচেয়ে পেছনে থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের সব উন্নয়ন হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীক। 

কেউ যদি বলে আমাদের প্রধান ফসল ধান সবচেয়ে বেশী উৎপাদন হয় দিনাজপুরে। তাই ঢাকার মত সকল উন্নয়ন দিনাজপুরেও করতে হবে। বড় বড় হোটেল করতে হবে। পিকনিক স্পট করতে হবে। ফ্লাইওভার করতে হবে। ঢাকার মত সমান করে উন্নয়ন বরাদ্দ দিতে হবে তাহলে এটাকে আপনি পাগলের প্রলাপ বলবেন নিশ্চয়ই। এটাকে যদি পাগলের প্রলাপ বলেন তবে কেন আপনি চান পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে সমান বরাদ্দ দিতে হবে? 

বাংলাদেশে সবচেয়ে সফল শিল্প ‘তৈরি পোশাক শিল্প’। এতে মানুষের কর্মসংস্থানও হয় অনেক বেশি। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গার্মেন্টস কারখানা ঢাকা বিভাগে যখন ছিল ১৫ হাজারের বেশি, তখন চট্টগ্রাম বিভাগে মাত্র এক হাজার আর রংপুর বিভাগে মাত্র তিনটি। এখন এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেউ যদি বলে ঢাকা বিভাগ অন্যান্য বিভাগের সাথে বৈষম্য করেছে তা রীতিমত হাস্যকর। কারণ বাংলাদেশের যেখানে এই শিল্প কারখানা স্থাপন করা লাভজনক সেখানেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে। 

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে নগরায়ন অনেক কম হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের তুলনায়। ব্যবসা বাণিজ্যসহ সবদিক দিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামে। এর নানান কারণ রয়েছে। শিক্ষিতের হার, নদী বন্দর, সমুদ্র বন্দর, ব্যবসা বাণিজ্য জন্য আগে থেকেই বিখ্যাত, যোগাযোগের সুবিধা, জলবায়ু ইত্যাদি অনেক কিছুই অবদান রেখেছে। এই ব্যাপারটিকে সামনে এনে কেউ যদি বলে উত্তরবঙ্গের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে তবে তা ভুল হবে। 

তৃতীয়ত 
অনেকে বলে থাকেন এদেশে বেশী মানুষের বাস ছিল। এদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতেও বেশি বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল। এটা নিরঙ্কুশ নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন প্রয়োজন হতে পারে। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি ক্ষেত্রে বরাদ্দ আসলে জনসংখ্যার উপরে নির্ভর করে না। বরাদ্দ নির্ভর করে প্রয়োজনের উপরে। ধরুন ঢাকা- চট্টগ্রামের রাস্তা সংস্কার করতে হবে। সেক্ষেত্রে খরচ নির্ভর করবে না এ পথ দিয়ে কত মানুষ যাতায়াত করবে বরং নির্ভর করবে এর দূরত্ব কত? পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে সাতগুণ বড়। সেক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সেখানে খরচ বেশি হবে এটা স্বাভাবিক। এভাবে শুধু যোগাযোগ নয় অবকাঠামোসহ প্রায় সকল উন্নয়ন বরাদ্দের জন্য জনসংখ্যা মূল ফ্যাক্টর নয়। 

চতুর্থত
আরেক সমস্যা হল আমরা মনে করে নিয়েছি পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পূর্ব ও পশ্চিমের জীবনযাত্রা অবকাঠামো সমান ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সনে পাকিস্তান হবার সময় পূর্ব পাকিস্তান যা ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত ছিল এবং যা তদানীন্তন ভারতের যে কোন অঞ্চলের চাইতে ছিল পশ্চাদপদ। পূর্ব পাকিস্তানের নতুন রাজধানী ঢাকার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী, লাহোর ও অন্যান্য শহরের একটি তুলনা করতে গিয়ে এক সময়ের পূর্ব বাংলা সম্পর্কে অভিজ্ঞ সাংবাদিক লেখক এইচ.এম আব্বাসী লিখেন: ‘ঢাকা যখন রাজধানীতে পরিণত হয় তখন সেখানে মুসলমান কিংবা হিন্দু মালিকানায় একটি সংবাদপত্রও প্রকাশিত হতো না। মাত্র ৫ ওয়াটের একটি রেডিও ষ্টেশন ছিল এবং বেশ কয়েক বছর সময় লাগে সেখান থেকে বাংলা দৈনিক আজাদ ও ইংরেজী দৈনিক মনিং নিউজ প্রকাশনা শুরু হতে। আমার একটা বড় দায়িত্ব ছিল পত্রিকার ছবি ব্লক করে করাচী থেকে বিমান যোগে তা ঢাকায় প্রেরণ করা যা নতুন ইংরেজী দৈনিক অবজারভার-এ প্রকাশিত হতো অর্থাৎ ঢাকায় ব্লক বানানোর কোন মেশিনও ছিল না।

তারপরেও পূর্ব পাকিস্তানের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগেনি, এটা অবিশ্বাস্যকর। এটার একটা বড় কারণ হতে পারে পাকিস্তান শাসকরা এই প্রদেশটিকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত উন্নয়নের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান তার জীবন শুরু করে বলা যায় সম্পূর্ণ শূন্য থেকে, অর্থনৈতিক ও শিল্পক্ষেত্রে প্রদেশটির কোনই অবকাঠামো ছিল না। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ছিল মোটামোটি শিল্পসমৃদ্ধ এবং ছিল সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক অবকাঠামো। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে সর্ব বিবেচনায় পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় অনেক অগ্রসর।’

১৯৪৭ সালের বাস্তব চিত্র হল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগনই ছিল গরীব। বৃটিশ যুগের পূর্ব বাংলায় বসতি স্থাপনকারীদের জীবনের মান ছিল অতি নিচে। এর সুস্পষ্ট কারণ ছিল পূর্ব বাংলা বৃটিশদের কলোনী হিসেবে শোষিত ও নিগৃহীত হয়েছে ১৯০ বছর তথা ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তান অঞ্চলে বৃটিশদের কলোনী ও শোষণের সময়কাল ছিল ৯০ বছর। প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৮৫৮ সালে বৃটিশ রাণী ভিক্টোরিয়া পুরো ভারতের কর্তৃত্ব গ্রহণের পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এটা মোটেই অবিশ্বাস্য নয় যে, বৃটিশদের শাসনামলে পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক বেশী শোষিত ও নিগৃহীত হয়েছিল। বিদেশী শাসন-শোষণ ছাড়াও পূর্ব বাংলার জনসাধারণ তাদের স্বদেশীদের দ্বারাও বৃটিশ শোষণ থেকে কম নির্যাতিত ও শোষিত হয়নি। জনসংখ্যার অধিকাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ভূমির প্রায় নিরঙ্কুশ মালিকানা ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের। ১৯৪৭ সাল নাগাদ তারা ৮০ শতাংশ ভূমির মালিক ছিল।

পঞ্চমত
কথিত বৈষম্যের প্রমাণ হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের কম প্রতিনিধিত্বের অভিযোগ একটি জনপ্রিয় শ্লোগান। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩ লক্ষ সদস্যের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার। অথচ সংখ্যায় বাঙালি ছিল বেশি। এই সংখ্যা দেশের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য চিত্রিত করে। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবানুগভাবে বিষয়টির মূল্যায়ন করতে হলে কেহই ১৯৪৭ সালে সেনাবাহিনীতে বাংলাভাষী মুসলমান সৈনিকদের সংখ্যা কত ছিল এই হিসাবের দিকে অবশ্যই দৃষ্টিপাত করবে। পাকিস্তানের শুরুতে ফেডারেল সেনাবাহিনীতে বাংলাভাষী মুসলমান সৈনিকের সংখ্যা ছিল শ’কয়েক বা কোন অবস্থাতেই এক হাজারের বেশী নয়।

সেনাবাহিনীতে বাংলাভাষীদের সংখ্যা অতি নগণ্য হওয়ার ঐতিহাসিক কার্যকরণ রয়েছে। বৃটিশ আমলে বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে সেনাবাহিনীতে নেয়া হতোনা। আবার বাঙালি মুসলমানরাও বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে খুব একটা যেতোনা। মূল কারণ হল প্রাকৃতিক কারণে নাতিশীতোষ্ণমন্ডলের মানুষগণ যোদ্ধা হয় না। সাধারণত যোদ্ধা হয় রুক্ষ অঞ্চলের মানুষগণ। সেই হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ ঐতিহাসিকভাবে যোদ্ধা জাতি। আগে থেকেই সেনাবাহিনীতে তাদের উপস্থিতি ছিল বেশি। 

সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের এমন দূরাবস্থার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাঙালি তথা বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করে সেনা সার্ভিসে তাদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য অনুরোধ জানান। পাকিস্তানের ২৩ বছরে এক হাজার বাঙালি থেকে সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ হাজার-এ, যার বৃদ্ধি সূচক হচ্ছে চার হাজার শতাংশ। এই তুলনায় সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির হার ছিল অনেক কম। ঐ সময়ে ৫০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা সদস্য বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭১ সনে দাঁড়ায় ২,৬০,০০০ যার বৃদ্ধিসূচক হচ্ছে ১২০০ শতাংশ। অর্থাৎ তুলনামূলক বিবেচনায় সেনাবাহিনীতে অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২৮০০ শতাংশ বেশী। 

১৯৪৮ সালের হিসাব মতে সেনাবাহিনীতে চাকরীর জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানী প্রার্থী ছিল ২৭০৮ জন; আর পূর্ব পাকিস্তানের আবেদনকারী প্রার্থী ছিল মাত্র ৮৭ জন; অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী প্রার্থী ছিল ৩০০ ভাগ বেশী। ১৯৫১ সালে সেনাবাহিনীতে চাকুরী প্রার্থী পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল ১৩৪ আর পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল ১০০৮ জন। ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা একটু বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৬৫ জনে। কিন্তু তুলনামূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিল ২০০ গুণ বেশী অর্থাৎ ৩২০৪ জন। আবেদনপত্র দাখিল কিংবা সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য কিংবা ডিসক্রিমিনেশান থাকার গালগল্প হয়তো কেউ দাঁড় করাবেন, যা কিছুতেই প্রমাণযোগ্য নয়।

এটা অবশ্যই সবার জানার কথা যে সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে দরকার কঠোর ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ যা দিন কয়েক এবং মাস কয়েকের ব্যাপার নয়। পৃথিবীর কোন দেশের পক্ষেই জেনারেল এর চাইতে অনেক নিচের একজন সেনা অফিসারকেও ২৫ বছরের কমে তৈরী করা সম্ভব নয়। ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের দুই জন অফিসারের নাম উল্লেখ করার মত হয়ে উঠে এর একজন ছিলেন কর্ণেল ওসমানী এবং আর একজন ছিলেন মেজর গনি। অথচ ঐ সময়ের মধ্যে পাঞ্জাব ও পাঠানদের মধ্য থেকে বহু সৈনিক জেনারেল পদে পর্যন্ত উন্নীত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি পদে কর্মরত থাকাকালে আইয়ুব খান ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী অর্জনেচ্ছু ছাত্রদের এক সমাবেশে তাদেরকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার আহবান জানান। কিন্তু তাদের নিকট থেকে তেমন উৎসাহব্যাঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি। এর পরের দুই বছরের পরিসংখ্যানে তা স্পষ্ট। ১৯৫৬ সালে সেনাবাহিনীর অফিসার পদে আবেদনকৃতদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিল মাত্র ২২ জন; অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছিল ১১০ জন। ১৯৫৭ সনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আবেদন করার সংখ্যা ৮০ শতাংশ উন্নীত হয়ে দাঁড়ায় ৩৯ জনে, অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আবেদনকারীদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ থেকে ২৯৪-তে। 

ষষ্ঠত
সরকারি চাকুরি তথা কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ-এর সম্মিলিত প্রতিনিধিত্বের চাইতে অনেক কম। এর পাশাপাশি আর একটি বাস্তবতা ছিল পাঞ্জাবী নয়, পশ্চিম পাকিস্তানীদের এমন প্রতিনিধিত্বের সংখ্যাও ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা তথা বাঙালি, সিন্ধী, পাঠান ও বেলুচীদের ঐতিহাসিক অনগ্রসরতারই ফল। পাঞ্জাবে বসতি গড়া ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম মুহাজিররা ছিল পূর্ব বাংলা, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগোষ্ঠীর চাইতে পড়ালেখায় অনেক অগ্রসর। শিক্ষা-দীক্ষায় শেষোক্ত জনগোষ্ঠীর তুলনামূলক অনগ্রসতার কারণ ছিল অর্থনৈতিক এবং কিছুটা সামাজিক। বস্তুতঃ পূর্ব বাংলা, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানরা উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে। কিন্তু পাঞ্জাব ও অন্যান্য অঞ্চলের জনগণ আধুনিক উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শুরু করে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের বলা যায় পর পরই। 

অর্থাৎ তারা পাকিস্তানের অপরাপর অঞ্চলের মুসলমানদের চাইতে শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল ৭০ থেকে ৮০ বছরের অগ্রে। এর প্রধান কারণ ছিল উনবিংশ শতাব্দীর ৭০ এর দশকে স্যার সৈয়দ আহমেদেরর নেতৃত্বে আলীগড়ে প্রতিষ্ঠিত এঙ্গলো মহামেডান কলেজ ভারতের বধিষ্ণু অঞ্চলের মুসলমানদেরকে উচ্চ শিক্ষায় আকৃষ্ট করে তোলে। পাশাপাশি লাহোর সরকারী কলেজ এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বহু আগে। ১৮৫৭ সালে স্থাপিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেগুলোতে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ছিল অনুল্লেখ্য; এমনকি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও মুসলিম ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকজন। হিন্দু ছাত্র ও শিক্ষকরা ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে কেবল ১৯৪৭ সালের পর, যখন পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও শিক্ষকতার ফুরসত পায়। সত্যিকার অর্থে শিক্ষা-দীক্ষায় বাংলার মুসলমানদের অনগ্রসরতার কারণেই বৃটিশ যুগের ভারতীয় সিভিল সার্ভিস তথা আইসিএস-এ কোন বাঙালি মুসলমানের ঢোকার যোগ্যতা ছিলনা; যদিও উক্ত সার্ভিস ১৮৫৩ সালের অধ্যাদেশ বলে ১৮৫৪ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের প্রশাসন পায় মাত্র ১০০ জন প্রাক্তন আইসিএস অফিসার আর ভারত পায় ৫০০ জন। প্রাপ্ত ১০০ জনের মধ্যে একজনও বাঙালি কিংবা পাকিস্তানের অন্যান্য অনগ্রসর এলাকার ছিল না।

ঐ ১০০ জনের মধ্যে কেউ কেউ ছিল বৃটিশ বংশোদ্ভুত মুসলমান, কেউ ছিল শিক্ষায় অগ্রসর ভারতের অপরাপর এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীভূক্ত। সঙ্গত কারণেই তারা ছিল পাঞ্জাব বা ইউপি’র মুসলমান। পাঞ্জাব ও ইউপি’র মুসলমানদের অগ্রসরতা আর পূর্ব বাংলার মুসলমানদের অনগ্রসরতার আরো প্রমাণ আছে। ১৮৮৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় আইসিএস অফিসারদের মধ্যে পাঞ্জাবের ছিল তিন জন মুসলমান, শিখ ছিল দুই জন এবং হিন্দু ছিলনা একজনও; এমনকি মুসলমান সংখ্যালঘিষ্ঠ এলাকা অযোধ্যার ৫ জন মুসলমান ছিল আইসিএস আর তার বিপরীতে ছিল ছয় জন হিন্দু। অথচ বাংলা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও মাত্র দুই জন মুসলমান ছিল আইসিএস, আর ৯ জন ছিল হিন্দু। 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এক সময় আইসিএস সার্ভিসে শুধু মনোনীত একজন বাঙালি মুসলমান জনাব নুরুন্নবী চৌধুরীকে পাওয়া যায়। ফলে পাক প্রশাসনে উদ্ভূত বিশাল শুন্যতা পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের অফিসারদেরকে দিয়ে পুরণ করতে হয়েছে। তবে প্রতিযোগিতা নয় ১৯৪৯-৫০ সালে প্রবর্তিত ৪০ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সার্ভিসের পূর্ব পাকিস্তানীদের স্থান লাভ শুরু হয়। সেনাবাহিনীতেও একইভাবে পাকিস্তানের অপরাপর অঞ্চলের চাইতে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক সার্ভিসে নিয়োগ দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাকেও পাওয়া যায়নি; অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আট জনকে পাওয়া যায়।

১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাওয়া যায় দুই জনকে, একজন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাওয়া যায় ১৬ জনকে (যার মধ্যে ৭ জন ছিল পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট এবং ১০ জন ছিল ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১৬ বছরের ব্যবধানে ১৯৬৪ সালে সিএসএস-এ পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ জন (১৫ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) আর পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ জন (১৩ জন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের)। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সার্ভিসে পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় ১০ গুণ।

পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা বৃদ্ধি এত দ্রুত হারে ঘটেছিল যে তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সামগ্রিক প্রতিনিধিত্বের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যায়। যার দরুণ ১৯৭০-৭১ সালে বহু বাঙালি অফিসারই পাকিস্তান প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারী ছিল সিএসএস ক্যাডারের একজন বাঙালি। যে হারে পাকিস্তান প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আরো ১০ বা ২০ বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতিনিধিত্ব জনসংখ্যা অনুপাতে যথাযথ পর্যায়ে উপনীত হতো। 

সপ্তমত
১৯৭০ সনে পূর্ব পাকিস্তানে যে প্রাথমিক স্কুল ছিল ২৮৩০০ আর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৩৯৪১৮। বলা হয় প্রাথমিক শিক্ষায় পিছিয়ে রাখার জন্যই এই বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ বেশি স্কুলও থাকার কথা বেশি। এখানে প্রচারণা এমনভাবে চালানো হয় যাতে পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে সাতগুন বৃহৎ পশ্চিম পাকিস্তানের বাস্তবতা অসচেতন পাঠকের নিকট চাপা থাকে। মূলত শিশুদের জন্য প্রাথমিক স্কুল শিক্ষা বিস্তারের শুরু থেকেই প্রতিটি মহল্লায় গড়ে উঠে এবং তা প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রতিটি শিশুর পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে পারে এমন দূরত্বে। ফলে প্রতি ৪/৫ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা লাভ করে সন্নিহিত এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠার পর পরই। শিক্ষাবীদদের সংজ্ঞায় যাকে বলা হয় স্কুল মেপিং; এই বাস্তবতায় সাতগুণ বড় পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা বেশী হবারই কথা। সেই হিসেবে বলা যায় পশ্চিম পাকিস্তানে আরো বেশি স্কুল হওয়া উচিত ছিল। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। পার্থক্য খুব একটা বেশি ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪৪৭২ এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৩৯৬৪।

অষ্টমত
সবচেয়ে বড় কথা হল, পাকিস্তান যদি জাতিগতভাবে বাঙ্গালীদের ক্ষমতা থেকে দূরে অথবা শোষন করার চিন্তা করতো তবে তারা জনসংখ্যার অনুপাতে সংসদীয় আসন বিন্যাস করতো না। পাকিস্তানের মোট তিনশত আসনের মধ্যে ১৬২ আসন পূর্ব পাকিস্তানে দেয়া হত না। যার কারণে শুধু একটি প্রদেশের ভোট দিয়েই টোটাল পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। স্বৈরাচারী স্বৈরাচারীই। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান শুধু পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর ছিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যও তিনি স্বৈরাচার ছিলেন। এদেশের মানুষ যেমন তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষও তেমনি তার বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছে। স্বৈরাচারী আইয়ুবের শাসনকে দিয়ে টোটাল পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কথা বলার যৌক্তিকতা অন্তত এদেশের মানুষের কম। কারণ গণতান্ত্রিক পাকিস্তানে শাসন বেশী করেছে বাঙ্গালীরাই। এমনকি ভাষা আন্দোলনের সময়ও পাকিস্তানের শাসক ছিল বাঙ্গালীরাই। 

নবমত
বৈষম্যতত্ত্বের উদ্ভব ঘটানো হয়, পাকিস্তানে অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের প্রকৃত যে পরিসংখ্যান (যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতারণামূলক বলে প্রমাণিত হয়) তাতে উন্নয়নের যে গতি ছিল তা অব্যাহত থাকলে বৈষম্য সত্ত্বর বিদূরিত হয়ে দুই অংশের অর্থনৈতিক অবস্থা সমান রূপই পরিগ্রহ করতো। সে হিসেবে পাকিস্তান অবিচ্ছিন্ন থাকলে এত দিনে শুধু যে পুরো মুসলিম উম্মার নেতৃত্বেই দেশটি অভিষিক্ত হতো তাই নয়; বিশ্বের অন্যতম বৃহৎশক্তি হিসেবেও পাকিস্তান আবির্ভূত হতো। পাকিস্তানের তেমন সম্ভাবনাই ছিল ভারত ও ইহুদী চক্রের (যারা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার কাজে সর্বমূখী মদদ যুগিয়েছিল) চক্ষুশুল। তারা দ্রুত গড়ে উঠা মুসলিম শক্তি পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য সকল ধরণের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় লিপ্ত হয়।