৩০ মার্চ, ২০২১

অপপ্রচার থেকে প্রসার



নতুন করে একটি সমস্যা দেখা দিল মক্কাবাসীদের সামনে। মুহাম্মদ সা. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এসে পড়লো হজ্জের সময়। এটা তো জানা কথা যে, আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিনিধিদল এ সময় মক্কায় আসবে। এ কারণে তারা খুব বিচলিত হয়ে পড়লো। মুহাম্মদ যদি এখন সবার কাছে তার কথাগুলো পেশ করে তবে তো সবাই নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যাবে।

তখন তারা পরিকল্পনা করলো হাজিরা মক্কায় প্রবেশ করলে তাদেরকে মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে এমন কিছু বলবে যাতে তারা মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে সতর্ক থাকে। মুহাম্মদ সা.-এর তাবলীগ তাদের ওপর প্রভাব তৈরি না করে। তারা অনেক চিন্তা করলো কিন্তু সমাধানে আসতে পারলো না। অতএব তারা সেসময়ের একজন পণ্ডিত ব্যক্তি ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার কাছে গেল।

ওয়ালিদ বললো, প্রথমে তোমরা সবাই এই বিষয়ে একমত হবে। নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করবে না। একজনের কথা অন্যজন মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে, এমন যেন না হয়। এজন্য আগে ঠিক করা হবে আমরা হাজিদের কী বলবো। তারপর আমরা সবাই তা প্রচার করবো। একেকজন একেকভাবে প্রচার করলে হাজিরা আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। অতএব আমরা কী বলবো তা নির্ধারণ করবো।

তখন সবাই বললো, আপনি ঠিক করে দিন, আমরা কী বলবো?
ওয়ালিদ বলবো, প্রথমে তোমরা বলো, আমি শুনি। পরে সেখান থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।

এরপর কয়েকজন বললো, আমরা বলব যে, তিনি একজন জ্যোতিষী।

ওয়ালিদ বললো, না তিনি জ্যোতিষী নন, আমি জ্যোতিষীদের দেখেছি, তার মধ্যে জ্যোতিষীদের মতো বৈশিষ্ট্য নেই, জ্যোতিষীরা যেভাবে অন্তঃসারশূন্য কথা বলে থাকে তিনি সেভাবে বলেন না।

এরপর আরেকজন বললো, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন পাগল।

ওয়ালিদ বললো, না তিনি পাগলও নন। আমি পাগলও দেখেছি, পাগলের প্রকৃতিও দেখেছি। তিনি পাগলের মতো আচরণও করেন না পাগলের মতো উল্টাপাল্টা কথাও বলেন না।

লোকেরা বললো, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি।

ওয়ালিদ বললো, তিনি কবিও নন। কবিত্বের বিভিন্ন রকম আমার জানা আছে। তার কথা কবিতা নয়।

কেউ কেউ বললো, তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন যাদুকর।

ওয়ালিদ বললো, না তিনি যাদুকরও নন। আমি যাদুকর এবং তাদের যাদু দেখেছি। তিনি ঝাড়ফুঁক করেননা এবং যাদু-টোনাও করেননা।

এরপর সকলে মিলে বললো, তাহলে আমরা কী বলবো হাজিদেরকে?

ওয়ালিদ বললো, আল্লাহর শপথ তার কথা বড় মিষ্টি। তার কথার তাৎপর্য অনেক গভীরতাপূর্ন। তোমরা উপরোক্ত যে কথাই বলবে শ্রোতাদেরকে, তারা যখন মুহাম্মদের কথা শুনবে তখন সবাই তোমাদের মিথ্যা মনে করবে।

তবে তার সম্পর্কে শুধু একথাই বলতে পারো যে, মুহাম্মদ একজন যাদুকর। সে যেসব কথা তা শুনতে খুবই ভালো শোনায়, সবাই মুগ্ধ হয়। তবে তার কথা শোনার পর পিতা পুত্রের মধ্যে, ভাই ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ফাসাদ তৈরি হয়। একে অপরের শত্রু হয়ে যায়। মুহাম্মদ যা বলে এগুলো মোটেই আল্লাহর পাঠানো কথা নয়। এগুলো মানুষের বানানো কথা।

ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার কথা সবার পছন্দ হলো। সবাই সিদ্ধান্ত নিল হাজিরা মুহাম্মদের দেখা পাওয়ার আগেই তাদেরকে মুহাম্মদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হবে।

কোনো কোনো বর্ণনায় একথাও উল্লেখ রয়েছে যে, ওয়ালিদ যখন লোকদের সব কথা প্রত্যাখ্যান করলো তখন তারা বললো, তাহলে আপনি সুচিন্তিত মতামত পেশ করুন। এ কথা শুনে ওয়ালিদ বললো, আমাকে একটুখানি চিন্তা করার সময় দাও। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ওয়ালিদ উপরোক্ত মন্তব্য করেছিল।

যাই হোক, মুশরিকদের এই সিদ্ধান্তে মুহাম্মদ সা. ভেবে পাচ্ছিলেন না কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন! মুসলিমরা অত্যন্ত কষ্ট পেল কুরাইশদের এই আচরণে। এই ঘটনা আল্লাহ তায়ালা সূরা মুদ্দাসসিরে উল্লেখ করেছেন ১৮ থেকে ২৬ নং আয়াতে। আল্লাহ তায়ালা ওয়ালিদ সম্পর্কে বলেন,

//সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। অতঃপর সে ধ্বংস হোক! কীভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল? তারপর সে ধ্বংস হোক! কীভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল? তারপর সে তাকাল। তারপর সে ভ্রূকুঞ্চিত করল এবং মুখ বিকৃত করল। তারপর সে পিছনে ফিরল এবং অহংকার করল। অতঃপর সে বলল, ‘এ তো লোক পরম্পরায়প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়’। ‘এটা তো মানুষের কথামাত্র’। অচিরেই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাব।//

মক্কার মুশরিকরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলো। মুশরিকরা দলবদ্ধ হয়ে হ্জ্জ যাত্রীদের আসার বিভিন্ন পথে অবস্থান নেয় এবং নবী মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে হাজিদের সতর্ক করে।

এ কাজে সবার প্রথম ছিল আবু লাহাব। হজ্জের সময়ে সে হজ্জ-যাত্রীদের ডেরায়, ওকায, মাজনা এবং যুল মায়াযের বাজারে প্রচারণা চালায়। এছাড়া সে মুহাম্মদ সা.-এর পেছনে লেগে থাকে। নবী সা. আল্লাহর দ্বীনের তাবলীগ করেন আর আবু লাহাব পেছনে থেকে বলে, তোমরা ওর কথা শুনবে না, সে হচ্ছে মিথ্যাবাদী, বিদয়াতী এবং বেদ্বীন।

মুশরিকরা তাদের ষড়যন্ত্র করে। ইসলামের ক্ষতি করাই হয় তাদের পরিকল্পনার বেসিক উদ্দেশ্য। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা থাকে অন্যরকম। হজ্বের আগে মুহাম্মদ সা.-এর চিন্তা করছিলেন কীভাবে এতো মানুষের কাছে তিনি পৌঁছবেন! কেউ তার কথার গুরুত্ব দিবে কিনা এই নিয়েও তিনি সন্দিহান ছিলেন। এতো মানুষের কাছে একা পৌঁছানো প্রায় দুঃসাধ্য ছিল।

অথচ মুশরিকরা তাঁর এই কাজকে সহজ করে দিয়েছিল। তাদের ছুটোছুটি, তোড়জোড় ও সতর্ক করার ফলে হাজিরা মুহাম্মদ সা.-কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন। অনেকেই মুহাম্মদ সা.-কে দেখতে এলেন। কেউ কেউ কথা বললেন ও শুনলেন। মোটকথা হজ্জ যাত্রীরা সবাই জানতে পারলো যে, মক্কায় মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি নবুয়্যতের দাবি করেছে। তার কথা খুবই হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয়।

প্রকাশ্য দাওয়াতের ১ম বছরেই সারা আরবে ও আরবের বাইরেও কিছু কিছু এলাকায় খবর পৌঁছে গেল শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর আগমন হয়েছে।

২৯ মার্চ, ২০২১

সন্তানদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলুন



নাম তার আমর ইবনে হিশাম। বড্ড জ্ঞানী মানুষ। তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কূটনীতির কারণে তিনি মক্কার নেতা হন। লোকজন তাকে আবুল হাকাম বলে ডাকতো। আবুল হাকাম মানে জ্ঞানীর পিতা। মুহাম্মদ সা. দুইজন ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কাছে বেশি দোয়া করতেন একজন হলেন আমর ইবনে হিশাম অন্যজন হলেন উমার ইবনে খাত্তাব। কিন্তু আমরের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা.-এর দোয়া কবুল হয়নি। আমর সম্পর্কে মুহাম্মদ সা.-এর চাচা হন। মুহাম্মদ সা.-কে তিনি স্নেহ করতেন।

কিন্তু মুহাম্মদ সা. নবুয়্যত পাওয়ার পর আমর তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়। মুহাম্মদ সা.-কে কষ্ট দেওয়ার জন্য হেন কাজ বাকী ছিল না যা সে করেনি। আল্লাহর রাসূল সা. যাদের অভিশাপ দিতেন এর মধ্যে একজন আমর ইবনে হিশাম। তিনি আমরের উপাধি 'আবুল হাকাম' পরিবর্তন করে নাম দেন 'আবু জাহাল' অর্থাৎ মূর্খের পিতা। আবু জাহাল মক্কায় ঈমান গ্রহণ করা মুসলিমদের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালাতেন।

ইয়াসির রা.-এর পরিবারের ওপর তার নির্যাতন ছিল ভয়াবহ। ইয়াসির রা. ছিলেন দাস। তাই তাঁর ওপর নির্যাতন প্রতিরোধে কারো সাহায্য পাননি রাসূল সা.। ইয়াসির রা. স্ত্রী সুমাইয়া রা. ওপর অশ্লীলভাবে প্রতিদিন নির্যাতন করতো আবু জাহাল। তাদের সন্তান আম্মার রা.-এর ওপর চলেছে নির্যাতনের পাহাড়। একদিন হজরত সুমাইয়া রা.-এর লজ্জাস্থানে বর্শা গেঁথে খুন করে আল্লাহর এই দুশমন। সুমাইয়া রা. হন ইসলামের প্রথম শহীদ। অসহায় মুহাম্মদ সা. সেই পরিবারকে উদ্ধার করতে পারেন নি। এরপর খুন হন ইয়াসির রা.। রাসূল সা.-কে কাবার সামনে নামজরত অবস্থায় দেখলে আবু জাহল ময়লা, আবর্জনা, পশুর নাড়িভূড়ি সন্ত্রাসীদের দিয়ে ওনার মাথায় চাপিয়ে দিতেন। একবার তো রাসূল সা.-এর দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। ফাতিমা রা. খবর পেয়ে দৌড়ে এসে আবর্জনা সরিয়ে মুহাম্মদ সা.-কে উদ্ধার করেছিলেন।

হিজরতের পর রাসূল সা. মদিনায় রাষ্ট্র কায়েম করেন। সেখানে তিনি ও মক্কার মুহাজির সাহাবারা মক্কায় গত ১৩ বছর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ফিরিস্তি দিতেন। এসব বর্ণনায় প্রায়ই আবু জাহালের নাম উঠে আসতো। মদিনায় আল্লাহর রাসূল সা. শিশু-কিশোরদেরও নসিহত করতেন। সেখানেও জালিম আবু জাহালের নাম উঠে আসতো। আল্লাহর রাসূল সা. নসীহতে জিহাদী জজবায় উজ্জিবীত হন দুই মহান কিশোর। আর আল্লাহর রাসূলের মুখে আবু জাহালের নির্যাতনের কথা শুনে তার প্রতি তারা চরম ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।

বদর যুদ্ধে দুই মহান কিশোর যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে যুক্ত হলেন। এই প্রসঙ্গে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আওফ বলেন,

বদর যুদ্ধের দিনে আমি মুসলমানদের কাতারের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখি যে, ডানে বাঁয়ে দু'জন আনসার কিশোর। তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি তাদের চিনতাম না।

হঠাৎ একজন চুপিসারে আমাকে বললো, চাচাজান, আবু জাহাল কে? তা আমাদের একটু দেখিয়ে দিন। আমি বললাম, ভাতিজা, তুমি তাকে কী করবে?

সে বললো, আমি শুনেছি, আবু জাহাল প্রিয় নবী সা.-কে বেশি কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর শপথ! যদি আমরা আবু জাহাল কে দেখতে পাই তবে ততক্ষণ পর্যন্ত পর্যন্ত তার কাছ থেকে আলাদা হব না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার এবং আমাদের মৃত্যু মৃত্যু না হয়।

আব্দুর রহমান রা. বলেন, একথা শুনে আমি অবাক হলাম। অন্যজন আনসার কিশোরও আমাকে চুপিসারে একই কথা বললো। কয়েক মুহুর্ত পরে আমি আবু জাহালকে লোকদের মধ্যে বিচরণ করতে দেখছিলাম। আমি উভয় আনসার কিশোরকে বললাম, ওই দেখো তোমাদের শিকার। যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছো। একথা শোনামাত্র উভয় আনসার কিশোর আবু জেহেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে হত্যা করে ফেলল।

এই দুইজন কিশোর হলেন মায়াজ ইবনে আমর ও মাউজ ইবনে আফরা।

এই প্রসঙ্গে মায়াজ ইবনে আমর বলেছেন, আবু জাহাল কাফেরদের দুর্ভেদ্য পাহারার ভেতর ছিলো। আমি আবু জাহালকে চিনে রাখলাম এবং তার কাছাকাছি থাকতে লাগলাম। সুযোগ পাওয়া মাত্র আমি তার ওপর হামলা করলাম। তাকে এমন আঘাত করলাম যে, তার পা হাঁটুর নীচে দিয়ে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। ঝরে পড়া খেজুরের মত তার পা উড়ে গেলো। এদিকে আবু জাহালকে আমি আঘাত করলাম আর ওদিকে তার পুত্র ইকরামা আমার কাঁধ বরাবর তরবারি দিয়ে আঘাত করলো। এতে আমার হাত কেটে গেল কিন্তু তা চামড়ার সাথে লেগে ঝুলে রইলো।

আমার লড়াই করতে অসুবিধা হচ্ছিলো। কর্তিত হাত পেছনে রেখে অপর হাতে তরবারি চালাচ্ছিলাম। এতেও বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো। আমি তখন হাতের কার্তিত অংশ পায়ের নীচে রেখে এক ঝটকায় হাত দেহ পৃথক করে ফেললাম। এরপর আবু জাহালের ওপর এমন আঘাত করলাম যে, সে ঢলে পড়লো। ইতোমধ্যে মাউজ ইবনে আফরা আবু জাহাল ও ইকরামার সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেল। এরপর মায়াজ ইবনে আমর আল্লাহর রাসূল সা.-এর কাছে জানালেন যে, তিনি আল্লাহর দুশমন আবু জাহালকে হত্যা করেছেন। মহানবী সা. অত্যন্ত খুশি হলেন।

মুহাম্মদ সা.-এর যেন আবু জাহালের লাশ দেখার জন্য তর সইছে না। তিনি যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বললেন, আবু জাহালের পরিণাম কে দেখবে দেখে আসো। সাহাবারা তখন আবু জাহালের সন্ধান করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আবু জাহালকে এমতাবস্থায় পেলেন যে, তা নিঃশ্বাস চলাচল করছিলো। তিনি আবু জাহালের ধড়ে পা রেখে মাথা কাটার জন্যে দাড়ি ধরে বললেন, ওরে আল্লাহর দুশমন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা তোকে অপমান অসম্মান করলেন তো?

আবু জেহেল বললো, কিভাবে আমাকে অসম্মান করলেন?

তোমরা যাকে হত্যা করেছো তার চেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষ আছে নাকি? তার চেয়ে বড় আর কে? আহা, আমাকে যদি কিশোররা ছাড়া অন্য কেউ পরাজিত করতো! এরপর সে বলতে লাগলো, বলো তো আজ জয়ী হয়েছে কারা? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ আবু জেহেলের কাঁধ পা দিয়ে চেপে রেখেছিলেন। আবু জাহাল তাঁকে বললো, ওরে বকরির রাখাল, তুই অনেক উঁচু জায়গায় পৌঁছে গেছিস।

এ কথোপকথনের মধ্যেই আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আবু জাহালের মাথা কেটে মুহাম্মদ সা.-এর সামনে হাজির করে বললেন, হে আল্লাহর রসূল, এই হচ্ছে আল্লাহর দুশমন আবু জাহালের মাথা। নবী সা. অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ সত্যই, সেই আল্লাহর শপথ! যিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। এই কথা তিনবার বললেন।

এরপর নবী সা. বললেন, আল্লাহ তায়ালা সুমহান। সকল প্রসংশা তাঁরই জন্যে নিবেদিত, তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি সত্য করে দেখিয়েছেন, নিজের বান্দাদের সাহায্য করেছেন এবং একাকীই সকল দলকে পরাজিত করেছেন।

নবী সা. আরো খুশি হতে চাইলেন। আরো সন্তুষ্ট হতে চাইলেন! তিনি বললেন, চলো। আমাকে তার লাশ দেখাও। সাহাবারা নবী সা.-কে আবু জাহালের লাশের কাছে নিয়ে গেল। তিনি বললেন, ও হচ্ছে এই উম্মতের ফিরাউন। অতঃপর নবী সা. কিশোর মায়াজ ইবনে আমর রা.-কে আবু জাহালের আনীত সম্পদ দিয়ে দিলেন। আর আবু জাহালের তরবারি দিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে।

এই ঘটনা বর্ণনা করার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের প্রোগ্রামগুলোতে মাদ্রাসা ছাত্রদের নিয়ে আসার ব্যাপারে সেক্যুলার সমাজের ব্যাপক প্রতিবাদ উঠছে। আর এই ইস্যুতে মুসলিমদের মধ্যে হীনমন্যতা দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো ইসলামপন্থী বলতে চাইছেন কিশোর ও মাদ্রাসা ছাত্রদের (বিশেষত যারা আন্ডার এইটিন) রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যাতে না আনা হয়। এতে নাকি কিশোরদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়।

অথচ ব্যাপারটা হচ্ছে উল্টো। কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন না করানোর ফলে মূলত আমাদের দেশে এক অথর্ব যুবসমাজ তৈরি হচ্ছে। এদের না আছে রাজনৈতিক জ্ঞান না আছে কূটনীতিক জ্ঞান। এক ভোগবাদী সমাজ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ কিশোর বেশি ক্ষিপ্ত হয় যখন ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশের প্রতি ইনজাস্টিস করা হয়। অথচ ফেনী নদীর পানি, কিংবা তিস্তার পানি অথবা সীমান্তে মানুষ হত্যা নিয়ে তাদের বিকার নেই।

আমাদের প্রতিবেশী মুশরিক রাষ্ট্র ভারত ও এদেশে তাদের দালাল সেক্যুলাররা চায় এমন একটি অথর্ব জনগোষ্ঠী। তাতেই তাদের শোষণ করা সহজ হয়। অথচ ইসলামের ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। আমাদের পূর্বপুরুষরা ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। কিশোররা যুদ্ধপ্রস্তুতি দিয়েই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতেন। যার মাধ্যমে হিন্দুস্থানে ইসলামের পতাকা উচ্চকিত হয়েছে সেই মুহাম্মদ বিন কাসিম ১৭ বছর বয়সে শুধু যুদ্ধে এটেইন করেনি বরং তাঁর নেতৃত্বে বিশাল ভারত ইসলামের ছায়াতলে এসেছে। এছাড়াও উসামা বিন জায়েদ, তারিক বিন যিয়াদ ইত্যাদি কম বয়স্ক সেনাপতি ইসলামের ইতিহাসে রয়েছে।

অতএব আপনার সন্তানকে ইতিহাস ও রাজনীতির শিক্ষা দান করুন। তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করুন। উম্মাহ চেতনা জাগ্রত করুন। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য শোনান। নইলে আমি-আপনি মুশরিকদের বন্দিশালা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হবো না। মনে রাখবেন, রাজনীতি ও জিহাদ নিয়ে আমাদের মধ্যে যেন কোনো হীনমন্যতা কাজ না করে।

২৫ মার্চ, ২০২১

সন্দ্বীপের কোলে দু'দিন



সন্দ্বীপের ইতিহাস বেশ পুরনো। এটি একসময় শিল্প, শিক্ষা, ব্যবসায় অনন্য ছিল। শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাহাজ, লবণ ও বস্ত্র। সন্দ্বীপের জাহাজ রপ্তানী হতো আরবে। এটা সেসময়ের কথা যখন ইউরোপিয়ানরা জাহাজ বানানো দূরে থাকুক, কেনারও সামর্থ রাখতো না।

সন্দ্বীপের লবণ ও কাপড় সারা পৃথিবীতে বিক্রি হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রিপোর্ট অনুসারে প্রতি বছর সন্দ্বীপে উৎপাদিত প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার মণ লবণ, তিনশ জাহাজে করে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো।

একটি সমৃদ্ধ দ্বীপ ছিল সন্দ্বীপ। মধ্যযুগের বিখ্যাত বাঙালি কবি আব্দুল হাকিমের বাড়ি এখানেই। তিনি বলেছেন বিখ্যাত সেই কথা

//যেসব বঙ্গে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।//

মুঘল আমল পর্যন্ত এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভাঙ্গন, তুফান আর চট্টগ্রামের মগদের আক্রমণ। সীতাকুন্ড দিয়েই মগরা বেশিরভাগ আক্রমণ পরিচালনা করতো। সে কারণেই সম্ভবত সীতাকুণ্ডের দিকে সন্দ্বীপের যে ইউনিয়ন তার নাম মগধরা ইউনিয়ন। ১৬০০ সাল থেকে এটি বিদেশীদের নজরে পড়ে। তার আগে মুসলিম বণিকেরা এখানে ইসলাম কায়েম করে।

প্রথমে পর্তুগালের ব্যবসায়ীরা এখানের বাসিন্দাদের জিম্মী করে। এরপর মগরাজ। তাদের ঠেকিয়ে এখানে স্বাধীন রাজ্য কায়েম করেন দিলওয়াল খাঁ। তারপর শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এখানের মানুষদের সাথে নিয়ে শক্তিশালী নৌ-বাহিনী তৈরি করেন। তারপর তাদের সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম দখল করে মগদের অত্যাচার থেকে সন্দ্বীপবাসীকে উদ্ধার করেন।

ব্যবসা, যোগাযোগ ও শিল্পে এগিয়ে থাকার কারণে বঙ্গের একসময়ের বড় বন্দর ছিল সন্দ্বীপ। শিক্ষা-দীক্ষাও সন্দ্বীপ ছিল নামী এলাকা। তাই এখানে বড় বড় কবি সাহিত্যিকেরা আসতেন। শুধু তাই নয় এখানের সৌন্দর্যও ছিল নজরকাড়া। ইবনে বতুতা, সিজার ফ্রেডরিকের মতো বিখ্যাত পর্যটকরাও সন্দ্বীপকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। কবি নজরুল এখানে এসে লিখেছেন বিখ্যাত মধুবালা গীতিনাট্য। এছাড়া চক্রবাকের অনেকগুলো কবিতাও সন্দ্বীপে সাগরের পাড়ে বসে রচনা করেন।

সন্দ্বীপের অবনতি হতে শুরু করে ইংরেজ আমলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের ব্যবসা ঠিক রাখতে বঙ্গের সকল শিল্প বন্ধ করে দেয়। তাদের লবণ চালানোর জন্য এখানের লবণ কারখানা বন্ধ করে দেয়। ইউরোপীয় নিম্নমানের কাপড় ভারতে চালানোর জন্য এখানের সকল চরকা বন্ধ করে দেয়। যারা গোপনে চরকা চালাতো তাদের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দেয়। আমার জানামতে আজ পর্যন্ত সন্দ্বীপে বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠেনি।

আমার তো মনে হয়, নবাবদের ভুলে যদি ব্রিটিশদের কাছে বাংলার পরাজয় না হতো তবে শিল্প বিপ্লব ইউরোপে হতো না, বাংলায় হতো। অবশ্য এটা আমার ধারণা। এখানের সকল শিল্পই বিশ্বে সর্বাধিক উন্নত ছিল যা ইংরেজরা দুইশ বছর বন্ধ রেখেছে। তাদের শোষণে একটি শিক্ষিত, ধনী ও উন্নত জাতি পর্যায়ক্রমে অশিক্ষিত ও গরীব জাতিতে পরিণত হয়েছে।

ইংরেজরা বঙ্গের এই সমৃদ্ধ এলাকা থেকে প্রচুর রাজস্ব আদায় করার চেষ্টা চালিয়েছে। শায়েস্তা খাঁ এখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে আগের থেকেও খাজনা কমিয়ে দেয়। যার ফলে এখানের বাসিন্দারা মুঘলদের অনুগত থাকতে পছন্দ করেছিল। ইংরেজদের চাহিদা অনুসারে ব্যাপক খাজনা আদায় করা সম্ভব হয়নি বিধায় স্থানীয় মুসলিম জমিদাররা জামিদারি হারিয়েছে। সেসময়ে প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন আবু তোরাব।

মীরজাফরের জামাতা মীর কাসিম এখানে গোকুল ঘোষাল নামে কোলকাতার এক হিন্দু ব্যবসায়ীকে জমিদার হিসেবে অনুমোদন করে। গোকুল ঘোষাল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে জমিদার হিসাবে রাজস্ব সংগ্রহের উদ্দেশ্য সন্দ্বীপ আগমন করেন ১৭৬৩-৬৪ সালে। তার সাথে আবু তোরাবের বিরোধ চরমে পৌঁছে ১৭৬৭ সালে।

জমিদার আবু তোরাব ইংরেজ ওয়াদদাদারের কাজে রাজস্ব জমা দেয়া থেকে পুরাপুরি বিরত থাকেন। তাছাড়া, গোকুল ঘোষালের প্রতিনিধিদের সন্দ্বীপ থেকে বিতাড়ণের জন্য আবু তোরাব তাঁর সেনাপতি মালকামকে নির্দেশ প্রদান করেন।

অতঃপর মীর জাফরের জামাতা নবাব মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী থেকে নবাবের অনুগত একদল সৈন্য এসে তোরাব আলীর মুখোমুখি হয়। কিন্তু প্রতিরোধ ও চাপের মুখে কিছুদিনের মধ্যে গোকুলের লোকজন সন্দ্বীপ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স এবং আরো কয়েকজন সেনাধ্যক্ষের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনাবাহিনী নদী পার হয়ে সন্দ্বীপে পৌঁছায়।

১৭৬৭ সালের মধ্যভাগে সন্দ্বীপ শহরের সামান্য উত্তরে চার আনি হাটের অদূরবর্তী কিল্লাবাড়িতে আবু তোরাব বাহিনীর সাথে ক্যাপ্টেন নলিকিন্স-এর বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে আবু তোরাব পরাজিত ও নিহত হন। আবু তোরাব চৌধুরী জমিদার হলেও সুশাসনের কারণে কৃষক প্রজারা তাঁকে ভালবাসতেন। এ করণে উপরিউক্ত যুদ্ধে সন্দ্বীপের কৃষকগণ আবু তোরাব চৌধুরীর পক্ষাবলম্বন করেন। ইতিহাসে এটি সন্দ্বীপের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ বলেও খ্যাত হয়।

এরপরে আরো দুইবার এখানের লোকেরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। শেষ অন্তত বিশ বছর এখান থেকে খাজনা নিতে পারেনি ইংরেজরা।

সন্দীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা সব জায়গায় সমভাবে ভালো নয়। সীতাকুন্ড থেকে ২৫০ টাকা ভাড়া লাগে স্পিডবোটে। এখানে খুবই নৈরাজ্য চলে। সুযোগ পেলেই তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। এখানে নিয়মিত চলাচল করার জন্য ওয়াটার বাস চালু করা দরকার তাহলে দুর্ভোগ কমবে আশা করি। এখানে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডের সাথে কানেক্ট করা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে এখানে মানুষ বিদ্যুতের পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছে।

পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালের আগ পর্যন্ত সন্দ্বীপ নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নোয়াখালী থেকে যাতায়াত সহজ ছিল না এবং সন্দ্বীপের পশ্চিম অংশ ভাংতে থাকায় এটি নোয়াখালী থেকে দূরে সরে গিয়েছে। প্রশাসনিক সুবিধা হাসিলের জন্যই চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হয়।

তবে এখানকার মানুষের কালচার ও ভাষা অনেকটাই নোয়াখালীর মতো। সকালবেলা নামাজ পড়েই এখানের চা-দোকানে চা খেতে খেতে এলাকাবাসীর সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছিলাম। এখানের গরুর দুধের চা আর গুলগুইল্লার স্বাদ বহুদিন মুখে লেগে থাকবে। সন্দ্বীপ ট্যুরে এসে এখানের স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি যা সত্যিই দারুণ ছিল।

বরাবরের মতো এখানের ইমাম সাহেবকে পেয়েছি নোয়াখালীর। এটা আমার এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আমি বাংলাদেশের যত স্থানেই ঘুরতে গিয়েছি সেখানের মসজিদ বা মাদ্রাসায় নোয়াখালীর লোক আমি পেয়েছি। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। ভদ্রলোক আমাদের জন্যে মসজিদ সর্বক্ষণ খোলা রেখেছেন। মসজিদের টয়লেট, টিউবওয়েল, পুকুর ইত্যাদি ব্যবহার আমাদের জন্য সহজ হয়েছে।

সাগরের পাড়ে ক্যাম্প করার জন্য একটি আদর্শ স্থান সন্দ্বীপের হরিশপুর। তবে অবশ্যই আবহাওয়া অনুকূলে থাকা প্রয়োজন। শীতকালের আশে পাশে হলে ভালো হয়। কিছুদিন পর কালবৈশাখী শুরু হলে এখানে আর আসা যাবে না।

২৪ মার্চ, ২০২১

বিংশ শতাব্দির আলোকবর্তিকা বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী রহ.



ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিক থেকেই মুসলিমরা তাদের পতন দেখতে শুরু করে। একের পর এক অঞ্চল হাতছাড়া হতে থাকে। এই সংকট মুহূর্তে তুরস্কের মাটিতে আলোর আভা দেখা দিল। তুর্কীর বিতলিস অঞ্চলের ছোট্ট একটি গ্রামের নাম নুরস। আর সেখানেই জন্ম নেন মুসলিমদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে আসা সাঈদ। ১৯২৪ সালে খিলাফত বিলুপ্ত হওয়ার পর মোস্তফা কামাল পাশা গং দেশে সেক্যুলারিজম কায়েম করেছে। এটা করতে গিয়ে ইসলামের নাম নিশানা সব মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। আর অন্যদিকে রাশিয়ার সমাজতন্ত্র তরুণদের ঘায়েল করেছে। সব মিলিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু তুরস্ক থেকে ইসলাম বিলুপ্ত হতে যাচ্ছিল। এই সময়ে বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী তাঁর আন্দোলন শুরু করেন। বক্তব্য বিবৃতি ও লেখালেখি করে তিনি দুইটি জঘন্য ও ইসলামবিরোধী আদর্শের মুকাবিলা করেছেন।

জন্ম ও শৈশব
১৮৭৭ সালে নুরস গ্রামের এক কুর্দি পরিবারে সাঈদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মির্জা আফিন্দি। মায়ের নাম নুরিয়া হানম। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল শুধু সাঈদ। নুরস গ্রামের সন্তান হওয়ায় নামের শেষে যুক্ত হয়েছে নুরসী। আর তাঁর লেখাগুলোর সংকলন 'রিসালায়ে নূর' পাবলিশ হওয়ার পর তিনি উপাধি পান বদিজ্জামান। বদিউজ্জামানের মানে হলো যুগের বিস্ময় বা যুগশ্রেষ্ঠ। তাঁকে প্রথম এই উপাধি দেন মোল্লা ফাত্হুল্লাহ আফিন্দী। এভাবে তাঁর নাম হয়ে ওঠে বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী।

নয় বছর বয়সে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়। তাঁর প্রথম শিক্ষালয়ের নাম মোল্লা আমীন আফিন্দী মাদ্রাসা। পরবর্তীকালে মীর হাসান ওয়ালী মাদ্রাসা, বায়েজিদ মাদ্রাসাসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষালয়ে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। সাঈদ নুরসী একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিলো খুবই প্রখর। যেই কোন বিষয় তিনি অতি সহজে আয়ত্ব করতে পারতেন। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিও ছিলো প্রশংসনীয়। তাঁর যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে লোকেরা অবাক হয়ে যেতো। উল্লেখ্য যে শরীর চর্চাতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন।

দাওয়াত ও তাবলীগ
সাঈদ নুরসী যখন তরুণ তখন রাষ্ট্রের প্রধান সুলতান আব্দুল হামিদ সানি। সেসময় রাষ্ট্রের অনেক প্রশাসক ও গভর্নর দুর্নীতি ও জুলুমের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। সাঈদ নুরসী তাদের ইসলামের পথে ও জুলুম থকে দূরে থাকার দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। প্রথমে তিনি মিরান গোত্রের প্রধান মুস্তাফা পাশার কাছে দাওয়াত নিয়ে যান। মুস্তাফা পাশা ভালো যোদ্ধা ছিলেন। সুলতান আব্দুল হামিদ তাকে রুশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল পাহারা দেওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। সাঈদ নুরসী তার কাছে যান। তাকে ফরজ পালনের প্রতি আহ্বান জানান ও জনগণের সাথে ভালো আচরণের উপদেশ দেন। শুরুতে মুস্তফা পাশা বিরূপ আচরণ করলেও পরবর্তীতে সাঈদ নুরসীর ব্যক্তিত্বের কাছে নতি স্বীকার করেন, সৎ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি সাঈদ নুরসীকে একটি অত্যাধুনিক রাইফেল উপহার দেন।

এরপর তিনি আরেকটি প্রদেশ মারদিনে গমন করেন সেখানে তাবলীগের কাজ করতে থাকেন। একটি মসজিদে দারস দিতে থাকেন। এভাবে তাঁর বহু ভক্ত জুটতে থাকে। এসময় মারদিনের একজন তরুণ লেখক নামিকজ কামালের লেখার ভক্ত হয়ে পড়েন। নামিকজ কামাল মূলত বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অপরাধ নিয়ে লেখালেখি করেন। তিনি সুলতানকে আব্দুল হামিদকে জনগণের মুখোমুখি হওয়ার আহ্বান জানাতেন। সে সময়ের শাসন কাঠামো অনুসারে শাসক জনগণের কাছে জবাবদিহীতা করতেন না। মূলত শাসকের কোনো কাজে প্রশ্ন তোলা যেত না। নামিকজ কামাল এই বিষয়ে লিখতেন যে, ইসলাম অনুযায়ী শাসক জনগণের কাছে জবাব দিতে বাধ্য। এই লেখাগুলো সাঈদ নুরসীকে প্রভাবিত করে। ১৮৯২ সাল থেকে তিনি তার দারসে এই কথাগুলো বলতে থাকেন।

ফলশ্রুতিতে সাঈদ নুরসী মারদিনের গভর্নর নাদির বে'র কোপানলে পড়েন। তাঁকে আটক করা হয় ও তাঁর প্রদেশ বিতলিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিতলিসের গভর্নর উমার পাশার সাথে সাঈদ নুরসীর আলাপ হয়। উমার পাশা সাঈদ নুরসীর জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন এবং সাঈদ নুরসীকে তাঁর বাড়িতেই রাখার ব্যবস্থা করেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া হতো এই বাড়িতে। সাঈদ নুরসী আলাপচারিতার ভেতর দিয়ে তাঁদের নিকট ইসলামের আলো ছড়াতে থাকেন। উমার পাশার বাড়িতে অবস্থানকালে সাঈদ নুরসী ব্যক্তিগত পড়াশুনায় গভীর মনোযোগ দেন। তিনি ব্যাপকভাবে তাফসীর, হাদীস ও ফিক্হ অধ্যয়ন করতে থাকেন।

জ্ঞানের জগতে উজ্জ্বল তারকা
ইসলামী জ্ঞান জগতের একজন উদীয়মান তারকা হিসেবে সাঈদ নুরসীর খ্যাতি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওয়ান (ভান) প্রদেশের গভর্নর হাসান পাশা তাঁকে তাঁর কাছে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সাঈদ নুরসী ওয়ান পৌঁছে হাসান পাশার মেহমান হন। তিনি যুগপৎভাবে জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণের কাজ করতে থাকেন। কিছুকাল পর সুলতান আব্দুল হামিদ ওয়ানের গভর্ণর হিসেবে দায়িত্ব দেন তাহির পাশাকে। তিনিও একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিলো। তিনি সাঈদ নুরসীর জন্য তাঁর লাইব্রেরী উন্মুক্ত করে দেন।

দূরদর্শী সাঈদ নুরসী উপলব্ধি করেন যে বর্তমানে প্রচলিত বিদ্যার সাথে নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও হাসিল করা প্রয়োজন। সেই জন্য তিনি নিজেই ভূগোল, দর্শন ও ইতিহাস ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন করেন। এই ক্ষেত্রে তিনি নিজেই ছিলেন নিজের শিক্ষক। ওয়ান শহরে তিনি হরহর মাদ্রাসা নামে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। এই মাদ্রাসা তিনি নিজেই পরিচালনা করতেন।

বাস্তবে শিক্ষাদান করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন যে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন একান্ত প্রয়োজন। এই উপলব্ধিই তাঁকে তুলনামূলকভাবে অনুন্নত পূর্ব আনাতোলিয়ায় ‘মাদ্রাসাতুজ জাহরা’ নামে একটি মডেল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিতে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁর পরিকল্পনা ছিলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামী জীবন দর্শন ও আধুনিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী করে তুলবেন। মাদ্রাসাতুজ জাহরার পরিকল্পনা নিয়ে তিনি রাজধানী ইস্তাম্বুলে যান। কিন্তু সুলতানের কাছে তা পেশ করার সুযোগ না পেয়ে ওয়ান ফিরে আসেন।

ওয়ানে একদিন গভর্ণর তাহির পাশা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এইটি ছিলো বৃটিশ পার্লামেন্টে সেক্রেটারী ফর কলোনীজ মি. গ্ল্যাডস্টোনের ভাষণ সংক্রান্ত রিপোর্ট। এই ভাষণে তিনি বলেছিলেন,

‘So long as the Muslims have the Quran, we shall be unable to dominate them. We must either take it from them, or make them lose their love of it.’

অর্থাৎ ‘যতদিন মুসলিমদের হাতে আল কুরআন থাকবে আমরা তাদেরকে বশ করতে পাবো না। হয় আমাদেরকে তাদের কাছ থেকে ঐটি নিয়ে নিতে হবে অথবা তারা যেন এর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে তার ব্যবস্থা করতে হবে।’

মি. গ্ল্যাডস্টোনের এই বক্তব্য সাঈদ নারসীর মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, ‘‘I shall prove and demonstrate to the world that the Quran is an undying, inextinguishable Sun.’’ অর্থাৎ ‘আমি প্রমাণ করবো ও দুনিয়াকে দেখাবো যে আল কুরআন মৃত্যুহীন, এবং নিভিয়ে ফেলা যায় না এমন এক সূর্য।’’

তাঁর এই লক্ষ্য হাছিলের জন্য তিনি দুইটি পথ অবলম্বনের চিন্তা করেন। একটি ছিলো মাদ্রাসাতুজ জাহরা স্থাপনের চেষ্টা, অন্যটি রিসালা-ই-নূর নামক পুস্তিকা সিরিজ রচনা করে আল কুরআনের জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পর্কে লোকদেরকে সজাগ করে তোলা।

সুলতান আবদুল হামিদ সানির মুখোমুখি
সাঈদ নুরসী আবার ১৯০৮ সালে কনস্ট্যান্টিনোপাল আসেন। এবার তিনি সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের সাক্ষাৎ পান। তিনি সুলতানকে মাদ্রাসাতুজ জাহরার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন। তাছাড়া সাক্ষাতের এই সুযোগে তিনি সুলতানের ব্যর্থতার কিছু দিক সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। সুলতানের কর্মকর্তাদের মধ্যে ইহুদী প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করেন। অনেক উজির ব্রিটিশদের সাথে যুক্ত এসব কথা বলেন। সুলতান ও তাঁর সহকারীগণ আর কোনদিন এমন প্রত্যক্ষ সমালোচনার সম্মুখীন হননি। ফলে ইলদিজ প্রাসাদে কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হন সাঈদ নুরসী।

সুলতানের বিচারক সাঈদ নুরসী সম্পর্কে জানতেন। তিনি তাঁকে সুলতানের সাথে বেয়াদবির যে অভিযোগ এসেছে তা থেকে রেহাই দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তিনি কয়েকজন ডাক্তারের কাছ থেকে সাঈদ নুরসী মানসিকভাবে সুস্থ নন-এই সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে তাঁকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য তোপতাসি মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দেন।

ইয়াং তুর্কিদের সাথে আলোচনা
ইয়াং তুর্কি ছিল তুর্কিদের একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এর নেপথ্যে ছিল ইহুদিবাদী গোষ্ঠী ও ব্রিটিশ সরকার। যাদের সাথে সুলতানের মনোমালিন্য হতো তদেরই তারা সহায়তা করে তাদের দলে নিয়ে আসতো। একই পলিসি তারা সাঈদ নুরসীর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে। তোপতাসি মেন্টাল হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে ইয়াং তুর্কিরা স্যালোনিকা নিয়ে আসেন। তাদের সংগঠনের নাম ছিল ‘কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস’। সংগঠনের অন্যতম নেতা রফিক বে-র বাড়িতে তিনি মেহমান হিসেবে অবস্থান করতে থাকেন। কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেসে এমন সদস্যও ছিলেন যাঁরা ইসলামের প্রতি ইতিবাচক মনোভংগি পোষণ করতেন। আবার এমন সদস্যও ছিলেন যাঁরা ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। সাঈদ নুরসী তাদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করতেন যে তুর্কীর সংহতি, অগ্রগতি ও গণ মানুষের স্বাধীনতা ইউরোপীয় নয়, ইসলামী বিধানের অনুসরণের মাঝে নিহিত।

সাঈদ নুরসীর বাগ্মীতা ও পাণ্ডিত্য ইউনিয়নের নেতাদের বেশ প্রভাবিত করে। তাকে যে করেই হোক দলের মুখপাত্র বানানোর চেষ্টা করে। অপরদিকে সাঈদ তাদেরকে মুসলিম বানানোর চেষ্টা করে। এই সুযোগ্য ব্যক্তিটিকে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে লাগাবার অভিপ্রায় নিয়ে নেপথ্যের ইয়াহুদী নেতা ইমানুয়েল কারাসো সাঈদ নুরসীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ চলতে থাকে। ইয়াহুদী নেতা হঠাৎ আলোচনা বন্ধ করে ওঠে পড়েন। বাইরে এসে তিনি সঙ্গীদেরকে বলেন, ‘‘আমি যদি আরো কিছুক্ষণ আলোচনা চালাতাম, তাহলে ও আমাকে মুসলিম বানিয়ে ছাড়তো।’’

কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস-এর প্রথম সরকার
যেসব লোকদের ব্যাপারে সুলতানকে সতর্ক করতে গিয়ে সাঈদ নুরসী তাঁর বিরাগভাজন হন সেই লোকেরাই কয়েকদিন পর সুলতানকে পদত্যাগে বাধ্য করে। ১৯০৮ সনে কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর পক্ষ থেকে আনোয়ার পাশা মেসিডোনিয়াতে উসমানীয় খিলাফতের জন্য একটি সংবিধান ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীর বিরাট অংশ আনোয়ার পাশার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। সুলতান আবদুল হামিদ কমিটি অব ইউনিয়ন এণ্ড প্রগ্রেস এর সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হন।

তিনি উক্ত সংবিধান অনুমোদন করেন। তিনি হন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান। কমিটির মনোনীত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় উজির/মন্ত্রীপরিষদ। বহু সংখ্যক ইসলামী ব্যক্তিত্ব কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেসের সরকার মেনে নিতে পারেননি। এই সরকারের কার্যক্রমের মাঝে তাঁরা ইসলামের পতন দেখতে পান।

এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তুর্কীর দুরবস্থা অব্যাহত থাকে। বিভিন্ন রনাঙ্গনে সৈন্যবাহিনী পরাজিত হতে থাকে। এতে লোকেরা নাখোশ হয়। কমিটির সমর্থিত পত্রিকাগুলো সুলতানকে আক্রমণ করে লেখালেখি করতে থাকে। এতে বহু লোক মানসিকভাবে আহত হয়। সুলতানের বিশ্বস্ত কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ লোক এই সময় আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান। কমিটি সরকার পুরাতন অফিসারদেরকে সরিয়ে শূণ্য পদে তাদের পছন্দসহ ব্যক্তিদেরকে বসাতে থাকে। সেনাবাহিনীতেও একই পলিসি অনুসরণ করা হয়। প্রায় আট হাজার সামরিক অফিসার তাঁদের পদ হারান।

কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর দ্বিতীয় সরকার
১৯০৯ সনের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে ইস্তাম্বুলে সুলতানের পক্ষের সৈন্যরা ক্যু করে। কমিটির অফিসারদেরকে তাঁদের ঘরে তালাবদ্ধ করে ক্যান্টনমেন্টের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয়। তারা পার্লামেন্ট ভবনও দখল করে। আয়া সোফিয়া মাসজিদে সমাবেশ করে। তারা সুলতান আব্দুল হামিদ ও শরীয়াহর পক্ষে শ্লোগান দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস সরকার পদত্যাগ করে। কমিটির নেতৃবৃন্দ পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন।

স্যালোনিকা ছিলো কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর সবচেয়ে বেশি মজবুত ঘাঁটি। মাহমুদ শওকত পাশার নেতৃত্বে একদল সৈন্য রাজধানী অভিমুখে অভিযান চালায়। ২৪শে এপ্রিল তারা ইস্তাম্বুল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। সুলতান আবদুল হামিদ সানিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। নতুন সুলতান বানানো হয় আব্দুল হামিদের ভাই পঞ্চম মুহাম্মাদকে। ১৯১৮ সনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সুলতান ছিলেন। আবার কমিটি সরকার কায়েম হয়। মার্শাল ল জারি করা হয়। অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়। ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতি নামক সংস্থাটিও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতী
১৯০৯ সনের শুরুর দিকে হাফিয দারবিশ ওয়াহদাতি বে-র নেতৃত্বে ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতী নামে একটি সংগঠন কায়েম হয়। আয়া সোফিয়া মাসজিদে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় এই সংগঠনের। সেই অনুষ্ঠানে সাঈদ নুরসী দুই ঘন্টা বক্তৃতা করেন। ইয়াং তুর্কি আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯০৮ সাল থেকে কমিটি শাসন শুরু হলে মুসলিম চিন্তাবিদেরা এর বিরুদ্ধে এই সংগঠন দাঁড় করান।

ইস্তাম্বুলের সেনা বিদ্রোহ দমন করার পর শত শত লোক গ্রেফতার করা হয়। কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস এর বিশ্বাস ছিলো যে ইত্তিহাদ-ই-মুহাম্মাদী জামিয়াতীর উসকানিতেই এই বিদ্রোহ ঘটে। আর যেহেতু সাঈদ নুরসী এই জামিয়াতীর সাথে জড়িত, সেহেতু তিনিও অপরাধী। এই কারণে কমিটি সরকার সাঈদ নুরসীকে গ্রেফতার করে। ১৯০৯ সনের ১৯ জুলাই একটি কালো দিন। ঐদিন হাফিয দারবিশ ওয়াহদাতি বে ও আরো বারো জনকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। এরপর একে একে এই সংগঠনের ২৩৭ জন মুজাহদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

বন্দী সাঈদ নুরসীকে বায়েজিদ নামক স্থানে কোর্ট মার্শালে উপস্থিত করা হয়। যেই কক্ষে তাঁর বিচার হচ্ছিলো সেই কক্ষের জানালা দিয়ে পনরজনের ঝুলন্ত লাশ দেখা যাচ্ছিলো। কোর্ট মার্শালের প্রিজাইডিং অফিসার সাঈদ নুরসীকে বলেন, ‘‘আপনি শারীআহ চাচ্ছেন? যারা শারীয়াহ চায় তারা বাইরে ঝুলে থাকা ঐ লোকগুলোর মতো ফাঁসিতে ঝুলে।’’ সাঈদ নুসরীর নির্ভীকতা ছিলো বিস্ময়কর। তিনি ইসলামবিদ্বেষী সামরিক অফিসারকে বললেন, ‘‘আমার যদি এক হাজার জীবন থাকতো, আমি শারীয়ার এক একটি অংশের জন্য আমার জীবনগুলো কুরবান করে দিতাম। কারণ শারীয়াহ-ই হচ্ছে সমৃদ্ধি, কল্যাণ, সুবিচার ও সততার পথ।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘বীর ব্যক্তিরা অপরাধ করে না। যদি তারা অভিযুক্ত হয় তারা শাস্তিকে ভয় পায় না। আমি যদি অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হই আমি দুইজন শহীদের পুরস্কার পাবো। আমি যদি জেলখানায় থাকি তবে সম্ভবত জেলখানাই হচ্ছে স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে সবচে’ বেশি আরামপ্রদ স্থান। জালিম হয়ে বাঁচার চেয়ে মজলুম হয়ে মরা উত্তম।’’ কমিটি অব ইউনিয়ানের নেতাদের মধ্যে সাঈদ নুরসীর ভক্ত থাকায় তিনি অবশেষে জালিমের কারাগার থেকে মুক্তি পান।

১৯১০ সনে সাঈদ নুরসী সমুদ্র পথে তাঁর জন্মভূমিতে পৌঁছেন। বহু স্থানে লোকেরা তাঁকে দেখতে আসে। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখেন। ১৯১১ সনে তিনি সিরিয়া সফরে আসেন। দিমাসক শহরের উমাইয়া মাসজিদে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। প্রায় দশ হাজার শ্রোতা তাঁর বক্তৃতা শোনে। সেখান থেকে তিনি বৈরুতে যান। বৈরুত থেকে আবার রাজধানী ইস্তাম্বুলে যান।

নতুন সুলতানের মুখোমুখি
সাঈদ নুরসীর মাথায় মাদ্রাসাতুজ জাহরা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। নতুন সুলতান পঞ্চম মুহাম্মাদের সাথে তিনি এই বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী ছিলেন। সুলতান ও কমিটি অব ইউনিয়ন এণ্ড প্রগ্রেস সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ইউরোপীয় প্রদেশগুলোতে সফরে যাচ্ছিলেন। তিনিও তাঁদের সাথে যুক্ত হন। তাঁরা স্কপজি ও প্রিস্টিনা হয়ে কসোভা পৌঁছেন। কসোভাতে একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিষয় আলোচনা হচ্ছিলো। এই সুযোগে সাঈদ নুরসী পূর্ব আনাতোলিয়াতে তাঁর পরিকল্পিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

কিন্তু ১৯১২ সনে বলকান যুদ্ধে তুর্কী পরাজিত হওয়ায় কসোভাতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সম্ভাবনা রহিত হয়ে যায়। ১৯১৩ সনে সাঈদ নুরসী কসোভা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ মাদ্রাসাতুজ জাহরা স্থাপনের জন্য বরাদ্দ করার আবেদন পেশ করেন। সুলতান এই আবেদন মঞ্জুর করেন। ওয়ান হ্রদের তীরে ভিত্তি প্রস্তরও স্থাপিত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সনের নভেম্বর মাসে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার তাঁর পরিকল্পিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ভবন নির্মাণের কাজ স্থগিত হয়ে যায়।

রনাঙ্গনে সাঈদ নুরসী
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে গ্রেট বৃটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া। তুর্কী জার্মানীর পক্ষে যোগ দেয়। আনোয়ার পাশা তখন যুদ্ধমন্ত্রী। তিনি আনোয়ার পাশার সাথে দেখা করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলার অনুমতি হাসিল করেন। তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বাহিনী গঠন করে তিনি রনাঙ্গনে নেমে পড়েন। তাঁর জন্মভূমি বিতলিসে তিনি ও তাঁর বাহিনী বীরের মতো লড়েন। কিন্তু ১৯১৬ সনের মার্চ মাসে রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে বিতলিস দখল করে নেয়। সাঈদ নুরসী বন্দী হন। দুই বছর তিনি কাটান বন্দীশালায়। ১৯১৮ সনে তিনি বন্দীশালা থেকে পালিয়ে চলে আসেন। তাঁকে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেয়া হয়।

দারুল হিকমাহ ইসলামীয়া
১৯১৮ সনে ওয়াহিদ উদ্দীন সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ নামে মসনদে বসেন। ১৯১৮ সনের ১২ই অগাস্ট সরকার দারুল হিকমাহ ইসলামীয়া নামে একটি সংস্থা গঠন করে। মুহাম্মাদ আকিফ এই সংস্থার সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। এই সংস্থার নয়জন সদস্যের মধ্যে সাঈদ নুরসী ছিলেন একজন। মুসলিম জাহানের সমস্যাবলীর সমাধান চিহ্নিতকরণ, মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে পরিচালিত বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণগুলোর জবাবদান, দ্বীন ইসলামকে হেয় করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করণ, মোটকথা ইসলামের পুনর্জাগরণই ছিলে এই সংস্থার উদ্দেশ্য। ১৯২২ সনের নভেম্বর মাসে আংকারাভিত্তিক তুর্কীর নতুন সরকার সুলতান পদ বিলুপ্ত করে। ঐ সরকার দারুল হিকমাহ ইসলামীয়ার কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়। সংস্থাটি বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত চার বছর সাঈদ নুরসী এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন।

প্রথম মহাযুদ্ধে তুর্কীর পরাজয়ের গ্লানি
প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানী ও তুর্কী পরাজিত হয়। ১৯২০ সনের ১০ই অগাস্ট বিজয়ী শক্তিগুলো সেভার্স চুক্তির মাধ্যমে তুর্কীর ওপর চরম আঘাত হানে। চুক্তি অনুযায়ী ঈজিয়ান সাগরের কয়েকটি দ্বীপ ও থ্রেস তুর্কীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গ্রীসকে দেয়া হয়। মিসর, সুদান, সাইপ্রাস, ইরাক, ফিলিস্তিন ও আরব উপদ্বীপ গ্রেটবৃটেনের কর্তৃত্বাধীনে দেয়া হয়। লেবানন, সিরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া প্রভৃতি তুলে দেয়া হয় ফ্রান্সের হাতে। কনস্ট্যান্টিনোপল ও আলেকজান্দ্রিয়া নৌবন্দর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। তুর্কীর বিমান বহর মিত্র শক্তির হাতে চলে যায়। সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদের হাতে থাকে রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল ও আনাতোলিয়ার পার্বত্যাঞ্চল। তবে কনস্ট্যান্টিনোপলেও মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করে। সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ দখলদার বাহিনীর হাতের পুতুলে পরিণত হন। কমিটি অব ইউনিয়ান এণ্ড প্রগ্রেস সরকারের পতন ঘটে। সুলতান সকল ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন।

আংকারাতে সমান্তরাল সরকার গঠন
আনাতোলিয়া ছিলো ইয়াং তুর্কসের শক্ত ঘাঁটি। সেখান থেকে ইয়াং তুর্কস ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। অথচ এই ইউরোপিয়ানরাই তাদের মদদ দিয়ে সুলতান আব্দুল হামিদকে পরাজিত করায়। ঐসময় তারা ইউরোপিয়ানদের বন্ধু ভেবেছিল। আব্দুল হামিদের পতনের মধ্য দিয়ে তারা ব্রিটেনের বিষদাঁত দেখেছে। কিন্তু এখন আর মোকাবেলা করার সেই শক্তি তাদের ছিল না। যাই হোক তারা সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন রিফাত রউফ বে ও আলী ফুয়াদ পাশা। সুলতান বিদ্রোহ ঠেকাতে ইংল্যান্ডের সাহায্য নেয়।

১৯১৯ সনে আনাতোলিয়াতে ইয়াং তুর্কস প্রতাপশালী হয়ে উঠলে তাদেরকে দমন করার জন্য সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মাদ সেনাবাহিনীর জাঁদরেল অফিসার মুস্তাফা কামাল পাশাকে ইন্সপেক্টার জেনারেল নিযুক্ত করে সেখানে পাঠান। সেখানে গিয়ে মুস্তাফা কামাল পাশা বিদ্রোহীদের দলে ভিড়ে যান। ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে ইয়াং তুর্কস সেখানে একটি নির্বাহী পরিষদ গঠন করে। মুস্তাফা কামাল পাশা হন এই পরিষদের চেয়ারম্যান। সদস্য ছিলেন রিফাত রউফ বে, বেকীর সামী বে, রুস্তম বে, মাজহার বে ও হায়দার বে। এই নির্বাহী পরিষদ আংকারাকে রাজধানী করে আনাতোলিয়া শাসন করতে থাকে। এই ভাবে আংকারায় কনস্ট্যান্টিনোপলের সমান্তরাল সরকার কায়েম হয়ে যায়।

১৯২০ সালে মুস্তাফা পাশার নেতৃত্বে তুর্ক সৈন্যগণ স্মার্ণা থেকে গ্রীক সৈন্যদেরকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। ১৯২১ সনে সাকারিয়া রণাংগনেও গ্রীকদেরকে পরাজিত করা সম্ভব হয়। এই দুইটি সামরিক বিজয় আংকারা সরকারের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি করে। কমিউনিস্ট রাশিয়া আংকারা সরকারকে প্রথম স্বীকৃতি দেয়। ফ্রান্স এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে সিলিসিয়া থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়। ইতালী এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে আদালিয়া ছেড়ে চলে যায়। এর মাধ্যমে মোস্তফা কামাল পাশার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। কামাল পাশা ইস্তাম্বুল দখল করেন এবং দ্বিতীয় আবদুল মাজিদকে খলিফাহ নির্বাচিত করে। আর ষষ্ঠ মুহাম্মদ ইংল্যান্ড পালিয়ে যান।

কামাল পাশার মুখোমুখি
মুস্তাফা কামাল পাশা তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি ১৯২২ সালে ৯ নভেম্বর সাঈদ নুরসীকে আংকারায় একটি সংবর্ধনা দেন। এরপর ১৯২৩ সনের ১৯ জানুয়ারী সাঈদ নুরসী দশ দফা দাবি সম্বলিত একটি চিঠি গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলির সদস্যদের নিকট পাঠান। এই চিঠির মাধ্যমে তিনি সকলকে দ্বীনী কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ করে দেন। এরপর এসেম্বলির সদস্যদের মধ্যে তাবলীগ চালাতে থাকেন।

এসেম্বলির চেয়ারম্যান কামাল পাশা এই তৎপরতা দেখে বিরক্ত হন। একদিন তিনি রাগতস্বরে সাঈদ নুরসীকে বলেন, ‘‘আমাদের প্রয়োজন একজন বীর আলিমের। আপনার উন্নত চিন্তাধারা থেকে উপকৃত হবার জন্যই আপনাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে। অথচ আপনি এখানে এসে সালাত সম্পর্কে লেখালেখি শুরু করলেন। এইভাবে আমাদের মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করলেন।’’

সাঈদ নুরসী নির্ভীকভাবে জবাব দিলেন, ‘পাশা, পাশা, ঈমানের পর ফরজ সালাতগুলোই তো ইসলামের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যারা সালাত আদায় করে না তারা বিশ্বাসঘাতক। আর বিশ্বাসঘাতকের অভিমত গ্রহণ করা যায় না।’’ উপস্থিত সকলেই ঘাবড়ে গেলেন। তাঁরা ভাবলেন, এই সব উক্তির জন্য সাঈদ নুরসীকে চড়ামূল্য দিতে হবে।

কিন্তু চতুর কামাল পাশা নিজের রাগ সামলে নিলেন। দুই দিন পর তিনি সাঈদ নুসরীকে তাঁর অফিসে ডেকে নেন ও বিভিন্ন বিষয়ে দুই ঘন্টা আলাপ করেন। তিনি সাঈদ নুরসীকে মাসিক তিনশত লিরার বিনিময়ে পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে মুবাল্লিগ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন, তাঁকে এসেম্বলীতে সদস্য পদ দিতে চান ও দারুল হিকমাহ ইসলামীয়ার সদস্য পদের অনুরূপ একটি পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। সাঈদ নুরসী এইসব পদ প্রত্যাখ্যান করেন।

কামাল পাশার স্বৈরশাসন
আংকারাতে অবস্থানকালে সাঈদ নুরসী বুঝতে পেরেছিলেন তুর্কীর মুসলিমদের ওপর নতুন বিপদ জেঁকে বসেছে। ১৯২৩ সনের এপ্রিল মাসে তিনি আংকারা ত্যাগ করে ওয়ান চলে আসেন। ১৯২৩ সনের অক্টোবর মাসে কামাল পাশা তুর্কীকে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে তিনি এর প্রেসিডেন্ট হন ও ইসমত ইনুনুকে প্রাইম মিনিস্টার বানান। ১৯২৪ সনে একটি আইনের মাধ্যমে ‘‘খালীফাহ’’ পদ বিলুপ্ত করেন। খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মাজিদকে পদচ্যুত হন। কামাল পাশা তুর্কীকে একটি সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তুর্কীর রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে আংকারায় স্থানান্তরিত করেন।

কামাল পাশা চরম ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন। যা কিছু ইসলামী আইন তখনো প্রচলিত ছিলো সেইগুলো বাদ দিয়ে তিনি সুইস কোড (Swiss Code) প্রবর্তন করেন। তিনি পর্দা প্রথার বিলোপ সাধন করেন। একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ করেন। সহশিক্ষা প্রবর্তন করেন। ইসলামী বিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশের সর্বত্র সেকুলার স্কুল-কলেজ স্থাপিত হয়। আরবীতে আযান দেয়া নিষিদ্ধ হয়। আরবী বর্ণমালার পরিবর্তে ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করা হয়। পাগড়ি ও ফেজ টুপি পরা নিষিদ্ধ হয়। হ্যাট পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। সালাম পরিত্যক্ত হয়।

দেশে সেকুলার পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সেকুলার ও সমাজতান্ত্রিক বই পুস্তক ব্যাপকহারে প্রকাশিত হতে থাকে। যুব সমাজ উচ্ছৃংখল হয়ে উঠে। বেহায়াপনা উলংগপনা বৃদ্ধি পায়। মদখোরের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ১৯৩০ সনে কামাল পাশা ‘রিপাবলিকান পিপলস পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৪৬ সন পর্যন্ত এটিই ছিলো তুর্কীর একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল।

সাঈদ নুরসীর নতুন আন্দোলন
আংকারা থেকে ওয়ান এসে সাঈদ নুরসী প্রথমে তাঁর ছোট ভাই আবদুল মাজীদের বাসায় উঠেন। কিন্তু তাঁর কাছে বহু সংখ্যক লোক আসা-যাওয়া করতে থাকায় তিনি নুরসিন মাসজিদে স্থানান্তরিত হন। এই মাসজিদ এবার তাঁর ইসলামী জ্ঞান বিতরণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। কিছুকাল পর তিনি মাউন্ট এরেকে চলে যান ও সেখানে যারনাবাদ নদীর উৎসমুখের নিকটে অবস্থান করতে থাকেন। তবে জুমাবার তিনি নুরসিন মাসজিদে এসে খুতবাহ দিতেন। তিনি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাসায় তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ের ওপর বক্তব্য রাখতেন। তাঁর এক ছাত্র মোল্লা হামীদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আমার লক্ষ্য হচ্ছে ঈমানের বুনিয়াদ মজবুতভাবে গড়ে তোলা। যদি বুনিয়াদ মজবুত হয়, কোন তুফানেই তা ভেংগে পড়বে না।’’

সশস্ত্র তৎপরতার বিরোধিতা
সাঈদ নুরসী তখন প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করছিলেন। তবুও বিভিন্ন গোত্রের সরদার ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর নিকট আসা-যাওয়া করতো। কুর্দদের মধ্যে অনেকেই সরকার-বিরোধী হয়ে উঠে। সরকারের ইসলামী বিরোধী কার্যকলাপ তাদেরকে ব্যথিত করে। অন্য দিকে তাদের অঞ্চলের সমস্যাবলী সমাধানের প্রতি সরকারের উদাসীনতা তাদেরকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। জনৈক শায়খ সাঈদ এই সময় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে তোলেন। হুসাইন পাশা নামক একজন সরদার সাঈদ নুরসীর সাথে সাক্ষাত করে বলেন, ‘আমার সৈন্য, ঘোড়া, গোলাবারুদ প্রস্তুত। আমরা শুধু আপনার কমাণ্ডের অপেক্ষা করছি।’’

সাঈদ নুরসী সরকার পরিবর্তনের জন্য সশস্ত্র তৎপরতা চালানোর ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর শানিত যুক্তি ব্যবহার করে ঐ ধরণের তৎপরতায় আগ্রহী ব্যক্তিদেরকে নিরুৎসাহিত করে চলেন। তথাপিও আবেগ প্রবণ ও ত্বরা প্রবণ লোকেরা ঐ দিকেই ঝুঁকে পড়ে।

১৯২৫ সনের ১৩ই ফেব্রুয়ারী শায়খ সাঈদের নেতৃত্বে সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়। রাষ্ট্রশক্তির মুকাবিলায় এটি ছিলো একটি অপ্রতুল প্রয়াস। মুস্‌তাফা কামাল পাশার সৈন্যরা অভিযান চালিয়ে দুই মাসের মধ্যেই এই বিদ্রোহ দমন করে। বিদ্রোহ দমনের পর ইনডিপেনডেন্স ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। বিচাররের নামে প্রহসন করা হয়। বহু লোককে শাস্তি দেয়া হয়।

সরকার ওয়ান প্রদেশের প্রভাবশালী ইসলামী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে গ্রেফতার করে। একদল সৈন্য এসে যারনাবাদ নদীর উৎমের নিকটবর্তী নিভৃত স্থান থেকৈ সাঈদ নুরসীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। শায়খ মাসূম, কুর হুসাইন পাশা, হাসান আফিন্দী, আবদুল বাকী আফিন্দী, আবদুল্লাহ আফিন্দীসহ কয়েকশত পুরুষ ও মহিলাকে প্রথমে ইজমির ও পরে আন্টালিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে তাকে বিভিন্ন স্থানে নির্বাসনে পাঠানো হয়।

রিসালা-ই-নূর
মুসলিমদের সঠিক দিক নির্দেশনা নিয়ে তিনি তাঁর প্রবন্ধ কালেকশন রিসালায়ে নূর তৈরি করেন। এটা কোথাও মুদ্রন করা যায় নি। তার অনুসারীরা নিজ হাতে এটাকে কপি করতে থাকে।

তবে সরকারের বৈরী মনোভাবের কারণে রিসালা-ই-নূর কপি করণ ও বিতরণ সহজ কাজ ছিলো না। সন্দেহ হলেই পুলিশ লোকদের বাড়িতে হানা দিতো। কারো কাছে কপি পাওয়া গেলে তাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। মারধোর করতো। কাউকেও বা বন্দী করে রাখতো। রিসালা-ই-নূর একদিকে আল কুরআনের শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অন্য দিকে বাঁচিয়ে রেখেছে আল কুরআনের বর্ণমালাকে। রিসালা-ই-নূরের প্রভাব বেড়েই চলে। রিসালা-ই-নূরের প্রভাবে নীরবে সৃষ্টি হতে থাকে ইসলামী জাগরণ।

১৯৩৫ সনের ২৭শে এপ্রিল সাঈদ নুরসী ও তাঁর একদল অনুগামীকে ইস্‌পারটা থেকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েকদিনের মধ্যে মিলাস, আন্তালিয়া, বলভাদিন, আইডিন, ওয়ান ও অন্যান্য স্থান থেকে রিসালা-ই-নূরের বহু সংখ্যক পাঠককে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য জনগণের ধর্মীয় আবেগের ব্যবহার ও ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংস্থা গড়ে তোলার অভিযোগ আনা হয়।

জেলখানায় সাঈদ নুরসীকে একটি কক্ষে ও ৩১ জনকে একটি ওয়ার্ডে রাখা হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দীদের সংখ্যা হয় একশত বিশজন। অত্যন্ত কষ্টদায়ক পরিবেশে তাঁদেরকে থাকতে বাধ্য করা হয়। জেলখানায় তাঁরা জামায়াতে সালাত আদায় করতেন। পারা ভাগ করে নিয়ে দৈনিক কয়েকবার আল কুরআন অধ্যয়ন সমাপ্ত করতেন। সমবেতভাবে আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন। কারাগার কার্যতঃ শিক্ষাগারে পরিণত হয়। সাঈদ নুরসী ইউসুফ আ.-এর তৎপরতার অনুরূপ তৎপরতার নিরিখে জেলখানাকে মাদ্রাসা-ই-ইউসুফিয়া বলে উল্লেখ করতেন।

কোর্টে সাঈদ নুরসীকে এগার মাস ও পনরজন অনুগামীকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেয়া হয়। অন্যরা মুক্তি পায়। এই রায় প্রদান করা হয় ১৯৩৫ সনের ১৯শে অগাস্ট। ১৯৩৬ সনের মার্চ মাসে সাঈদ নুরসী জেলখানা থেকে মুক্তি পান। সাঈদ নুরসীকে এবার নির্বাসিত করা হয় কাসতামনুতে। প্রথমে তিন মাস তাঁকে থানাতেই একটি কক্ষে কাটাতে হয়। পরে থানার বিপরীত দিকে একটি ভাড়া করা বাড়িতেই তিনি থাকা শুরু করেন।

কাসতামনুতে শীতকালে তীব্র শীত পড়ে। শীতের প্রচণ্ডতায় তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বাত রোগে ভুগতে থাকেন। তবে তাঁর কলম চলতে থাকে বিরামহীন। আরো কিছু রিসালা-ই-নূর তিনি লিখতে সক্ষম হন। পুলিশের হয়রানি সত্ত্বেও তাঁর সাথে দেখা করতে আসতো তাঁর ভক্তরা। তিনি রিসালা-ই-নূরের পাঠক বা ছাত্রদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের উপদেশ দিতেন। আত্মম্ভরিতা পরিহার করতে বলতেন। তিনি বলতেন যে কারো সাথে ভালোবাসা হবে শুধু আল্লাহরই জন্য, আবার কারো সাথে শত্রুতা হবে আল্লাহরই জন্য। রিসালা-ই-নূর দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে থাকে। সাঈদ নুরসী বলতেন, এই আলো ভবিষ্যতের দিকে ছুটে যাবে। ইনশাআল্লাহ্‌।

১৯৩৮ সনে কামাল পাশার মৃত্যু হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট হয় ইসমত ইনুনু। সেও কামাল পাশার পদাংক অনুসরণ করে। ১৯৪৩ সনের ২রা সেপ্টেম্বর তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করে ডেনিযলি পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাঁর ১২৬ জন অনুসারীকেও গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্য থেকে ৭৩ জনকে জেলে পাঠিয়ে, অন্যদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। ডেনিযলি জেলখানাও ইসলামী শিক্ষাগারে পরিণত হয়। এটি পরিণত হয় দ্বিতীয় মাদ্রাসা-ই-ইউসুফিয়ায়। ১৯৪৮ সালেও আবার গ্রেপ্তার হন তিনি। এদিকে রিসালায়ে নূরও সারা দেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়।

১৯৫০ সালে আদনান মেন্দেরেস ক্ষমতায় আসেন। তিনি সাঈদ নুরসীর সাথে বিরোধ কমিয়ে আনেন। সাঈদ নুরসীও তাঁর ডিমোক্রেটিক পার্টিকে ‘কম মন্দ’ গণ্য করতেন। ১৯৫৭ সনের নির্বাচনে তিনি তাঁর ছাত্রদেরকে ডিমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে ভোট দিতে বলেন।

আদনান মেন্দেরেসকে তিনি মুসলিম জাহানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্‌বান জানান। পূর্বাঞ্চলের জন্য পরিকল্পিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইসলামী ধাঁচে গড়ে তোলার জন্য তিনি আবেদন জানান। জাতীয়তাবাদ নয় ইসলামী জাতিসত্তার চেতনাকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি পরামর্শ দেন। সাঈদ নুরসী মুসলিম জাহানের ঐক্যের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি ‘ইউনাইটেড ইসলামিক স্টেটস’ এর স্বপ্ন দেখেন।

১৯৫৭ সনে আংকারা ও ইস্তাম্বুল প্রিন্টিং প্রেসে প্রথম মুদ্রিত হয়ে রিসালা-ই-নূর প্রকাশিত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাঈদ নুরসী মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘রিসালা-ই-নূরের উৎসবের এই তো সময়। আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। এই তো সেই সময় যার জন্য আমি দীর্ঘকাল অপেক্ষা করেছি। এবার আমি যেতে পারি।’’

মহান আলোকবর্তিকার প্রস্থান
১৯৬০ সনে সাঈদ নুরসীর বয়স হয় ৮৩ বছর। তাঁর শরীরের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে থাকে। তিনি উরফা যাওয়ার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। কয়েকজন সাথী নিয়ে ২২ মার্চ তিনি উরফা পৌঁছেন। তিনি একটি হোটেলে উঠেন। রাতে তাঁর জ্বর খুব বেড়ে যায়। তিনি কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬০ সনের ২৩শে মার্চ রাত তিনটার সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তঁর মৃত্যুর খবর শুনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অগণিত মানুষ ছুটতে থাকে উরফার দিকে। উলু মাসজিদে তাঁর জানাযার নামায হয়। স্থানীয় কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তাঁর রিসালা-ই-নূর মুসলিম জাতিকে পথ দেখায়। কমিউনিজম ও জাতীয়তাবাদ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। একসময়ের ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু থেকে ইসলাম হারিয়ে যেতে বসেছিল। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী তাঁর প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা ঠেকিয়ে দিয়েছেন। তাইতো সেখান থেকে নাজিমুদ্দিন এরবাকানের নেতা উঠে এসেছিলেন।

২৩ মার্চ, ২০২১

৫০ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

১৯৭১ সালের দেশভাগের ৫০ বছর হতে চলেছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নিয়ে বহু লেখা হচ্ছে এবং হবে। অনেকে আলোচক এই নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। দুঃখজনক হলো এখানে তারা নিজেদের প্রত্যাশাকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা বলে ভুল করছেন। গতকাল এক বক্তব্যে আমার দলের সাধারণ সম্পাদক মিয়া গোলাম পরওয়ারও তাঁর নিজের প্রত্যাশাকে দেশের প্রত্যাশা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এখানে বহু প্রত্যাশা ও বহু প্রাপ্তি ছিল। এদেশে বহু মানুষ বহুরূপ, বহুধা বিভক্ত। তাই তাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি বহুরূপ ও সাংঘর্ষিক।

১৯৭২ সালে দেশভাগ পরবর্তী জনগণকে মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করা যায়
১. দেশভাগের পক্ষের শক্তি 
২. দেশভাগের বিপক্ষের শক্তি 
৩. দেশভাগ নিয়ে নিরপেক্ষ শক্তি 

১. দেশভাগের পক্ষের শক্তি 
দেশভাগ নিয়ে যারা পক্ষের শক্তি তাদের মধ্যে যারা তাদের মধ্যে দুইটি পক্ষ 
ক) মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী পক্ষ 
খ) নেতৃত্বদানকারীর মূল উদ্দেশ্য না জেনে যারা যুদ্ধে এটেইন করেছেন অথবা পক্ষে থেকেছেন 

ক পক্ষের প্রত্যাশা ছিল  
- বাংলাদেশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা (রাশিয়ার আদলে)
- এই দেশ থেকে ধর্মীয় ভাবধারা বা ধর্মের প্রভাব নিশ্চিহ্ন করে নাস্তিকতা প্রতিষ্ঠিত করা 
- ধনী-গরীবের ব্যবধান দূর করা (পুঁজিবাদ দূর করা)
- দেশের সকল সম্পত্তি জাতীয়করণ করা 

ক পক্ষের প্রাপ্তি 
- ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র যুক্ত করা। কিছুদিন পর তা বাতিল হলেও এখন আবার সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে যুক্ত হয়েছে। 
- ১৯৭২ সালে ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা, কওমী মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া।  
- দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করা। যেসব স্থানে ইসলাম ও মুসলিম শব্দ আছে তা মুছে ফেলা। ইসলামপন্থী নেতাদের কারাগারে আবদ্ধ করা। তাদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া। বহু ইসলামপন্থীকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা। 
- অবাঙ্গালি মালিকদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা ও তাদের কলকারখানা জাতীয়করণ করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা।
- ১০০ বিঘার বেশি জমি একজনের কাছে থাকবে না। এই আইন প্রতিষ্ঠা।  

ক পক্ষের অপ্রাপ্তি 
- দেশ ও জনগণের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রভাব তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়া। সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে যারা নিয়েছে নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।  
- নাস্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা যায় নি। ৫০ বছর পরে আজ বাংলাদেশে ধর্মীয় প্রভাব অনেক বেড়েছে। রাজনীতিতে সবাইকে এখানে ধর্ম নিয়েই চলতে হয়। 
- ধনী গরীবের মধ্যে ব্যবধান দূর হয়নি। বরং তা আরো প্রকট হচ্ছে। গত দশবছরে ধনী বৃদ্ধি ও গরীব বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে সামনের সারিতে। 
- অবাঙ্গালিদের সম্পদ ছাড়া আর কারো সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হয়নি। 

খ পক্ষের প্রত্যাশা 
- মুসলিম জাতীয়তাবাদের (উম্মাহ চেতনা) উৎখাত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা 
- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা  
- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা  
- বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করা (সোনার বাংলা গঠন)

খ পক্ষের প্রাপ্তি 
- সর্বক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 

খ পক্ষের অপ্রাপ্তি 
- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। 
- লুটপাট চুরি ডাকাতি সামাজিক অনাচার বৃদ্ধি পেয়েছে
- গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার নাই বললেই চলে 
- বাংলাদেশ দিন দিন ঋণের ভারে জর্জরিত হচ্ছে। 
- মানুষের নিরাপত্তা নাই বললেই চলে 

২. দেশভাগের বিপক্ষ শক্তি 
যারা দেশভাগের বিপক্ষ শক্তি তারাও দুইভাগে বিভক্ত 
ক) পক্ষের শক্তির সাথে মিশে যাওয়া  
খ) নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখা 

ক পক্ষের প্রত্যাশা 
- পক্ষের শক্তির সাথে কোনোরকম মিশে গিয়ে নিজের জীবন বাঁচানো ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা 

ক পক্ষের প্রাপ্তি 
- বেশিরভাগই পক্ষের শক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছে। অনেকেই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। 

ক পক্ষের অপ্রাপ্তি 
- এই পক্ষের কোনো অপ্রাপ্তি নেই। 

খ পক্ষের প্রত্যাশা 
- নিজেদের সংগঠিত করা 
- ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক ধারা চালু করা 
- মুসলিম উম্মাহ চেতনা জাগ্রত করা  
- মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ভাবধারা ফিরিয়ে আনা 
- ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, বিপুলভাবে মসিজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা 
- ইসলামকে আবারো দেশের মূলনীতিতে ফিরিয়ে আনা 
- স্বৈরাচার প্রতিরোধ করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা 

খ পক্ষের প্রাপ্তি
- নিজেদের সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছে 
- ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক ধারা চালু হয়েছে 
- মানুষের মধ্যে দিনে দিনে ধর্মের প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হয়েছে 
- ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রনয়ণ, সে অনুসারে প্রতি জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠা 
- ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু এবং তা দিনে দিনে জনপ্রিয় হওয়া 
- স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হওয়া 
- ব্যাপকভাবে মসজিদ মাদ্রাসার চাহিদা বেড়ে যাওয়া 

খ পক্ষের অপ্রাপ্তি
- স্বৈরাচারী শাসন রুখতে না পারা 
- জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে উম্মাহ চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে না পারা 
- ইসলামকে মূলনীতিতে নিয়ে আসতে না পারা 
- ইসলামবিরোধী নীতিগুলো (শিরক, সুদ, জেনা) প্রতিরোধ করতে না পারা 
- ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি জনমত তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া। যারা বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় তাদের সংখ্যা ১৫% এর কম। 

 ৩. দেশভাগ নিয়ে নিরপেক্ষ শক্তি 
দেশভাগ নিয়ে যারা নিরপেক্ষ ছিল তাদের প্রত্যাশা আর না বুঝে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা লোকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি একইরকম। তাই আবার উল্লেখ করলাম না।

২১ মার্চ, ২০২১

পর্ব : ০৬ - আল্লাহর রাসূল সা.-এর তারবিয়াতী মিশন


ইসলাম গ্রহণের পর মুহাম্মদ সা.-এর বন্ধু আবু বকর রা. তাবলীগের কাজ শুরু করেন। তিনি উসমান ইবনে আফফান, তালহা ইবন উবাইদিল্লাহ, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। তারা সকলে সাথে সাথে এ দাওয়াত কবুল করেন। এতে তিনি অত্যন্ত উৎসাহ বোধ করেন। এরপর তিনি উসমান ইবনে মাজউন, আবু উবাইদা এবং আল আরকাম ইবনে আবিল আরকামকে নিয়ে মুহাম্মাদের খিদমতে হাজির হন। তারা মুহাম্মদ সা.-এর সাথে কথা বলেন এবং সকলেই ইসলাম গ্রহণ করেন।

অনেক আগ থেকেই ইসলামের শিক্ষাগৃহ ছিল মসজিদ। আদম আ. দুনিয়াতে এসে বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবাঘর নির্মাণ করেন। এটিই মানব জাতির প্রথম তারবিয়াতী সেন্টার। তারবিয়াতী সেন্টার বলতে বুঝিয়েছি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। নূহ আ.-এর সময়ে ঘটে যাওয়া মহাপ্লাবনে কা'বা ঘর ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর ইবরাহীম আ. তাঁর পুত্র ইসমাঈল আ.-কে সাথে আবার একই স্থানে কা'বা ঘর নির্মাণ করেন। তখন থেকে এটি মক্কার শিক্ষা-দীক্ষা ও ইবাদতের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।

আল্লাহর রাসূল সা. নবুয়্যত পাওয়ার পর প্রায় তিন বছর গোপন দাওয়াত দিয়েছিলেন। দাওয়াত গ্রহণের পর মুসলিমদের তারবিয়াত প্রশিক্ষণ দেওয়াটা জরুরি বিষয় হয়ে পড়ে। প্রথম তিন বছর খুব বেশি আদেশ ছিল না বলে বেশি প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন হয়নি। তবে আল্লাহর রাসূল সা. নিজ গৃহে এই নসীহত ও প্রশিক্ষণের কাজ আঞ্জাম দিতেন।

প্রকাশ্য দাওয়াতের সাথে সাথে বিরোধীতাও বাড়তে থাকে। এসময় রাসূল সা. বিভিন্ন স্থানে নসীহত ও তারবিয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন। আদি মাদ্রাসা কা'বা ঘরেই বেশি বেশি জমায়েত হতেন মুসলিমদের নিয়ে। তিনি ভালো কাজের উপদেশ দিতেন ও নামাজ শিক্ষা দিতেন। একবার তাঁরা একত্রিত হয়ে নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় একদল মুশরিক সাহাবাদের গালাগাল দেয়। এতে দুই পক্ষ মারামারিতে লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. একজন মুশরিককে এমনভাবে পেটালেন যে, তার রক্ত গড়িয়ে পড়লো। এভাবে নিয়মিত সংঘর্ষ হতে থাকলো। অন্যাদিকে দুই সাহাবী ইয়াসির রা. ও সুমাইয়া রা. শাহদাতবরণ করলেন।

অত্যাচারের এবং নির্যাতনের ভয়াবহ এ অবস্থায় কৌশল হিসাবে রাসূলুল্লাহ সা. মুসলমানদের বলেছিলেন যে, প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা নতুন মুসলমানরা যেন প্রচার না করেন, তাছাড়া দেখা সাক্ষাত এবং মেলামেশার ব্যাপারে মুসলমানরা যেন গোপনীয়তার আশ্রয় নেন, কেননা আল্লাহর রাসূলের সাথে মুসলমানদের দেখা সাক্ষাতের কথা যদি অমুসলিমরা শোনে তাহলে তারা ইসলামের শিক্ষা দীক্ষার প্রসারে বাধা সৃষ্টি করবে, ফলে উভয়ের পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠবে।

আর এ ধরনের সংঘর্ষ বারবার ঘটলে এবং দীর্ঘায়িত হলে মুসলমানদের এই ছোট দলটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এ কারণে গোপনীয়তার কৌশল অবলম্বন করা ছিলো অত্যাবশ্যক। কৌশল অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরামরা তাদের ইসলাম গ্রহণ, ইবাদত বন্দেগী, তাবলীগ, পারস্পরিক দেখা সাক্ষাৎ মেলামেশা সবই গোপনভাবে করতেন। তবে শুধু রাসূলুল্লাহ সা. তাবলীগে দ্বীন এবং ইবাদত সব কিছুই প্রকাশ্যে একা করতেন।

এই গোপনীয়তার কারণে মুসলিমরা আল্লাহর রাসূল সা. থেকে শিক্ষা নেওয়াটা বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। এই সমস্যা সমাধানে আল্লাহর রাসূল সা. সাহাবাদের সাথে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে আসলেন। তিনি আল আরকাম ইবনে আবিল আরকামের ঘরকে তারবিয়াতের স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেন। হিলফুল ফুযুল গঠনের সময়েও আরকাম রা. মুহাম্মদ সা.-কে সাহায্য করেছিলেন। আরকাম রা.-এর ঘর ছিল সাফা পাহাড়ের পাদদেশে। তিনি তাঁর ঘরকে মুসলিমদের প্রশিক্ষণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। নবুয়্যতের ৫ম বছর থেকে এখানে ইসলামের গোপন সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মদ সা. ও অন্যান্য সাহাবীরা গোপনে এখানে মিলিত হতেন ও মিটিং করতেন। এখানেই মুসলিমদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হতো।

ইসলাম প্রচারের সূচনা থেকেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. মানব জাতির মহান শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং ইসলামী শিক্ষার নিয়মনীতি প্রবর্তন করেন। তিনি নবুয়ত লাভের পর কাবাকে প্রথম শিক্ষায়তন হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। পরে তিনি মক্কা নগরীর সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আরকাম বিন আবুল আরকামের বাড়িতে ‘দারুল আরকাম’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

দারুল আরকামই ইসলামের প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাসূলুল্লাহ সা. নিজে এখানে শিক্ষা দানে নিয়োজিত ছিলেন। আবু বকর সিদ্দিক রা., হজরত উমর ইবনে খাত্তাব রা., হজরত উসমান ইবনে আফফান রা., হজরত আলী ইবনে আবি তালিবসহ রা.সহ প্রথম শ্রেণীর সাহাবায়ে কেরাম এখানকার উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন। মদিনায় হিজরতের আগে আকাবার শপথের মাধ্যমে যারা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তাদের প্রশিক্ষিত করতে তিনি হজরত মুসআব ইবনে উমাইরকে মদিনায় পাঠান। মহানবী সা.-এর হিজরতের সময় দারুল আরকামে শিক্ষাদানের জন্য হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম ও মুসআব ইবনে উমাইরের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। হিজরতের পর মক্কায় অবশিষ্ট মুসলমানদের মধ্যে দারুল আরকামের মাধ্যমেই দাওয়াতে ইসলামের কর্মকাণ্ড জারি রাখা হয়। এর মানে রাসূল সা. হিজরত করলেও দারুল আরকামের অফিস ও মাদ্রাসা তিনি ক্লোজ করেন নি।

মক্কার এই বেসরকারি ও গোপন সেন্টার থেকে শুরু করে ইসলামের প্রশিক্ষণের নিমিত্তে আল্লাহর রাসূল সা. হিজরতের পর মদিনায় অনেকগুলো তারবিয়াতী সেন্টার তৈরি করেন। মদিনার তারবিয়াতি সেন্টারগুলো প্রকাশ্য ও সরকারি তত্ত্বাবধানে। তবে দারুল আরকামের শিক্ষার্থীরাই ছিলেন আল্লাহর রাসূল সা.-এর বেশি প্রিয় ও উঁচু মর্যাদার সাহাবী। ইসলামের জন্য যারা ত্যাগ-কুরবানীর নজির বেশি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন ও ইসলামকে যারা নিজের মধ্যে ও সমাজে ভালোভাবে কায়েম করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরাই দারুল আরকামের ছাত্র।

মুহাম্মদ সা.-এর তারবিয়াতী মিশন সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সেই পবিত্র সত্ত্বা। যিনি নিরক্ষর লোকদের মধ্য থেকে একজনকে নবী করে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদেরকে তার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন, তাদেরকে পবিত্র করবেন, তাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও প্রজ্ঞা। যদিও ইতোপূর্বে তারা ভ্রান্তিতে (অজ্ঞতায়) মগ্ন ছিলো। ’ (সূরা জুমআ- ০২)

রাসূল সা. নিজেই বলেন, ‘নিশ্চয় আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। (সুনানে ইবনে মাজাহ - ২২৯)

মুয়াবিয়া রা. বলেন, ‘তার জন্য আমার বাবা ও মা উৎসর্গিত হোক। আমি তার পূর্বে ও পরে তার চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি। ’ -সহিহ মুসলিম
রাসূলুল্লাহ সা. পাঠদানের সময় থেমে থেমে কথা বলতেন। যেন তা গ্রহণ করা শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। খুব দ্রুত কথা বলতেন না যেনো শিক্ষার্থীরা ঠিক বুঝে উঠতে না পারে আবার এতো ধীরেও বলতেন না যাতে কথার ছন্দ হারিয়ে যায়। বরং তিনি মধ্যম গতিতে থেমে থেমে পাঠ দান করতেন।

রাসূলুল্লাহ সা. কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে, তার দেহাবয়বেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হতো। তিনি দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠ দান করতেন। কারণ, এতে বিষয়ের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রোতা শিক্ষার্থীগণ সঠিক ধারণা লাভে সক্ষম হয় এবং বিষয়টি তার অন্তরে গেঁথে যায়। যেমন, তিনি যখন জান্নাতের কথা বলতেন, তখন তার দেহে আনন্দের স্ফূরণ দেখা যেতো। জাহান্নামের কথা বললে ভয়ে চেহারার রঙ বদলে যেতো। যখন কোনো অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে বলতেন, তার চেহারায় ক্রোধ প্রকাশ পেতো এবং কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেতো। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সা. যখন বক্তব্য দিতেন- তার চোখ লাল হয়ে যেতো, আওয়াজ উঁচু হতো এবং ক্রোধ বৃদ্ধি পেতো। যেনো তিনি (শত্রু) সেনা সম্পর্কে সতর্ককারী। ’ -সহিহ মুসলিম : ৪৩

শিক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষককে অনেক সময় গল্প-ইতিহাস বলতে হয়। রাসূল সা.ও পাঠদানের সময় গল্প বলতেন। তিনি গল্প বলতেন অত্যন্ত মিষ্টি করে। এমন মিষ্টি ভঙ্গি গল্প-ইতিহাস স্বপ্রাণ হয়ে উঠতো। জীবন্ত হয়ে উঠতো শ্রোতা-শিক্ষার্থীর সামনে। হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি (মুগ্ধ হয়ে) রাসূল সা.-এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি আমাকে শিশুদের কাজ সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি তার মুখে আঙুল রাখলেন। এবং তাতে চুমু খেলেন। ’অর্থাৎ তিনি শিশুদের মতো ঠোঁট গোল করে তাতে আঙুল ঠেকালেন। -মুসনাদে আহমদ : ৮০৭১

রাসূল সা. পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের নিকট প্রশ্ন করতেন। যেনো তারা প্রশ্ন করতে এবং তার উত্তর খুঁজতে অভ্যস্ত হয়। কেননা নিত্যনতুন প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে নিত্যনতুন জ্ঞান অনুসন্ধানে উৎসাহী করে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করেন, হে মুয়াজ! তুমি কী জানো বান্দার নিকট আল্লাহর অধিকার কী? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। রাসূল সা. বলেন, তার ইবাদত করা এবং তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করা।’ -সহিহ বোখারি : ৭৩৭৩

নবী করিম সা. অনেক সময় কোনো বিষয় স্পষ্ট করার জন্য উপমা ও উদাহরণ পেশ করতেন। কেননা উপমা ও উদাহরণ দিলে যে কোনো বিষয় বোঝা সহজ হয়ে যায়। হজরত সাহাল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ও এতিমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করবো। হজরত সাহাল (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) তার শাহাদত ও মধ্যমা আঙুলের প্রতি ইঙ্গিত করেন।’ (সহিহ বোখারি : ৬০০৫) এরকম বহু হাদিস আছে। যেমন তাকওয়া অন্তরে থাকে এটা বুঝাতে তিনি অন্তরের দিকে ইঙ্গিত করেন।

শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো প্রাক্টিক্যাল বা প্রয়োগিক শিক্ষা। রাসূল সা. অধিকাংশ বিষয় নিজে আমল করে সাহাবিদের শেখাতেন। শেখাতেন হাতে-কলমে। এজন্য হজরত আয়েশা রা. বলেন, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো কোরআন। রাসূল সা. বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় কর, যেমন আমাকে আদায় করতে দেখো। ’ -সুনানে বায়হাকি : ৩৬৭২

মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার একটি সহজ উপায় হলো- মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলা। রাসূল সা. বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষাদান করেছেন। যেমন- এক যুবক রাসূল সা. কে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। তার কথা শুনে উপস্থিত লোকেরা মারমুখি হয়ে উঠলো এবং তিরস্কার করলো। রাসূল সা. তাকে কাছে ডেকে নিলেন এবং বললেন, তুমি কী তোমার মায়ের ব্যাপারে এমনটি পছন্দ কর? সে বললো, আল্লাহর শপথ না। আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গিত করুন। রাসূল সা. বললেন, কেউ তার মায়ের ব্যাপারে এমন পছন্দ করে না। এরপর রাসূল সা. একে একে তার সব নিকট নারী আত্মীয়ের কথা উল্লেখ করেন এবং সে না উত্তর দেয়। এভাবে রাসূল সা. তার বিবেক জাগ্রত করে তোলেন। -মুসনাদে আহমদ : ২২২১১

কখনো কখনো কোনো বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য রাসূল সা. রেখাচিত্র ও অঙ্কনের সাহায্য নিতেন। যেন শ্রোতা ও শিক্ষার্থীর সেটা বুঝতে সহজ হয়। হজরত আবু মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সা. একটি চারকোণা দাগ দিলেন। তার মাঝ বরাবর দাগ দিলেন। যা তা থেকে বের হয়ে গেছে। বের হয়ে যাওয়া দাগটির পাশে এবং চতুষ্কোণের ভেতরে ছোট ছোট কিছু দাগ দিলেন। তিনি বললেন, এটি মানুষ। চতুষ্কোণের ভেতরের অংশ তার জীবন এবং দাগের যে অংশ বের হয়ে গেছে সেটি তার আশা। ’ (সহিহ বোখারি : ৬৪১৭) এভাবে রাসূল সা. রেখাচিত্রের সাহায্যে মানুষের জীবন ও জীবনের সীমাবদ্ধতার বিষয় স্পষ্ট করে তুললেন।

রাসূলে আকরাম সা. শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের অনাগত জীবন সম্পর্কে যেমন আশাবাদী করে তুলতেন, তেমনি তার চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন। যেমন- হজরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সা. একটি ভাষণ দিলেন। আমি এমন ভাষণ আর শুনিনি। তিনি বলেন, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে অল্প হাসতে এবং বেশি কাঁদতে। ’ (সহিহ বোখারি : ৪৬২১) হজরত আবু জর গিফারি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ বললো এবং তার ওপর মৃত্যুবরণ করলো, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, যদি সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে? রাসূল সা. বলেন, হ্যাঁ। যদি সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে।’ (সহিহ বোখারি : ৫৪২৭)

রাসূলুল্লাহ সা. ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন। হজরত আবু মাসউদ আনসারি রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট অভিযোগ করে যে, হে আল্লাহর রাসূল! আমি নামাজে অংশগ্রহণ করতে পারি না। কারণ অমুক ব্যক্তি নামাজ দীর্ঘায়িত করে ফেলে। তখন রাসূল সা. বলেন, ‘হে লোক সকল! নিশ্চয়ই তোমরা অনীহা সৃষ্টিকারী। সুতরাং যে মানুষ নিয়ে (জামাতে) নামাজ পড়াবে, সে তা যেনো হাল্কা করে (দীর্ঘ না করে)। কেননা তাদের মধ্যে অসুস্থ্য, দুর্বল ও জুল-হাজাহ (ব্যস্ত) মানুষ রয়েছে। (সহিহ বোখারি : ৯০)

গুরুতর অপরাধের জন্য রাসূলুল্লাহ সা. কখনো তার শিষ্য ও শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদান করে সংশোধন করতেন। তবে রাসূল সা. অধিকাংশ সময় শারীরিক শাস্তি এড়িয়ে যেতেন। ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন। যেমন উপযুক্ত কারণ ব্যতীত তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় হজরত কাব ইবনে মালেক রা.-সহ তিনজনের সঙ্গে রাসূল সা. কথা বলা বন্ধ করে দেন। যা শারীরিক শাস্তির তুলনায় অনেক বেশি ফলপ্রসূ ছিলো।

রাসূল সা. বেদুইন একটি জাতিকে তার কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করান। তার শিক্ষা ও সাফল্য শুধু ইহকালীন সাফল্য বয়ে আনেনি বরং তার পরিব্যপ্তি ছিলো পরকালীন জীবন পর্যন্ত। দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাসূল সা.-এর তারবিয়াতী মিশন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। আমরা যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি তার সম্পর্কে যদি আমাদের পূর্ণ জ্ঞান না থাকে তবে কীভাবে আমরা সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবো? এজন্য ইকামাতে দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার হলো তারবিয়াত বা প্রশিক্ষণ।