২৩ নভে, ২০২০

বঙ্গকথা পর্ব-৬৬ : পাকিস্তানের ১ম সাধারণ নির্বাচন ও ইয়াহিয়া খান


আমাদের দেশে প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী আইয়ুব খানকে যতটা ভিলেন হিসেবে দেখানো হয় তার চাইতে বেশি ভিলেন দেখানো হয় ইয়াহিয়া খানকে। কিন্তু এই ইয়াহিয়া খানই বাঙালিদেরকে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক অধিকার দেন। পাকিস্তানের সকল জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেন। স্বৈরাচারমুক্ত পাকিস্তান গঠনে আমার দৃষ্টিতে তাঁর আন্তরিকতা ছিল অসাধারণ। তার হাত ধরে পাকিস্তানের জনগণ নিজেদের জন্য নেতা নির্বাচনের সুযোগ পায়।  


১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের কাছে থেকে ক্ষমতা গ্রহণের পর ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে যত শীঘ্র সম্ভব তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশকে একটি ব্যবহারযোগ্য শাসনতন্ত্র দেওয়া এবং যেসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়েছে তার একটা সমাধান বের করা। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেন। 


আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র বাদ দিয়ে ফেডারেল পার্লামেন্টারি ধরনের সরকারব্যবস্থা চালু করেন। প্রাপ্তবয়স্ক সকল পাকিস্তানী নাগরিকের ভোটাধিকারভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার দান এবং আইন-আদালতের মাধ্যমে এই অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং তাকে শাসনতন্ত্র রক্ষকের ভূমিকা দেয়া। যে আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য একটি ইসলামী ভাবাদর্শভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে, ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর দেশে জাতীয় পরিষদের এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত জাতীয় পরিষদের কাজ হবে দেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। তিনি ১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে উক্ত নির্বাচনের Legal frame work order-এর মূলধারাগুলো ঘোষণা করেন। উক্ত আদেশে নির্বাচন ও জাতীয় পরিষদ গঠন ও এর কার্যাবলি কেমন হবে তা ঘোষণা করেন। 


১. পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ৩১৩ জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১৩টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। 


২. মহিলারা সাধারণ আসনে নির্বাচনের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দও প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যগণ স্ব-স্ব প্রদেশের সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রার্থীগণকে নির্বাচিত করবেন। 


৩. প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ সেই প্রদেশের জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রার্থীগণকে নির্বাচিত করবেন। জাতীয় পরিষদের কোনো আসন শূন্য হলে তিন সপ্তাহের মধ্যে উক্ত শূন্য আসন নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। 


৪. ২৫ বৎসর বয়স্ক যে কোনো পাকিস্তানী নাগরিক যার নাম ভোটার তালিকায় লিপিবদ্ধ আছে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। (তবে আদালত কর্তৃক ঘোষিত বিকৃত মস্তিষ্ক কোনো ব্যক্তি, কিংবা আদালত কর্তৃক দুই বছরের বেশি সময়ের সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি সাজা ভোগের পর পাচ বছর সময় অতিবাহিত না হয়ে থাকলে, কিংবা ১৯৬৯ সালের ১ আগস্টের পর কোনো- না-কোনো সময় মন্ত্রী ছিলেন অথচ মন্ত্রিত্বের অবসানের পর দুই বছর অথবা কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের অনুমতি অনুসারে ২ বছরের কম কোনো নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে থাকে এমন ব্যক্তি, কিংবা সরকারি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি, কিংবা সরকারি চাকুরি থেকে বহিস্কৃত কোনো ব্যক্তি যদি বহিষ্কারের পর অন্তত পাঁচ বছর কিংবা কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের অনুমতি অনুসারে ৫ বছরের কম কোনো নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত না হয়ে থাকে, কিংবা পাকিস্তানের কোনো সরকারি চাকুরের স্বামী বা স্ত্রী হন, কিংবা তিনি আগে দেউলিয়া হন এবং আদালত কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত হবার পর ১০ বছর অতিক্রান্ত না হয়ে থাকে, ইত্যাদি এমন সকল প্রার্থী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।) 


৫. কোনো ব্যক্তি একই সঙ্গে জাতীয় পরিষদের ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রার্থী হতে পারবেন না। 


৬. কেউ একই সঙ্গে কোনো পরিষদের একাধিক নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী হতে পারবেন তবে একাধিক আসনে নির্বাচিত হলে তাকে নির্বাচনের সরকারি ফলাফল ঘোষণার পনেরো দিনের মধ্যে একটি আসন রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি তা করতে ব্যর্থ হলে তার নির্বাচিত সবগুলি আসন শূন্য বলে বিবেচিত হবে। 


৭. কোনো সাংসদ স্পিকার বরাবর স্বহস্তে লিখিত চিঠির মাধ্যমে পদত্যাগ করতে পারবেন। কোনো সদস্য স্পিকারের নিকট থেকে ছুটি না নিয়ে একাদিক্রমে পনেরোটি কার্যদিবসে অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হয়ে যাবে। কোনো সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদের প্রথম অধিবেশনের সাত দিনের মধ্যে শপথ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে তার সদস্যপদ শূন্য বলে গণ্য হবে। তবে স্পিকার নির্বাচনে বিলম্ব ঘটলে উপরিউক্ত সময়কাল বাড়ানো যাবে। 


৮. জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট তার পছন্দমতো দিন, সময় ও স্থানে জাতীয় পরিষদের সভা আহবান করবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিতে পারবেন। জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করবেন।


৯. স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকার পদ শূন্য হলে জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ অন্য আরেকজন সদস্যকে স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচিত করবেন। স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনার জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন। স্পিকারের পদ শূন্য হলে ডেপুটি স্পিকার কিংবা ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য হলে উক্ত পদ পূরণ না-হওয়া পর্যন্ত কমিশনার স্পিকার/ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করবেন। 


১০. জাতীয় পরিষদের কোনো অধিবেশনে ১০০ জনের কম সংখ্যক সদস্য উপস্থিত থাকলে অধিবেশনের কাজ চালানো যাবে না, অধিবেশন চলতে চলতে সদস্য সংখ্যা ১০০ জনের কম হয়েছে বলে কোনো সদস্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কোরাম পূর্ণ না-হওয়া পর্যন্ত অধিবেশন স্থগিত রাখবেন কিংবা মুলতবি করে দিবেন। সদস্যরা পরিষদে বাংলা, উর্দু কিংবা ইংরেজিতে বক্তৃতা দিবেন। পরিষদের কার্যবিবরণীর সরকারি রেকর্ড উর্দু, বাংলা এবং ইংরেজিতে রক্ষিত হবে। 


১১. ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বিন্যাস করা করা হবে। (এর ফলে বাঙালিরা লাভবান হয়, তবে এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়। শুধু মাত্র বাংলার আসন দিয়েই পুরো পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে বাংলা পায় ১৬২ টি আসন) 


ইয়াহিয়া খান ঘোষিত সিদ্ধান্তগুলো সকল বিরোধী দল সাদরে গ্রহণ করে। ভাসানী ন্যাপ বাদে অন্য দলগুলি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভাসানী মাওবাদী ছিলেন। গণতন্ত্র বাদে সশস্ত্র বিপ্লবে তিনি বিশ্বাস করতেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তিনি এবং তার দল সব সময় একটি অশান্ত পরিবেশ চাইতেন যাতে করে সেই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে জনগণকে ভুল বঝিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যায়। একই উদ্দেশ্য নিউক্লিয়াসেরও ছিল। তারা ভেবেছিলো যদি ইলেকশন হয় ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ পরিচালনা করে তবে তাদের বিরুদ্ধে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা কঠিন হবে। তাই ভাসানী নির্বাচনের বিরোধীতা করে আন্দোলন শুরু করে। এই সময় তিনি তার বিখ্যাত উক্তি করেন "ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো"। তবে জনগণ তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নি। এমনকি তার দলের মধ্যেও এই নিয়ে ভাঙন তৈরি হয়। ভাসানীর এই দূরাবস্থা দেখে নিউক্লিয়াসও দমে যায়। তাছাড়া ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ক্ষতও তাদের দূর্বল করে রাখে।  


১৯৭০ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে ১ম সাধারণ নির্বাচন। বেশ উৎসাহ উদ্দীপনায় সব দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ভাসানীর দল বাদে পাকিস্তানের প্রায় এগারোটি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তবে প্রায় সকল প্রধান দলসমূহ, যেগুলি সেসময় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হতো- সেগুলো মূলত ছিল আঞ্চলিক। যেমন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এর কোনো সমর্থন ছিল না। তদনুরূপ ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পাটির জনসমর্থন ছিল সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশদ্বয়ে, অন্যত্র তার সমর্থন ছিল না। ওয়ালী ন্যাপের সমর্থন বেশি ছিল বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। অপরদিকে সর্বপাকিস্তান ভিত্তিক যে-দলগুলি তখন ছিল সেগুলি কেবল নামেই ছিল সর্বপাকিস্তানী, বাস্তবে কোনো প্রদেশেই এগুলির ব্যাপক জনসমর্থন ছিল না। 


নির্বাচনে যাতে সকল রাজনৈতিক দল ভালোভাবে এটেইন করতে পারে সেজন্য ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ফলে সেদিন থেকেই নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সকল মতের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। ফলে তারা নির্বাচনী মেনিফোস্টেতে ৬ দফার কথা উল্লেখ করলেও বক্তব্য বিবৃতিতে তা উহ্য রাখে। বরং শেখ মুজিব ইসলামী কানুন প্রতিষ্ঠার কথা বলে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করা শুরু করে। 


১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ভেঙে ন্যাপ গঠিত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তা জনপ্রিয়তা লাভ করে। ৬০ দশকে সারা পৃথিবীর সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। পাকিস্তানেও তার ব্যাতিক্রম হয় না। ১৯৬৭ সালের কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে মস্কোপন্থী নেতারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা চালায়। তাই মশিউর রহমান যাদু মিয়ার পরামর্শে রংপুরে কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করা হয়। ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুরে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনের পর দেশিয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রশ্নে ন্যাপ চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের আবদুল ওয়ালী খান। পূর্ব পাকিস্তান ওয়ালী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ বাংলায় মোজাফফর ন্যাপ নামেও পরিচিত হয়।   


মোজাফফর ন্যাপ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে অগ্রাধিকার দিলেও ক্ষমতার বন্টন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ছয়দফা থেকে তাদের দাবি অনেক নমনীয় ছিল। ন্যাপ (ওয়ালী) কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয় ও মুদ্রা রেখে বাকি বিষয়গুলি প্রদেশের হাতে দেয়ার পক্ষপাতী ছিল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ এই যে, এই দলটি বাঙালি বুর্জোয়াদের দল এবং তারা পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়া গোষ্ঠীর একচেটিয়া সুযোগ সুবিধার অংশীদারিত্ব চায়। ন্যাপ (ওয়ালী) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল। তবে তা অর্জনের লক্ষ্যে তারা একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের নির্বাচনী শ্লোগান ছিল : বাংলার কৃষক-শ্রমিক জাগো’। 


মওলানা ভাসানী নির্বাচনের ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদান করতে থাকেন। তিনি একদিকে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, আবার ভোটের আগে ভাত চাই’ স্লোগানও উত্থাপন করেন। তিনি নির্বাচনে তার দলের অংশগ্রহণের ব্যাপারে দুই পূর্বশর্ত আরোপ করেন : এক, জাতীয় সংসদে কৃষক ও শ্রমিকদের জন্য আসন নির্দিষ্ট করতে হবে; দুই. নির্বাচনের পূর্বেই ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের আলোকে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নের মীমাংসা করতে হবে। এর মধ্যে নির্বাচনের আগে নানান দাবি দাওয়া উদ্ভট আন্দোলন শুরু করেন। এর মধ্যে চোর খেদাও অন্যতম। উনি হঠাৎ করে ঘোষণা করলেন গ্রাম-বাংলার চোর ডাকাত সমস্যা বড় সমস্যা। ভোটের আগে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। এই বলে তার কর্মীদের দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চোর নির্মুল কমিটি গঠন করলেন ও মব জাস্টিস সৃষ্টি করে কিছু খুন করলেন। শেষপর্যন্ত মওলানা ভাসানীর দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। 


পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) কেন্দ্রকে শক্তিশালী রেখে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, অর্থ, মুদ্রা, প্রাদেশিক ও বৈদেশিক বাণিজ্য এবং যোগাযোগ বিষয়ক ক্ষমতা অর্পণের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। পার্টি মেনিফেস্টোতে দাবি করা হয় যে, দুই প্রদেশের মধ্যে সকল ধরনের বৈষম্য যেন দশ বছরে দূর করা যায় সে লক্ষ্যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সংবিধানে উল্লেখ করা উচিত। এই দল বিশ্বাস করত যে কেবলমাত্র ধর্মীয় বন্ধনে পাকিস্তানের। উভয় অংশের ঐক্য অটুট রাখা সম্ভব। পিডিপি নেতা নূরুল আমিন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদিতার অভিযোগ উত্থাপন করে। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগের ছয়দফা দাবিকে নির্বাচনী রেফারেন্ডাম হিসেবে গণ্য করায় আওয়ামী লীগ যদি পূর্ব পাকিস্তানে জনসমর্থন অর্জন সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে জনসমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্য অটুট রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।


জামায়াতে ইসলামি এই দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা অপরাপর ইসলামি দল এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ উত্থাপন করে যে ঐ সকল দল ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। জামায়াতে ইসলামির মতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুসৃত ভুল নীতির কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। জামায়াত ১৯৫৬ সালের সংবিধানের কিছু পরিবর্তন করে উক্ত সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করে । পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রশ্নে জামায়াতের অভিমত ছিল যে বিভিন্ন প্রদেশকে এতটুকু স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা উচিত যা দেশের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট করবে না। 


জামায়াত ইসলামী আওয়ামী লীগের ছয়দফার সমালোচনা করে বলে যে ছয়দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করবে। পূর্ব পাকিস্তান জামাতের নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের ছয়দফা কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করে বলেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পাকিস্তানের অখন্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। জামায়াত দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান সমাজতান্ত্রিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচির দ্বারা সম্ভব নয়, কেবলমাত্র ইসলামী অর্থনীতিই পারে পাকিস্তানের সকল সমস্যার সমাধান করতে।


কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান পাঞ্জাবের মিঞা মমতাজ দৌলতানা পাকিস্তানে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, তিনি আওয়ামী লীগের ছয়দফার কঠোর সমালোচনা করেন এবং বলেন যে, ছয়দফার বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল ক্ষমতাহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়বে। এই দল যে-কোনো ধরনের সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল। দলের নেতৃবৃন্দ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির কঠোর সমালোচনা করে।


কনভেনশন মুসলিম লীগ শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা পাকিস্তানে ইসলামি আদর্শ অনুসরণের পক্ষপাতী ছিল। অন্য দুই মুসলিম লীগের ন্যায় এই দলও ভারত-বিরোধী পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের পক্ষপাতী ছিল। এই দলের নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন।


কাইয়ুম মুসলিম লীগ এই দলও ভারত-বিরোধী ছিল। দলের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানকে এই বলে অভিযুক্ত করেন যে, তিনি ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করতে চান। এই দল শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষপাতী ছিল। দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাই দলের লক্ষ্য বলে প্রচার করা হয়। উপরে উল্লেখিত দলসমূহের কর্মসূচি বিশ্লেষণ করলে তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়- প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী দল, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দল ও ডানপন্থী দলসমূহ যারা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার এবং ইসলামী ভাবধারার শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিল।


১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আসনসংখ্যা ছিল সাধারণ ৩০০ এবং মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ১৩টি। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল সাধারণ ১৬২ এবং মহিলা ৭টি। 


১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৯৭১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। ৩০০ টি আসনে মোট ১,৯৫৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর পর কিছু প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেয়। মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে ১,৫৭৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করে। আওয়ামী লীগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১৬২টি আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং অবশিষ্ট ৮ জন প্রার্থী দেয় পশ্চিম পাকিস্তানে। জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দেয়। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ১৫১। পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ১২০ আসনে প্রার্থী দেয়। তার মধ্যে ১০৩ টি ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা কোন প্রার্থী দেয়নি। পিএমএল (কনভেনশন) ১২৪ আসনে, পিএমএল (কাউন্সিল) ১১৯ আসনে এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ১৩৩ আসনে প্রতিদ্বন্দীতা করে।


নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রায় ৬৫% ভোট পড়েছে বলে সরকার দাবী করে। সর্বমোট ৫৬,৯৪১,৫০০ রেজিস্টার্ড ভোটারের মধ্যে ৩১,২১১,২২০ জন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ২৩,৭৩০,২৮০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটার।


জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সাথে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে।


আওয়ামী লীগ ৩৮.৩% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ১৬০

পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯.৫% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৮১

পিএমএল (কাইয়ুম) ৪.৫% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৯

পিএমএল (কনভেনশন) ৩.৩% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৭

জমিয়ত উলেমা -ই- ইসলাম ৪.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৭

মারকাজি জমিয়তন-উলেমা-পাকিস্তান ৪.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৭

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) ২.৩% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৬

জামায়াত-ই-ইসলামী ৬.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ৪

পিএমএল (কাউন্সিল) ৬.০% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ২

পিডিপি ২.৯% ভোট পেয়েছে এবং আসন পেয়েছে ১। 


প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল 

পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে ভুট্টোর পিপলস পার্টি দুইটি প্রদেশে, খান ওয়ালির ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দুইটি প্রদেশে ও শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ একটি প্রদেশে ভালো করেছে। 

পাঞ্জাবের মোট ১৮০ টি আসনের মধ্যে পিপলস পার্টি পেয়েছে ১১৩ টি। সিন্ধু প্রদেশের মোট ৬০ টি আসনের মধ্যে ২৮ টি পেয়েছে পিপলস পার্টি। বেলুচিস্তানের ২০ টি আসনের মধ্যে ন্যাপ (ওয়ালি) পেয়েছে ৮ টি আসন। সীমান্ত প্রদেশের ৪০ টি আসনের মধ্যে ন্যাপ (ওয়ালি) পেয়েছে ১৩ টি আসন। পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। 


এই নির্বাচনে সরকারের পক্ষ থেকে কারচুপি হয়েছে এমন অভিযোগ আনেনি কোনো রাজনৈতিক দল। অথবা পাকিস্তানী সেনাশাসকরা নির্বাচনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করেছেন এমন অভিযোগও পাওয়া যায়নি। তবে সরকারের প্রতি যে অভিযোগ এসেছে তা হলো পূর্ব পাকিস্তানে প্রচুর কেন্দ্র দখলের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ, ইয়াহিয়া খান তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন। 


আমার পর্যবেক্ষণে এটা সঠিক নয় যে, ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের প্রতি প্রীতি দেখিয়ে তাকে দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়েছেন। বরং বলা যায় ইয়াহিয়া খান কেন্দ্র দখলের মতো পরিস্থিতি হবে এমন ধারণা করতে পারেননি বলে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর কারণ এটি একটি নতুন সংস্কৃতি যা আওয়ামী লীগের হয়ে নিউক্লিয়াস চালু করেছিল। এবং তা থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।   

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন